শিক্ষানীতি : ফিরে দেখা, সামনে চাওয়া

আমাদের মধ্যে এমন ছেলেমেয়ে বোধহয় খুব কমই আছে, আশি আর নব্বইয়ের দশকে যারা গণতন্ত্রের জন্যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি। হয়তো আমাদের অনেকেই কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না; কিন্তু তারপরও আমাদের একটি সংগঠন ছিল : ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা দাবির মধ্যে একটি অন্যতম দাবি ছিল : একমুখী, সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
এই শিক্ষানীতি কেমন হবে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিতর্কও ছিল। ড. কুদরত-ই খুদার শিক্ষানীতি নিয়েও ভিন্নমত ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু তারপরও মোটা দাগে আমরা চেয়েছিলাম এমন এক শিক্ষানীতি যা প্রাথমিক স্তর থেকেই একমুখী, সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রচলন ঘটাবে।
এই শিক্ষানীতির আকাঙ্ক্ষায় আমাদের অনেকে রাজপথেই শহীদ হয়েছেন, আমরা আমাদের সঙ্গীর লাশ কাঁধে বয়েছি, আমাদের আকাঙ্ক্ষা ও শপথ আরও তীব্রতর হয়েছে। একসময় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের প্রথানুগত শিক্ষা জীবন শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষা এখনও পূরিত হয়নি।
এসবই পুরানো কাসুন্দি। কিন্তু কী করব বলুন? লোককথা বলে, অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যু ঘটলে মানুষ ভূত হয়ে যায়; অতৃপ্তি নিয়ে আমাদের শিক্ষাজীবন ফুরিয়ে গেছে, আমরা বেঁচে আছি ভূতের মতো।
এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। ওই শিক্ষানীতি ওয়েবসাইটেও দেয়া আছে, যাতে সবাই মতামত দিতে পারেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, দেখি-দেখি করেও তা দেখা হয়নি।
এবং দেখার আগেই এখন পত্রপত্রিকা থেকে জানতে পারছি, মৌলবাদীরা বলছে, এই শিক্ষানীতি নীতি নাকি মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। এই শিক্ষানীতি নাকি শিশুদের ধর্মশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে, নৈতিকতাহীন করে তুলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আশি আর নব্বইয়ের দশকে বছরের পর বছর আমরা শ্লোগান দিয়েছি, ‘একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি চালু কর’, ‘সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি চালু কর’। শিক্ষাঙ্গনে পাত্তা না পেলেও এই মৌলবাদীরা তখন আন্দোলনের নামে বড় বড় দলগুলির পিছু-পিছু ছুটোছুটি করেছে আর আমাদের সঙ্গীদের সময়-সুযোগমতো হত্যা করেছে, হাতপায়ের রগ কেটে দিয়েছে, ড্রিলিং মেশিন দিয়ে শরীর ফুটো করেছে।
একবার আমি ভার্সিটিতে দেখেছিলাম, পেয়ারাওয়ালার কাছ থেকে পেয়ারা নিয়ে এক শিবির কর্মী সেটি টুকরো করার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর তার সঙ্গী তাকে বলছে, ‘এই পেয়ারা ঠিকমতো কাটতে পারিস না, কম্যুনিস্টদের কাটবি কেমন করে?’
এখন এই মৌলবাদীরাই কি না নৈতিকতার জন্যে আহাজারি করছে! তারা বলছে, নৈতিকতা আর ধর্মশিক্ষা উঠে যাবে নতুন শিক্ষানীতি চালু হলে!
হয়তো এ শিক্ষানীতি নিয়ে আমাদেরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভিন্নমত রয়েছে; কিন্তু মৌলবাদীরা যে-সব কথা বলে বেড়াচ্ছে, যে-ভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা থেকে স্পষ্ট যে, শিক্ষানীতিতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এমন কিছু-কিছু আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, যা এই মৌলবাদীদের ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এবং যুদ্ধাপরাধী নিজামী তো কয়েকদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে খুব স্পষ্ট করেই বলেছে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
সত্য হলো, আমাদের এই সময়ে ধর্মশিক্ষা আর নৈতিকতার শিক্ষা ক্রমশই আলাদা হয়ে পড়ছে এবং নিজামী-গোত্রীয় মানুষদের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ অতীতকালের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ধর্মশিক্ষা আর নৈতিকতার শিক্ষা যদি একই রকম হতো তা হলে একাত্তরে ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতিকদের নেতৃত্বে কয়েকটি দল গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো সবচেয়ে নিন্দিত নৈতিকতাহীন জঘন্য কাজগুলি করতে পারত না, এ ধরণের কাজে সমর্থন যোগাতে পারত না।
তারা তখন সমর্থন যুগিয়েছে এবং এখনও যোগাচ্ছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতক ও ধর্ষকদের পাশেও দাঁড়িয়েছিল এই মৌলবাদীরা। ধর্মচিন্তা সক্রিয় থাকলেও তাদের নৈতিকতা তখন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রীয় ছিল।
কাজেই নৈতিকতাকে নৈতিকতার গুণেই বলিয়ান করে তুলতে আমরা চাই এমন একটি একমুখী, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাপদ্ধতি,- যাতে গতানুগতিক ও একক কোনও ধর্মশিক্ষা মুখ্য হয়ে দেখা দেবে না। আমরা জানি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি খুব বেশি বিকশিত না হওয়ায় অতীতে ধর্ম প্রত্যক্ষভাবে সমাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে; সেই ধারাবাহিকতায় যে-সব নৈতিকতা মানবধর্ম বিকাশের অনুকুল ছিল, নিশ্চয়ই নতুন শিক্ষাপদ্ধতিতেও সেগুলি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু নৈতিকতা যে আলাদা শক্তি, তা যে বিজ্ঞান ও সামাজিক-জ্ঞানভিত্তিক, এই চরম সত্য আমাদের সবাইকে ধারণ করতে হবে।
নব্বইয়ের পর, মনে হচ্ছে, আমরা সত্যিই ঝিমিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমাদের সেই পুরানো শত্রুরা একদম বসে নেই। ধর্মশিক্ষা আর নৈতিকতা শিক্ষাকে একই পাত্রে ঢেলে তারা জনগণকে গেলাতে চাইছে। যে-মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিজামীরা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় নিজেরাই পাত্তা দেয়নি, এখন তাদের সেই শিক্ষার জন্যে কত মায়া, কত ভালবাসা! এত মায়া-ভালোবাসার কারণ, ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত তারা এবং সেই কাজটি আবারও করতে চাইছে তারা। তাদের পক্ষ থেকে কেবল সংবাদ সম্মেলনেই নয়, গ্রামে-গ্রামেও প্রচার চালানো হচ্ছে যে, ‘প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা তুলে দেয়া হবে’। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষাপদ্ধতি থেকে প্রমাণিত হয়েছে, ললিতকলা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে শিশুর প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে; কিন্তু এই মৌলবাদীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, ধর্মহীন শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এরকম করা হচ্ছে।
জামাতচক্র খুব সংঘবদ্ধভাবেই নেমেছে এ অপপ্রচারে। সংবাদসম্মেলনে নিজামীদের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, শিক্ষানীতি সম্পর্কে ওয়েবসাইটে মত দেয়ার জন্যে তো আহ্বান জানানো হয়েছিল, আপনারা কি মত দিয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা একেকরকম কথা বলেছে। একবার বলেছে, আমাদের মত যে ওয়েবসাইটে গোপন করা হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? আবার বলেছে, আমরা আপনাদের মাধ্যমে জানাচ্ছি। আবার বলেছে, ঠিক আছে, এই বক্তব্য ওয়েবসাইটে যাবে।
এক সাংবাদিক বন্ধু আশঙ্কিত, তারা সত্যিই ওয়েবসাইটটিতে হানা দেবে এবং তাদের সংঘবদ্ধ কর্মীবাহিনীদের মন্তব্যের পর মন্তব্যে সাইটটিকে স্থবির করে ফেলবে। আর সে জন্যেই না কি জনগণের মতামত নেয়ার জন্যে নিজামী সময়সীমা আরও দু সপ্তাহ বাড়াতে বলেছেন।
এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না, কেননা শিবির ‘প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষানীতি : আমাদের বক্তব্য’ নামের একটি প্রচারপত্র ইংরেজি, আরবি আর বাংলা ভাষায় ছাপিয়ে মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন দূতাবাসগুলিতেও ধর্না দিচ্ছে এবং এবার আর তাদের মনে হচ্ছে না যে এর মধ্যে দিয়ে তারা বিদেশীদের পদলেহনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি জনগণ যাতে বিভ্রান্ত হয় সে-জন্যে তারা বঙ্গবন্ধু বলতে শুরু করেছে, জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করেছে! মিথ্যাবাদী রাখালরা এখন বলছে, ‘যা হয়েছে, তা তো পজিটিভই, তাই না?’
আমি আগেই বলেছি, হয়তো এই শিক্ষানীতি নিয়েও আমাদের অনেকের অনেক ভিন্নমত, অনেক সংযোজন-বিয়োজনমূলক বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু এসব ভিন্নমতের পরেও এই দাতালো শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে এক হতে হবে। শরীফ শিক্ষাকমিশনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে একটি সার্বজনীন, একমুখী, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতির জন্যে যে-আকাঙ্ক্ষা বিচ্ছুরিত হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষাকে নতুন করে উর্ধ্বে তুলে ধরতে না পারলে এবার আমাদের আকাঙ্ক্ষার চিরমৃত্যু ঘটবে।
কেননা অতীতে শিক্ষানীতির জন্যে আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছে মূলত সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে, কিন্তু এবার করতে হচ্ছে মূলত মৌলবাদের বিরুদ্ধে। সামরিকতন্ত্রও তাদের শিক্ষানীতিতে মৌলবাদকে সংযোজন করতে চেয়েছে, কিন্তু আন্দোলন করে আমরা এবং আমাদের পূর্বসূরিরা সে-সব শিক্ষানীতি বাতিল করাতে সামরিক জান্তাকে বাধ্য করেছে। এখন সামরিকতন্ত্র নেই, তাই মৌলবাদীরা চেষ্টা চালাচ্ছে গণতান্ত্রিকতার পিঠে সওয়ার হয়ে মৌলবাদী শিক্ষাপদ্ধতিকে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষার নামে গেলাতে।
আমরা যারা মাঝেমধ্যেই পিছু ফিরে তাকাই, বর্তমানের এই বিবর থেকে উঠে সামনেও যেতে চাই, যাদের এখনও হঠাৎ মধ্যরাতে প্রিয় বন্ধুর রক্তঝরার স্মৃতি অপরাধী করে তোলে, তাদের সবার প্রতি একটাই অনুরোধ : আসুন, সময় কখনোই শেষ হয় না, এখনও সময় আছে, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং এমন এক শিক্ষানীতির সূচনা করি আমাদের ভবিষ্যতকে সুস্পষ্ট করে তুলবে এবং আমাদের অতৃপ্ত অতীতও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

17 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
17
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.