সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আলোকে আইসিএসএফ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে, কিছু মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সাধনের উদ্দেশ্যে, এবং সামাজিক সম্প্রীতিপূর্ণ বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে সোচ্চার ও তৎপর। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের আড়ালে জামায়াত ইসলামী সহ এই দুষ্টচক্র সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের মহান স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও নারী জাগরণের উন্মেষ রোধে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আরো লক্ষ করছি যে, সরকার এসব ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠীকে সঠিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
আমরা হেজাফতে ইসলাম সহ এই জাতীয় দলগুলোর তথাকথিত লংমার্চ এবং হরতাল কর্মসূচির নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিথযশা নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ও শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চে অবস্থানরত তরুণদের উপর সুপরিকল্পিত হামলা ও আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে নগ্ন আক্রমণ। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন সময়ে যখন আপামর জনসাধারণ ১৯৭১-এ সংঘটিত যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচারের জন্য ঐক্যবদ্ধ, সেই সময়ে একটি চিহ্নিত মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে এ-ধরনের হিংসাত্মক আক্রমণ আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করবে।
আমরা জানি, এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে জনাব শাহরিয়ার কবির এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতো ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা অনন্যসাধারণ। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশরত অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের উপর এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশের উপর হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের আক্রমণ প্রমাণ করে যে উগ্র মৌলবাদী শক্তির কাছ থেকে আমরা কেউই নিরাপদ নই। এই আক্রমণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর বলেই আইসিএসএফ মনে করে।
দ্বিতীয়ত, পেশাগত দায়িত্বে নিয়োজিত নারী সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ আমাদের উদার, প্রগতিশীল, এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে এ-ধরনের মধ্যযুগীয় নৃশংসতা অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। সাহসী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন সহ সকল সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা বাংলাদেশে মুক্তভাবে তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, আইসিএসএফ এই প্রত্যাশা করে। এই ঘৃণ্য আক্রমণ চলতে দেওয়া নারীমুক্তি ও একটি সুষম সমাজের বিকাশে অন্তরায়। বাংলাদেশের নারীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্র এ-দেশকে একটি পশ্চাৎমুখী সমাজব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করব আগামী দিনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুরুষ ও নারীর সমঅধিকারের ভিত্তিতে একটি সুষম সমাজের বিনির্মাণে বাধা প্রদানকারী কুচক্রীদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করা হবে। সেইসঙ্গে আমরা ঘটনার সময়ে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বহীন আচরণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।
তৃতীয়ত, আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে লক্ষ করছি যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজকেও সাম্প্রতিক সময়ে হুমকি ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দুই দফায় তাঁর বাসায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলেছে এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের নানান ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আইসিএসএফ মনে করে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই বিচারের সঙ্গে জড়িত সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত চলমান একটি প্রক্রিয়া। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু একটি গণদাবি নয়, এটি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের একটি পবিত্র দায়িত্ব। এই তাৎপর্যপূর্ণ কাজে যাঁরা নিয়োজিত আছেন তাঁদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
চতুর্থত, ধর্মীয় অনুভূতিকে হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলামের মঞ্চ থেকে মুক্তচিন্তা চর্চাকারী ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে বিদ্বেষপূর্ণ আর উস্কানিমূলক মন্তব্য এবং ব্লগারদের ‘নাস্তিক’ হিসেবে অভিহিত করে তাঁদের ফাঁসির দাবি একটি গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য হতে পারে না। আইসিএএসএফ হেফাজতে ইসলামের এই অবস্থানকে তীব্রভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে এবং মনে করছে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই বাংলাদেশে সকল ধরনের মুক্তচিন্তার চর্চা হুমকির সম্মুখীন হবে। সেইসঙ্গে, সরকার কর্তৃক চার প্রগতিশীল ব্লগারের গ্রেফতারের ঘটনায় আইসিএসএফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং অনতিবিলম্বে তাঁদের সসম্মানে মুক্তির দাবি জানাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সরকারের দায়িত্বশীল মহল সাংবাদিক এবং মুক্তিযদ্ধের পক্ষের সকল ব্যক্তি ও সংগঠনের নিরাপত্তা বিধানে ভবিষ্যতে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
আইসিএসএফ বিশ্বব্যাপী ১৩টি ভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে ২০০৯ সালে গঠিত একটি ফোরাম, যারা ১৯৭১ সালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান, আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৭১ সালে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্যে ন্যাযবিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়। এই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং সম্মিলিত আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে আইসিএসএফ মনে করে।
নিবেদনক্রমে,
আইসিএসএফ
লন্ডন, যুক্তরাজ্য
৮ এপ্রিল ২০১৩
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF)
১৯৭১ এ সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের বিচারের মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিরসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত স্বাধীন বিশেষজ্ঞ, কর্মী এবং সংগঠনসমূহের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF)। বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ, অনুশীলন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যেই এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠা। এই সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এবং এর বিভিন্ন অঙ্গসমূহকে দালিলিক, আর্কাইভ এবং গবেষণা সহায়তা প্রদান করা ছাড়াও ট্রাইবুনালের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং দফতরসমূহের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, মতামত এবং পরামর্শ বিনিময়, এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণ এই নেটওয়ার্কের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের অংশ। আইসিএসএফ এর কার্যক্রম, এর প্রকল্পসমূহ, এর সাংগঠনিক ইউনিটসমূহ এবং সাংগঠনিক নীতিমালাসমূহ সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানতে ঘুরে আসুন: http://icsforum.org