(তওবা করলে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না – শরিয়া আইন)
নিজামী গং বরাবরই বলেন – জাতিকে নাকি বিভক্ত করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী-বিচারের বাতাস বইবার সাথে সাথে তাঁরা ওটা যত্রতত্র উচ্চকন্ঠে বলে বেড়াচ্ছেন। জাতির ঐক্যের খাতিরে নাকি গণহত্যা-গণধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার শিকেয় তুলে রাখা দরকার। লক্ষ ধর্ষিতাদের সাথে ও লক্ষ নিহতদের কোটি কোটি স্বজনদের সাথে গণহত্যাকারী ও গণধর্ষণকারীদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা নাকি খুবই দরকার।
জনাব নিজামী, কিছু স্পষ্ট কথা আপনার মাথায় না ঢুকুক কানে ঢালা প্রয়োজন। নষ্ট রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আর জাতির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া’র মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। আজ বিপদে পড়ে ঐক্যের কথা বলছেন, জাতিকে বিভক্ত কে করেছে রক্তরেখায়? আপনাদের আর জাতির মাঝখানে লক্ষ লাশ লক্ষ ধর্ষিতার হিমালয় কে তুলেছে? আপনারাই তুলেছেন, আমরা নই। সে হিমালয় আজো দাঁড়িয়ে আছে রক্তস্বাক্ষরে। পরাক্রমশালী বিদেশী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে আপনারা আমাদের সাথে ঐক্য করলে আমাদের শক্তি আর মনোবল অনেক বাড়তো। কিন্তু আপনারা বাংলায় জন্মে বাঙ্গালীর সঙ্গে ঐক্য না করে বাঙ্গালীরই বিরুদ্ধে খোলাখুলি জিহাদ ঘোষণা করলেন, অস্ত্র ধরলেন। জাতির ওপরে বিদেশীদের গণহত্যা-গণধর্ষণে শরিক হওয়াকে ইবাদত মনে করলেন এবং প্রাণপনে সে ‘‘ইবাদত’’ করলেন-ও। আপনাদের সক্রিয় সমর্থন নাপাক পিশাচদের শক্তি ও মনোবল অনেক বাড়িয়েছিল, আপনাদের সাহায্য না পেলে অনেক বাঙ্গালী বেঁচে যেত অনেক বাঙ্গালিনী ধর্ষিতা হতো না। এতসবের পর কিভাবে আমরা আপনাদের সাথে ঐক্য করি? আটত্রিশ বছর কেটে গেছে আপনারা সে অপরাধের জন্য আল্লা-রসুলের কাছে আর নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা তো চানইনি বরং সগর্বে বলেছেন – ‘‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’’।
করেছেন। মিসটেক নয়, ব্লান্ডার করেছেন। ভুল-ও করেছেন, অপরাধও করেছেন। কেন করেছেন জাতি জানে। ঐক্য যে করবেন, করবেন-টা কার সাথে? এ জাতি কখন আপনার নিজের জাতি ছিল? কখনোই না। এ জাতির সংস্কৃতি কবে আপনার সংস্কৃতি ছিল? কখনোই না। এ জাতির মরমীয়া ইসলাম কবে আপনাদের ইসলাম ছিল? কখনোই না। জাতির হাজার বছরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যে ঘুন ধরিয়ে ইসলামের হিংস্র ব্যাখ্যা আমদানী কে করেছে? আপনারাই করেছেন। তাই আপনারা যতনা বাঙ্গালী হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন পাকিস্তানি। যতনা মুসলমান হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন আরবী। তাই আগ্রহ আর উল্লাসের সাথে নিজের আত্মপরিচয়কে, স্বজাতির রক্ত আর নারীর সম্ভ্রমকে বিদেশীর পায়ে অর্ঘ্য দিয়েছেন। ধর্মীয় উন্মাদনা কতখানি উদগ্র হলে মানুষ এমন করে তা জাতি ঠিকই বোঝে। আপনাদের কম্পাসের কাঁটা সর্বদাই পাকিস্তান আর মধ্যপ্রাচ্য-মুখী হয়ে থাকে, জাতির বিরুদ্ধে ঐক্য তো আপনারা ওদের সাথে করেছেন।
কিছু মানুষ চিরকালই হিংস্র কসাই থাকবে। কিন্তু আমাদের কষ্টটা হচ্ছে এই যে আপনারা এটা করেছেন ইসলামের নামে। ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়ে শরিয়া আইন চালাতে চান। জাতির জানা দরকার একাত্তরের কসাইপনা ও কুকর্মের কি ব্যবস্থা শারিয়া আইনে আপনারা আগে থেকেই করে রেখেছেন, উদ্ধৃতি :
‘‘হিরাবা’র অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তওবা করিলেও শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে না – হিরাবার অপরাধের শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোন শাস্তি বাতিল করে না’’ – শরিয়া আইন নং ১৩, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২১৮ ও ২২২।
সুষ্পষ্ট আইন। অর্থাৎ হিরাবা’র অপরাধীরা তওবা করলে ‘‘শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে’’। হিরাবা কি? আবার উদ্ধৃতি দিচ্ছি আপনাদেরই ওই শরিয়া কেতাব থেকে :
‘‘হিরাবাহ্ বলিতে সংঘবদ্ধ শক্তির জোরে আক্রমণ চালাইয়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাইয়া জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বোঝায়। সম্পদ লুন্ঠন, শ্লীলতাহানী, হত্যা ও রক্তপাত ইহাতে অন্তর্ভুক্ত’’।
হল? ইসলামের নামে ইসলামের প্রতি এই ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা কে করেছে? আপনারা-ই করেছেন। এমন অজস্র আইন বানিয়েছেন আপনারা ইসলামের নামে। তরুণরা পড়ে না – কিছু তরুণ আপনাদের বিশ্বাস করে সমর্থন করে। ওই তরুণরা, কিংবা পরের প্রজন্ম যেদিন জানবে কি নিষ্ঠুরভাবে ওদের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ওদের আপনারা ঠকিয়েছেন সেদিন ওরাই আপনাদের গলা চেপে ধরবে। আইনটা বিশ্বাস হচ্ছে না? ইমেইল ঠিকানা পাঠিয়ে দিন, পৃষ্ঠার ছবি পাঠিয়ে দেব। মনে রাখবেন, তিন খণ্ডের বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন কোন একজনের লেখা নয়, আপনাদেরই ফেইথ-কাজিন ছয়জন পন্ডিতের টিম-এর লেখা – আপনাদেরই তত্ত্বগুরু শাহ আবদুল হান্নান-এর তত্ত্বাবধানে। ওটা কোন ব্যবসায়ি প্রকাশকের লাভের বই নয়, ওটা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন।
আপনারা হত্যাকারী ও ধর্ষকের দল, তা-ও আবার ইসলামের নামে। আমাদের হাজার দোষ থাকতে পারে কিন্তু হত্যাকারী ধর্ষকদের সাথে আমরা বাংলাদেশীরা ঐক্য করি না, ওদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াই।
এই জাতি কোন চাতুরীতে ভুলবে না – যত হও তুমি সুদক্ষ অভিনেতা
লাশের ওজন ধর্মে যাবে না কেনা – যতই ধুর্ত হোক ক্রেতা-বিক্রেতা।
হাসান মাহমুদ, বিজয় দিবস, ৩৯ মুক্তিসন (২০০৯)
হাসান মাহমুদ
শারিয়া আইন বিষয়ক তথ্যচিত্র, নাটক ও গ্রন্থের রচয়িতা। উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস; রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, হল্যান্ড; সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশন; ক্যানাডা প্রতিনিধি, ফ্রি মুসলিম্স্ কোয়ালিশন; প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
অবিশ্রুত - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:২৭ পূর্বাহ্ণ)
এমন শরীয়া আইন সঙ্গে আছে বলেই ধর্মীয় রাজনীতিকদের পক্ষে বলা সম্ভব হয়, একাত্তরে আমরা ভুল করি নাই। শুধু তাই নয়, এমন আইনগত ভিত্তি আছে বলেই তারা বংশবদ অনুসারীও তৈরি করে চলেছে, যারা এদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে।
অনেকে বলতে পারেন, এটি অতীতের একটি আইন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, অতীত হোক আর বর্তমান হোক, এমন একটি মানবতাবিরোধী আইন কীভাবে বৈধ বিবেচিত হতে পারে- তাও তাদের কাছে যারা শান্তির বাণী ছড়ায় বলে অনেকের বিশ্বাস!
নিশ্চয়ই এমন অজস্র শরীয়া আইন খুঁজে পাওয়া যাবে, যা মানবতাবিরোধী, যা ব্যক্তির বিকাশের বিরোধী, যা সমাজের অগ্রগতির বিরোধী। তারপরও সেসব কি আমাদের মানতে হবে, কেবল এই জন্যে যে তা ধর্মে আছে? দূর অতীতে হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ধর্ম এমন অনেক আইনের আশ্বাস দিয়েছিল, যাতে তার অনুসারীদের মনে অনুতাপ না জাগে, বরং জোশ জাগে গায়ের জোরে হলেও ক্ষমতা আয়ত্তে আনার- কিন্তু তাকে ধর্মীয়ভাবে, আত্মিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে অন্যায় বলে মনে করে না বলেই জামায়াত এখনও মিথ্যাচার করে চলেছে। আর তাদের কথিত রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে এগিয়ে আসছে একই পদের আরও কিছু দল যারা খিলাফত চায়, শরীয়া আইনের বাস্তবায়ন চায়।
এরপরও যারা খিলাফতের স্বপ্ন দেখেন, শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাদের করুণা ছাড়া আর কি-ইবা করার আছে!
তানবীরা - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:০৪ পূর্বাহ্ণ)
নিজামী তথা জামাত শিবিরের ইদানীং কালের কথাবার্তায় আমি খুব মজা পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছে ভীষন ভয় তাই যা নয় তা উলটো পালটা বকে যাচ্ছে। মাথা খারাপ হয়ে আছে বাছাধনদের।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (২:৪০ পূর্বাহ্ণ)
“নিশ্চয়ই এমন অজস্র শরীয়া আইন খুঁজে পাওয়া যাবে, যা মানবতাবিরোধী, যা ব্যক্তির বিকাশের বিরোধী, যা সমাজের অগ্রগতির বিরোধী। তারপরও সেসব কি আমাদের মানতে হবে, কেবল এই জন্যে যে তা ধর্মে আছে? দূর অতীতে হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ধর্ম এমন অনেক আইনের আশ্বাস দিয়েছিল, যাতে তার অনুসারীদের মনে অনুতাপ না জাগে, বরং জোশ জাগে গায়ের জোরে হলেও ক্ষমতা আয়ত্তে আনার”
আমি সম্পূর্ণ একমত। সম্ভবতঃ ‘ভাবনাচিন্তা’ বইয়ে মৈত্রেয়ী দেবী এক মুসলমান মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ” ১৪০০ বছর আগে যদি বলে না যেতো কেউ, তাহলে কি আপনারা একে অন্যায় বলতেন না?” ভদ্রমহিলা কোরআন এ নারীর উপর নির্যাতন না করার বিষয়ে যা বলা আছে তা থেকে উদ্ধৃতি দিতেই মৈত্রেয়ী দেবী এ প্রশ্ন করেছিলেন।
ওল্ড টেস্টামেন্ট এ কী আছে এই নিয়ে খ্রীস্টানরা কি তাদের রাষ্ট্রীয় আইন তৈরী করে? করেনা নিশ্চয়ই। আমরা কেন আমাদের হিতাহিত বোধ, মূল্যবোধ, শিল্পবোধ সবকিছুকেই বর্গা দিয়ে রেখেছি ধর্মের হাতে? এই মনোবৃত্তির ফোকর গলেই তো এইসব ধর্মব্যবসায়ী খুনিরা পথ করে নেয় আমাদের জীবনে।
বুয়েটে দেখতাম ভাল ভাল ছাত্র্ররা, আইটির রথী-মহারথীরা সব ইসলামী ছাত্রশিবিরের। শিবিরের সদস্যদের ভালো বিয়ে হয় বলে অনেক ইডেন কলেজের মেয়ে-হোম ইকনমিক্স কলেজের মেয়ে দেখতাম শিবির করতো। নিজামীর নিজস্ব স্কুলকলেজ রয়েছে- এইগুলি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে, এসে চলে যাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার, যুদ্ধাপরাধীদের যারা সহায়ক, যারা সহানুভূতিশীল, যারা মোসায়েব, যারা ধ্বজাধারী তাদেরও বিচার হওয়া দরকার। সামাজিকভাবে বয়কট করা দরকার। (আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি গো আযমকে তার অনেক নিকট আত্মীয় বিয়েতেও দাওয়াত দেয়না।) তাতে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হলেও ক্ষতি নাই, বাংলাদেশ নির্লোম কম্বলমুড়ি দিয়ে ভবিষ্যত পাড়ি দেবে।
রেজাউল করিম সুমন - ৩০ অক্টোবর ২০১৪ (১২:০৪ পূর্বাহ্ণ)
২৯ অক্টোবর ২০১৪ : নিজামীর ফাঁসির রায়।