নিজামী, যুদ্ধাপরাধ ও প্রয়োজনমাফিক শরিয়া আইন…

ইসলামের নামে ইসলামের প্রতি ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা কে করেছে? আপনারাই করেছেন নিজামী। অজস্র মনগড়া "শরিয়া আইন" বানিয়ে নিয়েছেন আপনারা ইসলামের নামে নিজেদের গা বাঁচাতে, এমনকি নিজেদের যুদ্ধাপরাধকে জায়েজ করা আইনও। তরুণরা পড়ে না - কিছু তরুণ আপনাদের বিশ্বাস করে সমর্থন করে। ওই তরুণরা একদিন জানবে কি নিষ্ঠুরভাবে ওদের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ওদের আপনারা ঠকিয়েছেন [...]

Book-Cover

(তওবা করলে গণহত্যাকারী গণধর্ষণকারীদের শাস্তি হবে না – শরিয়া আইন)

নিজামী গং বরাবরই বলেন – জাতিকে নাকি বিভক্ত করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী-বিচারের বাতাস বইবার সাথে সাথে তাঁরা ওটা যত্রতত্র উচ্চকন্ঠে বলে বেড়াচ্ছেন। জাতির ঐক্যের খাতিরে নাকি গণহত্যা-গণধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার শিকেয় তুলে রাখা দরকার। লক্ষ ধর্ষিতাদের সাথে ও লক্ষ নিহতদের কোটি কোটি স্বজনদের সাথে গণহত্যাকারী ও গণধর্ষণকারীদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা নাকি খুবই দরকার।

জনাব নিজামী, কিছু স্পষ্ট কথা আপনার মাথায় না ঢুকুক কানে ঢালা প্রয়োজন। নষ্ট রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আর জাতির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া’র মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। আজ বিপদে পড়ে ঐক্যের কথা বলছেন, জাতিকে বিভক্ত কে করেছে রক্তরেখায়? আপনাদের আর জাতির মাঝখানে লক্ষ লাশ লক্ষ ধর্ষিতার হিমালয় কে তুলেছে? আপনারাই তুলেছেন, আমরা নই। সে হিমালয় আজো দাঁড়িয়ে আছে রক্তস্বাক্ষরে। পরাক্রমশালী বিদেশী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সেই জীবন-মরণ যুদ্ধে আপনারা আমাদের সাথে ঐক্য করলে আমাদের শক্তি আর মনোবল অনেক বাড়তো। কিন্তু আপনারা বাংলায় জন্মে বাঙ্গালীর সঙ্গে ঐক্য না করে বাঙ্গালীরই বিরুদ্ধে খোলাখুলি জিহাদ ঘোষণা করলেন, অস্ত্র ধরলেন। জাতির ওপরে বিদেশীদের গণহত্যা-গণধর্ষণে শরিক হওয়াকে ইবাদত মনে করলেন এবং প্রাণপনে সে ‘‘ইবাদত’’ করলেন-ও। আপনাদের সক্রিয় সমর্থন নাপাক পিশাচদের শক্তি ও মনোবল অনেক বাড়িয়েছিল, আপনাদের সাহায্য না পেলে অনেক বাঙ্গালী বেঁচে যেত অনেক বাঙ্গালিনী ধর্ষিতা হতো না। এতসবের পর কিভাবে আমরা আপনাদের সাথে ঐক্য করি? আটত্রিশ বছর কেটে গেছে আপনারা সে অপরাধের জন্য আল্লা-রসুলের কাছে আর নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা তো চানইনি বরং সগর্বে বলেছেন – ‘‘একাত্তরে আমরা ভুল করিনি’’

করেছেন। মিসটেক নয়, ব্লান্ডার করেছেন। ভুল-ও করেছেন, অপরাধও করেছেন। কেন করেছেন জাতি জানে। ঐক্য যে করবেন, করবেন-টা কার সাথে? এ জাতি কখন আপনার নিজের জাতি ছিল? কখনোই না। এ জাতির সংস্কৃতি কবে আপনার সংস্কৃতি ছিল? কখনোই না। এ জাতির মরমীয়া ইসলাম কবে আপনাদের ইসলাম ছিল? কখনোই না। জাতির হাজার বছরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যে ঘুন ধরিয়ে ইসলামের হিংস্র ব্যাখ্যা আমদানী কে করেছে? আপনারাই করেছেন। তাই আপনারা যতনা বাঙ্গালী হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন পাকিস্তানি। যতনা মুসলমান হয়েছেন তার চেয়ে বেশী হয়েছেন আরবী। তাই আগ্রহ আর উল্লাসের সাথে নিজের আত্মপরিচয়কে, স্বজাতির রক্ত আর নারীর সম্ভ্রমকে বিদেশীর পায়ে অর্ঘ্য দিয়েছেন। ধর্মীয় উন্মাদনা কতখানি উদগ্র হলে মানুষ এমন করে তা জাতি ঠিকই বোঝে। আপনাদের কম্পাসের কাঁটা সর্বদাই পাকিস্তান আর মধ্যপ্রাচ্য-মুখী হয়ে থাকে, জাতির বিরুদ্ধে ঐক্য তো আপনারা ওদের সাথে করেছেন।

Book-Page-218

Book-Page-222

কিছু মানুষ চিরকালই হিংস্র কসাই থাকবে। কিন্তু আমাদের কষ্টটা হচ্ছে এই যে আপনারা এটা করেছেন ইসলামের নামে। ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়ে শরিয়া আইন চালাতে চান। জাতির জানা দরকার একাত্তরের কসাইপনা ও কুকর্মের কি ব্যবস্থা শারিয়া আইনে আপনারা আগে থেকেই করে রেখেছেন, উদ্ধৃতি :

‘‘হিরাবা’র অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী তওবা করিলেও শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে না – হিরাবার অপরাধের শাস্তি ব্যতীত তওবা অন্য কোন শাস্তি বাতিল করে না’’শরিয়া আইন নং ১৩, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২১৮ ও ২২২

সুষ্পষ্ট আইন। অর্থাৎ হিরাবা’র অপরাধীরা তওবা করলে ‘‘শাস্তি হইতে রেহাই পাইবে’’। হিরাবা কি? আবার উদ্ধৃতি দিচ্ছি আপনাদেরই ওই শরিয়া কেতাব থেকে :

‘‘হিরাবাহ্‌ বলিতে সংঘবদ্ধ শক্তির জোরে আক্রমণ চালাইয়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাইয়া জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা বোঝায়। সম্পদ লুন্ঠন, শ্লীলতাহানী, হত্যা ও রক্তপাত ইহাতে অন্তর্ভুক্ত’’।

হল? ইসলামের নামে ইসলামের প্রতি এই ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা কে করেছে? আপনারা-ই করেছেন। এমন অজস্র আইন বানিয়েছেন আপনারা ইসলামের নামে। তরুণরা পড়ে না – কিছু তরুণ আপনাদের বিশ্বাস করে সমর্থন করে। ওই তরুণরা, কিংবা পরের প্রজন্ম যেদিন জানবে কি নিষ্ঠুরভাবে ওদের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে ওদের আপনারা ঠকিয়েছেন সেদিন ওরাই আপনাদের গলা চেপে ধরবে। আইনটা বিশ্বাস হচ্ছে না? ইমেইল ঠিকানা পাঠিয়ে দিন, পৃষ্ঠার ছবি পাঠিয়ে দেব। মনে রাখবেন, তিন খণ্ডের বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন কোন একজনের লেখা নয়, আপনাদেরই ফেইথ-কাজিন ছয়জন পন্ডিতের টিম-এর লেখা – আপনাদেরই তত্ত্বগুরু শাহ আবদুল হান্নান-এর তত্ত্বাবধানে। ওটা কোন ব্যবসায়ি প্রকাশকের লাভের বই নয়, ওটা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন।

আপনারা হত্যাকারী ও ধর্ষকের দল, তা-ও আবার ইসলামের নামে। আমাদের হাজার দোষ থাকতে পারে কিন্তু হত্যাকারী ধর্ষকদের সাথে আমরা বাংলাদেশীরা ঐক্য করি না, ওদের বিরুদ্ধেই দাঁড়াই।

এই জাতি কোন চাতুরীতে ভুলবে না – যত হও তুমি সুদক্ষ অভিনেতা
লাশের ওজন ধর্মে যাবে না কেনা – যতই ধুর্ত হোক ক্রেতা-বিক্রেতা।

হাসান মাহমুদ, বিজয় দিবস, ৩৯ মুক্তিসন (২০০৯)

হাসান মাহমুদ

শারিয়া আইন বিষয়ক তথ্যচিত্র, নাটক ও গ্রন্থের রচয়িতা। উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস; রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, হল্যান্ড; সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশন; ক্যানাডা প্রতিনিধি, ফ্রি মুসলিম্‌স্ কোয়ালিশন; প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস।

৪ comments

  1. অবিশ্রুত - ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:২৭ পূর্বাহ্ণ)

    এমন শরীয়া আইন সঙ্গে আছে বলেই ধর্মীয় রাজনীতিকদের পক্ষে বলা সম্ভব হয়, একাত্তরে আমরা ভুল করি নাই। শুধু তাই নয়, এমন আইনগত ভিত্তি আছে বলেই তারা বংশবদ অনুসারীও তৈরি করে চলেছে, যারা এদের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছে।
    অনেকে বলতে পারেন, এটি অতীতের একটি আইন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, অতীত হোক আর বর্তমান হোক, এমন একটি মানবতাবিরোধী আইন কীভাবে বৈধ বিবেচিত হতে পারে- তাও তাদের কাছে যারা শান্তির বাণী ছড়ায় বলে অনেকের বিশ্বাস!
    নিশ্চয়ই এমন অজস্র শরীয়া আইন খুঁজে পাওয়া যাবে, যা মানবতাবিরোধী, যা ব্যক্তির বিকাশের বিরোধী, যা সমাজের অগ্রগতির বিরোধী। তারপরও সেসব কি আমাদের মানতে হবে, কেবল এই জন্যে যে তা ধর্মে আছে? দূর অতীতে হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ধর্ম এমন অনেক আইনের আশ্বাস দিয়েছিল, যাতে তার অনুসারীদের মনে অনুতাপ না জাগে, বরং জোশ জাগে গায়ের জোরে হলেও ক্ষমতা আয়ত্তে আনার- কিন্তু তাকে ধর্মীয়ভাবে, আত্মিকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে অন্যায় বলে মনে করে না বলেই জামায়াত এখনও মিথ্যাচার করে চলেছে। আর তাদের কথিত রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার জন্যে এগিয়ে আসছে একই পদের আরও কিছু দল যারা খিলাফত চায়, শরীয়া আইনের বাস্তবায়ন চায়।
    এরপরও যারা খিলাফতের স্বপ্ন দেখেন, শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তাদের করুণা ছাড়া আর কি-ইবা করার আছে!

  2. তানবীরা - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:০৪ পূর্বাহ্ণ)

    নিজামী তথা জামাত শিবিরের ইদানীং কালের কথাবার্তায় আমি খুব মজা পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছে ভীষন ভয় তাই যা নয় তা উলটো পালটা বকে যাচ্ছে। মাথা খারাপ হয়ে আছে বাছাধনদের।

  3. সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ৬ জানুয়ারি ২০১০ (২:৪০ পূর্বাহ্ণ)

    “নিশ্চয়ই এমন অজস্র শরীয়া আইন খুঁজে পাওয়া যাবে, যা মানবতাবিরোধী, যা ব্যক্তির বিকাশের বিরোধী, যা সমাজের অগ্রগতির বিরোধী। তারপরও সেসব কি আমাদের মানতে হবে, কেবল এই জন্যে যে তা ধর্মে আছে? দূর অতীতে হয়তো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ধর্ম এমন অনেক আইনের আশ্বাস দিয়েছিল, যাতে তার অনুসারীদের মনে অনুতাপ না জাগে, বরং জোশ জাগে গায়ের জোরে হলেও ক্ষমতা আয়ত্তে আনার”
    আমি সম্পূর্ণ একমত। সম্ভবতঃ ‘ভাবনাচিন্তা’ বইয়ে মৈত্রেয়ী দেবী এক মুসলমান মহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ” ১৪০০ বছর আগে যদি বলে না যেতো কেউ, তাহলে কি আপনারা একে অন্যায় বলতেন না?” ভদ্রমহিলা কোরআন এ নারীর উপর নির্যাতন না করার বিষয়ে যা বলা আছে তা থেকে উদ্ধৃতি দিতেই মৈত্রেয়ী দেবী এ প্রশ্ন করেছিলেন।
    ওল্ড টেস্টামেন্ট এ কী আছে এই নিয়ে খ্রীস্টানরা কি তাদের রাষ্ট্রীয় আইন তৈরী করে? করেনা নিশ্চয়ই। আমরা কেন আমাদের হিতাহিত বোধ, মূল্যবোধ, শিল্পবোধ সবকিছুকেই বর্গা দিয়ে রেখেছি ধর্মের হাতে? এই মনোবৃত্তির ফোকর গলেই তো এইসব ধর্মব্যবসায়ী খুনিরা পথ করে নেয় আমাদের জীবনে।
    বুয়েটে দেখতাম ভাল ভাল ছাত্র্ররা, আইটির রথী-মহারথীরা সব ইসলামী ছাত্রশিবিরের। শিবিরের সদস্যদের ভালো বিয়ে হয় বলে অনেক ইডেন কলেজের মেয়ে-হোম ইকনমিক্স কলেজের মেয়ে দেখতাম শিবির করতো। নিজামীর নিজস্ব স্কুলকলেজ রয়েছে- এইগুলি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে, এসে চলে যাচ্ছে।
    যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার, যুদ্ধাপরাধীদের যারা সহায়ক, যারা সহানুভূতিশীল, যারা মোসায়েব, যারা ধ্বজাধারী তাদেরও বিচার হওয়া দরকার। সামাজিকভাবে বয়কট করা দরকার। (আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি গো আযমকে তার অনেক নিকট আত্মীয় বিয়েতেও দাওয়াত দেয়না।) তাতে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হলেও ক্ষতি নাই, বাংলাদেশ নির্লোম কম্বলমুড়ি দিয়ে ভবিষ্যত পাড়ি দেবে।

  4. রেজাউল করিম সুমন - ৩০ অক্টোবর ২০১৪ (১২:০৪ পূর্বাহ্ণ)

    ২৯ অক্টোবর ২০১৪ : নিজামীর ফাঁসির রায়।

    বদরপ্রধান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে

    মুক্তিযুদ্ধকালে যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীকে যেতে হবে ফাঁসিকাষ্ঠে।

    মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।

    মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে তিনি বলেন, “আদালত সম্মত হয়েছে যে, তিনি যে মাত্রায় হত্যা, গণহত্যা ঘটিয়েছেন, তাতে সর্বোচ্চ সাজা না দিলে তা হবে ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা।”

    জামায়াতের আজকের আমির নিজামী চার দশক আগে ছিলেন জামায়াতেরই ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনীর প্রধান।

    স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মামলার রায়ে উঠে এসেছে।

    ট্রাইব্যুনাল বলেছে, বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ নিজামী পবিত্র ধর্ম ইসলামের অপব্যবহার করেন।

    মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

    এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী গণহত্যাসহ চার অভিযোগের প্রত্যেকটিতে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি চারটি অভিযোগে নিজামীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আট অভিযোগে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

    ৭১ বছর বয়সী নিজামী হলেন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করা চতুর্থ রাজনীতিবিদ, আদালত যাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিল। এর আগে চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

    বিগত চার দলীয় জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তার আগে ২০০১-০৩ সময়ে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী।

    বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এমন একজন ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ‘চপেটাঘাত’ ছিল বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

    দণ্ড শুনে জামায়াত আমির উঠে দাঁড়াননি, কোনো কথাও বলেননি। দৃশ্যত বিমর্ষ নিজামীকে শুধু বিচারকের দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাতে দেখা যায়।

    রায় জানার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধা, রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা এবং আসামির জেলা পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস প্রকাশ করে।

    অন্যদিকে রায়ের প্রতিবাদে নিজামীর দল জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা করে তিন দিনের হরতাল। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়।

    এ রায়কে ‘ন্যায়ভ্রষ্ট’ আখ্যায়িত করে নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম আপিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অন্যদিকে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, এই রায়ে ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

    সরকার, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, বিভিন্ন বামদল, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

    রায়ের পর নিজামীকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখান থেকে রাতে তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের পর থেকে তিনি ছিলেন।

    ৮ অভিযোগ প্রমাণিত, ৪ অপরাধে ফাঁসি

    সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়েছে।

    এসব ঘটনার মধ্যে সাঁথিয়ার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা, ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, একজনকে ধর্ষণ, বাড়িঘরে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ; ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।

    রায়ে বলা হয়, শত শত নিরস্ত্র মানুষ, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত এই চার অপরাধ ছিল একাত্তরের বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও নিরস্ত্র মানুষকে গণহত্যা ছিলো ‘ভয়ানক’।

    “এটা মানব সভ্যতার মর্যাদাহানিকর অপরাধ হিসাবে মূল্যায়িত হওয়ার দাবি রাখে।”

    আর অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

    এসব ঘটনার মধ্যে পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে হত্যা; মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প খুলে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা; পাবনার বৃশালিখা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে হত্যা; ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে হত্যার পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

    বাকি আট অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় এসব অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

    রায়ে বলা হয়, একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আল-বদর বাহিনীর প্রধান নিজামী নিজে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় অংশগ্রহণ করেন। বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় নিজামীর ভূমিকা ‘ডি-জুর ও ডি-ফ্যাক্টো’ (প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি)।

    “অভিযুক্ত তার কৃতকর্মের ফল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যায় তিনি আলবদর সদস্যদের উৎসাহ, সত্যায়ন, অনুমোদন এবং নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন।”

    আদালত মনে করে, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা কেবল অপরাধের ভয়াবহতাকেই বৃদ্ধি করেনি, বরং বাঙালি জাতিকে এক অব্যক্ত ‘ট্রমার’ মুখোমুখি করে। শাস্তির ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

    “দশকের পর দশক ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের স্বজন ও জাতির অব্যক্ত ব্যথার ক্ষেত্রে আইনের ভাষা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ন্যায় বিচার হচ্ছে সেটাই, যা অপরাধীকে তার কৃতকর্মের ফল শোধ করে দেয়।”

    ‘চপেটাঘাত’ ও ধর্মের অপব্যবহার

    একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও বিগত জোট সরকারের আমলে মতিউর রহমান নিজামীকে মন্ত্রিত্ব উপহার দেওয়াকে লাখো শহীদের প্রতি চপেটাঘাত বলে মন্তব্য করেছে আদালত।

    রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন যে, সক্রিয়ভাবে যিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, তাকে এই প্রজাতন্ত্রের মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

    “আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তৎকালীন সরকার কর্তৃক এই অভিযুক্তকে মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া একটা বড় ধরনের ভুল (ব্লান্ডার) ছিল। পাশাপাশি এটা ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ নারীর প্রতি ছিল সুস্পষ্ট চপেটাঘাত। এই লজ্জাজনক ঘটনা পুরো জাতির জন্য অবমাননাকর।”

    স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০১ সালে সরকার গঠনের সময় মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন নিজামীকে। যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদও সে সময় মন্ত্রিত্ব পান।

    আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মতিউর রহমান নিজামী একজন প্রখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত (আসামিপক্ষের দাবি অনুযায়ী) হওয়ার পরও কোরানের আদেশ ও মহানবীর শিক্ষার পরিপন্থী হয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা ও নিধন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর কর্মকাণ্ডকে সহযোগিতা ও অনুমোদন আদায়।

    “আমরা ধরে নিতে বাধ্য হচ্ছি যে মতিউর রহমান নিজামী ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় ‘আল্লাহ’ ও পবিত্র ধর্ম ‘ইসলাম’ এর নামের অপব্যবহার করে ‘বাঙালি জাতি’কে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।”

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.