বিজয়ের রক্তশিখায় স্বপ্নের নামাবলি

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় কোন কৃত্রিমতা ছিল না। তারা রক্ত দিয়েই একটি মানচিত্র পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। তাই প্রাণের বলিদান, আত্মাহুতি কোন মুখ্য বিষয় ছিল না। সে সময় রাজনীতিকরাও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ভূমির। একটি বলীয়ান জাতিসত্তার। মানুষ রাজনীতিকদের কথায় আস্থা রেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। সে যুদ্ধে তারা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এরপরের দায়িত্বটুকু ছিল জনগণ-রাজনীতিকের সমন্বয় সাধনের। যে কাজটি দ্রুত করতে পারেননি স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্রশাসকরা। করতে পারলে তাৎক্ষণিক বহুধা বিভক্তির জন্ম হতো না। মানুষও বিভ্রান্ত হতো না। একটি স্খিতিশীলতার পথ দেখতো জাতি [...]

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় কোন কৃত্রিমতা ছিল না। তারা রক্ত দিয়েই একটি মানচিত্র পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। তাই প্রাণের বলিদান, আত্মাহুতি কোন মুখ্য বিষয় ছিল না। সে সময় রাজনীতিকরাও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি স্বাধীন ভূমির। একটি বলীয়ান জাতিসত্তার। মানুষ রাজনীতিকদের কথায় আস্থা রেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। সে যুদ্ধে তারা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এরপরের দায়িত্বটুকু ছিল জনগণ-রাজনীতিকের সমন্বয় সাধনের। যে কাজটি দ্রুত করতে পারেননি স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্রশাসকরা। করতে পারলে তাৎক্ষণিক বহুধা বিভক্তির জন্ম হতো না। মানুষও বিভ্রান্ত হতো না। একটি স্খিতিশীলতার পথ দেখতো জাতি।

রাষ্ট্রের অবকাঠামো নির্মাণে, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সবসময়ই জরুরি ভূমিকা রাখে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে পরিকল্পনায় ছিলেন ব্যাপক উদার। তার উদারতা তাৎক্ষণিক মহানুভবতার পরিচয় দিলেও পরাজিত পক্ষ সেটা দেখেছিল দুর্বলতা হিসেবে। যার ফলে এখনও তারা বলে কিংবা বলার সাহস দেখায়, শেখ মুজিব ঘাতক-দালালদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন! বঙ্গবন্ধু তেমন কোন ‘ক্ষমা’ ঘোষণা করেননি। বরং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্খা নেয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ব্যক্তিগত খাতিরের সুযোগ নিয়ে, সামাজিক মুচলেকা দিয়ে তারা পার পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেউ কেউ পলায়ন করেছিল পাকিস্তানে। পলাতক মাহমুদ আলী পাকিস্তানে মারা গেলেও, গোলাম আযমরা ফিরে এসেছিল পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এবং পাখনা মেলেছিল সদলবলে।

পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর যারা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার নেশায় মত্ত ছিল তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। দেশের মঙ্গল সাধনের চেয়ে, দেশ থেকে মুজিব এবং তার স্বপ্নের নামাবলি মুছে দেয়ার প্রধান ইজারা নিয়েছিল তারা। দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানোর চেয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লুটপাটকে বেছে নিয়েছিল তারা টিকে থাকার সিঁড়ি হিসেবে। প্রয়োজনীয় গণ উন্নয়ন খাতের বাজেটকে সঙ্কুচিত করে তারা মনগড়া অনুন্নয়নশীল খাতে বরাদ্দ করেছিল বেশি রাষ্ট্রীয় অর্থ। সবচেয়ে বেশি অমনোযোগী ছিল শিক্ষা খাতের প্রতি। ভয় ছিল, মানুষ সুশিক্ষিত হয়ে গেলে লুটপাটের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে।

একটি জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে যে প্রত্যয়টির প্রধানত প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে দেশ গঠনে আন্তরিকতা। সেদিকে না এগিয়ে একটি মহল বন্দুক উঁচিয়ে ক্ষমতার স্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে ছিল মরিয়া। শেখ মুজিবকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন নেতা ষ্পষ্ট বলেছিলেন, কাল সাপেরা ছোবল দিতে পারে। হ্যাঁ, সেটাই হয়েছিল।

বন্দুকধারীদের সঙ্গে খুব সহজেই যোগ দিয়েছিল পরাজিত রাজাকারচক্র। তাদের মধ্য থেকে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করার মাধ্যমে রাজাকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বেশ জোরেশোরে। এ সময়ে দু’টি চেষ্টা ছিল প্রকট। একটি হচ্ছে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে পলিটিশিয়ানদের জন্য ‘পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট’ করা। আর অন্যটি হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামক দলটিকে ক্রমেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এই দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, অতএব এদেরই নিপাত কর­ এমন একটি নেপথ্য চিন্তায় ইন্ধন যুগিয়েছিল পরাজিত ঘাতক আলবদর-রাজাকার চক্র। পাক তমদ্দুনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা ছিল ব্যাপক।

একটি রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে সে রাষ্ট্রের মানুষের জন্য পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করার বিষয়ে বাংলাদেশে পরাজিত চক্রের শুরুতেই ছিল না। তারা খামোশ হয়ে, পরিস্খিতি পর্যবেক্ষণে ছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত। এরপরই সুযোগের সদ্ব্যহার করেছিল যথার্থই।

দুই.
বাংলাদেশের উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, জনগণের প্রতি রাজনীতিকদের আনুগত্য না থাকা। দায়বদ্ধতার অভাব এবং জনগণের সম্পত্তি হরণ করে নেয়ার মানসিকতা। স্বৈরশাসক এরশাদ সে কাজে নতুন মাত্রা যুক্ত করে, মস্তানদের লেলিয়ে দেন প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের ওপর। ফলে দেশের ভেতরে ‘পলিটিক্যাল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’রা প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠে। এরা মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত পায়। তাদের বাসা থেকে ধৃত হয় গালকাটা কামালের মতো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। রাষ্ট্রপক্ষ, জনগণের ওপর এমন দানব লেলিয়ে দেয়ার ঘটনাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিষিয়ে তোলে।

এরশাদের পতনের পর তারা নতুন আঙ্গিকে প্রধান দুইদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ওপর ভর করে। তারা শুরু করে নতুন নতুন অপচেষ্টা। এই যে দুই প্রধান দলের ভেতরের লুটেরা শ্রেণী, তারা যে এরশাদের সৃষ্টি তা খুঁজে দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এদের দেখাদেখি প্রধান দুই দলে আরও কিছু নেতা এ পথ অনুসরণ করেছে ’৯০-এর গণ আন্দোলনের পরে।

প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশে ডানপন্থি মোর্চাটি বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে। এই যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা’ সেটাও কিন্তু রাজনীতিকদের পারস্পরিক অবিশ্বাসের ফসল। রাজনীতিকদের যে নূন্যতম দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নেই তার প্রমাণও এই তত্ত্বাবধায়ক প্রথাটি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও এত চমৎকার গণতান্ত্রিক সৌহার্দ্যতা থাকার পরও বাংলাদেশ তা অনুসরণ করতে পারেনি তা চরম বেদনাদায়ক এবং লজ্জাজনকও বটে।

বিএনপির ব্যর্থতার কারণে ’৯৬-এর নির্বাচনে জিতে আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ সময়ে আওয়ামী নেতারা আরও দাম্ভিক, অহমিকাপূর্ণ আচরণ শুরু করেন গণ মানুষের প্রতি। দুর্নীতিতে তারাও সমান পারদর্শিতা দেখান। মানুষ দাঁড়ানোর পথ খুঁজে না পেয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার বিএনপি জোটের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। সে সঙ্গে মন্ত্রিত্ব পায় একাত্তরের আলবদর বাহিনীর দুই খুনি ও তাদের প্রেতাত্মা।

দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ লালনে স্বীকৃত রাজনীতিকদের কি ভূমিকা ছিল তা আজও অজ্ঞাত। শায়খ রহমান কিংবা বাংলা ভাই কখনই দেশে প্রধান কোন নায়ক ছিল না। প্রধান নায়করা নেপথ্যে ছিল এবং এখনও আছে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের মূল্য যারা এখনও স্বীকার করতে চায় না­ তারা অন্যভাবে ক্ষমতার মসনদ চায়।
আর তা হচ্ছে জঙ্গিবাদ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপ, সমীক্ষার মতে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের উর্বর ভমি হতে চলেছে। সে কথা আমরা গেল প্রায় এক দশক থেকেই শুনে আসছি। যা রাষ্ট্রের জন্য, মানুষের জন্য ভয়ানক শঙ্কার কারণ। শঙ্কার কারণ সুস্খ ধারার রাজনীতির জন্যও।

এমন চরম হতাশার মধ্যেই জন্ম নেয় ওয়ান-ইলেভেন নামক পরিবর্তনটি। কিন্তু নানা পর্যবেক্ষণের পর ২০০৮ সালের শেষার্ধে আমরা দেখলাম রাষ্ট্রক্ষমতা সেই পুরনো খেলোয়াড়দের হাতেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে। ৩৭ বছরে কি পেয়েছে এই জাতি? কতটা পূরণ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গীকার? কেন হয়নি? কারা হতে দেয়নি? ২০০৮ সালের বিজয় দিবসে প্রশ্নগুলোর উত্তর  খোঁজা দরকার।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি, এদেশে ভাস্কর্য পর্যন্ত নিরাপদ নয়। একশ্রেণী ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে দেশকে অচল করে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। সেই স্বৈরশক্তি এবং জঙ্গিশক্তি দুটি প্রধান দলকে নিয়ন্ত্রণ করার মতলব আঁটছে। জাতীয় পার্টি আর মহাজোটের সঙ্গে থাকবে না­ ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করছে পতিত স্বৈরাচাররা। এমনি একটি শঙ্কা নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিশেষ মহলের কৃপায় স্বতন্ত্র এবং ছোট দলগুলো যদি আগামী সংসদে ফ্যাক্টর হয়ও তবুও কি কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বাংলাদেশ? নাকি শহীদের রক্তেভেজা মাটিতে অধরাই থেকে যাবে স্বপ্নের নামাবলি!

নিউইয়র্ক, ১১ ডিসেম্বর ২০০৮

ফকির ইলিয়াস

একটা সূর্য চাই, একটা চন্দ্র চাই / নদীর নীরব নগরে পসরা সাজাই ।।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.