শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গফুরের মৃত্যুর পর বরিশাল আমার কাছে অনেকটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তার পরও যাঁদের টানে বরিশাল যেতাম, তাঁদের একজন রানী ভট্টাচার্য, সর্বজনের রানীদি। রোজ সকালে তাঁর সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বসতে হতো, শোনাতে হতো বরিশালের দৈনিকগুলোর হেডলাইন ও খবর। নানা আলোচনা ও গল্প চলত অনেকক্ষণ, ব্যতিক্রম ঘটার উপায় ছিল না। তিনিও চলে গেলেন, কেউ আর এখন আমার জন্য হিরণালয়ে আকুল অপেক্ষায় থাকবে না। একে একে নিভিছে দেউটি। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার এও এক বিড়ম্বনা : অনুজ ও বন্ধুদের মৃত্যুর অনিবার্য দুঃখভোগ। আমি বরিশাল যাই ১৯৫৪ সালে, বি.এম. কলেজে জীববিদ্যার ডেমোনেস্ট্রটের চাকরিতে। সেবার শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের পার্টি-ডেনে (কমিউনিস্ট পার্টির গোপন আশ্রয়ের স্থান) যাওয়া এবং হিরণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় হলেও রানীদির সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি তখনও এ বাড়ির কেউ নন। ১৯৫৮ সালে বি.এম. কলেজে অধ্যাপনার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর কোনো একসময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ ঘটে। তিনি ততদিনে আমাদের হিরণদার সহধর্মিণী। ১৯৬০ সালে আমার বিয়ে হয় তাঁর পাশের বাড়িতে, তার পর থেকে নিত্য দেখাশোনা। মনে পড়ে, বিয়ের দিন তাঁর বাড়িতেই বরযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। পাশাপাশি দুটি বাড়ি, কয়েক প্রজন্মের সখ্য। আমরা ছিলাম এক পরিবারের সদস্য। স্বাধীনতার পর ওই বাড়ি থেকে পার্টি-ডেন উঠে যায়, যেখানে একসময় আবদুর রব সেরনিয়াবাত কয়েক বছর সপরিবারে বসবাস করেছেন; পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। হিরণদা সম্ভবত পার্টি ছেড়ে দেন। হতে পারে ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি রুশ ও চীন পন্থায় বিভাজিত হওয়া থেকেই শুরু। আমি ১৯৭৪ সালে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদের কাজ নিয়ে মস্কোয় চলে যাই। দু-তিন বছর পরপর দেশে বেড়াতে এলে গোটা ছুটির বেশির ভাগ কাটত বরিশালে। হিরণদা ও রানীদির সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা চললেও তাঁরা একবারও জিজ্ঞেস করতেন না -- রাশিয়া কেমন দেশ, ওখানকার জীবনযাত্রা কেমন। চাইলে তাঁরা ওই স্বপ্নের দেশে চিকিৎসা ও ভ্রমণের সুযোগ নিতে পারতেন। এই সময় তাঁরা আরেকটি ব্যতিক্রমী ব্রত গ্রহণ করেন -- দুঃস্থ জীবজন্তু পালন, বিশেষত বিড়াল ও কুকুর। একদিন দেখলাম রানীদি জলে ভেজা কয়েকটি বিড়ালছানা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম ড্রেনে দড়ি বাঁধা সাতটি বিড়ালছানা পড়ে আছে -- এই খবর শুনে তিনি ছুটে যান এবং ওদের বাঁচান। ক্রমে তাঁদের বাড়ি একটি ছোটখাটো পিঁজরাপোল হয়ে…
শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গফুরের মৃত্যুর পর বরিশাল আমার কাছে অনেকটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তার পরও যাঁদের টানে বরিশাল যেতাম, তাঁদের একজন রানী ভট্টাচার্য, সর্বজনের রানীদি। রোজ সকালে তাঁর সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বসতে হতো, শোনাতে হতো বরিশালের দৈনিকগুলোর হেডলাইন ও খবর। নানা আলোচনা ও গল্প চলত অনেকক্ষণ, ব্যতিক্রম ঘটার উপায় ছিল না। তিনিও চলে গেলেন, কেউ আর এখন আমার জন্য হিরণালয়ে আকুল অপেক্ষায় থাকবে না। একে একে নিভিছে দেউটি। [...]