
রানী ভট্টাচার্য (৩১ ডিসেম্বর ১৯২৭ - ২ মার্চ ২০০৯)
আমি বরিশাল যাই ১৯৫৪ সালে, বি.এম. কলেজে জীববিদ্যার ডেমোনেস্ট্রটের চাকরিতে। সেবার শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের পার্টি-ডেনে (কমিউনিস্ট পার্টির গোপন আশ্রয়ের স্থান) যাওয়া এবং হিরণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় হলেও রানীদির সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি তখনও এ বাড়ির কেউ নন। ১৯৫৮ সালে বি.এম. কলেজে অধ্যাপনার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর কোনো একসময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ ঘটে। তিনি ততদিনে আমাদের হিরণদার সহধর্মিণী। ১৯৬০ সালে আমার বিয়ে হয় তাঁর পাশের বাড়িতে, তার পর থেকে নিত্য দেখাশোনা। মনে পড়ে, বিয়ের দিন তাঁর বাড়িতেই বরযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। পাশাপাশি দুটি বাড়ি, কয়েক প্রজন্মের সখ্য। আমরা ছিলাম এক পরিবারের সদস্য।
স্বাধীনতার পর ওই বাড়ি থেকে পার্টি-ডেন উঠে যায়, যেখানে একসময় আবদুর রব সেরনিয়াবাত কয়েক বছর সপরিবারে বসবাস করেছেন; পার্টি তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। হিরণদা সম্ভবত পার্টি ছেড়ে দেন। হতে পারে ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি রুশ ও চীন পন্থায় বিভাজিত হওয়া থেকেই শুরু। আমি ১৯৭৪ সালে প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদের কাজ নিয়ে মস্কোয় চলে যাই। দু-তিন বছর পরপর দেশে বেড়াতে এলে গোটা ছুটির বেশির ভাগ কাটত বরিশালে। হিরণদা ও রানীদির সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা চললেও তাঁরা একবারও জিজ্ঞেস করতেন না — রাশিয়া কেমন দেশ, ওখানকার জীবনযাত্রা কেমন। চাইলে তাঁরা ওই স্বপ্নের দেশে চিকিৎসা ও ভ্রমণের সুযোগ নিতে পারতেন।
এই সময় তাঁরা আরেকটি ব্যতিক্রমী ব্রত গ্রহণ করেন — দুঃস্থ জীবজন্তু পালন, বিশেষত বিড়াল ও কুকুর। একদিন দেখলাম রানীদি জলে ভেজা কয়েকটি বিড়ালছানা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম ড্রেনে দড়ি বাঁধা সাতটি বিড়ালছানা পড়ে আছে — এই খবর শুনে তিনি ছুটে যান এবং ওদের বাঁচান। ক্রমে তাঁদের বাড়ি একটি ছোটখাটো পিঁজরাপোল হয়ে ওঠে। আমি ছেলেবেলা থেকেই কুকুর-বিড়াল ভালোবাসি। মস্কো গিয়েই একটি স্পেনিয়ালের বাচ্চা কিনি। এগারো বছর আমার সঙ্গী ছিল সে, পরে মারা যায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে। কোনোদিন আর কুকুর পালব না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারিনি। এক বন্ধু একটি পুড্ল্ ছানা দিতে চাইলে নিয়ে নিই। আসলে গছাতে এসেছিলেন। ওর ছিল মৃগীরোগ। মাঝেমধ্যে খিঁচুনি দিতে দিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ত, মুখ থেকে ঝরত অঝোর লালাস্রোত। কিন্তু ওকে ফেলে দিতে পারিনি। পাঁচ বছর টিকে ছিল, তারপর মারা যায়। বড়োই নেওটা ছিল, তাই কষ্ট পেলাম। আইন ভেঙে রাতের বেলায় লুকিয়ে কবর দিলাম আমার বাগানে। তারপর লিখলাম কুকুর-কাহিনী — ‘অতিসখা প্রিয়সখা’। এটি প্রথম বের হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত নবারুণ মাসিক পত্রিকায় (মে-জুন ১৯৯২), উৎসর্গিত হয়েছিল ‘আর্ত-তাড়িত পশুকুলের জননীকল্পা’ রানী ভট্টাচার্যের উদ্দেশে। পরে সংকলিত হয়েছে আমার গহন কোন বনের ধারে বইয়ে।
শ্রদ্ধেয় জাফর ভাই, আবু জাফর শামসুদ্দিন, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও পণ্ডিত, আমাদের প্রজন্মকে ‘ত্রিকালদর্শী’ বলতেন, কেননা আমরা ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি জমানা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছি। বলাবাহুল্য, রানীদিও এই গৌরবের অধিকারী। একাত্তরে বরিশালেই ছিলেন, কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে, হত্যাকারীদের শিকারের তালিকায় তাঁর নাম ছিল ওপরের দিকে, বেঁচে গেছেন শেষ পর্যন্ত। আশ্রয়দাতার অভাব ঘটেনি। আজীবন সারস্বত বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। প্রধান শিক্ষকও ছিলেন, মানুষ করেছেন গোটা এক প্রজন্মকে। মনোরমা মাসিমার এই শিষ্য আমৃত্যু বরিশাল মহিলা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। হিরণদা তাঁদের ভিটের যে অংশটুকু জনসেবায় দান করে যান সেখানে রানীদির উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে মহিলা পরিষদের দোতলা ভবন। লেখাপড়ায় আগ্রহী একটি মুসলিম মেয়ে সম্ভবত বাল্যবিবাহ এড়াতে রানীদির সাহায্য চাইলে নিঃসন্তান হিরণদা ও রানীদি তাকে স্বগৃহে আশ্রয় দেন। স্নাতক পর্যন্ত পড়ান, বিয়েও দেন ওর পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। তাঁদের সেই কন্যা এখন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আদর্শ ও প্রয়োগের সহজদৃষ্ট ফারাক হিরণদা-রানীদির মধ্যে ছিল না এতটুকু।
শেষ বয়সে রানীদি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন, তবু চলাফেরা করতে পারতেন কোনোক্রমে। এই সময় কাপড়ে আগুন লেগে শরীরের অনেকটা পুড়ে যায়, সুস্থ হয়ে উঠলেও দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মহিলা পরিষদ যথাসম্ভব তাঁর দেখাশোনা করেছে সর্বক্ষণ। অন্তিম শয্যায় রক্তদাতার অভাব ঘটেনি।
‘ত্রিকালদর্শী’রা মহাকালের অমোঘ নিয়মেই একদিন লোপ পাবেন। রানীদির মৃত্যুতে তাঁদের একটি নক্ষত্রের পতন হলো।
