সাধারণ জনগণের বিশেষ করে তরুণ সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। সেই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর মহাজোট সরকার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে Į যাদের অধিকাংশই ছিলেন জামায়েতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। অন্য দলেরও দুএকজন ছিলেন। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তাদের আক্রোশ নতুন করে শুরু হল। তাদের ধারণা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে অন্য কেউ এ ধরনের বিচার করার সাহস পেত না। কথাটা একবারে অমূলক নয়। কারণ ফাসির রায় কার্যকর না করার জন্য খোদ আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা রায় কার্যকর করায় অবিচল ছিলেন। এ জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি জামাত সমর্থিত বর্তমান সরকারের ও আইসিটি কুশীলবদের আক্রোশের মাত্রাটা সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ নিয়েও নানা বিতর্ক। যে মৃত্যু সংখ্যাকে ঘিরে এই বিচারের প্রহসন সেটিও তো ক্রমে অসত্য হিসেবে উদঘাটিত হলো। কিন্তু আইসিটি সেই মিথ্যে তথ্যেরে ওপর ভিত্তি করেই রায় প্রদান করলো।

এক.
বাংলাদেশে ড: মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ।আর যেভাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছে তার কোন বৈধতাই নেই। সুতরাং রায় কি হল তা নিয়ে আলোচনা অনর্থক। তবুও প্রশ্ন, কেন এত তড়িঘড়ি করে কোন নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই এ ভাবে ফাসির রায় ঘোষণা করা হল?
যারা এই রায় ঘোষণা করেছেন তারাও জানেন নিয়মকানুন মেনে এই রায় ঘোষণা করা হয় নাই। তবে কেন?
এর অন্যতম প্রধান কারণ—প্রতিহিংসা, আক্রোশ এবং জিঘাংসা।
কিসের এই জিঘাংসা?
সেটা জানতে আলোচনাটা শুরু করতে হবে একটু পিছন থেকেই।
নব্বই দশক থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারটি বেশ জোরেশোরেই আলোচনায় আসতে থাকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে।
উল্লেখ্য যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে জামায়েতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি(পিডিপি) সরাসরি পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করে। জামায়েতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্র শিবির) ক্যাডার ভিত্তিক আলবদর বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী জান্তার সাথে সরাসরি যুদ্ধের সময় হত্যা ও নির্যাতনে জড়িত ছিল।
রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলেন জামায়েতে ইসলামী নেতা মৌলানা একেএম ইউসুফ যিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী (আপিল শুনানি চলছিল) হয়েও কিছুদিন আগে বেকসুর খালাস পেয়ে জেল থেকে মুক্তি পান।
এমতাবস্থায় নিজ দলের এবং সাধারণ জনগণের বিশেষ করে তরুণ সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। সেই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর মহাজোট সরকার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে Į যাদের অধিকাংশই ছিলেন জামায়েতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। অন্য দলেরও দুএকজন ছিলেন।
সেই থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি তাদের আক্রোশ নতুন করে শুরু হল। তাদের ধারণা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে অন্য কেউ এ ধরনের বিচার করার সাহস পেত না।
কথাটা একবারে অমূলক নয়। কারণ ফাসির রায় কার্যকর না করার জন্য খোদ আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা রায় কার্যকর করায় অবিচল ছিলেন। এ জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি আক্রোশের মাত্রাটা সবচেয়ে বেশি।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন অন্যতম অগ্রদূত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ ও লালন করার বিশ্বস্ত প্রহরী। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তার দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। তদুপরি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গীবাদ দমনে তার সাহস এবং নিরলস সংগ্রাম সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর এ সকল দূর্ধ র্ষ জঙ্গিকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শোনা যাচ্ছে সম্প্রতি ছাড়া পাওয়া দু’ একজন জঙ্গি ১০ নভেম্বর ২০২৫ দিল্লীর বোমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িত থাকতে পারে। এব্যাপারে ভারত ব্যাপক তদন্ত করছে।
শেখ হাসিনা থাকলে তাদের সব দিক থেকে অসুবিধা। সে জন্যই তাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার উৎখাতের দিনই শেখ হাসিনাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা। সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তারা এখন হতাশ এবং মহা সংকটে আছে। তারা ভাল করেই জানে শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে ফাসির রায় কার্যকর করার কোন অবকাশ নেই। তবুও অক্রোশটা যদি একটু কমে। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মত।

যে কারণে ফরমায়েশি কোর্ট বানিয়ে ন্যূনতম সময়ে ফরমায়েশি রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারা তাদের সেই প্রতিহিংসা, আক্রোশ এবং জিঘাংসার প্রতিফলন ঘটাল।


দুই.

এ কে রাইফেল সহ অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো গেল কোথায়

একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদদের সংখ্য়া নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যেই বলে থাকে এত লোক শহীদ হয় নাই, অনেক কম লোক মারা গেছে যা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বক্তব্যরেই প্রতিদবনি । আবার এ সকল দলগুলোই ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে সহিংস আন্দোলনে নিহতদের সংখাটা কত বাড়িয়ে বলা যায় সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত । তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কাছে হিসেব দিয়েছে ১৪০০ মৃত্যুর । আবার নিজেদের স্বাস্থ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ৮৫০ জন , এদিকে পত্রিকাগুলোর হিসেবে ৫৩১ জন । এর মধ্যে পুলিশ হত্যা এবং ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য হত্যাকান্ডও আছে , কারণ হিসেবটি ২০২৪ এর জুলাই থেকে ঐ বছরের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হয়েছে । অবশ্য এর পর থেকে অদ্যবদি মব সন্ত্রাস , গুম -খুন চলছেই । প্রতিদিনই নদীতে বেওয়ারিশ লাশ ভেসে আসছে । পুলিশ হত্যা সহ এগুলুর দায় ত ইমডেমনিটি দিয়ে বন্ধ করেই রাখা হয়েছে ।

এবার আসি মৃত্যুর কারণ নিয়ে কি খেলা হচ্ছে । ২০২৪ এর জুলাই -আগস্টের সহিংস আন্দোলনে আবু সাঈদের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং আন্দোলনের একটি অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট । অথচ এ মৃত্যু নিয়ে ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছয় বার বদল করা হয়েছে । আবু সাঈদের পিতা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি আবু সাঈদের মাথায় গভীর আঘাতের এবং রক্তপাতের চিহ্ন দেখেছেন । কিন্তু এই বক্তব্য আমলেই নেওয়া হয় নি । ফলে আবু সাঈদ কি পুলিশের গুলিতে শহীদ , নাকি অনেকের মত অনুযায়ী পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হওয়ার পর নিজ দলের লোকের হাতে গুরুতর আহত অবস্থায় অনেকক্ষণ যাবত রক্তক্ষরণে মারা যায় তা এখনও স্পষ্ট হচ্ছে না । কবর থেকে লাশ তুলে ময়না তদন্ত করতেও দেওয়া হয় নি । কি যেন লুকানোর চেষ্টা হচ্ছে সবসময় । এ নিয়ে সরকার এখন পর্যন্ত নিশচুপ ।

এদিকে ১২ আগস্ট , ২০২৪ এক সাক্ষাতকারে সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত বলেছেন ,এটা খুবই উদ্বেগজনক যে সিভিলিয়ানদের হাতে ৭.৬২ স্নাইপার কিভাবে গেল ? এ বিষয়ে মেসিভ ইনভেস্টিগেশন প্রয়োজন । তিনি বলেছেন পুলিশের কাছে এগুলু থাকার কথা নয় । তিনি এও বলেছেন ৫ আগস্ট ২০২৪ সবচেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে এই স্নাইপার রাইফেল দিয়ে । এই সকল স্নাইপার রাইফেল কোথায় থেকে এবং কোন জঙ্গিদের হতে ছিল এব্যাপারে একজন মেজর (বরখাস্ত ) বলেছেন এবং জঙ্গি তৌহিদ স্বীকারোক্তিও দিয়েছে । একজন সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম প্রকাশ্যেই বলেছেন , মেট্রোরেলে আগুন , পুলিশ হত্যা না করলে এত সহজে বিজয় অর্জন করা যেত না । এ ব্যাপারে প্রকাশ্য বলার পরও এগুলো নিয়ে কোন সঠিক তদন্ত নেই ।

আরেক দিকে এক পাকিস্তানী নাগরিক নিজেই ভিডিওতে বলেছেন যে তিনি একে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছেন । এক মেয়ে বোরকার নিচ থেকে বের করে বড় সাদা তোয়ালে পেচানো একটি একে ৪৭ রাইফেল জমা দিয়েছে । আন্দোলনকারিরা সকল থানা লুট করে সব অস্ত্র নিয়ে গেছে । নরসিংদী জেলখানা ভেঙে জঙ্গিরা সাজাপ্রাপ্ত সব জঙ্গীকে ভারী অস্ত্র সহ নিয়ে গেছে । সম্প্রতি ঢাকা বিমান বন্দরে বিশাল অগ্নিকান্ডের সময় সিলগালা করা সেফটি ভল্ট ভেঙে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক কমব্যাট অস্ত্র লুট হয়েছে শুনা যায় । সেটি পুনরায় সিলগালা করার পর সেই হাই সিকিউরিটি এলাকার সেফটি ভল্ট থেকে দুই দিন পর পুনরায় আরও অস্ত্র নাকি লুট হয়েছে । এত অত্যাধুনিক অস্ত্র লুট করল কারা – এ ব্যাপারে সরকার একেবারেই নিশচুপ । বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে এক উপদেষ্টার লাগেজে অস্ত্র পাওয়া গেল – এ নিয়েও কোন উচ্চবাক্য নেই ।

এভাবে আরও কত ধরনের চাঞ্চল্যকর খবর বিভিন্ন ভাবে বের হচ্ছে । অনেক বিস্ময়কর খবর আছে যেগুলু হয়তো বেরও হচ্ছে না । তবে বিভিন্ন সুত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে ৭.৬২ স্নাইপার রাইফেল , একে -৪৭ রাইফেল সহ এ সব অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই এর মাধ্যমে । এ খবর সত্যি হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্বক হুমকি । অতিতেও এধরনের ঘটনার নজির আছে । কিন্তু এ গুলো নিয়ে সরকারের কোন তদন্তও নেই , মাথা ব্যাথাও নেই । সরকার শুধু ব্যস্ত আছে ক্যাঙ্গারু কোর্টে তড়িঘড়ি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সহ সংশ্লিষ্ঠ সবাইকে ফাসির আদেশ জারি করা নিয়ে ।


ড: আবদুল আউয়াল
সাবেক উপাচার্য , সিলেট কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়
প্রাক্তন ভিজিটিং প্রফেসর, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

0 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.