সাহিত্যে স্বাধীন দেশের আবাহন আমরা শুনেছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরে সেই আবাহন আর কণ্ঠস্বরের মধ্যে দিয়ে বাঙালির কথাসাহিত্যও সুস্পষ্ট এক আদল পেয়েছিল। তার আগেও গদ্য ছিল, কিন্তু সেই গদ্যে ছিল না বাঙালির সামাজিক-অসামাজিক জীবনের স্বাদ ও গড়ন ছিল না নিরীক্ষণ ছিল না যাকে এখন বলি ‘বিটুয়িন দ্য লাইনস সেসবের অস্তিত্ব। বঙ্কিম হয়ে উঠেছিলেন একইসঙ্গে আমাদের কথাসাহিত্যের জনক ও আত্মজ। তবে কেবল কথাসাহিত্যেরই আদল দেন নি তিনি, তৈরি করেছিলেন সাহিত্যে মৌলবাদের গড়ন; যদিও কথাটা শুনতে খুবই লাগে, কেবল কানে নয়, কান ছাড়িয়ে হৃদয়েরও মধ্যে। সাহিত্য তো শুধু বাস্তবতা নয়, সাহিত্য বাস্তবতাকে আত্মস্থ করে, অতিক্রমও করে। আত্তীকরণ ও অতিক্রমণের মধ্যে দিয়েই সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সাহিত্যিক বঙ্কিম তাঁর আশেপাশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে আত্মস্থ করতে পারেন নি। আত্মস্থ করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেন নি হজম করে ফেলতে এবং প্রচণ্ড বিবমিষায় উগড়ে ফেলেছেন ভেতর থেকে। উল্টেপাল্টে ফেরত আসা সাম্প্রদায়িক বাস্তবতার সে গন্ধ তাই ভয়াবহ উৎকট। সাম্প্রদায়িকতাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তিনি অনতিক্রান্ত এক বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছেন এবং সম্প্রদায়কেই মনে করেছেন মুক্তির কাণ্ডারী। এসব কথা মানতে কষ্ট হয়, বিশেষত সেই বঙ্কিমের কথা মনে হলে,- যে-বঙ্কিমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ’। এত যে সুকৃতি তাঁর, সাম্প্রদায়িকতা সেসবের মধ্যে একেবারেই বিসদৃশ, চৌবাচ্চাভর্তি খাঁটি দুধে একফোঁটা প্রস্রাব পড়ার মতো। মাত্র একটি ফোঁটা, কিন্তু স্বাদ ও পবিত্রতা নষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট ওইটুকুই। অনেকে দুর্বোধ্যতাকে হালআমলের গদ্যের প্রধান দুর্বলতা বলেন; কিন্তু বঙ্কিম পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা অনুভব করতে পারি, দুর্বোধ্যতা নয়- যুগে যুগে কথাসাহিত্যের প্রধান সংকট হলো গতিহীনতা। এই গতিহীনতা লেখকের ভাষাকে মৃত করে তোলে। কিন্তু গতিময়তা ছিল বলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাক্যগঠন ও শব্দব্যবহার অত দুর্বোধ্য হওয়ার পরও শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে একেবারে মুদির দোকানদার পর্যন্ত সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আহমদ শরীফ অবশ্য আমৃত্য দাবি করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও জাতীয়তাবাদী। বলেছেন, দেশকে প্রথম মাতৃরূপে জেনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনিই প্রথম তাত্ত্বিক অর্থে একটি ভৌগলিক স্বদেশ ও স্বজাতির অনুসন্ধানে নামেন। সুবা-ই-বাঙ্গলা বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে স্বদেশ হিসেবে মূর্ত করে তোলেন তাঁর লেখায়। এর অধিবাসীদেরও তিনি তাঁর স্বজাতির করে নেন। এ অঞ্চলের জনতার জন্যে বাঙালি অভিধা তিনিই ফিরিয়ে আনেন এবং তাঁর সেই বাঙালি কেবল…

প্রায় নিঃশব্দেই আমাদের দেশের লোকজ চিন্তাতত্ত্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিকাশের সোপানশীর্ষে ওঠে। তখন একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন চলছে এবং ওই শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনও মুখোমুখি বিরোধিতায় না গিয়ে বাঙালির মনন আধুনিক করে তোলার কাজ করে চলেছেন রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭), ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রমুখ চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলা নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা। এর অন্যদিকে সাধারণ জনতার বিক্ষুব্ধ মনোজগত আপাতচোখে হঠাৎ হলেও মূলত দীর্ঘ বঞ্চণার পথ বেয়ে প্রকাশ পেয়েছিল সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট সর্বস্তর ছুঁয়ে যাওয়া ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে। (more…)

যে মা’কে আমাদের নৃতত্ত্ববিদরা আর ক’দিনের মধ্যেই খুঁজে ফিরবেন শামসুর রাহমানের কবিতায় (কেননা তা বাদে এই মায়ের প্রতিকৃতি আর কোথাও রইবে না ‘উন্নয়ন আর ক্ষমতায়নের’ বাঁধভাঙা জোয়ারে), সেই মায়ের প্রচ্ছায়া কোনও কোনও গাঢ়তর দুর্বল মুহূর্তে আমাকে অশ্রুবিদ্ধ করে। জেন্ডার সমতার ইচ্ছাকৃত জটিল সমীকরণ নিয়ে বসলে শামসুর রাহমানের আঁকা এই মায়ের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, কেউ তো অবশ্যই বলতে পারেন পুরুষতন্ত্রের পিছুটান আর মাদকতা মেশানো উল্লাস রয়েছে তাতে। কিন্তু মানুষকে লুপ্ত নাশপাতির ঘ্রাণ বরাবরই মুগ্ধ করে, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদের সৌগন্ধে যত সামন্ত্রতান্ত্রিকতার প্রচ্ছায়াই গবেষকরা দেখুন না কেন, শেষ পর্যন্ত নগ্ন নির্জন হাতের স্পর্শই মানুষকে গুড়িয়ে দেয় ভেতর থেকে। (more…)

এটিও অনেক পুরানো লেখা, যখন ছাত্র আমি- সেই ফাল্গুন ১৩৯৬-এ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯০-এ, আর ছাপা হয়েছিল বৈশম্পায়ন নামের এক ছোট কাগজের প্রথম সংখ্যায় মার্চ ১৯৯০-এ। কিন্তু এখনও এটি আমার একটি প্রিয় লেখা, এখন এর অনেক দুর্বলতা বুঝতে পারার পরেও... হয়তো তার একটি অন্যতম কারণ, আমার বন্ধুদের এ লেখাটা খুব ভালো লেগেছিল আর মাহমুদুল হকেরও ভাল লেগেছিল। এরও বছর চারেক পরে মাহমুদুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার, খোলা রাজপথে, নির্মুল কমিটির এক কর্মসূচি চলার সময় . . . অন্যান্যদের মতো, আরও স্পষ্ট করে বললে, মাহমুদুল হক কারও মতোই ‘কিছু একটা তো করছি’ ভেবে আত্মহারা হন নি। হাসান আজিজুল হকও ‘অবশেষে তাঁর ক্ষমতার বেদী থেকে সরে দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন’ দেখে ১৯৭৫-এ অসীম সাহা রীতিমতো আতংকিত হয়েছিলেন (এদেশের গল্প : পূর্ণতা অপূর্ণতা/ অসীম সাহা; কণ্ঠস্বর, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) এবং পাঠকরুচির মৃত্যু না ঘটলে অনায়াসেই অনুমান করা যায় যে গত ১৯৮৯-এ ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ পড়ে নিঃসন্দেহে অসীম সাহা অপঘাতে মারা গেছেন। প্রসঙ্গটি উত্থাপন অপরিহার্য এ কারণে যে লেখার ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই এটি উচ্চকিত করে জানানোর জন্যে সমর সেনের পন্থা কোনও সাহিত্যিকই পছন্দ করেন নি। বরং পূর্বনির্মিত ইমেজকে পুঁজি করে তারা অভ্যাসবশে লিখে গেছেন এবং এখনও লিখছেন; আর পাঠকও এমন রুচিহীন, অনুসন্ধিৎসুহীন যে ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়’ বলার কৌতূহলও নেই। সে তুলনায়, মাহমুদুল হক অনেক সাহসী, সমর সেনের কাছাকাছি, অনেকদিন হলো নীরব তিনি। কেন নীরব এই প্রশ্নের উত্তরে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘বাল্যশিক্ষা পড়ছি...’। তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে প্রাইমারি স্কুলে। আমাদের বাড়িতে ছিল অনেক পুরানো পত্রপত্রিকা। বোধহয় ইঁচড়ে পাকা হবো এই ভয়েই আমাদের মেজো ভাই ঝুলকালি, ধুলোবালি ঝেড়েমুছে তা থেকে খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট কিছু পত্রপত্রিকা বের করে দেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের বড়ভাই আর বড়বুবুর গ্রাহকসংগ্রহ ‘শাহীন’ আর ‘সেতারা’ ওভাবেই আমাদের কাছে আসে। সবার কথা মনে নেই,- তবে মাহমুদুল হক, আল মাহমুদ এবং শহীদ সাবের যে ওতে বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য ও দাগ কাটার মতো গল্প লিখেছিলেন, তা ভালভাবেই মনে আছে। এর মধ্যে শহীদ সাবের নিহত হয়েছেন একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে, তবে শিশুকিশোরদের জন্যে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। আল মাহমুদ বুদ্ধিজীবীসুলভ ইতরামি থেকে লেখা কলামগুলো বাদ দিলে পুরোপুরি কাব্যচর্চায় নিয়োজিত হয়েছেন…

শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে এ লেখাটি লিখেছিলাম অনেক আগে, ১৯৯৮ সালে। কয়েকদিন হলো তাঁকে খুব মনে পড়ছে... আপনাদেরও মনে পড়ুক, এই প্রত্যাশায় লেখাটা তুলে দিচ্ছি। (more…)

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.