এটিও অনেক পুরানো লেখা, যখন ছাত্র আমি- সেই ফাল্গুন ১৩৯৬-এ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯০-এ, আর ছাপা হয়েছিল বৈশম্পায়ন নামের এক ছোট কাগজের প্রথম সংখ্যায় মার্চ ১৯৯০-এ। কিন্তু এখনও এটি আমার একটি প্রিয় লেখা, এখন এর অনেক দুর্বলতা বুঝতে পারার পরেও… হয়তো তার একটি অন্যতম কারণ, আমার বন্ধুদের এ লেখাটা খুব ভালো লেগেছিল আর মাহমুদুল হকেরও ভাল লেগেছিল। এরও বছর চারেক পরে মাহমুদুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার, খোলা রাজপথে, নির্মুল কমিটির এক কর্মসূচি চলার সময় . . .
অন্যান্যদের মতো, আরও স্পষ্ট করে বললে, মাহমুদুল হক কারও মতোই ‘কিছু একটা তো করছি’ ভেবে আত্মহারা হন নি। হাসান আজিজুল হকও ‘অবশেষে তাঁর ক্ষমতার বেদী থেকে সরে দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন’ দেখে ১৯৭৫-এ অসীম সাহা রীতিমতো আতংকিত হয়েছিলেন (এদেশের গল্প : পূর্ণতা অপূর্ণতা/ অসীম সাহা; কণ্ঠস্বর, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) এবং পাঠকরুচির মৃত্যু না ঘটলে অনায়াসেই অনুমান করা যায় যে গত ১৯৮৯-এ ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ পড়ে নিঃসন্দেহে অসীম সাহা অপঘাতে মারা গেছেন। প্রসঙ্গটি উত্থাপন অপরিহার্য এ কারণে যে লেখার ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই এটি উচ্চকিত করে জানানোর জন্যে সমর সেনের পন্থা কোনও সাহিত্যিকই পছন্দ করেন নি। বরং পূর্বনির্মিত ইমেজকে পুঁজি করে তারা অভ্যাসবশে লিখে গেছেন এবং এখনও লিখছেন; আর পাঠকও এমন রুচিহীন, অনুসন্ধিৎসুহীন যে ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়’ বলার কৌতূহলও নেই। সে তুলনায়, মাহমুদুল হক অনেক সাহসী, সমর সেনের কাছাকাছি, অনেকদিন হলো নীরব তিনি। কেন নীরব এই প্রশ্নের উত্তরে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘বাল্যশিক্ষা পড়ছি…’।
তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে প্রাইমারি স্কুলে। আমাদের বাড়িতে ছিল অনেক পুরানো পত্রপত্রিকা। বোধহয় ইঁচড়ে পাকা হবো এই ভয়েই আমাদের মেজো ভাই ঝুলকালি, ধুলোবালি ঝেড়েমুছে তা থেকে খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট কিছু পত্রপত্রিকা বের করে দেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের বড়ভাই আর বড়বুবুর গ্রাহকসংগ্রহ ‘শাহীন’ আর ‘সেতারা’ ওভাবেই আমাদের কাছে আসে। সবার কথা মনে নেই,- তবে মাহমুদুল হক, আল মাহমুদ এবং শহীদ সাবের যে ওতে বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য ও দাগ কাটার মতো গল্প লিখেছিলেন, তা ভালভাবেই মনে আছে। এর মধ্যে শহীদ সাবের নিহত হয়েছেন একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে, তবে শিশুকিশোরদের জন্যে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। আল মাহমুদ বুদ্ধিজীবীসুলভ ইতরামি থেকে লেখা কলামগুলো বাদ দিলে পুরোপুরি কাব্যচর্চায় নিয়োজিত হয়েছেন এবং শামসুর রাহমানের প্রতিতুলনায় ঈর্ষণীয় সাহিত্য প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে পাঠকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন এবং আমি বলব তিনি রক্ষা পেয়েছেন আমাদের সময়ের রুচিহীন পাঠকদের কবল থেকে। আর মাহমুদুল হকও অন্তরালে, তার কারণ অন্যবিধ, এমনকি আড্ডাতেও যান না তিনি। কেননা আড্ডা এখন, তাঁর কাছে মনে হয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী কবি সাহিত্যিকের চক্র, যাতে আর কারও ঠাঁই নেই, তাতে রয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার লোভ-লালসার ছড়াছড়ি। জানা মতে, মাহমুদুল হকও কোনও শিশুকিশোর উপযোগী বই প্রকাশ করেন নি- যদিও সেসব গল্প একসঙ্গে প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের সব শিশুকিশোর সাহিত্যিকই অন্তত মনে মনে লজ্জা পাবেন।
এরকম শিশুকিশোর উপযোগী গল্প লিখলেও, এমনকি কালো মাফলার-এর মতো ছোট গল্প লিখেও তাঁর পরিচয় মূলত উপন্যাস দিয়ে। সাধারণভাবে আমাদের কথাসাহিত্যের যে ইতিহাস রয়েছে তাতে তাঁকে অনুসন্ধান করা রীতিমতো কষ্টকর। তিনি আলোচিত হন ‘জীবন আমার বোন’ লিখে এবং আজ যখন আমরা ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আলোচনায় উচ্ছসিত তখন এই পটভূমিকাটার উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করি না। সাধারণভাবে কথাসাহিত্য মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণকে পরিপার্শ্ব হিসেবে দাঁড় করানোর একটা প্রচণ্ড প্রতারণা আমাদের সাহিত্যিকরা তৈরি করেছেন এবং রাজনৈতিক নিরুত্থানের সঙ্গে নিজেদের সীমাবদ্ধতা সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে পরিতৃপ্ত সাহিত্যবর্জ্য নিষ্কাশন করে রাজনৈতিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার নামে আরও তরলতা তৈরি করেছেন,- যা এখনও উৎপন্নমান। সেই ক্ষেত্রে ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর মতো একনিষ্ঠ পরিশ্রমী উপন্যাস বেরিয়ে এলে সমালোচক এবং পাঠকেরা বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে পড়েন। এবং আমি অনেককেই জানি, যারা না পড়েই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই উপন্যাসটির সমালোচনা-আলোচনা এবং প্রশংসা করেছেন। অতএব, বলাই বাহুল্য, এই আলোচনায় ‘জীবন আমার বোন’ সংযোজিত হয় নি। এবং উনসত্তরকে নিয়ে লেখা আরও একটি উপন্যাস আহমদ ছফা’র ‘ওঙ্কার’ কোনও সমালোচকের এমনকি নামতালিকায়ও আসে নি। তবে এসব নিয়ে মাহমুদুল হকের তেমন কোনও দুঃখবোধ আছে বলেও মনে হয় না। কেননা তাঁর কাছে লেখকই তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় বিচারক। আর সেটিই তাঁর নীরবতার বড় কারণ। কিন্তু আমরা যারা ‘৪৭-এর দেশবিভক্তি দেখি নি, যাদের স্মৃতিতে নেই স্মৃতিকে বিভাজন করার পীড়িত সময় তাদের কাছে তিনি বড় সরব এবং সরবতার গৌরব তিনি প্রজন্মক্রমে ভোগ করবেন ‘কালো বরফ’-এর জন্যে – তা তিনি যতই নীরব থাকুন না কেন।
‘কালো বরফ’ পাঠকের কাছে আসে ১৯৭৭-এ, সাপ্তাহিক পূর্বাণীর ঈদ সংখ্যায়; এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হওয়ায় তা আরও বেশি নিমগ্নতা লাভ করে। এই সাপ্তাহিক পূর্বাণীতেই আরও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি সৈয়দ শামসুল হকের ‘দূরত্ব’- বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে এটিও খুব আলোচিত হতে পারত, পারত ‘কালো বরফ’ও। আবারও বলি, পাঠক হিসেবে আমরা খুবই দীন, নির্ভর করি প্রচারণার ওপর, নিজেদের অনুসন্ধিৎসুতার ওপর নয়।
’৪৭-এর দেশ বিভক্তি আমাদের কথাসাহিত্যের জন্যে এক মারাত্মক দৈন্য নিয়ে আসে। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের কথাসাহিত্যিকদের তালিকা বিরাট এবং এখন যদিও তার একটি সমকালীন সমবায় তৈরি করা সম্ভব, তথাপি তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসায় শিল্পসফলতার বিশে¬ষণে এক বাক্যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ব্যতীত কারও নাম জোর গলায় বলা যাবে না। যদিও বিষয় ব্যাপকতার প্রশ্নে অনেকেই সংযোজিত হবেন। কিন্তু বিষয়গত ব্যাপকতার সীমানায় দেশবিভাগ খুব একটা টানাপড়েনের সৃষ্টি করে নি। ইতিহাসগত দৃষ্টান্ত অনুযায়ী, কথাসাহিত্যিকরা বাংলা ভাষার বিভক্তিতে খুবই উৎসাহী হন ‘ভেড়ার দলে বাছুর প্রামাণিক’ হওয়ার প্রবণতাক্রান্ত হওয়ায়। এমনকি ভাষার ওপর মারাত্মক রাষ্ট্রিক আঘাতও তাদের চৈতন্যদয় ঘটাতে পারে নি।
মাহমুদুল হকই প্রথম পরবর্তী প্রজন্মকে এবং নিজের প্রজন্মকেও এই গ্লানিবোধ থেকে মুক্ত করেন। দেশবিভাগে ছিন্নমূল এক মানুষের যাপিত জীবনের মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা বিচ্ছিন্নতাবোধকে একই সঙ্গে যাপিত সংলগ্নতাকে তিনি উন্মোচন করেন এবং কোনও রকম রাজনৈতিক ঘটনাকে পুঁজি না করেই এর ভয়াবহতায় ঠেলে দেন পাঠককে। এক অদ্ভূত আত্মনিমগ্নতায় তিনি কালো বরফ-এর কাহিনী নির্মাণে এগিয়ে আসেন এবং ক্রমশই মনে হয় এর নির্মাতা নেই। কাহিনীই কাহিনীর নির্মাতা :
খুব ছোটবেলায় আমার অভ্যেস ছিলো বুড়ী আঙ্গুল চোষার। কখনো ঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো-বা জানালায় একা একা ব’সে কেবল আঙ্গুল চুষতাম। আঙুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভালো লাগতো, ঠিক সে রকম কোনো ব্যাপার নয়। তখন ভালো লাগা বা মন্দ লাগা এ সবের কোন ঝক্কি ছিলো না, যতো দূর মনে পড়ে। পৃথিবী যে গোল, এইসব শুনে কান মাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা বিষম ব্যাপার। ভাবতাম আমরা তাহলে কোথায় আছি, তলার দিকে না ওপরের দিকে, তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝ’রে পড়ার কথা।
এরকম আত্মগত যার শৈশব, তার কাছে মূল্যবান সাধুখাঁদের ছেলে পাঁচুর দেয়া কাচের চুড়ির একটি শিকল। এই ধরনের বয়স তার- যার নির্মাণ মাহমুদুলের কাছে নিরীক্ষারও বটে। তার তখন মনে পড়ে রাণীবুবুর কথা, যে মাথায় ঠুশ দিয়ে তাকে ভয় দেখাতো কাল সকালে মাথায় দুটো শিং গজিয়ে যাবে। এবং, পড়তে পড়তে আমারও মনে হয়েছিল, ঠিক এইভাবে যদি কখণও লবণ ফেলে দিতাম তখন আমার মেজোবুবু ভয় দেখাতেন, ঠিকমতো লবণ তুলতে, কেননা তা না হলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ মানুষকে উবু করে ভ্রু দিয়ে বাধ্য করবে মাটির ওপর থেকে লবণ তুলে আনতে। শুনে চিন্তিত হতাম এবং পাকা মেঝেতে ধুলো ফেলে চেষ্টা করতাম ভ্রু দিয়ে ধুলো তোলার।
অতএব বলব, আত্মগত চেতনে শৈশব কৈশোর সম্পৃক্ত করতে অথবা জীবনের দুর্দমনীয় অসহায়ত্বের আত্মিকতার মূলে গিয়ে নির্ভরতা খোঁজার অনায়াসসাধ্য কাজটি একমাত্র মাহমুদুলের পক্ষেই সম্ভব। এমনকি যে হাসান আজিজুল হক শৈশবকৈশোরকে বিষয় অবলম্বন না করেই কথাসাহিত্যে অবাধ বিচরণ করেছেন, এই মুহূর্তে পত্রিকাটির নাম মনে পড়ছে না, সেখানে এক সাক্ষাৎকারে তিনিও বলেছিলেন, মানুষের সারা জীবনকে যদি একটি পাল্লায় আর শৈশবকৈশোরকে আরেকটি পাল্লায় তোলা যায়, তবে শেষেরটার ওজনই বেশি হবে। মাহমুদুলের কৃতিত্ব, সেই সময়টিকে তিনি আঙ্গিকগত পরীক্ষণে নিয়ে আসেন এবং পাঠকদেরও শৈশব কৈশোর তাড়িত করেন। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস নিরাপদ তন্দ্রা’র শেষের ক’টি পৃষ্ঠায় এই আত্মগত সত্ত্বা আবিষ্কারের বিষয়টি তিনি প্রথম উপস্থাপন করেন এবং কালো বরফ-এ তা বিশিষ্টতা পায়।
অনায়াসে আরও কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যায় :
তারপর ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে গাল থেকে আঙ্গুল বের করে বলতাম, ‘মাছ ভাই, মাছ ভাই, আমি যেন খুব শীগগির লাল মিঠাইওয়ালা হতে পারি। মাছ ভাই, মাছ ভাই, আমি যেন পানুদার মতো মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে সাদা, প্লান্ডু মানে পেঁয়াজ, এইসব পট পট বলতে পারি।
কিংবা,
মাঝে মাঝে হাতকড়া লাগানো কয়েদীর পালকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে নেওয়া হতো। মনি ভাইজান তখন রাস্তার ধার থেকে চেঁচিয়ে বলতো, ‘এই যে জামাই বাবারা, জিলিপি খাবে?’ মাঝে মাঝে টিপু ভাইজান এইসব ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ তুলতো, আব্বাকে দেখতাম বকাঝকা করতে। এমন ঘটলে মনি ভাইজান রেগে গিয়ে টিপু ভাইজানকে বলতো, দাঁড়া, তোর লাগালাগি আমি বার করছি। সব্বাইকে বলবো, তোর নাম দুদু।
বলাবাহুল্য দুদু টিপুর বিস্মৃতপ্রায় ডাকনাম। কিন্তু কালো বরফ বিশিষ্টতা পায় কি শুধু এই শৈশবতাড়নাতেই? না। এরপরেই মাহমুদুল তাঁর বিষয় উপস্থাপনার জন্যে লেখার আঙ্গিক বদলে ফেলেন এবং শৈশবের যে ‘আমিত্ব’কে লীন করে ফেলেন লেখক সত্ত্বার সঙ্গে সেই ‘আমি’কে তিনি সমকালীন তৃতীয় বচনে দেখতে থাকেন। সে তখন আবদুল খালেক হয়ে যায়, এক সন্তানের পিতা, জীবনযাপনে গতানুগতিক, কিন্তু স্বপ্নপীড়িত, অতীতাশ্রয়ী, অতএব উন্মূল এবং প্রবল বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রতীক অথচ পাশাপাশি বর্তমান সংলগ্ন। শালিক উড়ে এলে তার মনে হয় এটিকে তার মরে যাওয়া বোন তুলি ভেবে ছোটবেলা ফড়িং খাওয়াতো আর ভাঙা ঠ্যাং দেখে আবেগাপ্লুত হতো।
এরকম একজন আবদুল খালেক, যার ভেতরের ‘আমি’ হঠাৎ দেখে শৈশবের চিত্রপটে বেশ্যা মাধুকে আর মাধুর ভেতর থেকে কেঁদে ওঠা মাধুরীকে, সেই আবদুল খালেক স্ত্রীকে অনায়াসে মাধু-মাধুরাণী ডাকে আদর করে। এমনকি স্ত্রীর শৈশবের কথা ভেবেও কষ্ট পায়। শৈশবে মামীর অবহেলা আর অত্যাচারে বেড়ে ওঠা রেখা যার স্বপ্ন থাকে স্বামীর ঘরে গিয়ে মামীর সব কিছু ফেরৎ দেবে; অথচ সেখানেও আবিষ্কার করে অক্ষমতা – এই রেখাকে সে মাধু বলে ডাক দিতে চায়।
রেখা বললে, ‘মাধুরীটি কে?’
‘তা জানি না। মাধুরী বলে কেউ কোনোদিন বোধ হয় ছিল না। কেউ কোনোদিন তাকে দেখেনি, কেউ কোনোদিন তার নাম শোনেনি, বোধ হয় এই রকম-’ আবদুল খালেক বলতে থাকলো, ‘কিন্তু আমার মনে হয় সে আছে, হয়তো তুমিই মাধুরী, আমি চোখ খুলে দেখিনি, তাই চোখেও পড়েনি-’
এইভাবে মাহমুদুল হক তাঁর রচনায় একটি কমপ্লেক্স তৈরি করেন প্রথম পুরুষ ও তৃতীয় পুরুষের জবানবন্দিতে। তা অনিবার্য হয়ে ওঠে, কেননা আবদুল খালেক আর শৈশবে ফিরে যেতে পারে না, এমনকি সে অনুভব করে শৈশব থেকে পর্যায়ক্রমিক যে মানব প্রকৃতির বিকাশ তার তাও নেই – সে নেহাৎই বাস্তুহারা। কিন্তু আবদুল খালেক চাইলেও তার শৈশবের ভৌগলিক সীমানায় যেতে পারে না, যেতে পারে না, কেননা শুধু স্থানের সঙ্গেই মানুষের সম্পর্ক থাকে না, থাকে মানুষের সঙ্গে মানুষের। আর তার সেই প্রিয় মানুষগুলিও নেই। তা ছাড়া যে পথ দিয়ে তার আসা সেই পথও তো আর আগের মতো নেই।
বেশ দূরে সরে গেছে পদ্মা। পালতোলা নৌকার বহর আবছা আবছা দেখা যায়। যা ভেবেছিল এখন আর তার কিছুই নেই। হাজা মজা, শুকনো। এই লৌহজং নামটা তার মাথার ভেতরে, অন্ধকারে দোলা দূর নৌকায় বাতির মতো এখনো টিপ টিপ করে জ্বলে। গোয়ালন্দ, আরিচা, ভাগ্যকুল, তারপাশা, ষাটনল, এই নামগুলোর ভেতরে এখনো সে দারুণ এক দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়।
ভাবতেই পারেনি আবদুল খালেক, এমন ভাবে তাকে হতাশ হতে হবে। তার সব উৎসাহে ভাটা পড়ে। কেন এল এত দূর, শুধু একটা নামের জন্যে, লৌহজং একটা নাম, এই নামের জন্যে!
আবদুল খালেক, এক নিরীহ অধ্যাপক আবদুল খালেকের জন্যে কাল তো থেমে থাকার কথা নয়। তবু সে সকলের ভেতরেই একটা আলাদা সংসার আবিষ্কার করে, সে সংসারে খেলার পুতুলের জন্যে সর্বস্ব চলে যায়, একটুকরো ভাঙা কাঁচের জন্যে বুকভাঙা কান্না ওঠে, কাগজের নৌকো ডুবে গেলে নিঃস্ব হয়ে যায়। এই বিশাল জগতে এই আলাদা সংসার চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে আবদুল খালেক আসলে কোনওখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রেখা উদ্বিগ্ন হয়, নরহরি কবিরাজ উদ্বিগ্ন হয়, কোথায় থাকে সন্তান টুকু, রেখা আবদুল খালেকের মধ্যেই প্রতিক্ষণ সেই টুকুকে আবিষ্কার করতে থাকে। আবদুল খালেকের ভেতরে টুকুকে নির্মাণের শর্ত তৈরি করেন মনি ভাইজান, যে মনি ভাইজান ঝগড়া করে ছবিদির সঙ্গে, আবার ভালোওবাসে তাকেই,
সেই সে বছর, যে বছর উল্টাপাল্টা খুব ঝড় গেল, পুকুর পাড়ের বাতাবী নেবু গাছটা প’ড়ে যায়, টিন প’ড়ে সুকদেবের মার পা কেটে গিয়ে ছিল, রজনি ভেন্ডারের অমন জোয়ান মেয়েটা কলেরায় মারা যায়, মনি আমার কোলে এলো’ – মা বলতেন এই ভাবে। তা ও ছেলে তো আমার ধুলোয় ঘোঁটা কেটে মানুষ! না পেয়েছে আদর, না যত্ন। বছর না ঘুরতে কোলে এলো। টিপুর পিঠোপিঠি। কাকে দেখি, কাকে ধরি, একলা মানুষ একটা গামছা বিড়ে পাকিয়ে মাথার নিচে দিয়ে মেঝেয় শুইয়ে রাখি, একা একা হাত পা ছুঁড়ে খেলা করে। ক্ষিদে পেলে কাঁদে, পেট ভরা থাকলে ঘুমিয়ে থাকে, বড় অবহেলায় মানুষ হয়েছে ছেলেটা-’
মা’র সে বলা ছিল কত সুন্দর। ‘ও আমার কোলে এলো’- একটা গানের কলি। আজ এই ভর দুপুরে, গরীব বৌনা গাছে নীচে দাঁড়িয়ে এক অস্থির খালেক, রেখা যাকে স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে আব্বা বলে জানে, হু হু করে কেঁদে ফেললো। এতদিন পর, কোন এক অজ্ঞাত কারণে, ঝির ঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গানের এই কলিতে ভর দুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে। সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ মুছে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলি মনে হয়, কৈ, কোথাওতো কোন দাগ লেগে নেই!
তার শৈশবেই সে ধীরে ধীরে এক সময় বুঝতে পারে সে একজন মুসলমান। তাকে পাকিস্তান চলে যেতে হবে! না, মাহমুদুল, আমি আগেই বলেছি, কোন রাজনৈতিক বলয় তৈরি করেন নি, আসলে তার প্রয়োজনই পড়ে নি। সম্প্রতি ‘বিচিত্রা’ পর পর ক’টি ঈদসংখ্যায় শওকত আলীর কয়েকটি উপন্যাস ছেপেছে, দেশবিভাগ তাঁরও উপন্যাসের বিষয়। কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিস্তৃতি তার শিল্পযাত্রাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তুলনায় মাহমুদুল অনেক বেশি উজ্জ্বল,
মনি ভাইজান চুপি চুপি আমাকে বললে, পোকা শোন, আমার সঙ্গে চল, কাজ আছে। আমি মনি ভাইজানের চোখ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার হাত ধরে মনি ভাইজান দৌড়–তে শুরু করলো। বললে আরো জোরে জোরে ছোট, পা চালা। বার বার আমি পিছনে পড়ে যাই। মনি ভাইজান আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। ধমক মারে আর বলে, এক গাট্টা মেরে খুলি উড়িয়ে দেব তোর মাথার, শুয়োর কোথাকার, আরো জোরে দৌড়া, আরো জোরে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আমি দম নেই, আবার ছুটতে থাকি, ছোটা যেন আর শেষই হয় না। শেষে ছবিদি’দের বাগানে পৌঁছে আমরা থামি। মনি ভাইজান বললে, একটু জিরিয়ে নে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলবি না, বলবি রাণীর কথা, রাণী একটা বই নিয়ে পাঠিয়েছে। চুপি চুপি ছবিকে বলবি আমার কথা, আমি এইখানে। পারবি তো? … … …মনি ভাইজান বললে, আমাকে কিছু দাও ছবি, আমাকে কিছু দাও। উঠে দাঁড়িয়ে ছবিদি বললে, কি নেবে মনিদা, কি নেবে তুমি? মনি ভাইজান বললে, তোমার যা খুশি, যা দিতে পারো, হাতে সময় নেই, দেরী হয়ে যাচ্ছে, দাও। ফস্ করে মাথা থেকে ফিতা খুলে দিল ছবিদি। বললে, এটা নেবে? মনি ভাইজান ভিক্ষা নেয়ার মতো দু’হাত পেতে বললে, তোমার মাথার কাটা, ক্লিপ, যা পার, সব দাও। ছবিদি দিল। দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। বললে, মনিদা আমি মরে যাব, আমি মরে যাব।
এইসব মনে করতে করতে আবদুল খালেক কাঁদতে থাকে। রেখা তাকে বলে, কাঁদছো কেন? কিন্তু আবদুল খালেক মনে করতে পারে না। মাহমুদুল হকের এই চরিত্র ক্রমে ক্রমে উপলব্ধি করে মুসলমানিত্ব বোঝার সঙ্গে সঙ্গে, স্টিমার পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে আসতে আসতে তার আর মনি ভাইজান দু’জনের তার ছিঁড়ে গেছে। আর জোড়া লাগে নি। লাগবেও না। লাগে নি বলে মনি ভাইজান আত্মহত্যা করেছে আর তার করণীয় উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা ক্রমাগত কাঁদাচ্ছে তাকে। সে কাঁদছে আর স্মৃতিপীড়িত প্রলাপে মগ্ন হয়ে যাচ্ছে।
রেখা বললে, ‘থাক, তুমি চুপ করো, ঘুমোও, তুমি যে কী-’ আর কোন কথা বললে না আবদুল খালেক। এক সময় বোধ হয় তার তন্দ্রা এলো। ঘুমোবার আগে রোজ যা হয়, সেই হাত-পা মুড়ে, হাঁটু দ- ক’রে টুকুর মতো এই এতোটুকু হয়ে গেল সে। তারপর একসময় হাতড়ে হাতড়ে রেখার একটা পায়ের ওপর হাত রেখে সে বললে, আমাকে কোলে নাও না মাধুরী-’
মাহমুদুল হকের কালো বরফ এখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তার অনুক্ত শ্রুতিতে আমরা অনুভব করি শৈশব কৈশোর স্মৃতির রহস্যময় শক্তিমত্তায় গড়া বিচ্ছিন্নতা ও সংলগ্নতা যা পুনরায় মানুষকে শিশু করে দেয়, যা মানুষকে পুনরায় নির্মিত হবার জন্যে নির্ভরতা খোঁজায়। এবং এ স্বীকারোক্তি দেয়াও বোধকরি অতিশয়োক্তি হবে না, যে-কোনও পরিণত পাঠকের চোখকেও তিনি আবেগাশ্রিত করার মতো ভাষা গঠনে সমর্থ হয়েছেন এ উপন্যাসে।
পরিণত বয়সের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে পাওয়া আরও একটি স্বীকারোক্তি দিয়ে রাখি প্রসঙ্গত। একবার যখন আমি গ্রামের বাড়িতে, আমার বন্ধুরা ছড়িয়েছিটিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে, হঠাৎ একদিন সড়কের ধারে একটি গাড়ি থামল। একটি সালোয়ার কামিজপড়া মেয়ে নামল, শীতবিকেলে একটি কালো শালে গা জড়ানো তার। পরপরই নামলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। পরিচয় দিলেন, এখানে তার বাবার বাড়ি, ‘৪৮-এ চলে গেছেন পশ্চিমবঙ্গে। তিনি নিজে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় কী এক কাজে এ দেশে এসেছেন, সঙ্গে মেয়েও এসেছে দাদার বাড়ি দেখতে। উচ্চপদস্থ বলে অসুবিধা হয় নি, প্রাইভেট কার সংগ্রহ করে চলে এসেছেন ঢাকা থেকে। বেশিক্ষণ থাকলেন না, ঘন্টাখানেক। ভদ্রলোক নিজে দেখলেন, মেয়েকে দেখালেন, মেয়েটির এখানে তেমন কোনও স্মৃতি নেই, গাড়িতে উঠতে গিয়ে স্মিত হেসে বলল, ‘আসি’। কিন্তু ভদ্রলোক কিছু বললেন না, কিংবা বলতে পারলেন না, চোখ মুছতে মুছতে গাড়িতে উঠলেন।
আর আমি তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের শীতলতায় সজ্জিত, অন্ধকারের অতলতায় নিমজ্জিত স্মৃতিময় কালো বরফের খেলাঘর চলন্ত গাড়ির উত্তাপে গলে যাচ্ছে, পরমুহূর্তেই পিছনে উড়তে থাকা ধুলি ও ধোঁয়া তাকে শুষে নিচ্ছে।