যে মা’কে আমাদের নৃতত্ত্ববিদরা আর ক’দিনের মধ্যেই খুঁজে ফিরবেন শামসুর রাহমানের কবিতায় (কেননা তা বাদে এই মায়ের প্রতিকৃতি আর কোথাও রইবে না ‘উন্নয়ন আর ক্ষমতায়নের’ বাঁধভাঙা জোয়ারে), সেই মায়ের প্রচ্ছায়া কোনও কোনও গাঢ়তর দুর্বল মুহূর্তে আমাকে অশ্রুবিদ্ধ করে। জেন্ডার সমতার ইচ্ছাকৃত জটিল সমীকরণ নিয়ে বসলে শামসুর রাহমানের আঁকা এই মায়ের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, কেউ তো অবশ্যই বলতে পারেন পুরুষতন্ত্রের পিছুটান আর মাদকতা মেশানো উল্লাস রয়েছে তাতে। কিন্তু মানুষকে লুপ্ত নাশপাতির ঘ্রাণ বরাবরই মুগ্ধ করে, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদের সৌগন্ধে যত সামন্ত্রতান্ত্রিকতার প্রচ্ছায়াই গবেষকরা দেখুন না কেন, শেষ পর্যন্ত নগ্ন নির্জন হাতের স্পর্শই মানুষকে গুড়িয়ে দেয় ভেতর থেকে। কতদিন যে আমি কখনও আমার মাকে কোনও গান গাইতে শুনিনি পড়তে পড়তে ভেতর থেকে শূন্য হয়ে গেছি, কতদিন যে মা’কে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে/ ছায়াবৃতা আপন সংসারে মন্ত্রের মতো মনে করতে করতে শপথ নিয়েছি নিজের জগতকে মা’র মতো সীমিত করে তার ভেতরেই অসীম হয়ে ওঠার মতো একাগ্রতার দীক্ষা নিতে… ততদিনই ব্যর্থতার ঝাপট এসে নিক্ষিপ্ত করেছে ফের শূন্যতার মধ্যে। সেই অনন্ত ব্যর্থতার শিখরে দাঁড়িয়ে অবনত চোখে আবারও চোখ মেলতে হয়েছে শামসুর রাহমানেরই কবিতায়,- দেখি, পাওয়া যায় কী না একাগ্রতার কোনও উৎস! তিনি মা’কে দেখি। আজো দেখি কী এক মায়ায়/ পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়/ দু’বেলা আবেগ ভরে।… লিখতে লিখতে আমাদের ছুঁড়ে দেন এক প্রতীকী অক্ষমতার মধ্যে। সেই অক্ষমতা প্রতিদিন অনুভব করি আমি। পাখি,- মুক্তি কিংবা স্বাধীনতার অনন্য প্রতীক বলে যাকে সম্ভবত সেই অনাদীকাল থেকেই ভাবতে শিখেছে মানুষ, সেই প্রতীককে তিনি দেখেন এবং তাঁর সঙ্গে আমরাও দেখি উড়ে এসে বসতে আপন সংসারে ছায়াবৃতা মায়ের হাতে এবং আমরা সীমার বৃত্তে অসীম সে হাতের তালুবন্দি পাখির সঙ্গে প্রত্যক্ষ করি নিজেদের অক্ষমতাও,- কেননা বেড়ে ওঠার স্পর্ধায় স্পর্ধিত আমরা পাখির মতো অনায়াসে আর ফিরে এসে বসতে পারি না আমাদের উৎসে। হয়ত আমাদের এই না-ফিরতে পারার অক্ষমতাই আসলে আমাদের মুক্তিকে খণ্ডিত করে রেখেছে, আমাদের স্বাধীনতার অনাবিল আস্বাদ থেকে দূরে রেখেছে। শামসুর রাহমান এক সমগ্রতার মধ্যে দিয়েও অকস্মাৎ সেই খণ্ডিত হওয়ার অনুভবে নিয়ে যান আমাদের এবং তারপর যোগান প্রত্যাবর্তনের সমূহ প্রণোদনা।
সাধারণত আমরা বাঙালি মধ্যবিত্তরা মুখে রাজাউজির মারি, সততার পরাকাষ্ঠা দেখাই; কিন্তু যখন সত্যি সত্যি রাজাউজিরের বিরুদ্ধে কথা বলার প্রয়োজন হয়, যখন সততার পরাকাষ্ঠা দেখানোর প্রয়োজন হয় তখন আমাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু শামসুর রাহমান সেরকম বদ্ধ জলে আস্ফালন দেখান না, শাদা চোখে মনে হয় তাঁকে পলায়নপর, কেননা সবার সঙ্গে তিনি অযথাই গলা মেলান না, তাঁকে এ দেশে একটি সংগঠিত তো বটেই অসংগঠিত গোষ্ঠীর ক্ষুব্ধবিক্ষুব্ধ মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালান সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে। অথচ যখন দরকার হয় তখন এই রাজাউজির মারা মানুষদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু এই ‘মেরুদণ্ডহীন’ মানুষ হিসেবে পরিচিত মধ্যবিত্ত মানুষটিই উঠে দাঁড়ান, আমরা দেখি মেরুদণ্ড প্রকৃতার্থে কতটা ঋজু করা যায় এবং আমরা শিখি নিজেদেরও দ্বিধাহীনভাবে প্রতিবাদী করে তুলতে। নির্ঝঞ্ঝাট কিন্তু আত্মসমালোচিত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্যে তিনি নিজের গোত্রে সমালোচিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন। আমাদের মনে আছে, তিনি পদত্যাগ করেছিলেন সেই ২০০১-এর অক্টোবরে, মৌলবাদবিরোধী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংগঠনের দায়িত্ব থেকে এবং বলেছিলেন, চক্রান্তকারীদের মুখোশ উন্মোচনেরও আগে প্রয়োজন আমাদের নিজেদেরই আত্মসমালোচনা করার। তাঁকে হত্যাচেষ্টার মামলা আপনাআপনি খারিজ হয়ে গেছে, কেননা উপস্থিত হয়ে তিনি তাঁর উত্তরাধিকারদের জীবনের ঝুঁকি আরও বাড়াতে চান নি। এ সবই সাধারণ মানুষের মতো চাওয়া, এই আকাক্ষার পরিব্যপ্তিই তাঁকে নিয়ে গেছে এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে। রাজরোষের মুখে কেউ মহাকবি ফেরদৌসের পরিণতি পায়, শামসুর রাহমান বরাবর সেরকম পরিণতি পেয়েছেন। আমরা চর্বিত চর্বনে তাঁকে অপবাদ দিতে পারি, তিনিই তো শামসুর রাহমানের মনোনীত কবিতা শিরোনামে এরশাদের কবিতা ছাপিয়েছিলেন। কিন্তু সে সত্যের চেয়েও তো অসীম ক্ষমতাধর এই সত্য,- মানুষ যখন প্রতিবাদের সম্মিলিত অনুভব প্রকাশের জন্যে একটি স্বরের প্রত্যাশা করছিল তখন তিনিই সেরকম স্বর হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, লিখেছিলেন বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে এ দেশের প্রতিটি আন্দোলনে এরকম শিল্পিত হয়ে আর কে স্পন্দন জাগাতে পেরেছে? একুশ বাঙালির মনোজগতে ভাঙনের পদধ্বনি শুনিয়েছিল আর সত্তরের মহাপ্লাবন শুনিয়েছিল সর্বস্তরব্যাপী ভাঙনের আগমণী, সেই ভাঙনের কালপঞ্জীও তৈরি করেন তিনি, লেখেন দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত মৌলানা ভাসানীর কথা,- …রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,/যেন মহা-প্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ/ সহযাত্রীদের মধ্যে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি/ উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে।…’ এবং ‘সবাই দেখলো চেনা পল্টন নিমেষে অতিশয়/ কর্দমাক্ত হয়ে যায়, ঝুলছে সবার কাঁধে লাশ।/ আমরা সবাই লাশ, বুঝি-বা অত্যন্ত রাগী কোনো/ ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত/ চকিতে করেছে ধ্বংস, পড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা।… ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ ঢেকে দেয়ার জন্যে ব্যাকুল এই শিল্পিত ভাসানী থেকে শুরু করে আসাদের শার্ট কোথায় তিনি অনুপস্থিত? তিনি লিখেছেন বন্দি শিবির থেকে এবং তারপরও থেমে যান নি। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ তো তিনি এমন সময়েই লিখেছেন যখন আমরা আবারও সংগ্রাম শুরু করেছি আমাদের সেই পুরানো শত্রুদের সঙ্গে, সে শত্রুর কেউ মৌলবাদের ধ্বজাধারী, কেউ সামরিকতন্ত্রের লেবাসপরিহিত। যে প্রাতিষ্ঠানিকতায় তাঁর বসবাস, তা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি দ্বিধা করেন না প্রয়োজনে। যেমন করেন নি বাংলা একাডেমীর সভাপতি পদ কিংবা নির্মূল কমিটির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে। মাওসেতুং-এর মতো বিপ্লবী নন তিনি, কিন্তু তাঁর জীবনের এই ব্যবহারিক দিক স্মরণ করিয়ে দেয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে মাও-য়ের বেছে নেয়া ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত। রাজনীতি থেকে দূ
রে থেকেছেন তিনি; কিন্তু রাজনীতির সাংস্কৃতিক আকরকে স্বচ্ছতোয়া রাখতে তাঁর এই নিজেকে অতিক্রম করে ওঠা আমাদের বার বার বিস্মিত করেছে। যে রাজনৈতিক কালপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতিগত চেতনা অর্জন করতে থাকে, স্বাধীনতার সংগ্রাম রচিত হতে থাকে, স্বাধীনতাও আসে, আবার সে স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এই রাজনৈতিক কালপ্রবাহকে তিনি রাজনীতির বৃত্ত থেকে টেনে বের করে এনেছেন এবং শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার মধ্যেও সেই রাজনৈতিক কালপ্রবাহকে পরিভ্রমণ করতে শিখিয়েছেন। এভাবে দেখতে গেলে, হয়ত কথাটা শুনতে খারাপ লাগবে কিন্তু একেবারে নির্জলা সত্য, রবীন্দ্রনাথ যেমন বেঁচে থাকবেন বাংলা ভাষার শেষ দিন অবধি, তেমনি শামসুর রাহমানও বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের সমান বয়সী হয়ে। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে তিনি মধ্যবিত্তের খোলস ঝেঁড়ে ফেলে অচেনা এক মানুষ হয়ে উঠেছেন রাজাউজির বধ করা সব মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের স্তম্ভিত করে দিয়ে এবং একটি বিশাল ক্রমসম্প্রসারিত শ্রেণীর প্রতিটি মধ্যবিত্তকে এভাবে শক্তি যুগিয়েছেন অচেনা এক প্রতিবাদী মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার,- যে প্রতিবাদী মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ পাওয়া যায় একমাত্র ফরাসী বিপ্লবের মধ্যবিত্তের মধ্যে।
আর তাঁর ব্যক্তিক সারা জীবনের আত্মসমালোচনা তো তিনিই করেছেন কখনও আত্মকথনে, কখনও কবিতাতে। দুঃস্বপ্নে একদিন সেরকম কবিতা যাতে তিনি ছিঁড়েখুঁড়ে দেখান নিজের শ্রেণীঅবস্থান এবং দুঃসময়ে মুখোমুখির মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে যান তাঁর আত্মপীড়নের বোধিসত্ত্বায়। তাঁর ভেতরে ঘুমন্ত এক মানুষের ক্রন্দন শুনি আমরা, বাচ্চু তুমি, বাচ্চু তুই, চলে যাও চলে যা সেখানে/ ছেচল্লিশ মাহুৎটুলীর খোলা ছাদে। আমি ব্যস্ত, বড়ো ব্যস্ত,/ এখন তোমার সঙ্গে, তোর সঙ্গে বাক্যালাপ করার মতন/ একটুও সময় নেই। কেন তুই মিছেমিছি এখানে দাঁড়িয়ে/ কষ্ট পাবি বল?’ নিজেকে চেনান তিনি, উজাড় মাইফেলের প্রেত ঘুরি হা-হা বারান্দায়।/ এখন আমিও খুব সহজে ঠকাতে পারি, বন্ধুর নিন্দায়/ জোর মেতে উঠতে লাগে না দু-মিনিটও, কখনো-বা/ আত্মীয়ের মৃত্যু-কামনায় কাটে বেলা, পরস্ত্রীর/ স্তনে মুখ রাখার সময় বেমালুম ভুলে থাকি/ গৃহিণীকে। আমাকে ভীষণ ঘেন্না করছিস, না রে?/ এখন এইতো আমি। চিনতিস তুই যাকে সে আমার/ মধ্য থেকে উঠে/ বিষম সুদূর ধু-ধু অন্তরালে চ’লে গেছে। তুইও যা, চ’লে যা। নিজেকে ছাপিয়ে উঠতে না পারলে কি সম্ভব নিজের কৈশোরক নামের কাছে এই আত্মক্রন্দনের মধ্যে দিয়ে নিজেকেই সমালোচিত করা? এমনকি এখন তো পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে তাঁর আত্মকথা, সেখানে অনেকখানেই আছে এমন সব স্বীকারোক্তি, পাবলো নেরুদার আত্মকথায় যা আছে জন্যে আমরা বা আমাদের বন্ধুরা যৌবনে নেরুদার বন্দনা করেছি। যা কিছু ঈর্ষার বা সন্দেহের, সমালোচনার বা ধিক্কারের তা কেবল সমকালের মানুষকে পীড়িত করে, ক্রুদ্ধ করে; সমকাল ছাপিয়ে ভবিষ্যতের খাতায় তার ঠাঁই হয় টীকা বা টিপ্পনী হিসেবে, তুলনামূলক মূল্যায়নের উপাদান হিসেবে। শামসুর রাহমানের তাঁর আত্মকথনের মধ্যে দিয়ে নিজেকে জীবৎকালেই মীমাংসিত করে রেখে যাচ্ছেন, দেখি তিনি নিজেকেই নিজে ছিঁড়েখুঁড়ে এইসব বলছেন:
…লুকাবো না, সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে ভালো লাগলো। প্রথম দিকে ঘোরের মধ্যে কাটলো, কিন্তু বেশ কিছু সময় কাটার পর, কোনো কোনো সমস্যা, বিশেষ করে মাইনে বাড়াবার তাগিদে আমি ক্রমাগত উৎপীড়িত হ’তে লাগলাম।.. তবে কেউ কেউ বলতে পারেন, অফিসের মোটরকারে সওয়ার হয়ে নানা জায়গায় চলে যাওয়া, প্রায়শ বিভিন্ন জমকালো নৈশ পার্টিতে সময় কাটানো তো তোফা ব্যাপার। কিন্তু কিছুকাল পর এগুলো কেমন ফাঁপা, ফাঁকা মনে হয়। আবার এমন অভ্যাস হয়ে যায় যে, সহজে সেই আকর্ষণীয় চক্র থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল। আমিও রীতিমতো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম নৈশ আসরে।.. প্রেসিডেন্ট এরশাদ শুধু হাতে রাইফেল তুলে নেননি, পদ্য লেখার কলমও তুলে নিতেন অবসর মুহূর্তে। এবং তাঁর এই কাব্যচর্চা আমাকেও ফ্যাসাদে ফেলেছিলো, যখন আমি ‘দৈনিক বাংলা’ এবং ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক ছিলাম। ‘বিচিত্রা’র যোগ্য, চটপটে প্রধান সাংবাদিক শাহাদাৎ চৌধুরীর হঠাৎ কী খেয়াল হলো ‘বিচিত্রা’র একটি পাতায় কবিতা ছাপা হবে ‘শামসুর রাহমান নির্বাচিত কবিতা।’ তাড়াহুড়োর মধ্যে কোনো ভাবনা চিন্তা না ক’রেই শাহাদাৎ চৌধুরীর প্রস্তাবে সায় দিয়ে ফেলি। ভেবে দেখা হলো না, যেহেতু ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক হিশেবে আমার নাম ছাপা হয়, সব রচনাই তো আমার নির্বাচিত। যাই হোক, এই ভুলের খেসারত আমাকে দিতে হয়েছে বহুদিন। হয়তো এখনো কেউ কেউ আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন সে জন্যে। .. এখানে উল্লেখ করতে চাই, অনেক পরে যখন আমি আর দৈনিক বাংলা/বিচিত্রার সম্পাদক নই এবং তিনিও নন বাংলাদেশের হর্তাকর্তা, তাঁর প্রকাশিত দৃষ্টিনন্দন একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে উপহার হিশেবে পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁর এই সৌজন্য, স্বীকার করছি, মুগ্ধ হয়েছিলাম।
এরকম সব স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে, কিংবা এরকম কোনও কবিতার মধ্যে দিয়ে শামসুর রাহমান হয়ে ওঠেন সেরকমই সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়ানো মানুষ, যে মানুষের নিপাট সাধারণত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে এক মহৎ শিল্পীর সহজাত সব আবেগ, যার জোরে সে শ্রেণীবিত্ত অতিক্রম করে প্রতিবাদী মানুষেরও প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে এবং সাধারণ মানুষের কাতারে খুবই অনায়াসে নেমে আসতে পারে। তাঁর কাছে থেকে আমরা শিখি সেই অসাধারণত্ব, সেই ক্ষমতা যা দিয়েই কেবল সম্ভব একেবারে চূড়ান্ত ক্রান্তিকালে সঠিক পথটি বেছে নেয়া, মধ্যবিত্তসুলভ সব দোদুল্যমানতা অতিক্রম করে সকলের আইকন হয়ে ওঠা কিংবা সকলের সঙ্গে পা ফেলা। যে ক্ষমতা সংবিদ্ধ থাকে তলস্তয়ের ভেতর, পুশকিনের ভেতর, রবীন্দ্রনাথের ভেতর, শামসুর রাহমানও সেরকম অপরিহার্য হয়ে ওঠেন আমাদের প্রতি আন্দোলনে, প্রতি প্রতিবাদে। তাঁর কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা যত নাগরিকতা, নাগরিক নিঃসঙ্গতা একসময় আকুলতার মতো আরও মহীয়ান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অনুষঙ্গ শৈল্পিকভাবে ধারণ করার অভিযাত্রা শুরু করার মধ্যে দিয়ে। তাঁর কবিতার কমনীয় আদলের মধ্যে থেকে আমাদের গায়ে এসে লাগে নগরের আঁচ, তিনি কবিতার নগরায়ণ ঘটান মুহুর্তের মধ্যে ধুধু মাঠে শব্দের নাগরিকতা দিয়ে, আবার সেই নগরকেই তিনি পরম আশ্রয়ী করে তোলেন শব্দের ক্ষিপ্র বোধন দিয়ে। তাঁর যৌবনের যে এক প্রিয় বান্ধব, যিনিও অমরতা পেয়েছেন বাংলা কবিতায় নাগরিকতার বোধ তৈরি করে, সেই শহীদ কাদরীকে তিনি যে কবিতায় স্মরণ করেন, সেই হরতাল কবিতা এই ঢাকা শহরের প্রতিটি হরতালে আমাদের মনে হঠাৎই ভেসে আসে : দশটি বাঙময় পঙ্ক্তি রচনার পর একাদশ পঙ্ক্তি নির্মাণের আগে/ কবির মানসে জমে যে-স্তব্ধতা, অন্ধ, ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্র/ থাবা থেকে গা বাঁচিয়ে বুকে/ আয়াতের নক্ষত্র জ্বালিয়ে/ পাথুরে কণ্টকাবৃত পথ বেয়ে ঊর্ণাজাল-ছাওয়া/ লুকনো গুহার দিকে যাত্রাকালে মোহাম্মদ যে-স্তব্ধতা আস্তিনের ভাঁজে/ একদা নিয়েছিলেন ভ’রে,/ সে স্তব্ধতা বুঝি/ নেমেছে এখানে। ইতিহাসমুখর এই ঋজুতা কিন্তু জীবনানন্দে নেই, যদিও জীবনানন্দে রয়েছে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি ইতিহাসকাতরতা। মিথ আছে, আছে রুক্ষপাথুরে জমিনে সেই মিথ ব্যবহারের সফল সব উদাহরণ, শামসুর রাহমানের মিথ জীবনানন্দ কিংবা বিষ্ণু দে’র কবিতার মতো নয়, মিথকে তিনি জারিত করতে পারেন হেনরি মুরের আধুনিক শিল্পভঙ্গিমার সঙ্গে, তাঁর মিথ গড়িয়ে যায় না স্নানের জলের মতো। জীবনানন্দ যেমন নজরুলকে অতিক্রম করে আসেন, শামসুর রাহমানও তেমনি তাঁর প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে অতিক্রম করে আসেন। তিনি বাংলা কবিতায় নাগরিকবোধের সমার্থক হয়ে ওঠেন এবং এভাবে বাংলা কবিতার এক বিচেছদপর্বের পুরোধা হয়ে ওঠেন। এটি হলো সেই বিচ্ছেদপর্ব যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশই বাংলা ভাষার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
এবং তাই যতদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বেঁচে থাকবে, ততদিন শামসুর রাহমানও বেঁচে থাকবেন আমাদের সমালোচনার কিংবা মুগ্ধতার তোয়াক্কা না করে।
২০০৩ সালে শামসুর রাহমানের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলন প্রকাশিত সংকলনে প্রকাশিত একটি লেখা।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
mahtab - ২৪ অক্টোবর ২০০৮ (৮:২৬ অপরাহ্ণ)
খুবই ভাল লাগল ।
রেজাউল করিম সুমন - ১৩ ডিসেম্বর ২০০৮ (৯:০৪ অপরাহ্ণ)
এ নিয়ে কয়েকবার পড়লাম এই লেখা।
কণ্ঠশীলন-এর সংকলনটি দেখিনি। মুক্তাঙ্গনে এ লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত না হলে আমি বঞ্চিত হতাম। ওই সংকলন এখনো কিনতে পাওয়া যায় কি?
সা্ইদুল ইসলাম - ১৮ আগস্ট ২০১২ (৩:০০ পূর্বাহ্ণ)
মন ভরে গেল। মনে মনে হয়তো এমন একটি লেখা পাঠের জন্যই প্রত্যাশা ছিল। ধন্যবাদ শামীম ভাই। শামসুর রাহমানের মিথের ব্যবহার নিয়ে আরো বিশদ আলোচনা হতে পারে। অপেক্ষায় রইলাম। এই মুহূতে আমার প্রিয় একটি বই ‘ইকারুসের আকাশ’খুব মনে পড়ছে।
রায়হান রশিদ - ১৮ আগস্ট ২০১২ (৫:০০ অপরাহ্ণ)
‘সাধারণ’ কাকে বলে? অসাধারণ কিসে হয়? কিছু মানুষ সময়কে ছুঁয়ে দিয়ে যান তাদের সারা জীবনের কাজ দিয়ে। আর, সাধারণ আমাদের অসাধারণকে চিনতে দেরী হয়ে যায়!