[নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আরমান রশিদের পোস্টটি পড়লাম। একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাতের জন্য লেখককে ধন্যবাদ। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক এবং জরুরী বলেই প্রত্যুত্তরটি আলাদা পোস্ট হিসেবে ছাপতে ব্লগ প্রশাসককে বিনীত অনুরোধ করছি — লেখক]
আরমান রশিদ,
আপনার সুলিখিত পোস্টটি পড়লাম। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আপনি খানিকটা আশংকিত এবং কিঞ্চিত হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন জেনে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সেই সঙ্গে এও লিখেছেন যে – মহাজোটের বিজয়ে আপনি “হাঁফ” ছেড়ে বেঁচেছেন। যদি আপনার বক্তব্য অনুযায়ী দু’টি “evil” এর মধ্যে একটিকে আপনি বেছে নিতে বাধ্য হয়ে থাকেন (যদিও আপনি কাকে ভোট দিয়েছেন সেটি স্পষ্ট নয়), তাহলে সংগত কারণেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচার কোন কারণ ঘটেনা। সেক্ষেত্রে, দু’টি evil এর মধ্যে আপনি আদৌ কোন পার্থক্য করেন কিনা, করলে কেন করেন, এবং আপনার বর্ণিত “শুষ্ক মুখ তরুণেরা” সেই পার্থক্যটি করে ঠিক করেছেন কিনা, সেটি যদি একটু পরিষ্কার করে বলতেন তবে আমাদের জন্য আলোচনার আরেকটু সুযোগ তৈরী হোতো।
দেখতে পাচ্ছি “lesser of two evils” তত্ত্বটিতে আপনার প্রবল আপত্তি। আমারও। তবে সেটি তত্ত্বটি ইংরেজীতে বলে নয়। একটি বাংলা তত্ত্ব দিই – “মন্দের ভাল” – একেবারে খাঁটি বাঙ্গালী তত্ত্ব। তবে তাতে আপনার বা আমার কারোই আপত্তি (যদিও আশংকা করছি সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন কারণে) কিছু কমবে বলে মনে হয়না। এটি কেউ বলতেই পারেন যে বাংলাদেশের জনগণ এবার ভোটের মাধ্যমে “মন্দের ভালোটিকে” বেছে নিয়েছেন। এই তত্ত্বটির অসুবিধে একটিই। সেটি হল “মন্দের ভালো” বেছে নিতে কেউ ৮৫% আসনে কাউকে বিজয়ী করেনা, ১০% এরও কম আসনে কাউকে পরাজিত করেনা। আমার মনে হয়েছে এবারের ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আসলে পরাজিত করেছে কিছু চিহ্নিত শক্তিকে। এরা হল – মৌলবাদী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি, দূর্নীতিবাজ শক্তি, দাড়ি-টুপি-শিফন-সাফারীধারী নানান পদের ধর্ম ব্যবসায়ী শক্তি। আর রায় দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে, মানবতার পক্ষে। এই নিয়ামকগুলোর প্রতিফলক হিসেবে আওয়ামী লীগই কেন আবির্ভূত হল (হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের এককভাবে ২২০টিরও বেশী আসন সেই ইঙ্গিতই দেয়) তা নিয়ে আপনার মনকষ্ট থাকতেই পারে, কিন্তু সেটিই বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী কৌশলকে আপনি “দেহপসারিণীর দেহ ব্যবসার” সাথে তুলনা করেছেন। নিজেদের উপায়হীন ভিকটিম ভাবা, নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতা, ক্ষোভ ঘৃণা, লাম্পট্য আর নপুংসকতা দেহপসারিণীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজের পুরুষদের একটি পুরনো অভ্যাস। এতে নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতা ঢাকা পড়ে, আবার রাতে বিবেক দংশনহীন সুখনিদ্রারও ব্যাঘাত ঘটেনা। মজার বিষয় হল, এই দেহপসারিণীর খদ্দেরটির দিকে আমরা কিন্তু কেউ কখনো আঙ্গুল তুলিনা। কখনো জানতে চেষ্টা করেছেন কি খদ্দেরটি কারা? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু প্রশ্ন করুন না নিজেকে। “যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া যাদের লক্ষ্য” (!) তারা কেন মনে করলেন (পাঁচ দশকেরও বেশী সময় আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পরও) যে স্বৈরাচারের সাথে (যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের অগুণতি নেতাকর্মী প্রাণ দিলেন) গাঁটছড়া বাঁধা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই? বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের ভোটের সমীকরণটি কি বলে? এই বাংলাদেশে জনতার একাংশ তিন দশক ধরে বিবেকহীন, মানবতাহীন, ক্যান্টনমেন্ট জাত ধর্মব্যবসায়ীদের ক্ষমতায় আনেনি? গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে স্বৈরাচারী নীতিহীন এরশাদ কেমন করে ভোটের জন্য একটি “ফ্যাক্টর” হয়ে যান? সেই দায় শুধুই কি রাজনৈতিক নেতৃত্বের? নেতৃত্বের সমালোচনা করা সহজ, আত্মসমালোচনা করা বোধ হয় ততটা সহজ নয়। কি বলেন?
একমাত্র মূর্খ ছাড়া যে কেউই স্বীকার করবেন যে গণতন্ত্র একটি দ্বিমূখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিক নির্দেশনা দেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তারা জনগণের মতামতের প্রতিফলনকে ধারণও করেন। জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে ঠিক করেন, কিছু সুস্পষ্ট বার্তা পাঠান – কেমন নেতৃত্ব তারা আশা করেন। যেমনটি জনগণ পাঠিয়েছে এবারের নির্বাচনে। এ কারণেই রাজনীতিতে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে – every nation gets the leader it deserves . এই কথাটি বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের সময় যেমন সত্য ছিল, আজও তেমনই সত্য আছে। আসুন নিজেদের প্রশ্ন করি। গত তিন দশকে আমরা আমাদের নেতৃত্বের কাছে কি বার্তা পাঠিয়েছিলাম? এই বাংলাদেশের ইতিহাসে আমাদেরই জনতার একাংশ অন্তত তিনবার ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্বকে এই বার্তা পাঠিয়েছিল যে – মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি তেমন গর্হিত অপরাধ নয়, দেশটিকে মিনি-পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা কোন অপরাধ নয়, “আপোষহীন” ধর্মীয় আঁতাত কোন অপরাধ নয়, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা, পদানত করা কোন অপরাধ নয়।
নির্বাচনের ফলাফল দেখে আপনি বলেছেন যে – ফলাফলই প্রমাণ করে স্বৈরাচারের সাথে জোট বাঁধার আসলে কোন প্রয়োজন ছিলনা। ভবিষ্যতটা জানা থাকলে অতীতের মূল্যায়ন কতই না সহজ! ভোটের আগে কেউ কি এমন ফলাফল সত্যিই কল্পনা করতে পেরেছিল? এমনকি আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ছাপা কোন জরিপ, কোন পরিসংখ্যান কি এই ইঙ্গিত দিয়েছিল? “ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য” যাদের নাকি চোখে ঘুম নেই, তারা স্বৈরাচারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন কেন? “ভালবেসে” সুদিনের ভাগ দেয়ার উৎসাহ থেকে?
আমার মত এমন অনেকেই আছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে যারা একেকবার করে আশায় বুক বেঁধেছেন। এবারই প্রথম আমার মনে হয়েছে জাতিগতভাবে ১৯৭১ এর পর আমরা আত্মশুদ্ধির পথে নামলাম। জাতিগতভাবে আমরা ক্রমশ ইতিহাস বিবর্জিত, নপুংসক, সুবিধাবাদী জাতিতে পরিণত হচ্ছিলাম। আজ অনেক দিন পর যেন খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। আওয়ামী লীগের এই বিজয়ে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যাবে এই আশা করিনা। কিন্তু অন্তত আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবার আরো একটি সুযোগ তো তৈরী হল।
এবারের নির্বাচনে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন দেশের আপামর দরিদ্র সংগ্রামী জনতা, আর সেই সব তরুণ-তরুণীরা যারা কল কারখানায় শ্রম দেয়, গার্মেন্টসে চাকুরী করেন, নির্যাতিত হন, ধর্ষিত হন, দেশের মানুষের মুক্তির বাণী বুকে নিয়ে রাজপথে জীবন দেন। সেই মানুষদের রায়কে “lesser of two evils” বলা বোধ হয় এক রকম ধৃষ্টতারই নামান্তর। আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঠিক সূত্র সন্ধানের চেষ্টায়। সেই ইতিহাস – যার সন্ধান পাঠ্য পুস্তকের পাতায় মেলেনি, প্রচার মাধ্যমে মেলেনি। এটি সেই ইতিহাস যা বেঁচে ছিল দেশের এই সাধারণ দরিদ্র সংগ্রামী মানুষের বুকের ভেতর। সমাজের নানা স্তরের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি ক্রমশ খুব হতাশ হয়ে লক্ষ্য করছিলাম যে এদেশের তরুণ সমাজের একটি অংশ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানেনা। এদের মধ্যে বিলেত আমেরিকা ফেরত তথাকথিত কিছু শিক্ষিত তরুণ তরুণীও রয়েছেন। আমাদের বিশাল সৌভাগ্য যে আমাদের তরুণ সমাজের বিশাল অংশ এই আত্মতুষ্ট, সুবিধাবাদী, ইতিহাস বিবর্জিত প্রজন্মের অংশ নয়।
পরিশেষে, ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার বয়স কত তা জানা নেই। যদি তিরিশ/চল্লিশ এর কোঠায় হয়, তবে জানতে ইচ্ছে করে ইতিপূর্বে কখনো ভোট দিয়েছেন কিনা – দিলে কাকে দিয়েছিলেন? দেশের খেটে খাওয়া কম বয়সী সেই সব তরুণেরা যাদের অনেকে অভুক্ত থেকে রাজপথে নামেন, এই দরিদ্র দেশটির ততধিক দরিদ্র কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব উজ্জ্বল তরুণেরা যারা দেশময় আন্দোলনের ঝড় তোলেন – তাদের সাথে কখনো কোন আন্দোলন সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন কিনা? আপনি কি দেহপসারিণীদের খদ্দের নাকি নিরব আত্মতুষ্ট সমালোচক এবং দর্শক?
এই দীর্ঘ আলোচনাটি আপনার হতাশাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল কি? দিয়ে থাকলে দুঃখিত।

“শুধু স্বপ্নহীন ক্ষোভে বসে থেকে থেকে, ঘুমে ঘুমে, আত্মগোপনে গোপনে ক্লান্ত। একটা কিছুকে উপলক্ষ করে আবার দাঁড়াতে চাই।”
