[নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আরমান রশিদের পোস্টটি পড়লাম। একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাতের জন্য লেখককে ধন্যবাদ। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক এবং জরুরী বলেই প্রত্যুত্তরটি আলাদা পোস্ট হিসেবে ছাপতে ব্লগ প্রশাসককে বিনীত অনুরোধ করছি — লেখক]
আরমান রশিদ,
আপনার সুলিখিত পোস্টটি পড়লাম। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আপনি খানিকটা আশংকিত এবং কিঞ্চিত হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন জেনে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সেই সঙ্গে এও লিখেছেন যে – মহাজোটের বিজয়ে আপনি “হাঁফ” ছেড়ে বেঁচেছেন। যদি আপনার বক্তব্য অনুযায়ী দু’টি “evil” এর মধ্যে একটিকে আপনি বেছে নিতে বাধ্য হয়ে থাকেন (যদিও আপনি কাকে ভোট দিয়েছেন সেটি স্পষ্ট নয়), তাহলে সংগত কারণেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচার কোন কারণ ঘটেনা। সেক্ষেত্রে, দু’টি evil এর মধ্যে আপনি আদৌ কোন পার্থক্য করেন কিনা, করলে কেন করেন, এবং আপনার বর্ণিত “শুষ্ক মুখ তরুণেরা” সেই পার্থক্যটি করে ঠিক করেছেন কিনা, সেটি যদি একটু পরিষ্কার করে বলতেন তবে আমাদের জন্য আলোচনার আরেকটু সুযোগ তৈরী হোতো।
দেখতে পাচ্ছি “lesser of two evils” তত্ত্বটিতে আপনার প্রবল আপত্তি। আমারও। তবে সেটি তত্ত্বটি ইংরেজীতে বলে নয়। একটি বাংলা তত্ত্ব দিই – “মন্দের ভাল” – একেবারে খাঁটি বাঙ্গালী তত্ত্ব। তবে তাতে আপনার বা আমার কারোই আপত্তি (যদিও আশংকা করছি সম্পূর্ণ দু’টি ভিন্ন কারণে) কিছু কমবে বলে মনে হয়না। এটি কেউ বলতেই পারেন যে বাংলাদেশের জনগণ এবার ভোটের মাধ্যমে “মন্দের ভালোটিকে” বেছে নিয়েছেন। এই তত্ত্বটির অসুবিধে একটিই। সেটি হল “মন্দের ভালো” বেছে নিতে কেউ ৮৫% আসনে কাউকে বিজয়ী করেনা, ১০% এরও কম আসনে কাউকে পরাজিত করেনা। আমার মনে হয়েছে এবারের ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আসলে পরাজিত করেছে কিছু চিহ্নিত শক্তিকে। এরা হল – মৌলবাদী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি, দূর্নীতিবাজ শক্তি, দাড়ি-টুপি-শিফন-সাফারীধারী নানান পদের ধর্ম ব্যবসায়ী শক্তি। আর রায় দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে, মানবতার পক্ষে। এই নিয়ামকগুলোর প্রতিফলক হিসেবে আওয়ামী লীগই কেন আবির্ভূত হল (হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের এককভাবে ২২০টিরও বেশী আসন সেই ইঙ্গিতই দেয়) তা নিয়ে আপনার মনকষ্ট থাকতেই পারে, কিন্তু সেটিই বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী কৌশলকে আপনি “দেহপসারিণীর দেহ ব্যবসার” সাথে তুলনা করেছেন। নিজেদের উপায়হীন ভিকটিম ভাবা, নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতা, ক্ষোভ ঘৃণা, লাম্পট্য আর নপুংসকতা দেহপসারিণীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজের পুরুষদের একটি পুরনো অভ্যাস। এতে নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতা ঢাকা পড়ে, আবার রাতে বিবেক দংশনহীন সুখনিদ্রারও ব্যাঘাত ঘটেনা। মজার বিষয় হল, এই দেহপসারিণীর খদ্দেরটির দিকে আমরা কিন্তু কেউ কখনো আঙ্গুল তুলিনা। কখনো জানতে চেষ্টা করেছেন কি খদ্দেরটি কারা? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু প্রশ্ন করুন না নিজেকে। “যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া যাদের লক্ষ্য” (!) তারা কেন মনে করলেন (পাঁচ দশকেরও বেশী সময় আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পরও) যে স্বৈরাচারের সাথে (যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের অগুণতি নেতাকর্মী প্রাণ দিলেন) গাঁটছড়া বাঁধা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই? বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের ভোটের সমীকরণটি কি বলে? এই বাংলাদেশে জনতার একাংশ তিন দশক ধরে বিবেকহীন, মানবতাহীন, ক্যান্টনমেন্ট জাত ধর্মব্যবসায়ীদের ক্ষমতায় আনেনি? গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে স্বৈরাচারী নীতিহীন এরশাদ কেমন করে ভোটের জন্য একটি “ফ্যাক্টর” হয়ে যান? সেই দায় শুধুই কি রাজনৈতিক নেতৃত্বের? নেতৃত্বের সমালোচনা করা সহজ, আত্মসমালোচনা করা বোধ হয় ততটা সহজ নয়। কি বলেন?
একমাত্র মূর্খ ছাড়া যে কেউই স্বীকার করবেন যে গণতন্ত্র একটি দ্বিমূখী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিক নির্দেশনা দেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তারা জনগণের মতামতের প্রতিফলনকে ধারণও করেন। জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে ঠিক করেন, কিছু সুস্পষ্ট বার্তা পাঠান – কেমন নেতৃত্ব তারা আশা করেন। যেমনটি জনগণ পাঠিয়েছে এবারের নির্বাচনে। এ কারণেই রাজনীতিতে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে – every nation gets the leader it deserves . এই কথাটি বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের সময় যেমন সত্য ছিল, আজও তেমনই সত্য আছে। আসুন নিজেদের প্রশ্ন করি। গত তিন দশকে আমরা আমাদের নেতৃত্বের কাছে কি বার্তা পাঠিয়েছিলাম? এই বাংলাদেশের ইতিহাসে আমাদেরই জনতার একাংশ অন্তত তিনবার ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্বকে এই বার্তা পাঠিয়েছিল যে – মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি তেমন গর্হিত অপরাধ নয়, দেশটিকে মিনি-পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা কোন অপরাধ নয়, “আপোষহীন” ধর্মীয় আঁতাত কোন অপরাধ নয়, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা, পদানত করা কোন অপরাধ নয়।
নির্বাচনের ফলাফল দেখে আপনি বলেছেন যে – ফলাফলই প্রমাণ করে স্বৈরাচারের সাথে জোট বাঁধার আসলে কোন প্রয়োজন ছিলনা। ভবিষ্যতটা জানা থাকলে অতীতের মূল্যায়ন কতই না সহজ! ভোটের আগে কেউ কি এমন ফলাফল সত্যিই কল্পনা করতে পেরেছিল? এমনকি আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ছাপা কোন জরিপ, কোন পরিসংখ্যান কি এই ইঙ্গিত দিয়েছিল? “ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য” যাদের নাকি চোখে ঘুম নেই, তারা স্বৈরাচারের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন কেন? “ভালবেসে” সুদিনের ভাগ দেয়ার উৎসাহ থেকে?
আমার মত এমন অনেকেই আছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে যারা একেকবার করে আশায় বুক বেঁধেছেন। এবারই প্রথম আমার মনে হয়েছে জাতিগতভাবে ১৯৭১ এর পর আমরা আত্মশুদ্ধির পথে নামলাম। জাতিগতভাবে আমরা ক্রমশ ইতিহাস বিবর্জিত, নপুংসক, সুবিধাবাদী জাতিতে পরিণত হচ্ছিলাম। আজ অনেক দিন পর যেন খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। আওয়ামী লীগের এই বিজয়ে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যাবে এই আশা করিনা। কিন্তু অন্তত আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচবার আরো একটি সুযোগ তো তৈরী হল।
এবারের নির্বাচনে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন দেশের আপামর দরিদ্র সংগ্রামী জনতা, আর সেই সব তরুণ-তরুণীরা যারা কল কারখানায় শ্রম দেয়, গার্মেন্টসে চাকুরী করেন, নির্যাতিত হন, ধর্ষিত হন, দেশের মানুষের মুক্তির বাণী বুকে নিয়ে রাজপথে জীবন দেন। সেই মানুষদের রায়কে “lesser of two evils” বলা বোধ হয় এক রকম ধৃষ্টতারই নামান্তর। আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঠিক সূত্র সন্ধানের চেষ্টায়। সেই ইতিহাস – যার সন্ধান পাঠ্য পুস্তকের পাতায় মেলেনি, প্রচার মাধ্যমে মেলেনি। এটি সেই ইতিহাস যা বেঁচে ছিল দেশের এই সাধারণ দরিদ্র সংগ্রামী মানুষের বুকের ভেতর। সমাজের নানা স্তরের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি ক্রমশ খুব হতাশ হয়ে লক্ষ্য করছিলাম যে এদেশের তরুণ সমাজের একটি অংশ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানেনা। এদের মধ্যে বিলেত আমেরিকা ফেরত তথাকথিত কিছু শিক্ষিত তরুণ তরুণীও রয়েছেন। আমাদের বিশাল সৌভাগ্য যে আমাদের তরুণ সমাজের বিশাল অংশ এই আত্মতুষ্ট, সুবিধাবাদী, ইতিহাস বিবর্জিত প্রজন্মের অংশ নয়।
পরিশেষে, ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার বয়স কত তা জানা নেই। যদি তিরিশ/চল্লিশ এর কোঠায় হয়, তবে জানতে ইচ্ছে করে ইতিপূর্বে কখনো ভোট দিয়েছেন কিনা – দিলে কাকে দিয়েছিলেন? দেশের খেটে খাওয়া কম বয়সী সেই সব তরুণেরা যাদের অনেকে অভুক্ত থেকে রাজপথে নামেন, এই দরিদ্র দেশটির ততধিক দরিদ্র কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব উজ্জ্বল তরুণেরা যারা দেশময় আন্দোলনের ঝড় তোলেন – তাদের সাথে কখনো কোন আন্দোলন সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন কিনা? আপনি কি দেহপসারিণীদের খদ্দের নাকি নিরব আত্মতুষ্ট সমালোচক এবং দর্শক?
এই দীর্ঘ আলোচনাটি আপনার হতাশাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল কি? দিয়ে থাকলে দুঃখিত।
অস্মিতা
"শুধু স্বপ্নহীন ক্ষোভে বসে থেকে থেকে, ঘুমে ঘুমে, আত্মগোপনে গোপনে ক্লান্ত। একটা কিছুকে উপলক্ষ করে আবার দাঁড়াতে চাই।"
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৩ comments
সৈকত - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ (১:৫৮ পূর্বাহ্ণ)
অসাধারণ একটি লেখা। সবরকমের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দোষে দুষ্ট হওয়া সত্বেও আওয়ামী লীগের এই বিজয় কিছু সত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। গতবারের আওয়ামী শাসনকালে উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। আশা করি তাঁরা জনতার রায় বুঝে একটি যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দেবেন।
আরমান রশিদ - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ (৭:৩০ পূর্বাহ্ণ)
আগেই বলে নেই আমার লেখার ভুল ত্রুটি দয়া করে সকলে মার্জনা করবেন।
অস্মিতা,
প্রথমেই বলি, আপনার লেখার হাতটা কিন্ত চমৎকার। আপনার সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। একই সাথে ধন্যবাদ জানাই এই নির্বাচনী ফলাফলের ইতিবাচক দিকগুলি সকলের কাছে তুলে ধরার জন্য। আমার মত যারা কিঞ্চিত হতাশাগ্রস্ত তাদের কষ্ট এতে কিছুটা লাঘব হবে তবে এও আশা করি তারা সম্পূর্ণ ভাবে আত্মতুষ্টিতে বিস্মৃত হবেন না। আমার লেখাটির মূল উদ্দেশ্যই ছিল এই প্রসংগে একটি উন্মুক্ত বিতর্কের সূচনা করা যা থেকে আমরা সকলেই হয়ত কিছু না কিছু শিখতে পারবো। লেখাটি শুধু আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র, তবে আমার মত যারা জন্মসূত্রে একটি ভোটের অধিকার পেয়েছেন তাদের সমষ্টিগত মতামতের হয়তো একটা দাম আছে, এবং আশা কারি একদিন এদেশে সেই মতামতেরও মূল্যায়ন হবে, হয়ত একদিন সেই মতামতের প্রতি আমরা সকলে আরো সম্মান আর সহনশীলতা দেখাতে শিখবো। তবে মনে রাখবেন দেশে আমার মত লোকের সংখ্যাই বেশি যাদের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকলেও কোনো (দেবতুল্য?) নেতা বা নেত্রীর প্রতি সরাসরি আনুগত্য নেই।
এবার আপনার ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলির উত্তর একে একে দেই।
১। “যদিও আপনি কাকে ভোট দিয়েছেন সেটি স্পষ্ট নয়” না, আমার নির্বাচনী এলাকায় ভোট স্থগিত হবার কারণে আমি এবার ভোট দিতে পারিনি, তবে দিলে ‘নৌকা’কেই দিতাম। কেন? তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২। “আপনার বয়স কত তা জানা নেই” – তিরিশের কোঠায়।
৩।“ইতিপূর্বে কখনো ভোট দিয়েছেন কিনা – দিলে কাকে দিয়েছিলেন” – সাল মনে নেই তবে ৯/১০ বছর বয়সে এরশাদের আমলে একবার এক আত্মীয়ার হাত ধরে চাঁদপুরের এক দখলকৃত ভোট কেন্দ্রে ‘লাঙ্গল’ মার্কায় শ’খানেক ভোট দিয়েছিলাম। হয়তো সেই অভিশাপে বয়স হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো ভোট দেয়ার সুযোগ হয়নি।
৪।“কোন আন্দোলন সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন কিনা?” – ৯০ এর আন্দোলনে স্কুলে থাকতে কিছু মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। আর কলেজে থাকাকালীন চট্টগ্রামের লাল দীঘির ময়দানে গোলাম আযমের সমাবেশ ঠেকাতে কিছু ঘাম আর ইট/পাটকেল ঝরিয়েছি আর শিবির/বিডিআর এর দৌড়ানি খেয়ে এক পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়েছি। ব্যস, এটুকুই, এর চেয়ে বেশি কিছু কখনো করতে পারিনি দেশের জন্য।
৫।“আপনি কি দেহপসারিণীদের খদ্দের”- না।
৬।“নাকি নিরব আত্মতুষ্ট সমালোচক এবং দর্শক”- আত্মতুষ্ট মোটেও নই তবে নিরব দর্শক বিলক্ষণ ছিলাম এতকাল, এই লেখাটির আগ পর্যন্ত।
৭।“এই দীর্ঘ আলোচনাটি আপনার হতাশাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল কি?” না। আপনি যা বলেছেন এর বেশীর ভাগই আমরা প্রতিনিয়ত মিছিল, মিটিং, টকশো আর সুশীল সমাজের কাছ থেকে শুনি। এসব নতুন কিছু না। তবে সামাজিক জীবনে এর চর্চা সত্যই সবার কাম্য।
আমার হতাশার মূল যে দুটি কারণ আমি আমার লেখায় উল্লেখ করেছি (১ আদর্শের সাথে সমঝোতা, ২ প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া) তার প্রতিক্রিয়া কিন্তু আপনার লেখায় অনুপস্থিত। নিশ্চই এটা ইচ্ছাকৃত নয়, আবেগের তাড়নায় বাদ পড়েছে। স্বৈরাচার আর মৌলবাদের সাথে আঁতাতকে কিভাবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়? এটা কি আদর্শ বিচ্যুতির সামিল নয়? সূধা সদনের পাশের এক ছোট্ট রেস্তোরায় আমার নিয়মিত যাতায়াত। সেই সুবাদে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অসংখ্য নেতা কর্মীর সাথে নিয়মিত কথা বলার সুযোগ গত কয়েক মাসে আমার হয়েছে। এই নির্বাচনের প্রাক্কালে মনোনয়ন প্রক্রিয়া আপনি কাছ থেকে কতটা দেখেছেন জানি না, তবে আমি শুধু সেই সকল নেতা কর্মীর কথা বলতে পারি যারা দূর দূরান্ত থেকে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু তাদের কথাটি বলার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি, দিন রাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল পুলিশ বেষ্টনীর বাইরে। অসহায় চোখে যাদের দেখতে হয়েছে বড় বড় জীপে করে জনগণ বিচ্ছিন্ন নেতাদের সূধা সদনে ঢুকতে আরে মনোনয়ন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে।
“ভোটের আগে কেউ কি এমন ফলাফল সত্যিই কল্পনা করতে পেরেছিল? এমনকি আগ মূহুর্ত পর্যন্ত ছাপা কোন জরিপ, কোন পরিসংখ্যান কি এই ইঙ্গিত দিয়েছিল?” বিভিন্ন দলের অনুগত ও মদদপুষ্ট এ সব জরিপের প্রতিফলন বাস্তবে সামান্যই পাওয়া যায়। তবে এটা বলতে পারি যে রাজনৈতিক আবহাওয়ার যেটুকু রেশ আমি পেয়েছি শহর, বন্দর, গ্রামের লোকের সাথে কথা বলে, আওয়ামী লীগের এই জয় এর ব্যাপারে কারোই মনে কোনো সংশয় ছিল না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যে কতটাই জনগণ বিচ্ছিন্ন এর থেকে তাই প্রমাণ হয়। জনগণের মতামত আর চাওয়া পাওয়া যতদিন সূধা সদন আর হাওয়া ভবনের গেটের বাইরে আটকা পড়ে থাকবে ততদিন জনমানুষের আত্মশুদ্ধি কোনোই কাজে আসবে না। তাদের অপেক্ষা করতে হবে আরেক বঙ্গবন্ধু-তাজ উদ্দিনের প্রতিক্ষায়।
জনগণের এই রায়কে lesser of two evils বলাটা সত্যিই হয়ত ধৃষ্টতার সামিল। এই রূপ ধৃষ্টতা দেখাবার জন্য আমি লজ্জিত। আত্মপক্ষ সমর্থনে শুধু এইটুকু বলতে পারি যে যারা ‘বিএনপি ঠেকাও’ মনোভাব নিয়ে ভোট দিয়েছে তারা এই তত্ত্বেরই অনুসারী। এখন প্রশ্ন হল এই নির্বাচনে তাদের সংখ্যা কত? আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ২০০১ সালে যারা আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডের কারণে বিএনপি কে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করেছিল এবারও কিন্তু তাদেরই ভোটে আওয়ামী লীগের এই জয়। এবং জনগণের এই বিপুল অংশ হঠাত করেই মাত্র ৭ বছরে সুশীল(?) হয়ে যায়নি। ২০০১ সালের সেই রায়ের জন্য তাদের “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি”র পক্ষের শক্তি, “দেশটিকে মিনি-পাকিস্তান বানানোর অপচেষ্টা”কারী, “দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা, পদানত করা”র চক্রান্তকারী হিসেবে গালাগাল দেয়াটাও কি ধৃষ্টতা নয়? থাক, যে দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই এমন যে কোনো নেতার নামে ঘুষ, চাঁদাবাজী/টেন্ডারবাজী, হত্যা/ধর্ষন, দেশদ্রোহীতার মামলা হলে মামলা নিষ্পত্তির আগেই জোর গলায় চিৎকার শুরু হয় যে “আমরা চক্রান্তের শিকার”, ২০০১ সালের জনগণের রায়কে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের অপশক্তির চক্রান্ত মনে করাটাও নতুন কিছু হবেনা।
বুঝিনা, কেন জানি মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মুখে মুখে যারা যত বেশী আস্ফালন করেন, স্বৈরাচার আর মৌলবাদের সাথে চুক্তি/আঁতাত আর অগণতান্ত্রিক মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সমালোচনা/প্রতিবাদে তাদেরই কখনো সাথে পাওয়া যায়না।
আসুন না আমরা সবাই সত্যকে সত্য, মিথ্যা কে মিথ্যা, ভুল কে ভুল আর অন্যায় কে অন্যায় বলা শিখি!
আরমান রশিদ - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ (৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ)
সৈকত দা (@#১),
“গতবারের আওয়ামী শাসনকালে উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। ” আপনার অভিজ্ঞতাটুকু আমাদের জানাবেন, প্লিজ!
এবার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতার অভাব নেই। তারা যদি সত্যিই দেশটাকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করতে পারে তবে তাদের সাত খুন মাফ। সেই চেষ্টায় দেশে যদি একটা যুদ্ধও বাধে তাও ভাল, অন্তত ‘৭১ এর অসম্পূর্ণ যুদ্ধটা যদি শেষ করা যায়।
অস্মিতা - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (১:২৬ অপরাহ্ণ)
@ আরমান রশিদ (২ নং মন্তব্য)
না আরমান রশিদ – বলার অপেক্ষা অবশ্যই রাখে। আমার পোস্টটির মূল সুরটি ছিল জাতি হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সমান অংশীদার হিসেবে কিছু আত্ম জিজ্ঞাসার সূচনা করা। তাই দু’টি evil এর মধ্যে কেন আপনার আওয়ামী লীগকে lesser evil বলে মনে হল তাদের “আদর্শিক পতন” এর পরেও, সেটি আপনাকে আরেকটু খোলাসা করে বলতেই হবে। আচ্ছা বরং আমি কিছুটা সাহায্যই করি, পাছে এত সব প্রশ্নের উৎপাতে তিতি বিরক্ত হয়ে আপনি অকালেই এই ব্লগ ত্যাগ করেন সেই ভয়ে।
যদিও আপনার মস্তিষ্কের গোপন কোষে কোষে কোন্ গভীর আবেগ (থুক্কু, ‘ভাবনা’) নিয়ত সঞ্চারিত হয়, তা আমার জানা নেই। তবুও গত দুই দশকে বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষের সাথে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, যাচিত বা অযাচিতভাবে রাজনৈতিক আলোচনার সুবাদে যে অম্ল মধুর অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করেছি তার ভরসায় আপনার নৌকায় ভোট দানের “ঐতিহাসিক” সিদ্ধান্তের পেছনে সম্ভাব্য/অসম্ভাব্য কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।
আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন:
১) ভালবেসে “বিবেকের তাড়নায়”;
২) সকলে নৌকায় ভোট দিচ্ছেন, ‘আমি কি করে না দেই’ এই জাতীয় জটিল moral dilemma-য় পতিত হয়েছেন বলে;
৩) ছোটবেলায় একবার নৌকায় করে দাদা বাড়ি গিয়েছিলেন – গুড় মুড়ি খেতে খেতে নৌকায় ভাসার সেই আনন্দময় স্মৃতি ভুলতে পারেননি বলে;
৪) আপনি একজন “প্রাক্তন” এবং “কূপিত” বিএনপি সমর্থক, এখন ধানের শীষের ভোট দেয়া বিশাল লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে সেটি ভাবছেন বলে (এ প্রসঙ্গে “উপায়হীন” বিএনপি সংক্রান্ত
মাসুদ করিমের মন্তব্যটি দেখে নিতে পারেন এই ব্লগে);
৫) আপনার কাছে আসলে মূল প্রায়োরিটি corruption - আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ এই মুহুর্তে তেমনভাবে খুঁজে পাচ্ছেন না, কিন্তু খোঁজার চেষ্টা জোরেশোরে অব্যাহত রাখবেন বলে;
৬) আপনি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী একটি পরিবারের সন্তান – অনেক ভুল ত্রুটি সত্ত্বেও এই দলটিকে এদেশের প্রগতির জন্য, মানবতার জন্য শেষ আশ্রয় বলে মনে করেন এবং তাদের অনেক কাজ ‘ঠিক মন মতো’ না হলেও এই বিজয়ের মাসে তাদের একটি সুযোগ দিয়ে দেখতে চান বলে;
৭) আপনি “স্বৈরাচার”-কে খারাপ জানলেও এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী + ‘আপোষহীন’ দূর্নীতিবাজ মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফল যে চার দল, তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য করেন বলে;
৮) মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আপনার তেমন আস্থা নেই, আবেগ তো নেই-ই তবে আজকাল ছেলে বুড়ো সকলেই যেমনভাবে বলছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে ভোট না দিলে আপনার সামাজিক জীবনে একটি বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে সে আশংকায়;
৯) আপনি একবার সাবিনা ইয়াসমিনের কিন্নরী কন্ঠে “মাঝি নাও ছাইড়া দে” গানটি শুনে প্রচন্ড আন্দোলিত হয়েছিলেন – আজও গানটি শুনলেই আপনার হৃদয় “দোলায়িত” হয় বলে;
১০) আপনি রাত জেগে খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণা দেখছিলেন। পরদিন সকালবেলা চালের দোকানে চাল কিনতে গিয়ে দেখলেন যে মূল্য কেজিপ্রতি আরো দু’টাকা বেড়েছে। আপনি মনে মনে ভাবছিলেন দশ টাকার চাল কেমন করে ৪২ টাকা হল। সেদিন আপনি চাল না কিনে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। বাড়ি এসে শুনলেন আপনার এলাকায় নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেছে, আপনি মনে মনে ভাবলেন যখনই নির্বাচন হোক এবার নৌকাকেই ভোট দেবেন যা থাকে কপালে যদিও আপনি জানেন যে নৌকা রান্না করে খাওয়া যায়না কিন্তু ধানের শীষ (সম্ভবত) যায়।
এ মুহুর্তে এই ক’টিই মনে পড়ছে। তালিকায় কোনটি বাদ পড়ে থাকলে জানিয়ে দেবেন, সংকোচ করবেন না যেন।
আমার লেখাটিকে আপনার “আবেগতাড়িত” মনে হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমার মত আরও অনেকের এই বিশ্বাসটিকে “আবেগতাড়িত” বলে অনেকেই ইতিপূর্বে মন্তব্য করেছেন। গোলাম আযম থেকে হালের প্রৌঢ়, নব্য বিএনপিদের অনেকেই। কথাটি সত্যি। আবেগ বলুন, বিশ্বাস বলুন, ভালবাসা বলুন – একে ভর করে এ দেশের কিছু মুক্তিকামী মানুষ অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করে জীবন, জীবিকাকে বাজি রেখে ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম করে গেছেন। চেষ্টা করেছেন এই আবেগটি সঞ্চারিত করতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মানুষ হিসেবে আমার অনেক দুর্বলতা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু এই দুর্বলতাটির জন্য, ভালবাসাটির জন্য সব সময়ই গর্ববোধ করেছি। জীবনে একবারই আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের চেয়েও উঁচু হয়ে আকাশ স্পর্শ করেছিলাম – জাতি হিসেবে সেই স্মৃতি আমাদের সবচেয়ে বড় “অস্মিতা”।
লিখেছেন – আবেগের তাড়নায় আপনার দু’টি প্রশ্নের জবাব দেইনি। আমার ধারণা ছিল প্রথমটির জবাব আমি দিয়েছি। দ্বিতীয়টির জবাব আসলে সত্যিই দিইনি – দিতে ইচ্ছে করেনি বলে। আওয়ামী লীগ এবার তৃণমূল থেকে তার নেতৃত্ব বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেকথা আপনার নিশ্চয়ই অজানা নেই। প্রথমবার হিসেবে সেই প্রক্রিয়া শতভাগ শুদ্ধভাবে তারা পালন করতে পারেননি। প্রতি এলাকা থেকে একাধিক নাম এসেছে, সব সময় সবচাইতে ত্যাগী ও সৎ মানুষটি শেষ পর্যন্ত হয়তো মনোনয়ন পাননি, আশাহত সকলের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করাও সম্ভব হয়নি হয়তো। ভোটের রাজনীতিতে জেতার সমীকরণটি মাথায় রেখে বেশ কিছু অযোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়নও তারা দিয়েছেন। কিন্তু এত সব কিছুর পরেও তারা তৃণমূলের মানুষদের কথাটি শোনার চেষ্টা হলেও করেছেন, প্রায় শ’খানেক নতুন মুখকে মনোনয়ন দিয়েছেন – তাদের সেই প্রচেষ্টাটুকু সাধারণ মানুষ মনে রেখেছেন বলেই মনে হয়। এই “না ভোট” এর হাওয়াতেও ভোটের ফলাফল তাই বলে। বিষয়গুলো নিয়ে পত্র পত্রিকাতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ভুলত্রুটি চিহ্নিত করার পাশাপাশি সকলেই এই প্রচেষ্টাটির প্রশংসা করেছেন। সেই সব আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন। আজ রাজনীতিতে নৈতিকতার এই দুর্দিনে কারো সৎ প্রচেষ্টার মূল্যায়নটি যদি না করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আপনার সাথে তর্ক করার কোন প্রয়োজন দেখিনা। আপনি লিখেছেন আপনার এলাকায় ভোট স্থগিত রয়েছে। অনুমান করি আপনার এলাকায় সম্ভবত মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত জনাব নুরুল ইসলাম। এই মানুষটিকে মনোনয়ন দিয়ে মহাজোট কোন অন্যায় করেছিল বলে মনে করেন কি?
এবার প্রথম প্রশ্নটির কথায় আসি। স্বৈরাচারের সাথে মহাজোট গঠনে আমি একেবারেই একমত নই। তবে সেই প্রসঙ্গে জাতি হিসেবে আত্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার কথাটিই বলবার চেষ্টা করেছি আমার পোস্টে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে আঙ্গুল তোলা তো অনেক হল – এমনকি গত দু’বছরে রাজনীতির বংশ নিকেশ করার চেষ্টাও তো কম দেখলাম না। এবার বোধ হয় নিজেদের দিকে আঙ্গুল ঘোরানোটিও খুব জরুরী। সমীকরণটি আসলে খুবই সহজ। রাজনীতিতে এরশাদ ততদিনই ফ্যাক্টর থাকবেন যতদিন আমরা তাকে ভোট দেব। যে ২০০১ সালের নির্বাচনকে আপনি “গণ রায়” বলছেন (এই বিষয়ে বেশ কিছু কথা বলবার ছিল – সে প্রসঙ্গ আরেকদিন) সেই রায়েও কতজন মানুষ তাকে ভোট দিয়েছিল মনে আছে কি? আমরা কি আসলেই এত অসহায় যে এরশাদকে ভোট দিতে হবে? একারণেই বলি যে এবারের নির্বাচনে আমরা আত্মশুদ্ধির পথে নামলাম। মানুষ তাদের ভোট দিয়ে, আওয়ামী লীগকে নিরন্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কোন অংকের হিসাব মেলাতেই তার এরশাদের শরণাপন্ন হবার বাধ্যবাধকতা আর নেই। আপনি বলেছেন, কোন পরিসংখ্যানে না এলেও সাধারণ মানুষ ঠিকই জানতেন যে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। মজার বিষয়টি কি জানেন? ২০০১ সালের নির্বাচনেও বেশীর ভাগ মানুষ বিশ্বাস করতো আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। সন্দেহ থাকলে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোট প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাটি জেনে নেবেন। আপনি বলেছেন এটাই নাকি প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ কতখানি “জনবিচ্ছিন্ন”। শুনে হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। আওয়ামী লীগের অনেক বদনাম শুনেছি। তারা “জনবিচ্ছিন্ন”, তাও আবার এই নির্বাচনের context এ – এটি সত্যিই একটি “আশ্চর্য নতুন” concept; “জনবিচ্ছিন্ন” আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশের এতগুলো মানুষ তবে সত্যিই ভুল করলো!!
পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশের নির্বাচন সম্বন্ধে জানার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মনে আছে যুক্তরাজ্যে ইরাক আক্রমণের পর লেবার পার্টির সমর্থন যখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে, তখনো মানুষ তাদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। কনসার্ভেটিভ টোরী কিংবা বর্ণবাদী বিএনপি (British Nationalist Party)-কে ভোট দেয়নি। নির্বাচনের পর লেবার পার্টির বিজয়ের কারণ নিয়ে যতখানি আলোচনা হয়েছে, ততখানিই দুশ্চিন্তা নিয়ে মানুষ বিশ্লেষণ করেছে বিএনপির প্রাপ্ত ভোটকে (স্বল্প সংখ্যক হলেও)। সভ্য দেশে “সভ্যতাবিরোধী” শক্তিগুলোকে মানুষ সবসময়ই চিহ্নিত করেছে, prioritise করেছে। আমাদের দেশের সভ্য মানুষেরাও সভ্যতা বিরোধী বিএনপি জামাত জোটকে চিনতে এবার আর ভুল করেনি। ফ্রান্সের জনগণকেও যখন উগ্র ডানপন্থী বর্ণবাদী ল’পেন এবং দূর্নীতিতে অভিযুক্ত শিরাকের মধ্যে বাছাই করতে হয়েছিল, তারা তখন ঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে ভুল করেনি।
হায়রে! আপনি বলেছেন ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিজ চোখে দেখেছেন, তার কয়েকটিতে অংশগ্রহণ করে আপনার “মূল্যবান” ঘামও ঝরিয়েছেন। আপনাকে কি আমার বুঝিয়ে বলতে হবে কেন বিএনপি জামাত সমর্থককে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী বলি? ভয় হয়, গোলাম আযম বিরোধী সেই জনসভায় ছিন্ন পাদুকার এক পাটির সাথে আপনার বিবেক বুদ্ধি এবং চিন্তা পদ্ধতিটিও জলাঞ্জলী দিয়ে এসেছেন কিনা! যে বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে, জাতির জনক, চার নেতা আর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের রক্তের দাগ হাতে নিয়ে যারা ক্ষমতায় এল, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে কয়েক দশক ধরে কয়েক প্রজন্ম ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে দিল, ঘাতকদের পুনর্বাসিত করলো, ক্ষমতা দিল, মন্ত্রীত্ব দিল, নিজেদের দল থেকে স্বাধীনতার সপক্ষের শেষ চিহ্নগুলোও বিতাড়িত করলো – তাদের যে সব শিক্ষিত সচ্ছল মানুষেরা ভোট দিল – লক্ষ্য করুন – শুধু “সহ্য”ই করলো না, অপ্রতিবাদে “নিরব” থাকলো না – ভোটের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সমর্থনের সীল মারলো, তাদেরকে আর কি বলা সংগত? এদের স্বাধীনতা বিরোধী বলাকে আপনার ধৃষ্টতা মনে হল? এদের ইতিহাস বিস্মৃত, অকৃতজ্ঞ, মেরুদন্ডহীন, কুলাঙ্গার বললে আপনার মনোবেদনা কিছু কম হতো কি?
এই ইতিহাসগুলো কি আপনার সত্যিই জানা নেই? জানা না থাকলে দয়া করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়ে, পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখে নেবেন, পড়ে নেবেন। মাঠে গিয়ে হাওয়া না হয় একদিন নাই খেলেন!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মন্তব্যটি দীর্ঘ হয়ে গেল। আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
মুক্তাঙ্গনের সবাইকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা। তসলিমা নাসরিনের কবিতায়:
রেজাউল করিম সুমন - ১ জানুয়ারি ২০০৯ (৭:৪৩ অপরাহ্ণ)
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে চাই আরমান রশিদকে, যার লেখার প্রতিক্রিয়ায় অস্মিতা একটি স্বতন্ত্র পোস্ট লিখতে প্রণোদিত হয়েছেন। দুজনের দ্বৈরথ থেকে অনেকগুলো পয়েন্ট উঠে আসছে। অনুসরণ করছি।
এই সুযোগে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের — অর্থাৎ গত দু-তিন দিনের — কয়েকটা বিচ্ছিন্ন টুকরো প্রতিক্রিয়ার কথা বলি। আমাদের এক বামপন্থী বন্ধু এই পট-পরিবর্তনে একেবারেই খুশি নয়। কেন? উত্তরে জানা গেল, অচিরেই বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে প্রতারিত হবে, কাজেই আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের এই বিজয়ে খুশি হবার সুযোগ কোথায়! তার দল এবার “না ভোট”-এর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল।
অন্য এক (অতি)-বাম ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের নির্বাচন মহাষড়যন্ত্রের নির্বাচন। তাঁর দলের লোকজন একমত হলেও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীরা কেউই এই মূল্যায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না! আর তাই মনের দুঃখে তিনি হয়তো এখন সুধীন দত্ত আওড়াচ্ছেন, “বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী”!
এদিকে কলকাতার এক নামকরা লেখক — বাংলাদেশ-বিশেষজ্ঞও বটে — তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের পাঠিয়েছেন উচ্ছ্বসিত এক ইমেইল বার্তা :
অভিনন্দন বাংলাদেশের মানুষকে
অভিনন্দন আমার বন্ধুদের
প্রগতিশীল চিন্তার জয়
সাম্প্রদায়িকতার পরাজয়
আমাদেরও উদ্দীপ্ত করেছে
নতুন বাংলাদেশের জন্ম হবে এই আশায় বুক বাঁধছি
আপনারা কী করছেন কী ভাবছেন জানতে ইচ্ছে করছে
বাংলাদেশের এক অগ্রগণ্য কবি আমাকে ফোনে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে: “আমরা নতুন করে স্বাধীন হলাম।” “একটু কি অতিশয়োক্তি হয়ে যাচ্ছে না?” — আমার এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আমার জন্মসাল জানতে চাইলেন। স্বীকার করতে হলো, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি।
মুক্তিযুদ্ধ-না-দেখা আমার মনে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গত আওয়ামী আমলে মুখে-মুখে প্রায়-প্রবাদ-হয়ে-ওঠা একটা কথা : “আওয়ামী লীগ হারলে আমরাও হেরে যাই, কিন্তু আওয়ামী লীগের জয়ে আমরা জিতি না কখনো।” নতুন একটা প্রশ্নও এখানে ওঠে : এবারের অভূতপূর্ব এই জয় কি কেবল আওয়ামী লীগেরই জয়?
একাত্তরে সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন আর সংগ্রামের ভিতর জন্ম নিয়েছিল যে-বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশকে ফিরে পেতে চাই আমরা।
সৈকত আচার্য - ৩ জানুয়ারি ২০০৯ (২:০৯ পূর্বাহ্ণ)
@ রেজাউল করিম সুমনঃ
আপনার ঐ বামপন্থী বন্ধুকে দয়া করে বলবেনঃ
চারপাশের মানুষের সাথে যাতে তারা প্রতিদিন অল্প অল্প করে দু’ চার কথা বলার অভ্যাস তৈরী করে, তাদের জন্য দু’দন্ড সময় কষ্ট করে যাতে ব্যয় করে, নইলে প্রচুর বই, দলিল, দস্তাবেজ ও সংগ্রামী কাহিনী পড়তে পড়তে তিনি জনগন থেকে অনেক বেশি এগিয়ে যাবেন। জনগণ অনেক পেছনে পড়ে রইবেন। তিনি আরো এগিয়ে যাবেন। একা। জনগণ আরো পিছিয়ে পড়বেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি পৌঁছে যাবেন আগামী শ’তকে। হাতছানি দেবেন জনতাকে। বিপ্লবকে। ডাক দেবেন বিপ্লবের।
আগামী শতকের পৃথিবী থেকে সেই ডাক এই পৃথিবীর কানে এসে পৌঁছুবে কিনা, এবং জনতার কোন সারা মিলবে কিনা কে জানে। সেদিন পুঁজিবাদের সংকট আরো চরমে উঠবে, সাম্রাজ্যবাদ আরো একচেটিয়া হয়ে পুরো বিশ্বের মানূষের অগ্রগতির পথ আগলে দাঁড়াবে। সে দিন শোষণ থাকবে চরমে, জনতা থাকবে দুনিয়াব্যাপী মারমুখো, কিন্ত যে বামপন্থী বন্ধুরা একটি বিপ্লবী দল নিয়ে এ সবের সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেবেন বলে আমরা জানি, সেদিন তাদের দেখা মেলা ভার হয়ে যাবে, যদি তারা জনতার ভাষা না বুঝেন। বিপ্লবের জন্য সবক্ষেত্র প্রস্তত থাকার পর ও দাবানল জ্বলে উঠতে পারবেনা, যদি সংগঠন প্রস্তত করা না থাকে।
আজ থেকে শুরু হয়ে যাক, মানুষের নাড়ি বোঝার সংগ্রাম। চলুন বাম পক্ষের বন্ধুরা, জোতিষ শাস্ত্র চর্চা বন্ধ করি। গণ মানুষের রাজনীতির চর্চা শুরু করি। শুরুটাতো অন্তত করি। না হলে, সেই যে মান্না দে গেয়েছেনঃ
তাই ই সত্য হয়ে থাকবে।
আরমান রশিদ - ২ জানুয়ারি ২০০৯ (২:২৫ অপরাহ্ণ)
পূর্ববর্তী মন্তব্যের পরিসংখ্যানগুলি এখান থেকে নেয়া।
@রেজাউল করিম সুমন (মন্তব্য ৫)
ধন্যবাদ আপনাকেও।
বাম দল আর (অতি) বাম দল দুটির নাম জানতে পারি কি? মাফ করবেন যদি নাম জানতে চাওয়া টা ব্লগিং এর রীতি বিরুদ্ধ হয়।
সাথেই থাকুন।
মাসুদ করিম - ৩ জানুয়ারি ২০০৯ (৩:১৫ পূর্বাহ্ণ)
আমার হাতে সময় খুব কম, সময় কম থাকলে আমি সাধারণত ব্লগে ঢুকি না, বা ঢুকলেও মন্তব্য করি না। কিন্তু একটা ছোট্ট অনুভাবনা আমাকে তাড়া করল। হুমায়ুন আজাদ একটা বই লিখেছিলেন “আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম?” সেটা ছিল ২০০১-এ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিএনপিজামাত দু:শাসনের তীব্র প্রতিক্রিয়া। আওয়ামী লীগ যেন সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে, যেন দু:শাসন ফিরে না আসে এদেশে, আর যদি ২০০৯-এ আবার ফিরে আসে সে দু:শাসন, তবে সেই দু:শাসনের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় লেখা হবে আরেকটা বই, কে লিখবেন তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু যে বইটা লেখা হবে তার শিরোনাম আমরা জানি : “আমরা কি কখনো বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?” কাজেই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের মানুষ যেন সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে, ওই অস্তিত্ববিলীন করা বইটা যেন কাউকে লিখতে না হয়।
শামীম ইফতেখার - ৩ জানুয়ারি ২০০৯ (৭:১৬ পূর্বাহ্ণ)
[আলোচনার সুবিধার্থে মন্তব্যটি এখানেও কপি করা হল। এই থ্রেডে লেখকের মূল পোস্টেও কিছু আলোচনা চলছে, এখানে দেখুন - ব্লগ প্রশাসক]
আরমান রশিদের মূল পোস্টে বলা হয়েছে:
প্রথমত: জানার আগ্রহ হচ্ছে ঠিক কোন্ নির্বাচনী অঞ্চলের ভোটারদের কথা বলা হচ্ছে এখানে? অঞ্চলের নাম জানা থাকলে প্রার্থী ডাটাবেজ দেখে বিস্তারিত আলোচনায় অংশ নেয়ার ইচ্ছে আছে। জানতে চাচ্ছি একারণেই – দেশের সব অঞ্চলের ভোটারদের নির্বাচনের দিন এমন শুষ্কমূখ হবার কথা না।
দ্বিতীয়ত: যে প্রশ্নটি সাথে সাথেই মনে উদয় হয়, তা হল, যে ভোটাররা শুষ্ক মুখে ভোট দিয়ে বাড়ী ফিরেছেন, তারা ২০০১ এর নির্বাচনের দিন কেমন মুখে বাড়ী ফিরেছিলেন? আনন্দিত মুখে? যদি ধরে নিই সেদিন তারা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভোট দিয়ে বাড়ী ফিরেছিলেন, তাহলে তাদের সেদিন এতো আনন্দের উৎস কি ছিল? আরও, ২০০১ এও যদি তারা শুষ্ক মুখে ফিরে থাকেন, তাহলে সেই শুষ্কতা কি এই জন্যে যে তারা পার্লামেন্টে পাঠানোর মত প্রার্থী হিসেবে মুজাহিদ-নিজামীর জোট ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাননি?
তৃতীয়ত: পোস্টের মূল সুরে শুষ্ক মুখ ভোটারদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, মনে হচ্ছে যেন এরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ট ভোটার। আর তা নাহলে তাদের নিয়ে পোস্ট লেখার প্রয়োজন নিশ্চয়ই লেখক অনুভব করতেন না। আর এঁরা যদি সংখ্যাগরিষ্ট ভোটারের অংশ না হয়ে থাকেন, তাহলে এঁদের শুষ্ক মুখ নিয়ে এত উতলা হবার তো কোন কারণ দেখিনা।
চতুর্থত: সারা দেশ জুড়ে মানুষদের ভোট দানের যে উৎসব আমেজের কথা জানি, তা কি আসলে ভুল/বানোয়াট ছিল? প্রতিটি টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে প্রতিটি পত্রিকা আর ব্লগে আমরা কিন্তু উল্টোটাই জেনেছি। “উৎসব আমেজ” আর “শুষ্ক মুখ” একটু পরস্পর বিরোধী হয়ে যায় না কি? আমার তো মনে হয় এই তথাকথিত শুষ্ক মুখ মানুষগুলো আসলে কে, কিংবা তাদের অতীত রাজনীতি আর ভোটের প্যাটার্ণ কি তা একটু খতিয়ে দেখাটা এখানে জরুরী।
সবশেষে, নির্বাচনের ঠিক পর পরই সারা দেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, বহির্বিশ্বের সমস্ত বাঙ্গালীরা যখন দিনটিকে এবং ভোটের ফলাফলকে সেলিব্রেট করছে, ঠিক তেমনই এক মুহুর্তে লেখকের এই তিক্ত প্রতিক্রিয়া কিছুটা অবাক করেছে আমাকে। নির্বাচিত দলের নিরন্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে অনেকেই একটু নার্ভাস। আমিও কিছুটা, অনেকেরই মতো। সে দুশ্চিন্তা একচ্ছত্র ক্ষমতা কিভাবে ব্যবহৃত হয় সামনের দিনগুলোতে, তা নিয়ে; সে দুশ্চিন্তা জনগণের আকাশসম expectation নিয়ে, যা বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই পূরণ করা হবে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পোস্ট লেখক যে শুষ্কমুখ মানুষদের প্রতিক্রিয়ার কথা জানালেন, তা হয় সমষ্টির অতি সরলীকৃত চিত্রায়ন, না হয় ভ্রান্ত। আর নয়তো তা একটি নির্দিষ্ট খন্ডিত শ্রেনীর ভোটারদের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন।
নীড় সন্ধানী - ৪ জানুয়ারি ২০০৯ (৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
চমৎকার একটা আলোচনা-কাম-বাকযুদ্ধ। যেমন মূল লেখা তেমনটি মন্তব্য সকল, একে অপরের চেয়ে কাটিখানিক সরস, কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। আমি এই বিতর্কে নতুন করে কিছু বলার দেখছি না, যতটুকু বলার থাকতে পারে তার চেয়ে বেশী বলা হয়ে গেছে। চমৎকার এই আলোচনা দেখে বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিলো সংসদটা যদি এরকম হতো, এত সুন্দর বিতর্কময়, কথাময়। বিদ্বেষের বদলে যদি প্রানবন্ত হতো!
নির্বাচন নিয়ে আমার সামান্য কয়েকটা পর্যবেক্ষনের কথা বলিঃ
১) মধ্যবিত্ত ভোটারদের বেশীরভাগ স্থান পরিবর্তন করেনি। জোট সরকারের চরম দুর্নীতি চুরি-বাটপারিকে তিরস্কার করেও ধানের শীষে ভোট দিয়ে স্ববিরোধীতার চিরায়ত নজীর এবারও রেখেছে। আমি এই শ্রেনীটা, যাদের সংখ্যাগরিষ্ট বয়স্ক, যাঁরা এখনো মুসলিম লীগ মানসিকতায় বিএনপি আওয়ামী লীগকে মূল্যায়ন করে, তাদেরকে সমাজের দুষ্ট ক্ষত বলবো।
২) নিন্মবিত্ত ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তাঁরা দলে দলে নৌকায় সীল মেরেছে। এদের কারনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোট পেয়েছে।
৩) তরুন ভোটার, নতুন ভোটারগন খালেদা পরিবারের দুর্নীতি ও রাজাকার প্রীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এদের কারনেও আওয়ামী লীগ এই বিরাট ব্যবধানে জিতেছে।
কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হবে যখনঃ
১) আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার আগামী পাঁচ বছর আলমিরায় তুলে রাখবে
২) আওয়ামী লীগ ভুলে যাবে এই বিজয় দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের অবদান নয়
৩) আওয়ামী লীগ বিএনপির ভুল রাস্তাকে আদর্শ হিসেবে নেবে
১ম ভুলের সুত্রপাত ২০০৯:
নির্দলীয় লোকের খোঁজ না করে সরাসরি দলীয় নেতা জিল্লুর রহমান কে দেশের প্রেসিডেন্ট বানানো সিদ্ধান্ত।
সমর্থনে যুক্তিঃ
-নিরপেক্ষ নির্দলীয় মানুষ বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে প্রেসিডেন্ট করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিরাট ভুল করেছিল। আওয়ামী লীগের ২০০১ নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য সেটা প্রধান একটা কারন।
আমার মতঃ
-এটা একটা কুযুক্তি, কুপমন্ডুকতা, ও আওয়ামী লীগের সত্যদর্শনের ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগের ২০০১ সালের ভরাডুবির জন্য ৮০% দায়ী হাজারী-তাহের গং জাতীয় গডফাদার সন্ত্রাসীরা যাদের দমন না করে উৎসাহিত করা হয়েছিল।
এখানে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ নিজেদের ভালো কাজের মূল্যায়ন করতে জানে না। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো দেখার ক্ষমতা যাদের থাকে না, তাদের কাছ থেকে খুব বেশী কিছু আশা করা যায় না। তাই আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জিতলেও দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনার ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
আরমান রশিদ - ৫ জানুয়ারি ২০০৯ (৫:০১ পূর্বাহ্ণ)
@ অস্মিতা (৪ নং মন্তব্য)
আপনার মজার মজার মন্তব্যগুলি (‘নৌকা’য় ভোট দেয়ার কারণ) পড়ে প্রাণ খুলে হাসলাম। মনে পড়ে গেল বহু পুরোনো সেই সব বন্ধু মহলের আড্ডাগুলির কথা। একে অন্যকে পচিয়ে আরো বুদ্ধিমান হওয়ার সেই পুরোনো বালকসুলভ খুনসুটিতে এককালে কিছুটা দক্ষতা থাকলেও বহুদিনের চর্চার অভাবে এখন আমি একেবারেই ম্রিয়মান। তাই আপনার শাণিত জিভের মিছরির ছুরির বিপরীতে সেই চেষ্টায়ই যাব না। আপনার বয়স জানা নেই, যদি বিশ-বাইশ উত্তীর্ণ হন তবে আপনাকে অভিনন্দন অভ্যাসটা ধরে রাখতে পেরেছেন বলে। অসংখ্য হাততালি আর ধন্যবাদ আপনাকে।
একটি উন্মুক্ত বিতর্কের মূল উদ্দেশ্যই যদি তথ্য সংগ্রহ আর যুক্তির ভিত্তিতে ধীরে ধীরে মতভেদ ঘোচানো হয় তবে আসুন প্রথমেই দেখি এখন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কি কি মিল এই আলোচনা থেকে উঠে এসেছে। আপনি এরশাদের সাথে একাত্মতায় মৃদু আশাহত জেনে খুশি হলাম (যদিও মৌলবাদের সাথে চুক্তির কথা কিছু বলেননি – যেখানে শুনেছি ফতোয়া জারীও জায়েজ করা হয়েছিল)। অন্তত পক্ষে এটা একটা ভাল শুরু। আরো ভাল লেগেছে আপনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত আছে জেনে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আপনার সারা জীবনের গবেষণা লব্ধ ‘বিপুল জ্ঞানভান্ডার’ থেকেও ভবিষ্যতে অনেক কিছু শেখার আশা রাখি। আর আপনার লেখায় আত্মশুদ্ধির আর আত্মদর্পণের যে বিষয়গুলি বার বার উঠে এসেছে, আমার ধারণা এই বিতর্কের মাধ্যমে আমরা সেই চেষ্টাই করছি। তাহলে শেষ সমীকরণে একটা পার্থক্যই ফুটে উঠে আর তা হল আওয়ামী লীগের এবং এর বর্তমান নেত্রীত্বের প্রতি আপনার একচ্ছত্র অন্ধ আনুগত্য (স্বল্প পরিচয়ে আমার এই অনুধাবনটি যদি ভুল হয় তবে আর বাকিটুকু পড়ার প্রয়োজন নেই, এখানেই পরস্পরকে ধন্যবাদ দিয়ে আপাতত বিদায় নিতে পারি) । আপনার কি জানা নেই, প্রতিপক্ষ নয়, বরং বাস্তবতা বিবর্জিত অন্ধ আনুগত্যই যে কোনো দলের সব চেয়ে বড় শত্রু! আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, রাজনীতি এমনকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েও নিজেকে বিশেষজ্ঞ বলে দাবী করি না। ভাষাজ্ঞান আরো সীমিত এবং নিজের আবেগকে কলেমে (বা কী-বোর্ডে) নিয়ে আসার ব্যাপারে তো একেবারেই হাস্যকর। তবে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যুক্তির অঙ্গনে সামান্য হয়তো বিচরণ করেছি। এবার দেখি সেই যুক্তির (আমার একমাত্র অস্ত্র) ভিত্তিতে আপনার আনুগত্যে কিছুটা বাস্তবতার ছোঁয়া দেয়া যায় কি না।
আপনার চেতনার প্রতি পূর্ণ সমর্থন আর শ্রদ্ধা সত্যেও জানাতে হয়, কোনো আদর্শের বা চেতনার প্রতি ভালবাসা বা আনুগত্য এমনকি দেশপ্রেম যখন যুক্তিহীন আর অন্ধ হয় তখন তা মৌলবাদেরই নামান্তর। ৯/১১ পরবর্তী আমেরিকায় আমি এমন অনেক তরুণ দেখেছি যারা দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে হিংস্র আক্রোশে নিরিহ আফগান-ইরাকিদের কচুকাটা করেছে। একই ঘটনা ঘটে ২য় বিশ্বযুদ্ধ প্রাক্কালে জার্মানিতে। এর সবই আপনার জানা বলে আমার বিশ্বাস। এসব ঘটনাকে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে তুলনা করছি না বরং সতর্ক করছি তাদের যারা আপনার মত দেশের ৩২% (বা হয়ত ৩৯% এমনকি ৫২%) ভোটারদের যুদ্ধাপোরাধীদের সাথে এক কাতারে দাঁড় করাতে সচেষ্ট। সেই চেষ্টা “সকল অমুসলিমই কাফের আর নরকের কীট” বলার সামিল। তাই অন্ধ সমর্থনের আগে দেখার বিষয় আমাদের সেই ভালবাসা আমাদের নেতা-নেত্রীরা ঠিক পথে ব্যবহার করছে কিনা বা এর থেকে ফায়দা লুটছে কিনা। আরো দেখার বিষয় তারা মুখে মুখে যে চেতনার কথা বলে তাদের কাজে তা প্রমাণ করছে কিনা। আপনার লেখা আবার পড়তে গিয়ে মনে হল আপনি নির্বাচনের ৮৫% বনাম ১০% আসনের সংখ্যাগত মায়াজালে আটকা পড়ে গেছেন আর এই আবেশ ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই সেই অতিরিক্ত আত্মতূষ্টি কিছুটা কাটাতে আপনাকে জানাই যে ভোট সংখ্যা বিবেচনায় কিন্তু পার্থক্যটি ৪৮% বনাম ৩২%। শুনতে অতটা ভাল শোনাল না, তাইনা? আরেকটু এগুলে হয়ত ধড়মড় করে উঠে বসবেন। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় ৫২% লোক এই নির্বাচনে হয় ভোটই দেয়নি(১৩%) নতুবা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে(৩৯%)। আশাকরি এবার আপনার পূর্ণ মনযোগ পেয়েছি। হয়ত ভাবছেন গ্লাসটা অর্ধেক পূর্ণ না ভেবে অর্ধেক খালি দেখার চেষ্টা করছি । যাইহোক, এতেই কি প্রমাণ হয় না জাতি হিসেবে আমরা আজও কতটা বিভক্ত? তাই আমদের কাজ শেষ হয়ে গেছে ভেবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো কারণ নেই। এজন্যই ভোটের এই ফলাফলে হাঁফ ছেড়েছি, খুশি হয়েছি স্বাধীনতা বিরোধীদের ঠেকাতে পেরে, কিন্তু অহেতুক আত্মতূষ্টিতে বিগলিত হয়ে যাইনি। এই নির্বাচনে যেই ২ কোটি ৩১ লাখ (মহাজোটের ৩ কোটি ৪২ লাখের বিপরীতে) ভোটার চার দলকে ভোট দিয়েছে (বা যেই ৩৯% ভোটার আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে) তাদের সরাসরি দেশ ও জাতির শত্রু হিসেবে চিহ্নিত না করে বা ইতিহাস বিস্মৃত, অকৃতজ্ঞ, মেরুদন্ডহীন, কুলাঙ্গার বলে গাল না দিয়ে বরং কারন খোঁজার চেষ্টা করি তাদের এই মনভাবের। জানার চেষ্টা করি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটির অর্থ তাদের কাছে কি আর দৈনন্দিন জীবনে তাদের কাছে কোন বিষয়গুলি প্রাধান্য পায় যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের এই সিদ্ধান্ত জানায়। আমি কেন নৌকায় ভোট দিতাম তার ‘কল্পনাপ্রসূত’ কারণ খোঁজার চেয়ে তা বরং অনেক বেশী অর্থবহ হবে। আমার মতে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য একটা অংশই অন্ধ স্বাধীনতা বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের দোসর। আর চেতনা বিবর্জিত যে শিক্ষিত শ্রেনীর উল্লেখ করলেন সেই টেন্ডার/সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদীর দল ছড়িয়ে আছে ব্যাবসায়িক মহল থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ এমনকি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকারী সুশীল সমাজের মধ্যেও এবং তারা তো দুই পক্ষেই উপস্থিত। শুধু পার্থক্য এটুকুই যে আওয়ামী লীগের পক্ষের এই সুবিধাবাদীরা জোর গলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম মুখে আনতে পারে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেউ কথা বললেই সে সুবিধাবাদী নয় ভাবাটা বোকামি হবে।
স্বপ্নের যে বাংলাদেশ আমরা দেখি আপাত দৃষ্টিতে বিপক্ষের এই বিপুল জনগোষ্ঠিকে বাদ দিয়ে, তাদের এই একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ না করে আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পারবনা। আর এতে বিফল হলে ভবিষ্যতের প্রতিটি নির্বাচনে বারবারই দেশ যেন একটা পিভোট পয়েন্টের উপর পেন্ডুলামের মত দোদুল্যমান অবস্থায় থাকবে। কে না জানে কাউকে নিজ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে গালাগালি করাটা কতটাই না হাস্যকর একটা কৌশল! নাকি আপনি নিজ আবেগের গর্বে নিমজ্জিত হয়ে বিপক্ষের সকলকে গালাগালি করেই বেশী আত্মতুষ্টি পান আর অন্যদের মাঝে এই একি আবেগ ধীরে ধীরে বিস্তারের চেষ্টাকে নেহাত অপ্রয়োজনীয় মনে করেন? ভুলে যাবেন না দেশটা আপনার আমার যতটুকু, দেশটা তাদেরও ততটুকুই। নয়তো আর একটা কাজই বাকি থাকে, হয় ‘জয় বাংলা’ বলে লগি বইঠা হাতে তাদের কচুকাটা করি নয় দেশটাকে আরেকটা ভাগ করে এই ৩২% কে সেখানে খেদিয়ে দিয়ে একটা নতুন রাষ্ট্র ‘আওয়ামী বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করি (বাকশালের কথা মনে পড়ে গেল কি?)। আশা করি এটা অন্তত বলবেন না, ছোট্ট এই দেশটা আবার ভাগাভাগি করা কেন বাপু, এই ২ কোটি ৩২ লাখই তো মাত্র লোক, পরিবার পরিজন সহ ৫ কোটি হবে বড়জোড়, তাদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলেই হয়, লেঠা চুকে যায়।
আমার ধারণা (ভয়ে ভয়ে বিনয়ের সাথে বলছি) ৭১ এর পর থেকে আমাদের দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ সহ সকল রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে যেভাবে প্রতারিত হয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে জাতি আজ এত বিভক্ত। এবং সেই প্রতারণার দায়িত্ব ৭২-৭৫ এর আওয়ামী নেতৃত্ব অর্থাৎ (দুঃখের সাথে বলতে হয়) খোদ বঙ্গবন্ধুর উপরও কিছুটা বর্তায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি ৭৫ পরবর্তী কোনো নেতৃত্বের ওপর সমালোচনা করার জন্য যতটুকু লাগে সেই পরিমাণ শ্রদ্ধাবোধটুকুও আমার নেই তাই সেই দিকে এগুচ্ছিনা। সাথে সাথে একথাও মানি, দীর্ঘ ১৫ বছর ব্যাপি সামরিকতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের অপপ্রচার আর প্রচার মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণকে অন্ধ করে রাখাও এই বিভক্তির অন্যতম প্রধান কারণ। হয়ত অহেতুক আরেকটি অর্থহীন বিতর্কের সুত্রপাত করছি, তবু বলি ‘দেশের জন্য দল’, ‘দলের জন্য দেশ’ নয়। ৭১ এ জনমানুষের চেতনা তৎকালীন আওয়ামী লীগের আদর্শে পরিস্ফুটিত হয়েছিল বিধায় আওয়ামী লীগের এক ডাকে লাখ লাখ লোক জীবন দিতে পিছপা হয়নি। এবং ৭ কোটি লোককে এক ডাকে একত্রিত করার সেই ঐতিহাসিক অসাধারণ অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুর।তিনিই এই জাতীকে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাবার পথ দেখিয়েছেন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে। জাতির পিতা হিসেবে তার সেই অর্জনকে অস্বীকার করা নিজেদের বেজন্মা বলে গাল দেয়ার সামিল। একই ভাবে যুদ্ধকালীন সময়ে তাজ ঊদ্দিনের মত একজন নেতা পাওয়া ছিল আমাদের পরম সৌভাগ্য। সেই সাথে স্বরণ করতে হয় সেই বাম পন্থী দল আর নেতাদের কথা, ৭১ এমনকি ৪৭ এরও অনেক আগে থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা এখন যা বুঝি আমাদের মনে সেই অনুভূতির ভিত্তি স্থাপন করার জন্য যারা কাজ করে গেছেন। দুঃখের বিষয় এই যে ৭১ পরবর্তী সময়ে এই সব বাম পন্থী নেতাদের অনেককেই নির্বিচারে হত্যা করা হয়। আর তাজ উদ্দিন? তাকে তো এক প্রকার দল থেকেই তাড়িয়ে দেয়া হয়। একই সাথে আওয়ামী লীগের বহু নেতা রাতারাতি কোটিপতি বনে যায়। আর বঙ্গবন্ধু হয় এসব দেখেও দেখেননি অথবা দলের নেতা কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে তিনি ছিলেন অপারগ। এই প্রসঙ্গে দুটো ছোট্ট কাহিনী বলি। ছাত্র জীবনে আমার প্রয়াত বাবা একজন একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। একাত্তরে অন্য অনেক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীর মত দেশ ত্যাগ না করে তিনি দেশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি তার অন্ধ সমর্থন বেশীদিন টেকেনি। ৭৩ এর নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে তিনি যেদিন দেখলেন তার ভোট ইতিমধ্যে দেয়া হয়ে গেছে সেদিন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেন। পরের গল্পটা তারই এক সহপাঠির (যিনি এখনো জীবিত আছেন এর সত্যতা প্রমাণের জন্য )। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্যেও ৭১ এ তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। চট্টগ্রামের বেশ কয়টি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার ছিলেন তিনি। অগণিত যুদ্ধে অংশ নিয়ে ‘মহামুল্যবান’ ঘাম ঝরিয়েছেন (রক্ত কথাটা বলতে পারছিনা কারণ তিনি আহত হয়েছিলেন কিনা জানা নেই)। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বাম পন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবার অপরাধে ৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত স্ত্রী-কন্যা ফেলে তাকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে আর মাঝরাতে বন্ধুদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়েছে একটু আশ্রয় এর আশায়। যে দেশের জন্য তার এই বিশাল আত্মত্যাগ শেষ পর্যন্ত তিনি সেই দেশই ছাড়তে বাধ্য হন। তাই আপনার কাছে জানতে চাই, সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকারের এই সকল কর্মকান্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কতটুকু বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়? এই কারণেই কি আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক ধীরে ধীরে ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হয়নি? তাই আড়াই কোটি (আর ৫২% বিবেচনায় ৭ কোটিরও বেশী) লোককে ঢালাও ভাবে গালাগাল দেয়ার আগে তাদের দিকটাও দয়াকরে বিবেচনা করার চেষ্টা করুন। আর আপনি যে আত্মদর্পণের কথা বলছেন তা নিজ দলের উপরই প্রয়োগ করুন না কিছুটা। আপনার কথার সূত্র ধরে
অস্মিতা - ৫ জানুয়ারি ২০০৯ (৪:২৭ অপরাহ্ণ)
@ আরমান রশিদ (#১০)
যাদের নিয়ে কিনা আলোচনা করার মত শ্রদ্ধাবোধটুকুও আপনার অবশিষ্ট নেই, তাদেরকে যারা ক্ষমতায় আনলো তাদের মতামতের প্রতি আমাকে “শ্রদ্ধাশীল” হতে বলছেন? একটু বোধ হয় স্ববিরোধিতাই হয়ে গেল। আপনি এক জায়গায় বলেছেন “এবার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতার অভাব নেই। তারা যদি সত্যিই দেশটাকে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত করতে পারে তবে তাদের সাত খুন মাফ। “সেই চেষ্টায় দেশে যদি একটা যুদ্ধও বাধে তাও ভাল, অন্তত ‘৭১ এর অসম্পূর্ণ যুদ্ধটা যদি শেষ করা যায়।” অথচ আমি যখন এদের (যুদ্ধাপরাধী জোটকে যারা ক্ষমতায় আনেন) স্বাধীনতাবিরোধী বলি, তখন আপনি আমার মধ্যে “অন্ধ আবেগ” দেখেন, বাকশাল পূনর্গঠনের চক্রান্ত দেখেন, লগিবৈঠা হাতে এই সমর্থকদের পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র দেখেন! আবারও স্ববিরোধিতা। আর যদি সেই যুদ্ধটি বাধে আজ, তবে প্রতিপক্ষ কারা হবেন বলে আপনি মনে করেন? শুধুই কি জামাত? সেই জামাতকে সমর্থন করে সামনে বা পেছন থেকে কারা “ইসলাম গেল”, “সার্বভৌমত্ব গেল”, “মানবাধিকার গেল”, “ঐ যে ভারত এলো” বলে আওয়াজ তুলবে সে বিষয়ে কি আপনার কোন সন্দেহ আছে? শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে যারা (স্বাধীন দেশে জামাতকে পাশে বসিয়ে) “দেশদ্রোহী”, “পতিতা” বলে গাল দিয়েছিল, তাদেরকে (কিংবা তাদের ভোট দানকারী সেই ৪১% বা ৩২%) কি আমরা ভুলে গেছি এরই মধ্যে?
আপনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন এই নির্বাচনে চার দলীয় জোটকে ভোট দিয়েছে ৩২%। লিখেছেন:
আমাকে বিনীতভাবে স্বীকার করতেই হচ্ছে – এই সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থন প্রদানের কারণ আমি অনুধাবন করতে ব্যর্থ। তবে আশা করি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে প্রগাঢ় যুক্তিবাদী মন নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারবেন জোট সরকারের দুষ্কর্মের তালিকায় আর নতুন কোন্ দুষ্কর্মটি যুক্ত হলে এই গোষ্ঠিটি তাদের আর ভোট দেবেনা কিংবা নিদেন পক্ষে “না ভোট” দেবেন বা অন্য কোন প্রার্থী খুঁজে নেবেন।
নৌকাকে এই ৩২% কি কারণে ভোট দেয়না, তার কিছু কারণ অবশ্য আপনি চিহ্নিত করেছেন। আলোচনার স্বার্থে সেগুলোকে আমি শ্রেনীবদ্ধ করছি, ভুল হলে বা কিছু বাদ পড়ে থাকলে শুধরে দেবেন সেই ভরসা রেখেই।
-‘৭১-‘৭৫ সময়ে আওয়ামী সরকারের সময়ে কিছু মানুষের দুর্নীতি (যে অভিযোগটি অনেকাংশে সত্য বলে মনে করি)।
-আওয়ামী লীগের বাকশাল গঠন। (সত্য)।
-বাম সংগঠনের (মূলতঃ জাসদের) নেতাকর্মীদের হত্যা নির্যাতন। (সত্য)।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই ক’বছরের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি সেই সব মানুষের ভূমিকা যারা ‘৭৫-২০০৮ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিএনপি জামায়াতের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আমি বলেছি এই সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে যাদের ভূমিকা নিয়ে আমার মূল প্রশ্ন তারা “শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল” (উপরে আমার ৪ নং মন্তব্য দেখুন)। “শিক্ষিত” বলতে বুঝিয়েছি যারা ইতিহাস পড়েছেন বা পড়ার ক্ষমতা রাখেন। “স্বচ্ছল” বলতে বুঝিয়েছি ন্যূনতম অর্থে শুধুমাত্র “পেটে ভাতে” বাঁচার জন্য যাদের ভোট বিক্রি করতে হয়না। এবার দেখি আপনার উপরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ‘৭৫ পরবর্তী বিএনপি সমর্থকদের ভূমিকা।
(১) আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আপনার ভাষায় ‘রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া’ বেশীর ভাগের পরবর্তী বছরগুলোতে ঠাঁই হয়েছে কোথায়? মেজর জিয়া মন্ত্রী সভা করেছিলেন কাদের নিয়ে? সৎ ত্যাগী বাম নেতাদের নিয়ে কি? ২০০১ সালের পর জোট সরকারের পুকুর চুরী কি এই ৩২% এর অজানা?
(২) বাকশাল গঠনের কারণ ও ফলাফল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। যে মানুষটি স্বাধীন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ অনেকে দিয়েছেন। সিদ্ধান্তটিকে কি আমি সমর্থন করি? একেবারেই না। কিন্তু ‘৭৫ থেকে ২০০৮ এই পুরো সময়টিতে আওয়ামী লীগ কি তার বাকশালীয় সিদ্ধান্তে ফিরে গেছে? ‘৯৬ ক্ষমতা পাওয়ার পরও? এবারেও জনগণ তাদের কার্যত “এক দলীয় শাসন” নিশ্চিত করার পরও শেখ হাসিনার গত কয়েক দিনের কোন আচরণ বা বক্তব্য কি তার ইঙ্গিত দেয়?
(৩) ‘৭১-‘৭৫ সময়ে সব চাইতে বেশী নির্যাতনের শিকার জাসদের নেতৃত্বের মূল ধারাটি বর্তমানে কোন্ জোটে আছেন? এঁরা জোটে আছেন কেন? আওয়ামী লীগকে সর্বাংশে সমর্থন করেন বলে? নাকি ‘৭১ এর চেতনার মূল ধারাটির পক্ষে এখনো একে কমন প্লাটফর্ম মনে করেন বলে? তাদের কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছেন, সেই প্রতিশোধ নিতে তারা ‘৭১ এর চেতনা পরিপন্থী শক্তিকে সমর্থন দেননি কখনো। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুন্ন রাখতে অন্যান্য বাম দলগুলোর সাথে মিলে কখনো কখনো দেশদ্রোহীতার অপবাদ মাথায় নিয়ে সংগ্রাম করে গেছেন। একই কথা ১৪ দলের অন্য শরীকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর বাইরে বাম দলের আরও ধারা যেগুলো মহাজোটের বাইরে, তারা কখনো নিজেরা প্রার্থী দিয়েছেন, প্রয়োজনে “না ভোটের” প্রচারণা চালিয়েছেন, কিন্তু তাদের সমর্থকরা কখনো বিএনপি-জামাত জোটকে সমর্থনের সীল মারেননি। এর বাইরে যে সব প্রাক্তন বামেরা বিএনপি সমর্থক, তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে সমাজতন্ত্রের কোন্ আদর্শের ভিত্তিতে তারা একটি বুর্জোয়া উগ্র ডানপন্থী জোটের সাথে এক কাতারে সামিল হন।
আপনি তাজউদ্দিন এর কথা বলেছেন। যত দূর জানি মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁর শেষ আক্ষেপ ছিল “মুজিব ভাই জানলেন না কে তার বন্ধু ছিল” (নিঃসঙ্গ সারথি দ্রষ্টব্য)। বিরোধী দল গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নেননি। মোশতাকের মন্ত্রীসভা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তার প্রিয় জনেরা আওয়ামী লীগেই ছিলেন। প্রয়োজনে এর বিভিন্ন ভুল ত্রুটি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, সমালোচনা করেছেন, কখনও বিএনপি জামাতের পক্ষে কাজ করেননি। পিতার ক্ষোভ আর বেদনার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পিতার “আদর্শকে” হত্যা করার পিতৃঘাতি সিদ্ধান্ত নেননি। একই কথা প্রযোজ্য জাতির আর তিন নেতার ক্ষেত্রেও। কর্নেল তাহেরের পরিবার, খালেদ মোশাররফ, জহির রায়হান শহীদুল্লাহ কায়সার ও তাঁদের মত মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো অযুত লক্ষ পরিবারকে দেখুন। ‘৭১-‘৭৫ পর্যন্ত সময়কালের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ আছে তাদের। সেই প্রতিশোধ নিতে বিএনপি’র গলায় তারা কখনো মালা পরাননি। মনে রাখবেন, সুসময়ে আদর্শের পরীক্ষা দেওয়া সহজ, দুঃসময়ে একে ধরে রাখাই সবচেয়ে কঠিন। জাতির সৌভাগ্য সেই পরীক্ষা তারা পাশ করেছেন শত ভাগ সাফল্যের সাথে। একে আওয়ামী লীগের প্রতি অন্ধ আনুগত্য বলেনা। বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা। এরা বিএনপিকে সমর্থন করেননি কারণ মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা আওয়ামী লীগের একার নয়। সেই মালিকানা সমুন্নত রাখার দায় আপনার আমার সকলের। মনে রাখবেন এই ইতিহাসটি বাঁচিয়ে রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন কিছু মানুষ। নব্বই এর দশকে ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুসহ চার নেতার হত্যার বিচার শুরু, আজকের বিজয়ের মাসে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম – এ সবই তাদের অব্যাহত আন্দোলনের ফসল। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন সেই সব তরুণেরা যারা পথ সভা, সেমিনারে, বিভিন্ন ইন্টারনেট ফোরামে দিন রাত কাজ করেছেন ইতিহাসটুকু বাঁচিয়ে রাখতে, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। এরা এদের আগের প্রজন্মের ব্যক্তিগত হতাশা, ক্ষোভকে পুঁজি করে ইতিহাস বিরোধিতার পথে হাঁটেননি। খেলাফত মজলিসের সাথে আওয়ামী লীগ যখন চুক্তি করে ২০০৬ এ, তখন এরাই ছুটে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার কাছে। সেই সমষ্টিগত দাবীর প্রতি সম্মান জানাতে আওয়ামী লীগ বাধ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালে এই অংশটিই (সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ) কাজ করেছেন ১৪ দল আর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি। এসব বলার অর্থ এই নয় যে সকলে ১৪ দল বা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবেন। না হলে একজন মানুষ যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন তিনি তবে কি করবেন? প্রতিবাদে সরব হবেন, এই চেতনার পরিপন্থী নয়, এমন কোন সৎ প্রার্থী খুঁজে নেবেন, নিদেন পক্ষে কাউকে ভোট দেয়ার মত না পেলে শেষ প্রতিবাদ হিসেবে ভোট দেবেন না। কিন্তু বিএনপিকে “হ্যা” ভোট কেন দেবেন? মনে রাখবেন, ইতিহাস ক্ষমাহীন। সে মীর জাফর এর ব্যক্তিগত ক্ষোভ বেদনার খোঁজ রাখেনা। যে জার্মান জাতির ক্ষোভ বেদনাকে পুঁজি করে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন, ইতিহাস সেই ক্ষোভ বেদনার খবর জানতে চায় না। তাই মানবতাবিরোধী এই শক্তিটিকে ক্ষমতায় আনার লজ্জা জার্মান জাতিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে অর্ধ শত বছর ধরে।
কয়েক মাস আগে আমার মত আরও অনেকেই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে টিভি পর্দায় দেখেছিলেন জামাতিদের হাতে বৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহাম্মদ আলী আমান এর নিগৃহিত হওয়া (এখানে দেখুন)। এই বৃদ্ধ মানুষটি যখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে জাতির সামনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, তখন আপনার বর্ণিত এই ৩২% (২০০১ এর ৪১%) কি ভাবছিলেন মনে মনে? খুব বিস্মিত হয়েছিলেন কি? জানতে ইচ্ছে করে এদের কাউকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সামনে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলে তারা কি বলতেন? বলতেন কি এই মুক্তিযোদ্ধার পিঠে আজ যারা লাথি মারে সেই অপশক্তিকে শক্তি জোগাতে, পুষ্টি জোগাতে বাধ্য হয়েছেন তারা কারণ তিন দশকেরও আগে বঙ্গবন্ধুর সরকার কিছু ভুল করেছিল বলে? সেদিন আমি নিশ্চিত যে আমার মত এমন অনেক নারী আছেন যারা এইটুকু ভেবে খানিকটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন যে বাংলার বিশাল শব্দ ভান্ডারে একটি শব্দের কোন যথার্থ স্ত্রীবাচক প্রতিশব্দ নেই, শব্দটি হল “কাপুরুষ”।
‘৯৬ এ জামাতের সাথে আওয়ামী লীগের একত্রিত আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। যত দূর মনে পড়ে গণতন্ত্রের (সুষ্ঠ নির্বাচন) জন্য তারা এক দাবী নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। বিএনপির মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করে জামাতের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করে নয়। সেই আন্দোলনে কেবল আওয়ামী লীগ আর জামাতই ছিলনা, দেশের বেশীর ভাগ প্রগতিশীল শক্তি এবং সুশীল সমাজও সাথে ছিল; আবার কেউ কেউ সাথে না থাকলেও পাশাপাশি সমান্তরালে একই ইস্যু নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। এই একত্রিত আন্দোলনে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, জামাত হয়েছিল তার চেয়েও বেশী। একত্রিত এ আন্দোলনকে প্রশ্ন করলে ‘৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের common platform কেও প্রশ্ন করতে হয়, যেখানে বিএনপি আওমায়ী লীগ ও বাম দলগুলোর সাথে একই ইস্যুতে জামাতও আন্দোলন করেছিল। তার পরেও ‘৯৬ এর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি কিনা? না করি না। কিন্তু প্রশ্ন থাকে – আমাদের এই “অসমর্থন” থেকে বিএনপিকে “সমর্থনের” কোন যৌক্তিক ভিত্তি তৈরী হয় কি? মনে হয় না।
আপনি বলেছেন তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব বাছাই করলে জামাতের যদি ভোটের সমীকরণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আওয়ামী লীগের হয় কেন! উত্তরটি রয়েছে আপনার চোখের সামনেই। জামাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়না কারণ, তাদের সমর্থকেরা নির্দিষ্ট একটি আদর্শ বা অনাদর্শে বিশ্বাসী, যেটির উৎপত্তি আক্ষরিক অর্থেই “আকাশ” (আরশ) থেকে। কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভ বেদনা থেকেই তারা তাদের আদর্শ বিচ্যুত সচরাচর হন না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় “তথাকথিত” বিশ্বাসীদের কেউ কেউ হন। আর তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের নমুনা যদি হয় ডজন খানেক যুদ্ধাপরাধী, গণ হত্যাকারী ধর্ষককে দলের নেতৃত্বে বসানো (দলের মধ্যে অন্তত হাজার খানেক অপেক্ষাকৃত কম ক্লেদাক্ত অতীতসম্পন্ন নব্য এবং বাচ্চা রাজাকার থাকা সত্ত্বেও), তবে সেই জাতীয় “তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বাছাই” প্রক্রিয়াটিতে আপনার মত অভিভূত হতে পারছি না বলে দুঃখিত।
লিখেছেন:
যে বিষয়টি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত প্রতিটি মানুষ সোচ্চার ছিলেন গত কয়েক মাস, অধীর অপেক্ষায় ছিলেন বিষয়টি আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অন্তর্ভূক্ত হয় কিনা তা জানতে, ইশতেহার ঘোষণার সাথে সাথে বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলের প্রতিটি মানুষ যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, দেশের অন্তত তিনটি টিভি চ্যানেল সংবাদমাধ্যম সকাল সন্ধ্যা এই নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করলো – তখন তা কিভাবে আপনার প্রথম দৃষ্টিতে “চোখেই পড়লো না”, তা নিয়ে খানিকটা ধন্দে পড়লাম। মনে হল বিষয়টি চোখে পড়ুক সেটি যেন আপনি তেমনভাবে চাননি, বা চোখে পড়ার পর খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছেন এমন মনে হল না। কি জানি হয়তো আওয়ামী আমলের দুঃশাসনের তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত থেকে থাকবেন, তাই হয়তো তেমন মনযোগ দেয়া হয়ে ওঠেনি প্রথমটায়। লিখেছেন, কেন মাত্র ৭টি শব্দে এই ঘোষণা দেওয়া হল। এবার সত্যিই একটু ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো, “যুক্তিবাদী” মানুষের যুক্তির মান দেখে। স্কুল জীবনে এক ইসলামিয়াত শিক্ষক ছিলেন যিনি বিঘত মেপে নম্বর দিতেন, এ যে দেখি সেই একই যুক্তি! ইশতেহার কি মহাকাব্য লেখবার জায়গা? নাকি অভিসন্দর্ভ? কোন্ প্রক্রিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে সেটি কি ইশতেহারে পই পই করে বর্ণনা করতে হবে? দেশের ও বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যে না পৌঁছেই? ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনার লেখার এ অংশটি আমাকে মনে করিয়ে দিল বাংলা প্রবাদের সেই ঈর্ষাকাতর মানুষটির কথা, পড়শীর সন্তানের পাশের সংবাদে যিনি “নাখোশ হয়ে” বলেছিলেন – ‘পাশ দিলে কি হবে, চাকরী তো পাবেনা’। আর চাকরী পাওয়ার সংবাদ শুনে আরো নাখোশ হয়ে বলেছিলেন – ‘চাকরী তো পেয়েছে, দেখেন বেতন পায় কিনা’! যত দূর জানি, শেখ হাসিনা তার নির্বাচন পরবর্তী প্রথম প্রেস কনফারেন্সে যুদ্ধাপরাধের অঙ্গীকারটি পূনর্ব্যক্ত করেছেন, ইতোমধ্যে জাতিসংঘের এক প্রতিনিধির কাছে সহযোগিতাও চেয়েছেন। তবে আমি মনে করি এই কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের নয়। কৃতিত্ব সেই মানুষদের যারা এই প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করেছেন এবং দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত যারা বাড়ি ফিরে যাবেন বলে মনে হয় না। তারা যদি যানও, তাদের জায়গা নেবে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম। এই প্রজন্ম ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে, তাদের আগের প্রজন্মের ব্যক্তিগত হতাশা ক্ষোভকে শক্তিতে পরিণত করেছে। এই প্রজন্ম প্রশ্ন করে নেতৃত্বকে, নিজেকে, এবং সর্বোপরি তার আগের প্রজন্মকেও যাদের নিরবতায়, বিস্মরণে এবং দিকভ্রষ্ট সমর্থনে আজ বাংলাদেশের এই পরিণতি।
জানতে চেয়েছেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আজম জে চৌধুরীর মামলাটির বিষয়ে আমি কি ভাবি? যেখানে তিনি দাবী করেছিলেন তিন কোটি টাকা তিনি নাকি স্যুটকেসে (!) ভরে শেখ হাসিনাকে দিয়েছিলেন। তিন কোটি টাকা কিভাবে একটি স্যুটকেসে আঁটানো যেতে পারে, সে বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ওজন করে অংক করে দেখিয়েছেন কেন এটি অসম্ভাব্য। যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবং প্রক্রিয়ায় মামলাটি হয়েছে, সেটি তো আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। জনাব আজম পরবর্তীতে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক একাধিক প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন বলে জানি, যার একটি তো খোদ সামরিক আমলেই মিলিটারির খড়গ মাথায় নিয়ে। একজন প্রধানমন্ত্রী, যিনি কিনা মুখ ফুটে না বললেও কয়েক শো কোটি টাকা মানুষ বাড়ী এসে দিয়ে যায় (উদাহরণ: যুবরাজ এক এবং দুই), সেখানে কেন তিনি মুখ ফুটে তিন কোটি টাকা দাবী করবেন, এমনকি তা না দিলে ‘ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব’ বলে হুমকি দেবেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে, এর পরও যুক্তিসংগত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাতে পারলে নিশ্চয়ই তা মেনে নেব। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক এই সামরিক সরকার কম চেষ্টা তো করেননি সে সব খুঁড়ে বের করতে (দূর্নীতি মামলাগুলোতে খুব কাছে থেকে কাজ করেছেন এমন দু’একজনের কাছ থেকে তাই জেনেছি)। সজীব ওয়াজেদ জয়ের “বিপুল” অর্থ বৈভবের কথা বলেছেন। যত দূর মনে পড়ে সামরিক সরকারের মদদপুষ্ট ‘প্রোব’ এই বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরী করে। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতি-রিপোর্ট তৈরী হয়েছিল, তার একটি পড়ে দেখতে পারেন এই লিন্কে। প্রশ্ন করেছেন, আমি এসব অভিযোগ বিশ্বাস করেছি কিনা। না, করিনি। অন্তত, যেভাবে সেগুলো আমাদের সামনে এসেছে তার উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করার কোন কারণ দেখিনি। আসলে ‘৭৫ এর পর থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারটি সম্পর্কে এত সব কাল্পনিক অভিযোগ শুনেছি যে আজকাল নতুন কোন অভিযোগ আসলে তা এক চিমটি লবন সহকারে গ্রহণ করার চেষ্টা করি। তবে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আপনার এই vigilance প্রশংসনীয়। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য আপনার হাতে থাকলে তা জানাতে পারেন এবং তার একটি কপি দূর্নীতি দমন কমিশনে পাঠাতে ভুলবেন না যেন।
আপনি বলেছেন: “আওয়ামী লীগ সকলের কাছে সেই হারানো শ্রদ্ধা ফিরে পাবে যদি এবার তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে আর বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করতে পারে।” মাত্র ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে “যুদ্ধ বাধাবার”, “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করার” ম্যানডেট দিয়ে দিলেন বাকী ৩২% এর সক্রিয় আপত্তি থাকবে জেনেও? বলেন কি? আপনার সেই ৩২% এর রাজনৈতিক অধিকারের তাহলে কি হবে? তখন আবার “ঐ দেখ ঐ আসে বাকশাল” বলে আওয়াজ তুলবেন না তো? যুক্তিবাদী মনের যেই বাস্তবতা সদা ছুঁয়ে থাকে আপনাকে, তা এখনো সাথেই আছে তো?
আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে জন মানুষের বিজয় দেখার পাশাপাশি কিছু আশংকার কথা অনেকেই এখানে উল্লেখ করেছেন। আমার সব চাইতে বড় শংকাটি হল এই সরকার কোন ভুল করলে সেই ভুলত্রুটিকে উপজীব্য করে কিছু মানুষ আবারো ভোট দেবে সেই বিএনপি জামাত জোটকেই; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কোন বিকল্প শক্তিকে তারা খুঁজে নেবেন না। নিজেদের বিকলাঙ্গ শরীরে লুপ্তপ্রায় মেরুদন্ডটিতে ভর করে হামাগুঁড়ি দিয়ে ফিরে যাবেন ইতিহাস বিরোধীদের “নিরাপদ” আশ্রয়ে; গাইবেন অন্ধকারের গান। সেই দিনে আমি এও নিশ্চিত যে অল্প কিছু মানুষ তখনো চেষ্টা করে যাবেন নিভে যাওয়া দীপটিকে আবারো জ্বালিয়ে সেই গভীর অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিতে। সেদিন তাদের সেই সংগ্রামে কারা সামিল হবেন, আমাদের আত্মদর্শনের আয়না আমাদের সেই সত্য বলে দিক।
এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করা সকল মন্তব্যকারীকে (সৈকত, আরমান রশিদ, রেজাউল করিম সুমন, সৈকত আচার্য, মাসুদ করিম, শামীম ইফতেখার, নীড় সন্ধানী) আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার পক্ষ থেকে এই আলোচনার এখানেই ইতি। ভাল থাকবেন সবাই।
আরমান রশিদ - ১০ জানুয়ারি ২০০৯ (৫:৫৬ অপরাহ্ণ)
এবারকার মন্তব্যটি ছোট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। নতুন কোন বিষয় উত্থাপন না করে স্ববিরোধীতা সহ আরো যে সব অভিযোগ আপনি তুলেছেন তা খন্ডনের চেষ্টা করবো।
আমার দৃষ্টিতে মোটেই না। আমি এখনো মনে করি এই ৩২% কে বাদ দিয়ে দেশে একটি দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই তাদের কাছে কোন বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ তা নির্ণয় একান্ত জরুরি বলে মনে করি। আপনি বার বারই সেই শিক্ষিত, স্বচ্ছল, সুবিধাবাদী শ্রেনীর সাথে এই ৩২% কে গুলিয়ে ফেলছেন। আর তা যদি না করেন তবে তো তা বাংলাদেশের অন্তত ৩২% লোককেই শিক্ষিত ও স্বচ্ছল বলে দাবী করার সামিল যা কিনা আরো হাস্যকর। তবে আপনার সব গালাগাল যদি এই ৩২% এর মূল অংশটাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সুবিধাবাদী আর গোড়া মোলবাদীদের উদ্দেশ্য করে হয় তবে এই প্রসঙ্গে আপনার সাথে আমার কোন বিরোধ নেই।
আপনি অভিযোগ করেছেন জামাতের আভ্যন্তরীণ গণতত্রের চর্চায় নিকৃষ্টতম রাজাকারদের নেতৃত্বে উঠে আসায় আমি অভিভূত। চোরের দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সবচাইতে বড় চোরটাই নেতা নির্বাচিত হবে এতে অভিভূত হবার কি আছে? আশা করি আপনি ঠিক একই কারণে আওয়ামী লীগে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা দেখতে এতটা অনিচ্ছুক নন। ছোট বেলায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি জামাতের শিশু সংগঠন ফুলকূড়ির সাথে জড়িয়ে পড়ি। তাই তাদের সাংগঠনিক কৌশল আর মগজ ধোলাই এর অনেক পদ্ধতি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাই বলবো শত্রুর কৌশল থেকে শিক্ষা না নিয়ে আমরা যদি শুরুতেই তাদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করি তবে তা শত্রুরই পক্ষে কাজ করবে। আমাদেরই তাচ্ছিল্যের সুযোগে এতদিন সংগঠিত হয়ে জামাত আজ এত শক্তিশালী এবং দিন দিন আরো শক্তিশালী হচ্ছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরেও, সংবিধানের দিক নির্দেশনা সত্বেও আমরা মাদ্রাসা শিক্ষাকে (অবহেলা/তাচ্ছিল্যে?) সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে এক করতে পারিনি। এর জন্য কোন জোর দাবী বা আন্দোলনও আমরা করিনি। ফলশ্রুতিতে মাদ্রাসাগুলি ধীরে ধীরে জামাত সহ অন্যান্য মৌলবাদের ঘাটিতে পরিণত হয়েছে। তাই যখন শুনি কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দারিদ্রের কারণে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পরবর্তীতে শিবিরের কর্মী হিসেবে বেড়ে উঠছে তখন তাকে আপনার মত ঘৃণা করতে পারি না বরং ক্ষোভ হয় দেশের শিক্ষানীতির এই চরম অব্যবস্থার উপর।
ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের বিষয়গুলি কতটুকু প্রাধান্য পেয়েছে সেই বিচার আমি পাঠকদের উপরই ছেড়ে দেব। নির্বাচন পূর্ববর্তী যে সব টক শোতে আওয়ামী লীগের নেতাদের আনা হয়েছিল তাদের আমি (হয়তো সংগত কারণেই) ধর্মীয় বিষয়গুলি (এমনকি উত্তরাধীকারের ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের প্রসঙ্গ) সুকৌশলে এড়িয়ে যেতে দেখেছি। তবে হ্যাঁ, নির্বাচনের এই বিপুল জয়লাভের পর বিষয়গুলি নিয়ে তারা এখন খোলাখুলিই আলাপ করছেন। আশা করবো এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম হবে না। আরো আশা করবো শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলি আদালতের মুখ দেখবে আর আইনী প্রক্রিয়ায় নিস্পত্তি হবে এবং সম্প্রতি একজন নবনির্বাচিত মন্ত্রী সরকারি আইনজীবিদের অদক্ষতার যে চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন সেই সব অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে কোন দোষী ব্যক্তি তাদের চৌকশ আইনজীবিদের সহায়তায় আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবেন না।
আগামীকাল বাড়ী যাচ্ছি নির্বাচনে অংশ নিতে। আরো ইচ্ছে আছে, বিএনপি-জামাতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত, আমার এলাকার সাধারণ মানুষের ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণগুলি চিহ্নিত করা। কি জানলাম তা ফিরে এসে জানাব এখন পর্যন্ত যারা সাথে আছেন সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আপাতত বিদায় নিচ্ছি।
ভাল থাকুন।