মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: এতগুলো শিশুর মৃত্যুর দায় কী শুধুই যান্ত্রিক ত্রুটির?

যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে সেটি 'পড়ে' না—নেমে আসে। সেই নামার পথ ও পদ্ধতিতেই লুকিয়ে থাকে পাইলটের দক্ষতা ও প্রস্তুতির সত্যিকারের পরীক্ষা। অনেক প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সামলাতে না পারার দায় শুধুই কি এক নবীন পাইলটের অনভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাবের ওপর দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে? 

Air Force Jet Crashes in a Bangladesh School, Credit: The Hindu

গত দু’দিন ধরে মাইলস্টোন স্কুলের ট্র্যাজেডি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অনেক বিশ্লেষণ ঘুরছে, যার অধিকাংশই জল্পনা-কল্পনা ও প্রযুক্তিগত অজ্ঞতার ফসল। সেই কারণেই এই লেখা—একটি তথ্যভিত্তিক ও পেশাগত বিশ্লেষণ।

শুরুতেই আসুন এ সংক্রান্ত প্রচারিত মিথগুলো ভাঙা যাক।

মিথ ১. পাইলট মাইলস্টোনের মাঠে অবতরণ করতে চেয়েছিলেন।
এটি একেবারেই ভুল ও হাস্যকর ধারণা। যুদ্ধবিমান অবতরণের জন্য ১ কিমি লম্বা মাঠও যথেষ্ট নয়। তদুপরি, মাইলস্টোনের মাত্র ১ কিমি পশ্চিমে তুরাগ নদীর ওপারে অনেক খোলা জায়গা ছিল।

মিথ ২. ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ট্রেনিং কেন?
যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ সাধারণত শহরের বাইরে হয়। কিন্তু উড্ডয়ন ও অবতরণ তো রানওয়ে থেকেই করতে হয়, যা প্রায়শঃই শহরের কাছেই থাকে।

মিথ ৩. বিমানটি ছিল খুব পুরোনো ও ‘জংধরা’।
এটিও বিভ্রান্তিকর। ঘাতক F-7 BGI হলো F-7 সিরিজের একটি কাস্টম ভেরিয়েন্ট যুদ্ধবিমান যা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য  প্রস্তুত করা হয় । এটি সম্পূর্ণ ট্রেনিং ক্ষমতায়নের ও তারপর কম্ব্যাট মিশনের জন্য যথার্থ। ২০০৬-২০০৮ এ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এটি ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে।  F-7 B।I এর বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটি পূর্ণ একক আসনের যুদ্ধবিমান। শুধুমাত্র  পাইলটদের লাস্ট ফেজ ট্রেনিং এর চূড়ান্ত কালে এটি ব্যবহার করা যায়। 

নিয়ম অনুযায়ী যেকোন বিমানের প্রতিটি যন্ত্রাংশ নির্ধারিত সময়/ঘণ্টা শেষে বদলানো হয়। না বদলালে বিমান ‘এয়ারওয়ার্দি’ থাকে না। তাই ফিটনেস পাস থাকলে  বিমানের বয়স কতো হলো তা গুরুত্বহীন। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান এয়ারফোর্স এখনো ১৯৬০-এর দশকে নির্মিত T-35 Talon প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করে। তা এখনও ওড়ার উপযোগী।

মিথ ৪. রানওয়ের পাশে উঁচু বিল্ডিং কেন?
নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা এ প্রশ্নের জন্ম দেয় বটে, তবে স্মরণ রাখা জরুরি যে বিমানটি একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। উঁচু ভবন এ ঘটনায় সরাসরি দায়ী নয়।

এবার প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা যাক।  

ISPR জানায়, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির দুপুর ১:০৬-এ তেজগাঁও বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেন। এটি ছিল তাঁর প্রথম সলো ফ্লাইট—অর্থাৎ প্রশিক্ষক ছাড়া এককভাবে বিমান চালানো। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই তিনি যান্ত্রিক ত্রুটির কথা জানান এবং ঘাঁটিতে ফিরতে গিয়ে বিমানটি ভূপাতিত হয়।

একজন নতুন পাইলটকে সলো ফ্লাইট বা একা বিমান চালনার অনুমতি দেয়া হয় তখনই যখন তিনি মোটামুটিভাবে একটা বিমান উড্ডয়ন করতে পারেন‚ পথ খুঁজে নেয়া বা নেভিগেশনের ন্যূনতম  পারদর্শীতা দেখাতে পারেন এবং বিমানটি নিরাপদে অবতরণ করাতে পারেন। 

ধরে নেয়া যায় প্রশিক্ষকের সাথে এর আগেও বহুবার এই তিনটি যোগ্যতা প্রমাণের পরেই পাইলট তার সলো ফ্লাইটের অনুমতি পেয়েছেন। বাস্তবে শিক্ষার এই স্তরে থাকা কোন পাইলটের কিন্তু এমনিতেই ইমারজেন্সি বা কোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযোগী পারদর্শিতা থাকে না। সে অনুশীলনগুলি শেখানো হয় আরো পরের ধাপে। তথাপি সবার বোঝার সুবিধার্থে কিছু বিষয় জানিয়ে রাখা যাক।

পাইলটদের একেবারেই শুরু থেকেই উড্ডয়নের তিনটি মূলনীতি শেখানো হয়। প্রাধান্যের ক্রমানুসারে সেগুলি নিম্নরূপ:

১. Aviate—প্রথমেই মনোযোগ দাও উড্ডয়নে ও বিমান নিয়ন্ত্রণে।
২. Navigate—এরপর ঠিক করো কোন দিকে যাবে ও কোথায় গ্লাইড করে নামা সম্ভব।                    ৩) Communicate—কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে বা ইমার্জেন্সি ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করে নিজের পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা জানাও। 

ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও বিমান হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে না। এমনকি ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলেও না। তা গ্লাইড করে নামতে পারে যদি পাইলটের প্রশিক্ষণ থাকে এবং যথেষ্ট উচ্চতা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের একটা অত্যাবশ্যকীয় অংশ হলো ইঞ্জিন অকেজো হয়ে গেলে বা ইঞ্জিনে আগুন লাগলে কি করতে হবে সে দক্ষতার প্রশিক্ষণ। এজাতীয় দক্ষতাগুলো অর্জিত হয় সলো ফ্লাইটের আরো পরের ধাপে। বিমান যদি কোন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অথবা প্রচন্ড ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে টুকরো টুকরো হয়ে না যায়, তাহলে ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলেও সেটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং গ্লাইডিং দুরত্বের মধ্যে কোন রানওয়ে থাকলে সম্পূর্ণ নিরাপদে অবতরণ করাও সম্ভব। 

ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে পাইলটকে মূলত তিনটি কাজ করতে হয়: 

১) Aviate: বিমানের বেগ পরিবর্তন করে এমন একটি গতিতে আনতে হয় যে গতিতে প্লেনটি সবচেয়ে দীর্ঘক্ষণ গ্লাইড করে আকাশে ভাসবে। প্রতিটি বিমানের ক্ষেত্রে এই বেগ ভিন্ন। এটিকে বিমানটির Best glide speed বলে। 

২) Navigate: এর পরই বিমানের বর্তমান উচ্চতা মাথায় রেখে পাইলটকে হিসেব করতে হয় এই গতিতে সে সর্বোচ্চ কতদূর গ্লাইড করে ভাসতে পারবে। সেই সীমার মধ্যে যদি কোন বিমানবন্দর থাকে তাহলে তো খুবই ভাল কথা আর তা না থাকলে তাকে খোলামেলা কোন মাঠের সন্ধান করতে হয় বা এমন কোন জায়গা যেখানে মানুষ হতাহতের সম্ভাবনা থাকবে সর্বনিম্ন। 

৩) Communicate: সবশেষে পাইলট যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন তিনি কি করতে চান, তখন নিজের সিদ্ধান্ত ও পরিস্থিতি তিনি জানাবেন কনট্রোল টাওয়ারকে, যেন তারা জরুরি ব্যবস্থা নিতে পারে বা সাহায্য পাঠাতে পারে। 

বিমান ভূপাতিত হওয়ার দূর্ঘটনাকে বৈমানিকরা সাধারণত দুটো ভাগে ফেলেন:

১. Controlled Flight Into Terrain (CFIT): পাইলট পুরো নিয়ন্ত্রণে রেখেও বিমানকে মাটি স্পর্শ করাতে সক্ষম হন।

বিমান ভূপাতিত হবার সময় পাইলটরা সব সময় চেষ্টা করেন যেন মাটি স্পর্শ করে বিমান সম্পূর্ণ স্থির হবার আগ পর্যন্ত বিমানের নিয়ন্ত্রণ পাইলটের হাতে থাকে। একে পাইলটরা বলেন ”Controlled flight into terrain” । সম্প্রতি আমরা ভারতে এয়ার ইন্ডিয়ার দূর্ঘটনায় এমনটি হতে দেখেছি। মাটিতে আঘাত পাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত বিমানটিকে কোন রকম ডিগবাজি খেতে দেখা যায়নি‚ নিয়ন্ত্রণ ছিল পাইলটদের হাতে যদিও ইঞ্জিন অকেজো থাকায় তাদের আর কিছুই করার ছিল না এবং বিমানটি গ্লাইড করে এসে ভূপাতিত হয়েছিল।


২. Stall-Spin Crash: ইঞ্জিন কাজ না করলেও অক্ষত আছে এমন বিমান যখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভূপাতিত হয় তখন পতনের সবচেয়ে বড় কারণ সাধারণতঃ Stall-Spin দূর্ঘটনা। যেখানে বিমানের গতি কমে গিয়ে ভারসাম্য হারায় ও পাইলট নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়।

এ দূর্ঘটনা মূলতঃ পাইলটের কয়েকটি ভুলের কারণে হতে পারে। হয়তো তিনি নূন্যতম গতিবেগ ধরে রাখতে অপারগ ছিলেন। খুব তীক্ষ্ণভাবে অথবা রাডারের সাথে সামঞ্জস্যহীনভাবে টার্ন নেয়াও Stall-Spin দূর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ। তবে এভাবে নিয়ন্ত্রণ হারালেও সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া সম্ভব যদি প্লেনের যথেষ্ট উচ্চতা থাকে অর্থাৎ হাতে যথেষ্ট সময় থাকে। বিমানটি যদি মাটির খুব কাছে থাকে তাহলে স্টল বা স্পিন থেকে আর রক্ষা নেই। 

রানওয়ে বরাবর একটা কাল্পনিক রেখা প্রসারিত করলে সেটিকে Extended Runway Centerline বলে আর অবতরণের আগে সেখানে পৌছে বিমানকে সর্বশেষ যে বাঁকটি নিয়ে রানওয়ের সাথে লাইনআপ করতে হয় সেটিকে Base to Final Turn বলে। এই বাঁক নেয়ার সময় বিমানের উচ্চতা থাকে খুবই কম এবং গতিবেগও থাকে ন্যূন্তম স্টল স্পিডের খুব কাছাকাছি। বিশ্বে এই Base to Final Turn নিতে গিয়ে Stall-Spin এর কারণে সর্বোচ্চ সংখ্যক দূর্ঘটনা ঘটেছে, সবই পাইলটের সামন্য অসতর্কতার কারণে ।

 

এবার আসুন মাইলস্টোন দূর্ঘটনার সম্ভাব্য কি কি কারণ থাকতে পারে তা বিবেচনা করা যাক। নিম্নোক্ত চারটি কারণে F-7 BGI- ফ্লাইটের উপরোক্ত দূর্ঘটনা ঘটা সম্ভব:

কারণ ১) পাইলট গ্লাইড রেঞ্জ ভুল হিসাব করেছিলেন।
যদি বিমান শাহজালাল এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছানোর উপযুক্ত উচ্চতায় না থাকে, তবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বিকল্প জায়গায় অবতরণের।

ISPR এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী পাইলট টের পেয়েছিলেন, বিমানটি ঠিক মতো কাজ করছে না এবং তিনি বেইজে ফিরতে চাইছিলেন। যদিও পরিস্থিতি দেখে ধারণা হয়, পাইলট তেজগাঁও বেইজে নয় বরং শাহ জালাল এয়ারপোর্টে অবতরণের চেষ্টা করছিলেন, কেননা  তার জন্য সেই রানওয়েই ছিল সব চাইতে কাছে। প্রশ্ন জাগে, যখন তিনি টের পেলেন যে তার বর্তমান উচ্চতা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গ্লাইড করে পৌছানো সম্ভব নয়, তার আগেই প্লেন ভূপাতিত হবে, তখন তিনি কি করলেন? পাইলট হিসেবে তখন তার কর্তব্য ছিল এয়ারপোর্টে পৌছানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে মাইলস্টোনের মাত্র এক কিলোমিটার পশ্চিমে তুরাগ নদীর ওপারে খোলা মাঠে অবতরণের চেষ্টা করা, অথবা সেদিকে বিমানটি ধাবিত করে ইজেক্ট করা। তা করলে এতোগুলি শিশুর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো। তিনি নিজেও প্যারাশুটের সহায়তায় বেঁচে যেতেন।  

কারণ ২) তুরাগ নদীর ওপারে খোলা মাঠ ছিল মাত্র ১ কিমি পশ্চিমে, পাইলট তা বেছে নেননি।
এ সিদ্ধান্তটি গোলমেলে ও অবিশ্বাস্য! তিনি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের ওপর প্লেন নামিয়ে থাকেন তবে তা আত্মঘাতী আচরণ,যে আচরণকে বলা হয় Aviation Suicidality ।

টুইন টাওয়ার হামলায় আমরা দেখেছি রাজনৈতিক বা আদর্শিক কারণে কিভাবে বিমানকে মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।  দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ হলো, ২০১৫ সালে জার্মানউইংস ফ্লাইট ৯৫২৫–এর পাইলট আন্দ্রেয়াস লুবিটজের বিমানের ভূপাতিত হওয়ার ঘটনাটি। আন্দ্রেয়াস লুবিটজ মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ১৫০ জন যাত্রীসহ বিমানটি পাহাড়ে আছড়ে ফেলেন। তদন্তে দেখা যায়, তার মানসিক অবস্থা লুকানো হয়েছিল। বাংলাদেশের সামরিক বা বেসামরিক শিক্ষার্থী পাইলট ও পুরোদস্তুর পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কী প্রটোকল আছে, তা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। F-7 BGI- এর উপরিউক্ত ফ্লাইট পাইলটের ইনস্ট্রাকটরের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা অত্যাবশ্যক। 

দূর্ঘটনা নিয়ে এত কথা ছড়ানো চলছে কিন্তু সে সবের আড়ালে যে ব্যক্তি পাইলটকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তার বিষয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলছে না। আই এস পি আরও এ প্রসঙ্গে টুঁ শব্দ উচ্চারণ করছে না। পাইলট যদি অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে নেমে আসতেন তখন নিশ্চয়ই এ পরিস্থিতি হতো সম্পূর্ণ অন্যরকম।

প্রশিক্ষকের অনুপস্থিতি কি দায় এড়াতে সাহায্য করছে? এই দূর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের প্রশিক্ষক বা ইন্সট্রাকটরের কোনো বক্তব্য বা উপস্থিতি গণমাধ্যমে আসেনি। এমনকি তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিবৃতিতেও তাঁর ভূমিকা বা পর্যবেক্ষণ উল্লেখ নেই। একজন নবীন পাইলটের সলো ফ্লাইট অনুমোদনের সিদ্ধান্ত, ফ্লাইট পরিকল্পনা এবং তাঁর দক্ষতা যাচাইয়ের পুরো দায়িত্ব প্রশিক্ষকের ওপরই পড়ে। তাঁর অনুপস্থিতি তাই তদন্তের এক জটিল দিককে সামনে আনছে—তিনি কোথায়, এবং তাঁর পর্যবেক্ষণ যথাযথ ছিল কি না, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবের মধ্যে প্রশিক্ষকের নিরবতাও একটি “অপ্রকাশিত তথ্য” হিসেবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

কারণ ৩) Base to Final Turn-এর সময় বিমান Stall Spin এর কবলে পড়ে।
ধরে নেয়া যাক, পাইলট যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গ্লাইড করে পৌছানো সম্ভব। তাহলে প্রশ্ন জাগে রানওয়ে থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে কেন বিমানটি ভূপাতিত হলো? এর একটাই সম্ভাবনা থাকতে পারে: স্টল-স্পিন দূর্ঘটনা। 

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় মাইলস্টোন ক্যাম্পাসটি শাহজালাল বিমানবন্দরের ৩ কিলোমিটার উত্তরে একেবারে Extended Runway Centerline এর উপর অবস্থিত।  যেহেতু এটি ছিল একটা ট্রেনিং ফ্লাইট, তাই ধরে নেয়া যায় পাইলটের ম্যানুভার করার কথা ছিল দীয়াবাড়ির পশ্চিমের খোলা যায়গায়। সেখান থেকে শাহ জালাল বিমানবন্দরে আসতে হলে প্রথমে তাকে যেতে হবে পূব দিকে এবং রানওয়ে থেকে ৩-৪ কিমি উত্তরে (ঠিক যেখানে মাইলস্টোন স্কুলটি অবস্থিত)। সেখনে পৌঁছে তাকে ৯০ ডিগ্রি Base to Final Turn টার্ণ নিয়ে রানওয়ের সাথে লাইনআপ করতে হবে। হতে পারে এই টার্নটি নেয়ার সময় পাইলটের অসতর্কতায় বিমানটি Stall Spin দূর্ঘটনার শিকার হয়ে ক্রাশ করে। 

বিমানটি ঠিক কোন দিক থেকে উড়ে এসে ঠিক কোন বিল্ডিংএ আঘাত করেছে ‚ আঘাতের সময় বিমানটি কি সোজা ছিল নাকি কাত বা উল্টে ছিল সেসব নিরীক্ষা করলে সহজেই Stall Spin হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করা সম্ভব। হতে পারে পাইলট টার্ন নেয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারাতেই ইজেক্ট করেন। কিন্তু ইজেক্ট করতে বেশি দেরী করে ফেলায় অথবা ইজেকশনের সময় প্লেন কাত বা উল্টো হয়ে থাকার কারণে ইজেকশন সীট তাকে উপরের দিকে ছুড়ে মারার বদলে এক পাশে বা নিচের দিকে ছুঁড়ে মারে যার দরুন তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। যদিও তার পা ভাঙ্গা ব্যতিত আর কোনও আঘাতের কথা জানা যায় না।  সিসিটিভি ফুটেজ থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে বিমানটিকে গোত্তা খেয়ে নিচে পড়তে এবং কাত হয়ে বিল্ডিংএ আঘাত করতে দেখা যায় যা Stall Spin দূর্ঘটনারই ইঙ্গিত বহন করে।

তাহলে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে উপরোল্লিখিত কারণগুলির একটি বা একাধিক সত্য হবার কারণে উক্ত দূর্ঘটনা ঘটেছে।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে এই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কার দায় কতটুকু? 

সরকারিভাবে এ ঘটনার তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনো স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি, তদন্ত কমিটি কী রকম স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করবে। অতীতেও আমরা দেখেছি, সামরিক দুর্ঘটনার রিপোর্টগুলো জনসমক্ষে আনা হয় না। 

এবার কি ব্যতিক্রম হবে? 

বিমানটির ট্রান্সপন্ডার থেকে প্রাপ্ত জিপিএস রাডার ডাটা ‚ কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে কথোপকথন‚ তার মিশন প্ল্যান ‚ ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডারে (যদি থেকে থাকে) প্রাপ্ত তথ্য‚ এবং ধ্বংসাবশেষের সুষ্ঠ নিরীক্ষা করলে সহজেই এই তদন্ত শেষ করা সম্ভব।

বেসামরিক এলাকার উপর দিয়ে নিয়মিত ট্রেনিং ফ্লাইট চালানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা কি জরুরি নয়? যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের রুট যদি এমন এলাকায় হয় যেখানে স্কুল, হাসপাতাল বা ঘনবসতি রয়েছে, তাহলে প্রতিটি ফ্লাইটই সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করে। 

বিমানটিতে যদি যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে থাকেই, তাহলে রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না।

 বিমানবন্দরের পাশে উঁচু ভবনের অনুমোদনও একধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। বিশেষ করে যারা Extended Runway Centerline এর উপর এতোবড় একটা ক্যাম্পাস নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে তারা কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না। এতগুলো প্রাণহানি—বিশেষ করে শিশুমৃত্যু—তা যান্ত্রিক ত্রুটির বাইরেও কাঠামোগত নানা বিচ্যুতির ইঙ্গিত বহন করে। 

যান্ত্রিক ত্রুটি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, পাইলটের দক্ষতার কমতি এবং  প্রশিক্ষকের দায় বিবেচনা করলে  একটি সামগ্রিক দায়চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে যার ফলাফল হতে পারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দীর্ঘকালীন নানা সমস্যার উদ্ভব।

মর্মান্তিক এই ঘটনায় যে শিশুরা প্রাণ হারিয়েছে, তারা ছিল দেশের ভবিষ্যৎ। ট্র্যাজেডির পর মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকগণ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। শিশুদের সহপাঠীরা ট্রমার মধ্যে রয়েছে। গত এক বছরে প্রথমে পুলিশ,তারপর বিজিবি, এরপর সেনাবাহিনী  ও শেষে বিমান বাহিনী একের পর এক জরুরী বাহিনীগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। যে বাহিনীগুলো জনগণের আস্থার স্থান ছিল তাদের সে অবস্থান হারাবার মতো পরিস্থিতি যেন তৈরী হয় – এমন নানান ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঘটনা ও দূর্ঘটনা ঘটে চলেছে।

সুতরাং অনেক প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে যন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সামলাতে না পারার দায় শুধুই কি এক নবীন পাইলটের অনভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাবের ওপর দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা যাবে? 

 

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

1 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
1
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.