জার্মান লেখক বার্নার্ড শ্লিংকের উপন্যাস 'দ্য রিডার' নিয়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া। [...]

বার্নার্ড শ্লিংকের উপন্যাস দ্য রিডার  প্রথমবার বেশ তাড়াহুড়ো করে পড়েছিলাম। সিনেমাটা দেখার আগেই শেষ করে ফেলা চাই। তাই কোনো কিছু খেয়াল না করে একটানে পড়ে গিয়েছিলাম। কিছুদিন আগে আবার পড়লাম, পড়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। উপন্যাসে চরিত্র তিনটি — হানা শ্মিৎজ, মাইকেল বার্গ এবং ঘটনাপ্রবাহ।

তিন পর্বের দ্য রিডার-এর গল্পের প্রথম পর্ব শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার বছর পনেরো পর পশ্চিম জার্মানিতে। পনেরো বছরের মাইকেল বার্গ স্কুল থেকে ফিরবার পথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ট্রাম কন্ডাক্টর জনৈকা মহিলার সাহায্যে সে বাড়ি ফেরে। এর পরের অনেকগুলো দিন তাকে বিছানায় কাটাতে হয় হেপাটাইটিস রোগে। মা’কে মাইকেল বলেছিল একজন ভদ্রমহিলার সাহায্যের কথা। সুস্থ হয়ে মহিলাকে ফুল দিয়ে ধন্যবাদ জানানোতেই শেষ হয় না, বরং একটি অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে দু’জনের মধ্যে। স্কুল থেকে মাইকেল ক্লাস কেটে হানার ফ্ল্যাটে আসত, হানাকে বই পড়ে শোনাত, হানা তাকে স্নান করিয়ে দিত, এরপর দু’জনে মিলিত হত। এ সম্পর্কের কোনো লক্ষ্য নেই, নেই কোনো ‘হোয়াট নেক্সট’। যদিও মাইকেল কয়েকবার চিন্তা করে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নতুন ক্লাসে উঠবার পর মাইকেলের হানার সাথে যোগাযোগ কমে আসে। একদিন হানাকে সে দেখতে পায় স্যুইমিং পুলের কাছে, যেখানে মাইকেল বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে। পরদিন থেকে হানা যেন মিলিয়ে যায়।

দ্বিতীয় পর্বে বছর সাতেক পর মাইকেল আইনের ছাত্র, একটি মামলা দেখবার সূত্রে হানার সঙ্গে তার দেখা হয়। বলা ভালো হানাকে সে দেখে। যুদ্ধাপরাধে হানা এবং আরও কয়েকজন অভিযুক্ত। মামলা চলাকালে মাইকেল আবিষ্কার করে হানার জীবনের সবচাইতে গোপনীয় তথ্য — হানা লেখাপড়া জানে না! কথাটি গোপন করতে হানা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত মেনে নেয়।

তৃতীয় পর্বে মাইকেল হানার জন্য জেলে বই পড়ে পাঠাতে থাকে টেপ করে। অন্যদিকে হানা পড়তে লিখতে শেখে। মাইকেলকে চিঠিও লেখে। যেহেতু হানার কেউ নেই, জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে জেলমুক্ত জীবনে মাইকেল যেন হানাকে সাহায্য করে। মাইকেল রাজি হয়, কিন্তু জেলমুক্তির আগের দিন আত্মহনন করে হানা তার আর মাইকেলের মাঝে চিরবিচ্ছেদ আনে।

গল্পের কোনো ডালপালা নেই, চরিত্রও অল্প কয়েকটি। গল্পের পুরোটাই মাইকেলের একক সংলাপের মতো। পড়তে পড়তে অনেকগুলো প্রশ্ন আপনা থেকেই মাথায় আসে। কেন হানা মাইকেলকে বেছে নিয়েছিল? মাইকেল দুর্বল ,তাই? মাইকেল তাকে পোশাক-পরিবর্তনের সময় দেখে ফেলেছিল এবং সেই ‘অপরাধের’  সাজা দেবার সুযোগ নিয়েছিল সে? দুর্বলকে বইপড়ার জন্য বেছে নেয়া হানার কাছে নতুন কিছু নয়। মাইকেল সম্পর্কটি থেকে খুব বেশি কিছু পায় নি, শুধু ক্ষণিকের আত্মবিশ্বাস দেয়া ছাড়া। তার তুলনায় হারিয়েছে অনেক বেশি। নারীদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই তার জীবনে স্থায়ী হয় নি। এমনকি নিজের কন্যা-সন্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি। হানার আকস্মিক বিদায় তাকে টেনে নিয়ে যায় অদ্ভুত এক মানসিক অবস্থায়, যেখানে সে না পারে হানার স্মৃতিকে দূর করে দিতে, না পারে সেটার সঙ্গে থাকতে। হানা পরবর্তী শারীরিক সম্পর্কও অসফল হয়। সামান্যতম কোমল ব্যবহারও তার জন্য অসম্ভব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের মন বিচিত্র, আঘাত পেলে সেটাকে সে নিজেই সারাতে চেষ্টা করে। যে জটিলতার মধ্য দিয়ে মাইকেল যায়, সেটাকে নানা ভাবে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা যে বিফলে যায় তা বোঝা যায় তার বিয়ে এবং বিচ্ছেদে।

হানার সঙ্গে মাইকেলের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ আদালতে। হানা এসএস সদস্য ছিল এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত — ব্যাপারটি মাইকেলের জন্য নিদারুণ। যে সীসার মতো ভারী জটিল সম্পর্কের ইতিহাস সে বয়ে চলেছে, তার সঙ্গে যোগ হয় যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সম্পর্কের লজ্জা।  কোনো কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে সে চেষ্টা করে হানার অপরাধকে ঘৃণা করার, কিন্তু ব্যর্থ হয়। হানা নিজের গোপনীয়তা ভঙ্গের চাইতে যাবজ্জীবন জেলকে শ্রেয় মনে করে তা-ই বেছে নেয়। মাইকেল নিজের দেশ আর হানার অপরাধ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে, নিজের দোষগুলোর কথাও ভাবে। হানার গোপন কথাটি আবিষ্কারের ফলে মাইকেল পেয়ে যায় অনেক প্রশ্নের উত্তর যা তাদের দু’জনের সম্পর্কের সময় উদিত হয়েছিল।

বিয়ে বিচ্ছেদের পরে হানার সঙ্গে মাইকেলের দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্পর্ক শুরু হয়। আরেকবার মাইকেল রিডারের ভূমিকায় ফিরে যায়। হানার জেলজীবনের শেষ পর্যন্ত সে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস স্বকন্ঠে টেপ করে হানাকে পাঠায়। হানা জেলে বসেই লেখাপড়া শিখে মাইকেলকে চিঠি লেখে। জেলমুক্তির কিছু আগে তাদের পুনর্বার দেখা হয় এবং সেটাই শেষ দেখা। মুক্তির আগে হানা নিজেকে জীবন থেকে মুক্তি দেয়।

পুরো উপন্যাসটি যেহেতু মাইকেলের জবানিতে আমরা পাই, তাই হানাকে নিয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারি না। মাইকেলকে হানা জীবনের যতটুকু ভাগ দিয়েছে সেটা থেকে এটুকুই জানা যায় যে, সে বিবাহিতা — যা বোঝা যায় ‘ফ্রাউ’ সম্বোধনে; তার ১৭ বছরের একটি ছেলে আছে একই নামে। অবাক লাগে এটা ভেবে যে দিনের পর দিন হানা লেখাপড়া না জেনে কীভাবে কাজ করে এসেছে? কোথাও-না-কোথাও তো তাকে সই করতে হয়েছে। আমরা তাকে যেখান থেকে দেখি, সেই ট্রামের কন্ডাক্টর হিসেবে তাকে টিকিট বিক্রি বা কোনো কিছুরই কি রিপোর্ট দিতে হয় নি? বাড়ি ভাড়ার চুক্তি বা কেনাকাটা কোনো কিছুতেই কি লিখতে বা পড়তে হয় নি? গল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে বোঝা যায় কেন সে নিজেকে রহস্যময় করে রেখেছিল। অক্ষরজ্ঞান নেই, এটাকে সে যেভাবে সম্ভব গোপন করে গেছে। তারপরও প্রশ্ন জাগে, হানা ইহুদিদের ক্যাম্পে নিয়ে কী করা হয় তার কিছুই কি জানত না? চোখের সামনে এত নিষ্ঠুরতা দেখেও সে চাকরিটা ছাড়ে নি কেন? সেটার জন্য তো তাকে লেখাপড়া জানতে হত না। যে গোপন কথার জন্য হানা জেলে গিয়েছিল, সেটা সে কাটিয়ে উঠেছিল। পড়েছিল হলোকাস্ট নিয়ে বইপত্র। মাইকেলের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎকার পর্বের পর তারও নিশ্চয়ই মনে নানা চিন্তা এসেছিল, কিন্তু আমরা তার কিছুই জানতে পারি না। কেন সে আত্মহত্যা করেছিল সেটার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হতে পারে যে, যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত থাকার লজ্জাতে সে কাজটি করে। ব্যাখ্যাটা আশ্চর্য নয়? কারণ যতদিনে হানা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, ততদিনে সারা বিশ্ব জেনে গেছে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী করে গেছে। এতদিন সে কিছুই জানে নি?

উপন্যাসের সবচাইতে বড় চরিত্র ঘটনাপ্রবাহ। এই প্রবাহে হানাকে ধরা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রজন্ম আর মাইকেল পরের প্রজন্ম। মাইকেল আঙুল তোলে তার পূর্ব প্রজন্মের দিকে। কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাবার পথে যে ট্রাকে সে লিফট নেয়, তার ড্রাইভার তাকে বলে,

An executioner is not under orders. he’s doing his work, he doesn’t hate the people he executes, he’s not taking revenge on them, he’s not killing them because they’re in his way or threatening him or attacking him.

এভাবেই কি মাইকেলের (বা শ্লিংকের) আগের প্রজন্ম নিজেদের ভূমিকা জাস্টিফাই করেছিল? মাইকেল বাবার প্রজন্মের দিকে আঙুল তোলে। তাঁরা হয় চুপ করে ছিলেন, নয়তো হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন। তবে মাইকেলও কিন্তু চুপ করেই ছিল, হানার গোপনীয়তা ভঙ্গ হবে বলে বিচারকের খাস-কামরায় ঢুকেও তাঁকে কিছু বলে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দুটো মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ছায়া ফেলে। উপন্যাসটিকে নানান ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সবশেষে এটা আসলে দু’জন মানুষের গল্প, যাদের জীবন কেটে গেছে লজ্জার সাথে যুদ্ধ করে। পাঠকের কাছেই তাদের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে।

অদিতি কবির

বই পড়তে যত ভাল লাগে, লিখতে তার চেয়ে বেশি আলসেমি লাগে। একাডেমিক পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তালগোল পাকিয়ে গেছে।

৩ comments

  1. মিঠুন দস্তিদার - ২২ আগস্ট ২০১২ (৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ)

    আমি শুধু সিনেমাটি দেখেছি। হানা চরিত্রে কেট উইনস্লেটের অনবদ্য অভিনয়ে অনেকদিন বুঁদ হয়েছিলাম। কিন্তু এই পোষ্ট মারফত জানলাম মূল বইটির কথা। কিছু কিছু ব্যাপার আসলেই যুক্তিগ্রাহ্য নয় তবে ঘটনাপ্রবাহের তোড়ে তা হয়তো ভেসে গেছে। কিন্তু পূর্ব প্রজন্মের জাস্টিফাই করার কথাটি সম্পূর্ণ কুযুক্তি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে কেউ এইরকম কুযুক্তি দিলে তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারবো না।

  2. সা্ইদুল ইসলাম - ২২ আগস্ট ২০১২ (১১:১১ পূর্বাহ্ণ)

    এ-পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে উপন্যাস এবং সিনেমা দুটোর প্রতিই আগ্রহ তৈরি হলো। ধন্যবাদ অদিতি।

  3. পারু রহমান - ৩০ আগস্ট ২০১২ (১০:৫৮ অপরাহ্ণ)

    বইটার কথা জানা ছিল না। ধন্যবাদ অদিতি !!

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.