২৪ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর হওয়ার তিনদিন আগের কথা। দুপুরবেলা লন্ডনের বেশ কয়েকজন বাঙালি সাংবাদিক টেলিফোন পেলেন, বিকেলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক রহমানের এক সন্তান তাদের সঙ্গে বসতে চান।
তার আগের দিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রতিনিধি প্রধান স্টিফেন ফ্রোয়ান বাংলাদেশ সরকারকে জানান, সংস্থাটির পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ক্যাথরিন এস্টোনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে সব ধরণের মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকারের কাছে ইইউ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শাসি-প্রাপ্তদের শাস্তি পরিবর্তনের দাবি জানানোর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধ ও বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রেও যাতে এ ধরণের শাস্তি প্রয়োগ করা না হয় তার আগাম আবদার রাখে এ বিবৃতিতে।
পরিপ্রেক্ষিতই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সৈয়দ ফারুক রহমানের সন্তান ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই উদ্যোগটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। যদিও তিনি তা স্বীকার করেননি। তার কাছে বিষয়টি ছিল নেহাৎই কাকতালীয়। যদিও এটি জানাতে তিনি দ্বিধা করেননি, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছেই তারা লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে ফাঁসির রায় বাংলাদেশ সরকার পরিবর্তন করে, অন্য কথায় পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এটি মনে করা মোটেও অসঙ্গত হবে না যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওই সিদ্ধান্ত ছিল নেহাৎই লবিং-এর ফল। কেননা, পরদিন ২৫ জানুয়ারিতেই ইরাকে কার্যকর হয় কেমিক্যাল আলীর ফাঁসি। সব ধরণের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতার ধ্বজাধারী বকধার্মিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সে ফাঁসির ব্যাপারে কোনও বিবৃতিই ছিল না, যেমন ছিল না এর আগে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির বিরুদ্ধে।
বিকেল পাঁচটার দিকে ব্রিকলেনের অপেক্ষাকৃত নির্জন একটি রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয় কর্নেল ফারুকের সন্তান ড. জুবায়ের ফারুকের সেই সংবাদ সম্মেলন। দেখা গেল, সংবাদ সম্মেলনটির ব্যাপারে রক্ষা করা হয়েছে কঠোর গোপনীয়তা। সম্মেলনে জন্যে বেছে নেয়া হয়েছে এমন একটি রেস্টুরেন্ট, যেটির অবস্থান ব্রিকলেনের অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় আর তার মালিকেরও ১৯৭২ সালের সংবিধানবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে। রেস্টুরেন্টটির দোতলায় স্বল্পালোকিত কক্ষটিতে টেবিলের ওপর মাইক্রোফোন, সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যপত্র এবং দুটি পানিভর্তি গ্লাস আর তার পেছনে দু’জন মানুষ। একজন, লেখার অপেক্ষা রাখে না, সৈয়দ ফারুক রহমানের ছেলে ড. জুবায়ের ফারুক; আরেকজন, নিজেই নাম জানালেন তিনি- ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আজহার। লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক আমাকে অনুচ্চ গলায় পরে জানালেন, ঘোরতর পাকিস্তানবাদী এই আলী মোহাম্মদ আজহার।
সংবাদ সম্মেলনের পর বিষয়টি আরও কয়েকজন নিশ্চিত করলেন। জানালেন তারা, ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আজহার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাচ্চা এই পাকিস্তানবাদী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর একবারও দেশে যাননি, যদিও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনের প্রধান নেতা গোলাম আযম পর্যন্ত ভোল পাল্টে সেখানে চলে গিয়েছেন, দেশের নাম বাংলাদেশ হলেও ভেতরের সব কিছুই যেন পাকিস্তানের মতো করে ফেলা যায় – এই রাজনৈতিক মনোবাসনা ও লক্ষ্য নিয়ে।
এমন একজন মানুষকে সঙ্গী করে সৈয়দ ফারুক রহমানের পুত্র ড. জুনায়েদ ফারুক তাঁর পিতার মৃত্যুদণ্ড হালকার করার জন্যে সাংবাদিক-রিপোর্টারদের মাধ্যমে যে-আবেদন জানাতে এসেছিলেন, সেই আবেদন তাই শেষ পর্যন্ত আর মানবিক আবেদনের পর্যায়ে থাকল না, বরং পলকা এক আবেদন হয়ে গেল, হয়ে উঠল বিশেষ এক রাজনৈতিক ঘরানার সংঘবদ্ধ তৎপরতার অন্যতম উদাহরণ।
২.
ড. জুবায়ের ফারুক ওই সংবাদ সম্মেলনে আহ্বান রেখেছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে উঠে মানবিক অধিকারের স্থান থেকে তাঁর পিতাসহ দণ্ডিত সবারই মৃত্যুদণ্ড যেন হালকা করে দেয়া হয়। বলেছিলেন তিনি, ১৯৭৫-এ সংঘটিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মনে যে-আবেগের সৃষ্টি হয়েছে, সেসবের প্রতি তার শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু সম্মেলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যারা উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চয়ই এখনো মনে করতে পারবেন, একবারও তিনি বলেননি, ‘১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ড’, লিখিত বক্তব্য তো বটেই, মৌখিক আলোচনাতেও তিনি বার বার বলেছেন, ‘দ্য ইনসিডেন্ট অব সেভেনটিফাইভ’! কঠিন এক সচেতনতার মধ্যে দিয়ে উচ্চারিত তার ওই শব্দগুলি ছিল কানে লাগার মতো। আলোচনার শুরুতে এবং পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে আবারও তিনি জানিয়েছিলেন, তার অস্ট্রেলিয়াবাসের কথা। জানিয়েছিলেন লন্ডনে এসেছেন সপ্তাহখানেক হলো আর এই ভ্রমণের কারণ মৃত্যুদণ্ড হালকা করার উদ্দেশ্যে লবিং করা।
কিন্তু সঙ্গে এমন একজন ব্যক্তি কেন, যিনি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার করার জন্যে তার জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন? এটি ছিল একটি বড় প্রশ্ন। সৈয়দ ফারুক রহমান পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বেশ কয়েক মাস পরে। বাংলাদেশে আত্মীয়তার বন্ধন যত প্রগাঢ়ই হোক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পরিবারগুলির কোথাও না কোথাও খুব নিভৃতে গভীর এক দূরত্ব রয়েছে। হাসিমুখে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি দাঁড়ালেও সেই দূরত্ব ঘুচবার নয়। যে-মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ই কেবল নয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে পূর্ব পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখেছে, সেই মানুষটির সঙ্গে সৈয়দ ফারুক রহমানের এই নৈকট্য কি কেবলই পারিবারিক বলে ধরে নেয়া যাবে?
প্রশ্ন আরও ছিল (যদিও তা কেউ করেননি), যদি পারিবারিক কোনও ক্ষীণ সম্পর্ক থেকেও থাকে, এরকম একটি সংবাদ সম্মেলনে, যেটি রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে উঠে মৃত্যুদণ্ড হালকা জানানোর অনুরোধ করার জন্যে আয়োজিত হয়েছিল, সেখানে এমন একজন রাজনৈতিক অবস্থানসম্পন্ন ব্যক্তিকেই বা কেন নিয়ে এসেছেন ড. জুবায়ের ফারুক?
এর উত্তর অবশ্য প্রকারান্তরে দিয়ে গেছেন জুবায়ের ফারুক। লিখিত বক্তব্যে বলেছেন তিনি, ‘আমি কোনও রাজনীতিক নই। এরকম পরিস্থিতিতে আর সব সন্তানের পিতার জন্যে যে-রকম অনুভূতি কাজ করে, আমিও সেরকম অনুভূতি নিয়েই দণ্ড মওকুফের আবেদন করছি।’ তিনি ওই বক্তব্যে আরও বলেছেন, ১৯৭৫ সালের রাজনীতি সম্পর্কে তার ‘কোনও ধারণাই নেই’।
সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, যে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না, সেদেশের এমন একটি স্পর্শকাতর ঘটনায় আপনার এ আবেদন কীভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে? আর এরকম একটি হত্যাকাণ্ডে আপনার পিতার সম্পৃক্ততার কথা ওঠার পরেও আপনার কি কোনো আগ্রহ হয়নি দেশটির ইতিহাস এবং গুরুতর ওই ঘটনার ব্যাপারে জানবার?
জুবায়ের তখন উত্তর দিয়েছিলেন, অবশ্যই আমি ইতিহাস সচেতন, তবে আমি ওই ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নই। আমার তখন জন্মই হয়নি। তারপরই তিনি কথার মোড় ঘুরিয়ে আবার বলেছিলেন, যাই হোক, আমার মূল বক্তব্য হলো, শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বিশ্বজুড়েই গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং সম্প্রতি সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে উন্নত দেশগুলিতেও এটি বিলুপ্ত হয়েছে।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল, মুখে ড. জুবায়ের যতই বলুন ‘আমি রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে কোনো যুক্তিতর্ক করতে আসিনি, আমি এসেছি শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কথা বলতে’ – আসলে তিনি এসেছেন উন্নত দেশগুলির সেই আইন বিলুপ্তির সুযোগটি কয়েকজন খুনিকে রক্ষা করার জন্যে ব্যবহার করতে।
ড. জুবায়ের-এর কাছে আবারও জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে তো সৈয়দ ফারুক রহমানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। জুবায়ের কি তাদের কাছ থেকে এ মামলার ব্যাপারে কোনো আন্দোলন প্রত্যাশা করেন? তিনি তার উত্তরে বলেছিলেন, আমি খুব সংক্ষেপে বলতে চাই, আমি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নই এবং খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার পিতার নৈকট্যের সঙ্গেও আমার কোনও নিকটসম্পর্ক নেই। কিন্তু তিনি যে আসলে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকেই কথা বলতে এসেছিলেন, একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন, সেটি বোঝা গেল খানিক পরেই। তাকে যখন বলা হলো, আপনি কি মনে করেন এই মামলায় কোনও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে? আইন বিষয়ে পড়ালেখা করা জুবায়ের তখন বললেন, ‘এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় আমি নেই। তবে আমার কয়েকজন ব্যারিস্টার আছেন, যারা এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত, তারা এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে পারবেন। আমি নিজে থেকে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে পারি না।’
অতএব তিনি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেন এবং তাঁর প্রশ্নোত্তরের পর ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আজহার মুখ খুললেন। জানিয়ে দিলেন তিনি, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি।
যে-সব কথা বিড়ালতপস্বী সেজে ড. জুবায়ের বলেননি, সেসবই বলতে লাগলেন ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আজহার। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার দাবিদার জুবায়ের বলেছিলেন, তার পিতাকে তিনি মোটেও দোষী মনে করেন না। নিজে তিনি অজ্ঞতার ভান করবেন বলেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এমন একজনকে যিনি বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে ঠিক তার মতো করেই অনুভব করেন, যিনি ঠিক তার মতো করেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাকে অপমূল্যায়ন করেন; তার সেই ব্যারিস্টারসঙ্গী, পাকিস্তানপন্থী ব্যারিস্টার আলী মোহাম্মদ আজহার এরপর জুবারের ফারুকের খুনি পিতা ও তার সঙ্গীদের ‘নির্দোষিতার প্রমাণ’ তুলে ধরার চেষ্টা চালালেন সাংবাদিকদের সামনে।
৩.
এক প্রশ্নের উত্তরে জুবায়ের ওই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তিনি নাকি তার পিতার সঙ্গে কোনওদিনই এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেননি। পিতার সঙ্গে তার সবশেষ দেখা হয় জেলখানায়, ১৯৯৮ সালে। লৌহকপাটের আরেক পাশে দাঁড়িয়ে শুধু পিতা কেন, যে-কারও সঙ্গেই কথা বলার সময় ভিন্নতর এক অনুভূতির জন্ম নেয়। কিন্তু ২৮ বছরের ছেলে তার পিতার সর্বপ্রচারিত এমন একটি ঘটনা সম্পর্কে কোনওদিন কথা বলেননি, তাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? জুবায়ের ফারুক আমাদের সেটিই বিশ্বাস করতে বলেছেন। আরও বিশ্বাস করতে বলেছেন, তিনি রাজনীতিক নন। তিনি আমাদের বিশ্বাস করতে বলেছেন যে, তিনি শুধু তার পিতার মৃত্যুদণ্ডই হালকা করতে চান না, চান আর সবার মৃত্যুদণ্ডও হালকা করাতে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত কখনও তিনি বলেননি, বাংলাদেশ থেকে মৃত্যুদণ্ডের আইনটি বাতিল করা হোক, বলেননি এ দাবিতে তিনি তার ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন। তাই এ-ও বলা যায়, তিনি আসলে বিশ্ব মানবাধিকার আইনের মানবিক দিকটিকে অন্যায়ভাবে ব্যবহারের অপচেষ্টা করেছেন। শেষের দিকে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে অতীতের দিকে নয়, ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।’ যে অতীতের দুর্গন্ধ সঙ্গে নিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে এসেছিলেন, তার উৎকট গন্ধে কেউ যাতে ক্ষিপ্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্যে এর চেয়ে ভালো হিতোপদেশ আর কী হতে পারে? যাদের অতীত থাকে না, তাদের ভবিষ্যতও থাকে না – জুবায়ের ফারুক সেটি কি জানেন?
জুবায়ের ফারুক যে বিড়ালতপস্বী সেজে লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিক ও রিপোর্টারদের বোকা বানানোর চেষ্টা করে গেছেন, তার প্রমাণ এখন ধীরে ধীরে পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা জানতে পেরেছি, তিনি আসলে বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টির ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর ই-মেইল করে সৈয়দ জুবায়ের ফারুক ও তার বড়ভাই সৈয়দ জানিয়েছে, ‘‘জাতির এই বীরদের কারাগারের কনডেম সেলে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে জুলুম, নির্যাতন করার পর অবশেষে রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা অবৈধ উপায়ে তড়িঘড়ি করে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করেছেন। কারণ তারা জানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অন্যায় মেনে নেবে না।’’ তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতের পাপেট সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড বৃথা যাবে না। জনগণ এই মহান বীরদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে যারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।… পরিবারের শোক-ভারাক্রান্ত সদস্য হিসেবে আমরা বলব, এই বীররা ভারতীয় আগ্রাসন এবং ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার্থেই তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেলেন। ভারতপন্থী মুজিব তার ৩৪ হাজার রাজনৈতিকবিরোধী এবং ২ লাখ ৪০ হাজার নিষ্পাপ সাধারণ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিলেন। ইতিহাসে এর স্বাক্ষ্য রয়েছে।’’ (আমাদের সময়, ২৯ জানুয়ারি, ২০১০)।
এই হলো জুবায়ের ফারুকের রাজনৈতিক ইতিহাসজ্ঞান – তার সেই ইতিহাসজ্ঞান অনুযায়ী ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা সবাই ‘জাতীয় বীর’ আর যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, যুদ্ধের পর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য পর্যন্ত বিদায় করে দিয়েছিল, তারা হলো কি না ভারতপন্থী, তারা হলো কি না ‘লাখ লাখ সাধারণ মানুষদের হত্যাকারী’! এই ইতিহাসজ্ঞান তিনি লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিক-রিপোর্টারদের কাছ থেকে ২৪ জানুয়ারি রবিবার গোপন রেখেছিলেন। এরপরও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, কেবল মানবিক আকুতি জানানোর জন্যেই সেদিন ড. জুবায়ের ফারুক সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়েছিলেন? কেবল এই মানবিক আকুতি জানানোর জন্যেই তার পরিকল্পনা ছিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করার এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতেও ‘অনুকুল পরিস্থিতি’ থাকলে এরকম সংবাদ সম্মেলন করার?
৪.
দূর অতীতে ১৬৭০ সালে রাশিয়ায় স্তেপান রাজিনের নেতৃত্বে সর্বাত্মক এক কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল। আমাদের দেশের ফকির মজনু শাহের মতো স্তেপান রাজিনও নৌকায় করে নদীতে নদীতে ঘুরে বেড়াতেন, কৃষকদের ওপর জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। তাঁর সেই বিদ্রোহী নৌকা স্পর্শ করে কাস্পিয়ান সাগরের জল, ভলগা নদীর জল, ডন নদীর জল। অনেক আগে পড়া সেই কাহিনী এতদিন পর মনে নেই ভালো করে। এটুকু মনে আছে, একের পর এক জনপদ ও নদী অতিক্রম করছিলেন স্তেপান রাজিনের বাহিনি, ফাঁসিতে ঝুলাচ্ছিলেন অত্যাচারী জমিদার ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোদের। এরকমই একবার এক জমিদারকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সময় তার বালিকা মেয়ে ছুটে এসে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘ওকে রেহাই দাও, রাজিন। তোমার যদি এইভাবে ফাঁসি হয় আর তোমার যদি আমার মতো একটি ছোট্ট মেয়ে থাকে, তা হলে তার কেমন লাগবে বলো?’
স্তেপান রাজিনের চোখ দিয়ে দরদরিয়ে অশ্রু নেমে এলো। আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তারপর চোখ নামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা সমবেত কৃষকদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ফাঁসি দিয়ে দে। বড় হলে বুঝতে পারবে।’
জুবায়ের ফারুক দাবি করেছিলেন, ইতিহাস জানা নেই তার। ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কেউ কেউ হয়তো ভেবেছিলেন, সেই বালিকার মতো বড় হয়ে (আর কত বড় হবে জুবায়ের ফারুক? কেউ কি আর তার নিজের চেয়েও বড় হতে পারে?) ইতিহাস জানার পর একদিন তিনি নিশ্চয়ই বুঝবেন, এই দণ্ড কার্যকর বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে, বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল করার জন্যে কী ভীষণ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু আমরা জানি, বুঝে শুনেই ২৪ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যায় সবার সামনে মিথ্যা বলে গেছেন তিনি, বাংলাদেশের ইতিহাস-অজ্ঞতার ভান করে গেছেন, বাংলাদেশের আইনী প্রক্রিয়া না বোঝার অভিনয় করে গেছেন। সংগোপনে তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন ‘হত্যার যৌক্তিকতার’ এক নষ্ট ইতিহাস। তিনি বলেছিলেন, তার পিতা দোষী নয়; এখন দেখা যাচ্ছে পিতাকে তিনি ‘জাতীয় বীর’ও মনে করেন। ফ্রিডম পার্টির মতো একটি সংগঠনের যিনি ভাইস চেয়ারম্যান, তার পঠিত ও রচিত ইতিহাস তো এরকমই হওয়ার কথা।
জুবায়ের ফারুক জানেন না, ওই নষ্ট ইতিহাসের চাপে একদিন তারও মৃত্যু হবে। কিন্তু বাংলাদেশ তারপরও বেঁচে থাকবে এবং তার অমিত সম্ভাবনাগুলিও একে একে সত্যি হবে।
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৭ comments
abu naser robii - ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৯:৫৬ অপরাহ্ণ)
বাংলাদেশ জয়ী হবেই … … জুবায়েরদের ব্যপারে আমাদের সচেতন থাকা আবশ্যক, লেখক কে ধন্যবাদ।
অবিশ্রুত - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:৪৪ পূর্বাহ্ণ)
ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আবার তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ-সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়েছে তিন ফেব্রুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে। সেখানে এমনকি হুমকি দেয়া হয়েছে (যদিও তাদের ভাষায় এটি নাকি উদ্বেগ), এর ফলে অপর পলাতক ছয় আসামীকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা নাকি কঠিন হয়ে পড়বে।
আচ্ছা, ২৫ জানুয়ারি কেমিক্যাল আলীর ফাঁসি হওয়ার পর কি এই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কোনও বিবৃতি দিয়েছে?
রায়হান রশিদ - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ)
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করে কোনখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলে সেটা নিয়ে তাদের মন্তব্য না করলেই নয়! ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের পক্ষে আমিও নই, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বিষয়টিকে একটা ‘প্রায় ধর্মতত্ত্বের’ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে আজকাল। যেন, এটাই বিষয়টিকে দেখবার একমাত্র নৈতিক মানদন্ড। এটা মেনে নিতে আপত্তি আছে। ‘মৃত্যুদন্ডের পক্ষের পূর্বতন নৈতিকতার মানদন্ড বিপক্ষের আরেক প্রস্থ নতুন নৈতিক মানদন্ড দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে কেবল’ – এর বেশী কিছু হিসেবে ব্যাপারটিকে দেখার মনে হয় না কোন অবকাশ আছে। (কথাটা আমার না, রেফারেন্সটা মনে পড়লে যুক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করবো)।
কেমিকেল আলি এবং সাদ্দাম হুসেন দু’জনের মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রেই এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অবশ্য নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল (লিন্ক দেয়া হল)।
মোহাম্মদ মুনিম - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ)
মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তিটি হচ্ছে এটি একটি irreversible action. কার্যকর হয়ে গেলে পরবর্তীকালে যদি প্রমাণিত হয় যে আসামী নির্দোষ ছিল, তবে কিছুই করার থাকে না। এরকম ঘটনা ঘটেনি তা নয়। আমেরিকাতে সত্তরের দশকে এক সিরিয়াল কিলারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। পরবর্তীকালে ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখা গেলো তার শিকারদের একজনকে সে আসলে খুন করেনি। বছর দশেক আগে গুলিতে নিহত ব্যক্তির শরীর থেকে গুলি উদ্ধার করে সেই গুলি পরীক্ষা করে খুনী সনাক্ত করার প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছিল। সেই প্রযুক্তি মৃত্যুদন্ডে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহারও করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে দেখা গেল, প্রযুক্তিটি পুরোপুরি ভুয়া।
মৃত্যুদন্ডের পক্ষে যুক্তি হলো এটা একটা শক্ত deterrent, মৃত্যুদন্ডের ভয়ে লোকে খুন খারাবি করবে না। এটা খুব একটা ভাল যুক্তি নয়, আমেরিকাতে বছরে শয়ে শয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পরেও বছরে প্রায় বিশ হাজার খুন হয়। তবে মৃত্যুদন্ডের ভয়ে আসামীরা guilty plea করে (মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে না এই শর্তে), যার ফলে বিচারকার্য দ্রুত হয়। আর যারা খুনের শিকার হন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মানসিক সান্ত্বনার ব্যাপার তো আছেই।
যাই হোক, বংগবন্ধুর খুনিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর পুরোপুরি আইনী প্রক্রিয়াতে হয়েছে। তারা শুধু বংগবন্ধুকে নয়, তার আট বছরের সন্তানকে খুন করেছে, তার গর্ভবতী পুত্রবধূকে খুন করেছে, শুধু তাই নয়, দীর্ঘ বিশ বছর এই খুন নিয়ে প্রকাশ্য জনসভাতে আস্ফালন করেছে। এমনেস্টি যাই বলুক, কিছু কিছু অপরাধের একটাই শাস্তি, মৃত্যুদন্ড। এই মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সাথে সাথে আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ‘নাজাত’ দিবস বা ‘সিপাহি জনতার বিপ্লব’ জাতীয় ফালতু ব্যাপার চিরদিনের জন্য বিদায় নিবে, এটাই কাম্য।
আলমগীর - ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:২৬ পূর্বাহ্ণ)
অসাধারণ একটা লেখা। অনেক ধন্যবাদ অবিশ্রুত।
নৈতিকভাবে এমনেস্টি সব ধরণের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে। (বালি দ্বীপের ঘটনায় আমরোজির মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে অস্ট্রেলিয়ার এমনেস্টি প্রধান সমালোচিত হয়েছেন।)
কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড আমার বিবেচনায় প্রয়োজনীয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা তেমন একটি। খুনীদের মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত কোন অনুশোচনা ছিলো না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায়, যতটা দ্রুততার সাথে তা কার্যকর করা হয়েছে- তা ভালো লাগেনি। মিষ্টি বিতরণ, শোকরানা নামাজ, লাশে জুতা নিক্ষেপ- ভালো লাগেনি। এগুলো অসভ্যতা।
তানবীরা - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:২৩ পূর্বাহ্ণ)
বাংলাদেশে আত্মীয়তার বন্ধন যত প্রগাঢ়ই হোক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পরিবারগুলির কোথাও না কোথাও খুব নিভৃতে গভীর এক দূরত্ব রয়েছে। হাসিমুখে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি দাঁড়ালেও সেই দূরত্ব ঘুচবার নয়।
অসাধারন উক্তি।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে
অবিশ্রুত - ২১ মার্চ ২০১১ (৩:০৭ পূর্বাহ্ণ)
সেদিন ড. জুবায়ের ফারুক যে-বিবৃতিটি পাঠ ও বিতরণ করেছিলেন, তা ডকুমেন্টেশনের স্বার্থে নিচে হুবহু তুলে ধরছি :
এ বিবৃতিটি প্রচার করা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের বাংলা সংবাদপত্রগুলির সাংবাদিকদের কাছে। এখনও হয়তো অনেকের সংগ্রহে আছে। এরকম আরও অনেক বিবৃতি ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই জানা যাবে, যদি একটু খোঁজ করা হয়। বিবৃতিটিতে যুক্ত টেলিফোন নাম্বারটি সম্ভবত যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে জুবায়ের ফারুক ব্যবহার করছিলেন।