‘ধান সাধারণত ৭০ দিন পানিতে ভিজাইয়া রাখা হয়।’
অনেক আগে এসএসসির এক পরীক্ষার্থী এই অবিশ্বাস্য ধানের রচনা লিখেছিল। কেবল এই রচনার অবিশ্বাস্যতার গুণে নয়, এসএসসি পরীক্ষার্থীর নির্বুদ্ধিচর্চার সংবাদ হিসেবে রচনাটি পরীক্ষক শিক্ষকের মারফতে প্রকাশ পেয়েছিল সংবাদপত্রে।
এবার আরেকটি বাক্য শুনুন।
‘যুগে যুগে কিছু মহামানবের আবির্ভাব হয়। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দিন তেমনি এক মহামানব, আব্রাহাম লিংকনের মতো একজন মহামানব। (আমাদের সময়, ১৮ বৈশাখ ১৪১৬/ ১ মে ২০০৯)।’
এই অবিশ্বাস্য বাক্যটি বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের কণ্ঠ দিয়ে। তিনি অবশ্য এসএসসি পরীক্ষার্থী নন, ডক্টরেট ডিগ্রি পর্যন্ত অর্জন করেছেন। তাই তাঁর মুখনিঃসৃত এ বাক্যকে নিবুর্দ্ধিচর্চার উদাহরণ বলি কী করে? বরং বলা যেতে পারে, এটি তৈলমর্দনচর্চার একটি অন্যতম উদাহরণ। সেনাপ্রধান তখন তাঁর সামনেই বসেছিলেন, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভূমিকম্পকালীন অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য সংগৃহীত যন্ত্রপাতি হস্তান্তর উপলক্ষে চট্টগ্রামের আর্মি এম্বারসেশন ইউনিটে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তারা। প্রশংসা করার এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? অতএব তিনি প্রশংসা করেছেন মুক্তস্বরে। তবে পত্রিকার পাতায় যে কথাটা ছাপা হতে পারে, তা বোধহয় তাঁর মাথায় ছিল না। তাই এখন পত্রিকায় তাঁকে প্রতিবাদপত্র পাঠাতে হচ্ছে, যাতে তিনি লিখছেন, ‘আমি এরকম কোনও কথা বলিনি’ (আমাদের সময়, ২০ বৈশাখ ১৪১৬)। রাজ্জাক সাহেবকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাঁর এই কথার মধ্যে দিয়ে সবার জন্যে নতুন এক দুর্যোগই নিয়ে এসেছেন।
দিনবদলের জন্যে যাদের বাংলাদেশের জনগণ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে মাত্র চার মাস আগে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাদের কথার ওজন যদি এরকম হয়, তা হলে জনগণের জন্যে আরও বড় দুর্যোগ অপেক্ষা করছে। অনেকে অবশ্য এখনও আশাবাদী, তারা এখনও বলছেন, সরকার তো কেবল ১০০ দিন পার করলো, আরও একটু সময় ধৈর্য ধরতে হবে…।
তা কথাটাকে মিথ্যা বলি কী করে? সত্যিই তো, মাত্র ১০০ দিন অথবা মাস চারেক আগে সরকার ক্ষমতায় এসেছেন; আর আমাদের এই রাষ্ট্রে কত যে ধুলাবালি জমেছে সেটা তো মাত্র একটা উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়,- মাত্র ৩৮ বছরে দেশটির সংবিধানে এক ডজনের বেশি সংশোধনী এসেছে, গণতন্ত্র দিতে এতই তত্পর ছিলেন আমাদের বিভিন্ন সরকার! এইসব ‘গণতান্ত্রিক সংশোধনী’র সূত্র যে-ভার জমেছে তা সরানো কি এত সহজ?
কিন্তু এ কথা যখন বলি, তখন কি আমাদের এ কথাটি মনে থাকে, সরকারের বয়স যে কয়দিনই হোক না কেন, যে-দলটি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে সে-দলটির বয়স মাত্র ১০০ দিন নয়, সে-দলটির বয়স ৬০ বছর এখন। ১৯৪৯ সালে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। দলটি দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, ১৯৫৪ সালে একবার যুক্তফ্রন্টের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদারও ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগেও দু’ দফায় সাড়ে আট বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে আওয়ামী লীগ। রাজপথের আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রক্ষমতার সদরে-অন্দরে যেসব সোজাসাপটা কিংবা উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটে তার সব কিছুই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে তারা টানা অর্ধদশক ধরে। সে হিসেবে ষষ্ঠেন্দ্রিয়ও প্রখর হওয়ার কথা এ দলটির।
তারপরও আমাদের বিস্ময়ে ক্রুদ্ধ হতে হয়, যখন দেখি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পর এই দলটিরই যুবলীগ নেতাকর্মীরা সারা দেশে দুম্বার মাংস নিয়ে মারামারি, কাড়াকাড়ি করে ( দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ বৈশাখ ১৪১৬/ ১ মে ২০০৯)। দুম্বার মাংস কি বাঙালির ও বাংলাদেশির খাদ্যরুচির সঙ্গে খুব বেশি মেলে? নাকি কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব ঘুরে এসেছেন বলে আরব মুল্লুক থেকে আসা দুম্বার মাংস খাওয়া খুবই সওয়াবের কাজ? নাকি যুবলীগ নেতা-কর্মীদের ধারণা, দুম্বার মাংস খায় বলে জামাত-বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘাড়েগর্দানে বেশ পয়মন্ত, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে ওই মাংস খেতে হবে? এমনও তো নয় যে, ওই মাংস বাজারে বেশি দামে বেচা যাবে!
শুধু কি তাই? আমরা বিস্ময়ে ক্রুদ্ধ হয়ে দেখি, শাসক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের কারণে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। দু’চার জায়গায় এর জন্যে ইসলামী ছাত্র শিবির দায়ী বটে, কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন অস্থির ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে। আমাদের এও দেখতে হয়েছে, নির্যাতিতদের জন্যে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে টাকা বরাদ্দ নিয়ে তার চেক হাতিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-সাংসদ, এমনকি নিজের দলের সত্যিকারের নির্যাতিত নেতাকর্মীরাও এই অনুদান পায়নি। এই ধরনের নেতা-সাংসদের কি সত্যিই কোনও দরকার আছে কোনও রাজনৈতিক দলের?
আমাদের, ১৫ কোটি মানুষের, মনে হয় দরকার নেই। কিন্তু মনে হয় না আওয়ামী লীগের। মনে হয় না বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের। তাই আওয়ামী লীগ বাগমারায় এনামুল হক নামের সাংসদকে পোষে। গফরগাঁওয়ে গিয়াসউদ্দিন আহমদ নামের সাংসদকে পোষে, যার পেটোয়া বাহিনী সাংবাদিককে ঘোষণা দিয়ে পিটায়। তাই বিএনপি ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন নামের সাংসদকে পোষে, যে জমির উদ্দিন নির্লজ্জের মতো চিকিত্সার নামে তো বটেই, নিজের বাসার সকালের নাস্তার খরচটিও সংসদের তহবিল থেকে নিয়েছেন। তাই বিএনপি ব্যারিস্টার মওদুদ নামের একজন বিশ্ববিখ্যাত বর্ণচোরাকে পোষে, যে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডও রহিত করতে তত্পর ভূমিকা রাখে। খোদা না করুন, আজ এরা মারা গেলে এক মাসের মধ্যেই উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে; কিন্তু এদের দল থেকে বের করে দিয়ে নতুন উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার নৈতিক বল কি আওয়ামী লীগের, কি বিএনপির কারও নেই!
সরকার ক্ষমতায় গিয়ে গত ১০০ দিনে বা চার মাসে কী করেছেন, তার হিসেব করা অবশ্য খুবই সোজা। বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, টেন্ডারবাজি, দুম্বার মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি, নির্যাতিতদের চেক লুট,- সরকার যদি ভালো কোনও কাজ করেও থাকেন, তার সবই দুর্গন্ধে ঢেকে দিয়েছে এইসব কাজকারবার।
কিন্তু বিষয়টিকে তো আরও একদিক থেকে দেখা যায়। আমরা যদি সত্যপথ যদি খুঁজে পেতে চাই, তা হলে বোধকরি সেদিক থেকেই বিষয়টিকে দেখা প্রয়োজন। আমাদের এখন এটিও জানা প্রয়োজন, এই চারমাসে বিরোধী দলগুলি কী করেছে?
২৫ ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় যখন হত্যাকাণ্ড চলছে, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া তখন কালো কাচঘেরা গাড়িতে নিরুদ্দেশে যাচ্ছেন,- ওই দিনটির কথা না হয় উহ্যই রাখি; এই চার মাসের মধ্যে, উদাহরণ হিসেবে কেবল একটি দিন, এই গত দুই মে’র কথাই বলি। ওইদিন বিএনপির আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনের পর প্রথম প্রকাশ্যে জনসভা করেছেন পল্টন ময়দানে। সেখানে তিনি বলেছেন,
‘দেশে কোনও জঙ্গি নেই, যা ছিল আমরা ধরেছি ও শাস্তি দিয়েছি। এই জঙ্গি জঙ্গি বলে দেশিবিদেশী সৈন্য আনার চক্রান্ত চলছে (প্রথম আলো, ২০ বৈশাখ ১৪১৬/ ৩ মে ২০০৯)।’
খালেদা জিয়া বলছেন, ‘জঙ্গিদের ধরে আমরা শাস্তি দিয়েছি’; কিন্তু সবাই জানেন, বছরের পর বছর তারা আসলে কী করেছেন। দুধকলা দিয়ে তারা বাংলা ভাই, আবদুর রহমানদের পুষেছেন; তারপর যখন সেই সাপ তাদেরই ছোবল দিয়েছে, সারা দেশে একযোগে পাঁচশ’র বেশি জায়গায় বোমা ফাটিয়ে নিজেদের সরব অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে, তখন বাধ্য হয়েছেন ‘ও বাবা, তোমরা তো ভারী বেয়াদপি করেছো’ বলতে। খালেদা জিয়ার একজন মন্ত্রী ছিলেন আলতাফ হোসেন নাম; তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই বলেছিলেন, ‘মুফতি হান্নানের ওজনই তো ৭৩ কেজি না, সে কি করে ৭৩ কেজি ওজনের বোমা বানাবে?’। একবার তারেক রহমান একটি আন্তর্জাতিক বেতার মাধ্যমের বাংলা বিভাগের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘এসব (বোমা নিক্ষেপ) ঘটনার সঙ্গে আল-কায়েদার যোগ থাকতে পারে।’ কিন্তু পরে কী দিয়ে কী হলো, ওই গণমাধ্যমকে ব্যাখ্যা দিতে দেখা গেল, তিনি নাকি ওরকম কোনও কথাই বলেননি। এবং, কী অবাক কাণ্ড, তারা তখন তারেক রহমানের সাক্ষাতকারটি নতুন করে বাজিয়েও শোনালেন না শ্রোতাদের! এখন আমরা খালেদা জিয়াকে বলতে শুনছি, সব জঙ্গীদের তারা ধরে ধরে শাস্তি দিয়েছেন। তাই নতুন কোনও জঙ্গী নেই, নতুন কাউকে শাস্তি দেয়ার দরকার নেই। আওয়ামী লীগ আবার কেন জঙ্গি খুঁজছে, সেটাই তাদের মাথাব্যথা।
এ ভাষণের মধ্যে দিয়ে খালেদা জিয়া প্রকারান্তরে জঙ্গিদের প্রতি তাঁর পতাকার নিচে সমবেত হওয়ার আহ্বান রাখলেন; প্রকারান্তরে জঙ্গিদের বুঝিয়ে দিলেন, আওয়ামী লীগের এই পাঁচ বছরের শাসনামলে বিএনপির পতাকার নিচে তারা নিরাপদে থাকবে।
খালেদা জিয়া দুর্নীতির প্রসঙ্গও তুলেছেন দুই মে’তে। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী,
‘‘১ মে পল্টনের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জোট আমলে বিদ্যু” খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে যে অভিযোগ করেন তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের ৫ বছরের শাসনামলে ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি প্রমাণ করুন। আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের ৫ বছরে বিদ্যু” খাতে বাজেট ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে ব্যয় হয়েছে। বাকি টাকা ব্যয় হয়েছে বিদ্যুতের উন্নয়ন ও সঞ্চালন খাতে। তা হলে ২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয় কীভাবে? (ইত্তেফাক, ২০ বৈশাখ, ১৪১৬/ ৩ মে ২০০৯)।’’
একটি খাতকে ঘিরে সেই খাতে যত বাজেট থাকে তার বাইরেও দুর্নীতি ঘটতে পারে। তারপরও এ নিয়ে এখানে আর কথা বাড়াবো না। তবে প্রসঙ্গক্রমেই আরও একটি দিনের কথা মনে পড়ছে। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখ। খালেদা জিয়ার ভাষা ধার করেই বলি,- ‘জরুরি সরকার’ তার আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৩১ জুলাইয়ের পর অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ থাকবে না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু দিনক্ষণ শেষ হবার ঠিক একদিন আগে ৩০ জুলাই এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। দেখা গেল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এক কোটি টাকার কিছু বেশি অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে গেছেন। কালো টাকা শাদা করার জন্যে ওই সময় খালেদা জিয়া ৩৩ লাখ এবং সাইফুর রহমান ৩১ লাখ টাকার কর দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া তাঁর কর জমা দিয়েছিলেন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে। তারপর ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকার বিবরণের একটি কপি এনবিআর-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন (প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০০৭)। প্রথমে খালেদা জিয়ার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার আবেদন এনবিআর নিতে চায়নি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। একই ঘটনা ঘটেছিল সাইফুর রহমানের ক্ষেত্রেও। তখন এনবিআর-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান বদিউর রহমানকে বলতে শোনা গিয়েছিল, কোনও উপযুক্ত সংস্থা এখনও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ তোলেনি। তবে এনবিআর অনুমোদিত ছকেও তিনি আবেদন জমা দেননি (প্রথম আলো, ২ আগস্ট ২০০৭)।
খালেদা জিয়া কালো টাকা শাদা করতে গিয়েছেন শুনে টিআইবি ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মনে হয় একটু হোঁচট খেয়েছিলেন। তাই নরম গলায় বলেছিলেন, তা হলে তো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতাই রয়েছে মনে হয় (প্রথম আলো, ২ আগস্ট)। তবে ওই হোঁচট এতদিনে সেরে গেছে এবং খালেদা জিয়ার বাড়িটি নিয়ে যাতে আওয়ামী লীগ সরকার বাড়াবাড়ি না করে তা নিয়ে সম্প্রতি তিনি সবাইকে জ্ঞান দিয়েছেন। এই হলো আমাদের সুশীল মোজাফফর আহমদের দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতা! জিয়াউর রহমান একদা তাঁকে শিক্ষা উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতা তিনি এখনও নানা ভাবে প্রকাশ করে চলেছেন।
প্রথমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খালেদা জিয়ার অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার আবেদন গ্রহন করতে না চাইলেও খুব তাড়াতাড়িই অদৃশ্য কারণে সে পথ থেকে সরে আসে। জানি না, এর পেছনে টিআইবি’র সুশীল অধ্যাপক সাহেবদের কোনও ভূমিকা ছিল কি না। তবে পাঁচ আগস্ট এনবিআরের চেয়ারম্যান বদিউর রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যথাযথ নিয়ম মেনে (বা এনবিআর অনুমোদিত ছকে বা ফরমে আয়কর বিবরণী জমা দিলে) আবেদন করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার আবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গ্রহণ করবে (প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০০৯)। এবং তার পরের দিনই আমরা দেখি, এনবিআর-এর নির্ধারিত ছকে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার আবেদন করায় এনবিআর খালেদা জিয়ার আইনজীবীর কাছ থেকে আয়কর রিটার্ন গ্রহণ করেছে (সমকাল, ৭ আগস্ট)। কেবল খালেদা জিয়াই নন, তার পুত্র বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোও অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে জরিমানাসহ প্রায় ৪৮ লাখ টাকার আয়কর দেন। ২৮ জুলাই, ২০০৭-এ বাংলাদেশ ব্যাংকে চালান জমা দিয়ে চালান রসিদ ডাকযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয় (ইত্তেফাক, ৭ আগস্ট ২০০৭)।
এখন কেউ কি একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন, দুর্নীতি না করে কীভাবে একজন মানুষের ঘরে কালো টাকা জমে? খালেদা জিয়া কালো টাকা শাদা করেছেন, এটিও কী অস্বীকার করবেন? অনেকে তাঁর নামের আগেপরে অনেক বিশেষণ যুক্ত করে থাকেন, যুক্ত করতে পারেন, আমরা সেদিকে যাব না; কিন্তু যিনি কালো টাকা শাদা করেছেন, তাকে কি আমরা পারব না দুর্নীতিবাজ বলতে? প্রবাদ আছে, চোরের মায়ের বড় গলা। প্রবাদ তো আর এমনি-এমনি হয় না, চারপাশের বাস্তবতা থেকেই প্রবাদের উত্পত্তি ঘটে।
এখন খালেদা জিয়া চার মাসের মাথায় বলছেন সরকারকে গদি ছেড়ে দিতে। সেনাপ্রধানকে ‘মহামানব’ বলে তোষণ করে ড. আবদুর রাজ্জাকরা যেমন চাইছেন গদিকে নিশ্চিত করতে, তেমনি খালেদা জিয়াও পিলখানায় ‘আর্মি এসেছে শুনলে সবাই ভয়ে পালাতো’ বলে চাইছেন গদিতে যাওয়ার জন্যে সেনাবাহিনীর সহানুভূতির মাত্রা বাড়াতে। এতই ইচ্ছে তাদের কারও গদিঘরে থাকার, কারও গদিঘরে যাওয়ার! অথচ এই চার মাসে একটি ছায়া সরকার গঠনের মুরোদ পর্যন্ত হয়নি এই বিরোধী দলের। মুরোদ হয়নি কৃষি, শিক্ষা কিংবা অর্থনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার যে-সব পদক্ষেপ নিয়েছে তার গঠনমূলক সমালোচনা করার। কেবল একটি বুলিই তারা ঝাড়তে শিখেছেন, গদি ছেড়ে দিন। গদিঘরই মূল লক্ষ্য তাদের! গদিঘরে গিয়ে হয়তো তারা দুম্বার মাংস খাবেন না; তবে খাম্বার মতো কোনও খুঁটি হয়তো প্রদান করবেন দেশবাসীকে!
এখন আমাদের চিন্তা করা দরকার, আমরা দুম্বার মাংস খেতে দেব, না কি খাম্বার মতো কোনও খুঁটি নেবো, না কি নতুন কোনও পথে এগিয়ে যাব।
২০ বৈশাখ ১৪১৬/ ৩ মে ২০০৯
অবিশ্রুত
সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
শাহীন ইসলাম - ৫ মে ২০০৯ (৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ)
অবিশ্রুত যা লিখেছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে একটি হতাশা আমাদের অনেকের মধ্যে জমে আছে — এবং তা দিন দিন বেড়েই উঠছে। কোথায় যাব? এই দল বলুন আর ঐ দল বলুন, কোনো তফাৎ নেই, স্রেফ কতকগুলি ফাঁকা বুলি ছাড়া। খুব আঁতকে উঠেছিলাম যখন শুনলাম অাওয়ামী লীগ ফতোয়াবাজদের সাথে আঁতাত করেছে। … যাক সে সব কথা। এখন ভরসা নতুন প্রজন্মের উপর। কিন্তু আমরা ঠিক না থাকলে ওরাও বা আর কি হবে?
রায়হান রশিদ - ৫ মে ২০০৯ (৪:০৭ পূর্বাহ্ণ)
শুনেছি খাম্বা প্রবর এখন বিলেতে। শিরোমণির ভক্ত জনেরা তাঁর দেখাও নাকি পান পার্কে রেস্টুরেন্ট যা নিয়ে আবার দেশের পত্রিকায় গুণমুগ্ধ লেখাও ছাপানো হয় মহা সমারোহে। এঁদেরই একজন নাকি আবার হাওয়ারুন বিবির ডেরা কিনে নিয়ে গুরুচরণে অর্ঘ্য দেয়ার পরিকল্পনা করছেন; কারণটা নিতান্তই সেন্টিমেন্টাল (!), অন্য কিছু না।
আর মন্ত্রী রাজ্জাকের কথা শুনে অবাক হবার কিছু নেই। যার বিচারে মঈন-লিংকন এক হয়ে যায়, সেই ‘লেজবিশিষ্ট বৃক্ষচারী লম্ফনপটু স্তন্যপায়ী প্রাণীবিশেষের’ কথা তুলে কেন মিছিমিছি নিজেরা বিব্রত হই! বহুদিন আগে পড়া ময়ুখ চোধুরীর কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে:
শামস - ১৪ মে ২০০৯ (১১:০৬ পূর্বাহ্ণ)
দুম্বা আর খাম্বা — দুই-ই নিপাত যাক! কিন্তু নতুন পথটা কোন্দিকে?
ড. রাজ্জাক দাস্য-মনোবৃত্তির পরিচয় দিলেন। সেজন্যই কি তাঁর লজ্জাহীন স্থূল স্তুতিবাক্যে আব্রাহাম লিংকনকে টেনে আনতে হলো?
খুউউব জানতে ইচ্ছে করে, সীমাহীন দুর্নীতির পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই সুপুত্র জেল-হাজতের বাইরে থাকে কেন?