মুজিব-তাজউদ্দীন সম্পর্ক : শুধুই কি ভুল বোঝাবুঝি?

বলা হয়ে থাকে, স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত পথে না এগুনোর একটি অন্যতম কারণ, মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ‘ভুল বোঝাবুঝি।’

বলা হয়ে থাকে, স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত পথে না এগুনোর একটি অন্যতম কারণ, মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ‘ভুল বোঝাবুঝি।’ বিশেষ করে সুশীল বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে অহরহ এই ‘ভুল বোঝাবুঝি’র কথা এতভাবে বলা হয় যে, ইতিমধ্যে তা যেন প্রস্তরীভূত সত্যে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ঘটনার সমাবেশ এমনভাবে ঘটানো হয় যাতে পাঠক কিংবা শ্রোতারা নিজ দায়িত্বেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আসলে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই শেষ অব্দি তাঁদের সম্পর্ক এমন করুণ পরিণতি পায়। ব্যাপারটি দাঁড়ায় এরকম, বঙ্গবন্ধু নিজেই এক ট্র্যাজিক হিরো, কিন্তু তাঁর সেই ট্র্যাজেডি তাজউদ্দীনকেও গ্রাস করে বঙ্গবন্ধুরই কারণে!

কিন্তু সত্যিই কি তাই?

সংশয় নিয়েই বলি, এ ব্যাপারে অন্তত আমার সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন আলাপ-পঠন-অনুসন্ধানে এই সংশয় আরো জোরদার হয়েছে। জোর দিয়েই বলা যায়, বিভিন্ন মিসিং লিংক থাকলেও মুজিবের সঙ্গে তাজউদ্দীনের দূরত্ব দেখা দেয়ার বেশ কিছু ধারালো যুক্তিসংগত দিক আমাদের সামনে ঘোরাফেরা করছে। যদিও সুশীল বুদ্ধিজীবী-গবেষকগণ এগুলো দেখেও না দেখার ভান করছেন বলে মনে হয়। এরকম কিছু দিক সম্পর্কেই এ লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করছি, এগুলো সম্পর্কে সকলে মতামত দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ হতে ও সংশয় কাটিয়ে উঠে নতুন কোনো সংশয় ও প্রত্যাশার দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেন। ব্লগ বলেই আমি চেষ্টা করছি, সংক্ষেপে ধারণাগুলো তুলে ধরতে, যাতে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি : তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নয়, বরং একবার পিছে ফিরে দেখা যাক, পূর্ব বাংলাকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত করার স্থির লক্ষ্যে সত্যিই কারা সাংগঠনিকভাবে দীর্ঘ দিন ধৈর্য ধরে কাজ করে গেছেন। কেননা তাত্ত্বিকভাবে ঘরোয়া পরিবেশে সমমনাদের মধ্যে কিংবা পার্টিফোরামে কথা বলা, কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলা, হঠাৎ করে প্রকাশ্যে ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ বলা কিংবা ‘স্বাধীনতা চাই’ বলে ওঠা এক ব্যাপার, আর বছরের পর বছর ধরে নিরন্তরভাবে এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো আরেক ব্যাপার। এতে কোনো সংশয় নেই, অনেকেই স্বাধীনতার প্রত্যাশা করতেন; কিন্তু স্বাধীনতার লক্ষ্য স্থির করে ধৈর্য ধরে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়েছেন বোধকরি মাত্র তিনজন ব্যক্তি : শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুল আলম খান এবং সিরাজ শিকদার। এদের মধ্যে একপর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র সিরাজ শিকদারই দলগতভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে পার্টিপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান কোন ফোরামে কাদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করতেন, কোন কোন নেতা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা অস্পষ্ট। আমরা বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণে পাই, বঙ্গবন্ধু অমুককে অমুক দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি সে অনুযায়ী অমুকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কিংবা অমুক কাজ করেছেন। অর্থাৎ এ নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো সুনির্দিষ্ট বৃত্ত ছিল না। ন্যাপ কিংবা সিপিবি’র মতো রাজনৈতিক দলগুলো এখন তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস যেভাবেই লিখুক না কেন, ১৯৭০ সালের দিকেও তাদের দলীয় অবস্থান ছিল এই যে, ‘ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন’। দেবেন শিকদারের ‘বাইশ বছরের গোপন জীবন’ থেকে জানা যায়, কমিউনিস্ট পার্টিতে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একবার প্রস্তাব উঠলেও তা চার ভোটের ব্যবধানে বাতিল হয়ে যায়। যারা হেরে গিয়েছিলেন তারাও আর পরে এ নিয়ে কোনো তৎপরতা অব্যাহত রাখেন নি। এক কথায় কি মস্কোপন্থী কি পিকিংপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলেরই দেশকে স্বাধীন করার কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না, দলকে ও দলের কর্মীদের ওই লক্ষ্যে সংগঠিত করার প্রক্রিয়া ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেকেই যে এটি চাইতেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই; আমি শুধু বলতে চাই, এটি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

রাজনৈতিক-সাংগঠনিকভাবে এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল শুধু মাত্র ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের গড়ে তোলা নিউক্লিয়াসের। অর্থাৎ ১৯৭১-এর প্রায় ৯ বছর আগে থেকেই সচেতনভাবে পূর্ব বাংলায় একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়। যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতার সম্পর্ক না থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল। শেখ মুজিবের সম্পর্ক থাকায় তাজউদ্দীনসহ প্রধান সারির হাতে গোণা কয়েকজন নেতা এ সম্পর্কে জানতেন বলে ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু তাদের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা আমাদের চোখে পড়ে না। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন মূলত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিকাশমান নেতারা। এরা নির্বাচনের কাজের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তিমূলও তৈরি করে ফেলেন। ওই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায়, ১৯৬৮ নাগাদ এই নিউক্লিয়াস স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিল। প্রতি মহকুমায় ৪-৫জন সদস্য থাকত। ১৯৬৮-৭০ সালে এর সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার (আ স ম আবদুর রব, মুক্তিযুদ্ধে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ভূমিকা, কালের কণ্ঠ, ২৪ জানুয়ারি ২০১৩)।

নিউক্লিয়াস, যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা পরিষদ হয়ে ওঠে, ইংরেজিতে পরবর্তী সময়ে যা পরিচিতি পায় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ বা বিএলএফ নামে, ১৯৭০-এর নভেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহে এতে যুক্ত হন শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ। কিন্তু তার আগেই এটি সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের পর ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে ‘বিএলএফ-এ যোগ দিন’ শ্লোগানও লেখা হয়েছিল। যদিও তা তখন আলোচিত হয় নি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সঙ্গে যুক্ত আফতাব আহমাদ, আ ফ ম মাহবুবুল হক, রায়হান ফেরদৌস মধু, বদিউল আলম প্রমুখ এ ধরণের প্রচারকাজ চালানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বিএলএফ-এর তৎপরতা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই শুরু হয়। আফতাব আহমাদের মতে, (দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ এপ্রিল ২০০০), ছাত্রলীগের র্যাডিক্যাল ধারার সমাজতন্ত্রঅনুরাগী সদস্যরা ভিয়েতনামের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা থেকে সেখানকার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের আদলে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের চিন্তা করেন। ডা. মাহফুজুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু : ছাত্রলীগ-নিউক্লিয়াস’ (মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, ২০১৩) বই থেকে একটু আলাদাভাবে জানা যাচ্ছে, ‘সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এই চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াসের দুইজন ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপের দুইজন মোট চারজনকে নিয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই বাংলাদেশে বসে বিএলএফ গঠন করেন।

কাজেই ‘র’ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা যাবে না’ এরকম তত্ত্বের নিরিখে (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কিংবা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানরা যেমনটি মনে করেন) ‘বিএলএফ’ গড়ে তুলেছিল, এটির কোনো ভিত্তিই নেই। বিএলএফ-এর কাজ আগেই শুরু হয়েছিল।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিউক্লিয়াস বা বিএলএফ-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকলেও এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বিএলএফ-এর নির্বাচিত সদস্যদের দু’ দফায় ভারতে ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানোর উদ্যোগ নিলেও দলটির অন্যান্য নেতা, যেমন তাজউদ্দীন আহমদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক কেমন ছিল? তাজউদ্দীনও স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তিনি কি কেবল বঙ্গবন্ধুর দেয়া দায়িত্বভারই পালন করেছেন? বিএলএফ-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্যাটার্নটি কী ছিল? বিএলএফ সম্পর্কে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েও কি অন্ধকারে ছিলেন?

বলা বাহুল্য, যতদিন না আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এ ধরনের বিভিন্ন মিসিং লিংক অনুসন্ধানের দিকে নজর দেব, ততদিন অনেক কিছুই অমীমাংসিত থেকে যাবে।

মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ : মুজিব বনাম তাজউদ্দিন

অনেক আগে থেকেই বিশেষত মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। যেমন, চন্দ্রশেখর দাসগুপ্ত, যিনি ভারতের একজন পেশাদার কূটনীতিক, ১৭ ডিসেম্বর ২০১১-তে ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় লেখেন, মার্চের প্রথম দিকে ঢাকায় ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার কে. সি. সেন গুপ্তের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। তাজউদ্দীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামানকে ১৯৭৩ সালের ২৯ আগস্ট যে সাক্ষাৎকার দেন, তা থেকে জানা যাচ্ছে ৫-৬ মার্চে তাদের সঙ্গে ডেপুটি হাই কমিশনার অফিসে যোগাযোগ হয়। কন্যার অসুস্থতার কথা বলে ডেপুটি হাই কমিশনার এরপর কলকাতা যান এবং ৮ মার্চে ফিরে আসেন। লেখার অপেক্ষা রাখে না, সশস্ত্র সহায়তাসহ যাবতীয় সহযোগিতাসংক্রান্ত কারণেই এসব তৎপরতা চলেছিল। এদিকে, এ-ও জানা যাচ্ছে, ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে মুজিবের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী যোগাযোগ রাখতেন, মুজিবের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান ইন্দিরার দফতরে পৌঁছায় ১৯ মার্চ। নয়াদিল্লীর নেহেরু মেমোরিয়ার মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘হাকসার পেপারস’-এ যুক্ত ১৪ মার্চ ১৯৭১-এ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবতে লেখা ঢাকার ডেপুটি হাইকমিশনারের চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যাচ্ছে। যা শ্রীনাথ রাঘবন তাঁর গ্রন্থে ব্যবহার করে এই যোগাযোগের দাবি করেছেন। গ্যারি জে বাস ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইয়ে জানাচ্ছেন, ২ মার্চেই ইন্দিরা তার মুখ্য সচিব হাকসার এবং র প্রধান আর এন কাও-কে যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেন। এ সময় ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো শেখ মুজিবর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে এই ভারত-যোগাযোগের ব্যাপারে পারস্পারিক মতবিনিময় হলেও ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের নীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে কোনো সূক্ষ্ম কূটনৈতিক পার্থক্য ছিল কি ? আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, তাজউদ্দীন আহমদ কি আলাদাভাবেও স্বাধীনতার লক্ষ্যে নিজে থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছিলেন, যে-ব্যাপারে বিএলএফ (শেখ মুজিবসহ চারনেতা) অন্ধকারে ছিলেন? বলাই বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রে রাখার ব্যাপারে অতি-মনোযোগ দিতে গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধগবেষকরা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধানই করেন নি বলতে হবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এরকম ভাবনা আসছে কেন? কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে।

একটি কারণ : এরকম ঘটনার কথা আমি-আপনি সকলেই জেনেছি, ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন ৩২ নম্বরের বাসায় যান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে এবং তাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে একটি কাগজে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ কিংবা তাজউদ্দীনকন্যার গ্রন্থসহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থে এটিকে নানাভাবে দ্রষ্টব্য করে তোলা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাটাকে এত গুরুত্বারোপ দেয়ার কারণ কি? এর মানে কি এই, ঘটনার উল্লেখকারীরা বোঝাতে চান, তাজউদ্দীন নিজেই স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে শেখ মুজিবের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে সংশয়ী ছিলেন? তা যদি না হয়, তা হলে এটিকে এত গুরুত্বপূর্ণ করে দেখানোর মানে কি? কেননা, দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ তো আরো কিছু ঘটনার কথা জানতেন। যেমন, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ট্রান্সমিটারের সাহায্যে একটি বার্তা প্রচারিত হবে কিংবা অয়ারলেসে একটি বার্তা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকরা ভারতে চলে যাবেন এবং ভবানীপুর থেকে পরবর্তী কাজ শুরু করবেন। দলের যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাজউদ্দীন ছিলেন তাতে এইসব সিদ্ধান্ত তাঁর জানা না-থাকার প্রশ্নই আসে না। তাই বিচ্ছিন্নভাবে ২৫ মার্চের রাতের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব ও তাজউদ্দীন ওই ঘটনাটিকে দেখলে যত উত্তেজকই মনে হোক না কেন, তা নিশ্চয়ই মূল সিদ্ধান্তকে (ভারতে সুনির্দিষ্ট একটি স্থানে গিয়ে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে হবে) পাল্টে দেয়ার মতো ছিল না।

বিভিন্ন ভাষ্য থেকে পরিষ্কার, তাজউদ্দীনকে এবং বিএলএফ-এর চারনেতাকে (কাজী আরেফ আহমেদ-এর গ্রন্থের ভাষ্যানুযায়ী, শুধু তাজউদ্দীনকে নয়, আওয়ামী লীগের আরো ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং কামারুজ্জামানকেও) নির্দেশনা দেয়া হয়, আক্রান্ত হলে কোনখানে যেতে হবে এবং কী ভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। কাজী আরেফ আহমেদ (ইতিহাসের নির্মোহ গতিধারা, জনকণ্ঠ ১৯৯৫), তোফায়েল আহমেদসহ বিভিন্ন নেতার বয়ানে জানা যায়, ২৫ মার্চের আগেই ১৯৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে বলেন, ‘পড়ো, মুখস্থ কর। ঠিকানা ২১ রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। …আক্রান্ত হলে এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবে।’ মনে রাখতে হবে, সেটি ১ মার্চ নয়, ৭ মার্চ নয়, ২৫ মার্চ নয়—১৮ ফেব্রুয়ারি! এ থেকে এরকম কি ধারণা করা অমূলক হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব শারিরীকভাবে যে অনুপস্থিত থাকবেন, এরকম এক ধরণের ধারণাও তিনি দিয়ে রেখেছিলেন?

তাই প্রশ্ন আসে, প্রথম থেকেই কি শেখ মুজিবুর রহমানের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের দ্বিমত ছিল?

দ্বিতীয় কারণ, মঈদুল হাসান ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ৩ এপ্রিল রাতে ‘‘তাজউদ্দীন আহমদকে ১ সফদার জং রোডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌঁছান, মিসেস গান্ধী তখন বারান্দায় হাঁটছিলেন হন হন করে। তাঁকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম প্রশ্ন ছিল-‘শেখ মুজিব কোথায়?’ এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, ‘শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন কেন?’ তাজউদ্দীন আহমদ তবু তাঁকে বলেন, ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন; সরকার গঠন করেছেন; তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন।’ কিন্তু তাঁর এই কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি।’’

প্রশ্ন ওঠে, তাজউদ্দীন আহমদ কি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের নিশ্চিত করেছিলেন, ক্রান্তিকালে তিনি অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগেই তাকে নিয়ে ভারতে চলে যাবেন? কিন্তু সেটি সম্ভব না হওয়াতে এবং এই বোঝাপড়ার বিষয়টি শেখ মুজিবের কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ায় পরবর্তীকালে মুজিব-তাজউদ্দীনের সম্পর্কে কালো ছায়া পড়ে?

উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের সঙ্গে মুজিবের সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং আপদকালীন সময়ে ২১, রাজেন্দ্রপুর গিয়ে অবস্থান নেয়ার স্থান নির্বাচনে ভূমিকা পালনকারী ও বিএলএফ নেতাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দায়িত্ব পালনকারী প্রাক্তণ আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজগঞ্জের ডা. আবু হেনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারী অনেকেই জানেন, স্বাধীনতার পর আবু হেনা জানতে পারেন যে, মুজিবের গড়ে তোলা চ্যানেলে নয়, বরং আলাদাভাবে যুদ্ধের আগে থেকেই তাজউদ্দীনের সঙ্গে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কিন্তু এ ব্যাপারটি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের কেউই কোনো অনুসন্ধান করেননি। কারণ যে-কোনো কারণেই হোক না কেন, আমাদের প্রায় সকল গবেষকের মূল লক্ষ্যই থাকে মূলত বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টাকে ঘিরে। একই কারণে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের কর্মতৎপরতাও আলোর মুখ দেখে নি। জাসদ রাজনীতির বৃত্তের বাইরে একমাত্র বুদ্ধিজীবী ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমেদই বোধকরি একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি প্রসঙ্গক্রমে বিভিন্ন সময় সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। আর সিরাজ শিকদার তো পুরোপুরি অচ্ছুৎ! মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছি, তা অনুসরণ করলে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নেতাজী সুভাষ বোসকে এতদিনে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, যুদ্ধকালীন সময়ে অবশ্য ডা. আবু হেনা তাজউদ্দীন গঠিত সরকারের পাশে দাঁড়ান এবং বিএলএফ-এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীনের বিপর্যয় ঘটার অনেক আগেই আবু হেনার রাজনৈতিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।

ভারত সরকারের সঙ্গে তাজউদ্দীনের সম্পর্কের পুরো প্রতিচিত্র কি আমাদের কাছে কখনো উন্মোচিত হবে? তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনিই দলের প্রধান নেতা এবং ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, সরকার গঠন করেছেন, তারপর একটি বিভ্রাট ঘটায় তিনি গ্রেফতার হয়েছেন’ শুধুমাত্র এটুকু তথ্য দেয়াই কি ১৯৭১-এর এপ্রিলে জোরালো সম্পর্ক গড়ে ওঠার জন্যে যথেষ্ট ছিল?

‘বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার’ না ‘ বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার’?

গবেষকদের বিবরণ ও বিভিন্ন স্মৃতিচারণ থেকে যতদূর জানা যায়, ২৬ মার্চ বেতারে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শুনে তাজউদ্দীন চিন্তায় পড়ে যান। কেননা তাঁর মনে হয় যে, একক কমান্ডের আওতায় না থেকে বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতাকামী সকলে আলাদা আলাদা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে স্বাধীনতা অর্জন আরো দূরহ হয়ে পড়বে। এ কারণে ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি দ্রুত ভারতের উচ্চ পর্যায়ের সামনে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেন। বিএলএফ-এর কারো জন্যেই আর অপেক্ষা করেননি তাঁরা!

যে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভিত্তির ওপর তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গড়ে তুললেন, সংক্ষেপে তা এই যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চের রাত থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর গণহত্যাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ চালানো হচ্ছে, তাই জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা বাংলাদেশ সরকার গঠন করছে।
কিন্তু এর বিপরীতে স্পষ্টই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ছিল, বিএলএফ একটি কমান্ড কাউন্সিলের মাধ্যমে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আবদুর রাজ্জাকের ভাষায় এটি কমান্ড কাউন্সিল, শেখ ফজলুল হক মণির ভাষায় এটি বিপ্লবী সরকার, কিন্তু নাম যাই হোক না কেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, তাজউদ্দীনের গঠিত বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সঙ্গে এর তফাৎ যোজন যোজন।

কারণ, প্রথমত: এ ফলে এই তাত্ত্বিক ধারণাটি এলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো দীর্ঘ ধারাবাহিক ও অব্যাহত প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতির ফসল নয়, এটি নেহাৎই একটি আপতিক ঘটনা। ২৫ মার্চের রাত থেকে ভয়াবহ গণহত্যা, ধর্ষন, আক্রমণ, বাড়িঘরে আগুন, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি কারণে বাধ্য হয়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

দ্বিতীয়ত: অনুমান করি, খোদ শেখ মুজিবও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভূমিকা সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করতেন, দ্বিধান্বিত ছিলেন। যে কারণে তিনি এদের সংঘবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির গোপন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন নি। বাস্তবেও দেখা গেছে, অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় ছাত্রসংগঠকরা যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করছেন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করছেন, তখন এই সদস্যদের অনেকেই কোথাও কোথাও তার বিরোধিতা করেছেন। কেউ কেউ পরে দেশের মধ্যেই থেকে গেছেন এবং ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, কেউ আবার ভারতে চলে গেলেও কথায় কথায় হাপিত্যেস করেছেন, ছাত্রদের বাড়াবাড়ির জন্যেই এই ভয়ানক ম্যাসাকার ঘটেছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে একদিকে গ্রামে চলে যাওয়া নিবেদিত বামকর্মীদের শ্রেণিসংগঠন গড়ে তোলার তৎপরতায় অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীদের সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের তোপের মুখে আইয়ুবশাহীর পতন ঘটার পর থেকেই আওয়ামী লীগে বিডি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের যোগ দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তারা সমাজের ক্ষমতাকাঠামোয় নিজেদের অবস্থান সংহত করার প্রতিযোগিতায় নামে। এদের অনেকে সত্তরের নির্বাচনে আবারো সামনে চলে আসেন। শহীদুল্লাহ কায়সারের একটি কলামে এ সংক্রান্ত বিস্তৃত বিবরণ ছিল, যেটি হাতের কাছে না থাকায় আমি তুলে ধরতে পারছি না। এক কথায়, এদের সঙ্গে স্পষ্টতেই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এপ্রিল মাসে যে প্রক্রিয়ায় গঠিত হলো তাতে এই পুরানো নেতৃত্বই স্বাধীনতা যুদ্ধের ও দেশের মূল নীতিনির্ধারণকারী শক্তি হয়ে উঠল, বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট পেল।

তৃতীয়ত: সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার সরকারকাঠামো হওয়ার কারণে এতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে অংশগ্রহণকারী অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, শেখ মুজিব তো স্বাধীনতার পর দেশে ফিরেও ওই গণপরিষদকে বাতিল করেন নি কিংবা জাতীয় সরকার গঠনের পথে পা বাড়ান নি। এর উত্তরও খুবই সহজ, তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি অতীতের ওই ভ্রান্তিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন। তা ছাড়া তিনি যে খুব গভীরভাবে চিন্তা করেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিবেচনায় না নিয়ে সরকার গঠনের ও বিএলএফ-এর মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনা করতে বলেছিলেন, তেমনটি নাও হতে পারে। কিন্তু যদি একাত্তরে সরকার গঠন করতে গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের মুখ্য নির্ধারক না করে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেই মুখ্য করে তোলা হতো, তা হলে এই জনপ্রতিনিধিদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতার গর্ব না করে কঠিন পরীক্ষা দিয়ে নেতৃত্বে থাকতে হতো।

তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হওয়ার পর ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা থেকে দেশের ভেতর থেকে ছাত্র-যুব কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের চারনেতাকে। তবে কিছুদিন পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একক সিদ্ধান্তে তাদের ক্ষমতা সম্প্রসারিত করে তাদের রিক্রুটিংয়ের দায়িত্ব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও পরিচালনার অধিকার দেন। মাঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ থেকে জানা যাচ্ছে, তাজউদ্দীনের সম্মতি ছিল না এতে। তা ছাড়া পরে এ সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদের উপদেষ্টা আমিরুল ইসলামের মতে, বিএলএফ — যা পরে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হয়ে ওঠে — তা ছিল এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ‘বড় বিপর্যয়’! অথচ শেখ মুজিবের নির্দেশনার কথা যদি বলা হয়, সেটিই ছিল প্রকৃত নির্দেশনা। অনুমান করি, ভারতের সঙ্গে শেখ মুজিব তরফের যোগাযোগের প্রেক্ষিতে আসলে ভারতে বিএলএফ সদস্যদের প্রশিক্ষণেরই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের সরকার গঠনের ফলে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমাদের অনেক বোদ্ধা বলেন বটে, এটি ছিল ভারত সরকারের বিভক্ত করে রাখার নীতি; কিন্তু এমন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয় যে, খোদ ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সোভিয়েত ব্লক ও মার্কিন ব্লকের দ্বন্দ্বের ফলেই মুক্তিবাহিনী ও বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর পৃথক প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকে।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাজউদ্দীনকে ভয়াবহ টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে বিএলএফ নেতৃবৃন্দ যে তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, তা বলাই বাহুল্য। বার বার তাঁর ওপর অনাস্থা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীনের প্রথম শাপে বর, তিনি খোদ ডা. আবু হেনাকেই সরকারগঠনের সময় তাঁর পক্ষে নিয়ে আসেন, যিনি বিএলএফ নেতাদের জন্যে ২১, রাজেন্দ্র রোডের ঠিকানা নির্ধারণ করে এসেছিলেন এবং যার ভিত্তিতেই শেখ মুজিব তাজউদ্দীন ও চার নেতাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারিতে। তাজউদ্দীনের দ্বিতীয় শাপে বর, আদর্শিক কারণে ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যেকার দূরত্ব বাড়তে থাকে, ফলে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীতেও তার প্রভাব পড়ে এবং তাজউদ্দীন ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে একটি কম্যুনিকেশন প্যাসেজ গড়ে ওঠে — যা নিয়েও কাউকে কখনো মুখ খুলতে দেখা যায় না। লক্ষ্যণীয় ঘটনা, ১৯৭১-এর ১ সেপ্টেম্বরে জাতীয় পরিষদ সদস্য এনায়েত হোসেন খানের সভাপতিত্বে খন্দকার মোশতাক আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আব্দুল আজিজ প্রমুখের সমর্থকদের এক সভায় তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সম্পাদকদের পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। এই সভার ব্যাপারে সিরাজুল আলম খানের কোনো লক্ষ্যণীয় তৎপরতা ছিল না। অনুমান করা যায়, বিএলএফ-এর একটি পক্ষের তাজউদ্দীনের প্রাণনাশের চেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার পেছনে বিএলএফ-এর অভ্যন্তরীণ নতুন সমীকরণও কাজ করেছে।

অনেকেরই ধারণা, ভারত সরকারের সঙ্গে অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে তাজউদ্দীন বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে না পারলেও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন এবং বিরোধ কমতে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একদমই আলাদা। গবেষকরা চোখের ঠুলি খুলে কাজ করলেই দেখতে পাবেন, বিএলএফ-এর সদস্যদের ভারতীয় সামরিক প্রশিক্ষকরা তীব্র সমাজতন্ত্রবিদ্বেষী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। কিন্তু বিএলএফ-এর রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া বলতে গেলে সিরাজুল আলম খানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭০ সালেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে স্বপন কুমার দাশ ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করে। মাত্র ৮ জন সদস্য এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন (কাজী আরেফের বক্তব্য অনুযায়ী, এর মানে এই না যে তারা স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন)। প্রস্তাবটি গৃহীত হলেও শেষ মুহূর্তে আবদুর রাজ্জাকের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো এক বার্তার কারণে লিখিতভাবে আর সংযোজন করা হয় নি। যুদ্ধের শেষ দিকে স্বপন কুমার দাশকে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়। যার জন্যে বিএলএফ-এর মণি গ্রুপকে অভিযুক্ত করা হয়। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টার পরও বিএলএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বামপন্থী তরুণদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকলে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং ২০ নভেম্বর দেরাদুনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প অনেকটা আকস্মিকভাবেই বন্ধ করে দেয়া হয়।

এভাবে বিএলএফ-এ নতুন সমীকরণ এলেও এবং তাজউদ্দীন তার সুফল আংশিকভাবে পেলেও শেষ রক্ষা হয় নি। তাজউদ্দীন আহমদের গঠিত সরকারকাঠামো শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে নি।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রের মতদ্বৈধতা

সাধারণভাবেই স্বীকৃত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান মার্কিন লবির রাজনীতিক ছিলেন। অন্যদিকে, তাজউদ্দীন আহমদ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতি তাঁর বিশেষ মনযোগ, এমনকি সমর্থনও ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের একটি অন্যতম রাজনৈতিক বৈশিষ্ট ছিল, রাজনৈতিকভাবে তিনি বিবর্তিত হতেন অন্তর্লীন প্রক্রিয়ায়, যার প্রকাশে বিস্মিত হতে হতো, কিন্তু যার প্রকাশ এমন এক সময়ে ঘটত যখন প্রথাগত কায়দায় বিশ্লেষণকারীদের তা বিস্মিত ও সন্দেহপ্রবণ করে তুললেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তিনি ব্যাপক সাড়া পেতেন। সোহওয়ার্দীর মৃত্যু ঘটতে না ঘটতেই মুজিব ছয় দফা নিয়ে জনতার সামনে আসেন এবং তাঁর ও আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ঘটে। যদিও ছয় দফা পূর্ব বাংলায় তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সন্দেহের জন্ম দেয়। আজকে মতিয়া চৌধুরীরা ছয় দফার গুণগানে ব্যতিব্যস্ত, কিন্তু ১৯৭০ পর্যন্ত তাঁরা জনসভা করে বলে বেড়াতেন, ছয় দফা হলো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন, যারা পাকিস্তানকে ভাগ করতে চায়। আরো একটি কথা অনেকেই বিস্মৃত, ছয় দফাকে জনগণের সামনে সুন্দর করে তুলে ধরতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মমিন তালুকদার। আর সারা দেশে ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছয় দফাকে পরিকল্পিতভাবে প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মার্কিন লবির আওয়ামী নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ নানা বিতর্কের জন্ম দিতে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরাও মুক্তিকামীদের সহানুভূতি হারাতে শুরু করে। সোভিয়েত-ভারত ব্লক তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন সরকারকাঠামোর নিকটবর্তী হয়। এর সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণে। তিনি সেদিন ঘোষণা দেন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য পেতে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়। ১০ দিন পর আরো একটি ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে আসার আগেই ২৯ ডিসেম্বর খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ওই সময় বাংলাদেশে প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ডি পি ধর (২৩-২৯ ডিসেম্বর) সফর করছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের অনাগ্রহ এ দেশের জনগণের আবেগেরই প্রকাশ ঘটায়। সেদিক থেকে এটি দৃষ্টিকটূ নয়। একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহী না-ও হতে পারে, আনুষ্ঠানিকভাবে অনাগ্রহের প্রকাশও ঘটাতে পারে; কিন্তু ভারতে প্রথম সাক্ষাতে বিশ্বব্যাংকের প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারার পাশাপাশি তাজউদ্দীন আহমদ যেভাবে মুখ বন্ধ করে বসেছিলেন, তা ছিল বিস্ময়কর, অনভিপ্রেত, দৃষ্টিকটূ ও সর্বোপরী কূটনৈতিক আচরণবহির্ভূত। দ্বিতীয় সাক্ষাতেও তাজউদ্দীন আহমদ রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে নিস্পৃহ এবং বক্র আচরণ করেন। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হন, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪-এ তিনি অপসারিত হন। এরপর ৪৮ ঘন্টা যেতে না যেতেই বিশ্বব্যাংক প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে ২৭৫ মিলিয়ন ‘সাহায্য’ দেয়ার ঘোষণা দেয়। ৩০ অক্টোবর, ১৯৭৪-এ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায় ৩৩৭.৫১০ মিলিয়ন ডলার। এই সহায়তা ছিল আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৭ গুণ বেশি। বলতে গেলে এতে যত না ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, তারও বেশি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্লক ও সোভিয়েত ব্লকের ঠাণ্ডা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের অভিপ্রকাশ ঘটে। অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে, তাজউদ্দীন আহমদকে অপসারণের আগে বিভিন্ন দৈনিকে হঠাৎ করেই বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বড় বড় ছবি ছাপা হতে থাকে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্ত নিতে হয় ‘বৃহত্তর স্বার্থে’।

‘তাজউদ্দীন প্রশাসন’ ও জাসদের জন্ম

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশের প্রশাসনের দায়িত্ব নেয়ার জন্যে কেউই ছিলেন না। ভারতীয় জেনারেল বি এন সরকার এ দায়িত্ব নেন। যিনি ছিলেন একাত্তরের শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ-এর মিলিটারি সেক্রেটারি, পরে ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনে গঠিত সিভিল এফেয়ার্স অর্গানাইজেশনের বা সিএও-এর প্রধান। তাজউদ্দীন ফিরে না আগের টানা ছয়দিন তিনিই ছিলেন কার্যত বাংলাদেশ বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান। ঢাকায় বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় প্রশাসকরা আসতে থাকেন। এদের সঙ্গে দেশীয় আমলাদের দ্বন্দ্বের কথা আমরা কোনো কোনো আমলার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ থেকে পেতে শুরু করেছি।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, একটি ব্যাপার নিয়ে এখনো কোনো অনুসন্ধানভিত্তিক আলোচনা হয় নি। আর তা হলো ১০ জানুয়ারি পরযন্ত প্রায় একমাস ব্যাপী মুক্তিবাহিনীদের গড়ে তোলা প্রশাসনের কার্যক্রম। এই প্রশাসন কোথাও কোথাও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, কিন্তু এ-ও সত্য, এর ফলে ভারতের সিএও তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারে নি। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই প্রশাসনে কমান্ডার (বেসামরিক প্রশাসন) ও কমান্ডার (সামরিক) ছিলেন, বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্যে সহকারী কমান্ডারও ছিলেন। পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিলে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিল তা কাজে লাগানো যেতো। কিন্তু যুদ্ধ শেষ না হতেই অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ ছিল যে-কোনো মুক্তিযোদ্ধার আবেগের ওপর শক্ত আঘাত। ফলে প্রথমেই বিশৃঙ্ক্ষলার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের প্রতিটি দিন এই অস্ত্র তাদের সঙ্গী ছিল, সেই সঙ্গীকে আকস্মিকভাবে পরিত্যাগ করার মতো অবস্থা ছিল না তাদের। বিশেষত ভারতীয় সৈনিকরা যেখানে আশপাশেই ছিল।

সন্দেহ নেই, তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত ছিলেন; কিন্তু বিশ্বস্ততার বিনিময়ে তিনি চেয়েছেন মুজিবের মধ্যে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে। একই কারণে সিরাজুল আলম খানকেও কাজে লাগিয়েছেন তিনি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের দায় কখনোই স্বীকার বা বহন করেন নি। সে দিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আকাশের মতো উদার, শেখ মণিকে কাছে টেনে নিলেও সিরাজুল আলম খানের প্রতি তাঁর স্নেহ এতই প্রবল ছিল যে, রাজনৈতিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর জাসদের প্রতিটি নেতাকে ঝক্কি পোহাতে হলেও প্রতিটি স্তরেই তাঁর নির্দেশনা ছিল, খানকে যেন কখনো ঝামেলায় জড়ানো না হয়, গ্রেফতার বা হয়রানি করা না হয়। বলাই বাহুল্য, শেখ মুজিবের ক্ষেত্রে এটি বিরল ঘটনা নয়। যেমন, নির্মল সেনের স্মৃতিচারণা পড়লেও দেখা যায়, সম্পূর্ণ বিপরীত রাজনৈতিক অবস্থানে থাকলেও সেনের দল ও সহযোগীদের তিনি বেশ কয়েকবার রক্ষা করেছেন রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা থেকে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফেরেন, সিরাজুল আলম খান তখন ঢাকায় ছিলেন না। ৯ জানুয়ারি রাতে খুলনা থেকে ফেরার সময় গোয়ালন্দ ঘাটে প্রবল কুয়াশায় তার যাত্রায় বিঘ্ন করে। তিনি যখন ঢাকায় পৌঁছেন, ফজলুল হক মণি ততক্ষণে দাবার ছক পাল্টে ফেলেছেন নিজের মতো করে, সিরাজুল আলম খান উপস্থিত থাকলে যা সম্ভব ছিল না বলে অনেকেরই ধারণা। এরপরও সিরাজুল আলম খানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। বিএলএফ-এর অন্যতম সংগঠক, পরবর্তী সময়ে জাসদের নেতা মনিরুল ইসলামের বিবরণ থেকে (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র) থেকে জানা যাচ্ছে, স্বাধীন দেশে সিরাজুল আলম খানের লক্ষ্য ছিল, ‘তাজউদ্দীন প্রশাসন’ অক্ষুণ্ন থাকুক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানদের বোঝাপড়া হয় যে, বিভিন্ন দল ও মতের সমন্বয়ে বিপ্লবী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে, আওয়ামী লীগ এ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে, সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্রকে, তবে শেখ মুজিবুর রহমান সরকার কিংবা দল কোনোটিতেই থাকবেন না। তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন, তবে দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে পরামর্শ দিতে পারবেন। মনিরুল ইসলামের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু এ সময় দক্ষিণের দ্বীপ মনপুরাতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই বোঝাপড়া থেকেই ৩১ জানুয়ারি বিএলএফ-এর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পন করেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে যারা এখন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার বদলে বন্দনা শুরু করেছেন, তাদের কাছে গেলে মনে হয়, এসব নিছক কল্পনা। যদিও সিরাজুল আলম খান জাসদ গঠনের উদ্যোগ নিলে এরকম একটি সংবাদও ছড়িয়ে পড়ে, কোণঠাসা তাজউদ্দীন আহমদ জাসদে যোগ দিচ্ছেন। তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে জাসদের কমিটিতে একজনকে যুক্তও করেছিলেন। যদিও দক্ষতার সঙ্গে জাসদ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন। কেননা তাঁর সারা জীবনের লক্ষ্যই ছিল, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দিয়ে নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করা। তিনি শুধু অপেক্ষাই করে গেছেন। এটিই তাঁর জীবনের ট্র্যাজেডি, স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নেয়ার মতো সাহসী তিনি কখনো ছিলেন না, তিনি চাইতেন অপরের গড়ে তোলা কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে এবং সেই লক্ষ্যে ওই নকশায় নিজস্ব কিছু ছক যুক্ত করে নিতে। তাঁকে যখন পদত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হলো তখন পুরো আওয়ামী লীগে সিরাজুল আলম খানের মতো আর কেউই অবশিষ্ট ছিল না, যিনি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করবেন। জে এন দীক্ষিতের লেখা বই থেকে জানা যাচ্ছে, অপসারিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় দূতাবাসের স্থানীয় রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বার্তা পাঠান, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ‘গঠনমূলক কিছু করা’ হোক। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সে আহ্বানে সাড়া দেননি, ঠিক যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে নাক গলায় নি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হলো, তখন তাজউদ্দীন বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্তও নিতে পারলেন না, ‘সিরাজ কোথায়? সিরাজ যদি বলে কেবল তা হলেই আমি যাব’ বলে সিরাজুল আলম খানের বার্তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু সিরাজুল আলম খান তখন ভারতে, অনেক বেলা করে উঠে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। আসলে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু কেবল তাঁর নিজের মৃত্যু নয়, তাজউদ্দীন এবং সিরাজুল আলম খানেরও মৃত্যু ছিল।

জে এন দীক্ষিত জানাচ্ছেন, জেলহত্যার ব্যাপারেও তাঁদের কাছে নিশ্চিত পূর্বসংবাদ ছিল এবং তাঁরা ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের কাছে সে বার্তা পৌঁছেও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে আর আন্তর্জাতিক বিতর্কের মধ্যে জড়াতেই চায় নি। আমরা তাঁদের সবাইকেই হারিয়েছি, যাঁদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল।

জানি না, ‘তাজউদ্দীন প্রশাসন’ হলে দেশ সত্যিই এগিয়ে যেত কি না। কেননা প্রশাসনিক ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থোডক্স ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন ছিলেন। পাকিস্তানের রেখে যাওয়া অভিজ্ঞ আমলাদের দিয়েই কাজ চালাতে চাইতেন তিনি। অভিজ্ঞ আমলাদের অন্যান্য সরকারও সিদ্ধহস্তে কাজে লাগিয়েছেন, যেমন লেনিন কাজে লাগিয়েছিলেন লুনাচারস্কিকে। কিন্তু স্বাধীন দেশে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা থাকলে তিনি নিশ্চয়ই ভারতের সিএও (অনেকের বিবরণে কাও) কাঠামোর ব্যাপারে তিনি আগ্রহী হতেন না। এই আগ্রহের মধ্যে দিয়ে তিনি পুরানো অভিজ্ঞ আমলা এবং যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সামনে চলে আসা দেশপ্রেমিক আগ্রহী সংগঠক উভয় পক্ষকেই ক্ষুব্ধ করে তোলেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে ভারত সফরের সময় মুজিব সিএও কাঠামো প্রত্যাহারের ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি করান। এর মধ্যে দিয়ে হয়তো ভারতের নীতিনির্ধারকরাও তাজউদ্দীনের সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েন। বিএলএফ-এর আগ্রহের বিষয় ‘তাজউদ্দীন প্রশাসন’ অক্ষুণ্ণ থাকলে অবশ্য পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতো, তা বলা মুশকিল। কেননা তাঁর অর্থোডক্স ধারণা তাদের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতো, তা বলা কঠিন। এই অর্থোডক্স ধারণার বিপরীতেই ১৯৭২-এর অক্টোবর প্রথম ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ প্রশাসনের উচ্চতর পদে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে) নিয়োগ শুধুমাত্র ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। এবং এটি কেবল ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। অনেকেই এখনো এটির সমালোচনা করে থাকেন। কেননা স্নাতক ডিগ্রিধারী এবং ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হলেই যে-কেউ ‘মৌখিক পরীক্ষা’ দিয়ে এই নিয়োগ পাওয়ার শর্ত ছিল। ১৯৭৩ সালের জুনে আবারো একই ধরণের নিয়োগ উদ্যোগ নেয়া হলেও এতে মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধা উভয় কর্মসংস্থানপ্রার্থীদেরই নিয়োগ হয় এবং তা সংক্ষিপ্ত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে। এসব পদক্ষেপ এখনো সমালোচিত। প্রশাসনের খোলনলচে পাল্টে দেয়ার বুলি ছাড়লেও প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রশাসনে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্তে এখনো তারা ভীষণ সমালোচনামুখর।

আর যাই হোক না কেন, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের দূরত্বের কারণ যে সুশীলদের মায়াকান্নায় ইনানোবিনানো ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নয়, তা নিয়ে অন্তত আমার কোনো সংশয় নেই। কিন্তু কী সেই কারণ? এখানে তা বা সেগুলো খোঁজার সূত্রপাত করা হলো মাত্র। আশা করি, আপনারাও সেই অনুসন্ধানে শামিল হবেন।

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

১৭ comments

  1. অপালা বসাক - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (২:৪১ পূর্বাহ্ণ)

    খুবই তথ্যপূর্ণ লেখা, তবে বিশ্লেষণ নিয়ে অনেক কিছুই বলবার আছে। কিন্তু তার আগে লেখককে ধন্যবাদ জানানো দরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অব্যবহিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক গবেষণার জন্য। লেখক যদি এ সম্পর্কিত একটি গ্রন্থতালিকা এখানে সংযুক্ত করেন তাহলে ভালো হবে। আমার মৌলিক প্রশ্ন, লেখকের গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়, কারণ তাজুদ্দিন আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যেকার সম্পর্ক বিশ্লেষণে কেবলমাত্র ভুল বোঝাবুঝিই শেষ সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এই ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার হলে মুক্তিযুদ্ধের আগেই হতো, তারা দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া তাজুদ্দিন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে প্রতিদিন দুপুরবেলা গণভবনে লাঞ্চ করতেন এবং দীর্ঘ আলোচনা করতেন বলে চাঁদপুরের/পটুয়াখালীর মহিউদ্দিন যিনি বঙ্গবন্ধুর ড্রাইভার ছিলেন তার কোনো একটি সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে। গোপনে তিনি তাজুদ্দিনকে নিয়ে আসতেন ধানমণ্ডির বাসা থেকে। আরো বড় কথা হলো, বাকশাল গঠনের সকল দায়-দায়িত্ব অন্তরালে থেকে তাজুদ্দিনকে দিয়ে করিয়েছেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। বিশেষ করে সোভিয়েত নেতা আন্দ্রে কোসিগিনের সঙ্গে তাজুদ্দিন নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, কমরেড মণি সিং বাকশাল গঠনের আগে অন্ততঃপক্ষে ১০/১২ বার ঢাকা-মস্কো যাতায়াত করেছেন। বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় থাকলাম। আরেকটা কথা, যশোর বিমানবন্দরে তাজুদ্দিনের দেয়া কোনা বক্তব্য/মন্তব্য/সাক্ষাতকার সম্পর্কে লেখকের জানা থাকলে এখানে উল্লেখ করবেন আশা করি।
    আবারও অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে এই বিতর্ক উত্থাপনের জন্য।

    • অবিশ্রুত - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (৪:৪৮ অপরাহ্ণ)

      তাজউদ্দীনের পদত্যাগের পর বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক ছিল। তবে যতদূর জানা যাচ্ছে, তাজউদ্দীন তখন আতঙ্কে দিন কাটাতেন। তিনি একদমই পক্ষে ছিলেন না বাকশাল গঠনের। তাই বাকশাল গঠনের কাজকর্ম করেছেন বলে মনে হয় না, কোনো গ্রন্থেও পড়িনি। শেখ মণি সেসময় মস্কো যাতায়াত করেছেন, সেটা বিভিন্ন বইয়ে আছে। বাকশালের কমিটিতে সিপিবি’র কয়জন ছিলেন, সেটা বলতে পারছি না। বাকশাল গঠনে তারা কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন, সেটি সম্ভবত তা থেকে খানিকটা অনুমান করা যাবে। না, চাঁদপুর বিমানবন্দরে দেয়া তাজউদ্দীনের বক্তব্য সম্পর্কে এই মুহূর্তে কিছু জানাতে পারছি না। সিমিন হোসেন রিমির সম্পাদনায় তাঁর দেয়া বক্তব্যের একটি সংকলন বের হয়েছে, সেখানে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। ধন্যবাদ আপনাকেও।

      • R.M. Farhad - ৩ নভেম্বর ২০১৬ (১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ)

        Yes, what I know Tazuddin Ahmed were involved to form BAKSAL but at the end. Banghabandhu sent the final copy to Tazuddin Ahmed to check the list and He saw (Tazuddin Ahmed)He was not enlisted in the BAKSAL committee with some other important leader. At that time He phoned one of the AL leader Mr Momtaz Ahmed Ex MLA, MCA, MPA and political advisor Sector 8 & 9 Satkhira and told him, you are not enlisted in the committee including me but don`t worry I will placed you with a honorable position. This phone help to understand Tazuddin Ahmed were involved in the process of BAKSAL system.

  2. মোহাম্মদ মুনিম - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (২:৫৭ পূর্বাহ্ণ)

    “১২ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হন, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭২-এ তিনি অপসারিত হন।” এই তথ্যটি কি সঠিক? যদ্দুর জানি তাজউদ্দিন আহমেদ ১৯৭৪ সালের শেষে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন।

    • মাসুদ করিম - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (১০:২১ পূর্বাহ্ণ)

      ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে অর্থমন্ত্রী হন, ২৬ অক্টোবর, ১৯৭২-এ তিনি অপসারিত হন। এরপর ৪৮ ঘন্টা যেতে না যেতেই বিশ্বব্যাংক প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে ২৭৫ মিলিয়ন ‘সাহায্য’ দেয়ার ঘোষণা দেয়। ২৯ অক্টোবর, ১৯৭২-এ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন।

      @অবিশ্রুত – হ্যাঁ, এখানে টাইপের ভুল আছে, আপনি যাচাই করে সংশোধন করুন।

      তাজউদ্দীন আহমদ ‘পদত্যাগ’ করেন ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪। বিশ্বব্যাংকের ২৭৫ মিলিয়ন সাহায্যের ঘোষণা আসে ২৮ অক্টোবর ১৯৭৪। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে আসেন ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪

      আরেকটা তথ্যও এখানে দিয়ে রাখা ভাল জাসদ-এর জন্ম হয় ২৩ অক্টোবর ১৯৭২।

  3. মাসুদ করিম - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ)

    ১২ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব তার প্রথম মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেন, সব সময় শুনে এসেছি পূর্ববর্তী তাজউদ্দিন আহমেদের মন্ত্রিসভায় তিনি ব্যাপক রদবদল করেছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই এটাই স্বাভাবিক – রদবদলগুলো কী ছিল, তার কোনো তালিকা পাওয়া সম্ভব?

    • অবিশ্রুত - ৪ নভেম্বর ২০১৫ (৪:৩৬ অপরাহ্ণ)

      হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে টাইপের ভুল। হেনরী কিসিঞ্জারও বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৪ সালে। দুঃখিত বললে কমই বলা হয়। তবে জাসদের জন্ম ২৩ নয়, ৩০ কিংবা ৩১ অক্টোবর ১৯৭২-এ।

    • অবিশ্রুত - ১০ নভেম্বর ২০১৫ (১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ)

      বঙ্গবন্ধু কী ভাবে রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং মন্ত্রিপরিষদে কী কী পরিবর্তন এলো সে সম্পর্কে ড. কামালের বক্তব্য :

      পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্লেনে লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। প্লেনে করে আসার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছেন, ‘দেখো, আমি দলের প্রধান হিসেবে থাকি, তাজউদ্দীন সরকারি কাজগুলো করতে থাকুক।’ আমি বললাম, আপনি জাতির পিতা। সবকিছু মিলে আপনার যে অসাধারণ অবস্থান, তাতে আপনি সরকারে না থাকলেও সব ফাইল আপনার কাছে চলে যাবে। এটা পাকিস্তানেও হয়েছিল, জিন্নাহ সাহেবের কাছে সব ফাইল চলে যেত। ফলে ওখানে সংসদীয় ধরনের উন্নয়ন হয়নি। দ্বিতীয় একটি বিষয় তিনি আমাকে প্লেনে জিজ্ঞেস করেছেন, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার, না প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার হবে? আমি বললাম, ছয় দফার মধ্যে তো আমরা সংসদীয় পদ্ধতির কথাই বলেছি। আর সেটা বাদেও আপনি তো এখন রাষ্ট্রপতি। আপনি তো নামবেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সুতরাং আপনিই বিবেচনা করুন। আরো বললাম, আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে সবাইকে নিয়ে একটা সংসদীয় পদ্ধতির উন্নয়ন করতে পারবেন, আর আপনি রাষ্ট্রপতি থাকলে তা আর গড়ে উঠবে না। কেননা সবকিছু চলে যাবে আপনার কাছে। তখন তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। বললেন, তুমি যা বলছ, তা বিবেচনা করা দরকার।

      মজার বিষয় হলো, ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকলেন। মিটিং হচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হেয়ার রোডে। আমি গেলাম। সঙ্গে আবু সাঈদ চৌধুরী এবং আমিরুল ইসলামও এলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তো এখন রাষ্ট্রপতি। কালকে থেকে প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে কী করা লাগবে। আমরা তিনজনে একটা খসড়া করলাম। এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা থাকবে না, সাংবিধানিক কাঠামোয় একটি লাইন বসিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। গেজেট প্রকাশ করে আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতেই চলে আসবে। তাজউদ্দীন সাহেবকে বললেন, আপনি অর্থমন্ত্রী হন। আবু সাইদ চৌধুরী সাহেবকে বললেন, আপনি রাষ্ট্রপতি হন। নজরুল ইসলাম সাহেব হবেন শিল্পমন্ত্রী। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, তিনি আমাকে আইনমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করলেন। গেজেট প্রকাশ করে ১২ তারিখ বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীন সাহেব হয়ে গেলেন অর্থমন্ত্রী এবং আমি আইনমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার পাশের রুমটা অর্থমন্ত্রীর করে দিলে সব ফাইল ওখানে যেতে পারে। এত ফাইল দেখার সময় কোথায় থাকবে, আমি দল গোছাব এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে আমাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হবে। বিদেশ থেকে যারা আসবে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, দেখা করতে হবে। তাজউদ্দীন আমার পাশের রুমে বসলে অর্থমন্ত্রীর কাজ তো করবেই; পাশাপাশি আমার ফাইলগুলোও দেখবে।’

      মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তা হলে তিনিই ছিলেন সূত্রধর? আর ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামও তাতে হাওয়া দিয়েছেন? তা হলে এখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি মনে হয় কেন? আর মোশতাক কিংবা মণি তাঁর মাথা খেয়েছে বলে এত আহাজারিই বা কেন?

      কিসিঞ্জার আসার আগে আরো একটি পরিবর্তন আসে মন্ত্রিপরিষদে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন ড. কামাল, বিদায় নেন সামাদ আজাদ। আপাতদৃষ্টিতে মার্কিন লবির জয় হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই বাকশাল গঠনের প্রক্রিয়া থেকে মনে হয়, সেটি ছিল আমেরিকা-দেখানো সিদ্ধান্ত।

    • অবিশ্রুত - ১১ নভেম্বর ২০১৫ (৯:০১ অপরাহ্ণ)

      ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম মন্ত্রিপরিষদের দফতর বন্টন করা হয়। এতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন :
      তাজউদ্দীন আহমদ : প্রধানমন্ত্রী। অন্তর্ভুক্ত মন্ত্রণালয় : ক্যাবিনেট ডিভিশন, প্রতিরক্ষা, এস্টাবলিশমেন্ট, তথ্য ও বেতার, পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক বিষয়।
      আবদুস সামাদ আজাদ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। (আমার কয়েকদিন আগেও জানা ছিল না যে, ১৯৭০ সালেও তাঁর নামের সঙ্গে আজাদ শব্দটি যুক্ত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় এপ্রিল মাসে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে পাঠান ‘আজাদ’ ছদ্দনামে। এরপর থেকে তিনি আবদুস সামাদ আজাদ হয়ে ওঠেন)।
      খোন্দকার মোশতাক আহমদ : আইন ও সংসদীয় বিষয়, রাজস্ব।
      এ এইচ এম কামরুজ্জামান : স্বরাষ্ট্র ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন।
      মনসুর আলী : অর্থ, শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ, ব্যবসা ও বাণিজ্য।
      জহুর আহমদ চৌধুরী : স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা।
      ফণীভূষণ মজুমদার : খাদ্য, কৃষি, স্থানীয় প্রশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়।
      শেখ আবদুল আজিজ : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।
      ইউসুফ আলী : শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পূর্ত গৃহনির্মাণ, বিদ্যুৎ ও সেচ মন্ত্রণালয়।

      ১১ জানুয়ারি, ১৯৭১-এ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সাময়িক সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করেন, যাতে বলা হয় দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করবেন এবং মন্ত্রিসভার হাতে ক্ষমতা থাকবে, রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। আর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নতুন মন্ত্রিপরিষদে তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভার সকল সদস্যই থাকেন। তবে নতুন মন্ত্রি হিসেবে যুক্ত হন আরো দুজন। এরা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামাল হোসেন।
      ১৩ জানুয়ারি এই মন্ত্রিপরিষদের দফতর বন্টন করা হয়।
      শেখ মুজিবুর রহমান : প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও বেতার, ক্যাবিনেট অ্যাফেয়ার্স (ক্যাবিনেট ডিভিশন ও এস্টাবলিশমেন্ট)
      তাজউদ্দীন আহমদ : অর্থ, পরিকল্পনা, রাজস্ব।
      আবদুস সামাদ : পররাষ্ট্র।
      সৈয়দ নজরুল ইসলাম : শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্য।
      মোহাম্মদ মনসুর আলী : যোগাযোগ।
      খোন্দকার মোশতাক আহমদ : বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
      এ এইচ এম কামরুজ্জামান : ত্রাণ ও পুনর্বাসন।
      শেখ আবদুল আজিজ : কৃষি, স্থানীয় প্রশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়।
      ইউসুফ আলী : শিক্ষা ও সংস্কৃতি।
      জহুর আহমদ চৌধুরী : শ্রম, স্বাস্থ্য (সমাজকল্যান ও পরিবার পরিকল্পনাসহ)।
      ফণীভূষণ মজুমদার : খাদ্য ও অসামরিক সরবরাহ।
      কামাল হোসেন : আইন, সংসদীয় বিষয় ও সংবিধান প্রণয়ন, পূর্ত ও গৃহনির্মাণ।

      ১৯ জানুয়ারি আরো তিনজন নতুন মন্ত্রী যুক্ত হন। এরা হলেন :
      মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী : ব্যবসা ও বাণিজ্য।
      শামসুল হক : স্থানীয় প্রশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়।
      মতিউর রহমান : পূর্ত ও গৃহনির্মাণ।

      ১২ এপ্রিল, ১৯৭২-এ মন্ত্রিপরিষদ আবারো সম্প্রসারিত হয়। যুক্ত হন ৮ জন নতুন মন্ত্রী। ১৩ এপ্রিল তাঁদের দফতর বন্টন করা হয় এভাবে :
      মিজানুর রহমান চৌধুরী : তথ্য ও বেতার।
      আবদুল মান্নান : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
      আবদুল মালেক উকিল : স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা।
      সোহরাব হোসেন : মৎস্য, বন ও গবাদী পশু।
      মোল্লা জালালুদ্দিন : ডাক, তার ও টেলিফোন।
      এম এ জি ওসমানী : জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল ও বিমান।
      মফিজ চৌধুরী (ডাক্তার) : বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ, বিজ্ঞান ও কারিগরি গবেষণা।
      আবদুর রব সেরনিয়াবাত : ভূমি সংস্কার ও রাজস্ব।

      এই মন্ত্রিপরিষদ থেকে তাজউদ্দীন পদত্যাগ করার আগে আরো একজনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি মিজানুর রহমান চৌধুরী। ১৭ মে, ১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধু তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৩-এ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন আবু সাঈদ চৌধুরী।
      এরপরও বিভিন্ন মন্ত্রী যুক্ত বা বিযুক্ত হন।

      ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ বাকশাল অনুমোদনের পর ২৬ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার নাম ঘোষণা করা হয়। ১৭ জন মন্ত্রী ও ৯ জন প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পূর্বের সব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীই থাকেন। নতুন দফতরে বা নতুন করে যুক্ত হন :
      শেখ মুজিবুর রহমান : রাষ্ট্রপতির দফতর, ক্যাবিনেট ডিভিশন, প্রাতিষ্ঠানিক ডিভিশন, প্রতিরক্ষা।
      মোহাম্মদ মনসুর আলী : প্রধানমন্ত্রী (স্বরাষ্ট্র, যোগাযোগ, ডাক-তার-টেলিফোন, জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ জলযান চলাচল, বিমান চলাচল)।
      সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপ-রাষ্ট্রপতি) : পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা কমিশন।
      এ এইচ এম কামরুজ্জামান : শিল্প।
      মোহাম্মদুল্লাহ (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) : ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার।
      আসাদুজ্জামান : পাট।
      মোহাম্মদ কোরবান আলী : তথ্য ও বেতার।
      আজিজুর রহমান মল্লিক : অর্থ।
      মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (ড.) : শিল্প, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা এবং আণবিক শক্তি।
      কামাল হোসেন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নাম ঘোষিত হলেও তিনি তখন দেশে ছিলেন না। ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭৪ তিনি বিভিন্ন দেশ সফরে বের হন। পরে ফিরে না এসে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফেলো হিসেবে কাজ শুরু করেন। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফিরে এসে এই ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’ যুক্ত হন। ৮ আগস্ট, ১৯৭৫ মন্ত্রিসভায় যুক্ত হন আবু সাঈদ চৌধুরী।

  4. মাসুদ করিম - ৬ নভেম্বর ২০১৫ (১০:১৬ পূর্বাহ্ণ)

    সেপ্টেম্বর ১৯৭৪এর ২য় সপ্তাহ থেকে অক্টোবর ১৯৭৪এর ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত একটা বড় সময় বিদেশ সফরে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, এবং সেটা ব্যক্তিগত সফর ছিল না, অর্থমন্ত্রীর সফরই ছিল। এসময়টা কোন কোন দেশ সফর করেছিলেন তিনি? এই সফর থেকে ফেরার ১২/১৩ দিনের মাথায় ‘পদত্যাগ’, এব্যাপারটাও অনুসন্ধান করা দরকার।

    • অবিশ্রুত - ১১ নভেম্বর ২০১৫ (৯:২৬ অপরাহ্ণ)

      ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪-এ অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বুলগেরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লোভাকিয়া, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একমাসব্যাপী ভ্রমণের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দিল্লী হয়ে প্রথমে সোফিয়ায় যান তিনি। যাত্রার আগে বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের আভাস দেন, চলতি সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য দানকারী কনসর্টিয়াম গঠিত হতে পারে। এক নাগাড়ে একমাস সাত দিন বিদেশে অবস্থান করে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে তিনি ১৩ অক্টোবর জানান, আগামী ২৪ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য কনসর্টিয়ামের বৈঠকে ১৮টি দেশ অংশ নেবে। তিনি জানান, মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবী, কুয়েত, ইরান অংশগ্রহণ করার কথা জানালেও সৌদী আরব এখনো কিছু জানায়নি। তবে তারা যোগ দেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি আরো জানান, পাকিস্তানি আমলে গৃহীত বৈদেশিক ঋণের যে অংশ বাংলাদেশে দৃশ্যত কোনো পরিকল্পনায় ব্যয় হয়েছে সে অংশ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। অর্থাৎ এ নিয়ে হয়তো পাকিস্তানি ও মার্কিন লবির চাপ ছিল এবং উন্নয়নসাহায্যের প্রত্যাশায় তিনি বাধ্য হন আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে। একই সঙ্গে তিনি দেশের দুর্ভিক্ষাবস্থা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বিমানবন্দরেই। অনেকের মতে, যা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিমানবন্দরেই তিনি বলেন (তাজউদ্দীন আহমদ : ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃষ্ঠা ৪৭৫), `মানুষ না খেয়ে মরছে-এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে।…মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ-বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার জন্যই বা রাজনীতি। মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাটাই করা দরকার। এমনকি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত।’
      একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আমারও জানা ছিল না, ১৭ জুলাই ১৯৭৪-এ শেখ ফজলুল হক মণি আওয়ামী লীগ, যুব লীগ, শ্রমিক লীগ ও অন্যান্য কয়েকটি সংস্থা থেকে পদত্যাগ করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পদত্যাগপত্রসংহ বিজ্ঞপ্তি পাঠান। পরে এটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে দু’একটি সংবাদপত্র তা প্রকাশ করে পরে দুঃখপ্রকাশ করে। ১৯ জুলাইয়ের গণকণ্ঠে এবং ২১ জুলাইয়ের হলিডে-তে এই পদত্যাগপত্র প্রকাশ করা হয়।

  5. ফিরোজ আহমেদ - ৭ নভেম্বর ২০১৫ (১:৫৮ অপরাহ্ণ)

    দারুণ লেখা। অনেক ধন্যবাদ। সামান্য কিছু বিষয়ে সংশয় ও মতদ্বৈধতা থাকলেও পুরো লেখাটি খুবই কাজের।
    একটা ছোট অনুরোধ। ধরে ধরে সবগুলো তথ্যের জন্য তথ্যসূত্রের ব্যবস্থা করলে লেখাটার শক্তি বহুগুন বাড়বে। খুবই খাটুনির কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন লেখা টীকা, তথ্যসূত্র ও পাদটীকা দাবি করে।

    • অবিশ্রুত - ১১ নভেম্বর ২০১৫ (৯:৩১ অপরাহ্ণ)

      না, তেমন কোনো খাটুনি হবে বলে মনে হয় না। ২/১টি তথ্য আছে যা ব্যক্তিগত কথন থেকে জানা। কিন্তু সেগুলোও হয়তো কোনো না কোনো গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে। তবে ব্লগের পাঠকদের কাছে পাদটিকা হয়তো একটু বিরক্তিকরই হয়ে উঠবে। আপনার অনুসন্ধানের জায়গাগুলো জানলে যুক্ত করতে সুবিধা হবে। ধন্যবাদ।

  6. মাসুদ করিম - ৮ নভেম্বর ২০১৫ (৬:৫৩ অপরাহ্ণ)

    ড. মো. আনোয়ার হোসেন-এর ০৮ নভেম্বর ২০১৫ এর বিডিনিউজ২৪.কম এর মতামত-বিশ্লেষণ থেকে

    স্বাধীনতার রাজনৈতিক ভাবনা, প্রস্তুতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়াই পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনীর যে সব সদস্য বাস্তব অবস্থার কারণে অথবা অধস্তনদের চাপে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের উপর রাজনৈতিক নেতৃত্বের (তাজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের) কর্তৃত্ব না থাকায় সেনাবাহিনীর বিভেদের বীজটি রোপিত হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই।

    এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সর্বনাশটি করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে জিয়া, খালেদ ও শফিউল্লাহ– এই তিন সেনানায়কের নামে তিনটি ব্রিগেড গড়ে তুলতে দিয়ে ভবিষ্যতে ক্ষমতার রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের বীজ রোপনে তিনিই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী তাজউদ্দিন সরকারও দায়ভাগ এড়াতে পারেন না। ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল আবু তাহের রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী গঠন প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক হলেও, জেনারেল ওসমানী এবং বঙ্গবন্ধুর সহায়তা না পাওয়ার ফলে সেনাবাহিনী ছেড়ে সমাজ বিপ্লবের রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

    রাষ্ট্রগঠন প্রশ্নে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বকার ২৫ দিন সময়ে তাজউদ্দিন আহমদের অস্থায়ী সরকার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ভুলে ভরা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভ বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পাকিস্তানের সঙ্গে শেষদিন পর্যন্ত সহযোগিতা করেছে এমনসব ব্যক্তিদের নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে গোড়াতেই এক অর্থে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।

    স্বাধীনতার পর সামাজিক বিপ্লবের ডাক দিয়ে জাসদের উত্থানের প্রেক্ষাপট বর্তমান থাকলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মাত্র দশ মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে নেমে পড়া জাসদের নীতিপ্রণেতা বিশেষ করে মুখ্য তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে।

    এ কথা সত্য যে, মূলত একটি দক্ষিণপন্থী দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে থেকেই আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদরা সেই ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নিউক্লিয়াস গড়ে তুলে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। দলে নিউক্লিয়াসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দক্ষিণপন্থী ধারা বর্তমান থাকলেও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও দিকনির্দেশনাও লাভ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাওয়া শক্তি।

    তাই যেখানে বঙ্গবন্ধু তাদের উপর ভরসা করে, তাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার প্রয়োজনে বন্দিত্ব বরণ করলেন এবং সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের বিরল ও অতিপ্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত রইলেন, সময়ের কাজ সময়ে করতে অপারগ হলেন, কঠিন সময়ে তাঁর কাছ থেকে এত দ্রুত সরে আসা যথার্থ হয়েছিল কিনা তাও গভীরভাবে পর্যালোচনা প্রয়োজন।

  7. CHOWDHURY FARHAD - ৬ জানুয়ারি ২০১৯ (৬:২৬ অপরাহ্ণ)

    স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের ভূমিকা ইচ্ছাকৃত ভাবে খাটো করে দেখাচ্ছেন ! ১৯৫৮ সালে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন চেয়ে গণপরিষদে ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন ৷ সেদিন বঙ্গবন্ধু ছাড়া আওয়ামীলীগের সবাই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন ৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এই প্রস্তাব পাশ হয়েছিল ৷ মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার মূল ভূমিকা ছিল তাজউদ্দিন আহমদ ৷ কেন করেছিল তা মাইদুল হাসানের মূলধারা ৭১ বইয়ে উল্লেখ আছে ৷

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.