চিন্তাঝড় ২ : পিলখানা হত্যাযজ্ঞ — কারা, কেন, কীভাবে?

ঘটনার প্রথম প্রহরেই আমরা দ্রুত কিছু বিষয়ে অগ্রিম ইঙ্গিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম (এখানে)। এবার এ বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য এবং কিছু আনুমানিক বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে দ্রুত লিখছি [...]

[পোস্টের শিরোনাম ঈষৎ বদলে নেয়া হল]
ঘটনার প্রথম প্রহরেই আমরা দ্রুত কিছু বিষয়ে অগ্রিম ইঙ্গিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম (এখানে)। এবার এ বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য এবং কিছু আনুমানিক বিশ্লেষণকে ভিত্তি করে দ্রুত লিখছি:

১. সাম্প্রতিক সময়ে এমন কী ঘটেছে যা এ ধরণের সশস্ত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে?

সাম্প্রতিক সময়ের দুটো ঘটনায় এর কিছু উত্তর মিলতে পারে।

(ক) উপমহাদেশে আন্তঃদেশীয় জঙ্গিবাদের উত্থান ইস্যুকে সামনে রেখে সার্ক টাস্ক ফোর্সের উদ্যোগ এবং তাতে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার এবং সক্রিয় উদ্যোগ। এ নিয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে কিছু আলাপ-আলোচনার খবর ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বদল করার মাধ্যমে উদ্যোগটিকে অচল করা এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে।

(খ) আওয়ামী লীগ সরকার জাতির বহুদিনকার দাবি ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটি ছিল তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। কেবল প্রতিশ্রুতিতেই তা থেমে থাকেনি। ইতোমধ্যে সংসদে এ সংক্রান্ত পদক্ষেপকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব পাশ হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও তা নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়েছে সরকারের উদ্যোগে। সুতরাং এটা এখন স্পষ্ট যে, সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই সব উদ্যোগে দেশের ভেতরের একটি শ্রেণীর শঙ্কিত বোধ করার কথা। তাদের পক্ষে পুরো উদ্যোগকে বিপথগামী বা (চরম জাতীয় সংকট তৈরির মাধ্যমে) নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করা অসম্ভব নয়। যুদ্ধাপরাধী শুধু দেশের ভেতরেই নেই, দেশের বাইরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন কর্মকর্তার মধ্যেও রয়েছে। সুতরাং এ ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি মদদ থাকাও বিচিত্র নয়।

২. কী অর্জন করতে চেয়েছিল সশস্ত্র আক্রমণকারীরা?

এতে এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে, এমন মাপের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সরকারকে পুরোপুরি অস্থিতিশীল করে দেয়া এবং দেশের মধ্যে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করা। এর ব্যাপ্তির সাথে কেবল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যা কিংবা ১৯৭৫-এর ঘটনাবলিরই তুলনা করা যায়। কিন্তু কেন? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছে দাবি আদায়, কিন্তু এখন আমরা নিঃসন্দেহ যে সেটি ছিল cover বা front, যা নীড়সন্ধানীর মন্তব্যেও উঠে এসেছে। এর উত্তর খুঁজতে হবে হত্যাকাণ্ড এবং অরাজকতার সংখ্যার মধ্যে নয়। খুঁজতে হবে হত্যাকাণ্ডের ও অরাজকতার ধরণ এবং ঘটনাপ্রবাহের চরিত্রের মধ্যে।

৩. হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ এবং অরাজকতার বিশেষ ধরণ

কয়েক ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ঘটনার সময়ে। নিরস্ত্র অফিসারদের ঢালাওভাবে হত্যা, পরিবারের বেসামরিক অনেক সদস্যকে নির্যাতন ও ধর্ষণ, লুটপাট, মৃতদেহের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন ও বিকৃতকরণ। এগুলোর মধ্যে দুটো ধারা রয়েছে। একটি হলো পূর্বপরিকল্পিত, আরেকটি হঠাৎ সুযোগের বশে সংঘটিত। প্রথমটির ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করেছি হত্যাকারীরা যেন অত্যন্ত পরিকল্পতিভাবে পৈশাচিক নৃশংসতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছে। মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে অল্প অল্প করে নালায় ভাসানো, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃতদেহ থেকে চোখ ও অন্যান্য অঙ্গ উপড়ে ফেলা, পরিবারের নারী ও শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণের সাথে সাথে (এমনকী গর্ভবতী নারীরও) হাত-পা ভেঙে পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়া ইত্যাদি। এর সাথে পুঞ্জীভুত বিদ্বেষ বা স্যাডিজম-এর কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। যতদূর বুঝি, এর সাথে psychological warfare-এর মিল রয়েছে, যেখানে হত্যা বা নির্যাতনটাই প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এখানে প্রধান উদ্দেশ্যই হলো নৃশংসতার মাধ্যমে মানুষের (এ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর এবং তাদের সহকর্মী, পরিবার, বন্ধুদের) মানবতাবোধ এবং আবেগকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়া এবং নিয়ন্ত্রণের অতীত উস্কানি সৃষ্টি করা। এ ধরণের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির কৌশলের সাথে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ধরণের মিল রয়েছে।

৪. কারা দায়ী?

ঘটনার ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি দেখে মনে হয় এতে অনেক ধরণের শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ও অংশগ্রহণ রয়েছে। অনুমাননির্ভর একটি সম্ভাব্য তালিকা হতে পারে এরকম :

(ক) বিডিআর এর জওয়ানদের ভেতরকার দুটি দল। প্রথম দলটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বহুদিন ধরে বিডিআর-এর ভেতর পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হয়েছে এর রিক্রুটমেন্ট ব্যবস্থাকে manipulate করার মাধ্যমে। এতে থাকার সম্ভাবনা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পুরোনো ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের। দ্বিতীয় দলটি বিডিআর-এর সাধারণ জওয়ান যাঁরা বিভিন্ন বঞ্চনা এবং বৈষম্যের কারণে ক্ষুব্ধ। এ ক্ষেত্রে প্রথম দলটি দ্বিতীয় দলটির বঞ্চনাপ্রসূত আবেগকে আরো উসকে দিয়ে একে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

(খ) ঠাণ্ডা মাথায় উপরের ৩-এর আওতায় লিপিবদ্ধ করা অপরাধগুলো দল ‘ক’-এর পক্ষে বাস্তবায়ন করা একটু কঠিন। এর জন্য দরকার এ ধরণের নৃশংসতার দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরেকটি দল। যতদূর অনুমান, এই দলটি সম্ভবত বহিরাগত এবং উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ইতিপূর্বে এই ধরণের ক্র্যাক অ্যাসল্ট গ্রুপ ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম) এবং রাজনৈতিক শো ডাউনের সময় (যেমন: চট্টগ্রামে গোলাম আযমের প্রথম জনসভায়)। এটি জামাতের ‘সিরাজুস সালেহীন’ ধরণের একটি দল, যার সদস্যরা সাধারণত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্থান বা পাকিস্তান থেকে। বিভিন্ন খবরে এখন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে — ঘটনার আগের দিনই দফায় দফায় মিছিলের সাথে মিশে গিয়ে এমন একটি দলই সম্ভবত ‘ছাই রংয়ের পিকআপ’-এ করে বাক্সভর্তি অস্ত্র নিয়ে পিলখানা সদর দফতরে ঢুকে পড়েছিল। পিলখানায় এই দলটির host হলো উপরের দল ‘ক’। খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অব্যবহিত পরই এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আক্রমণ-দলটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে, দল ‘ক’-এর হাতে সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে যাবার দায়িত্ব দিয়ে। নীড় সন্ধানীর বিশ্লেষণেও সে ইঙ্গিত রয়েছে।

(গ) এত বড়ো মাপের মিশনের পেছনে সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকেও উচ্চপদস্থ কারো সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আবেগের বশে উড়িয়ে দেয়া উচিত হবে না। কারণ, পুরো ঘটনায় গোয়েন্দা বিফলতার বিষয়টি এখনো খুব অস্পষ্ট। এমন মাপের একটি ঘটনা দানা বেঁধে উঠবে আর সামরিক গোয়েন্দারা তার কোনো অগ্রিম আভাস পাবেন না, এমনটা মেনে নেয়া যায় না। এ বিষয়ে সরকারের তদন্তে আশা করছি কিছু উত্তর মিলবে। তাছাড়া, পুরো এলাকা যখন সেনাবাহিনী ঘিরে ফেললো ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই, কিছু কিছু অংশ সম্ভবত তখনো ঘেরাওয়ের বাইরে ছিল। তা নাহলে মূল অপরাধীদের বেশির ভাগই পালিয়ে গেল কীভাবে? এ ধরণের বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর এখনো কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সামরিক ঘেরাও-এর টেকনিক্যাল দিকগুলো তদারকির দায়িত্ব তো রাজনৈতিক সরকারের নয়। তাদের প্রায় কারোরই সে ধরণের সামরিক জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নেই! রাজনৈতিক সরকার তো সামরিক ঘেরাওকে অনুমোদন দিয়েই রেখেছিল, কিন্তু সেটা এমন দায়সারা/ত্রুটিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হলো কেন ও কীভাবে? বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার।

(ঘ) সরকারী এবং বিরোধী দলে সেনাবাহিনীর প্রতি ক্ষোভ লালন করা এক শ্রেণীর রাজনীতিকের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদদ থাকতে পারে এর পেছনে।

৫. তদন্তের কিছু সূত্র

(ক) এর উত্তর উপরের ২ নম্বরে কিছুটা পাওয়া যেতে পারে। শুধু অরাজকতা সৃষ্টি বা সরকার পতনের লক্ষ্যেই এ হত্যাকাণ্ড, এমন নয়। এই পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ থাকার কথা, যার আওতায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে অন্য কোনো শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। সেই শক্তিটি সামরিক হতে পারে, সামরিক সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক শক্তি হতে পারে, কিংবা শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শিক কোনো শক্তিও হতে পারে। এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বিচারমুক্তি (indemnity) দানের ক্ষমতা রাখেন বা তা দানের ক্ষমতা পাবেন, তেমনই কেউ হয়তো আশ্বাস দিয়ে থাকবেন। এমন কেউ (ব্যক্তি বা গোষ্ঠী) ছিলেন যিনি/যাঁরা পর্দার অন্তরালে অপেক্ষা করছিলেন। খুঁজে বের করতে হবে who was that person waiting in the wings. এ বিষয়ে সাদাকালো-ও লিখেছেন।

(খ) বিগত কয়েক বছরে সেনাবাহিনী, বিডিআর, আনসার এবং পুলিশ বাহিনীতে বহুবার জামাত-শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডারদের সুপরিকল্পিতভাবে নিয়োগ দানের অনেক খবরই আমরা পেয়েছি। এখন পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বের করতে হবে গত সাত বছরে নিয়োগকৃতদের পূর্ণ তালিকা এবং তা থেকে চিহ্নিত রাজনৈতিক ক্যাডারদের নাম। গত কয়েক বছরে তাদের প্রত্যেকের গতিবিধি তলিয়ে দেখতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইলে এই সব তথ্যই থাকার কথা। আরও খুঁজে বের করতে সেসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের নাম এবং তাঁরা ঠিক কী ভূমিকা পালন করেছেন এসব নিয়োগে। এঁদের প্রত্যেককেই (যেমন: প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর) পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এসেছে।

(গ) খবরে প্রকাশ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘটনার দিন এবং তার আগের দিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবং পিলখানায় লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত লিফলেটগুলো কোথায় ছাপা হয়েছে এবং কারা তা ছাপাতে দিয়েছে, সেটা খুব সহজেই বোধহয় বের করা সম্ভব।

(ঘ) খবরে জানা যায়, ঘটনার দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একটি মিছিল সংগঠিত করার চেষ্টা করে কিছু সন্দেহভাজন কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাদের উদ্দেশ্য বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের কাছে তখনই বিষয়টি অবগত করে। পরে এরকমই একটি মিছিল পিলখানা এলাকায় স্লোগান দিয়ে ঘুরতে থাকে। বিদ্রোহী সেনারা মিছিলটিকে হায়দার হুসেনের ‘বিখ্যাত’ বিডিআর সঙ্গীতটিও বাজিয়ে শোনায় সে সময়! এই মিছিলটির হোতা কারা সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সেদিনকার টিভি ফুটেজে মিছিলের অনেকের ছবিই থাকার কথা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জানা যাওয়ার কথা এই মিছিলটি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল নাকি সুপরিকল্পিত মদদ পুষ্ট ছিল।

(ঙ) ২৫ তারিখের ঠিক আগে এবং পরে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে কোন অস্বাভাবিক লেন দেন হয়েছে কিনা তদন্ত করে দেখতে হবে। এটি হতে পারে কোন এক সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠির পক্ষ থেকে হঠাত করে অস্বাভাবিক পরিমাণের শেয়ারের ক্রয় বা বিক্রয়। এতে ইঙ্গিত মিলবে বিডিআর ঘটনাটি যে ঘটবে তা কারা আগে থেকেই জানতেন এবং তা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হবার পরিকল্পনা করেছিলেন। এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে ৯/১১ এর পূর্বাপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জের অস্বাভাবিক কর্মতৎপরতা তদন্তের বিষয়টি যা থেকে অনেক সূত্রই বেরিয়ে এসেছিল।

(চ) ঘটনার জন্য দায়ী মূল ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই এখন দুশ্চিন্তার প্রহর গুনছেন। কারণ, তাদের পরিকল্পনা মত ঘটনা এগোয়নি, অন্তত এখনো তাই মনে হচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করার আরেকটি আপাত সহজ উপায় আছে। তারা হয়তো এখন জোর চেষ্টা করবেন এ ঘটনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট তৃতীয় শক্তির দিকে জাতির নজর ফেরানোর (ঠিক যেমনটি করা হয়েছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর) অবান্তর গুজব ছড়িয়ে। অথবা, আরেকটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর/সংকটের দিকে সবার মনযোগ তড়িঘড়ি করে সরানোর চেষ্টা করবেন, এমনকি কৃত্রিমভাবে তা তৈরী করে হলেও। এ থেকেও এদের অনেককেই চিনে নেয়া সম্ভব হবে বলে আমার ধারণা।

(ছ) গত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ এর এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে দশ ট্রাক (মতান্তরে ট্রলার) অত্যাধুনিক অস্ত্রের একটি চালান ধরা পড়ে (এখানে এবং এখানে দেখুন)। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে – এর মধ্যে ছিল প্রায় ১০,০০০ হাতিয়ার যার মধ্যে ছিল একে-৪৭ রাইফেল, প্রায় ৫০০০ গ্রেনেড এবং আনুমানিক ৩০০,০০০ রাউন্ড এ্যামুনিশন। এ যাবতকালের আটককৃত সর্ববৃহৎ অস্ত্রের চালান সম্ভবত এটাই। ঘটনার জন্য পরবর্তীতে কেবলমাত্র গুটিকয় ট্রলার মাঝি, কুলি এবং ট্রাক ড্রাইভারকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে ঘটনার জন্য মূল সন্দেহভাজন জোট সরকারের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের তদন্ত হয়নি। অন্তত আমার জানা নেই। কিংবা হলেও সেই তদন্তকে ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল। মনে পড়ে কথিত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নামটা তখন উঠে এসেছিল, যাঁর নিজস্ব শিপিং ব্যবসার সাথে এই অস্ত্র চালানের কিছু লিন্কও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তখন। সাধারণ জ্ঞান থেকে যতদূর বুঝি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করতে, কিংবা এলাকায় চাঁদাবাজীর জন্য এধরণের অস্ত্রের চালান দরকার হয়না। এর পেছনে আরও সুগভীর কোন পরিকল্পনা থাকারই বরং সম্ভাবনা বেশী। এই তদন্তটি আবার শুরু করতে হবে এবং এর সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই অনেক তথ্য পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ (জাতীয় চার নেতার একজন শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ এর ছেলে) মাত্র কিছুদিন আগে এই চালানটির তদন্ত বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাপারটা আমি শিঘ্রই তদন্ত শুরু করবো, তা করতে যদি দরকার হয় আকাশে যাবো, না হয় পাতালে যাবো’। প্রশ্ন হল, পূনঃ তদন্তের কথা তুলে সোহেল তাজ কি নিজের অজান্তেই অস্ত্র চালানকারী গোষ্ঠীটিকে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের শংকায় ফেলে দিলেন?

সবশেষে, একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। গত কয়েক দিন সেনা বাহিনীর এই অভূতপূর্ব সংযমের ব্যপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। চরম ব্যক্তিগত সংকটের মুখেও তাদের পেশাদারী দায়িত্ববোধ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এই দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হলে তাদের সহপাঠিরা পুরো এলাকা ঘিরে আন্দোলন করে, ভাঙচুর করে, যুদ্ধাবস্থা তৈরী করে। অথচ, নিজেদের ভাই, বন্ধু, স্ত্রীদের হত্যা এবং নির্যাতনের সম্ভাবনা দেখেও সেনাবাহিনী যেভাবে রাজনৈতিক সরকারের নির্দেশ এক চুলও অমান্য না করে দায়িত্বে অনড় ছিলেন, তা যতই ভেবেছি ততই অবাক হয়েছি। এটি আস্বস্তকারী এবং প্রশংসার দাবীদার, সন্দেহ নেই। তবে এখন আরেকটি বিষয় মনে হচ্ছে আমার। ঘটনার শুরুর প্রহরগুলোতেই সম্ভবত সশস্ত্র বাহিনীর উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন আসল ষড়যন্ত্রকারী কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য কী। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো তারা সচেতনভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের ক্রীড়নক হতে চাননি। এর অর্থ, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এমন কিছু ততক্ষণে জেনে গিয়েছিলেন, যা বাকীরা জানতেন না। এর অর্থ, ঘটনার তদন্ত এবং দায়ীদের খুঁজে বের করে ষড়যন্ত্রের মূল খুঁজে বের করায় সশস্ত্র বাহিনী এবং আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন হয়তো অনেকটাই এগিয়ে আছে। এর ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা এবং desperation খুব স্পষ্ট। সামরিক বাহিনীকে পিলখানায় আশানুরূপভাবে আক্রমণ করে বসতে না দেখে পর দিন অনেকটা ডেসপারেটভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা (কোন নতুন উস্কানী ছাড়াই) সারা দেশের অন্যান্য ক্যাম্পগুলোতে যেভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল, এতে তাই প্রতীয়মান হয়।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

19 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
19
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.