পৈশাচিক নখ দন্ত উঁচিয়ে সদম্ভে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধ খুনীর দল । অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বর্বর শক্তিকেই নিজেদের কাজে লাগানোর কৌশল গ্রহণ করেছে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আবার এমনও হতে পারে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বহীন আমাদের ‘তত্ত্বাবধানকারীরা’ এই অপশক্তির উপর নির্ভর করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বহীনতার অপবাদ দূর করতে চাইছেন । কয়েকটি ঘটনার পরম্পরা দেখলেই এই সন্দেহ আরো দানা বাধবে, দুঃস্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নেয়ার আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করবে।
আমাদের দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর যে-কোনো কর্মকাণ্ড সরকার মরিয়া হয়ে বাধা দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন দলের কর্মী ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা অজস্র মামলা দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে; আর অন্য দিকে, ধর্মের নামে সমস্ত সভ্যতাকে অস্বীকার ও তা ধ্বংসকল্পে প্রতিজ্ঞাকারীদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পুরো দেশ জুড়ে । দেশে জরুরি অবস্থার কারণে যখন রাজনৈতিক দলগুলো টু শব্দটিও করতে পারছে না, সেই সময় সামান্য একটি কৌতুক নিয়ে ধর্মের ষন্ডারা যখন বায়তুল মোকাররম থেকে জঙ্গি মিছিল বের করে, সরকার তখন নীরব। টুপিধারী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার বরং খড়্গ উত্তোলন করল মুক্তচিন্তা ও এর প্রসারের উপর।
দেশে আইনের শাসন ও সুষ্ঠু রাজনৈতির চর্চা প্রতিষ্ঠার জন্য গলদঘর্ম আমাদের বিভিন্ন প্রধান এবং অ-প্রধানগণ । কিন্তু, অন্ধকারের বাহক বিভিন্ন দল ও তাদের অনুসারী জঙ্গিদের পাশবিক আস্ফালন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কারো কোনো ধরনের উৎকণ্ঠার উদ্রেক করে না । কয়লা খনি মামলায় দেশের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রীদ্বয় যখন জামিন নেয়ার জন্য কোর্টের কাঠগড়ায় মাথা ঠোকেন, তখন কোনো এক মুজাহিদের বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারির পরও পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না, যদিও তিনি সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে বেড়ান, উদ্ধত সব মন্তব্য করে বেড়ান! এতে আমাদের ঘর্মাক্তদের নধর শরীরে নতুন কোনো স্বেদবিন্দু তৈরি হয় না । আমাদের শাসনতন্ত্র আর সামগ্রিক আইনব্যবস্থার উপর এর চেয়ে বড় চপেটাঘাত আর কী হতে পারে!
মৌলবাদী শক্তি একের পর এক আক্রমণ করে চলেছে আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতার উপর, রক্তাক্ত করে চলেছে আমাদের শরীর ও প্রাণ দুটোকেই। এর অতি সাম্প্রতিক আরেকটি উদাহরণ হলো গত বুধবার মৌলবাদী শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশের দাবির মুখে ঢাকা বিমান বন্দরের সামনে নির্মীয়মাণ লালন ভাস্কর্যটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া । এই অন্যায় ও বর্বর অপকর্মটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন, কিছু কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় ।
প্রথমত, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, যাদের পূর্বানুমতি নিয়ে ভাস্কর্যকর্মটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়, তারা কী করে কিছু মৌলবাদীর অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে?
দ্বিতীয়ত, ভাস্কর্যটি যেহেতু একটি শিল্পকর্ম, সেহেতু একে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই নিতে পারে না । তারা এবং সরকার ভাস্কর্যটি রক্ষায় অসামর্থ্য প্রকাশ করলে এটিকে সরিয়ে সুবিধাজনক এলাকায় স্থানান্তর করা যেত। কিন্তু তা না করে এটিকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া কি আমাদের সেই অসুর শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় না যারা আমাদের শহীদ মিনারটি পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল?
তৃতীয়ত, যখনই কোনো অরাজনৈতিক সরকার এদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে তখনই মৌলবাদী শক্তির অস্বাভাবিক উত্থান এবং আস্ফালন কি এটাই প্রমাণ করে না যে, মৌলবাদীদের সঙ্গে এই ধরনের সরকারগুলোর গোপন আঁতাত রয়েছে?
এই গোপন আঁতাতের সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের সময় এসেছে আজ। এই সময়ে কার্যকর ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতাকেই খণ্ডিত ও সীমিত করবে।