পৈশাচিক নখ দন্ত উঁচিয়ে সদম্ভে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধ খুনীর দল । অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বর্বর শক্তিকেই নিজেদের কাজে লাগানোর কৌশল গ্রহণ করেছে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আবার এমনও হতে পারে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বহীন আমাদের ‘তত্ত্বাবধানকারীরা’ এই অপশক্তির উপর নির্ভর করে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বহীনতার অপবাদ দূর করতে চাইছেন । কয়েকটি ঘটনার পরম্পরা দেখলেই এই সন্দেহ আরো দানা বাধবে, দুঃস্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নেয়ার আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করবে।
আমাদের দেশে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর যে-কোনো কর্মকাণ্ড সরকার মরিয়া হয়ে বাধা দিয়েছে এবং দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন দলের কর্মী ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা অজস্র মামলা দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে; আর অন্য দিকে, ধর্মের নামে সমস্ত সভ্যতাকে অস্বীকার ও তা ধ্বংসকল্পে প্রতিজ্ঞাকারীদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পুরো দেশ জুড়ে । দেশে জরুরি অবস্থার কারণে যখন রাজনৈতিক দলগুলো টু শব্দটিও করতে পারছে না, সেই সময় সামান্য একটি কৌতুক নিয়ে ধর্মের ষন্ডারা যখন বায়তুল মোকাররম থেকে জঙ্গি মিছিল বের করে, সরকার তখন নীরব। টুপিধারী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার বরং খড়্গ উত্তোলন করল মুক্তচিন্তা ও এর প্রসারের উপর।
দেশে আইনের শাসন ও সুষ্ঠু রাজনৈতির চর্চা প্রতিষ্ঠার জন্য গলদঘর্ম আমাদের বিভিন্ন প্রধান এবং অ-প্রধানগণ । কিন্তু, অন্ধকারের বাহক বিভিন্ন দল ও তাদের অনুসারী জঙ্গিদের পাশবিক আস্ফালন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কারো কোনো ধরনের উৎকণ্ঠার উদ্রেক করে না । কয়লা খনি মামলায় দেশের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রীদ্বয় যখন জামিন নেয়ার জন্য কোর্টের কাঠগড়ায় মাথা ঠোকেন, তখন কোনো এক মুজাহিদের বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারির পরও পুলিশ তাকে খুঁজে পায় না, যদিও তিনি সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে বেড়ান, উদ্ধত সব মন্তব্য করে বেড়ান! এতে আমাদের ঘর্মাক্তদের নধর শরীরে নতুন কোনো স্বেদবিন্দু তৈরি হয় না । আমাদের শাসনতন্ত্র আর সামগ্রিক আইনব্যবস্থার উপর এর চেয়ে বড় চপেটাঘাত আর কী হতে পারে!
মৌলবাদী শক্তি একের পর এক আক্রমণ করে চলেছে আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতার উপর, রক্তাক্ত করে চলেছে আমাদের শরীর ও প্রাণ দুটোকেই। এর অতি সাম্প্রতিক আরেকটি উদাহরণ হলো গত বুধবার মৌলবাদী শক্তির একটি ক্ষুদ্র অংশের দাবির মুখে ঢাকা বিমান বন্দরের সামনে নির্মীয়মাণ লালন ভাস্কর্যটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া । এই অন্যায় ও বর্বর অপকর্মটির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন, কিছু কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায় ।
প্রথমত, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, যাদের পূর্বানুমতি নিয়ে ভাস্কর্যকর্মটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়, তারা কী করে কিছু মৌলবাদীর অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে?
দ্বিতীয়ত, ভাস্কর্যটি যেহেতু একটি শিল্পকর্ম, সেহেতু একে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই নিতে পারে না । তারা এবং সরকার ভাস্কর্যটি রক্ষায় অসামর্থ্য প্রকাশ করলে এটিকে সরিয়ে সুবিধাজনক এলাকায় স্থানান্তর করা যেত। কিন্তু তা না করে এটিকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া কি আমাদের সেই অসুর শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় না যারা আমাদের শহীদ মিনারটি পর্যন্ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল?
তৃতীয়ত, যখনই কোনো অরাজনৈতিক সরকার এদেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে তখনই মৌলবাদী শক্তির অস্বাভাবিক উত্থান এবং আস্ফালন কি এটাই প্রমাণ করে না যে, মৌলবাদীদের সঙ্গে এই ধরনের সরকারগুলোর গোপন আঁতাত রয়েছে?
এই গোপন আঁতাতের সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের সময় এসেছে আজ। এই সময়ে কার্যকর ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা আমাদের সামগ্রিক স্বাধীনতাকেই খণ্ডিত ও সীমিত করবে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৭ comments
মাহতাব - ২২ অক্টোবর ২০০৮ (৯:২১ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ তাজরুল। আমরা খুব বাজে সময় পার করছি।
অলকেশ - ২২ অক্টোবর ২০০৮ (১১:০৩ অপরাহ্ণ)
সৈয়দ তাজরুলকে ধন্যবাদ, এই বিষয়টি ব্লগে তুলে আনার জন্য। বাউল ভাস্কর্য ভাংচুর জরুরি আইনের বিধিমালার লংঘন নয় কি? এই জঘন্য ঘটনার সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নূরানীর লেলিয়ে দেয়া বাহিনীকে মূলত প্রোটেকশন দিচ্ছিল। পুলিশ বাহিনীর প্রোটেকশন না পেলে, এই কাজ অসম্ভবই ছিল। কারণ আশেপাশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলত এই দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে।
এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অপরাধে, এই সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে জরুরি আইনে অভিযোগ উত্থাপন করে মামলা ঠুকে দেয়া বিশেষ জরুরি কাজ ছিল। হালের নব্য ধোঁকাবাজ পলিটিক্যাল নেগোশিয়েটর ড. হোসেন জিল্লুর গং-এর পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি এ ব্যাপারে। তাঁরা যদি দয়া করে উদ্যোগ না নেন তাহলে আস্থার পরিবেশ ও গুণগত রাজনৈতিক উত্তরণের পথ প্রশস্ত হবে কী করে? জাতি তাদের দেখানো পথে হাঁটবে কী করে? হোঁচট খেয়ে পড়বে যে!
রেজাউল করিম সুমন - ২৫ অক্টোবর ২০০৮ (৩:২৯ অপরাহ্ণ)
তাজরুল, ধন্যবাদ এই পোস্টটির জন্য।
“সচেতন শিল্পী সমাজ”-এর ব্যানারে নানা মাধ্যমের শিল্পী ও সর্বস্তরের সচেতন মুক্তচিন্তার মানুষেরা এরই মধ্যে সংগঠিত হয়েছেন। তাঁদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত লিখিত বক্তব্য হুবহু উদ্ধৃত করছি।
. . .
লালন চত্বর চক্রান্ত, ভাস্কর্য বিভ্রাট ও শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশ প্রসঙ্গে
ক. আমাদের প্রধান প্রশ্ন
লালন চত্বরে ভাস্কর্যের নামে সাজানো নাটক কার স্বার্থে?
খ. নীতিগতভাবে আমাদের অবস্থান
বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চায় এ ধরণের একটি শিল্প-সংস্কৃতি বিরোধী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হুমকির মুখে সম্প্রতি বিমান বন্দরের সামনের লালন চত্বরে ভাস্কর্যের নামে একটি স্থাপনা সরকারি সিদ্ধান্তে তৈরি ও ভেঙে সরিয়ে নেয়ার যে সাজানো ঘটনা ঘটেছে তাতে আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই।
ধর্মীয় লেবাসধারী তথাকথিত মূর্তি প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে নয়, সংশ্লিষ্ট শিল্পী (মৃণাল হক) কিংবা তার সঙ্গে যুক্ত মুনাফালোভী গোষ্ঠীর পক্ষে নয়, এমনকী সরকার বা ক্ষমতাকাঠামোর মেরুদণ্ডহীন অবস্থানের পক্ষেও নয় — নীতিগতভাবে আমাদের অবস্থান একমাত্র মুক্ত ও সুস্থ ধারার শিল্পচর্চার পক্ষে।
গ. আমরা যা চাই এবং যা চাই না
প্রথমত আমরা চাই শিল্পচর্চার সুস্থ ও মুক্ত পরিবেশ। ঢাকা সহ দেশের যে-কোনো প্রান্তে কোনো বিশেষ মহল (তারা যেই হোক) যদি শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশে বাধা সৃষ্টি করে তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর অবস্থান হবে সুস্থ ও মুক্ত ধারার শিল্পচর্চার পক্ষে — এমনটাই আমাদের কাম্য।
দ্বিতীয়ত নগরসজ্জা বা বিউটিফিকেশনের নামে গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা সহ সারা দেশে যে যথেচ্ছ ভাস্কর্য (?) ও স্থাপনা তৈরি প্রক্রিয়া চলছে তার অবসান হোক। এক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হলো : জনগুরুত্বপূর্ণ ও উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য একটি সুচিন্তিত ও সমন্বিত নীতিমালা তৈরি এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। এজন্য একইসঙ্গে শিল্পী, শিল্পসমালোচক, শিক্ষক, স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ প্রমুখের সমন্বয়ে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি “নির্বাচক পরিষদ” গঠন করা যেতে পারে। যারা উন্মুক্ত স্থানে ভাস্কর্য কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য নীতিমালা তৈরি, নকশা প্রণয়ন ও স্থান নির্বাচন সহ পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়াটির তদারকি করতে পারবে। এভাবে যেমন শিল্পকর্মের নান্দনিক ও শৈল্পিক মান বজায় রাখা সম্ভব হবে তেমনি একধরণের জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হবে।
তৃতীয়ত বিমান বন্দরের সামনে মৃণাল হকের ভাস্কর্যের (?) নামে স্থাপনা পুনঃস্থাপন কিংবা বিশেষ মহলের প্রস্তাবিত মিনার কিংবা ফোয়ারা কোনোটাই আমরা চাই না। বরং এখানে কী ধরণের স্থাপনা হবে — এই প্রশ্নের মীমাংসা থেকেই আমাদের প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
ঘ. যে শিল্প ভালোবাসে না সে মানুষ খুন করতে পারে
শিল্প হলো মানুষের সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার বহিঃপ্রকাশ। আর সৃজনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা হলো জীবনের স্বাভাবিক লক্ষণ। ধর্মীয় তকমাধারী যে মহলটি বিভিন্ন সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে সারা দেশে শিল্পচর্চার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে ও করছে — তারা আসলে সৃষ্টিশীলতাকে ভয় পায়। তারা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে দিতে চায়। যদিও নিজেরা ধর্ম পালন করে না তবু ধর্মকে ব্যবহার তারা নিজেদের নানা রকমের ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যস্ত ও সক্রিয়। তারা এতটাই সক্রিয় যে প্রয়োজনে মানুষের উপর বোমা হামলা কিংবা গ্রেনেড হামলা করতে তাদের বুক কাঁপে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে এই গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যম — যেমন সঙ্গীত, নাটক, যাত্রা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদিকে — বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তার শিল্প ভালোবাসে না, কেননা তারা আসলে জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ভয় পায়। তারা নিজেরা ক্ষমতালোভী এবং এ কারণে তারা ক্ষমতালিপ্সু বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহায়ক শক্তি হিসেবে যে-কোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এবং বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মুখে ধর্মের কথা বললেও বেনিয়া পুঁজির শাসন, অনৈতিক মুনাফা ও সুদের গতিরোধে এই মানব-বিরোধীদের কোনো ভূমিকাই নেই।
আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি যে, অতীতের ক্ষমতাসীন সরকারগুলো, এমনকী বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই গোষ্ঠীর পোষকতা করে চলেছে। শিল্পচর্চার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করতে যখনই কোনো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এই বিশেষ স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক মহল, তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর ভূমিকা হয়েছে নেতিবাচক ও শিল্পকলার বিপক্ষে। উদাহরণ হিসেবে উদীচীর অনুষ্ঠানে ও রমনা বটমূলে বোমা হামলা থেকে শুরু করে সম্প্রতি জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজের গানের অনুষ্ঠান বাতিল, যাত্র-পালার উপর অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ ইত্যাদি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। (এই তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে।) সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া হুমকির মুখে স্থাপনা অপসারণের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
আবার যখন একটি মুনাফালোভী চক্র ক্রমাগত ঢাকা সহ সারা দেশে বিউটিফিকেশনের নামে যথেচ্ছ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে টাকাপয়সা লুটে নিয়েছে তখন সরকার নীরব থেকেছে। অথচ একটি শহরে কোথায় কোনো ভাস্কর্য বা স্থাপনা তৈরি হবে এবং কীভাবে হবে — সেটা তদারকি করা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? কোনো রকম নীতিমালা ছাড়া, কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটির অনুমোদন ছাড়া একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এতদিন নগরসজ্জার নামে যা হয়ে আসছে তার দায়-দায়িত্ব সরকার কোনোমতেই এড়াতে পারে না।
এছাড়া, সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় কোথাও কোনো ভাস্কর্য বা স্থাপনা তৈরি করার তবে যে-কোনো পরিস্থিতিতে তা রক্ষার দায়িত্বও সরকারের। কিন্তু সেখানেও আমাদের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামো চরমভাবে ব্যর্থ। এই ঘটনা সম্পর্কে টিভি চ্যানেলগুলোতে আমরা যা দেখেছি ও জেনেছি তাতে এটাকে একটা সাজানো নাটক ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
তবে কি আমরা ধরে নেব ধর্মীয় লেবাসধারী শিল্পবিদ্বেষী ঐ বিশেষ গোষ্ঠীর মতো সরকারও শিল্প ভালোবাসে না?
ঙ. আমাদের ঘোষণা
যদি তাই হয়, তবে এই সরকার বা রাষ্ট্রের উপর আস্থা রেখে আমরা কতদূর এগুতে পারি? অতীতের মতো সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে শিল্প নির্বাচন ও স্থাপনের জন্যে নীতিমালা ও নির্মাণ প্রক্রিয়া ছেড়ে দিলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আমরা আশা করতে পারছি না। অতএব এই পরিস্থিতিতে, জনগণের শিল্প ও সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব জনগণেরই। সচেতন শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে তাই জানানো হচ্ছে :
১. যে-কোনো মূল্যে বাংলাদেশে সঙ্গীত, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সহ সকল মাধ্যমে মুক্ত শিল্পচর্চার ধারা অব্যাহত রাখা হবে এবং প্রতিপক্ষ যেই হোক না কেন তাকে (বা তাদেরকে) প্রতিহত করা হবে।
২. অচিরেই দেশের মুক্ত ধারার শিল্প ও সংস্কৃতির সক্রিয় ও সচেতন কর্মীদের একটি জাতীয় কনভেনশন আয়োজন করা হবে। এই কনভেনশনে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে।
৩. শিল্পী, ভাস্কর, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক প্রমুখ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
৪. এই নীতিমালার ভিত্তিতেই ঢাকা সহ সারা দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
৫. এছাড়াও এই কমিটি জাতীয় প্রয়োজনে শিল্প ও সংস্কৃতির মুক্ত চর্চার ধারা অব্যাহত রাখতে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নেবে।
৬. বিমান বন্দরের সামনে গোল চত্বর নিয়ে কায়েমি রাজনীতি যে চক্রান্তে মেতে উঠেছে, তার ফলাফল হিসেবে ইতিমধ্যেই লালনের মতো সংবেদনশীল সত্তার নামটি এর সাথে যুক্ত হয়েছে। ধর্মের লেবাসধারী যে মহলটি লালনকে ভয় পায়, তাদের চক্রান্ত ও কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আমরা ইতিমধ্যেই চত্বরটির নাম “লালন চত্বর” হিসেবে ঘোষণা করেছি।
৭. তার মানে কিন্তু এই নয় যে, লালনের নামে যে স্থাপনাটি সম্প্রতি অপসারিত হয়েছে, আমরা তার পুনঃস্থাপন চাই। বরং আমরা বলতে চাই, জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে গঠিত কমিটি যে নীতিমালা প্রণয়ন করবে, সেই নীতিমালার অধীনেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, ঐ চত্বরে কোন্ ভাস্কর্য হবে।
সচেতন শিল্পী সমাজ
কবির - ২৫ অক্টোবর ২০০৮ (৪:১১ অপরাহ্ণ)
সৈয়দ তাজরুল হোসেন ও মন্তব্যকারীদের ধন্যবাদ।
এই দুটি লিংক-ও দেখুন :
১. এয়ারপোর্ট এলাকায় লালন চত্বর ঘোষণা
২. ধর্মব্যবসায়ী মৌলবাদ, মৃণাল হক ও সরকার সবাইকে চিনে নিন
সৈকত আচার্য - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (১:২০ অপরাহ্ণ)
@ কবিরঃ না। আপনি যেই লিংকটি উপরে দিয়েছেন, তাতে করে মৃণাল হককে চিনতে পারা গেল না। এই আন্দোলনে উনাকে চেনার বিষয়টাও কি খুব প্রাসংগিক? লিংকটির সুবাদে লেখকের লিখাটা পড়লাম। লেখক “সচেতন শিল্পী সমাজের” একটি লিফলেটের বরাত দিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন, যে;
এই সব তথ্যগুলো এই আন্দোলনের সাথে কিভাবে প্রাসংগিক তা আমার বোধগম্য নয়। আপনি এটাকে প্রাসংগিক ভাবছেন কোন যুক্তি থেকে তা এখানে আলোচনা করলে বোঝার চেষ্টা করতাম। এছাড়া, লিফলেটের বরাত দিয়ে ঐ লেখক আমাদের জানাচ্ছেন সরকার এবং ভাস্কর দু’পক্ষের বিরুদ্ধেই দু’টো প্রধান অভিযোগ আছেঃ
১। ভাস্কর্য নির্মানে সরকারী নীতিমালার অভাব এবং
২। সরকার ও ভাস্করের যোগসাজসী দুর্নীতি।
এক্ষেত্রে প্রথমত বলতে হয়ঃ
বাউল ভাস্কর্যের বিরোধীতা করে যারা সেটাকে নামিয়ে ফেলেছিল, তারা উপরোক্ত কোন কারনে তা করেনি। আমাদের সংস্কৃতির উপর বর্বর উগ্র সাম্প্রদায়িক আস্ফালনের বহিঃপ্রকাশ এটি। সরকার একটি বিশেষ মূহূর্তে এদের কাজে লাগাচ্ছে। ফলে সংস্কৃতিপ্রেমী, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ জোট বেঁধে এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। সাদা চোখে দেখলে, লড়াইটা এখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বর্বরতার সাথে সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক শক্তির আদর্শিক লড়াই।
আবার, ভাস্কর্য নির্মানে পরিকল্পনাহীনতা বা দুর্নীতির অভিযোগ একটা সম্পূর্ন স্বতন্ত্র বিষয়, যা এই আন্দোলনের মূল চেতনার সাথে কোন ভাবেই একাকার করে দেখা যাবে না। ভাস্কর্য নির্মানে পরিকল্পনাহীনতা বা দুর্নীতির বিষয়ে একটা ভিন্ন ধরনের আন্দোলনের ডাক অবশ্যই দিতে হবে, কিন্ত এই আন্দোলনের সাথে ঐ ইস্যুকে একত্রে গুলিয়ে দেয়া যাবে না। তাতে করে মূল ইস্যু হারিয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ একইভাবে, কোন ভাস্কর দুর্নীতি করেছে কিনা, সেই প্রসংগ এখানে টেনে আনার মধ্যে দুটি দিক আছে।
ক) হতে পারে, আন্দোলনের মধ্যে ইননোসেন্টলি এই দাবী চলে এসেছে;
খ) ফলে, এই সুযোগে, বাইরের কেউ (মতলবী) এই দাবীকে হাইলাইট করে ফায়দা নিতে পারে, আন্দোলনের মোড় ঘোরানোর জন্য এবং আমাদের মত সাধারন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
একারনে আমার মনে হয়, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে ঐ সময়ের জন্য অপ্রধান ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসার মানে মতলবাজী করা অথবা না জেনে তাদের হাত শক্তিশালী করা।
সৈয়দ তাজরুল হোসেন - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ)
সুমনকে ধন্যবাদ “সচেতন শিল্পী সমাজ” এর পক্ষে সাংবাদিক সন্মেলনে উত্থাপিত বক্তব্যটি তুলে দেয়ার জন্য। কবির এর দেয়া দ্বিতীয় লিংকটি দেখলে শিল্পী হিসেবে মৃনাল হকের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হয় । এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য যে কোন তথ্য সকলকেই সাহায্য করবে ।
ইনসিডেন্টাল ব্লগার - ২৬ অক্টোবর ২০০৮ (৪:২৩ অপরাহ্ণ)
@ রেজাউল করিম সুমন (#৩)
“সচেতন শিল্পী সমাজ” এর ঘোষণাপত্রটি এখানে তুলে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। সেখানে যে বৃহত্তর আবেগের এবং আকাঙ্খার বিষয়গুলো উঠে এসেছে, আমি নিজেও তার ভাগীদার। ‘শিল্প চর্চার মুক্ত ধারা অব্যাহত রাখা’, ‘সার্বজনীন নীতিমালা প্রণয়ন’ ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে দ্বিমত করার মত কিছু নেই। (হ্যাঁ, ‘জাতীয় কমিটি’ সৃষ্টির প্রস্তাবটির সাথে আমি একমত নই, তবে সে অন্য আলোচনা)। এই বিষয়গুলো নিয়ে মূলধারায় প্রচারণা, সচেতনতা সৃষ্টি এবং লবিইং এর প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু লালন ভাস্কর্যের ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বলতে বাধ্য হচ্ছি সেসবই একটি “ভিন্ন” আন্দোলনের বিষয় যা নিয়ে ‘সচেতন শিল্পী সমাজ’ আজ সোচ্চার। এই সব ইস্যুকে মৌলবাদের আগ্রাসী উত্থান, রাষ্ট্রযন্ত্রের মৌলবাদ তোষণ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আন্দোলনের সাথে এক করে ফেলাটা মনে হয়না ঠিক কাজ হয়েছে। যিনি রথ দেখতে যাবেন, তিনি কিছু কলাও বেচতে চাইতেই পারেন, কিন্তু এখানে মনে হয় প্রায়োরিটির স্বার্থে শুধু রথ দেখাতেই অধিক মনোনিবেশ জরুরী ছিল।
প্রসঙ্গত বলে রাখি: “যে শিল্প ভালোবাসেনা সে মানুষ খুন করতে পারে” – সেখানকার এই উক্তিটি অতি সরলীকৃত আশাবাদদুষ্ট মনে হয়েছে। হিটলার এবং তার অধীন অনেক জেনারেলের শিল্পপ্রীতির কথা ইতিহাসবিদিত। তাঁদের অনেকেই প্রুশিয়ান ঐতিহ্যের কালচারাল রিফাইনমেন্টের ধারক বাহক ছিলেন, কিন্তু তা তাদের ছয় মিলিয়ন ইহুদীকে গণহত্যায় বিরত করেনি। সুতরাং শিল্পপ্রেমীরা খুনখারাবি করতে পারেনা, সেটা মনে হয় ঠিক নয়। যাকগে সে সব কথা। শিল্পমোদীরা আরো ভাল বলতে পারবেন। আমার দুশ্চিন্তা অন্য বিষয়ে।
মৃনাল হকের ভাস্কর্য, মৌলবাদীরা যেটির বিরোধিতা করছে, তা মান সম্পন্ন ছিল কি ছিলনা তা এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কোনো প্রদর্শনীতে, প্রতিযোগিতায়, কিংবা শিল্প সমালোচনার কলামে-প্রবন্ধে সেসবের হয়তো প্রাসঙ্গিকতা থাকতে পারতো। কিন্তু আমার সীমিত বিচারে মনে হয়েছে (সবিনয়ে বলতে চাই), এখানে বিষয়টির উত্থাপন শুধু অবান্তরই নয়, অনেকাংশে বিভ্রান্তিকরও বটে। নিজেকে শিল্পমোদী বলে দাবী করার মত অবস্থান বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই, তবে আর দশটা সাধারণ মানুষের মত শৈল্পিক উৎকর্ষতার বিরোধী আমিও নই। কিন্তু শৈল্পিক উৎকর্ষতা যখন এলিটিস্ট শৈল্পিক উন্নাসিকতায় পর্যবসিত হয়, তখনই সেটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। এখানে তেমনটিই হচ্ছে বলে আমার ধারণা। কেউ যদি উন্নাসিক হতে চান, সেটা তার বা তাদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত অভিরুচির ব্যপার। তাতে আমাদের আসলে কিছু যায় আসেনা। যায় আসে তখনই, যখন সে উন্নাসিকতা একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের ইস্যুকে বিস্তৃত করে দেয়, শাণিত করার পরিবর্তে; দিকভ্রান্ত করে দেয়, পথপ্রদর্শন করার পরিবর্তে; মূল শত্রুকে আচ্ছাদনে মুড়ে দেয়, উম্মুক্ত এবং চিহ্নিত করার পরিবর্তে।
বুদ্ধিবৃত্তীয় চর্চার মূল কথা হল প্রবলেমেটাইজেশন। সুলিখিত এ ঘোষণাপত্রটিতে সেটি মুক্তহস্তে করা হয়েছে। সেখানে অনেক বৃহত্তর পরিসরের খুঁটিনাটি উঠে এসেছে। কিন্তু এই সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে সে ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক জিমনাস্টিক্স কতটা সুফল বয়ে আনবে, সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সন্দেহ আছে এর সময়োপযোগীতা নিয়েও। কারণ, মৃনাল হককে ক্রুসবিদ্ধ করার কাজটা অন্য সময়ও হয়তো করা যেত (যদি নিতান্তই করতে হয়)। কিন্তু ঠিক এসময়ে এ বিষয়গুলো উত্থাপন করে আন্দোলনের আরো বৃহত্তর ইস্যুগুলোকেই ঘোলাটে এবং পথভ্রষ্ট করা হল বলে মনে করি। যে প্রশ্নটা হয়তো করা দরকার ছিল তা হল – এ ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলে শেষ বিচারে লাভ কার? শত্রু চিহ্নিত করে কর্মপন্থা নিরূপণে এই সাধারণ প্রশ্নটা মনে হয় করা জরুরী ছিল আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের।
@ সৈকত আচার্য (#৪)
ধন্যবাদ আপনার সুলিখিত সময়োপযোগী মন্তব্যটির জন্য। আপনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত।