মার্চে শোকের মাতম আর ডিসেম্বরে বিজয়ের বাজনা_ এ-ই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ উদযাপন। সেই স্মরণের তালিকায় সব কিছু আসে, আসে না কেবল সেইসব নারীদের কথা, যাদের শোকের শরিক রাষ্ট্র হয়নি। তাদের বিজয় আজো আসেনি। বিজয়হীনা সেই নারীদের আমরা বীর ডাকি না, ডাকি ‘বীরাঙ্গনা’ বলে। ‘বীরাঙ্গনা’ মানে বীরের অঙ্গনা, বীরের নারী। বীরত্বের যে পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা তাতে কেবল পুরুষেরই অধিকার। নারীর কোটায় কেবল বীরের অঙ্গনা হবার ছাড় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নারী আর ধর্ষণ-নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার লক্ষ লক্ষ নারীদের কেন এক দাগে পুরুষের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে? স্বাধীনতা অর্জনে যদি তাদেরও বিরাট ত্যাগ ও অবদান থেকে থাকে, তবে কেন তাদের কেবল ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবের মধ্যে আটকে থাকতে হবে? এটা কি বীরের সম্মান না অধঃস্তনের প্রতি করুণা ও অবজ্ঞা? একাত্তরের সব থেকে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ নারীরা। তাদের ঘরে থাকা সহজ ছিল না, পালানো ছিল আরো কঠিন। যুদ্ধে যেতে চাওয়াও যখন প্রায় অসম্ভব ছিল, তখনও যুদ্ধে সামিল হয়েছেন এমন নারী বিরল নয়। অথচ সত্তরের ডিসেম্বরে ছাত্রীদের কাঁধে ডামি বন্দুক দিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হলেও যুদ্ধের সময় মেয়েদের নিয়ে আলাদা কোনো বাহিনী গঠন কিংবা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ধর্ষিতার সারিতে তারা, গণহত্যার মোট সংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশও তারা। শাহীন আফরোজের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। জাতীয়তাবাদ কি তবে পুরুষের মতাদর্শ? আজ এতদিন পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঘৃণায় কথার আগ্নেয়গিরি জ্বালানো বরং সহজ; কিন্তু কঠিন সেসব নারীদের কথা বলা; স্বাধীনতার দাম যাদের সবচেয়ে বেশি মূল্যে শুধতে হয়েছিল। সরকারি হিসাবে আড়াই লাখ এবং কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় চার লাখ নারী একাত্তরে ধর্ষিত হয়েছিলেন। ৮ থেকে ৮৭ বছর বয়সের। একবার নয়, একদিনের জন্য নয়_ বারবার অনেক দিন ধরে অমানবিক পরিবেশে আটক থেকে। আত্মহত্যা করারও উপায় ছিল না। মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সিলিংয়ে ঝুলে পড়তে না পারে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তাদের নিপীড়নের ভয়াবহতার পুরোটা প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ নয়। আমরা পুরুষরা সেই নিপীড়নের শিকার হতে পারি না বলে হয়তো পুরুষালি ভাষায় তা প্রকাশ করাও কঠিন। মার্চ থেকে ডিসেম্বর…