মার্চে শোকের মাতম আর ডিসেম্বরে বিজয়ের বাজনা_ এ-ই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ উদযাপন। সেই স্মরণের তালিকায় সব কিছু আসে, আসে না কেবল সেইসব নারীদের কথা, যাদের শোকের শরিক রাষ্ট্র হয়নি। তাদের বিজয় আজো আসেনি। বিজয়হীনা সেই নারীদের আমরা বীর ডাকি না, ডাকি ‘বীরাঙ্গনা’ বলে। ‘বীরাঙ্গনা’ মানে বীরের অঙ্গনা, বীরের নারী। বীরত্বের যে পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা তাতে কেবল পুরুষেরই অধিকার। নারীর কোটায় কেবল বীরের অঙ্গনা হবার ছাড় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নারী আর ধর্ষণ-নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার লক্ষ লক্ষ নারীদের কেন এক দাগে পুরুষের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে? স্বাধীনতা অর্জনে যদি তাদেরও বিরাট ত্যাগ ও অবদান থেকে থাকে, তবে কেন তাদের কেবল ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবের মধ্যে আটকে থাকতে হবে? এটা কি বীরের সম্মান না অধঃস্তনের প্রতি করুণা ও অবজ্ঞা?
একাত্তরের সব থেকে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ নারীরা। তাদের ঘরে থাকা সহজ ছিল না, পালানো ছিল আরো কঠিন। যুদ্ধে যেতে চাওয়াও যখন প্রায় অসম্ভব ছিল, তখনও যুদ্ধে সামিল হয়েছেন এমন নারী বিরল নয়। অথচ সত্তরের ডিসেম্বরে ছাত্রীদের কাঁধে ডামি বন্দুক দিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হলেও যুদ্ধের সময় মেয়েদের নিয়ে আলাদা কোনো বাহিনী গঠন কিংবা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ধর্ষিতার সারিতে তারা, গণহত্যার মোট সংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশও তারা। শাহীন আফরোজের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। জাতীয়তাবাদ কি তবে পুরুষের মতাদর্শ?
আজ এতদিন পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঘৃণায় কথার আগ্নেয়গিরি জ্বালানো বরং সহজ; কিন্তু কঠিন সেসব নারীদের কথা বলা; স্বাধীনতার দাম যাদের সবচেয়ে বেশি মূল্যে শুধতে হয়েছিল। সরকারি হিসাবে আড়াই লাখ এবং কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় চার লাখ নারী একাত্তরে ধর্ষিত হয়েছিলেন। ৮ থেকে ৮৭ বছর বয়সের। একবার নয়, একদিনের জন্য নয়_ বারবার অনেক দিন ধরে অমানবিক পরিবেশে আটক থেকে। আত্মহত্যা করারও উপায় ছিল না। মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সিলিংয়ে ঝুলে পড়তে না পারে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তাদের নিপীড়নের ভয়াবহতার পুরোটা প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ নয়। আমরা পুরুষরা সেই নিপীড়নের শিকার হতে পারি না বলে হয়তো পুরুষালি ভাষায় তা প্রকাশ করাও কঠিন।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কারো মতে ১০ লাখ কারো মতে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। বেশি সংখ্যাটাই যদি ধরি এবং এর কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি নারী হন, তাহলেও ৬ লাখ নারী নিহত হয়েছিলেন। ৪ লাখ চরম নির্যাতিত (এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন) আর ৬ লাখ নিহত নারীর পরিণতি আমাদের জাতীয় মানসে কোন দাগ রেখে গেল? এই দশ লাখ নারী কেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে না। জাতীয় মুক্তির যুদ্ধের ‘গৌরব’ কি কেবলই পুরুষেরই? ১৯৭৩ সালে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন নারী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের দরিদ্র নারী তারামন বিবি। তিনি তার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পাওয়ার খবর জানতে পারেন ঘটনার ২৪ বছর পর।
ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (ব্রাউমিলার, ১৯৭৫: ৮৪)। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির পুরোধা এমএ হাসান দাবি করেন, ‘এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ এদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস। বাহাত্তর সালের গোড়াতেই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি তাঁর কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে নষ্ট করেছে। এত কিছুর পরও যারা জন্মাতে পেরেছিল তাদের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা, ভিখারির কাছে বিক্রি করাসহ বিদেশে দত্তক দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। এই নারীদের অনেকেরই প্রজনন ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
মাদার তেরেসা সেসময় এসব নারীদের সহযোগিতা করতে ঢাকায় আসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনেক শিশুকে কানাডা, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে পাঠানো হয়। এসব শিশুর নাম দেওয়া হয় ‘যুদ্ধশিশু’ (ওয়ার বেবি)। আজ তারা কী করছে, কী করছে তাদের হতভাগ্য মায়েরা? ‘কে আর ইতিহাস খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ হয়তো এ কারণেই যৌন নির্যাতন বিষয়ে তদন্তে যাওয়ার বদলে বিষয়টিকেই নীরবতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এসব নারীর ‘মানমর্যাদার’ কথা চিন্তা করে নষ্ট করে দেওয়া হয় তাদের নামধাম, নথিপত্র। এভাবেই জাতীয় অহম রক্ষার জন্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ইতিহাস থেকেও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। নির্যাতিত বা শহীদ নারীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ তো দূরের কথা একটা স্মারক পর্যন্ত নেই কোথাও। এখনকার কথা বলি। অতিসম্প্রতি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি জেনারেল হারুন-অর রশীদ প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিষয়টা যত কম আলোচিত হয় তত ভাল।’ এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। পরিবারের সদস্যরাও সান্তনা ও মর্যাদা দেওয়ার বদলে তাদের কিছুটা ‘পতিত’ ও করুণ চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, জাতির ধারণা কি কেবলই পুরুষালি, নারীর অস্তিত্ব, ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতি সেখানে কোথায়?
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে আটক অবস্থা থেকে দেশে ফেরেন বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় তিনি বলেন, ‘দুই লাখ মা-বোন! এদের আমি কোথায় কী করব?’ ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’ (বাংলার বাণী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)। ‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা’দের একটা সুব্যবস্থা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সন্তানদের মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া. আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না।’ (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল। কিন্তু এর মোকাবেলা না করে কর্তাব্যক্তিরা এটাকে চেপে যাওয়াই সঠিক মনে করেছেন। সরকারের তরফ থেকে এসব নির্যাতিত নারীকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তারা ভেবেছেন সেটাই নারী জীবনের একমাত্র গন্তব্য। অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন, তবে মোটা যৌতুক চান। যৌতুকের লিস্টির মধ্যে লাল জাপানি গাড়ি থেকে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করা পর্যন্ত ছিল। তাদের যুক্তি: এদের অভিভাবক হিসাবে যৌতুক মেটানোর দায়িত্ব সরকারের। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বাবা।’ ইতিহাসের দায় কি এতেই শোধ হয়? ড. ডেভিস মন্তব্য করেন, ‘না, কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি।… পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল (সাক্ষাৎকার, বিনা ডি কস্টা, ২০০২)।
জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদাবোধ আর পারিবারিক পবিত্রতার পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ একজোট হয়ে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে নারীর নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকে ‘বীরাঙ্গনা’ নামের আড়ালে ঢেকে দেয় এসব তার প্রমাণ। পরিবারের পিতা বা বড় ভাই আর ‘জাতির পিতা’ এখানে এক সুরে কথা বলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরুষালি ইতিহাস নারীকে কেবল সতীত্বের তকমা আঁটা চেহারাতেই দেখতে চেয়েছে। নারী যুদ্ধও করবে, পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বলিও হতে পারবে কিন্তু কোনোভাবেই পুরুষের পরিবারের সদস্য হওয়ার অনুপযুক্তা হতে পারবে না – তাকে ‘শুদ্ধ’ থাকতেই হবে। জাতীয় জীবনে একাত্তর মহান আবেগের উৎস। কিন্তু কী সমাজে আর কী রাষ্ট্রে সেই আবেগের মহত্ব একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের কোনো ভাবেই মর্যাদা দিতে পারে না।
মুক্তির যুদ্ধ ছিল একইসঙ্গে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে নারীর লড়াইয়ের ইতিহাস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণ হতে পারে না। পুরুষের মুক্তিযুদ্ধ তাই একাত্তরের একমাত্র কাহিনী নয়। যুদ্ধটা নারীরও। সেদিন বাঙালি সত্তা যেমন আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি নারীসত্তাকে দলিত ও ধ্বংস করাটাও শত্রুর লক্ষ্য ছিল। নারী তাই দু’ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল – প্রথমত, নারী হিসাবে; দ্বিতীয়ত, বাঙালি মাতা হিসাবে, বাঙালিদের জন্মদায়িনী হিসাবে। পুরুষদের অনেকে রণাঙ্গনে ছিল, অনেকে ছিল পালিয়ে। তার মধ্যে ভয়, অভাব, অনিশ্চয়তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ নারীকে একা একা সংসার ও পরিবার টিকিয়ে রাখার লড়াই চালাতে হয়েছিল। তার যাবার জায়গাও ছিল না। অথচ এদিকটা ভুলে যাওয়া হয়। পুরুষরা প্রতিরোধ গড়েছিল আর নারীরা পেছনে থেকে সমাজ-সংসার টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়েছে। বাহাত্তরে না হয় নতুন রাষ্ট্র যাত্রা করলো, একই সঙ্গে সমাজ-সংসারও যে চলতে পেরেছিল তার কারণ নারীর এই দায়িত্বশীল ভূমিকা। রণাঙ্গনের লড়াইয়ের থেকে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এটি।
একাত্তরে নির্যাতিত ও শহীদ নারীদের কথা মনে হলে আমার তাই রূপকথার কাজলরেখার গল্প মনে পড়ে। সেই কাজলরেখা যে বিপুল অধ্যাবসায়ে সূচরাজার শরীর থেকে সমস্ত সূচ তুলে তুলে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর পুরস্কার সে পায়নি। পেয়েছে অন্য আরেকজন, কারণ সূচরাজার চোখের সূচ কাজলরেখাকে লুকিয়ে অন্যজন তুলেছিল। সূচরাজা ভেবেছিল, সেই-ই তাকে বাঁচিয়েছে। পুরস্কার পেয়েছে সেইজন, কাজলরেখা হয়েছে ‘চাকরানি’। কী বিষ্ময়কর যে, যশোরের মধুমিতার জীবনে (ছদ্মনাম) এরকম ঘটনাই ঘটেছিল। বাড়ির সবাই পালাতে পারলেও মধুমিতা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। তারা তাকে ধর্ষণ করে উঠানে ফেলে রেখে ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায়। তার ছোটো ভাই রয়ে যায় সেই ঘরের মধ্যে আটক। মধুমিতার জবানিতেই শোনা যাক :
‘তাদের কাজ হয়ে যাবার পর তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি তো আমার ভাইটিকে মরতে দিতে পারি না। তাই অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও নিজেকে কোনো মতে তুলে ভাইকে দরজা ভাঙায় সাহায্য করলাম। তা করতে গিয়ে মারাÍকভাবে পুড়ে গেলাম। সেই রাতে লুকিয়ে থাকলাম বাড়ির পেছনের পুকুরটাতে। পরদিন ভোরে যখন পুকুর থেকে উঠলাম, আমার গায়ের মাংস খাবলা খাবলা করে খসে পড়তে লাগল। দু’একটা টুকরা ছাড়া গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, গাঁয়ের কিছু লোক ভোরের নামাজ পড়ে ফিরছে। আমাকে দেখে তারা মজা পেয়ে হৈহৈ করে উঠল। আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম, আমি বেশ্যা নই, ওমুক আমার বাবা, আমাকে সাহায্য করুন। কিন্তু তারা চলে গেল। সেদিন থেকে আমি জীবন্ত মরা। আমার শরীরে যন্ত্রণা। আজ আমার কোনো শিক্ষা কোনো স্থান কোনো মর্যাদা নেই। ভাইয়ের জন্য আমার জীবন, সম্মান সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি। অথচ আমি এখন তার চাকরের থেকে বেশি কিছু না। এই-ই বাংলাদেশে মেয়েদের কপাল।’’ (ইয়াসমিন সাইকিয়া, ২৮৬, হিস্টরি ওয়ার্কসপ জার্নাল)
রূপকথার কাজলরেখা শেষপর্যন্ত প্রতিদান ও সম্মান পেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবের হালিমারা তা পায় না। কারণ জীবন রূপকথার মতো সুবিচারপূর্ণ নয়, বরং জীবন অবিচারের সাগর।
যশোরের হালিমা পারভীনের কাহিনীও কম মারাÍক নয়। ১৯৭১ সালে হালিমা অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে বড় মানুষ হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার পিতাকে নির্মম প্রহার করে। এ দেখে হালিমার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায়। তিনি তার পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অস্ত্র তুলে নেন। তারা ৩৫ জন তরুণ-তরুণীর একটি বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং নেন। হালিমা একাধিক অপারেশনে অংশ নেন এবং আর্মি ও রাজাকার হত্যা করেন। একটা পর্যায়ে স্থানীয় দালালরা খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তারা ঘেরাও হয়ে যান। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা দেন এজন্য যে, নইলে অনেক গ্রামবাসীও মারা পড়ত। তাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সামনেই সব পুুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। হালিমার সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন ফাতেমা ও রোকেয়া নামের আরো দু’জন নারী যো। হালিমার ভাষায় : যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমরা আরো হাজার হাজার নারীকে বন্দি থাকতে দেখি… তাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজ হাতে তাদের কবর খুঁড়তে হতো।… বাড়ি ফেরার পর আমি বুঝলাম আমার যুদ্ধ শেষ হয়নি। যদিও যশোর স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমি স্বাধীন হইনি। আমার যুদ্ধ যেন নতুন করে শুরু হলো। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আমার নিজ মানুষদের সঙ্গে, আমার নিজের দেশের সঙ্গে যাদের জন্য আমি যুদ্ধ করেছি, যাদের জন্য আমি সব হারিয়েছি। আমার যুদ্ধ এখনো চলছে (ওমেন ইন ফ্রন্টাল ওয়ার: শাহীন আফরোজ, ২০০৫)। হালিমা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধের মধ্যে বন্দি হন। কিন্তু তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠে নাই, উঠেছে বীরাঙ্গনার খাতায়। এই ছিল তার পুরষ্কার! হালিমা ছোটবেলায় চেয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। সেই সাধ অর্ধেক পূরণ হয়েছে। তিনি ডাক্তার হতে পারেননি, অনেক কষ্টে সিভিল সার্জন অফিসের আয়া হতে পেরেছেন।
মধুমিতা বা হালিমার কণ্ঠ আরো অনেক বাংলাদেশি মেয়ের মতো। সেই কণ্ঠ নির্যাতিতের কণ্ঠ। যোদ্ধা হওয়া বা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের গর্বের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে তার সর্বনাশের ইতিহাস। তারা ছিল পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের দেশিয় দোসরদের কাছে ‘শত্রু শরীর’। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের শরীর হলো `নাপাক’। জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম এখানে একাকার হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা তাদের দেশ ও জাতি রক্ষার নামে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, ফেলে গেছে পুড়ে মরার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জীবন জ্যান্ত মরা’র থেকে বেশি কিছু হয়নি। এটা এমন এক দেশ যেখানে ধর্ষিতা নারী তা একাত্তরেরই হোক বা পরেরই হোক, সবক্ষেত্রে তারা বিচার পায় না, প্রায় নিরানব্বই জন নির্যাতিত নারীকে সামাজিকভাবে অমর্যাদাই করা হয়। জাতির জীবনে ধর্ষণ এত বড় দাগ রেখে গেলেও এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে আজো নারী নির্যাতিত হয়। আজো নির্যাতিত হওয়ার দায় নির্যাতক পুরুষের চেয়ে নারীকেই বেশি বহন করতে হয়। একাত্তরের নারী নির্যাতনের বিষয়টি যদি আমরা খোলা চোখে দেখতে পারতাম, রাষ্ট্রীয় ভাবে যদি তাদের সত্যিকার মর্যাদা দিয়ে পুনপ্রতিষ্ঠা করতে পারতাম তাহলে হয়তো নির্যাতিতকে হেয় চোখে দেখার এই অমানবিক চল এদেশ থেকে বিলুপ্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি।
তাই মধুমিতাদের গায়ের পোড়া মাংসের ঘ্রাণ আমাদের নাকে লাগে না। তাদের যন্ত্রণাও আমরা টের পাই না। আমরা তাদের ফেলে এসেছি দূর অতীতে_ কখনোই না ফুরানো একাকীত্বের মধ্যে, যেখানে তাদের স্মৃতি, ভয়, উদ্বেগ অথবা আশার কোনো অংশীদার নেই। তারা একাকী যন্ত্রনাভোগের সেই অনন্ত ব্যথার রাজ্যে বন্দী। আজো তাদের ‘…ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’।
পরিশিষ্ট : এটি বছর তিনেক আগের একই বিষয়ের লেখার বর্ধিত সংস্করণ।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪৫ comments
মুয়িন পার্ভেজ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:১৭ পূর্বাহ্ণ)
তথ্যঋদ্ধ ও মমতামাখা এ-লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ফারুক ওয়াসিফ। নারীদের — যাঁরা একাত্তরে নির্মমভাবে নির্যাতিতা — অতুলনীয় আত্মত্যাগের মর্যাদা আমরা সত্যিই রাখতে পারিনি। ‘বীরপুরুষ’দের যুদ্ধ শেষ হলেও ‘বীরাঙ্গনা’দের যুদ্ধ যে চলতে থাকে আজীবন, তা উঠে এসেছে যশোরের মধুমিতা ও হালিমা পারভীনের আত্মকথায় :
তবে অবিমৃশ্যকারী হয়ে ব’সে থাকার সময়ও আর নেই। স্বদেশে-বিদেশে যুদ্ধাপরাধীরা যে-শিকড় গেঁড়েছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বা সরকারি সৌজন্যে (১, ২, ৩), তা উপড়ে ফেলতে হলে যথাযথভাবে আইনি আঘাত হানার এখনই সময়।
২
সবিনয়ে জানাচ্ছি, ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির ব্যাখ্যা যদি ‘বীরের অঙ্গনা’ হয়, তবে ‘বীরপুরুষ’ শব্দটির ব্যবচ্ছেদও এরকম হওয়া উচিত : ‘বীরের পুরুষ’। কিন্ত এর কোনো কার্যকর অর্থ দাঁড়ায় কি? শব্দটি কর্মধারয় সমাসে সিদ্ধ; অর্থাৎ, ‘বীর’ (বিশেষণ) [যে-] ‘অঙ্গনা’ (বিশেষ্য)।
ফারুক ওয়াসিফ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:৩৯ অপরাহ্ণ)
১) এর উত্তরে বলবো, এযাবত একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞার পার্শ্ব ইস্যু হিসেবেই গণধর্ষণ-যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের প্রসঙ্গটি আসে, অন্যতম প্রধান অপরাধ হিসেবে নয়। যেমন, চলতি জীবনেও নারীর অবমাননা, নির্যাতিতা হওয়া ইত্যাদি ‘ঘটে থাকে, চলতে পারে’ জাতীয় মানসিকতায় দেখা হয় পুরুষতান্ত্রিক-নৈতিকতায়। সেজন্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তারা নেই, তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রকাশ্য বা গোপন কোনো ভূমিকাই নাই, ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেওয়া ছাড়া।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার যে দাবি তার মধ্যেও এটা প্রধান প্রসঙ্গ নয়। কখনো কখনো মনে হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির ভিত্তি কেবল গণহত্যা বা ধর্ষণ নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরাজিত প্রতিপক্ষের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। রাজনৈতিক বলেই তা ভুলে কখনো জামাতিদের সঙ্গে রাজনীতি করা চলে, কখনো দাবিটা লো-ভয়েসে রাখা চলে আবার কখনো ভলিউম বাড়ানোও চলে।
তাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলেই বিষয়টার মীমাংসা হয় তা নয়। সেটা পুরুষের প্রতিহিংসা তৃপ্তির বাইরে যাবে না। ব্যাপারটা এরকম যে, ‘আমার’ নারীকে নির্যাতন করেছিস, তোর রক্ষা নাই। নারীর জায়গা থেকে বিষয়টা দেখতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সুফল একাত্তরের নির্যাতিতা নারী কোনোভাবে পায় না, যদি না এ ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসে, রাজনীতিতে ও সমাজে তাদের মর্যাদার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার রাস্তা তৈরি হয়। তারপরো মানলাম, ধর্ষকদের বিচার হলো, কিন্তু যারা এতকাল অবজ্ঞা করেছে, যাদের নীরবতা ও সচেতন বাধার জন্য ঐ নারীরা আর সত্যিকার মানুষের জীবনে ফিরতে পারেনি, অনেকে আত্মহত্যা করেছে, অনেকে পতিতালয়ে জীবন শেষ করেছে ইত্যাদির জন্য যারা দায়ী তাদের বিষয়ে কী করণীয় বলবেন কি? এটা কি তাদের অপরাধ নয়? এবং সেই অপরাধ যুদ্ধাপরাধ নিশ্চয় নয়, তাহলে কী? কীভাবে তার বিচার হবে???
ফারুক ওয়াসিফ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:৪৩ অপরাহ্ণ)
পুরুষের মহিমাকীর্তনের জন্য তো বীর শব্দের বাড়তি কোনো বিশেষণ লাগেনি। ’অঙ্গনা’ সে কার অঙ্গনা? কার সাপেক্ষে তা? তাই আমি বীরাঙ্গনার মধ্যে বীর যে অঙ্গনা না দেখে বীরের অঙ্গনার ব্যাঞ্জনাই পাই বেশি। আমার ভুলও হতে পারে।
রেজাউল করিম সুমন - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৪২ অপরাহ্ণ)
‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ দুটি অভিধান থেকে :
বঙ্গীয় শব্দকোষ-এর মতে :
আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান-এর মতে :
যে-নারী নিজে বীর তিনি যেমন বীরাঙ্গনা [একই অর্থে আমরা বলি : ‘বীরকন্যা’ প্রীতিলতা] , তেমনি বীরের স্ত্রীও বীরাঙ্গনা।
মুয়িন পার্ভেজ - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (১০:৫৩ অপরাহ্ণ)
‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির আভিধানিক ব্যাখ্যার জন্য রেজাউল করিম সুমনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধান-এ (শৈলেন্দ্র বিশ্বাস-সঙ্কলিত, চতুর্থ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪, সাহিত্য সংসদ্, কলকাতা) দেখছি, আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান-বর্ণিত ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করা হয়েছে:
(পৃ. ৫১৭)
তবে বঙ্গীয় শব্দকোষ-নির্দেশিত দ্বিতীয় অর্থটিও যে দিব্যি চলতে পারে, তা বোঝা যায় ‘গুরুপত্নী’ বা ‘বন্ধুস্ত্রী’র কথা মনে এলে। ক্ষেপণাস্ত্রের যুগে সত্যিকারের বীরপুরুষের দেখা পাওয়া যায় না ব’লেই হয়তো আজকাল ‘বীরাঙ্গনা’র ব্যঞ্জনা বেশি পাই ‘বীর’-এর ভূমিকাতেই!
মাসুদ করিম - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
আমরা যারা যারা এই দাবি করছি, এটা আমাদের প্রধান প্রসঙ্গ নয়, জেনে ভালো লাগল! কী অসাধারণভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে পরাজিত প্রতিপক্ষের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বললেন! এই মন্তব্য উদ্দেশ্যমূলক, নারীবাদের মোড়কে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির বিরুদ্ধ মতামত।
ফারুক ওয়াসিফ - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৩৮ অপরাহ্ণ)
কথাটাকে আপনি নিজের গায়ে নিচ্ছেন কেন বুঝলাম না।
এই বুঝলেন শেষে! এ রাম আমি কোথায় যাব।
আপনার এই মন্তব্যে খুবই আহত ও আক্রান্ত বোধ করলাম। বহু পরিচিত এমন লাইনের কলঙ্কলেপন। যদি মরিয়াই প্রমাণ করতে হয় তো বলবো বহুবার মরে, মার খেয়ে এবং মার দিয়ে সেটা প্রমাণ করেছি। আরেকবার নাহয় না-ই দিলাম্
যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির ইতিহাস স্বাধীনতার বয়সের মতোই দীর্ঘ। সবাই এক জায়গা থেকে একভাবে করেনি। ইতিহাস বিস্মৃত হলে হবে কেন? এই নিয়ে কম রাজনৈতিক বাণিজ্য তো হয়নি। জাহানারা ইমামের সঙ্গে প্রতারণা কারা করেছিল? কারা গোলাম আযমের কদমবুসিতে পাঠিয়েছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে? আজো যে কায়দায় বিচারের তোড়জোর হচ্ছে, তাতে গুটিকতেক চিহ্নিত অপরাধীকে হয়তো শূলে চড়ানো হবে (আসলেই হবে কিনা সন্দেহ আছে), কিন্তু গণহত্যা, ধর্ষণ, বসতি পোড়ানো, নির্যাতনসহ অজস্র অপরাধের যে সার্বিক আয়োজন ছিল, তার কতটাকে বিচারের আওতায় আনার কার্যক্রম বা আইন আছে? বিএনপি করবে না জানা কথা, কিন্তু আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতায় থাকা আর বাইরে থাকার ইতিহাসে কয় পা এগিয়েছে এই পথে? কোনো নথিবদ্ধ প্রমাণ আছে? আছে নিহতদের নিয়ে কোনো জরিপভিত্তিক পরিসংখ্যান? সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম করে কেন ইস্যুটাকে কিছু অব: জেনারেলদের হাতে নিয়ে যাওয়া হলো? জাহানারা ইমামের সময়ে তো সর্বনাগরিকের এখানে প্রবেশাধিকার ছিল, সেজন্যই তা হয়ে উঠেছিল জাতীয় আন্দোলন। আজ কমান্ডাররা সেমিনার করে এই বিচার করে ফেলবার খোয়াব দেখাচ্ছেন। সরকার দেখাচ্ছেন আশাবাদ। আন্দোলনটা তাদের হাতে এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামে আছে। এ কে খোন্দকার এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, মোশতাকে মন্ত্রীসভার শপথ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। জেনারেল হারুন, ডেস্টিনির মালিকপক্ষীয় একজন। শাহরিয়ার কবীরদের সম্পর্কে নতুন করে বলবার কিছু নাই।
সেকারণে আমলীগের দাবি আর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নাগরিক বৃত্তের মধ্যে থাকা দাবি কখনো মেলে আবার কখনো কিছুটা আলাদাও থাকে। এই আলাদা থাকা অবস্থানের সমালোচনাকে যখন আপনি বিচারের বিরূদ্ধ মত বলবেন, তখন চিরপরিচিত আমলীগের সমালোচক মানেই বিএনপি-জামাত জাতীয় রোগের দেখা পাই। তারপরও যেভাবেই হোক বিচারটা হওয়া প্রয়োজন। এই আদিপাপের শাস্তি হলে রাজনীতি কিছুটা এগবে। সেজন্যই বিচার প্রশ্নে সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে বা থাকা উচিত। তবে বিচার দাবি শর্তহীন হলেও সরকারের প্রতি সমর্থন শর্তহীন হওয়া কঠিন আমার জন্য।
২.
নব্বই এর আগের আপোস আর নব্বই এর পরের এক দশকে এ নিয়ে যতটা উচ্চবাচ্য হয়েছে, কাজ তো তেমন কিছূই হয়নি। সেকারণে বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণহত্যাগুলোর মধ্যে পড়ে না। আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হলে যে নথিবদ্ধ প্রমাণ দরকার তা নেই। ৭২-৭৩ সালে মাত্র ১১৮ জনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের আওতায় আনা হয়েছিল। সংখ্যাটা কি এতই কম? বিচার করার কথা উঠছে ওয়ার ক্রাইম অর্থে, জেনোসাইড ও জেন্ডারসাইড অর্থে কি আইনী বা রাজনৈতিক প্রস্তুতি আছে?
পাকিস্তানীদের পাওয়া না গেলেও দেশের ভেতরের দায়ীদের অপরাধ, ভূমিকা সম্পর্কে জাতিকে পূর্ণভাবে অবহিত করতে ট্রুথ কমিশন গঠন করতে হবে। জানাতে হবে সেসময় কী হয়েছিল। এটা ঘৃণা বা প্রিতিহিংসার প্রশ্ন নয়, জরুরি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় কর্তব্য। অপরাধীদের চিহ্নিত করতে হবে। তারপর ঠিক করতে হবে কোন মাত্রার অপরাধকে বিচারের আওতায় আনা হবে সেটা। বিষয়টা গলার বা মনের জোশের নয়, অনেক জটিলতা আছে। এগুলোর মীমাংসা করতেই হবে, কারণ এইবারে যদি পূর্ণাঙ্গভাবে এটা না করা যায়, তাহলে চিরতের সেই সুযোগ হারাতে হতে পারে।
*** আপনি আমরা/আপনারা একটা ভেদ তৈরি করে নিয়েছেন। আমার অভিযোগ ছিল আওয়ামী বৃত্তের প্রতি। আপনি স্বেচ্ছায় নিজেকে সেই বৃত্তের বলে চিহ্নিত করলেন। সেহেতু বলতে হচ্ছে, জ্বি অভিযোগটা বহালই থাকছে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়ার জন্য আমলীগার হওয়া লাগে না। জাহানারা ইমাম কোনো দলের ছিলেন না।
মাসুদ করিম - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:০৫ অপরাহ্ণ)
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বিষয়ে আপনার পক্ষ বুঝতে পারলাম। কিন্তু ‘আমলীগ’ এটা কি টাইপিংয়ের ভুল ? নাকি আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত রূপ ? যদি তাই হয় তাহলে জানতে চাই আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘আমলীগ’ ঠিক কী করে হয়?
আপনার পোস্টটিতেও আপনি ‘বীরাঙ্গনা’র একটি মনগড়া অর্থ বের করেছেন, ‘আমলীগ’ও আপনার মনগড়া তাহলে ?
রায়হান রশিদ - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:২৮ অপরাহ্ণ)
বিষয়টা অতটা সাদামাটা না মনে হয় মাসুদ ভাই। ফারুক ওয়াসিফ এর মন্তব্যে একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী উঠে এসেছে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে নানা ধরণের অবস্থানের মধ্যে এই দৃষ্টিকোণগুলোও রয়েছে; আর তার সবগুলোই উদ্দেশ্যমূলক ধরে নিতে গেলে আমরা মনে হয় বিরাট ভুল করে বসবো। কারণ সেই পথ আরও বেশী বিভক্তির। এটা ঠিক যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে এক ধরণের চিন্তার clarity দরকার, uniformity দরকার, consensus দরকার (অন্তত বিবেকবান, প্রগতিশীল, সুবিচারপ্রার্থী মানুষদের মধ্যে তো বটেই), আর তা নাহলে এই বিচার করা আদৌ সম্ভব হবে না। এটা ঠিক যে এ মুহুর্তে বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানগুলোর সবগুলো (যেমন: মৃত্যুদন্ড ইস্যু, তথাকথিত আন্তর্জাতিক মানদন্ড ইস্যু, বিহারি ইস্যু) বিচার প্রক্রিয়াকে সরাসরি সহায়তা করে না, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ এবং এমনকি বাধাগ্রস্ত পর্যন্ত করে। হালে এই সব অবস্থানের কিছু কিছু এমনকি জামাতপন্থী একাডেমিক এবং লবিইস্টরাও ব্যবহার করছেন দেশ বিদেশে তাদের গা-বাঁচানোর কিংবা ডাইভারশন তৈরীর মতলব থেকে। আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিছু মানবাধিকার গ্রুপও কিন্তু এই সব বিষয়ে (অনেকটা হুট করেই বলবো) অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে (যেমন: ১৯৭৩ আইন, ট্রুথ রিকনসিলিয়েশন ইত্যাদি)। সব অবস্থানেরই জরুরী দিক এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক রয়েছে। কারণ, হতে তো পারতো অনেক কিছুই, এখনো করা যেতে পারে হয়তো অনেক কিছুই। কিন্তু বিচারের বিষয়টা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত সর্ব অর্থেই, সব আলোচনায়, সব সাংগঠনিক কর্মকান্ড এবং অবস্থানে। ৩৯ বছর অলস speculation এবং এর তার ছিদ্রান্বেষণে পার করে দিয়েছি আমরা, এখন আর সময় অবশিষ্ট নেই। তাই আমাদের কাজ হওয়া উচিত যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে যথাসম্ভব একটা গ্রহণযোগ্য (এবং তার চেয়েও জরুরী বাস্তবায়নযোগ্য) “সাধারণ অবস্থান” গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করা। ফারুক ওয়াসিফের পোস্টে সেই সুযোগটা তৈরী হয়েছে, কারণ তিনি অত্যন্ত কম আলোচিত একটা দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেছেন।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:২৪ অপরাহ্ণ)
লেখাটা পড়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম, আসলেই জাতির পিতা আর গৃহস্থ পিতার মনোভঙ্গী এখানে একই রকম। আমরা ঠিক কতটা বর্বর, কতটা মানুষ? আমাদের কাছে এমনকী জীবনের অবসানও গ্রহণীয় নারীর কৌমার্য এবং শারীরিক শ্লীলতা(!)র হানির কাছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম মহাত্মা গান্ধী মেয়েদের বিষ রাখতে বলেছিলেন ধারেকাছে, যাতে শ্লীলতাহানির আগেই তার মৃত্যু হয়, হাঃ বিংশ শতকের জহরব্রত! স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে সবার ফিরে আসা ছিল আনন্দের, আকুলতার, শুধু এইসব অসম্ভব নির্যাতিতা নারীদের ছাড়া। আমার জানতে ইচ্ছা করে, সেইসব মিলিটারীরা, যারা ফিরে গেছিল বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণ করে, তারা এখন কেমন জীবন যাপন করে? তাদের ছেলেমেয়েরা তাদের ঈদে-চাঁদে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে কি? তাদের ঘুমের ব্যাঘাত কখনো ঘটে কি? রুটিতে লাল সুরুয়ার মাংস জড়িয়ে খাবার সময় তাদের কখনো মৃতদের কথা মনে হয় কি? ধর্ষকের জন্যে বাকী জীবনের কোথাও কিছু আটকে থাকেনা, অথচ ধর্ষিতার জীবন অব্দি থমকে যায়! কেন?
মুক্তিযুদ্ধের নায়করা বলছেন, এবিষয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো, এমন মনোভাব আমাদের কী করে হলো? নারীনির্যাতন এবং নারীধর্ষণ চরম অপরাধ না হয়ে গোপন অসুখ হয়ে গেলো কী করে?
মুক্তিযোদ্ধাদের পণ নিয়ে বীরাঙ্গনাদের বিয়ে করবার সংবাদ পড়ে একটা কথা মনে হলো- বাঙালী বড় অদ্ভুত জাত, বাংলাদেশের মেয়েদের বিয়ে করবার বেলায় তারা কত কী দ্যাখে, কত লক্ষণ, কত বৈশিষ্ট্য, কত পূর্বাপর ইতিহাস, এইসব বীরপুঙ্গব যখন বিদেশে যায়, তখন অনায়াসে পশ্চিমানারীর গলায় ঝুলে পড়ে, তখন বারনারীতুল্য যৌন ইতিহাসও বাধা হয়ে দাঁড়ায়না (কারণটা কি পুঁজি? আবারো?)। তার নারী মাপবার বাটখারা অক্ষাংশভেদে পরিমার্জিত ও পরিশোধিত হয়।
এবছরের বিডিআর হত্যাকান্ডের সময় কিংবা পরে কেউ নারীনির্যাতনের প্রসঙ্গ তুললোনা, এমনকী নারীরাও না। শুধু মাঝে মাঝে কারো কারো আত্মহত্যার খবর শুনতে পেলাম আমরা। সহকর্মীদের সাথে আলাপ করবার সময় আমার উষ্মা দেখে রীতিমত বিরক্ত হয়ে একজন সহকর্মী বললেন- আপনি মিলিটারীদের চেনেন? একটা সন্দেহের কারণ ঘটলে এরা বরং তালাক দিয়ে দিবে, এই মেয়েগুলি বাচ্চাগুলি তখন যাবে কোথায়?
এই তো আমার দেশ, আগেও তাই ছিল, এখনো তাই আছে।
অবশ্য নারীর অবস্থান হয়তো বিশ্বময় আসলেই চিরসংখ্যালঘুর। আমার মনে পড়ে এথনিক ক্লেনজিং এর নামে বসনিয়ান নারীর বর্বর ধর্ষণ, সেইসব ওয়ার চাইল্ডদের মায়েদের তখনকার পোপ বলেছিলেন- ভালবেসে সেই শিশুদের বুকে তুলে নিতে, (এই নারীদের যাদের অনেকেই ভূমিষ্ঠ শিশুর মুখ দেখেননি ঘৃণায়, কেননা এইসব শিশুরা তাদের ভালবাসার ফসল নয়, এরা তাদের নির্মম নির্যাতনের অবিরাম স্মারক।) বলেননি- এই ধর্ষণ থামাও, মানুষের প্রতি মানুষের এই সর্বোচ্চ বর্বরতা থামাও।
ফারুক ওয়াসিফ - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (১১:৫৪ অপরাহ্ণ)
নারীর নির্যাতনকে গোপন করা, মানে কার কাছ থেকে গোপন করা? অন্য পুরুষের কাছ থেকে নয় কি? তাতে এই পুরুষের ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয়। কিন্তু যিনি নির্যাতিত তার বেদনা লাঘবের কী সুযোগ রাখা হলো? তাকে তো নির্যাতনের ক্ষত নিয়েই নিজের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হয়।
১) এর উত্তরে বলবো, এযাবত একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞার পার্শ্ব ইস্যু হিসেবেই গণধর্ষণ-যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের প্রসঙ্গটি আসে, অন্যতম প্রধান অপরাধ হিসেবে নয়। যেমন, চলতি জীবনেও নারীর অবমাননা, নির্যাতিতা হওয়া ইত্যাদি ‘ঘটে থাকে, চলতে পারে’ জাতীয় মানসিকতায় দেখা হয় পুরুষতান্ত্রিক-নৈতিকতায়। সেজন্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তারা নেই, তাদের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রকাশ্য বা গোপন কোনো ভূমিকাই নাই, ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেওয়া ছাড়া।
এই গল্পের অন্য অংশ ইয়াসমিন সাইকিয়ার গবেষণায় রয়েছে। ভিলেন এখানে বাঙালি যুবক। এর উল্লেখ ছাড়া চিত্রটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। একটা অংশ তুলে দিই আমার অনুবাদে:
এ গল্পটি বলেছে বিমান (ছদ্মনাম)। ‘‘এপ্রিলের তিন তারিখে পাকস্তানি বাহিনী শহরে ঢোকে। রেলওয়ে কলোনির বিহারিরা তাদের দেখে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা শুরু করে। দেখে আমাদের মনে রাগ জাগল। আমি এবং আমার পাঁচ বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, তাদের একটা শাস্তি পাওনা হয়েছে। আমরা এক প্রতিবেশী বিহারির বাড়িতে গেলাম। তাকে আমি ‘চাচা’ ডাকতাম। তার মেয়েটি আমার বোনের বান্ধবী। সে আমাকে ‘ভাই’ বলত। কিন্তু সেদিন সব মানবিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
আমরা জোর করে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ি… মেয়েটিকে ধরি এবং তার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলি। কিন্তু সে আমাদের হাত থেকে ছুটে পালায়। আমরাও পিছু নিই। তার পেছনে ছোটা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমার মনে কেবল তখন একটাই চিন্তা, আমি এই মেয়েটিকে ধর্ষন এবং বিনাশ করব, ওরা আমাদের শত্রু।… সেই মুহুর্তেই বুঝলাম আমার ভেতরে শয়তান জন্ম নিচ্ছে। আমার কাছে মানুষ মারার অস্ত্র আছে, আমার প্রশিক্ষণ আছে। ট্রেনিং দিয়ে আমাকে সাপের মতো ঠাণ্ডা বানানো হয়েছে। যুদ্ধের সময় আমি ভেবেছি, ‘এ আমার কী হলো’? এখন এতদিন পর এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, অনেক অপরাধ আমার। জাতীয়তাবাদ খারাপ জিনিস।’’ (সাইকিয়া, ২৮৬)..
২.
আপনার তীক্ষ্ণ মন্তব্যে প্রাণিত হয়েছি। ধন্যবাদ। আমি বিশ্বাস করি, পুরুষ তিনি যা-ই হোন পুরুষের সুবিধাবাদী অবস্থান একেবারে ঘোচাতে পারেন না। সেকারণে পুরুষ দৃষ্টি দিয়ে নারীর অধস্তনতাকে পুরোপুরি বোঝাও যাবে না। সংগ্রামটা যৌথ বটে, তবে পুরুষ নিজে যতক্ষণ না তার পুরুষালী বোধ থেকে মুক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ সে নারীর মুক্তির বাধা।
ভাবাল প্রশ্নটা, মনে পড়লো ঊনিশ শতকের একটি ঘটনা। ব্রিটিশ যুবরাজ সপ্তম কী অস্টম এডওয়ার্ড কলকাতায় এলে কলকাতার রক্ষণশীল রাজামহারাজারা তাদের অন্দরমহলে আসূর্যস্পর্শা স্ত্রীদের সামনেও তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। উর্ধ্ধতনদের কাছে গেলে নৈতিকতা, পৌরুষ বোধহয় কিছুটা শিথিল হয়ে যায়।
শাদা চামড়ারা প্রভু ছিল, তাই বোধহয় তাদের নারীদের বিয়ে করায় সনাতন নৈতিকতা উপনিবেশিক জেরে শিথিল হয়েও সুখ পায়।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৭:৪৬ অপরাহ্ণ)
“নারীর নির্যাতনকে গোপন করা, মানে কার কাছ থেকে গোপন করা? অন্য পুরুষের কাছ থেকে নয় কি? তাতে এই পুরুষের ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয়। কিন্তু যিনি নির্যাতিত তার বেদনা লাঘবের কী সুযোগ রাখা হলো? তাকে তো নির্যাতনের ক্ষত নিয়েই নিজের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হয়।”
যতদিন আমরা নারী নির্যাতন সংক্রান্ত শব্দাবলী নির্ভয়ে উচ্চারণ করতে সমর্থ হবো, ততদিন নারী হিসেবে, রাষ্ট্রএর নাগরিক হিসেবে আমরা যুদ্ধাপরাধ এবং নারীর প্রতি দৈনন্দিন অপরাধগুলির কোনো বিচার করতে সমর্থ হবোনা। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, গাওছিয়া বা চাঁদনিচক এ ভিড়ের ভিতর যেসব নোংরামি ঘটে, তাতে আজকাল বহু মেয়ে চেঁচিয়ে আপত্তি জানায়, এরকম একজন আমাকে বলেছিলেন যে লোকটি তার সাথে এই আচরণ করেছে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জভাবে জিজ্ঞেস করেছে- কি করেছি আমি? বলেন কি করেছি? না বলতে পারলে কেমনে হবে?” মেয়েটি আর কিছু বলতে পারেননি। এই আর-কিছু বলতে না পারার লজ্জা-সহনশীলতা-মূর্খতার বেষ্টনীতেই আমরা বড় হয়েছি, যতদিন আমরা এই ‘আর-কিছু’ বলতে না জানবো, যতদিন শব্দ এবং শব্দীয় বিবরণ নিয়ে আমাদের ট্যাবু না কাটবে, ততদিন আমরা যুদ্ধে নির্যাতিতা একটি নারীরও কন্ঠস্বর হতে পারবোনা। নির্যাতন গোপন করবার পথ ধরেই নির্যাতন সইবার পথ তৈরী হয়, নির্যাতন ভুলবারও।
নির্যাতন লাঘব হবার পথ নির্যাতকের শাস্তি, নির্যাতন ভোলেনা কেউ, শারীরিক বা মানসিক, কিন্তু আমি মনে করি নির্যাতকের শাস্তির মাধ্যমেই কেবল নির্যাতিতাকে কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্র জানায় যে রাষ্ট্র তার প্রতি মানবিক, সহানুভূতিশীল।
ইউরোপের পার্কগুলিতে বহু নারী ধর্ষিত হয়, কয়দিন আগে একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলা লন্ডন দেখতে এসে রাতে লন্ডনের পার্কে ধর্ষিত হন, এঘটনার আগে মহিলা সদ্যপরিচিত ধর্ষকদের সাথে বীয়র খান, এবং সেন্ট জে্মস পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে থাকেন। রাষ্ট্র কিন্তু ধর্ষকদের পাকড়াও করেছে, তাদের আদালতে হাজির করেছে, রাষ্ট্র বলেনি- কোন ধরণের মেয়ে মদ্যপান করে আমরা জানি। কোন ধরণের মেয়ে সন্ধ্যারাতে পার্কে হাঁটতে যায় আমরা জানি।” রাষ্ট্র তার পিতা/যাজক হবার চেষ্টা করেনি, তার নিজের দায়িত্ব পালন করেছে।
ধর্মপ্রাণ এবং ধর্মীয়রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল একজন মানুষকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একবার- ধর্ষণের শাস্তি বিষয়ে। তিনি অম্লানবদনে বলেছিলেন- ধর্ষিতারও দায় আছে, দেখতে হবে সে ধর্ষনে উদবুদ্ধ করেছে কীনা!” কি অদ্ভু্ত!
অতএব আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দশা, আমাদের ধর্মীয় মনোভাব, আমাদের শ্লীলতাবোধ এইসব সবকিছু থেকে আমাদের আইনপ্রয়োগ এবং শাস্তিপ্রদানের জায়গাগুলিকে মুক্তি দিতে হবে। যাতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলতে না পারেন- সব মেয়ে বাদ দিয়ে ছেলেরা ঐ মেয়েটাকে ধরলো কেন, এইটা দেখার বিষয়”, কোনো পুলিশ ইয়াসমীনকে ধর্ষণ করে হত্যা করে বলতে না পারে- মাইয়াডা বদচলন আছিল”। ধর্ষণ বা নারীনির্যাতনের শাস্তি দেবার পরে যাতে নির্যাতিতা নারী সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারে এবং স্বাভাবিক জীবনের অধিকার পায়। এ দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তার আইনের, তার দৃষ্টিভঙ্গীর- এতে রাষ্ট্র অনমনীয় মনোভাব দেখালে সেটি নাগরিকদের প্রভাবিত করতে বাধ্য।
মোহাম্মদ মুনিম - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:১৯ পূর্বাহ্ণ)
সাগুফতা শারমীনের কমেন্টটি পড়ে অনেকদিন আগে বিচিত্রার একটা রিপোর্টের কথা মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের এক বৃহৎ এনজিওর মালিক তাঁর অফিসের মহিলা কর্মচারীদের লো কাট ব্লাউজ পরতে বলতেন,তাঁকে বিচিত্রার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন ‘উন্নত বিশ্বে’ নাকি মহিলা কর্মচারীদের এ জাতীয় নির্দেশ হরহামেশাই দেয়া হয়। এর কয়েক বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসে সেই এনজিও কর্মকর্তার বর্ণনা করা উন্নত বিশ্বের সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখলাম। এখানে অফিসের পুরুষ কর্মকর্তারা মহিলা সহকর্মী বা অধস্তন কর্মচারীদের ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসম্যান্টের’ অভিযোগের ভয়ে মোটামুটি তটস্থ থাকেন। নিজের চোখের আরামের জন্য মহিলা কর্মচারীদের বিশেষ পোশাক পরতে বাধ্য করার কথা ভাবাও যায় না।
আমাদের দেশে মোটামুটি প্রতিটি মেয়েকেই প্রতিনিয়ত ছোট ছোট যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় আর এ ব্যাপারটি স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়া হয়। ‘ঈভ টিজিং’ পুলিশের খাতাতে অতি তুচ্ছ অপরাধ। অথচ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আমাদের দেশের মেয়েরা খুব পিছিয়ে নেই। নিজের শিশুকন্যাটি বড় হয়ে ডাক্তার বা ‘ব্যারিস্টার’ হবে, এই স্বপ্ন একজন স্বল্পশিক্ষিত কেরানি পিতাও দেখেন, মেয়ে মানেই বুড়ো বাপের ঘাড়ে বোঝা,এ ধরনের সেকেলে ধারণাগুলো আর নেই। কিন্তু যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে সামন্তবাদী ধারণাগুলো এখনো আছে।
ফারুক ওয়াসিফ - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ (১:০৭ অপরাহ্ণ)
জাবিতে গত ১২ বছর ধরে যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালার জন্য আন্দোলন হচ্ছে। সেখানকার শিক্ষক সমিতিও নীতিমালার প্রস্তাব তুলেছে। উচ্চ আদালত কেন নীতিমালা করা হবে না বলে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিসও জারি করেছে। কিন্তু কিছু হয়নি। এদেশে কিছু করা এত কঠিন।
নানান কারণে আমার একটি ধারণা প্রায় বদ্ধমূল হচ্ছে যে, উপমহাদেশে নারীদের দেখবার সনাতন দৃষ্টিটি খুবই অমানবিক। দেখবেন বেহেশতি জেওর, আর মনু সংহিতায় বর্ণিত নারীর বিধিবিধান এক। অবশ্য ভুলছি না, ইউরোপে চার্চ ও সামন্ততন্ত্র ডাইনি হত্যার নামে লক্ষ লক্ষ নারীকে পুড়িয়ে মেরেছিল।
তবে যৌন নির্যাতন বা হয়রানি থেকে পশ্চিম মুক্ত হয়েছে তা বলা যায় না। নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে সেখানে যেভাবে যৌনবস্তু করে ফেলা হয়েছে, তাদের নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন যেভাবে তৃতীয় দুনিয়ায় নারীকে ক্রমাগত পুৎজির দাসে পরিণত করছে, তা অবশ্যই সমালোচনার যোগ্য।
’ইভ টিজিং’ শব্দবন্ধ নিয়ে কিছু আপত্তি উঠছে। টিজিং বা উত্যক্ত করাই যেখানে বিষয় সেখানে ইভ শব্দটি লাগিয়ে একে চিরায়ত ব্যাপার (আদম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পুরুষ নারীর প্রতি এভাবেই আকৃষ্ট হয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করবে) করে তোলা হয় কিনা সেটা ভেবে দেখা যায়। পার্থক্যটি সুক্ষ বটে, কিন্তু উপেক্ষা না করাই ভাল।
ধন্যবাদ মোহাম্মদ মুনিম।
অবিশ্রুত - ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ (৮:৪৭ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ ফারুক ওযাসিফ, মুয়িন পার্ভেজের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলছি, আপনার এই তথ্যঋদ্ধ ও মমতামাখানো লেখাটির জন্যে।
তবে কাজলরেখার গল্পটির (যা বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমারও মাঝেমধ্যে মনে পড়ে) সূত্র ধরেই বলতে চাই, গল্পের শেষ কিন্তু অন্য রকম – একদিন সেই কাজলরেখা আবারও উঠে এসেছিল তার যথাযোগ্য অবস্থানে। গল্পের শেষটি যদি আমরা মনে না রাখি, গল্পের শেষটি যদি্ আমরা মনে না করিয়ে দেই তা হলে আমরা নিজেরা একসময় শর্মিলা বোসের অন্য কোনও প্রকরণ হয়ে উঠব অথবা হতাশার দিকটিই আমাদের বড় মনে হবে।
প্রসঙ্গত জানাই, নীলিমা ইব্রাহিমের একটি সাক্ষাৎকার মিডিয়া আর্কাইভে দুই পর্বে বিভক্ত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। সাক্ষাৎকারটি পড়লে তখনকার উদ্যোগ সম্পর্কে আরও খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে। শেখ মুজিবের ‘নষ্ট রক্ত’ শব্দ প্রয়োগ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়; কিন্তু সেই সময়টির ইতিহাসকে আবেগের বাইরে দাঁড়িয়ে বিবেচনা করলে বোধহয় মুজিবের প্রতিও আমরা মমতা বোধ করব। শোনা যায়, এখন যিনি বিরোধী দলীয় প্রধান নেত্রী, তার ঘর ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রেও শেখ মুজিবের বিশেষ ভূমিকা ছিল এবং তার স্বামীকে ডেকে নিয়ে মুজিবকে বলতে হয়েছিল, ‘এ আমার মেয়ে।’ এই যখন আমাদের বীরপুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদেরও মনোভাব (যা আপনি নিজেও তুলে এনেছেন যৌতুক, কবিতার অপ্রকাশিত বই প্রকাশ ইত্যাদি উদাহরণগুলির মাধ্যমে) তখন অসহায় মুজিব যদি বলেন ‘আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না’ তা হলে তাকে সমালোচনার সময় নিশ্চয়ই সহৃদয়তার সঙ্গেই করা প্রয়োজন।
বিষয়টি আসলেই তাৎপর্যপূর্ণ,
রাষ্ট্রের স্থপতির জন্যে এটি একটি বড় সংকটই ছিল বটে, তবে তার কারণ আমার মনে হয় না তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। দায়ী ছিল গোটা জাতির পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি – নয় মাসের যুদ্ধে যার বিলোপ ঘটে না। দু’টি মহাযুদ্ধ ইউরোপের নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ধাত্রীর কাজ করেছে, নারী একাকী সংসার সামলে, উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে পুরুষের পক্ষে তা পরবর্তী সময়ে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হয়নি কেড়ে নেয়া। নইলে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এদেরও কম নেই। আমাদের দেশেও দেখুন, গার্মেন্ট নারীদের স্বাধীনতা অনেক অর্থবহ, কেননা তা তারা অর্জন করেছে প্রাত্যহিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে; কিন্তু মধ্যবিত্ত নারীদের স্বাধীনতা ব্যতিক্রম বাদে অনেকটাই কাগুজে ও স্থূল, ভাবালুতাআক্রান্ত, কোনও কোনও সময় যৌন স্বাধীনতার সমার্থক। যাই হোক, এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আর একটি বিষয়, সম্ভবত ভুল ছবি পেস্ট করা হয়েছে। কেননা ছবিটি কোনও লাশের বলে মনে হচ্ছে না। শিল্পী নাইব উদ্দীনের তোলা বেশ কিছু আলোকচিত্র আছে, যেগুলি এ লেখার সঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আবারও আপনাকে ধন্যবাদ, এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির জন্যে।
ফারুক ওয়াসিফ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:১৩ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ অবিশ্রুত। তবে শর্মিলা বোস এখানে কীভাবে এসে পড়লেন তা বোধে এল না। কাজলরেখার মেটাফোর যথার্থ নাও হতে পারে। তবে রপকথায় শেষপর্যন্ত জয় দেখায়, সেটা মানুষের স্বপ্ন ও বাসনা, উইশফুল চাওয়া। তাকে ভেঙ্গে দেখানোর দরকার আছে। তা না করলেও কেবল এটুকু যোগ করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়:
২.
এই মমতা কার, প্রথমত পুরুষেরই নয় কি? যিনি ’ত্রাতা’ তিনি নরম মনের মানুষ হতে পারেন বা নাও পারেন তাতে কিছু যায় আসে না। আমি দুটো প্রসঙ্গ তুলবার চেষ্টা করেছি: ১. একাত্তরে যে নারীর এত অবদান সেই নারী স্বাধীনতার কাছে নারী-সংবেদী কিছুই পেল না কেন? ২. নির্যাতিতাদের শরীরের ওপর মনের ওপর খবরাদারি, তাদের উপেক্ষার মাধ্যমে দুর্ভোগের পথে আরো ধ্বংস থেকে রক্ষায় কিছু না করা ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ যদি হয়, তবে তার দায় কার, তার কী খেসারত?
না মুক্তিযোদ্ধার সম্মান, না সমর্থন, না রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, না ইতিহাসে ঠাই দেওয়া, কোনোভাবেই যা করা হয়নি, তার উত্তর একটাই, এই জাতীয়তাবাদ ভয়ানকভাবে পুরষতান্ত্রিক, দায়িত্বহীন ও সুবিধাবাদী। স্বাধীনতার সুফল অনেক মুক্তিযোদ্ধাও পেয়েছেন যারা উচ্চবর্গের, দলের লোক অনেক কিছু পেয়েছে সেসময়, সেগুলোকেও তো তাহলে মমতা দিয়ে দেখতে হয়। একাত্তর কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। তাই সাধারণ দৃষ্টিকোণ দিয়ে তার উপযুক্ত করণীয় খুজলে চলেবে না। তখন অনেক কিছুই করা যেত যা এখন করা কঠিন। কিন্তু করা হয়নি। তখনকার সরকার কার্যত নিজেকে সত্তর সালের ভোটে জয়ী সরকারের মতো দেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, নারীনিধন ও নির্যাতনসহ যে ভয়াবহতা ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেশ পার হয়েছে তার ছাপ বাহাত্তরের পরের কোনো সরকারের মধ্যেই দেখা যায়নি। বাঙলাদেশ রাষ্ট্র তার দেহ থেকে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত আর নারীর যন্ত্রনার দাগ মুছে ফেলে নির্বিকারভাবে জনতাকে শাসন আর সম্পদভোগকে বৈধ করে নিয়েছে। তার দায় মুজিবেরও কম নয়।
একাত্তরের নারী কী তাদের দুর্ভাগ্যের সান্তনা মমতার বরাতে অনুভব করতে পারেন? আমি জানি না, সেকারণে ঐসব নারীর চোখ দিয়ে এসব আচরণ ক্ষমাহীনই বলে মনে হয়।
এ কথা সাধারণ পুরুষের কথা, গোত্রপিতার (প্যাট্রিয়ার্ক) কথা, একাত্তর পেরুনো রাষ্ট্রনেতার কথা বলে মানা কঠিন। অবশ্য এ আমারই মত। বিশ্লেষণ ও বিচারের সময় মোহহীন এবং যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে জীবনমরণের সমান র্যাডিকাল যুক্তিকাঠামোই ব্যবহার করা প্রয়োজন। নইলে সকল কিছুরই কার্যকারণ থাকে এবং সকলেই সীমাবদ্ধ অতএব যা হয়েছে তার বাইরে কিছু করার ছিল না এবঙ যা হবার তা-ই হবে বা হয়ে থাকে জাতীয় অবস্থান নিতে হয়ে যে!
অবিশ্রুত - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৬:১৪ পূর্বাহ্ণ)
দুঃখিত, লিখতে একটু দেরিই হয়ে গেল বলে।
শর্মিলা বোসের আরেক প্রকরণের কথা বলেছিলাম (লিখেছেন, বুঝতে পারেননি)। আশপাশের কাউকে কাউকে আমাদের এই কাজলরেখাদের কথা এত নির্বিকারভাবে শুনতে দেখি, শোনার পর এত প্রতিক্রিয়াহীন চোখে তাকাতে দেখি যে, বোঝাই যায় পারমাণবিক বোমা বানানো আর ক্রিকেটে বিস্ময়কর সাফল্যের অধিকারী পাকিস্তান নামের দেশটির সেনারা এবং তাদের সহচররা নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেছে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। একজনকে দাবি করতে শুনেছি, ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া এসব নারীদের অনেকেই নাকি পাকিস্তানীদের প্রেমে পড়ে সুখের সঙ্গেই এক ধরনের ঘরসংসার শুরু করেছিল। এই যখন অবস্থা তখন এখানে শর্মিলা বোস ঢুকে পড়ার তো আর খুব বেশি দেরি দেখি না। ইয়াসমিন সাইকিয়া তার গবেষণায় যে-প্রাথমিক বুনিয়াদ স্থাপন করে গেছেন, তাতে মনে হচ্ছে এ ক্ষেত্রেও শর্মিলা বোসকে পেতে আমাদের দেরি হবে না, যে আমাদের হাতেকলমে দেখিয়ে দেবে, ধর্ষণই যেখানে হয়নি সেখানে বীরাঙ্গনার অস্তিত্ব থাকবে কেমন করে!
২.
এটি সত্যি, কাজলরেখা রূপকথা। কিন্তু তারপরও মানুষের চোখের নিচে এখনও না হয় একটু আশা থাকুক। তা ছাড়া, এই ধরণের রূপকথাগুলো নিয়ে আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে এখনও কোনও কাজ হয়নি। পরিবার, বিয়ে ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে এঙ্গেলসের বইটির কথাই ধরুন, যেসব উদাহরণ তিনি নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিবর্তনকে তুলে ধরার জন্যে ব্যবহার করেছেন, সেগুলোও প্রচলিত অর্থে বাস্তব নয়। কিন্তু সে-জন্যে তিনি যদি সেসব উড়িয়ে দিতেন, যদি সেগুলোর তলদেশ না খুড়তেন, তা হলে ইতিহাসের একটি দিক সম্পর্কে আমরা অজ্ঞই থেকে যেতাম। কাজলরেখা, মনে হচ্ছে, মাতৃতান্ত্রিক এমন এক গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যে-গোত্রে পুরুষের সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছিল। জানি না, আমার ধারণা সঠিক হবে কি না (গল্পটি পড়েছিলাম স্কুলজীবনে, মিলিয়ে পড়তে পারলে নিশ্চিত হতাম)। যাই ঘটুক না কেন, আমাদের কাজলরেখাদের জয় হবে, এই বিশ্বাস যেন আমরা না হারাই।
৩.
শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ও পুনর্বাসন প্রসঙ্গে এর মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত এটুকুই বলব, ওই সময়, সরকার বাদে অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কি কি বক্তব্য দেয়া হয়েছিল তার কোনো বিবরণ (সংক্ষিপ্ত হলেও) কোথাও পাওয়া যাবে কি? ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ন্যাপ, সিপিবি, জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করেছিল। এদের নির্বাচনী কর্মসূচীতে এ নিয়ে কোনও বক্তব্য ছিল কি (আমি জানার জন্যে বলছি)? কিংবা ওই সময় প্রকাশিত মননশীল কোনও পত্রিকায় (হতে পারে মাসিক সমকাল বা সংস্কৃতি অথবা গণসাহিত্য) এসব প্রসঙ্গে কোনও আলোকপাত করা হয়েছিল কি? আমার চোখে পড়েনি। মর্মান্তিক সত্য হলো, নীরবতার মধ্যে দিয়ে সরকারের ওপর দায়দায়িত্ব চাপিয়ে প্রগতিশীলরাও তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, কাজলরেখারা তাদের জন্যেও এত অস্পৃশ্য ইস্যু ছিল যে তারা এ ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর নিন্দা বা সমালোচনা কোনোটাই করতে যাননি!
যুদ্ধের পর কাজলরেখারা কেমন ছিলেন, তার প্রামাণ্যসাক্ষী নিচের এই লিংকটির সংবাদ :
এখানকার ভিডিও ফুটেজ জানিয়ে দিচ্ছে, কী দুঃসহ সময় কাটিয়েছে তারা। ইউটিউবের এই ফুটেজে, এনবিসি-এর সংবাদ দেখার সময় আমি যুদ্ধশিশু বহনকারী মেয়েটির চোখ খেয়াল করছিলাম। দেখুন, বিষণ্নতার সঙ্গে সেখানে বিপণ্নতা খেলা করছে, সে এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে আতঙ্কিত অবিশ্বাস গোপন করার চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু পারছে না, তার সামনে সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীরা ভিনভাষায় কথা বলছে, সে বুঝতে পারছে না- সেটিও তার চোখে অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে। সন্তান কোলে এক নারী বসে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই, সে সন্তানটির মুখ দেখানোর চেষ্টা করছে আর কোথাও কাকের দল চিৎকার করছে।
সৈকত আচার্য্য - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
@ অবিশ্রুতঃ
আপনি লিখেছেন,
গতকাল বিপ্লব রহমানের উদ্দেশ্যে প্রত্যুত্তর লিখতে বসার সময়, ঠিক এই কথাগুলোই ভাবনার মধ্যে আসছিল বার বার। আসলেই তো, অন্যদলগুলো যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো এবং স্বাধীনতার পক্ষে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিলো, কে কিভাবে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষন করলো, কারা কারা সক্রিয় ভুমিকা নিয়েছিলো এই ইস্যুতে এবং শেখ মুজিব সরকারের এই উদ্যোগের বাইরে আর কোন বিকল্প প্রস্তাব ছিল কিনা, এই বিষয়ে আমরা অনেকেই অন্ধকারে আছি। একারনে, আমিও জানতে চাই, কারো কাছে কি অবিশ্রুত উত্থাপিত এই তথ্যগুলো আছে? দয়া করে কেউ শেয়ার করবেন? এগুলোর উদঘাটন আজকে অনেক জরুরী। কারন ওই সময়টাকে আমরা বুঝতে চাই, আজকের দিনের পথ চলা এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে।
@ ফারুক ওয়াসিফ এবং বিপ্লব রহমানঃ
আপনাদের কাছে কি এই ব্যাপারে কোন তথ্য আছে? জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।
আপনি আরো লিখেছেনঃ
তারা নিন্দা বা সমালোচনা করেনি হয়তো এই কারনে যে, দু’টোর যে কোন একটা করলেই তো একটা দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়ার প্রশ্ন এসে পড়ে। এই মর্মান্তিক সত্য যদি বাস্তব সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয়, সেদিনের সেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মধ্যে প্রগতিশীলদের যে চরম সুবিধাবাদী ও দায়িত্বহীন অবস্থান ছিল (শুধু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর দুর্বল মানসিক বিকার) তা থেকে আজকে কি তারা বেড়িয়ে আসতে পারছে?
তানবীরা - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (২:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
কানাডা বাদে সবচেয়ে বেশি “ওয়ার চাইল্ড” এসেছে ইউরোপে। নেদারল্যান্ডসেও অনেক এসেছে। তারা মিলে নিজেরা একটি সমিতি বানিয়েছে, যারা প্রতিবছর সামারে একটি অনুষ্ঠান করে তার থেকে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশে পাঠায়, যে বাংলাদেশে তাদের জায়গা হয়নি। অনেকেই এদের আজকে নেদারল্যান্ডসে ঈর্ষনীয় ধনীর পর্যায়ে আছেন। অনেকেই বাংলাদেশে তাদের কল কারখানা স্থাপন করেছেন। কিন্তু তারা জানেন যে তাঁরা দেশে আকাংখিত নন। আমিও একটা লেখায় হাত দিয়েছিলাম এ বিষয়ে কিন্তু পরে কেনো যেনো আর কখনো লেখা হয়ে ওঠেনি সেটা।
ফারুক ওয়াসিফ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:৪২ অপরাহ্ণ)
এদের বিষয়ে সেখানে কোনো কাজ বা এদের নিজস্ব লেখালেখি আছে কি তানবীরা? কিংবা তোমার কাজটাই শুরু করো না নতুন উদ্যমে।
অস্মিতা - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:২৯ পূর্বাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ, কৃতজ্ঞতা জানাই চমৎকার এই পোস্টটির জন্য। আমার জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। বেড়ে ওঠার একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে এমন একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে দেশের প্রধান মিডিয়াগুলোতে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’, ‘জয় বাংলা’ ছিল নিষিদ্ধ কিছু শব্দ। নিজের দেশটির সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল সময়টির প্রকৃত ইতিহাস জানবার একমাত্র মাধ্যম ছিল অল্প কিছু পত্র পত্রিকার হঠাত-সাহসী কিছু কলাম, প্রায় দুষ্প্রাপ্য কিছু বই, আর মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে থাকা কিছু কাহিনী। আমার জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটি হল নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বিরাঙ্গনা বলছি’ বইটি হাতে পাওয়া। আমার বয়স তখন ১৪, এবং মনে পড়ে বইটি পড়ে এক রাতে আমার পৃথিবীকে দেখবার চোখটি পাল্টে গিয়েছিল। আমার একটি প্রায়ই ফিরে আসা দুঃস্বপ্নের শুরুও সেই থেকে। আমি প্রায়ই স্বপ্ন দেখতাম – একা একা স্কুলে যাচ্ছি, হঠাত চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো – কিছুতেই বাড়ির রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। চারিদিক থেকে কারা যেন এগিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। মনে পড়ে এক বাঙ্গালী নারী সাংবাদিক একবার বলেছিলেন – জন্মাবধি ‘ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে’ আমাদের নারীদের বসবাস। তাই হয়তো আজ এতো বছর পরেও প্রায়ই এই দুঃস্বপ্নটি তাড়া করে ফেরে।
একাত্তর এর এই অধ্যায়টি আমি সেই থেকে এক রকম একটি বাক্সের মধ্যে বন্ধ করে তালা দিয়ে রেখেছি। ধুলো জমতে দিই না, কিন্তু তালা খুলতে ভয় পাই। মাঝে মধ্যে হঠাত উঁকি দিলে যে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াই, তাতে পঁয়ত্রিশ বছরের শিক্ষা, বেঁচে থাকা, সমস্ত অর্জন মূল্যহীন হয়ে যায়। নিজেকে এক দলা মাংস পিন্ড ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
অবিশ্রুত’র সাথে একমত। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটির গায়ে এক কথায় “পুরুষতান্ত্রিক পিতার” লেবেল সেঁটে দেয়াটা বোধ হয় বড়ো বেশী সাদাকালো হয়ে গেল ফারুক ওয়াসিফ। বঙ্গবন্ধু কোন প্রেরিত পুরুষ নন যার এক কথায় একটি জাতির সহস্র বছরের সঞ্চিত পুরুষতান্ত্রিক বাস্তবতা পাল্টে যায়। সেই বাস্তবতার আলোকে যুদ্ধ শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সম্ভবত তাদের সম্মান নিয়ে মানুষ হিসেবে বাঁচবার একটা সুযোগ করে দেয়ার জন্যই। ‘আমি বিরাঙ্গনা বলছি’ বইটির এক নারীর কথা মনে পড়ে। যিনি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার মাথায় হাত রেখে যেদিন বলেছিলেন ‘তুই আমার মা’ সেদিন তার গ্লানিমুক্তি ঘটেছিল। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের সাথে তাই সেই নারীর শেষ বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়েছিল। তিনি আর দেশে ফিরতে চাননি। যেই বাস্তবতার আলোকে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি, তার কিছু ছোঁয়া পাই সেগুফতার সহকর্মীর জবানীতে। ‘নারীর ৭১’ বইতে শাহীন আখতার লিখেছেন সেই সব নারীদের কথা যারা নব্বুই এর দশকে গণ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। গ্রামে ফিরে যাওয়ার পর যাদের ঘর ভেঙ্গেছে, দুঃস্বপ্নের অধ্যায় নতুন করে শুরু হয়েছে, সন্তানদের জীবন ধ্বংস হয়েছে। এই বাস্তবতার পরিবর্তন হবে কবে? কে করবে? রাষ্ট্র একা? কিভাবে? আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই?
একথা ঠিক, যে এই যুদ্ধ শিশুদের রক্ষার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। তবে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির সেই সামর্থ্য (সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতা অর্থে) ছিল কিনা কিংবা আজও আছে কি না, সেটি ভাববার বিষয়। নিরপরাধ এই শিশুদের সুস্থভাবে বাড়তে দেয়ার জন্য যে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল প্রয়োজন, তার জন্য আমরা কি এখনো তৈরী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী যুদ্ধ শিশুদের বেড়ে ওঠার কাহিনী (এমনকি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেও) আমাদের কি শেখায়? আর ধর্ষিতা নারীদের সে সময় এই শিশুদের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা তো তাদের হাত পা বেঁধে পিঠে পাথর ঝুলিয়ে সাগরে ফেলে দেয়ারই নামান্তর। নারীবাদে “জরায়ুর স্বাধীনতা” একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের বেলায় এই শব্দটি বোধ হয় সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।
মনে পড়ে একবার বন্ধু মহলে আড্ডা হচ্ছিল ইংরেজী oxymoron শব্দটির বাংলা উদাহরণ খোঁজা নিয়ে। এক বান্ধবী বলেছিল, বাংলা ভাষায় oxymoron এর যথার্থ উদাহরণ হল “বাঙ্গালী পুরুষ”। আর “বীর বাঙ্গালী”? Oxymoron বোধ হয় নয়। ফেরদোসী প্রিয়ভাষিনীর কথা মনে পড়ে। এক বিকেলে এক সভাঘর ভর্তি মানুষের মাঝে যিনি ১৯৭১ এ তাঁর নির্যাতনের ইতিহাসটি স্মরণ করেছিলেন এবং শেষে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেছিলেন যে জীবনের সেই অধ্যায় নিয়ে গ্লানি তাঁর নেই। তিনি মনে করেন – যে দেশটিকে ভালোবাসেন তার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এটি তাঁর একটি অতি ক্ষুদ্র আত্মত্যাগ।
ফারুক ওয়াসিফ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:৫৩ অপরাহ্ণ)
শেখ মুজিবের কি পুরুষতান্ত্রিক না হয়ে অন্য কিছু হওয়ার উপায় বা সম্ভাবনা কি ছিল? তিনি তার রাজনীতি ও শ্রেণীর বাইরে যাবেন কীভাবে? রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে যদি বিচার করেন, তাহলে দেখবেন তার অগ্রগামীতা মতাদর্শে নয়, নেতৃত্বের যোগ্যতায় এবং জনগণের মন বোঝার ক্ষমতায়। (তার দলে তাজউদ্দীন অনেক অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন।) এ কারণে মুজিবই এ ভূখণ্ডের শেষ ‘জাতীয়’ নেতা। এর পরে যারা এসেছে তার বেশিরভাগই ক্রিমিনাল মানসিকতার অথবা উচ্চাভিলাষী ধুরন্ধর।
যাহোক, আমাদের প্রসঙ্গটি মুজিব নিয়ে নয়। ফলে মুজিব চরিত্র নিয়ে আমাদের ভিন্নতা থাকতেই পারে, তার বাইরেও একাত্তরকে দেখার জায়গা আছে। ব্যক্তিপুরুষ সেখানে যেন আড়াল হয়ে না দাড়ায়।
অস্মিতা - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ)
@ ফারুক ওয়াসিফ (৫.১)
বিলক্ষণ। পুরুষতন্ত্র মানব সভ্যতার আদিমতম তন্ত্রের একটি এবং এর ইতিহাস সহস্র বছরের পুরোনো। সেই আলোকে বঙ্গবন্ধু, আপনি এবং আমি কেউই হয়তো এই তন্ত্র ভেঙ্গে আজও বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমার আপত্তিটি কিন্তু অন্য জায়গায়। তার আগে একটু ভূমিকা দিয়ে নিই। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম এগিয়েছে এক পা এক পা করে। এর জন্ম কোনো ঐশী কেতাব থেকে হয়নি। কোন পুরুষ এর সার কথা একটি পুস্তকে সন্নিবেশিত করেননি। আধুনিক নারীবাদের কাছে সর্বরোগহারী মেটা থিওরির কার্যকারিতাও আজকাল অল্প বলেই মনে হয়। সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী বিভিন্ন তন্ত্রকে প্রশ্ন করেছে, দেশে দেশে কালে কালে কখনো কখনো কোন কোন তন্ত্রের সাথে আঁতাত করেছে, মোহগ্রস্ত হয়েছে, সম্পর্ক ছিন্নও করেছে। বিভিন্ন সময় চলার সময় এমন কিছু বান্ধব খুঁজে পেয়েছে যাদের অনেকেই “নারী স্বাধীনতা” শব্দটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেননি। পুরুষতন্ত্র তার যাবতীয় রং রূপ এবং nuance নিয়ে এখন আমাদের কাছে যেমনভাবে উপস্থিত এদের অনেকের কাছেই সেগুলো তেমনভাবে ধরা দেয়নি। ২০১০ এর চশমা দিয়ে তাই ১৯৭১ এর বিচার করতে যাওয়া একটু বিপদজনক (“একাত্তর কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। তাই সাধারণ দৃষ্টিকোণ দিয়ে তার উপযুক্ত করণীয় খুজলে চলেবে না। তখন অনেক কিছুই করা যেত যা এখন করা কঠিন। কিন্তু করা হয়নি।” “যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে জীবনমরণের সমান র্যাডিকাল যুক্তিকাঠামোই ব্যবহার করা প্রয়োজন। নইলে সকল কিছুরই কার্যকারণ থাকে এবং সকলেই সীমাবদ্ধ অতএব যা হয়েছে তার বাইরে কিছু করার ছিল না এবঙ যা হবার তা-ই হবে বা হয়ে থাকে জাতীয় অবস্থান নিতে হয়ে যে!”)। কারণ, সেই প্রচেষ্টায় কোন না কোনভাবে বেগম রোকেয়ার গায়েও “প্রতিক্রিয়াশীলতার লেবেল” সেঁটে দেয়ার সুযোগ তৈরী হয়।
গত দুই/তিন দশকে নারীবাদ একটি দিকের প্রতি বেশ জোর দিয়েছে। সেটি হল contextual analysis। পটভূমির বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে কোন তত্ত্ব চাপিয়ে নারীর প্রশ্নের বিচার করতে যাওয়া তাই প্রশ্নবিদ্ধ। আর ভিন্ন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে অন্য একটি পটভূমিকে বিচার করতে যাওয়াকে বলা হচ্ছে essentialism। এতো কথা বলবার কারণ হল এই যে, আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বা পটভূমি বিচারের প্রয়োজনীয়তাটিকে (অন্তত পুরুষতন্ত্রকে বুঝতে বা তার সাথে জুঝতে) সামনে নিয়ে আসা। মোহমুক্ত বিশ্লেষণের কথা যদি বলেন তাহলে কোন্ বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু তার সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন সেটি বোঝা এই জন্যই জরুরী। ভুল বুঝবেন না, বঙ্গবন্ধুকে “নারীর প্রশ্নাতীত বান্ধব” হিসেবে আমি দাবী করছি না, কিন্তু তাকে out of context এ বিচার করে দায়ী করাকে (“বাঙলাদেশ রাষ্ট্র তার দেহ থেকে মুক্তিযুদ্ধের রক্ত আর নারীর যন্ত্রনার দাগ মুছে ফেলে নির্বিকারভাবে জনতাকে শাসন আর সম্পদভোগকে বৈধ করে নিয়েছে। তার দায় মুজিবেরও কম নয়”) আমার অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা বলে মনে হয়েছে। অবিশ্রুত যে লিন্কটি দিয়েছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত উদ্যোগগুলো মুক্তিযোদ্ধা নারীকে সম্মান না জানানোর, বা তার বেদনা/নির্যাতনের চিহ্ন ধামাচাপা দেয়ার, বা তাকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার প্রমাণ বহন করে না। বরং চিহ্নিত করে নারীবাদী এবং শ্রেনী সংগ্রামী নেতৃত্বের ব্যার্থতাকে যাদের সঠিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও তৎপরবর্তী সেই সময়ে শ্রেনী বৈষম্য এবং পুরুষতন্ত্রকে যথার্থভাবে চ্যালেঞ্জ করতে বা পরিবর্তন করতে ব্যার্থ হয়েছিলো। সে সময়কার নারী নেতৃত্বের ব্যার্থতার কথা নীলিমা ইব্রাহিমের সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত করছি:
নারী স্বাধীনতার ultimate বাস্তবায়ন অথবা পুরুষতন্ত্রের পতন বঙ্গবন্ধুর কাছে অন্তত আমি আশা করি না। শুধুমাত্র এই কারণে যে পুরুষতন্ত্রকে সমূলে উৎপাটনের প্রতিশ্রুতি তিনি আমাদের কখনো দেননি। তবে তাকে “পুরুষতন্ত্রের মোড়ল” বলবার আগেও দু’বার ভাবি এই কারণে যে মুক্তিযোদ্ধা নারীর প্রতি তার আন্তরিক সম্মান, মমতা, পূনর্বাসন প্রকল্পসহ গৃহীত কিছু পদক্ষেপ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা, নারীর সম অধিকারের ঘোষণা আর তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নারী অধিকারের/মূল্যায়নের যাত্রাটিকে কন্টকাকীর্ণ করে না, বরং সামান্য হলেও এগিয়ে নিয়ে যায়।
বলেছেন:
তাজউদ্দিন অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন সত্যি। এও সত্যি যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আনুগত্য ছিল প্রবাদ তূল্য, যদিও তার সব সিদ্ধান্তের সাথে তিনি একমত ছিলেন না। এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেই শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য অক্ষয় ছিল (‘নিঃসঙ্গ সারথী’ দ্রষ্টব্য)। একজন অগ্রসর তাজউদ্দিন তাঁর চেয়ে “কম অগ্রসর” বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অধীনে থাকেন জীবনভর, এই ধারণাটি মনে হয় তাজউদ্দিনের “অগ্রসরতাকেই” প্রশ্নবিদ্ধ করে। করে না? অবশ্য সবকিছুই নির্ভর করে অগ্রসর মানুষ বলতে আপনি কি বোঝেন তার ওপর।
আপনি বলেছেন:
হক কথা। দলীয় লুটপাটে পূনর্বাসন, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদিতে টান পড়ে ঠিকই। কিন্তু শুধুমাত্র সে সব কারণেই কি মুক্তিযোদ্ধা ভাই ধর্ষিত বোনকে মেনে নিল না? পিতা কন্যাকে পরিত্যাগ করলো? স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলো?
আপনার লেখার সবচাইতে চমৎকার অংশটি আমার মনে হয়েছে এইটি:
সেই সঙ্গে এই প্রশ্নটিও করতে ইচ্ছে হয় – সেই নারী “শ্রেনী সংগ্রামীর” কাছ থেকেই বা কি পেলো? নকশালবাড়ি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বীর নারীরা কেমন আচরণ পেয়েছিলেন তাদের দল এবং কমরেডদের কাছ থেকে? এই বিষয়ে মল্লারিকা সিংহরায় এর এই লেখাটি দেখা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রের তীর্থভূমি সোভিয়েত রাশিয়াতে পুরুষতন্ত্রের পতন হয়েছে কি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনের লাল বাহিনীর আলোকপ্রাপ্ত সন্তানেরা বার্লিন বিজয়ের সময় ধর্ষণ নারী নির্যাতন কিছু কম করেছিল কি?
লিখেছেন:
একমত। কিন্তু বিনয়ের সাথে এও বলি যে এর শুরু কিন্তু করেছিলেন আপনিই অন্তত দুইটি বড়সড় প্যারায় এই মানুষটিকে উদ্ধৃত করে। সেটা করাটাই হয়তো স্বাভাবিক। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কোন্ আলোচনাই বা কবে সম্পন্ন হয়? তবে শুধু এইটুকু মনে রাখতে অনুরোধ করি। বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল ছিল মাত্র সাড়ে তিন বছরের। এর পর চৌত্রিশ বছর শ্রেনী সংগ্রামী কমরেডগণ, নারী নেতৃত্ব, আপনি আর আমি কি করলাম? এই শ্রেনী সংগ্রামীদের একাংশ যাদের ভুল নেতৃত্ব/অবস্থান সামরিকতন্ত্র, পাকিস্তানতন্ত্র আর ইসলামতন্ত্রকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে চুলোয় পাঠানোর আয়োজন সম্পূর্ণ করে, নারীর স্বাধিকারের সংগ্রামকে আরও একশো বছর পিছিয়ে দিয়ে তাদের শ্বাস নেয়ার পথটি পর্যন্ত রুদ্ধ করে, তেত্রিশ বছর এক রকম গালে হাত দিয়ে বসে থাকে – তাদের ব্যাপারে দু’একটি উক্তি এবং সমালোচনা আপনার লেখায় পড়বার আশা ছিল। “পুরুষতান্ত্রিক মুজিব” যে উদ্যোগগুলো নিয়েছিল সেই উদ্যোগগুলো বন্ধ করলো কে? কখন? কেন? সে সব বিষয়ের আলোচনা বাদ দিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরই কি কোন উপকার হয়? নাকি মুক্তিযোদ্ধা নারীর?
[মন্তব্যটি সঠিক থ্রেডে স্থানান্তরিত – ব্লগ এডমিন]
ফারুক ওয়াসিফ - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (১২:৫১ অপরাহ্ণ)
প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। দীর্ঘ মন্তব্য করেছেন। সময় করে আমার মত জানাব। আশা করি বিলম্বে বিড়ম্বিত হবেন না। 🙂
[মন্তব্যটি সঠিক থ্রেডে স্থানান্তরিত – ব্লগ এডমিন]
ফারুক ওয়াসিফ - ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:৩৩ অপরাহ্ণ)
@ অস্মিতা (৫.১.১)
আমার লেখাটির যে ক্রিটিকটি আপনি করেছেন, তার সারকথা এটাই দাঁড়ায় যে, শেখ মুজিব একাত্তরের নির্যাতিতা নারীদের বিষয়ে যা করেছেন, তার বাইরে কিছু করবার বাস্তবতা তখন ছিল না। এর বেশি কিছু করবার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেননি। ফলে আমার এই মূল্যায়ন খারিজ হয়ে যায় যে,
কিন্তু আপনি নিজেও স্বীকার করেছেন, শেখ মুজিবসহ তাঁর সময়ের আর কেউ বা আজকের আমি-আপনি পুরুষতন্ত্রমুক্ত নই। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে তো আপনি আমার অভিযোগটিই স্বীকার করে নিলেন যে, শেখ মুজিব যা করেছেন সমস্ত আবেগ ও উদারতা সত্ত্বেও সেটি একজন পুরুষেরই অবস্থান। এবং ধর্ষিতা নারীদের স্বামী, বাবা, ভাই কিংবা পুরুষ প্রাধান্যের মধ্যে থাকা তাদের নারী আত্মীয়রা কেউই সমাজ নির্ধারিত সীমাটি ডিঙাননি। ডিঙানোর রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও কেউ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেননি। জাতীয়তাবাদী থেকে কমিউনিস্ট সবার বেলাতেই এই অভিযোগ খাটে। তা যদি হয়, তাহলে বলতে হয়, একাত্তর সালের যুদ্ধ, ধ্বংস, নিপীড়ন, আত্মত্যাগ সমাজটাকে এগিয়ে নিতে পারেনি। এই দায় কি একা জনগণের? নাকি তার অগ্রসর অংশ যে মধ্যবিত্তনির্ভর নেতৃত্ব, তার। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কেবল একটা স্বাধীন রাষ্ট্র এবং তার নতুন শাসকশ্রেণী ছাড়া আর কিছু এদেশের হতভাগ্য জনগণের ভাগ্যে জোটেনি।
এটা বলা মাত্রই হা হা করে স্বাধীনতাকে হেয় করার অভিযোগ নিয়ে তেড়ে আসবেন কেউ কেউ। কিন্তু ৩৯ বছরে যে সিসিফাসের নিয়তি হয়েছে এদেশের, তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এবং সেই মূল্যায়নে ডান-বাম কারোরই দায় ঢাকার কোনো সুযোগ থাকবে না। মোহভঙ্গ না হলে নতুন বাস্তব সৃষ্টি হবে না, কনটেক্সট পাল্টাবে না, কনটেক্সট-এর গর্তে পড়ে থাকবে মানুষের বাঁচা-মরার ইতিহাস।
আপনি কনটেক্সচুয়াল না হওয়ার অভিযোগ করেছেন আমাকে। কিন্তু কোন কনটেক্সট মানব? কে কীভাবে কেন কোথায় কোন কনটেক্সট দেখে তা কি শ্রেণী-মতাদর্শ-লিঙ্গ নিরপেক্ষ? নিলীমা ইব্রাহিমকেই যদি সাক্ষি মানি, দেখবেন, তিনি কিন্তু অসন্তুষ্ট ছিলেন। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, সমগ্র বাস্তবতার প্রতি। এবং সেই বাস্তব পুরুষ নির্মিত ও শাসিত। যে বাস্তব নিপীড়নকে বৈধতা দেয়, সয়ে যেতে বলে, প্রেক্ষিত মানলে তো তার বিরুদ্ধে অসন্তোষেরও জায়গা থাকে না। সব তখন নিয়তির মতো অপ্রতিরোধ্য বলে মেনে নিতে হয়। হেগেলের কথা ছিল, যা বাস্তব তা যৌক্তিক, যা যৌক্তিক তা বাস্তব। অর্থাত যা হয়েছে যুক্তিসঙ্গত বলেই হয়েছে, নইলে তা হতো না। ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তাও ভাল এবং যা হবে তাও ভালই হবে। এই নির্ধারণবাদ, সক্রিয়তা তো দূরের কথা, চিন্তার সমালোচনারও বৈধতা দেয় না। আপনি প্রকারান্তরে এই অবস্থানটিই গ্রহণ করেছেন।
অথচ অন্য বাস্তবটি হলো, স্বাধীনতার জন্য দেশের উন্নতির জন্য সেসময় বিপুল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। ছাত্রসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন অংশে বিরাট তাড়না ছিল জাতিগঠনের, তা সঠিক আন্দোলনের আকার না পেয়ে জাসদের বিকারে ভেসে গেছে। অথচ দেশগঠনে না মুক্তিযোদ্ধাদের, না ছাত্রতরুণদের কাউকেই ডাকা হয়নি। সব আবার চলে গিয়েছিল দলের লোকের হাতে। এবং দলটি উচ্ছেদ হলে পুরনো শত্রুরা আবার জেঁকে বসেছিল। যেকোনো বিপ্লব, বিদ্রোহ জয়ী হওয়ার পর তার ভেতরে দুটি শক্তি মুখোমুখি হয়। একটি পরিবর্তনকে আরো এগিয়ে নিতে চায়, প্রতিশ্রুতি রাখতে চায়। আরেকটি চায়, নতুন অর্জিত অবস্থানকে কায়েমি করে পরিবর্তনের গতিকে থামিয়ে দিতে। বাংলাদেশে বাহাত্তরে প্রতিক্রিয়ার ধারাটিই জয়ী হয়েছিল। এবং সেই ধারা তার জনককেই খেয়ে ফেলল ৭৫-এ। এই প্রতিক্রিয়ার ধারাই একাত্তরের সামান্য যা রক্ষাকবচ ছিল, শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্যে দিয়ে তার সবকে ভাসিয়ে নিয়ে একাত্তরের আগের থেকে খারাপ জায়গায় দেশকে নিয়ে যায়। বিএনপি-র আবির্ভাব একাত্তরে পরাজিত এবং আ. লীগের রক্ষণশীল ধারার মিলিত ফসল। এরা সবাই মিলে তিরিশ লাখ মানুষের মৃত্যু, আড়াই লাখ নারীর চরম যৌনদাসত্বের জীবনকে উপেক্ষা করে মসনদ আঁকড়ে ছিল। তারা চলতে পেরেছিল। কিন্তু ওই নারীরা কিংবা শহীদ পরিবারগুলো কি চলতে পেরেছিল? তারা পারেনি, তারা শেষ হয়ে গেছে। এই শেষ হয়ে যাওয়াকে অনিবার্য বলে মেনে নিতে হবে? এর সমালোচনায় কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না? সেই প্রশ্ন নীলিমা ইব্রাহিমও কিন্তু তুলেছিলেন:
তাঁর নজরে এও ধরা পড়েছে যে, ফজিলাতুন্নেসা মুজিবও মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন দেশে তার অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। কেন পাননি? নারী বলে? নীলিমা ইব্রাহিম বলছেন, বেগম মুজিব
যাহোক, ক্ষতিগ্রস্থদের অবস্থান থেকে দেখলে, বাহাত্তর সালেই অন্য প্রতিরোধী বাস্তব সৃষ্টি হয়েছিল। ততকালীন নেতৃত্ব ও সমাজের এলিট গোষ্ঠী সেটাকে ত্বরান্বিত না করে বরং দমন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের কেশ স্পর্শ না করা গেলেও হাজার হাজার তরুণকে রক্ষী বাহিনীর হাতে জীবন দিতে হয়েছে। একটি ন্যুনতম মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের যে অবিকল্প দায়িত্ব ছিল, তা বোঝার জন্য ২০১০ সালের চশমার প্রয়োজন নাই। কেননা ঐ ল্ক্ষ্য হাসিলের জন্যই তো একাত্তর সাল ঘটেছিল। তা যে হয়েছিল সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমঅধিকারের ধারণার জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ। বলাবাহুল্য একাত্তরের আগের আ. লীগ এই চেতনার প্রতিপক্ষে যে ছিল তা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। কিন্তু একাত্তরের মধ্যে দিয়ে দলটির ভেতরেও একটি অগ্রণী অংশ তৈরি হয়েছিল। এসব অর্জনের জন্য বিপ্লব করার প্রয়োজন নাই। বুর্জোয়ারাই এতদূর যেতে সক্ষম।
বেগম রোকেয়ার উদাহরণ টেনেছেন। আমি বলি, ২০১০-এর চশমা দিয়েও রোকেয়া যতটা প্রগতিশীল ও মোহমুক্ত ততটা আজকের অনেকেই নন। রোকেয়া ইউরোপীয় নারীবাদী মেরি ওলস্টেনক্রাফট, ভার্জিনিয়া উলফদের চেয়েও বেশি দূর দেখেছেন ও যেতে চেয়েছেন। রোকেয়া ও লালন সেসময়ে যেভাবে উপনিবেশিকতাকে শনাক্ত করেছিলেন আজকের অনেক প্রগতিবাদীও তা করেন না। ফলে কনটেক্সট কার কাছে কেমন তা তার রাজনীতি, আকাঙ্খা ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
তাহলেও আমি আজকের অর্থে নারী মুক্তির প্রসঙ্গ একবারও তুলিনি। বলেছি, ন্যুনতম করণীয়র কথা। আর নির্যাতন-গণহত্যা ২০১০ সালের তুলনায় ১৯৭২-৭৩-এ বেশি সহনীয় ছিল, ঐ নারীদের তখন কম কষ্ট হতো এমন বোধি আমি পাইনি। সেই ন্যুনতম করণীয় (সামাজিক আন্দোলন, ইতিহাসে তাদের স্বীকৃতি, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে একটা আপোসে আসা। বিয়ে দেওয়ার বদলে তাদের চাকরি ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার মালিক করা, নামধাম গোপন করে তাদের পুনর্বাসন করা ইত্যাদি) তা না করার ফলে তারা বিদেশে পাচার হয়েছে হাজারে হাজারে, হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করেছে, যুদ্ধশিবিরের যৌনদাসী থেকে বাঙলার প্রস কোটয়ার্টারের যৌনদাসী হয়েছে। এগুলো অবহেলার ফল এবং আমি ফল দিয়ে কারণকে দুষছি, আবেগ বা স্বপ্ন দিয়ে নয়। তাই আপনাকে ’শ্রেণী সংগ্রামীদের’ নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষের তুলনায় শেখ মুজিবকে তুলে ধরার প্রশ্নে প্রসন্ন ভূমিকায় আমি স্ববিরোধই দেখতে পেয়েছি। বাংলাদেশের নকশাল নারীদের নিয়ে নেসার আহমদের একটি বই আছে, দারুণ। সেখানে অর্জন ও ব্যর্থতার চিত্রটি ভাবায়।
মুজিব এসেনশিয়ালিস্ট ভাবেই যুগের উপযুক্ত লোক, এবং যুগটা এসেনসিয়ালি অপরিবর্তনীয় ছিল; এমন কথাই কিন্তু আপনি বলছেন। ফলে আউট অব কনেটেক্সট এবং এসেনসিয়ালিজমের অভিযোগ আপনার দিকেই যায়। ততকালীন সরকার যুদ্ধ-নারীদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে আপনার সন্তোষ তাই সমর্থনীয় নয়। যে বিরাট বিপর্যয় হয়েছিল তার তুলনায় তা অতি সামান্য। প্রয়োজন ছিল জাতীয় আলোড়ন। সেটা কোনো মহত প্রকল্পের জন্য নয়, লাখ লাখ নারীর বেঁচে থাকার প্রশ্ন। মোদ্দা কথা, তাদের জন্য ক্ষমতাসীন এবং সমাজপতিরা মামুলি খুটখাট, কয়েকশ টাকা বা একটি শাড়ির বেশি কিছু ভাবতে পারেননি। এই কনটেক্সটকে যৌক্তিক বলে মেনে নেওয়া কীভাবে সম্ভব? যে সরকার বলপূর্বক জাতীয়করণ করে তাতে দলীয় লোকদের অধিকর্তার পদে বসাতে পারে, রক্ষীবাহিনী করতে পারে, বাকশাল গঠন করার মতো মহাযজ্ঞ ঘটাতে পারে, তারা এটা পারে না কেন? এটাকে পয়লা নম্বর সমস্যা মনে না করার জন্য। আমি আবারো বলছি, এটা সমাজ সংষ্কারের ঐচ্ছিক প্রশ্ন নয়, গভীর গহ্বরে আটকে থাকা অজস্র মানুষকে হাত বাড়িয়ে তোলা না তোলার প্রশ্ন। ব্যক্তিগত মমতা দিয়ে আমি রাজনীতির বিচার করতে শিখিনি। জিয়াউর রহমান নিজে নাকি সত ছিলেন, কিন্তু সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তপনার তিনি জন্ম দিয়েছিলেন, তা ক্ষমাহীন। এর সাপেক্ষে তার ব্যক্তিগত সততা অতি নগন্য ব্যাপার।
ছোটোখাটো প্রসঙ্গ গুলো নিয়ে আর বাগবিস্তার করছি না। কেবল এটুকু বলি, রাশিয়া বা চীনের অভিজ্ঞতা যেমন আমি এক টানে বাতিল করে দিতে পারি না, আবার কমিউনিস্ট বলেই ধোয়া তুলসী পাতা হবে তাও মানি না। ফলে শ্রেণী সংগ্রামীদের বলে যে সমালোচনা আপনি করেছেন, তা অতি গ্রাহ্য সমালোচনা। কিন্তু এখানে পাল্টাপাল্টি তুলনা করে বলার প্রয়োজনটা কোথায় তৈরি হলো? বা হলেও বিদ্বেষের যে সুর স্পষ্ট করেছেন, তা না করলেও চলতো।
আমি আমার লেখায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নারী প্রশ্নের ইতিপূর্ব ফাঁদতে বসিনি। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট ইস্যু’র আলোচনা করেছি। অবশ্যই তা অপূর্ণ, কিন্তু আমি গোলাপের কাঁটা যদি দেখতে পারি, তাহলে পরবর্তী যুগে যে বিষবক্ষ মহীরুহ হয়েছে তার বিষও সনাক্ত করতে সক্ষম এটুকু আস্থা আপনি রাখতে পারেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
[মন্তব্যটি সঠিক থ্রেডে স্থানান্তরিত – ব্লগ এডমিন]
অস্মিতা - ৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:৪৮ অপরাহ্ণ)
প্রত্যুত্তরের জন্য ধন্যবাদ। সেই সঙ্গে ধন্যবাদ আপনার অবস্থানের কিছু কিছু দিক স্পষ্ট করবার জন্য। কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বিষয়:
১. প্রেক্ষাপটকে/বাস্তবতাকে আরও গভীরভাবে “বুঝতে” চাইলে যে তাকে বদলানো যাবে না, এটা ঠিক নয়। আমিও মনে হয় সেটা বলিনি। বরং উল্টোটাই ঠিক। এর সাথে “নির্ধারণবাদের”, বা ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে কি বলেন সে যোগাযোগটা ধরতে পারলাম না!
২. রক্ষী বাহিনী গঠন এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাল্টে ফেলার সূচনা করা এই দু’টো বোধ হয় একই আকারের এবং মাত্রার বিষয় নয়। তুলনাযোগ্য নয়, প্রাসঙ্গিকও বোধ হয় নয়। রক্ষী বাহিনীর মতো বাহিনী তৈরী করতে রাষ্ট্রক্ষমতাই যথেষ্ট। কিন্তু একইভাবে “নারী সমস্যারও” মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল বলে যদি মনে করেন, তবে এই বিরাঙ্গনা নারীদের বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক সমস্যার যে বহু স্তরবিশিষ্ট মাত্রা ও রূপ রয়েছে তার গুরুত্বকেই অস্বীকার করা হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর আর কিছু করার ছিলো না, সুতরাং তার আমলে গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট’ – এমন কথাও মনে হয় কোথাও বলা হয়নি। নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর আরও অনেক কিছু করার ছিল এই নারীদের জন্য, সব জায়গায় সব কালেই সেটা থাকে। তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল এবং এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে ডিঙ্গাতে ডানে বায়ে কেউ তাকে সাহায্য করেনি সে কথাও সত্য। কয়েকশো বছরে যে বাস্তবতা গড়ে ওঠে তাকে বদলাতে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল। সেখানে সদ্য স্বাধীন দেশটির সরকার এবং বিরোধী দল উভয়েরই এজেন্ডায় বিষয়টি first priority হওয়া উচিত ছিল। হয়েছে কি? আপনার ভাষায় ৭২ পরবর্তী “প্রতিরোধী বাস্তবতা” (“বাহাত্তর সালেই অন্য প্রতিরোধী বাস্তব সৃষ্টি হয়েছিল। ততকালীন নেতৃত্ব ও সমাজের এলিট গোষ্ঠী সেটাকে ত্বরান্বিত না করে বরং দমন করেছে”) এই দিয়ে যদি জাসদের শ্রেনী সংগ্রামী কমরেড ভাইদের কথা বুঝিয়ে থাকেন তবে তাদের বিপুল কর্মকান্ডের তালিকায় বিরাঙ্গনা-মুক্তিযোদ্ধা নারীরা যে first priority ছিল (!) সেটা আমার জন্য আসলেই এক নতুন খবর! কারণ, সেটি first priority হলে নারীধর্ষক শক্তিটির (ISI, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি) মদদপুষ্ট জনৈক সেনাপতিকে (যিনি কিনা তার বীরাঙ্গনা স্ত্রীকেও তালাক দিতে একরকম তৈরীই ছিলেন!) ১৯৭৫ এ ‘বন্ধু’ কিংবা ‘রাজনৈতিক সুহৃদ’ ভেবে “ভুল” করার কোনো অবকাশ কি থাকে? আর মুজিবহীন রক্ষীবাহিনী বিহীন গত ৩৬ বছরে, এমনকি আজকেও, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শ্রেনী সংগ্রামী ভায়াদের দলীয় কর্মকান্ডে বা এজেন্ডায় যুদ্ধাপরাধ/বিরাঙ্গনা কিংবা নারী ইস্যু যে first priority তে রয়েছে তেমনটিও কিন্তু মনে হচ্ছে না! অথচ, আপনারই ভাষায় এটি “সমাজ সংষ্কারের ঐচ্ছিক প্রশ্ন নয়, গভীর গহ্বরে আটকে থাকা অজস্র মানুষকে হাত বাড়িয়ে তোলা না তোলার প্রশ্ন।” তাহলে প্রশ্ন করি, আজও সেটি অগ্রাধিকার তালিকায় টিপাইমুখ কিংবা তেল গ্যাস চুক্তির আগে কিংবা (কম পক্ষে) সাথে আসে না কেন? আসে না কারণ সম্ভবত বুদ্ধিবৃত্তিক অর্থে দেশের সবচাইতে অগ্রসর অংশের নেতৃত্ব দানকারীদের দলীয় এজেন্ডাতেও নারী ইস্যুটি এবং ১৯৭১ এ তার নির্যাতনের ইস্যুটি কেবল ফুটনোট হয়েই থাকে, তা নিয়ে ২০০৯ এ নিদেন পক্ষে একটি হরতালও আমরা হতে দেখি না!
৩. উনচল্লিশ বছর ধরে যে হিসাবের খাতায় শুধু প্রায়-শুন্যই জমা পড়ে (আপনার মতে), তার হিসেব চাইতে গিয়ে সাড়ে তিন বছরের কাছে যেমন যাই তেমনি বাকি ৩৫ বছরের কাছেও যাই, ডানে বাঁয়ে দু’দিকেই যাই। একে “পাল্টাপাল্টি” বোধ হয় বলে না, বলে কমন সেন্স।
৪. সাড়ে তিন বছরে “যুদ্ধাপরাধীদের কেশাগ্র স্পর্শ করা যায়নি” কিংবা হয়নি, কথাটা কি ঠিক হল? ৭১ থেকে ৭৫ এর মধ্যে কত গুলো আইন হয়েছিল, কতগুলো চুক্তি হয়েছিল, কত সহস্র দালাল-যুদ্ধাপরাধীর কাছে ট্রাইবুনালের সমন পাঠানো হয়েছিল, তাদেরকে জেলে ভরা হয়েছিল, বিচারকার্য শুরু হয়েছিল – সে সব কি আমরা ভুলে গেছি? আর সেই বিচার প্রক্রিয়াটিকে কারা বন্ধ করে দিলো? কাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় বন্ধ করলো তাও কি আমরা ভুলে গেছি?
৫. আমার লেখা বিদ্বেষাক্রান্ত বলে মনে করেছেন বলে দুঃখ পেলাম। নিশ্চয়ই আমারই বোঝানোর ভুল। শ্রেনী সংগ্রামীদের কাছে হিসেব চাওয়া বিদ্বেষ প্রসূত ছিলো না, আপনাকে শ্রেনী সংগ্রামের মোড়ল ভেবেও কথাগুলো বলিনি। কারণ, কোন তত্ত্বকেই প্রায়-নির্ভুল sacrosanct এবং immutable ধরে নিয়ে ফর্মূলা বানিয়ে ব্যক্তি বিশেষকে তার প্রোক্রাস্টিয়ান শয্যায় ফেলে কেটে কুটে অথবা সুবিধামতো টেনে লম্বা করে লেবেল সাঁটার রাজনীতি আমিও শিখিনি 🙂
পরিশেষে, আবারও বলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভেঙ্গে আমরা কেউই বেরিয়ে আসিনি। কিন্তু বীরাঙ্গনা নারীদের ইস্যুটিকে এই পোস্টে সামনে নিয়ে এসে, ধৈর্য্য ধরে আলোচনাটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। মতের পার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু এর সবচাইতে বড়ো উপযোগিতাটি বোধ হয় এই যে এতে একটি বিষয়ের ওপর চারিদিক দিক থেকে আলোকপাতের সুযোগ তৈরী হয়। আর সেটা আছে বলেই জীবন এতো বর্ণিল।
রায়হান রশিদ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৯:৫২ পূর্বাহ্ণ)
@ ফারুক ওয়াসিফ
ধন্যবাদ আপনার পোস্টের জন্য, বিশেষ করে এই কম আলোকিত দৃষ্টিকোণটি নিয়ে লেখার জন্য। আপনি লিখেছেন:
ইয়াসমিন সাইকিয়া থেকে আপনি অনেকটুকু উদ্ধৃত করেছেন মূল পোস্টে, সম্ভবত History Workshop Journal এর নিবন্ধটি থেকে। সাইকিয়াকে কি আপনার সত্যিই “নির্মোহ যুক্তি কাঠামো” এর ধারক মনে হয়েছে নিবন্ধটি পড়ে?
ফারুক ওয়াসিফ - ২৯ ডিসেম্বর ২০০৯ (৩:৩৩ অপরাহ্ণ)
ইয়াসিমন সাইকিয়ার নিবন্ধ Beyond the Archive of Silence: Narratives of Violence of the 1971 Liberation War of Bangladesh
নিবন্ধটি আমি পুরোটা অনুবাদ করি সমকালে ধারাবাহিকভাবে। তার লেখা, নয়নিকা মুখার্জির লেখা, সুসান ব্রাউমিলা, বিনা ডি কস্টা, আফসান চৌধুরীর গবেষণা থেকে উপকৃত হয়েছি।
সাইকিয়া বা আর কেউ নির্মোহ কিনা সেটা কি আলাদা প্রশ্ন নয়? আপনার প্রশ্নটার মধ্যেই একটা উত্তেরের আভাস আছে। সেটা জানতে আগ্রহী। তা নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে।
আমি বিষয়টাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছি তাতে আমি আমাদেরই প্রশ্ন করেছি।
বিপ্লব রহমান - ২ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৩২ অপরাহ্ণ)
১। অনেকদিন পর আপনার একটি লেখা পড়লাম। যথারীতি অসাধারণ লিখেছেন। বক্তব্যের ধারটুকুও এর স্বচ্ছতাকে ম্লান করেনি। চলুক।
২। ‘বীরাঙ্গনা’ নামক একটি তকমা দিয়েই মুজিব সরকার সে সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র। …
এখন বৃদ্ধ মা’র সঙ্গে যুদ্ধদিনের কথা আলাপ করে বুঝতে পারি, ছোট বেলায় ঢাকার পথে-ঘাটে যে অসংখ্য উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ মানসিক ভারসাম্যহীন অসহায় নারীদের দেখে ভয়ে মা’র কোলের নিরাপদ আশ্রয় নিতাম, সেই সব ‘পাগলী’দের অনেকেই হয়তো ছিলেন ‘বীরাঙ্গনা’!
আর একই দলের হাসিনা সরকার এখন প্রতিবন্ধীদের ‘সুবর্ন নাগরিক’ নামে আরেক তকমা আঁটার পায়তারা করছে। …
৩। যদি স্মৃতি প্রতারণা না করে, তাহলে লেখার ছবিটি বোধহয় ‘৭১ এ শরনার্থী শিবিরের ওপর তোলা পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত আলোকচিত্রী কিশোর পারেখের তোলা, যেখানে পাক-বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা এক হতভাগ্যের বেদনাটুকু ফোকাস করা হয়েছে।
কিন্তু লেখায় ছবিটির সৌজন্যটুকু স্বীকার না করাটা খুবই দৃষ্টিকটৃ লেগেছে। এটি একই সঙ্গে অনৈতিক, এমন কি তা কপিরাইট লংঘনের পর্যায়ে পড়ে।
সৈকত আচার্য্য - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (১:১৯ পূর্বাহ্ণ)
@ প্রিয় বিপ্লব রহমানঃ
আপনি লিখেছেনঃ
মনে হয়, আরো দু’ একটা দায়িত্ব তারা পালন করতে চেয়েছিলেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সেই সময়ে ‘৭২ সালেই সারা দেশ জুড়ে অনেক সেবাসদন খোলা হয়েছিল। নির্যাতনের শিকার, সেই নারীরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী হয় বাচ্চার জন্ম দিয়েছে কিংবা গর্ভপাত করেছে। রাষ্ট্রীয় এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সম্ভবতঃ বেশ কিছু বিবেচনার ভিত্তিতে, যেমন ধরুনঃ
এই নির্যাতিতা মহিলারা লুকিয়ে গোপনে অনেক হাতুড়ে ধাত্রীদের দারস্থ হচ্ছিল। যাদের অনেকেই ভুল চিকিত্সার বলি হয়েছেন। অনেকে জটিল শারীরিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সামাজিক বাস্তবতাও এমন ছিলনা যে, তাদের কেউ গ্রহন করবে। হয়তো আরেকটি বিবেচনা ছিল এই যে, এই বাচ্চাদের সঠিক ভাবে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। রাষ্ট্র মনে করেছে যে, এতে করে দেশের ভিতরে চরম গ্লানি নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে গিয়ে বেড়ে উঠার চাইতে, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে আপাতঃ উন্নত কোন কোন দেশের আবহে বড় হলে, অন্ততঃ মনুষ্যত্বের চরম যে অবমাননাটুকু দেশে তারা ভোগ করতো, তার থেকে নিস্তার পাবে। নিজের জীবনকে তারা একটা ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখার এবং মুল্যায়ন করার সুযোগ পাবে। কোন একদিন।
‘৭২ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই আয়োজন নারীকে খাটো করেনি, বরং, পরিস্থিতির বিবেচনায় একটা আপাতঃ সমাধান দিয়েছে (যদিও এই সমাধান কোন ভাবেই ideal সমাধান নয়)। সবচাইতে ভালো হতো, এই শিশুদের আমরা যদি এদেশে, নিজেদের ভাই-বোনের আদরে এবং এদেশের আলো বাতাসে বড় করতে পারতাম। ‘৭২ এর কথা ছেড়ে আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই, পারবে কি এদেশ তাদের ধারন করতে। এখনো? পতিতাপল্লী ছেড়ে হাজার হাজার মেয়ে এবং তাদের বাচ্চারা আমাদের সমাজে মানুষের মতো বাঁচতে চায়। আমরা কি তাদের আসতে দেই স্বাভাবিক জীবনে? আজও?
যেক্ষেত্রে আজকের দিনেও গর্ভপাত বিষয়টি ধর্মীয় মুল্যবোধ এবং আধুনিক সমাজের নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অনৈতিক মনে করা হয়, সে ক্ষেত্রে ৩৮ বছর আগে সরকারী উদ্যোগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া আদৌঃ চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ কিনা সে বিবেচনার ভার আপনার।
আরও একটি উদ্যোগ ছিলো, যেমনঃ বিভিন্ন বিদেশী সংস্থাগুলোকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আহবান জানানো হয়েছিলো। আহবান জানানো হয়েছিলো, আমাদের যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে। দেশের প্রচলিত আইন দত্তক প্রথার বিরুদ্ধে ছিল বিধায় ‘৭২ সালেই জারী করা হয়েছিল, Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 ( PO No. 124 of 1972) এতে করে বিদেশি রাষ্ট্রের দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রে আইনগত বাঁধাটা আর থাকলো না। আরো অনেক পুনর্বাসনের কাজ ধারাবাহিক ভাবে করা যেতো, নিশ্চয়ই। সরকার পরিচালনায় দক্ষতার অভাব কিংবা সরকারের অভ্যন্তরে নানা টানা পোড়ন এবং পরবর্তী সরকারগুলোর এ বিষয়ে চরম অনাগ্রহ এই প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছে। এই বেদনা এবং দুঃখ আমাদের প্রতিদিন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
পরিশেষে বলি, আপনার কথাটা, মাপ করবেন আমায়, কেবলিই একটি sweeping comment বলে মনে হয়েছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
ফারুক ওয়াসিফ - ৩ জানুয়ারি ২০১০ (১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ বিপ্লবদা, গুরুত্বপূণর্ সংযোজনের জন্য।
ছবিটির সূত্র হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই ছবিটি ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল রিভিউ পত্রিকার বিপ্লবী বন্ধুরা বছর ৭/৮ আগে একটি পোস্টার ছেপেছিল। আলোকচিত্রীর নাম মনে করিয়ে দেওয়ায় কৃতজ্ঞ।
তবে সূত্র উল্লেখ আর কপিরাইট এক জিনিস নয়। কপিরাইট বিতর্কের বিষয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
বিপ্লব রহমান - ৩ জানুয়ারি ২০১০ (১:৩৯ অপরাহ্ণ)
ঠিক আছে, চলুক |
তবে দেখুন, সূত্র না জানায়, আপনার লেখা থেকে ছবিটি হয়তো অন্য কেউ সূত্র ছাড়াই অন্যখানে ব্যবহার করলেন, তারপর একই কায়দায় আবার অন্য কেউ…যেমনটি হয়ছিলো চে গুয়েভারার ছবি নিয়ে, সব মিলিয়ে…এর একটি বিপদজনক দিক থেকেই যায়, যার সূচনা হয়তো অসাবধানতা/ অসচেতনতা থেকে। ধন্যবাদ।
ফারুক ওয়াসিফ - ৩ জানুয়ারি ২০১০ (২:৩৫ অপরাহ্ণ)
একদম একমত :)।
ফারুক ওয়াসিফ - ৩ জানুয়ারি ২০১০ (২:০৭ অপরাহ্ণ)
@ অস্মিতা (#৫.১.১.২.১), প্রত্যুত্তর ওপরে দিতে পারছি না বলে এখানে দিচ্ছি।
এ মুহূর্তে কেন এই লেখাটা আমি পোস্ট করেছি? কারণ দুটিঃ ১। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অংশটি প্রায় আলোচিতই হয় না, বা যেভাবে হয় সেটা একাত্তরের-নারীদের প্রতি নতুন অবমাননার সামিল, তাদের অতীতের অসহায় শিকার হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে। ২) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নের সঙ্গে ধর্ষনের বিষয়টিও যুক্ত করার আইনী ও চিন্তাগত কাঠামো অনুসন্ধান।
এ কাজটি আমরা করতে পারবো না, যদি না যথাযথ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটে বিষয়টাকে ফেলে দেখা যায়। যেমন ধরুন, যে পুরুষ নির্যাতিত হয় তখন সে মুক্তিযোদ্ধা অথবা শহীদ, কিন্তু যে নারী নির্যাতিত হয় শহীদের ধারণা (শহীদ এখানে সেকুলার টার্ম হিসেবে আসছে। জাতীয়তাবাদও ধর্মের মতো পবিত্র প্রতীক, মহান নেতা, চরম আত্মত্যাগ ও শহীদ ছাড়া দাড়ায় না) তার জন্য প্রযোজ্য নয়।
যুদ্ধে রাইফেল কামান আর পুরুষাঙ্গ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে এর শিকারদের একইভাবে জাতিগঠন সংগ্রামের শিকার হিসেবে জাতীয় ইতিহাসে স্বীকার না করার রাজনীতিটি যে এখনো বহমান, সেটাই আমি দেখাতে চেয়েছি। দেখাতে চেয়েছি যে, আক্রমণকারী পুরুষ এবং আক্রান্ত নারীর সমাজের পুরুষ একটি জায়গায় একমত যে, ধর্ষিতা নারীটি সমাজের বাইরের বস্তু হয়ে গেছে। তার প্রতি কারো কোনো দায় নেই। ডান-বাম প্রশ্নের থেকেও এটা আরো গুরুতর প্রশ্ন। এই চিন্তা এখনো আমাদের সমাজে রয়ে গেছে।
নীলিমা ইব্রাহিম যেখানে বলেন যে, প্রথম ধর্ষণগুলো করেছিল বাঙালি রাজাকারেরা। তার মানে এই প্রবণতা আমাদের সমাজেরই অংশ। এখনো তা রয়ে গেছে। একটা পরিসংখ্যান কিন্তু টানাই যায় একাত্তরে প্রতিদিন যত ধর্ষন হয়েছিল, আর আজ প্রতিদিন যত ধর্ষন হয় তার তুলনা করে। বর্ণবাদের সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাপক ধর্ষন ঘটছিল শাদাদের দ্বারা যেমন, এএনসি-র ক্যাডারদের দ্বারাও তেমন। তাদের নতুন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা-র বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ আছে। সেখানে এখনো ধর্ষণের হার পৃথিবীর মধ্যে বেশি।
যাহোক, এ নিয়ে যতই ভাবছি/ ভেবেছি ততই ভয়ঙ্কর সব তথ্য ও উপলব্ধি জন্মাচ্ছে। সেগুলো শেয়ার করাও কঠিন চেপে রাখা আরো কঠিন। কিন্তু কোনো না কোনো দিন আমাদের খোলাচোখে এই বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে। অতীতকে অতীতের গহ্বরে কবর দিয়ে আসা যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। অতীতের অমীমাংসিত সমস্যা নতুন নতুন রূপে ফিরে আসবেই এবঙ তার আবির্ভাব হয় তখন আরো জটিল আকারে। বিষয়টা তাই যেমন ইতিহাসের চলতি রাজনীতিরও তেমন।
আমি নিজেকে শ্রেণী সংগ্রামের লোক বলে ভাবতে চাই, সেই তাকদ যদিও নাই। সেকারণে আপনার শ্লেষগুলো বিচার-বিবেচনার বাইরের বিদ্বেষ হিসেবে আসতে দেখে এ বিষয়ে আলোচনার আগ্রহ হারিয়েছি। কাকে আপনি শ্রেণী সঙগ্রামী বলেন, কী বোঝেন, আমরা কী বুঝি ইত্যাদি প্রশ্ন রয়েই যায়। তবে মতাদর্শের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য মতাদর্শ। মতাদর্শের বাইরেও কেউ নয়। আমি আমার মতাদর্শ নিয়ে নিরন্তর সচেতন থাকতে চাই, আমার প্রশ্ন এই বিতর্কে আপনি তেমন সজাগ ছিলেন কি?
অস্মিতা - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৩৫ অপরাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ,
আপনার লেখার উদ্দেশ্য, এর প্রয়োজনীয়তা, এবং সততা এর কোনটি নিয়েই আমি প্রশ্ন তুলিনি। বৃথাই বড়োসড়ো দু’টো প্যারাগ্রাফ খরচ করলেন।
আমি যা বলতে চেয়েছি তা হল সীমাবদ্ধতা এবং অবস্থান সত্বেও কেউ কেউ কিছু কাজ করেছেন যা যথেষ্ট নয়, কিন্তু যার কিছু কিছু নারীর যাত্রাকে আবারও বলি ‘কন্টকাকীর্ণ করেনা’ বরং সামান্য হলেও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই সামান্য স্বীকৃতি দিতে, (বা সৌজন্যতাটুকু দেখাতে) কোন তন্ত্র (পুরুষ বা সমাজ উভয় অর্থেই) যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। অতীতের সমালোচনা অবশ্যই করা উচিত তবে সেটি করতে হলে তাতে একচোখামি বা শুধু বাঁচোখামি যাতে না থাকে। তা থাকলে বাঁয়ের দিকেও প্রশ্ন ওঠে এবং সেটির জবাব চাওয়া যেতেই পারে।
উপরের বিভিন্ন মন্তব্য থেকে দুটি রাস্তা স্পষ্ট হয়। এক, ভাল যা হয়েছে (বা নিদেন পক্ষে ক্ষতিকর হয়নি) এমন বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে একে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া (নিজেদের বিবেচনা ভাবনা এবং তত্ত্বের আলোকে)। অথবা দুই, আগের উদ্যোগগুলো বড় সড়ো একটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলে তার ওপর এক দোয়াত কালি ঢেলে দিয়ে পুনরায় শুরু করা। দ্বিতীয়টির ব্যাপারে তেমন দোষের কিছু দেখি না যদি না এই নতুন করে শুরু করার বিষয়টিতে আগ্রহ, কার্যক্রম এবং যথাযথ priority র অভাব না দেখি। ভুলগুলো চিহ্নিত করলে দায়িত্বশীল মানুষের দায়িত্ব জন্মায় সেটিকে ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এখানে ‘ভাল্লাগে না খেলবো না, যাও’ বলে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কি কোন সুযোগ আছে? উপরে আমার মন্তব্যের দুই নম্বর পয়েন্টে (৫.১.১.২.১) বামেদের বিরুদ্ধে আমার মূল অভিযোগ এইটি। কারও ভুল ধরবেন তাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তা যেন অতি সরলীকরণ না হয়। অতি সরলীকরণের এই প্রক্রিয়ার বিপদটি ৭৫ এ দেখেছি, গত ৩৬ বছর ধরেই দেখছি। ইতিহাস সাক্ষী, এটি প্রায় সব সময়ই প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে গেছে। বিপদটি কোথায় হয় দেখুন। মন্তব্যকারীদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ‘তকমা’ আঁটা ছাড়া কিছুই দেখেন না, কেউ কেউ হক থেকে শুরু করে কবির উমর সকলকেই অবদানহীন ‘ক্লোজ অবজারভার’ বলে মন্তব্য করেন। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মনে পড়ছে। ‘ওদের জানিয়ে দাও’, ‘একাত্তরের যীশু’ মনে পড়ছে, আর কেবলই দুঃখ হচ্ছে। এই ক’দিন আগেও না আমরা বলতাম যে সকলেই অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেননি, কিন্তু তাতে তাদের অবদান খাটো হয়না!!?? শাহরিয়ার কবির স্বজন হারিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছেন, জেলও খেটেছেন। তার পন্থা এবং অবস্থানের সাথে সকল সময়ে আমরা সবাই একমত হইনি। কিন্তু তার কোন ‘অবদানই নেই’ এই কথাটা কি ন্যায্য হল? ভাবছি নীলিমা ইব্রাহিম, জাহানারা ইমাম, আর সুফিয়া কামালরাই আর বাদ যান কেন? তাদের গায়ে “বুর্জোয়া নারীর চিল্লাচিল্লি” খেতাবটি জুড়ে দিলেই লোম বেছে কম্বল উজাড় হওয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়।
আমার সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন (প্রথমে অবশ্য বলেছিলেন ব্যক্তি মমতায় চেতনা আচ্ছন্ন হয়েছে, নির্ধারণবাদী ইত্যাদি)। যাহোক। যেই জীবন প্রতিদিন যাপন করি তাতে চোখ খোলা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি মুহুর্তে সমাজ সংস্কার কোন কিছুই এক মুহুর্তের জন্যও ভুলতে দেয়না যে আমি নারী। এর সাথে সচেতন থেকে লড়াই করাই প্রতিটি নারীর জীবন। তবে সেই সচেতনতা আপনার অনুমোদন পাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দিহান। আমার যাপিত জীবনের ব্যাপারে আমার চাইতে আপনি বেশী সচেতন এটি জেনে আশ্বস্ত হলাম। বামচক্ষুর উম্মীলন না ঘটলে আর আমার সচেনতনতা হলো না সেইটি কেউ ধরে নিতেই পারেন। তবে তা নিয়ে আমি তেমন ভাবিত নই। শ্রেনী সংগ্রাম বলতে আপনি কি বোঝেন বা আমি কি বুঝলাম তার চাইতেও জরুরী প্রশ্ন সম্ভবত এই যে বীরাঙ্গনারা কি বুঝলেন বা তাদের বোঝাতে কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল (এই তত্ত্বের চর্চাকারী দলগুলোর কাছ থেকে) কিংবা এই রাজনীতির কাছ থেকে তারা কি পেয়েছেন। সেই উত্তরটা এখনো পেলাম না।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৩ জানুয়ারি ২০১০ (৬:১৭ অপরাহ্ণ)
ফারুক ওয়াসিফ ও অন্যান্যদের দ্বারা নির্মিত বিশাল আয়োজনখানা পড়লাম। আমার এই স্বল্পমাত্রার আলোচনায় ফারুককে আমার গভীর ভালোবাসা জানাই।
একটি বিষয় আমার কাছে অন্তত পরিষ্কার যে, শেখ মুজিব তো আর ফিদেল ক্যাস্ট্রো হতে চাননি। তা হতে চাইলে তো কিউবার মতো এই দেশে সমাজতন্ত্রই কায়েম হয়ে যেত। ক্যাস্ট্রো তাঁর প্রেরণা, মেধা, প্রগতিশীলতার প্রতি দায়বদ্ধতা লালন করে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রগতিশীল কাঠামোয় সর্বাংশে রূপান্তরিত করেন।
আর এখন সংসদীয় রাজনীতির ক্ষমতাকাতর দুই সংগঠন তাদের মসনদের স্বার্থে যা দরকার তাই তো করবে! এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে এখন আমরা ভোটের রাজনীতির নানান জারিজুরি দেখব।
ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই, সাকা চৌধুরী, নিজামী বা মুজাহিদী শুধু নয়, যারাই যুদ্ধোপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া দরকার। আর শাহরিয়ার কবীরদের কথা বলবেন না কেন ফারুক ওয়াসিফ? সৈয়দ শামসুল হক, শাহরিয়ার কবীর, ব. উমররা ছিলেন এই জনযু্দ্ধরুপী মুক্তিযুদ্ধের ক্লোজ অবজার্ভার। তাঁরা সরাসরি কোনো অবদানই রাখেননি।
সাকা চৌধুরীর বিচারটা হওয়া দরকার সবার আগে। কারণ এই লোক অপরাধ তো করেইছেন, আবার বড়ো বড়ো কথা বলার ওস্তাদ। এক সাংবাদিক তাকে একবার প্রশ্ন করেন, আচ্ছা, আপনি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কোন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিলেন? তিনি বলেন, আমাদের ভাতিজি পুতুলের শ্বশুর যে ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিলেন, আমরাও সেই ফ্রন্টেই যু্দ্ধ করেছিলাম হাহাহা। আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনি পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব কতদিন পর্যন্ত স্বীকার করেন? উত্তরে তিনি বলেন, মরহুম শেখ মুজিব যতদিন তা মেনে নিয়েছিলেন আমরাও ততদিনই মেনে নিয়েছিলাম।
যাই হোক, ফারুক ওয়াসিফকে আবারও শুভেচ্ছা জানাই এমন একটি দরকারি পোস্ট উপহার দেয়ার জন্য।
সৈকত আচার্য্য - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (১:৩৪ পূর্বাহ্ণ)
@ কামরুজ্জামান জাহাংগীরঃ
তখন এদের ভূমিকা কি ছিল, একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন? ক্লোজ অবজারভার বলতেই বা কি বোঝাতে চেয়েছেন, একটু যদি পরিস্কার করেন, উপকৃত হব। অনেক ধন্যবাদ।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ)
সৈয়দ শামসুল হক স্বাধীনতাযু্দ্ধের শুরুর দিকে বাংলাদেশ থেকে লন্ডন চলে যান এবং বিবিসিতে কাজ করতে থাকেন। শামসুর রাহমান তাঁর স্মৃতিকথনে বলছেন, সৈয়দ শামসুল হকের উচিৎ হয়নি কাউকে না জানিয়ে এভাবে চলে যাওয়া। আবার সৈয়দ শামসুল হক নিজে জানিয়েছিলেন, তিনি তখন নীরবে নিভৃতে তাঁর বাঙালিত্ব বজায় রাখছিলেন। আমার সহজ প্রশ্ন, তখন এইভাবে শুধুমাত্র বাঙালিত্ব বজায় রাখার পরিবেশ ছিল?
শাহরিয়ার কবীর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি কোনো ভূমিকাই নেননি। ওই ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধকালে ওইভাবে নীরবে সময় পার করাটা কি সমীচীন কর্ম ছিল?
বদরুদ্দীন উমর কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ঘোষণা দিয়ে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, তা সত্য, কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর তো কোনো লড়াকু ভূমিকা দেখি না।
রায়হান রশিদ - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (৭:৫৫ অপরাহ্ণ)
@ ফারুক ওয়াসিফ # ১.১.২.১
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, শুধু আন্তর্জাতিক আদালতেই নয়, দেশীয় আদালতে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে হলে নথিবদ্ধ প্রমাণ কিছু কম লাগে না। তবে আপনার বক্তব্যের একটি অংশ পরিষ্কার হয়নি। আপনি কি বলতে চাইছেন আন্তর্জাতিক আদালতে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত? নাকি “আন্তর্জাতিক আদালত” কথাটা উল্লেখ করেছেন কেবল বিচারিক মানদন্ড বোঝাতে? দ্বিতীয়টি যদি হয়, তাহলে প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করতে চাই ‘আন্তর্জাতিক আদালতের” বিচারের মানও কিন্তু প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়!
আরেকটি বিষয়, জাতিসংঘের গণহত্যা তালিকায় স্বীকৃতি লাভের সাথে কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের নথিবদ্ধ প্রমাণ বিষয়টির কোন সম্পর্ক নেই। প্রথমটার সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং দেশীর রাজনীতির ব্যার্থতা জড়িত, দ্বিতীয়টা সাদাকালো আইনী মানদন্ড। Ndahiro এর লেখাটিও পড়ে নেয়া যেতে পারে এই প্রসঙ্গে, সাথে Beachler।
একটু বিভ্রান্তিকর ঠেকছে, হতে পারে আমারই বোঝার সীমাবদ্ধতা। ঠিক কোন্ তালিকার ক্যাটেগরি থেকে এই ১১৮ জন যুদ্ধাপরাধীর কথা বলছেন একটু উল্লেখ করলে বুঝতে সুবিধা হয়। ক্যাটেগরি তখন অনেকগুলো ছিল, সেটা আপনার অজানা থাকার কথা না। এখনো সে সব ক্যাটেগরি বহাল আছে।
শুধু ‘ওয়ার ক্রাইম’ অর্থে বিচার করার কথা উঠছে, এটি ঠিক কোথায় পাওয়া গেল? ১৯৭৩ সালের International Crimes (Tribunals) Act (যেটির মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের বর্তমান আয়োজন) এ স্পষ্টভাবে বলা আছে বিচার্য অপরাধগুলোর কথা। আইনটির তালিকাতেই ‘ওয়ার ক্রাইম’ ছাড়াও রয়েছে ‘জেনোসাইড’, ‘ক্রাইমস এগেইন্সট হিউম্যানিটি’, ‘ক্রাইমস এগেইনস্ট পীস’। এর বাইরের অপরাধগুলোও বিচারের জন্য কিছু generic provision রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে অন্যান্য অপরাধগুলোরও বিচার করা সম্ভব। আইনটির ধারা ৩ পড়ে নেয়ার অনুরোধ করবো। শুধু ধারাগুলোই নয়, এর বাইরেও আমাদের হাতে রয়েছে শব্দগুলোর/টার্মগুলোর প্রযোজ্য আইনী ব্যাখ্যা/সংজ্ঞা যা আমরা পেয়েছি ইউগোশ্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরা লিয়ন, কম্বোডিয়ার রায়গুলো থেকে।
ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন ধরতে পারলাম না। আইনী প্রস্তুতির কথা উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু “রাজনৈতিক প্রস্তুতি”র বিষয়টি (এ প্রসঙ্গে) স্পষ্ট হচ্ছে না। আর, “জেন্ডারসাইড” শব্দটিই বা উল্লেখ করা হল ঠিক কি অর্থে? কার জেন্ডারসাইড কিংবা কোথাকার জেন্ডারসাইড এর কথা বোঝাতে চেয়েছেন? বিহারী নারীদের ইস্যুটিকে বোঝাতে চাইলেন কি? নাকি বাঙ্গালী কর্তৃক বাঙ্গালী নারী ধর্ষণের ইস্যুটি? আমি মনে করি (নিতান্তই ব্যক্তিগত মত) টার্মগুলো আমাদের আরও সাবধানে ব্যবহার করা উচিত, বিশেষত, আইনের দৃষ্টিতে ‘জেন্ডারসাইড’ এর মতো এ ধরণের জটিল টার্মগুলো; সেগুলোর সংজ্ঞাগত প্রয়োগগত দিকগুলো বিবেচনায়। কারণ, এই প্রতিটি শব্দের সংজ্ঞার কিছু threshold point রয়েছে। ‘জেনোসাইড’ কখন ‘জেন্ডারসাইড’ হয়ে উঠতে পারে, কিংবা “war time rape” কখন “genocidal rape” হয়ে উঠতে পারে, তার কিছু strict মানদন্ড রয়েছে, doctrinal প্রয়োজনেই। আর সেই মানদন্ডে তাত্ত্বিকভাবে “জেন্ডারসাইড” আর যে কোন অপরাধের চেয়েও প্রমাণ করা কঠিন। এই শব্দগুলো তাই ছুঁড়ে দেয়ার আগে সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। সাইকিয়াকেও (যেখান থেকে আপনি অনেকটুকু উদ্ধৃত করেছেন) এই মৌলিক তাত্ত্বিক পার্থক্যগুলোর বিষয়ে সচেতন মনে হয়নি (আপনার মন্তব্য ৬.১. এর জবাবে)। বিস্তারিত জানতে দেখুন: MacKinnon, Sharlach, Carpenter, McCherif, Damgaard, Schabas (সবগুলো আইটেমই ওয়ার ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম এর ই-লাইব্রেরীতে রয়েছে)। ভাল কথা, সাইকিয়ার যে আর্টিকেলটি আপনি অনুবাদ করেছেন জানিয়েছেন, সেটিই History Workshop Journal (Issue#58, 2004) এই ছাপানো হয়েছিল, যা উপরে উল্লেখ করেছি (অন্য আর কোথাও ছাপা হয়েছিল কিনা জানা নেই)।
এও একটু বিভ্রান্তিকর। দয়া করে ব্যাখ্যা করুন ঠিক কোন্ ফ্রেমওয়ার্কে ট্রুথ কমিশনের প্রস্তাব আনছেন আপনি। আদালতনির্ভর বিচারের বিকল্প হিসেবে? নাকি সে প্রক্রিয়ার সম্পূরক হিসেবে কোন এক অদূর/সুদূর ভবিষ্যতের কথা মনে রেখে? ট্রুথ কমিশন বিষয়ে রুয়ান্ডা আর সিয়েরা লিয়নবাসীদের বিপরীত অবস্থানগুলো আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই। উল্লেখ প্রয়োজন, ট্রানজিশনাল জাস্টিস বিষয়ে এখনকার গবেষকরাও কিন্তু সবাই বিষয়টিকে একভাবে দেখেন না; একে অবশ্য-অনুসরণীয় তত্ত্বগত অবস্থানে বসানো তো আরও বহু দূরের কথা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের “ট্রানজিশনাল জাস্টিস সেন্টার” এর গবেষক গ্রুপের কিছু influential কাজ আছে এই বিষয়ে। সুপারিশ করবো Philip Clark এর সমালোচনাগুলো পড়বার জন্য (স্ক্যানিং এর কাজ চলছে; ইলাইব্রেরীতেও তোলা হবে)।
ধন্যবাদ।
অস্মিতা - ৪ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৩৮ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ রায়হান রশিদ, ম্যাককিননের লেখাটির কথা উল্লেখ করার জন্য (সম্ভবত হার্ভার্ড এবং ইউসিএলএ নারী জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ দু’টোকেই বোঝাতে চেয়েছেন)। সাইকিয়ার লেখা পড়ে আমারও মনে হয়েছে তিনি “war time rape” এবং “genocidal rape” এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন, সজ্ঞানে না অজ্ঞানে বলতে পারছি না। এই দু’টির মধ্যে পার্থক্য না করে জল ঘোলা করে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে জটিলতর করতে একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতাটির সাথে আমরা পরিচিত। (প্রাক্তন) য়ুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে দেখেছি, রুয়ান্ডায় দেখেছি (ধন্যবাদ রায়হান Ndahiroর প্রয়োজনীয় লেখাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য), সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা প্যানেলের কিছু আইনের শিক্ষকের লেখাতেও দেখেছি, চিহ্নিত জামাতিরা তো প্রতিনিয়তই করছে।
সাইকিয়ার আরেকটি বড়ো একাডেমিক অসততা বলে মনে করি তার লেখায় ১৯৭১ কে Civil War হিসাবে উল্লেখ করা। এ বিষয়ে ম্যাককিননের (যিনি আমার মতে গত কয়েক দশকের সবচাইতে শ্রদ্ধেয় এবং উল্লেখযোগ্য নারীবাদী গবেষকদের একজন) লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি নিচে। যে শ্রেনীটি ১৯৭১ কে civil war বলে চালিয়ে দিতে চান, তাদেরকে নিয়েই (য়ুগোশ্লাভিয়ার প্রেক্ষাপটে) ম্যাককিনন লিখেছেন:
আর সাইকিয়া-জাতীয় নারীবাদীদেরকে (!!) নিয়ে ম্যাককিননের এই উদ্ধৃতিটি পড়ে দেখা যেতে পারে:
বেশ কিছু দিন আগের একটা আড্ডার কথা মনে পড়ছে। আমরা ক’জন ভাবছিলাম, সাইকিয়ার এই লেখাটি হাতে পেলে শর্মিলা বোস না জানি কি করতেন! খুশীতে লাফ দিয়ে উঠতেন বোধ হয় 🙂
ফারুক ওয়াসিফ - ৭ জানুয়ারি ২০১০ (১১:২১ অপরাহ্ণ)
সময়াভাবে আপাতত এই লিংকটি শেয়ার করা গেল
আদি পাপ, ১৯৭১ এর অপরাধের বিচার
http://www.sachalayatan.com/faruk_wasif/23010
রায়হান রশিদ - ৮ জানুয়ারি ২০১০ (১০:২১ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ লিন্কটির জন্য। সচলায়তনে আহমেদ জিয়াউদ্দিন এর লেখাটির আপনার করা অনুবাদ পড়লাম। এখানকার আলোচনায় সুনির্দিষ্টভাবে লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা একটু কষ্ট করে উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করলে হয়তো বুঝতে সুবিধে হতো। কিছু প্রশ্নও এসেছে মনে, যা নিয়ে আরও আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তার আগে, আপনাকে বিনীত অনুরোধ:
১) আহমেদ জিয়াউদ্দিন এর মূল ইংরেজী লেখাটি কি পাঠাতে পারেন প্লিজ? পুরো লেখাটি খুঁজছি।
২) সমকাল এ ছাপানো আপনার করা সাইকিয়ার লেখার অনুবাদটির লিন্ক খুঁজছি। অনুবাদটির ওয়ার্ড বা পিডিএফ হলেও চলবে।
রেজাউল করিম সুমন - ৫ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৪৫ অপরাহ্ণ)
আমাদের ইতিহাসের অত্যন্ত-গুরুত্বপূর্ণ-অথচ-প্রায়-ধামাচাপা-দেওয়া একটি অধ্যায় নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করার করার জন্য ফারুক ওয়াসিফকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রাসঙ্গিক আলোচনা আগ্রহের সঙ্গে অনুসরণ করছি, আলোকিত হচ্ছি।
তানভীর ইসলাম - ৯ জানুয়ারি ২০১০ (১২:৫০ পূর্বাহ্ণ)
সাইকিয়ার নিবন্ধটি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলাম ফারুক ওয়াসিফের সচলে প্রকাশিত পোস্টে। (পোস্টের নীচের দিকে পাবেন)
http://www.sachalayatan.com/faruk_wasif/22979
Pingback: একজন বীরাঙ্গনা এবং একটি মুক্তিযুদ্ধ// মেকানিক্স