সেইসব ‘বীরাঙ্গনা’, তাদের না-পাক শরীর এবং একাত্তরের কাজলরেখাদের কথা

মার্চে শোকের মাতম আর ডিসেম্বরে বিজয়ের বাজনা_ এ-ই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ উদযাপন। সেই স্মরণের তালিকায় সব কিছু আসে, আসে না কেবল সেইসব নারীদের কথা, যাদের শোকের শরিক রাষ্ট্র হয়নি। তাদের বিজয় আজো আসেনি। বিজয়হীনা সেই নারীদের আমরা বীর ডাকি না, ডাকি ‘বীরাঙ্গনা’ বলে। ‘বীরাঙ্গনা’ মানে বীরের অঙ্গনা, বীরের নারী। বীরত্বের যে পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা তাতে কেবল পুরুষেরই অধিকার। নারীর কোটায় কেবল বীরের অঙ্গনা হবার ছাড় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নারী আর ধর্ষণ-নির্যাতন আর গণহত্যার শিকার লক্ষ লক্ষ নারীদের কেন এক দাগে পুরুষের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে? স্বাধীনতা অর্জনে যদি তাদেরও বিরাট ত্যাগ ও অবদান থেকে থাকে, তবে কেন তাদের কেবল ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবের মধ্যে আটকে থাকতে হবে? এটা কি বীরের সম্মান না অধঃস্তনের প্রতি করুণা ও অবজ্ঞা?

একাত্তরের সব থেকে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ নারীরা। তাদের ঘরে থাকা সহজ ছিল না, পালানো ছিল আরো কঠিন। যুদ্ধে যেতে চাওয়াও যখন প্রায় অসম্ভব ছিল, তখনও যুদ্ধে সামিল হয়েছেন এমন নারী বিরল নয়। অথচ সত্তরের ডিসেম্বরে ছাত্রীদের কাঁধে ডামি বন্দুক দিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হলেও যুদ্ধের সময় মেয়েদের নিয়ে আলাদা কোনো বাহিনী গঠন কিংবা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ধর্ষিতার সারিতে তারা, গণহত্যার মোট সংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশও তারা। শাহীন আফরোজের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। জাতীয়তাবাদ কি তবে পুরুষের মতাদর্শ?

আজ এতদিন পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঘৃণায় কথার আগ্নেয়গিরি জ্বালানো বরং সহজ; কিন্তু কঠিন সেসব নারীদের কথা বলা; স্বাধীনতার দাম যাদের সবচেয়ে বেশি মূল্যে শুধতে হয়েছিল। সরকারি হিসাবে আড়াই লাখ এবং কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় চার লাখ নারী একাত্তরে ধর্ষিত হয়েছিলেন। ৮ থেকে ৮৭ বছর বয়সের। একবার নয়, একদিনের জন্য নয়_ বারবার অনেক দিন ধরে অমানবিক পরিবেশে আটক থেকে। আত্মহত্যা করারও উপায় ছিল না। মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সিলিংয়ে ঝুলে পড়তে না পারে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তাদের নিপীড়নের ভয়াবহতার পুরোটা প্রকাশের জন্য যথেষ্ঠ নয়। আমরা পুরুষরা সেই নিপীড়নের শিকার হতে পারি না বলে হয়তো পুরুষালি ভাষায় তা প্রকাশ করাও কঠিন।

মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কারো মতে ১০ লাখ কারো মতে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। বেশি সংখ্যাটাই যদি ধরি এবং এর কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি নারী হন, তাহলেও ৬ লাখ নারী নিহত হয়েছিলেন। ৪ লাখ চরম নির্যাতিত (এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন) আর ৬ লাখ নিহত নারীর পরিণতি আমাদের জাতীয় মানসে কোন দাগ রেখে গেল? এই দশ লাখ নারী কেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে না। জাতীয় মুক্তির যুদ্ধের ‘গৌরব’ কি কেবলই পুরুষেরই? ১৯৭৩ সালে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন নারী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের দরিদ্র নারী তারামন বিবি। তিনি তার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পাওয়ার খবর জানতে পারেন ঘটনার ২৪ বছর পর।

ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (ব্রাউমিলার, ১৯৭৫: ৮৪)। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির পুরোধা এমএ হাসান দাবি করেন, ‘এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ এদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস। বাহাত্তর সালের গোড়াতেই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি তাঁর কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে নষ্ট করেছে। এত কিছুর পরও যারা জন্মাতে পেরেছিল তাদের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা, ভিখারির কাছে বিক্রি করাসহ বিদেশে দত্তক দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। এই নারীদের অনেকেরই প্রজনন ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

মাদার তেরেসা সেসময় এসব নারীদের সহযোগিতা করতে ঢাকায় আসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনেক শিশুকে কানাডা, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে পাঠানো হয়। এসব শিশুর নাম দেওয়া হয় ‘যুদ্ধশিশু’ (ওয়ার বেবি)। আজ তারা কী করছে, কী করছে তাদের হতভাগ্য মায়েরা? ‘কে আর ইতিহাস খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ হয়তো এ কারণেই যৌন নির্যাতন বিষয়ে তদন্তে যাওয়ার বদলে বিষয়টিকেই নীরবতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এসব নারীর ‘মানমর্যাদার’ কথা চিন্তা করে নষ্ট করে দেওয়া হয় তাদের নামধাম, নথিপত্র। এভাবেই জাতীয় অহম রক্ষার জন্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ইতিহাস থেকেও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। নির্যাতিত বা শহীদ নারীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ তো দূরের কথা একটা স্মারক পর্যন্ত নেই কোথাও। এখনকার কথা বলি। অতিসম্প্রতি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি জেনারেল হারুন-অর রশীদ প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিষয়টা যত কম আলোচিত হয় তত ভাল।’ এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। পরিবারের সদস্যরাও সান্তনা ও মর্যাদা দেওয়ার বদলে তাদের কিছুটা ‘পতিত’ ও করুণ চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, জাতির ধারণা কি কেবলই পুরুষালি, নারীর অস্তিত্ব, ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতি সেখানে কোথায়?

শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে আটক অবস্থা থেকে দেশে ফেরেন বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় তিনি বলেন, ‘দুই লাখ মা-বোন! এদের আমি কোথায় কী করব?’ ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’ (বাংলার বাণী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)। ‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা’দের একটা সুব্যবস্থা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সন্তানদের মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া. আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না।’ (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল। কিন্তু এর মোকাবেলা না করে কর্তাব্যক্তিরা এটাকে চেপে যাওয়াই সঠিক মনে করেছেন। সরকারের তরফ থেকে এসব নির্যাতিত নারীকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তারা ভেবেছেন সেটাই নারী জীবনের একমাত্র গন্তব্য। অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন, তবে মোটা যৌতুক চান। যৌতুকের লিস্টির মধ্যে লাল জাপানি গাড়ি থেকে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করা পর্যন্ত ছিল। তাদের যুক্তি: এদের অভিভাবক হিসাবে যৌতুক মেটানোর দায়িত্ব সরকারের। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বাবা।’ ইতিহাসের দায় কি এতেই শোধ হয়? ড. ডেভিস মন্তব্য করেন, ‘না, কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি।… পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল (সাক্ষাৎকার, বিনা ডি কস্টা, ২০০২)।

জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদাবোধ আর পারিবারিক পবিত্রতার পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ একজোট হয়ে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে নারীর নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতাকে ‘বীরাঙ্গনা’ নামের আড়ালে ঢেকে দেয় এসব তার প্রমাণ। পরিবারের পিতা বা বড় ভাই আর ‘জাতির পিতা’ এখানে এক সুরে কথা বলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরুষালি ইতিহাস নারীকে কেবল সতীত্বের তকমা আঁটা চেহারাতেই দেখতে চেয়েছে। নারী যুদ্ধও করবে, পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বলিও হতে পারবে কিন্তু কোনোভাবেই পুরুষের পরিবারের সদস্য হওয়ার অনুপযুক্তা হতে পারবে না – তাকে ‘শুদ্ধ’ থাকতেই হবে। জাতীয় জীবনে একাত্তর মহান আবেগের উৎস। কিন্তু কী সমাজে আর কী রাষ্ট্রে সেই আবেগের মহত্ব একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের কোনো ভাবেই মর্যাদা দিতে পারে না।

মুক্তির যুদ্ধ ছিল একইসঙ্গে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে নারীর লড়াইয়ের ইতিহাস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পূর্ণ হতে পারে না। পুরুষের মুক্তিযুদ্ধ তাই একাত্তরের একমাত্র কাহিনী নয়। যুদ্ধটা নারীরও। সেদিন বাঙালি সত্তা যেমন আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি নারীসত্তাকে দলিত ও ধ্বংস করাটাও শত্রুর লক্ষ্য ছিল। নারী তাই দু’ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল – প্রথমত, নারী হিসাবে; দ্বিতীয়ত, বাঙালি মাতা হিসাবে, বাঙালিদের জন্মদায়িনী হিসাবে। পুরুষদের অনেকে রণাঙ্গনে ছিল, অনেকে ছিল পালিয়ে। তার মধ্যে ভয়, অভাব, অনিশ্চয়তার মধ্যে লক্ষ লক্ষ নারীকে একা একা সংসার ও পরিবার টিকিয়ে রাখার লড়াই চালাতে হয়েছিল। তার যাবার জায়গাও ছিল না। অথচ এদিকটা ভুলে যাওয়া হয়। পুরুষরা প্রতিরোধ গড়েছিল আর নারীরা পেছনে থেকে সমাজ-সংসার টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়েছে। বাহাত্তরে না হয় নতুন রাষ্ট্র যাত্রা করলো, একই সঙ্গে সমাজ-সংসারও যে চলতে পেরেছিল তার কারণ নারীর এই দায়িত্বশীল ভূমিকা। রণাঙ্গনের লড়াইয়ের থেকে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না এটি।

একাত্তরে নির্যাতিত ও শহীদ নারীদের কথা মনে হলে আমার তাই রূপকথার কাজলরেখার গল্প মনে পড়ে। সেই কাজলরেখা যে বিপুল অধ্যাবসায়ে সূচরাজার শরীর থেকে সমস্ত সূচ তুলে তুলে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এর পুরস্কার সে পায়নি। পেয়েছে অন্য আরেকজন, কারণ সূচরাজার চোখের সূচ কাজলরেখাকে লুকিয়ে অন্যজন তুলেছিল। সূচরাজা ভেবেছিল, সেই-ই তাকে বাঁচিয়েছে। পুরস্কার পেয়েছে সেইজন, কাজলরেখা হয়েছে ‘চাকরানি’। কী বিষ্ময়কর যে, যশোরের মধুমিতার জীবনে (ছদ্মনাম) এরকম ঘটনাই ঘটেছিল। বাড়ির সবাই পালাতে পারলেও মধুমিতা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। তারা তাকে ধর্ষণ করে উঠানে ফেলে রেখে ঘরে আগুন দিয়ে চলে যায়। তার ছোটো ভাই রয়ে যায় সেই ঘরের মধ্যে আটক। মধুমিতার জবানিতেই শোনা যাক :

‘তাদের কাজ হয়ে যাবার পর তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি তো আমার ভাইটিকে মরতে দিতে পারি না। তাই অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও নিজেকে কোনো মতে তুলে ভাইকে দরজা ভাঙায় সাহায্য করলাম। তা করতে গিয়ে মারাÍকভাবে পুড়ে গেলাম। সেই রাতে লুকিয়ে থাকলাম বাড়ির পেছনের পুকুরটাতে। পরদিন ভোরে যখন পুকুর থেকে উঠলাম, আমার গায়ের মাংস খাবলা খাবলা করে খসে পড়তে লাগল। দু’একটা টুকরা ছাড়া গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, গাঁয়ের কিছু লোক ভোরের নামাজ পড়ে ফিরছে। আমাকে দেখে তারা মজা পেয়ে হৈহৈ করে উঠল। আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম, আমি বেশ্যা নই, ওমুক আমার বাবা, আমাকে সাহায্য করুন। কিন্তু তারা চলে গেল। সেদিন থেকে আমি জীবন্ত মরা। আমার শরীরে যন্ত্রণা। আজ আমার কোনো শিক্ষা কোনো স্থান কোনো মর্যাদা নেই। ভাইয়ের জন্য আমার জীবন, সম্মান সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি। অথচ আমি এখন তার চাকরের থেকে বেশি কিছু না। এই-ই বাংলাদেশে মেয়েদের কপাল।’’ (ইয়াসমিন সাইকিয়া, ২৮৬, হিস্টরি ওয়ার্কসপ জার্নাল)

রূপকথার কাজলরেখা শেষপর্যন্ত প্রতিদান ও সম্মান পেয়েছিল, কিন্তু বাস্তবের হালিমারা তা পায় না। কারণ জীবন রূপকথার মতো সুবিচারপূর্ণ নয়, বরং জীবন অবিচারের সাগর।

যশোরের হালিমা পারভীনের কাহিনীও কম মারাÍক নয়। ১৯৭১ সালে হালিমা অষ্টম শ্রেণীতে পড়তেন। স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে বড় মানুষ হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার পিতাকে নির্মম প্রহার করে। এ দেখে হালিমার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জন্মায়। তিনি তার পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অস্ত্র তুলে নেন। তারা ৩৫ জন তরুণ-তরুণীর একটি বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং নেন। হালিমা একাধিক অপারেশনে অংশ নেন এবং আর্মি ও রাজাকার হত্যা করেন। একটা পর্যায়ে স্থানীয় দালালরা খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তারা ঘেরাও হয়ে যান। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা দেন এজন্য যে, নইলে অনেক গ্রামবাসীও মারা পড়ত। তাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সামনেই সব পুুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। হালিমার সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন ফাতেমা ও রোকেয়া নামের আরো দু’জন নারী যো। হালিমার ভাষায় : যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমরা আরো হাজার হাজার নারীকে বন্দি থাকতে দেখি… তাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজ হাতে তাদের কবর খুঁড়তে হতো।… বাড়ি ফেরার পর আমি বুঝলাম আমার যুদ্ধ শেষ হয়নি। যদিও যশোর স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমি স্বাধীন হইনি। আমার যুদ্ধ যেন নতুন করে শুরু হলো। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আমার নিজ মানুষদের সঙ্গে, আমার নিজের দেশের সঙ্গে যাদের জন্য আমি যুদ্ধ করেছি, যাদের জন্য আমি সব হারিয়েছি। আমার যুদ্ধ এখনো চলছে (ওমেন ইন ফ্রন্টাল ওয়ার: শাহীন আফরোজ, ২০০৫)। হালিমা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধের মধ্যে বন্দি হন। কিন্তু তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠে নাই, উঠেছে বীরাঙ্গনার খাতায়। এই ছিল তার পুরষ্কার! হালিমা ছোটবেলায় চেয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন। সেই সাধ অর্ধেক পূরণ হয়েছে। তিনি ডাক্তার হতে পারেননি, অনেক কষ্টে সিভিল সার্জন অফিসের আয়া হতে পেরেছেন।

মধুমিতা বা হালিমার কণ্ঠ আরো অনেক বাংলাদেশি মেয়ের মতো। সেই কণ্ঠ নির্যাতিতের কণ্ঠ। যোদ্ধা হওয়া বা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের গর্বের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে তার সর্বনাশের ইতিহাস। তারা ছিল পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের দেশিয় দোসরদের কাছে ‘শত্রু শরীর’। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের শরীর হলো `নাপাক’। জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম এখানে একাকার হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা তাদের দেশ ও জাতি রক্ষার নামে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, ফেলে গেছে পুড়ে মরার জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের জীবন জ্যান্ত মরা’র থেকে বেশি কিছু হয়নি। এটা এমন এক দেশ যেখানে ধর্ষিতা নারী তা একাত্তরেরই হোক বা পরেরই হোক, সবক্ষেত্রে তারা বিচার পায় না, প্রায় নিরানব্বই জন নির্যাতিত নারীকে সামাজিকভাবে অমর্যাদাই করা হয়। জাতির জীবনে ধর্ষণ এত বড় দাগ রেখে গেলেও এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে আজো নারী নির্যাতিত হয়। আজো নির্যাতিত হওয়ার দায় নির্যাতক পুরুষের চেয়ে নারীকেই বেশি বহন করতে হয়। একাত্তরের নারী নির্যাতনের বিষয়টি যদি আমরা খোলা চোখে দেখতে পারতাম, রাষ্ট্রীয় ভাবে যদি তাদের সত্যিকার মর্যাদা দিয়ে পুনপ্রতিষ্ঠা করতে পারতাম তাহলে হয়তো নির্যাতিতকে হেয় চোখে দেখার এই অমানবিক চল এদেশ থেকে বিলুপ্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি।

তাই মধুমিতাদের গায়ের পোড়া মাংসের ঘ্রাণ আমাদের নাকে লাগে না। তাদের যন্ত্রণাও আমরা টের পাই না। আমরা তাদের ফেলে এসেছি দূর অতীতে_ কখনোই না ফুরানো একাকীত্বের মধ্যে, যেখানে তাদের স্মৃতি, ভয়, উদ্বেগ অথবা আশার কোনো অংশীদার নেই। তারা একাকী যন্ত্রনাভোগের সেই অনন্ত ব্যথার রাজ্যে বন্দী। আজো তাদের ‘…ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’।

পরিশিষ্ট : এটি বছর তিনেক আগের একই বিষয়ের লেখার বর্ধিত সংস্করণ।

একাত্তরের পর মাঠে-ঘাট পড়ে থাকতে কিংবা নদীতে ভেসে আসতে দেখা যেত এরকম অনেক বীরাঙ্গনার লাশ।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

45 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
45
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.