লোকটা ডাকাত সর্দার, ময়মনসিংহ অঞ্চলের একদার যাত্রার হিরো। শেষ তাকে দেখি ঢাকা জেলখানার হাজতিদের ওয়ার্ডের পাহারার দায়িত্বে। আমরা তার অধীন ছিলাম। তার প্রাণে গান ছিল এবং তার যাবজ্জীবন হয়েছিল। ডাকু রমজানের জন্যই রাতটা মাঝেমধ্যে রঙ্গিন হয়। অ্যালুমিনিয়ামের থালায় আঙুল ঠুকে গান গাওয়া ছিল তার রাতের মেরাজ। চোখ বন্ধ করে গাইতে গাইতে সে লুপ্ত হতো নিজের মধ্যে। কোনোদিন সে গাইতো মৈমনসিংহ গীতিকার 'আলোমতি ফুলকুমার' থেকে, 'রাজার ফুল বাগানে যাই, একটু হাঁটিয়া বেড়াই....আমার মনে শান্তি নাই।' গাইতো, 'বন্ধু থাকো, বন্ধু থাকো, বন্ধু থাকো আমার সনে বন্ধু থাকো ও বন্ধু থাকো বন্ধু থাকো তোমার ঢংয়ে।' আবার কোনোদিন গাইতো এই বিষন্ন ব্যালাড, 'যে আমারে আদর করে রে, নাম রাইখ্যাছে আদরিণী আমি কী তার আদর জানি-ই-ই-ই...' যার অর্থ আমার নাম, তার নাম কী তা আমি জানি? আত্মপ্রেমে 'আমি' মাত হয়ে থাকি, কিন্তু আমার 'আত্ম' কী তা কি আমি জানি? তাহলে কার জন্য 'আমি' প্রাণপাত করি? একদা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ৩২ নং খাতা ওয়ার্ডের সর্দার রমজান ডাকাত এই সমস্যায় জাগ্রত হতো; আমি আজ সেই সমস্যায় লুপ্ত।
বিরাট মাঠের পারে বাড়ি। বছরে কয়েকবার সেই মাঠে খুনোখুনি লড়াই হয়। প্রথম ভয় সেই বাড়িতে। একদিকে নিকষ বাঁশঝাড়, আরেকদিকে গাছগাছালি ভরা অন্ধকার, আরেকদিকে কয়েক ঘর প্রতিবেশী। বিরাট উঠানের পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেওয়ালে সন্ধ্যা হলেই ছায়াদের নড়াচড়া দেখতাম। দেখতাম আর বুকে থম ধরে যেত। কাউকে বোঝানো যেত না সেই ভয়। বয়স বেড়েছে দিনে দিনে, ছায়ারাও আসে না আর। তাদের আমি রেখে এসেছি শৈশবের সেই কুহককাতর জগতে।
আমার ভয়, আমার রোমাঞ্চ, আমার দুঃসাহসসকল নিয়ে আমি আমার সাঁই -- আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। বিরাট মাঠের পারে বাড়ি। বছরে কয়েকবার সেই মাঠে খুনোখুনি লড়াই হয়। প্রথম ভয় সেই বাড়িতে। একদিকে নিকষ বাঁশঝাড়, আরেকদিকে গাছগাছালি ভরা অন্ধকার, আরেকদিকে কয়েক ঘর প্রতিবেশী। বিরাট উঠানের পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেওয়ালে সন্ধ্যা হলেই ছায়াদের নড়াচড়া দেখতাম। দেখতাম আর বুকে থম ধরে যেত। কাউকে বোঝানো যেত না সেই ভয়। বয়স বেড়েছে দিনে দিনে, ছায়ারাও আসে না আর। তাদের আমি রেখে এসেছি শৈশবের সেই কুহককাতর জগতে। কিন্তু নিয়তির দেয়ালে কিসের যেন ঝলক দেখি, দেখি অন্তিম ভয় হয়ে নাচে সেইসব কৃষ্ণমূর্তি। প্রথম দুঃসাহস ছিল একটি অন্ধ ও মৃত কূপ। দুভাই মিলে কীসের যেন টানে ঝুঁকে, তার ভেতরে তাকাতাম। অনেক আগে ওখানে লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তলার অন্ধকারের দিকে তাকানোর রোমাঞ্চ আজো শিরার লহু চঞ্চল করে তোলে। রাত নামলে পড়োভিটার গহ্বর থেকে নিশাচর যেমন মুখ বাড়ায়, তেমনি বাস্তবের খোপ খুলে পরাবাস্তব রোমাঞ্চের জগতে উঁকি দিয়ে আসি। অন্ধকূপের মতো তারও টান শিহরিত করে, রোমাঞ্চভূক পতঙ্গ হয়ে মনে হয় ঝাঁপ দিই তার ইশারায়। প্রথম দুঃস্বপ্ন এসেছিল দরবেশের বেশে। আশ্বিনের ‘বিকেলের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতোন’ জ্বর আসতো শীত আসি-আসি করা বিকেলে। অসুখের জানালায় বসে আমি দেখি ঘুমন্ত ইঁদারা, পারদে ভাসন্ত চোখ। তারাদের চোখের হিম কুশের মতো এসে বেঁধে মনে। পরম বন্ধুর মতো ঘুম আসে, স্বপ্ন আসে। দেখি আমার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কালো মানুষটির পরনে গৈরিক, মাথার মাথালও গেরুয়া, বুকের 'পরে ভোরের মতো আলো-আঁধারি দাড়ি। আধখোলা জানালা দিয়ে আমরা চোখে চোখে তাকিয়ে থাকি। তাঁর মুখে অদ্ভুত হাসি ভাসে। কণ্ঠে স্নেহ ঝরিয়ে বলেন, ‘নাহ্ থাক, ঘুমাক’। ঘুমের মধ্যে টের পাই বুকের পরে শ্বাস ফেলে চলে গেলেন তিনি। বোবা ধরার অবোধ কষ্টে আমি গোঁ গোঁ করতে থাকি। অনেক বার তিনি এসেছেন। অনেক কাল হলো তিনি আর আসেন না। বোবা ধরা স্বপ্ন আসে মাঝে মাঝে। রাতভর বৃষ্টি যখন, তপ্ত শরীর হিমে পোড়ে যখন, কোথাও বোবায় ধরা কুকুর করুণ আর্তনাদ করে যখন, আমি বুঝি এমন কোনো রাতেই তিনি আবার আসবেন। আমার ভয়, আমার রোমাঞ্চ, আমার দুঃসাহসসকল নিয়ে আমি আমার সাঁই_তাঁর…