আমার সাঁই — আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করি।

বিরাট মাঠের পারে বাড়ি। বছরে কয়েকবার সেই মাঠে খুনোখুনি লড়াই হয়। প্রথম ভয় সেই বাড়িতে। একদিকে নিকষ বাঁশঝাড়, আরেকদিকে গাছগাছালি ভরা অন্ধকার, আরেকদিকে কয়েক ঘর প্রতিবেশী। বিরাট উঠানের পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেওয়ালে সন্ধ্যা হলেই ছায়াদের নড়াচড়া দেখতাম। দেখতাম আর বুকে থম ধরে যেত। কাউকে বোঝানো যেত না সেই ভয়। বয়স বেড়েছে দিনে দিনে, ছায়ারাও আসে না আর। তাদের আমি রেখে এসেছি শৈশবের সেই কুহককাতর জগতে।

আমার ভয়, আমার রোমাঞ্চ, আমার দুঃসাহসসকল নিয়ে আমি আমার সাঁই — আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করি।

বিরাট মাঠের পারে বাড়ি। বছরে কয়েকবার সেই মাঠে খুনোখুনি লড়াই হয়। প্রথম ভয় সেই বাড়িতে। একদিকে নিকষ বাঁশঝাড়, আরেকদিকে গাছগাছালি ভরা অন্ধকার, আরেকদিকে কয়েক ঘর প্রতিবেশী। বিরাট উঠানের পরে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই দেওয়ালে সন্ধ্যা হলেই ছায়াদের নড়াচড়া দেখতাম। দেখতাম আর বুকে থম ধরে যেত। কাউকে বোঝানো যেত না সেই ভয়। বয়স বেড়েছে দিনে দিনে, ছায়ারাও আসে না আর। তাদের আমি রেখে এসেছি শৈশবের সেই কুহককাতর জগতে। কিন্তু নিয়তির দেয়ালে কিসের যেন ঝলক দেখি, দেখি অন্তিম ভয় হয়ে নাচে সেইসব কৃষ্ণমূর্তি।

প্রথম দুঃসাহস ছিল একটি অন্ধ ও মৃত কূপ। দুভাই মিলে কীসের যেন টানে ঝুঁকে, তার ভেতরে তাকাতাম। অনেক আগে ওখানে লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তলার অন্ধকারের দিকে তাকানোর রোমাঞ্চ আজো শিরার লহু চঞ্চল করে তোলে। রাত নামলে পড়োভিটার গহ্বর থেকে নিশাচর যেমন মুখ বাড়ায়, তেমনি বাস্তবের খোপ খুলে পরাবাস্তব রোমাঞ্চের জগতে উঁকি দিয়ে আসি। অন্ধকূপের মতো তারও টান শিহরিত করে, রোমাঞ্চভূক পতঙ্গ হয়ে মনে হয় ঝাঁপ দিই তার ইশারায়।

প্রথম দুঃস্বপ্ন এসেছিল দরবেশের বেশে। আশ্বিনের ‘বিকেলের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতোন’ জ্বর আসতো শীত আসি-আসি করা বিকেলে। অসুখের জানালায় বসে আমি দেখি ঘুমন্ত ইঁদারা, পারদে ভাসন্ত চোখ। তারাদের চোখের হিম কুশের মতো এসে বেঁধে মনে। পরম বন্ধুর মতো ঘুম আসে, স্বপ্ন আসে। দেখি আমার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কালো মানুষটির পরনে গৈরিক, মাথার মাথালও গেরুয়া, বুকের ‘পরে ভোরের মতো আলো-আঁধারি দাড়ি। আধখোলা জানালা দিয়ে আমরা চোখে চোখে তাকিয়ে থাকি।

তাঁর মুখে অদ্ভুত হাসি ভাসে। কণ্ঠে স্নেহ ঝরিয়ে বলেন, ‘নাহ্ থাক, ঘুমাক’।

ঘুমের মধ্যে টের পাই বুকের পরে শ্বাস ফেলে চলে গেলেন তিনি। বোবা ধরার অবোধ কষ্টে আমি গোঁ গোঁ করতে থাকি।
অনেক বার তিনি এসেছেন। অনেক কাল হলো তিনি আর আসেন না। বোবা ধরা স্বপ্ন আসে মাঝে মাঝে। রাতভর বৃষ্টি যখন, তপ্ত শরীর হিমে পোড়ে যখন, কোথাও বোবায় ধরা কুকুর করুণ আর্তনাদ করে যখন, আমি বুঝি এমন কোনো রাতেই তিনি আবার আসবেন। আমার ভয়, আমার রোমাঞ্চ, আমার দুঃসাহসসকল নিয়ে আমি আমার সাঁই_তাঁর জন্য অপেক্ষা করি।

৩.
এ অবধি তিনি আসেননি। জন্ম আর বিবাহ এসেছে একই লগ্নে, অঝোর বৃষ্টির মধ্যে। কন্যা ও তুলার সন্ধিক্ষণে আমি তাহাদের পাই। প্রেম আসে সন্ধি পারায়ে।

জন্মের কথা মনে হলে গর্ভের ঘোলা অন্ধকারের সঙ্গে হলুদ আলোর মেশামেশির দৃশ্য দানা বাঁধে। যেন জল মেশানো ঘন রংদুটি পরস্পরকে গ্রাস করতে চাইছে। গর্ভের অন্ধ ঈশ্বর মাটির দুনিয়ায় সন্তানজন্ম পায় আর নাড়ি কেটে পরমকে হারায়। অথচ অন্ধের চোখ তো ঈশ্বর স্বয়ং। মনের মধ্যে সেই চক্ষু অপলক। তা মলিন দেখে না, সহি দেখে। তা সংসার দেখে না, বিশুদ্ধ প্রেম দেখে। যেন তারই আহ্বান েহে বসুধা, জননীর পিঞ্জর ছাড়িয়ে মায়াবি পর্দা সরিয়ে চলে আসছি তোমার নিকট।ে আর জীবনের চৌকিতে বসিয়ে আমায় তুমি গেছ স্নানে। আর আমার যে একা লাগে! আমি পারি না। উঠোন পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের শীতল ছায়ার নীচে স্নানঘর আমায় টানে।

হাঁটি হাঁটি পায়ে আমি তো তোমার কাছেই যেতে চেয়েছি। উঁকি দিয়েছি দরজার ছোট্ট ফুটোয়। তুমি জানলে না, আয়েশা হয়ে গেলে মা তুমি। অভিশাপ দিলে: জহরে কহরে মরবি। হায় হাসান, হায় নীল জহর! হায় হোসেন, হায় লাল খুন! মা, তুমি দিলে বর, তাই আমি জহরে জহরে নীলকণ্ঠ শিব। তুমি দিলে শাপ, তাই মাটিতে সিজদা রাখা উবু পিঠে ছুরি খেয়ে চলি।

মৃত্যুর লগ্নের কথাও মনে আসে। মনে আসে সইে স্বপ্ন: এক জোড়া পা, অঝোর বর্ষণের সন্ধ্যায় গোড়ালি ডোবা জলা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। সমস্ত আয়ু নিয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিল পথের ধারে। এই পথইে পয়েছে িজনম, পয়েছে িবয়সরে সাথী।
বয়স হারাতে হারাতে আজো আমি সং হয়ে দাঁড়িয়ে আছি সেই পথেরই ধারে। অশ্রু বয়ে যাওয়া খাঁড়ির মুখে উদ্দালক হয়ে বারবার বাঁধ জাগিয়েছি তোমার ঢল থামাব বলে, হে শ্যাম হে মরণ…

এ চোখে নামুক শঙ্খ,
দিগন্তরেখার সব খাঁজ ভরে যাক শ্মশানভষ্মে।
উঠতি আঁধার তখনি দেখে নিক, কার বুকে জমে আছে কতটুকু জল।
জান িনা, কার চোখে কোন অন্ধকার দেখে আলো হতে চেয়েছিল কে?

অকুলের সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছি বর্ষণমুখর সন্ধ্যার গ্রহণলাগা আলাের ছায়ায়।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

19 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
19
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.