পোলিশ চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস্তফ্ জানুসি-র (জ. ১৯৩৯) একটি ছোট গদ্যরচনা পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে। সেই লেখাটির অনুবাদ এখানে তুলে দিচ্ছি।
মত, পালটা মত
অন্যেরা যাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শিল্পী হিসেবে আমার দায়িত্ব। ঐকমত্য পোষণ করা শিল্পীর ধর্ম নয়। দ্বিমত পোষণ করার চেষ্টা থাকা চাই, তাহলেই সন্ধান মিলবে সত্যের। এই বিবেচনা থেকেই তিনটি প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করা হলো।
প্রসঙ্গ ১ : লোকজন যখন সংবিধানকে নির্বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে, তখন আমি ধন্দে পড়ে যাই। সংসদে প্রত্যক্ষ ভোট গ্রহণের মাধ্যমে সংবিধান পাশ হয়। কিন্তু এতে বড়ো রকমের ফাঁক থেকে যেতে পারে কিংবা এর প্রতি কারো শ্রদ্ধাবোধ না থাকতে পারে। আমার জানামতে এমন অনেক দেশ আছে যাদের সংবিধানগুলি খুব চমৎকার কিন্তু সে-সব দেশের বাস্তব পরিস্থিতি ভয়াবহ। সে-কারণেই, আমার দৃষ্টিতে, আইন বা সংবিধান মুখ্য বিষয় নয়। আমি মানব-মনের সত্যিকার শান্তির প্রত্যাশী, এবং সেখানে যদি সামঞ্জস্য থাকে, ভারসাম্য থাকে, তাহলে তা প্রতিফলিত হবে সংবিধানে। কিন্তু এমন অনেক জিনিসকেই স্বতঃসিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় বলে মনে করা হয় যেগুলি আমার দৃষ্টিতে আদৌ তা নয়। কূটনীতি ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষজন দুই রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী সীমারেখাকে অলঙ্ঘনীয় বলে মনে করেন। সীমান্ত জিনিসটা পুরোপুরি কৃত্রিম। তা মানুষের তৈরি এবং বিতর্কযোগ্য। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ বিতর্কের পরিসমাপ্তি হয় যুদ্ধে, যা কোনো সমাধান নয়। সীমান্তকে অলঙ্ঘনীয় বলা তাই অর্থহীন।
প্রসঙ্গ ২ : ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আমার দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রচয়িতার স্বত্ব পরিশোধ করা হলে আমি লাভবান হই। তবে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি আদৌ সংরক্ষিত হওয়া উচিত কি না সে-বিষয়ে নীতিগত অবস্থান থেকে আমি সংশয়ী। আমি জনপ্রিয় হতে চাই, আমি চাই আমার সৃষ্টির পাঠ গ্রহণে আগ্রহী যে-কারোর নাগালের মধ্যে তা পৌঁছে যাক। রাশিয়াতে আমার ফিল্মের পাইরেটেড ক্যাসেট দেখার পর আমার ইচ্ছে করছিল ওই বিক্রেতাদের বুকে জড়িয়ে ধরি, কারণ ছবিগুলিকে ক্রেতাসাধারণের নাগালের মধ্যে আনার জন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চীনে আমার ফিল্মের পাইরেটেড ডিভিডি-র সন্ধান পেয়ে আমি গৌরবান্বিত বোধ করেছি। আমার হয়তো কিছু আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু আনন্দের ভাগটাও তো কম নয়। আমার কাজের ব্যাপারে আগ্রহী যে-কারো কাছে তা সহজলভ্য হবার আকাঙ্ক্ষা এবং এর বিনিময়ে অর্থাগমের লোভ করা — এই দুটি অবস্থান পরস্পরবিরোধী। চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমি পারিশ্রমিক পেয়েছি। সত্যি বলতে কি, নিজের স্বত্বাধিকারের নিরাপত্তা বিধানে উদ্যোগী যে-কোনো বুদ্ধিজীবীই তাঁর প্রাপ্য সম্মানী আগেই পেয়ে গেছেন; এখন আমাদের কাম্য কিছু বাড়তি আয়। এই সমস্যার সমাধান অন্বেষণ আমার অভিপ্রায় নয়। রচনা-স্বত্ব নিয়ে আলোচনার জন্য আয়োজিত বেশ কয়েকটি অধিবেশনে আমি অংশগ্রহণ করেছি; জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজেরবাইজানের মতো গরিব দেশের উপর আমেরিকানদের চাপ প্রয়োগ আমি দেখেছি। স্টিভেন স্পিলবার্গ মনে করেন তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কারণ এসব দেশে তাঁর রচনা-স্বত্বের প্রতি সম্মান দেখানো হয়নি। আবেগগত দিক থেকে আমি আইনের প্রতি পক্ষপাত অনুভব করি না। যে-সব মানুষ বিনে পয়সায় চলচ্চিত্র দেখতে চান আমি তাদেঁরই পক্ষে। তাঁরা আর্থিক সংগতি থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে স্পিলবার্গ খুবই বিত্তবান। কাজেই আমার ন্যায়-ভাবনা আর আমার আইন-ভাবনার মধ্যে সংঘর্ষ তৈরি হয়। একজন শিল্পী হিসেবে এই সমস্যাটাকে চিহ্নিত করার অধিকার আমার আছে।
প্রসঙ্গ ৩ : বৈচিত্র্য একটি জনপ্রিয় ধারণা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ এর অন্তর্ভুক্ত; তবে আমি এই সর্বজনস্বীকৃত ধারণাকে সমর্থন জানাতে অপারগ। এর ত্রুটির দিকটা খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমি আগ্রহী। এ বছর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য নিয়ে পর পর আয়োজিত চারটি আলোচনাসভায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে আমার। এই আলোচনাসভাগুলি প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছে; সব কটি সভাতেই আমি নিজেকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছি — বৈচিত্র্যের সত্যিকার ভালো দিকটা ঠিক কী। অধিকাংশের সমর্থনপুষ্ট কোনো মূল্যবোধ যখন অন্য একটি মূল্যবোধের শ্বাসরোধ করতে চায় তখন আমি বিমর্ষ বোধ করি। মূল্যবোধগুলি বিশ্বজনীন; অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী নিজের মূল্যবোধগুলিকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশে সক্ষম হলে, আমি চাইব সেগুলি সংরক্ষিত হোক। আমি বরং মূল্যবোধগুলি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী, বৈচিত্র্য নিয়ে নয়; কারণ আমাকে তা টেনে নিয়ে যাবে সুপারমার্কেটের দিকে। আমি যখন একটি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি টুথপেস্ট হাতে নিই, তখন কি এ কারণে সুখী বোধ করি যে, আরো অজস্র প্রতিষ্ঠানের তৈরি টুথপেস্ট বাজারে আছে? আমার দরকার একটা ভালো টুথপেস্ট, পঞ্চাশটা থেকে একটা বেছে নিতে আমি চাই না; কারণ কত করমের টুথপেস্ট আজকাল তৈরি হচ্ছে তাতে আমার কিছু এসে যায় না। এই হলো বৈচিত্র্য। আমার এ নিয়ে কিছু সংশয় আছে। আমি মনে করি সত্যিকার মূল্যবোধের কথা বিবেচনায় রেখেই আমাদের বৈচিত্র্যে সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত; যদি তার সন্ধান মেলে, সেক্ষেত্রে আমাদের জানা থাকবে আমরা কী নিয়ে কথা বলছি। কেবল সংরক্ষণের খাতিরেই কোনো কিছুকে সংরক্ষণ করার মানে নেই; অনেক নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে কিছু খারাপ উপাদানও থাকতে পারে, সেগুলোকেও কি তাহলে সংরক্ষণ করতে হবে? অপরিহার্যত নয়, সব ক্ষেত্রেই নয়। সেগুলির ভিন্নতার কারণেই কি সে-সব সংরক্ষণ করতে হবে, না কি আমাদের উচিত তাদেরকে অধিকতর মানবিক একটি সমাজে রূপান্তর লাভে সহায়তা করা? শিল্পী হিসেবে আমি সবসময়েই মুদ্রার অপরপিঠকেও গোচরে আনতে চাই এটাই বোঝার জন্য যে, কোনো সরল সত্যই নিরঙ্কুশ নয়। এটা ভয়ানক রকমের বিপদ ডেকে আনতে পারে, আর এভাবেই তা ভাবাদর্শে রূপ নেয়। আমি চল্লিশ বছর ধরে বসবাস করেছি একটি ভাবাদর্শ-নির্ভর রাষ্ট্রে। সে-কারণেই যে-কোনো ভাবাদর্শিক প্রচেষ্টার ব্যাপারেই আমি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে থাকি।
একজন সামান্য পাঠক।