অধুনাবিস্মৃত এক কৃতী বাঙালির জন্মশতবর্ষে

দুই বঙ্গের কয়েকটি বিদ্যায়তনে এ বছর একযোগে উদ্‌যাপিত হতে পারত এক কৃতী ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রীর জন্মদিন, যিনি জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, বেঁচে থাকলে আজ যাঁর বয়স হতো একশো বছর। [...]

দুই বঙ্গের কয়েকটি বিদ্যায়তনে এ বছর একযোগে উদ্‌যাপিত হতে পারত এক কৃতী ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রীর জন্মদিন, যিনি জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, বেঁচে থাকলে আজ যাঁর বয়স হতো একশো বছর। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৯ মে; তার পরদিন কলকাতার কোনো-না-কোনো দৈনিকে নিশ্চয়ই সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে তাঁর কোনো ছবিও কি ছাপা হয়েছিল? হয়তো হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ – এই বাইশ বছরে তাঁর কোনো ছবি যেমন আমরা দেখিনি, তাঁর জীবন নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা হতেও শুনিনি; কিংবা কোথাও তা হয়ে থাকলেও সে-খবর জানতে পারিনি আমরা।

আমাদের অনেকের কাছেই তাঁর একমাত্র পরিচয় – তিনি অনুবাদক। তাঁর অনুবাদে মাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি পড়েননি এমন পাঠক আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে বিরল। তাঁর অনুবাদের তালিকায় আছে নানা ভাষার আরো সব কালজয়ী গ্রন্থ, যার মধ্যে অনেকগুলিই হয়তো এখন আর ছাপা নেই। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৌলিক রচনা ও অনুবাদকর্মের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকাও আমাদের হাতে নেই।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, জি এই হাবীব সম্পাদিত অনুবাদ পত্রিকা তরজমা-র প্রথম সংখ্যাটি তাঁর ও বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করার অন্য কোনো আয়োজনের খবর যেমন আমাদের জানা নেই, তেমনি জানা নেই তাঁর জীবন সম্পকে পর্যাপ্ত তথ্যও। তাঁর কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাচ্ছি সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান-এর প্রথম খণ্ডে (সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৪) :

পুষ্পময়ী বসু। মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ। পিতা : হরিচরণ বসু। আদর্শবাদী শিক্ষাব্রতী, সুলেখিকা ও নিষ্ঠাবতী সমাজসেবী। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের কৃতী ছাত্রী ছিলেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী দেশনেত্রীদের সংস্পর্শে এসে ঢাকার গ্রামে গ্রামে স্বদেশী প্রচারের কাজ করেন। বেথুন কলেজে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পড়তেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. পরীক্ষায় মহিলা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ. পাশ করেন। রাজশাহীর পি.এন. স্কুলে তাঁর কর্মজীবন শুরু। স্বদেশসেবী তরুণ-তরুণীদের আশ্রয়দানের কারণে রাজরোষে পড়ে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদ ছেড়ে কিছুদিন মোরাদাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারিবারিক কারণে কলিকাতায় চলে আসেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বহরমপুরের কাশীশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হয়ে তার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে দাঙ্গায় বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধীজির অবস্থানকালে তিনিও সেখানে দু-মাস কাটিয়েছেন। শিক্ষক আন্দোলনে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে একসময় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। পারিবারিক কারণে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বহরমপুর ছেড়ে তিনি কলিকাতায় আসেন। এখানে বালীগঞ্জ শিক্ষাসদনে প্রধান শিক্ষিকার পদে কর্মরত থাকেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণের পরও রেক্টর হিসেবে আরো কিছুদিন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, জাদুঘর, বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি, প্রেক্ষাগৃহ সবই তাঁর প্রয়াসে ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। একজন দক্ষ শিক্ষিকা হিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম ভারতীয় মহিলা প্রতিনিধিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। পরে একাধিকবার সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ, বার্মা ও চীন ভ্রমণ করেন। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মহিলা সংসদের প্রথম ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনেরও তিনি প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এছাড়া ভারতীয় শিশু আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেন। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ : গুড আর্থ, মাদার, কুলি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি, জাঁ ক্রিস্তফ, মন্নাভান্না, পেট্রিয়ট, স্পার্টাকাস, লু সুন-এর প্রবন্ধাবলী প্রভৃতি। জীবনপ্রেমী তিনি অনাসক্ত, নির্মোহ এক দর্শনের অধিকারী ছিলেন। বালীগঞ্জ শিক্ষাসদন থেকে পাওয়া গ্র্যাচুইটির সমস্ত টাকা তিনি ঐ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের কল্যাণ তহবিল গঠনে দান করেন। তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়কে দিয়েছেন তাঁর মায়ের নামে ‘সরোজিনী বসু’ প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য।
. . .

আসুন, মুক্তাঙ্গন-এর এই সীমিত পরিসরে হলেও সবাই মিলে স্মরণ করি এই পরহিতৈষী, শিক্ষাব্রতী, আমাদের প্রিয় অনুবাদক, পুষ্পময়ী বসুকে।

পুষ্পময়ী বসু (১৯০৮-১৯৮৬)

রেজাউল করিম সুমন

একজন সামান্য পাঠক।

১১ comments

  1. ঈশিতা - ২২ ডিসেম্বর ২০০৮ (৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ)

    ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৮:০৬ অপরাহ্ণ)

      ধন্যবাদ।

  2. ইমতিয়ার - ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ (৬:১৫ অপরাহ্ণ)

    রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ জন্মশতবার্ষিকীতে পুষ্পময়ী বসুকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে। তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, অথচ তিনিই গোর্কীর মা-কে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন!
    আমার যতদূর মনে পড়ছে বাংলা একাডেমী-র যে চরিতাবিধান (এখন সম্ভবত সংস্করণ শেষ এবং বাজারে পাওয়া যায় না) রয়েছে, তাতেও তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ছিল। তরজমা-য় তাঁকে নিয়ে কারা লিখেছেন, কীভাবে সংখ্যাটি বিন্যস্ত হয়েছে, সেটি যদি সুমন সময় সুযোগমতো যোগ করেন তা হলে অনলাইনের পাঠকরা উপকৃত হবেন।
    আর যারা এখনও এ্যাকটিভিস্ট তারা বোধকরি একটু বড় কলেবরেই চিন্তা করতে পারেন। এখনও কোনও কোনও প্রকাশক আছেন যারা জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক কিছু করেন। পুষ্পময়ী-র একটি অনুবাদ ও রচনাসমগ্র যোগ স্মারকগ্রন্থ তাঁর লেখা ও চিন্তাকে এক মলাটে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারে। যদিও এইসব বই এখন সংগ্রহ করা কঠিন কাজই বটে।
    মুক্তাঙ্গনকে এবং সুমনের কাছে আবারও কৃতজ্ঞতা, তাঁকে মনে করিয়ে দেয়াতে।

    • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (১০:০৬ অপরাহ্ণ)

      অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, জি এই হাবীব সম্পাদিত অনুবাদ পত্রিকা তরজমা-র প্রথম সংখ্যাটি তাঁর ও বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করার অন্য কোনো আয়োজনের খবর […] আমাদের জানা নেই […]।

      আমার এই কথা থেকে মনে হতে পারে যে, তরজমা-য় পুষ্পময়ী বসুকে নিয়ে লেখা আছে। না, বুদ্ধদেব বসু ও পুষ্পময়ী বসুর জন্মশতবর্ষে পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি এ দু’জনকে উৎসর্গ করা হয়েছে, তবে তাঁদের নিয়ে কোনো লেখা এখানে নেই। তরজমা সম্পর্কে শিগগিরই একটি আলাদা পোস্ট লেখার ইচ্ছে রইল।

      সম্পাদক জি এইচ হাবীবের কাছে শুনেছি, পত্রিকার উৎসর্গপত্র পড়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানতে চেয়েছেন, পুষ্পময়ী বসু গোর্কির মা ছাড়া আর কোন্ কোন্ বই অনুবাদ করেছেন?

      পুষ্পময়ী বসু অনূদিত মা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে, কলকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সী থেকে। সে-বছরই কলকাতার ভারতী লাইব্রেরী থেকে বেরিয়েছিল ওই একই উপন্যাসের অশোক গুহ-কৃত অনুবাদ। এ দুটিই বাংলায় মা-র প্রথম দুটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। (ভাগ্যক্রমে পুরোনো বইয়ের দোকানে দুটি বইয়েরই প্রথম সংস্করণ পেয়ে গিয়েছিলাম!) এর আগেও মা উপন্যাসের বঙ্গানুবাদ হয়েছে, তবে সেগুলি ছিল সংক্ষেপিত অনুবাদ।

      মাহবুবুল হকের মাক্সিম গোর্কির ‘মা’ (প্রতীক, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৯, প্রতীক সংস্করণ : ২০০৪) বইয়ের ৩২-৩৩ পৃষ্ঠায় পাচ্ছি:

      রুশ তথ্য অনুসারে ১৯৩৮-৫৫ সালের মধ্যে ভারতবর্ষে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাতেই উপন্যাসটির ৮টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এছাড়া হিন্দিতে ৫টি এবং উর্দুতে ২টি সংস্করণও প্রকাশিত হয়।
      বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র রূপে প্রকাশিত সাপ্তাহিক লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে মা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত বাংলা রূপান্তর প্রথম ধারাবাহিকভাবে [sic.] প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি অনুবাদকর্ম অব্যাহত রাখতে না পারায় কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন সুরেশ বিশ্বাস। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ পরে আত্মশক্তি পত্রিকায় বন্দেমাতরম শিরোনামে গোর্কির মা উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ করেন। তা ১৯২৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। মুখবন্ধে তিনি লেখেন :

      ‘Mother এক দিক দিয়া জগতের নির্যাতিত মানবতার গদ্যকাব্য — আর এক দিয়া বিগত যুগের রুষিয়ার সামাজিক বিপ্লবের অন্তরের কাহিনী। এ কাহিনীর নায়ক-নায়িকারা সবাই অতি সামান্য মানুষ — কুলী, মুটে, মজুর, নিরন্ন ছাত্র …।’

      মা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ লাঙলআত্মশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও গ্রন্থাকারে তা ১৯৩৩-এর আগে প্রকাশিত হয় নি। ১৯৩৩ সালে মা-র দুটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অনূদিত মা প্রকাশিত হয় গুপ্ত ফ্রেন্ডস প্রকাশনী, কলকাতা থেকে এবং বিমল সেন অনূদিত মা প্রকাশিত হয় বর্মণ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা থেকে। বিমল সেনের অনুবাদের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। ১৯৫৪ সালে গ্রন্থাকারে মা-এর আরো দুটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পুষ্পময়ী বসু অনূদিত মা প্রকাশ করেন ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, কলকাতা এবং অশোক গুহ অনূদিত মা প্রকাশ করেন ভারতী লাইব্রেরী, কলকাতা। পুষ্পময়ী বসু অনূদিত মা ১৯৬২ সালে বিদেশী ভাষা প্রকাশালয়, মস্কো থেকে নতুন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকেও পুষ্পময়ী বসু অনূদিত মা-এর আর একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় মা উপন্যাসের কয়েকটি কিশোর সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটদের মা (শিশু সাহিত্য সংঘ, কলকাতা, ১৯৪৬), নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় রূপান্তরিত ছোটদের মা (দীপায়ন, কলকাতা, ১৯৫৩), বিমল দত্ত রূপান্তরিত মাদার (দেব সাহিত্য কুটির, কলকাতা, ১৯৭৭), মোজাম্মেল হোসেন রূপান্তরিত মা (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৯)।

      আমরা জানি, মস্কোর বিদেশী ভাষা প্রকাশালয়-ই পরে প্রগ্রেস পাবলিশার্স (প্রগতি প্রকাশন) নামে জগদ্বিখ্যাত হয়। আর পুষ্পময়ী বসু অনূদিত মা-র ‘রাদুগা’-সংস্করণটি মূল রুশ পাঠের সঙ্গে মিলিয়ে সম্পাদনা করেছিলেন অরুণ সোম।

      পুষ্পময়ী বসুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন ও সেই সঙ্গে এ উপলক্ষে একটি স্মারক সংকলন প্রকাশ করা গেলে সত্যিই খুব ভালো হয়। সে-সংকলনে আমরা পেতে চাইব : তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনপঞ্জি ও রচনাপঞ্জি, নির্বাচিত রচনা ও অনুবাদ, সে-সবের মূল্যায়ন এবং তাঁকে নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণ ইত্যাদি। ইমতিয়ার ভাই, আপনার মতো আমরাও এই স্বপ্ন দেখি।

    • রণদীপম বসু - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৭:০৫ অপরাহ্ণ)

      ইমতিয়ার ভাই, আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরে আমি ‘বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ দ্বিতীয় সংস্করণ’টি হাতে নিয়ে আশাহত হলাম ! দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই সত্যি যে পুষ্পময়ী বসু’কে জায়গা দেয়ার মতো উদারতা বাংলা একাডেমী দেখায় নি। হয়তো আমাদের মতো একাডেমীও তাঁকে ভুলে গেছে। অথচ কী আশ্চর্য, ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’ কে আমরা মনে রাখলেও পুষ্পময়ীকে ঠিকই ভুলে গেছি !
      ধন্যবাদ রেজাউল করিম সুমন’কে একটা জুৎসই লজ্জা আমাদের হাতে ধরিয়ে দেবার জন্য ! হা হা হা !

      • রেজাউল করিম সুমন - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৮:২১ অপরাহ্ণ)

        বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান আমার সংগ্রহে নেই। এ বইটা দেখার জন্য এক শিক্ষকের বাসায় যাবার কথা ভাবছিলাম। আপনি আমার শ্রমলাঘব করলেন। আপনাকে ধন্যবাদ ‘সক্রিয়’ অংশগ্রহণের জন্য!

  3. অলকেশ - ২৬ ডিসেম্বর ২০০৮ (৯:৪৪ অপরাহ্ণ)

    দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই সত্যি যে পুষ্পময়ী বসু’কে জায়গা দেয়ার মতো উদারতা বাংলা একাডেমী দেখায় নি।

    “এখানকার একাডেমীগুলো সব ক্লান্ত গর্দভ; মুলো খাওয়া ছাড়া ওগুলোর পক্ষে আর কিছু অসম্ভব”
    – হুমায়ুন আজাদ।

  4. Pingback: মুক্তাঙ্গন | বইপ্রস্থ | মাসুদ করিম

  5. রেজাউল করিম সুমন - ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ (১:৩৫ পূর্বাহ্ণ)

    না, পুরোপুরি বিস্মৃত হননি তিনি! শ্যামলী গুপ্ত সম্পাদিত শতবর্ষের কৃতী বঙ্গনারী (১৯০০-২০০০) (ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০১) বইয়ে অন্তর্ভুক্ত একশো জনের অন্যতম পুষ্পময়ী বসু। এমনকী তাঁর একটি ছবিও ছাপা হয়েছে সেখানে (মূল পোস্টের শেষে সংযোজিত)! বইয়ে সংকলিত পুরো জীবনীটি নীচে উদ্ধৃত হলো :

    আদর্শবাদী শিক্ষাবিদ হিসাবে সুপরিচিত পুষ্পময়ী বসুর জন্ম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা হরিচরণ বসু ছিলেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ির নায়েব, তিনি শিক্ষানুরাগী হিসাবে সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোয় খুব আগ্রহী ছিলেন। পুষ্পময়ীরা চার বোন ও এক ভাই। তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর সেজদি সেই সময়ে বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অল্প বয়সে বিবাহের ফলে তাঁর পড়া বন্ধ হয়ে যায়। সেজদিরই মেয়ে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী করুণা সাহা। পুষ্পময়ী বসুর ভাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্র ছিলেন, কিন্তু শিক্ষারত অবস্থাতেই অসুস্থ হয়ে মারা যান।

    ইডেন হস্টেলে থাকার সময় কংগ্রেস নেত্রী আশালতা সেনের সঙ্গে পুষ্পময়ী বসুর পরিচয় হয়। খদ্দর বিক্রি করা, বিলিতি দ্রব্য বর্জন, পিকেটিং ইত্যাদি কাজে তিনি অংশগ্রহণ করতেন নিয়মিত; সময়টা হল ১৯২২-২৩। কলেজে পড়ার সময়ই বিপ্লবী দেশনেত্রীদের সংস্পর্শে আসেন। ঢাকার গ্রামে গ্রামে স্বদেশী আন্দোলনের প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বি.এ. অনার্সে সংস্কৃতে প্রথম স্থান অধিকার করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। রাজশাহী পি. এন. বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে তাঁর শিক্ষক জীবনের শুরু। স্বদেশী তরুণ তরুণীদের আশ্রয় দেবার অপরাধে সরকারের রোষানলে পড়ে একদিনের নোটিসে স্কুলের চাকরি ছাড়তে তিনি বাধ্য হন। শুধু কলেজ নয়, রাজশাহী শহর ছেড়ে তিনি চলে যেতে বাধ্য হন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। ১৯৩৪ সালে তখনই তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে শান্তিময় রায় প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে। আজীবন তিনি বিপ্লবী আদর্শে অবিচল থেকেছেন। এই সময় তাঁর পরিবারে বিপর্যয় ঘটে। মেজদি পাঁচটি সন্তানসহ পুষ্পময়ীর কাছে চলে আসেন স্বামীর মৃত্যুর পর। স্বভাবতই পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপর এসে পড়ায় তিনি বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যান, যেহেতু ব্রিটিশ রোষানলের স্বীকার [শিকার] ছিলেন তিনি।

    কিছুদিনের জন্য তিনি মোরাদাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৯ সালে পারিবারিক প্রয়োজনে কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে শিক্ষকতার কাজে দমদমের একটি প্রাতঃবিভাগের স্কুলে যোগ দেন। যেহেতু পরিবারের সব দায়দায়িত্ব তাঁর উপরে ছিল, তাই দুপুরবেলায় আবার মাড়োয়ারি বালিকা বিদ্যালয়েও শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বহরমপুর কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদ গ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। প্রধান শিক্ষিকা থাকাকালীন এই বিদ্যালয়ের উন্নতি সাধনে তিনি বহুবিধ কাজ করেছেন। তাঁর পাওয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তিনি ওই বিদ্যালয়ে দান করেন, তাঁর মায়ের নামে ‘সরোজিনী বসু প্রেক্ষাগৃহ’ নির্মাণের জন্য।

    চারের দশকে পুষ্পময়ী ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সঙ্গে যুক্ত হন। ’৪৩-এর মন্বন্তরে ত্রাণের কাজে নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালি দাঙ্গায় গান্ধিজির অবস্থানকালে তিনি ওখানে দু’মাস ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় বালিগঞ্জ শিক্ষাসদন স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরও রেক্টর হিসাবে এই স্কুলের সঙ্গে তিনি কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোত যুক্ত। এখানকার গ্রন্থাগার, যাদুঘর, বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি, প্রেক্ষাগৃহ সবই তাঁর উদ্যোগে এবং প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছে। তিনি একসময় শিক্ষক আন্দোলনে ‘নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি’র সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষক আন্দোলনের কাজে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রায় সব জেলাতেই যেতেন। বামপন্থী শিক্ষা আন্দোলনের ভিত তৈরি করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। শিক্ষিকা হিসাবে উৎকর্ষতার [উৎকর্ষের] জন্য তিনি জাতীয় শিক্ষিকার পুরস্কার লাভ করেন।

    ১৯৫২ সালে বিশ্বনারী সম্মেলনে ভারতীয় মহিলা প্রতিনিধিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৫৪ সালে তিনি ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক মহিলা সংসদেও প্রথম ভারতীয় মহিলা সভানেত্রী হন তিনি। জেনেভায় বিশ্বমাতৃ সম্মেলনেও ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এছাড়াও বহুবার তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, বার্মা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ভারতীয় শিশু আইন প্রণয়নের কমিটি-সদস্য হিসাবেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

    প্রখ্যাক শিক্ষাবিদ, সুলেখিকা পুষ্পময়ী বসু অনুবাদ সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। গুড আর্থ, মাদার ইত্যাদি উপন্যাস, লু সুনের নির্বাচিত গল্প, স্পার্টাকাস, জঁ ক্রিস্তফ, পেট্রিয়ট প্রভৃতি তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কুলী এবং দুটি পাতা একটি কুঁড়ি বই দুটিও তিনি অনুবাদ করেছেন। সমসাময়িক বহু পত্র-পত্রিকায় তাঁর বহু প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছে।

    শিক্ষানুরাগী হিসাবে তিনি তাঁর গ্র্যাচুইটির সমস্ত অর্থ তাঁর স্কুলেরই চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলে দান করেন। শিক্ষানুরাগের পাশাপাশি সমাজসেবার কাজেও তাঁর নিষ্ঠা ছিল অবিচল। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিক্ষা যেখানে পণ্য, সেখানে আদর্শবাদী শিক্ষিকা হিসাবে পুষ্পময়ী বসু এক বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। একদিকে শিক্ষা আন্দোলন এবং অপরদিকে নারী আন্দোলন, দুটি ক্ষেত্রেই তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। বামপন্থী প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ থেকেই পুষ্পময়ী বসু নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য।

    জন্ম : ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮; ময়মনসিংহ
    মৃত্যু : ২৯ মে, ১৯৮৬; কলকাতা।
    পিতা : হরিচরণ বসু।
    মাতা : সরোজিনী বসু।
    শিক্ষা : ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুল, ঢাকা ইডেন কলেজ, বেথুন কলেজ, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়।
    কর্মক্ষেত্র : সাহিত্যচর্চা, শিক্ষকতা, অনুবাদকর্ম ও সমাজসেবা।

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ (৭:০০ অপরাহ্ণ)

      সুমন, তোমাকে অশেষ শুভেচ্ছা ।

  6. Pingback: পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশ, সংগ্রাম ইতিহাসের নয়, অধিকার পারিবারিক নয় | প্রাত্যহিক পাঠ

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.