দুই বঙ্গের কয়েকটি বিদ্যায়তনে এ বছর একযোগে উদ্যাপিত হতে পারত এক কৃতী ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রীর জন্মদিন, যিনি জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, বেঁচে থাকলে আজ যাঁর বয়স হতো একশো বছর। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৯ মে; তার পরদিন কলকাতার কোনো-না-কোনো দৈনিকে নিশ্চয়ই সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে তাঁর কোনো ছবিও কি ছাপা হয়েছিল? হয়তো হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৬ থেকে ২০০৮ – এই বাইশ বছরে তাঁর কোনো ছবি যেমন আমরা দেখিনি, তাঁর জীবন নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা হতেও শুনিনি; কিংবা কোথাও তা হয়ে থাকলেও সে-খবর জানতে পারিনি আমরা।
আমাদের অনেকের কাছেই তাঁর একমাত্র পরিচয় – তিনি অনুবাদক। তাঁর অনুবাদে মাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি পড়েননি এমন পাঠক আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে বিরল। তাঁর অনুবাদের তালিকায় আছে নানা ভাষার আরো সব কালজয়ী গ্রন্থ, যার মধ্যে অনেকগুলিই হয়তো এখন আর ছাপা নেই। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৌলিক রচনা ও অনুবাদকর্মের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকাও আমাদের হাতে নেই।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, জি এই হাবীব সম্পাদিত অনুবাদ পত্রিকা তরজমা-র প্রথম সংখ্যাটি তাঁর ও বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করার অন্য কোনো আয়োজনের খবর যেমন আমাদের জানা নেই, তেমনি জানা নেই তাঁর জীবন সম্পকে পর্যাপ্ত তথ্যও। তাঁর কর্মময় জীবনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাচ্ছি সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান-এর প্রথম খণ্ডে (সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৪) :
পুষ্পময়ী বসু। মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ। পিতা : হরিচরণ বসু। আদর্শবাদী শিক্ষাব্রতী, সুলেখিকা ও নিষ্ঠাবতী সমাজসেবী। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের কৃতী ছাত্রী ছিলেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকার ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী দেশনেত্রীদের সংস্পর্শে এসে ঢাকার গ্রামে গ্রামে স্বদেশী প্রচারের কাজ করেন। বেথুন কলেজে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পড়তেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. পরীক্ষায় মহিলা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ. পাশ করেন। রাজশাহীর পি.এন. স্কুলে তাঁর কর্মজীবন শুরু। স্বদেশসেবী তরুণ-তরুণীদের আশ্রয়দানের কারণে রাজরোষে পড়ে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদ ছেড়ে কিছুদিন মোরাদাবাদ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পারিবারিক কারণে কলিকাতায় চলে আসেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বহরমপুরের কাশীশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হয়ে তার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে দাঙ্গায় বিধ্বস্ত নোয়াখালিতে গান্ধীজির অবস্থানকালে তিনিও সেখানে দু-মাস কাটিয়েছেন। শিক্ষক আন্দোলনে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে একসময় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। পারিবারিক কারণে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বহরমপুর ছেড়ে তিনি কলিকাতায় আসেন। এখানে বালীগঞ্জ শিক্ষাসদনে প্রধান শিক্ষিকার পদে কর্মরত থাকেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণের পরও রেক্টর হিসেবে আরো কিছুদিন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার, জাদুঘর, বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি, প্রেক্ষাগৃহ সবই তাঁর প্রয়াসে ও তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। একজন দক্ষ শিক্ষিকা হিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম ভারতীয় মহিলা প্রতিনিধিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। পরে একাধিকবার সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপ, বার্মা ও চীন ভ্রমণ করেন। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মহিলা সংসদের প্রথম ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনেরও তিনি প্রথম সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এছাড়া ভারতীয় শিশু আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি কাজ করেন। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ : গুড আর্থ, মাদার, কুলি, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি, জাঁ ক্রিস্তফ, মন্নাভান্না, পেট্রিয়ট, স্পার্টাকাস, লু সুন-এর প্রবন্ধাবলী প্রভৃতি। জীবনপ্রেমী তিনি অনাসক্ত, নির্মোহ এক দর্শনের অধিকারী ছিলেন। বালীগঞ্জ শিক্ষাসদন থেকে পাওয়া গ্র্যাচুইটির সমস্ত টাকা তিনি ঐ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের কল্যাণ তহবিল গঠনে দান করেন। তাঁর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়কে দিয়েছেন তাঁর মায়ের নামে ‘সরোজিনী বসু’ প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের জন্য।
. . .
আসুন, মুক্তাঙ্গন-এর এই সীমিত পরিসরে হলেও সবাই মিলে স্মরণ করি এই পরহিতৈষী, শিক্ষাব্রতী, আমাদের প্রিয় অনুবাদক, পুষ্পময়ী বসুকে।
একজন সামান্য পাঠক।