বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম পরাশক্তির সাথে টক্কর লেগেছে ইন্টারনেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের। গত পরশু গুগল তাদের ওয়েবসাইটে ঘোষনা দিয়ে জানিয়েছে যে চীনে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরিবেশ ক্রমাগত বিরূপ হয়ে পড়েছে এবং এই অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই তারা চীন থেকে তল্পি-তল্পা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। গুগল ও চীনের এই সংঘর্ষের কি কোন শুভ পরিণতি আছে?

একটু পেছনে তাকানো যাক। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অথচ গুগল চেনে না, এমন লোক বোধ হয় লাখে একটাও পাওয়া যাবে না। এক কথায় ইন্টারনেটের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বহুলব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিনের নাম হলো গুগল। ১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পিএইচডি অধ্যয়নরত ছাত্র ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন তাদের গবেষণার মাধ্যমে নতুন এক সার্চ এলগোরিদম প্রণয়ন করেন। এর আগে আরো অনেক সার্চ ইঞ্জিনই ছিল। ৯০-এর দশকে যারা নেট ব্যবহার করতেন তাদের অনেকের মনে থাকবে Lycos, Altavista বা Infoseek-এর কথা। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে এইসব ইঞ্জিনের চেয়ে গুগল অনেক বেশী সফল প্রমাণিত হয়।

ইন্টারনেটে রয়েছে শত কোটি ওয়েবসাইট। এর মধ্যে থেকে ঠিক আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটুকুই এক নিমেষের মধ্যে খুঁজে বের করে সেটাকে আপনার সামনে হাজির করা – একেবারে সহজ কাজ নয়। কিন্তু পেজ ও ব্রিন এই দুঃসাধ্য কাজটিই সাধন করেন। কি লাগবে আপনার? মিটার থেকে ফুট হিসাব করতে চাই? বলে দেবে গুগল। সম্রাট অশোকের রাজধানীর নাম যেন কি ছিল? জানে গুগল। আচ্ছা, কেক বানাতে চাই, কিছু রেসিপি দরকার। গুগলে গিয়ে খোঁজ লাগাও। ১৯৯৯ সালে এক প্রযুক্তি পত্রিকায় আমি প্রথম গুগলের নাম শুনি। লাস ভেগাসে বাৎসরিক প্রযুক্তি সম্মেলনে সদ্য পুরস্কার জিতেছে নতুন এই কম্পানী – ক্রিকেটের গুগলির সাথে নামের বেশ মিল! খবরটা পড়েই আমি গুগলে গিয়ে আমার স্কুল জীবনের এক হারিয়ে যাওয়া সহপাঠীর নাম সার্চ দেই। শুধু এতটুকুই জানতাম যে সে বিদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ঠিকই গুগল এনে দিয়েছিল তার নাম-ধাম, বর্তমানে কোথায় আছে কি করছে, এবং যোগাযোগের ইমেইল। বলা বাহুল্য, সেদিনের পর থেকে আজ অব্দি গুগল বিনা আর কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করার প্রয়োজন বোধ করিনি।

গেল দশ বছরে গুগল আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাইক্রোসফট-কে ছাপিয়ে গুগল বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তি কম্পানী। কোকাকোলা-কে টপকিয়ে গুগল এখন পৃথিবীর এক নম্বর ব্র্যান্ড। গুগল সার্চ ইঞ্জিন ছাড়াও এখন আছে গুগল নিউজ, গুগল ম্যাপস, গুগল ভিডিওস ইত্যাদি। ইয়াহু বা হটমেইল-এর সাথে পাল্লা দিতে এসেছে জিমেইল। ২০০৬ সালে গুগল কিনে নেয় ভিডিও আপলোড সাইট ইউটিউব-কে। দাম পড়ে ১৬৫ কোটি ডলার। (ইউটিউবের আদি প্রতিষ্ঠাতা যেই তিনজন, তাদের একজন বাঙালী ছেলে জাভেদ করিম। গুগল যখন ইউটিউব কিনে নেয়, জাভেদ-ও মেলা টাকা পেয়েছিল – প্রায় সাড়ে ছয় কোটি ডলার।)

সৃষ্টির শুরু থেকেই একটা স্লোগানের জন্য গুগল আলোচনা/সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে আসছে। Don’t be evil – কম্পানীর মূল পাথেয়-গুলোর অন্যতম। এর একটা মানে হলো যে – গুগলের যে বিশাল ক্ষমতা, সেটার যেন জেনে শুনে কোন অপব্যবহার না করা হয়। আর শুধুমাত্র টাকা বা স্বল্পমেয়াদী মুনাফার পেছনে ছুটে কম্পানীর সুনাম বা ভবিষ্যত যেন বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া না হয়।

গুগলের চীন যাত্রা

২০০৬ সালে গুগল একটি চীনা সাইট চালু করে – www.google.cn। এখন সমস্যা হলো যে তথ্যের অবাধ প্রবাহের ব্যাপারে চীনা সরকারের ঘোরতর আপত্তি আছে। সেটা যে কোন মাধ্যমেই হোক না কেন – নিয়ম-শৃংখলা থেকে ইন্টারনেট-ও মওকুফ নয়। উদাহরন স্বরূপ ধরেন ১৯৮৯ সালে বেইজিং-এর তিয়ানানমেন স্কোয়ারে ছাত্র আন্দোলনের কথা। চীনের ভেতরে বসে আপনি এই ঘটনা নিয়ে কোন তথ্য বের করতে পারবেন না ইন্টারনেট থেকে। একইভাবে তাইওয়ানের স্বার্বভৌমত্ব, তিব্বতের স্বাধীনতা, ফালুন গং গোষ্ঠী – এইসব বিষয়ও চীনা ইন্টারনেটে কঠোরভাবে সেন্সর করা হয়।

এমনকি আপাতদৃষ্টিতে বিপজ্জনক নয়, এমন সাইটও চীনে অহরহ ব্যান করা হয়। এর মধ্যে আছে ইন্টারনেটের সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইটগুলোও – যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, ফ্লিকার, উইকিপিডিয়া, ব্লগস্পট, পিকাসা, টুইটার, হটমেইল, জিমেইল এবং www.google.com (যদিও www.google.cn জায়েজ আছে।) এই ব্যাপক আকারের সেন্সরশিপ চালু রাখতে চীনা সরকার যেই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে, তার নাম গোল্ডেন শীল্ড প্রজেক্ট, ২০০৩ সাল থেকে এটি কার্যকর রয়েছে। গ্রেট ওয়াল অফ চায়নার সাথে মিল রেখে রসিকজন এর নাম দিয়েছেন গ্রেট ফায়ারওয়াল অফ চায়না।

২০০৬ সালে গুগল যখন চীনে প্রবেশ করে, তখন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গুগলের মূলমন্ত্র হলো তথ্যের অবাধ প্রবাহ, যেটা চীনা সরকার একেবারেই অনুমোদন করবে না। কিন্তু অন্যদিকে আছে চীনের ১৩০ কোটি লোক – সেই বিশাল বাজার থেকে দূরে থাকাও সমীচীন নয়। সবকিছু মিলিয়ে গুগল সিদ্ধান্ত নেয় যে চীনা সরকার প্রদত্ত নিয়মকানুন মেনে নিয়েই তারা চীনে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ চীনা সরকার যেসব সাইট ব্যান করতে বলবে, যেসব তথ্য সেন্সর করতে বলবে, গুগল সেই অনুযায়ী তাদের সার্চ রেজাল্ট বদলে দিয়ে তারপরেই নেট ব্যবহারকারীদের কাছে পরিবেশন করবে। একটা নোট জুড়ে দেবে নীচে – যে আইনগত কারনে আপনি সম্পূর্ণ সার্চ রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছেন না।

স্বভাবতই এই self-censorship-এর জন্যে গুগল কিছুটা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। প্রধাণ দুই মানবাধিকার সংস্থা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ – উভয়ই গুগলের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে। একদিকে আছে গুগলের স্বপ্রণোদিত স্লোগান Don’t be evil. আবার অন্যদিকে তারাই চীনা সরকারের আদেশ মোতাবেক নানান রকম ঘোমটা-বোরখা দিয়ে নেট সার্চ ঢেকে দিচ্ছে। মানে কথা ও কাজে একটা অসামঞ্জস্য আছে। গুগল তখন যেই যুক্তি দিয়েছিল তার সারকথা হলো যে – আমরা আমাদের নীতির প্রশ্নে পিছ-পা হয়েছি, এটা সত্য। কিন্তু চীন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না থেকে আমরা বরং বিশ্বাস করি যে খন্ডিত/আংশিক গুগল-ও চীনা নেট ব্যবহারকারীদের জন্যে একটা ভালো জিনিস হতে পারে। আর কিছু না হোক, আমরা তথ্যের একটা অল্টারনেটিভ সূত্র দিতে পারছি।

সেই ছিল ২০০৬ সালের কথা। চার বছরে হোয়াংহো নদীতে অনেক জল বয়ে গেছে। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন কারনে গুগল ও চীনা সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপের দিকে গিয়েছে। অবশেষে ১২ তারিখে গুগল তাদের বিবৃতিটি দিল – বললো যে এখন থেকে তারা আর google.cn-এর কোন সার্চ রেজাল্ট অদল-বদল করবে না, কোন প্রকার সেন্সরশিপে যাবে না। এবং এর ফলে যদি চীনা সরকার google.cn বন্ধ করে দেয় এবং চীন থেকে গুগল-কে বিদায় নিতে হয়, তাহলে সেই মাশুল তারা গুণতে রাজী আছে।

একদিকে ইন্টারনেট জগতের এক ভার্চুয়াল শক্তি, অপরদিকে ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির পরাশক্তি চীন। এই লড়াই একদিকে যেমন অসম, অপরদিকে তেমনই অভিনব। এই চূড়ান্ত পরিস্থিতির কিভাবে উদ্ভব হলো, এবং আগামীতে এর ফলাফল কি দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে লেখার ইচ্ছে রইলো এর পরের পর্বে।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

33 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
33
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.