এই লেখার শুরুতেই জানিয়ে দিই, যীশুর এক গালে চড় খেলে আরেক গাল পেতে দেয়ার বিধান মানবার মন নিয়ে এটি লেখা নয়।
যে আপনাকে লাঠি/সড়কি/রাম-দা হাতে মারতে আসে, তাকে লাঠি/সড়কি/রাম-দা হাতেই প্রতিহত করতে হয়, সেটা জেনেই এটা লেখা।
যদি আপনি জানেন আপনাকে লাঠি/সড়কি/রাম-দা দিয়ে প্রতিহত করা হবে, তাহলে আপনার লাঠি/সড়কি/রাম-দা ধরবার পূর্বপ্রস্তুতি থাকতে হবে, অথবা আগেই ভেবে রাখতে হবে, লাঠি/সড়কি/রাম-দা দ্বারা আক্রান্ত হলে আপনার কাছে তার প্রতিবিধান কি।
এইসব আগেই স্বীকার করে নিয়ে আমি কেবল এইটুকু নিয়ে আজকে লিখতে বসেছি, যে, প্রতিবিধান আপনি ভেবে রাখবেন বটে, সেইসাথে আপনাকে এও ভাবতে হবে আপনাকে এই লোকগুলি লাঠি/সড়কি/রাম-দা হাতে মারতে আসছে কেন? এই অসম্ভব ঘৃণার উৎস কি। এর চর্চ্চা কোথায় এবং কতদিনের?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে কোনো সভ্য দেশে দ্বিমত থাকার কথা নয়, উচিতও নয়। কিন্তু যে মানুষগুলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনাই, যারা এখনও ভাতকে ভাত আর মা’কে মা ডাকে, বাসায় গিয়ে বাংলাদেশের কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমায়, সে কেন জামাত-শিবির করে, কেন সে সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিপক্ষে এমন নাছোড়? কেন সে অন্য আর সকল মানুষকে কাফের এবং দিকভ্রান্ত ভাবতে শিখেছে? নারীকে এমন বৈরী চোখে দেখা তাকে কে শিখিয়েছে?
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষাখাতের বিপুল অর্থ ব্যয় হয় বলে আমি জানি। আন্তনগর মহাসড়কগুলিতে কয়েক হাত পর পর আপনি আজকে মাদ্রাসা খুঁজে পাবেন।এই শিক্ষাব্যবস্থায় দেশ-জাতি-জাতীয়তাবাদ-জাতীয় সংগীত ইত্যাদি সমন্বিত আছে কি না এটা না দেখে কেন এই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজের ইচ্ছামতন চলতে দেয়া হয়েছে?
যারা মাদ্রাসায় যায়, তারা কি খায়, কি পরে, কি শেখে, তারা বড়হুজুরের হাতে ধর্ষিত হয় কি না, তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি, তাদের শিক্ষাশেষে গন্তব্য কি এই নিয়ে কেন আমরা ভাবিনি? কেন সরকার ভাবেনাই? মহল্লার একেকটা বাড়ি থেকে একেকদিন খাওয়া পাঠানো হবে, এইরকম হিসাব করে আমরা একটা বিশাল হুজুরশ্রেণী তৈরি করেছি, এই পরান্নপুষ্ট-অশিক্ষিত-পরনির্ভরশীল জাতটা তৈরির আগে আমরা কেউ কেন ভেবে দেখলাম না? যে নিজের ভাষাতেই একটা ‘আউট-বুক’ পড়ে দেখেনাই, জ্ঞানলাভ করতে সুদূর চীনদেশ যাওয়া দূরে থাক, তালাবের ঐ পাড়ের মক্তব অব্দি যে কেবল যেয়ে দেখেছে, তার কাছে আমরা কেন ধর্মশিক্ষার জন্যে-বালামুসিবত কাটানোর জন্যে-দুঃস্বপ্নের অর্থ জানবার জন্যে যাই?
আমরা স্কুল-কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময়, হরলাল রায়ের রচনাবলী পড়বার সময়, টেস্টপেপার সলভ করার সময় কখনো কি মাদ্রাসায় কি পড়ানো হয় তা জানতে পেরেছি? আমরা কেবল জেনেছি- কেউ কেউ মাদ্রাসায় যায়, তারা হতদরিদ্র, তারা বাপে-খেদানো ছেলেমেয়ে, তারা ঘরজ্বালানিয়া ছেলেপুলে বলে তাদের সুমতি হবার আশায় বাপ-মা অতীষ্ট হয়ে মাদ্রাসায় দিয়ে দিয়েছে। তাদের ম্লানমুখ- তাদের শীর্ণশরীর কেবল একঝলক দেখা যেত যখন টিভিতে আটটার সংবাদে ঈদে-চান্দে উন্নতমানের খাদ্য বিতরণের খবর দেখানো হতো। আমরা এদেরকে শিক্ষাসফরে দেখিনাই। আমরা এদেরকে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দেখিনাই। আমরা এদেরকে ঈদের আনন্দমেলায় দেখিনাই। এই ভেদ, এই অনাত্মীয়করণ, এই পংক্তিবিভাজন রাষ্ট্র প্রণয়ন করেছে, আমরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তা দিনের পর দিন প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকার করেছি। প্রকৃতি শূণ্যতা পরিহার করে বলে জানি, প্রকৃতি যে প্রাণী তার বর্মের আড়ালেও নরম শরীর লুকাতে অপারগ, তার হন্তা হিসেবে বর্মভেদী আরেকটি প্রাণী পাঠায়, প্রকৃতি অজেয়র। আমাদের এই ভাবের-চিন্তার-কার্যক্রমের অভাবের সুযোগে এইসব মানুষগুলিকে পালন-পোষণ-তোষণ এবং শুভবুদ্ধিশোষণ করেছে জামাত-শিবির। তার ভাষা জেনেছে- তাকে জামাতের ভাষা শিখিয়েছে, তার স্বপ্ন জেনেছে- তাকে জামাতের স্বপ্নকে নিজের ভাবতে শিখিয়েছে, যে আর্থসামাজিক পংক্তি তার স্বপ্নেরও অধরা- তাকে আয়ত্তাধীন করে দেখিয়েছে। বিনিময়ে তাকে তার বাঙালিয়ানা থেকে গোত্রান্তরিত করে দিয়েছে। আর আমরা ছায়ানটের গান শুনে-একবেলা পান্তা খেয়ে ভেবেছি- বেশ হলো, এই তো আমার বাংলাদেশ, এই আমাদের জাতিসত্তা।
আমরা যার কুশলযাচ্ঞা করিনাই, যার ভালমন্দকে হিসাবের খাতাতেই রাখিনাই, যাকে হিতোপদেশ দিয়ে সময়ের অপচয় করিনাই, যাকে আমার পাশে আসন দেইনাই, সে কি ‘আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর’ বলে শ্বাস ফেলে বেড়াবে? না, সে আরেক আসন খুঁজবে, যেখানে আর কেউ তাকে মান দেয়, তাকে স্বীকার করে, তাকে গণ্য করে সেই স্থান খুঁজবে। আর কারো স্বপ্নকে নিজের বলে জানবে, আর কারো অনুষ্ঠানকে নিজের ভাববে। আমি কবে তাকে স্থান করে দেব, তার আশায় বসে থাকবে না। সেটাই ঘটেছে। আমাদের অজ্ঞানতার সুযোগে, আমাদের অবহেলার সুযোগে আমাদের নিজের দেশের মানুষ অনাত্মীয় হয়ে গেছে, আমরা তার খবরও রাখিনাই। আজকে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবী উঠেছে, এই বিষবৃক্ষের যে এত ঠেসমূল, এত শ্বাসমূল, এত আকর্ষী এতদিন ধরে গজিয়েছে, তার নজরদারী আমরা কেন করিনাই? এত এত মানুষকে দিনের পর দিন মগজধোলাই (রং-রিপু ও ধোলাই) করা হয়েছে- আমরা সেটা এতদিন লক্ষ্য করিনি কেন? দিনের পর দিন তাকে যা শেখানো হয়েছে, যা বিশ্বাস করে সে বেড়ে উঠেছে, যা তাকে পরিচিতি দিয়েছে একটি নামে, তাকে আমার কথায় সে কেন পরিত্যাগ করবে? সে তাই করবে যা বিপন্ন পশু করে, আক্রমণ এবং প্রত্যাঘাত।
এই লোকগুলি এতদিন ধরে যা শিখেছে- তাকে রিভার্স করবার আনলার্ন করাবার উপায় কি? সে উপায় কতদিনের? শুধু প্রতিহত করেই কি এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব? আমাদের প্রস্তুতি কই? আমরা কি টিভি চ্যানেলগুলিকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-গান-কবিতা-ফুটেজ এইসব ক্রমাগত মানুষকে দেখাতে পারতাম না, যাতে মানুষ কোনোমতে তার অতীত ভুলতে না পারে? আমরা কি শিশুদের স্কুলপর্যায় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ঐতিহাসিক স্থানগুলি সম্পর্কে সচেতন করে দিতে পারতাম না? আমরা কি আমাদের সীমিত ধর্মশিক্ষার আলোকেই এই মানুষগুলিকে বোঝাতে সক্ষম হতাম না যে, আমাদের অবস্থান কিসের বিরুদ্ধে? যে যেই ভাষা বোঝে, যে আলোতে পড়তে পারে/হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, তাকে তো সেই আলোতে-সেইভাষাতেই সম্বোধন করতে হবে। একটা উদাহরণ দেই- ধরা যাক আমাদের শ্রদ্ধেয় একজন বিদ্যাসাধক মানুষ বললেন- “মানুষ আল্লাহকে তার মনোমত গড়ে নিয়েছে।” এই কথা নিয়ে ঝড় উঠতে পারে, মুর্তাদ ঘোষণা দেয়া হতে পারে, ফাঁসীর দাবীতে নগর-জনপদ বিকল করে দেয়া যেতে পারে, নিরীহ পথচারীর প্রাণ যেতে পারে। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই তো এর উত্তর দেয়া যেতে পারে- হাদিসে কুদসী থেকেই দেয়া যেতে পারে- “আমি আমার বান্দার ধারনার সহিত রহিয়াছি, বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা পোষণ করে, আমি তাহার সহিত তেমন ব্যবহার করিয়া থাকি।” এ-কথা স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রিয়নবীকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। যে রুশভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না, তার সাথে ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হতে হবে রুশ- ঠিক তেমনি যে নবীরাসুল ছাড়া কিছু বুঝতে শিখেনাই, তাকে বুঝাতে হলে মাধ্যম হতে হবে আপনার ধর্মজ্ঞান-আপনার সহিষ্ণুতা, আপনাকে তার ভাষাতেই তার প্রতিবাদের উত্তর দিতে হবে এবং শুরু থেকেই চেষ্টা করতে হবে যেন আপনার আর তার ভাষায় এমন ভেদ না আসে, তার শিক্ষা যেন তাকে একটি পরমতসহিষ্ণুতার ভিত্তি দেয়। আপনি বিদ্যাভিমান-জাত্যাভিমান নিয়ে নিরুত্তর বসে থাকবেন, আর সাঈদীসাহেব বছরের পর বছর অপার বাচালতার সাথে সত্যমিথ্যা ওয়াজ করে তাকে শোনাতে থাকবেন, এভাবেই তো মানুষ পর হয়ে যেতে থাকবে।
(একই ঘটনা ঘটেছে বাঙালি অভিবাসীদের বেলায়, মূল ভূখন্ডের কেউ তাদেরকে পরম্পরার বাঁধনে বেঁধে রাখেনাই, ভাষা-সাহিত্য-শিল্পের উত্তরাধিকার বঞ্চিত কিছু ভাগ্যান্বেষী মানুষ তাই পাকিস্তানিদের অনুকরণে বিবাহানুষ্ঠান করে, উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের মতো করে সাজগোজ করে আর বাঙালিয়ানাকে জানে হিন্দুয়ানি হিসেবে।)
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের উত্তরাধিকার, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি এর কিছুই আমরা এদের মাথায় রোপণ করার চেষ্টা করি নাই, ঊষর ভূমি আগাছায় ভরে গেছে তাই, জামায়াতে ইসলামি সেই ঊষরভূমিতে যা কিছু দিনের পর দিন রোপণ করেছে, সেচ দিয়েছে- আজকে আমরা সেই কৃষিকাজেরই নমুনা দেখতে পাচ্ছি। দেখে শংকায়-পরিবেদনায় বিকলবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছি।
১২ এপ্রিল, ২০১৩
লন্ডন ইস্ট, ইউ কে
বিপন্ন বিস্ময়ের অন্তর্গত খেলায় ক্লান্ত।
