গল্পগুচ্ছের সাথে আমার পরিচয় বাল্যকালে, নীল কাপড়ে বাঁধাই একখানা মোটা বই, গোড়ার দিকে অরুণদা বলে কে একজন আমার বাবার অগ্রজপ্রতিম ভদ্রলোক বাবার বৌভাতে বইখানা উপহার দিয়েছেন — সেটা বাঁকা বাঁকা হরফে লেখা। অতএব, গল্পগুচ্ছ প্রথমত আমার কাছে ছিল সেই সময়ের চিহ্ন — যখন লোকে বিয়েতে বই উপহার দিত।
আর সবকিছুকে যেমন মা চিনিয়ে দেন — ‘ন’ চেনান, ন-এ নদী চেনান… সেইরকম করে আমাদের মা আমাদের গল্পগুচ্ছ চিনিয়েছিলেন। বাইরে ঝুপঝুপ বৃষ্টি, ঘরের কোণে কোণে অন্ধকার আর এই দেয়াল থেকে ঐ দেয়াল অব্দি দড়ি খাটিয়ে ভেজা শাড়ি-কাপড় মেলে দেয়া, কাপড়ের মাড়-আর্দ্রতা-নীল-গুঁড়োসাবানের গন্ধ ঠাসা সেই ঘরে আমাদের দু’পাশে রেখে আম্মা পড়ে শুনিয়েছিলেন — ‘কাবুলিওয়ালা’ আর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’। ‘হামি সসুরকে মারিবে’ শুনে কত হেসেছিলাম। আর পদ্মাতীরে সেই কদমফুললোলুপ শিশুর করুণ মৃত্যু আমাকে কত যে কাঁদিয়েছিল। সে তো কেবল শুরু, এই পরিজ্ঞানের শুরু যে আমাদের সাহিত্য শিশুর মৃত্যুতে আকীর্ণ (বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, ‘পুঁইমাচা’ কিংবা ‘কিন্নরদল’, রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’, শরৎচন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশাই’), তারপরে আরেকদিন, আম্মার কাছে বসেই পড়া — ‘বলাই’। মনে মনে বলাই যে আমার কী আপন, ঘাসিয়াড়া যেদিন আসে, সেদিন তার ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’, আর আমার বেলায় — যেদিন কাগজওয়ালা আসে, পুরাতন কাগজ-বই-খাতা ওজন করে কিনে নিয়ে যায় — এই বৈশ্য আচার আমার দারুণ অপছন্দ। ঘাসফুলের জন্যে — কন্টিকারির জন্যে বলাইয়ের অপার ভালবাসা আমাকে স্পর্শ করে। তারপরে ক্রমেই ‘ইচ্ছাপূরণ’, ‘অতিথি’ আর ‘ফেল’।
আস্তে আস্তে আমার দাঁত সবল হতে শুরু করেছে তখন, আমি নেড়েচেড়ে দেখছি তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’ — “বউ হাসিয়া বলিল — কার আমার? — বলিয়া শিবনাথের গায়ে হাসিয়া ঢলিয়া পড়িল। শিবনাথ চট করিয়া তাহার মুখে চুম্বন করিয়া বসিল। নান্তি মুখ মুছতে মুছতে বলল — কি রকম ভাত-ভাত গন্ধ তোমার মুখে!…”। এর পরে তারাশঙ্করের ছোটগল্পগুলি, বাংলা সাহিত্যের যা চিরকালীন সম্পদ, ‘অগ্রদানি’, ‘না’, ‘তারিনী মাঝি’ এইসব। কিন্তু গল্পগুচ্ছ সেই রাঙামাটির এবড়োখেবড়ো পথের বাইরে, এ যেন ধ্রুপদ, তার তাল-লয় — তার অবারিত বাক্যপ্রবাহ — তার ঈষৎ শ্লেষ — তার ব্যাজস্তুতি এইসব আমাকে ফেলে কখন সামনে চলে যায়, তার নাগাল মেলে না। এত শব্দ আছে বাংলায়, তাদের এমন রঙিন পরিচ্ছদ, তারা এমনি এসে ভেসে যায়? “মাল্যদান পড়, একটু সহজ ভাষায় লেখা আছে, পড়ে মজা পাবি”। স্ক্রীনপ্লে-র মতো করে লেখা ‘শেষের রাত্রি’ আমার অসম্ভব প্রিয় হয়ে উঠলো, ‘গুপ্তধন’ এর “পায়ে ধরে সাধা/রা নাহি দেয় রাধা” পড়ে আমার বিস্ময় মানে না।
রবীন্দ্রনাথের ‘ঘাটের কথা’, ‘ভিখারিনী’ ইত্যাদিতে বঙ্কিমবাবুর পদচ্ছাপ পাওয়া যায়, ‘দৃষ্টিদান’-এর কুমু যেমন করে স্বামীর স্বেচ্ছাচার মাথা পেতে মেনে নেয়, স্বামীর ডাক্তারিবিদ্যার অহংকারের কাছে নিজের চোখদুটি দান করে আবার সেই দৃষ্টিহীনতার জন্যে সতীনকে মেনে নিতে নিজেকে তৈরি করতে চেষ্টা করে (ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে সেই চেষ্টায় সে ব্যর্থ হয়, তার মুখ থেকে ব্রহ্মশাপের মতো বেরিয়ে আসে অমোঘ অভিশাপ।) তাতে তাকে বঙ্কিমের নায়িকাদের মতোই লাগে — কিন্তু সে ছাঁচ থেকে খুব দ্রুত রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে এসেছিলেন। আসলে ‘দেবী চৌধুরানী’র প্রফুল্ল যেভাবে শেষভাগে শ্বশুরবাড়ির তালপৈঠার ঘাটে বাসনের পাঁজা সাফ করে নিজেকে কৃতার্থ মনে করে, নারীশক্তির সেই দুর্গ্রহ এবং সহাস্য সশ্লেষ অবমাননা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এইখানে মনে পড়ে তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের আরেক কুমুকে, অন্তঃপুরের মেয়ে, বড় সাধারণ, স্বাভাবিক পূজার পিপাসা-প্রণতি-আত্মদানের উপাদানেই তৈরি, সেই মেয়েটির শোবার ঘরে ঢুকে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছেন শ্রদ্ধা পাবার অযোগ্য স্বামী হয়ে উঠেছে শরীর পাবার অযোগ্য। একালেও বিবাহসূত্রে ধর্ষণকে লোকে ধর্ষণ বলে মানতে দ্বিধা করে, সেকালের বিয়ের ঘেরাটোপে শরীর-মনের সর্বৈব ধর্ষণকে রবীন্দ্রনাথ ধর্ষণ বলেই দেখিয়েছেন, স্ত্রী তা কোনো সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করেই ক্ষমা করতে পারেনি। কুমুর মতো সহজ সাধারণ মেয়েও ভেবে ফেলেছে — সংসারে এমন বহুকিছু আছে, যা গর্ভজাত সন্তানের মুখ চেয়েও মানা যায় না। রবীন্দ্রনাথ গর্ভবতী কুমুকে যদিও শেষ দৃশ্যে স্বামীগৃহে ফেরত পাঠান, পাঠক জানতে পায়, এই যাওয়া অগ্যস্তযাত্রা নয়, কুমু ফিরবে।
‘দুর্গেশনন্দিনী’র পাঠানকন্যা আয়েশা যেখানে শেষ হয়েছে, তার পর থেকে তাঁর নায়িকাদের শুরু, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও ‘বিষবৃক্ষ’র কুন্দনন্দিনী বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রোহিনীদের পাপ-প্রায়শ্চিত্ত-ভাগ্যের লিখন-কর্মফল ইত্যাদির জটাজাল থেকে তুলে এনে অপার মানবিকতায় তিনি শুরু করেছিলেন ‘চোখের বালি’র বিনোদিনীকে আঁকা। সংসার করবার — বালিশে কার্পাসের কাজ করবার — খঞ্চাপোশে জলখাবার সাজাবার মানবিক আর্তিসমেত তাকে তুলে এনেছেন একাদশীর অন্ধকার থেকে। যদিও রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথ ‘জীবধাত্রী-জীবপালিনী-আদ্যাশক্তি’ হিসেবে নারীর তর্পণ করতে গিয়ে তার বাহুতে টেনে দিয়েছেন “দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন-দুখানি”, তার পরও তাঁর নায়িকারা চিরপুরাতনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে বাইরের জগৎ আস্বাদ করতে পেরেছে, একবার নয়, বহুবার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রথম দীপটি জ্বালিয়েছে, সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে বেগবান হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের আদরনীয়া কন্যারা ব্যক্তিগত জীবনে-বিবাহে যে দার্ঢ্য দেখাতে অক্ষম হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের নায়কনায়িকারা তা পূরণ করেছেন।
পরে যখন আমি সরসীবালা বসুর লেখা গল্প পড়ি, তাঁর নারীদের চিনি — আমার মনে হয়েছে এইসব ভাগ্য মেনে নেয়া রক্তাল্পতায় ভোগা ভাগ্যহীনার চেয়ে রবীন্দ্রনাথ কত বছর এগিয়েছিলেন — তাঁর কালের চেয়ে — তাঁর কালের প্রথার চেয়ে, ‘প্রতিবেশিনী’তে বিধবাবিবাহ দিয়েছেন, ‘অপরিচিতা’য় পণপ্রথার প্রতি এমন বিদ্রোহ হাজির করেছেন যে তার “জায়গা মেলেনি” কোথাও, ‘পয়লা নম্বর’-এ পুরোহিতের কাছ থেকে পাওয়া স্ত্রীকে বিধাতার হাত থেকে না নিতে পারা স্বামীকে অনিলার ত্যাগ এবং প্রণয়ীকে চিঠি “আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করো না। করলেও খোঁজ পাবে না” যেন রীতিমত বিচারের বাণী, ‘মানভঞ্জন’-এর পরস্ত্রীকাতর স্বামীর প্রতি গিরিবালার দারুণ প্রতিশোধ, ‘স্ত্রীর পত্র’-এর “তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন, মৃণাল”কে কে ভুলতে পারে, ‘ত্যাগ’-এর “তবে তুই শুদ্ধ দূর হইয়া যা”-এর সাথে আমাদের কতকালের কলুষ শুদ্ধু দূর হইয়া যায়, ‘দেনা-পাওনা’র নিরুপমা সরোষে জিজ্ঞেস করে “আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম…”, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’তে আবারও পিতার জাত্যাভিমান আর পণলিপ্সার বিপরীতে আধুনিক পুরুষের ভূমিকা… সমাজপিঞ্জরে নারীর অবস্থানসচেতন ‘বিচারক’-এর নিজ যৌবনের স্খলন-ইতিহাসের হাতেই অসামান্য বিচারলাভ… এইসবই একে একে হাজির হয়েছে এমন সহজাত দুষ্ট পোনি-ঘোড়ার মতো অসীম তেজে, যে অঘা পাঠকের অনেকসময় নজরেই পড়ে না এ কেমন নিঃশব্দ সর্বব্যাপী বিপ্লব (সহসা পাঠকের মনেই পড়ে না সেকালের নারী তখন বিহারে অন্ধকার মাইয়াখানায় মাসের পর মাস থাকতে বাধ্য হয়ে বন্দিনী অবস্থায় দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে, ছত্রিশগড়ে তাকে সতীদাহে তুলে দেয়া হচ্ছে, আঁতুড়ে থেকে অপুষ্টিতে-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রাণ দিচ্ছে অহরহ, খোদ জোড়াসাঁকোতেও মেয়েবউরা অন্তঃপুরচারিনী)। ‘যা হতে পারতো — হতে পারে’, তার সাথে ‘যা হতে নেই’ তার বিষম কোন্দল তো চিরকালই ছিল, যা হতে নেই তাকে এমন সহজ করে এমন আধুনিকতার সাথে জিতিয়ে দিয়েছেন কে কবে?
‘যা হতে নেই’ কিন্তু হতেই পারে, এইসব ঈশ্বরের মত নৈর্ব্যক্তিকভাবে নেড়েচেড়ে দেখা সহজ কর্ম নয়, সেকালে তো নয়ই। তার একটি দারুণ দৃষ্টান্ত ‘দুরাশা’, গল্পগুচ্ছের একটি গল্প। সেকালের লেখকদের জন্যে মুসলমানদের নিয়ে লেখা সহজ ছিল না নির্ঘাত, সহজ ছিল না তাদের দৈনন্দিন জীবনকে জানা, (তারা আসলেই পেঁয়াজ সরু করে কেটে তা দিয়ে পরমান্ন রান্না করে কিনা তা জানা?) তাদের ঘরেও মাচায় মিষ্টিকুমড়া ফলে কিনা তা জানা। এটা বোঝা যায় যখন তাদের মূলত দেখা যায় ঐতিহাসিক পটভূমিতে, রাজারাজড়াদের কোঁদলে-ব্যভিচারে-যুদ্ধবিগ্রহে-ডাকাতদলের সহযোগী হিসেবে (বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ কিংবা ‘কপালকুণ্ডলা’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘মুসলমানীর গল্প’, ‘ক্ষুধিত-পাষাণ’ কিংবা ‘দুরাশা’)।
এক অপ্রাকৃত মায়ালোক সূচিত হয় এইসব গল্পে। মুসলমানদের চালচিত্র তৈরিতে দরকার হয় “শ্বেতপ্রস্তর-রচিত বড়ো বড়ো অভ্রভেদী সৌধশ্রেণী, পথে লম্বপুচ্ছ অশ্বপৃষ্ঠে মছলন্দের সাজ, হস্তীপৃষ্ঠে স্বর্ণঝালরখচিত হাওদা” (‘দুরাশা’), কিংবা “বৃহৎ তাম্রঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতিদূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিক দোলকগুলির ঠুন্ ঠুন্ ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক” (‘ক্ষুধিত পাষাণ’)। তাদের আশপাশে কিংখাবের সাজ পরা ভীষণদর্শন কাফ্রি, তাদের সামনে নীলাভ স্ফটিকপাত্রে নাশপাতি-নারঙ্গী আর আঙুর, তাদের নারীদের “জাফরান রঙের পায়জামা এবং দুটি শুভ্র রক্তিম কোমল পায়ে বক্রশীর্ষ জরির চটি পরা, বক্ষে অতিপিনদ্ধ জরির ফুলকাটা কাঁচুলি আবদ্ধ, মাথায় একটি লাল টুপি এবং তাহা হইতে সোনার ঝালর ঝুলিয়া তাহার শুভ্র ললাট এবং কপোল বেষ্টন করিয়াছে” (‘ক্ষুধিত পাষাণ’), আলিফ লায়লা ওয়া লায়লাতে যেমন বিবরণ জানা যেত বা পুরানো মুঘল মিনিয়েচার ছবিতে এক-বাল্ তুলিতে যেমন যেমন আঁকা হতো। তাদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কেবল জানা যায় এই যে তাতে সকলি অফুরান, “সুদীর্ঘ অবসর, সুলম্ব পরিচ্ছদ, সুপ্রচুর শিষ্টাচার”। যেখানে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক তোয়ের হয়, সেটাও যেন ইতিহাসের আদলে, বৃদ্ধ হবির খাঁ ডাকাতদলের হাত থেকে সদ্যবিবাহিতা কমলাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন নিজের আটমহলা বাড়িতে, তাতে নির্মাণ করেন শিবমন্দির, মুঘলসম্রাট আকবর আর তাঁর রাজপুতানী স্ত্রী যোধাবাঈ এর ঐতিহাসিক মেলবন্ধন এর মতন শোনায় তা (‘মুসলমানীর গল্প’)।
জানা যায় না সেকালের মুসলমানেরাও “এক পায়ের উপর বসিয়া দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উত্থিত করিয়া কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা এবং চিংড়িমাছের ঝাল-চচ্চড়ি দিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত” পান্তাভাত খেত কিনা (‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’)। যখন চাষাদের ঘরে দুইভাইয়ের কলহ নিয়ে লিখতে হয়, তখন তারা হয়ে যায় ছিদাম রুই আর দুখীরাম রুই (‘শাস্তি’), তারা শেখ হয় না, জোলার পো হয় না, সৈয়দ-পাঠান কিংবা খাঁও হয় না। সেকালের দুর্ভেদ্য পর্দাপ্রথাই এর কারণ কিনা, কিংবা হিন্দু-মুসলমানের গার্হস্থ্যের বিপুল দূরত্ব, কে বলবে। কার অসহযোগিতায়, বা কার কূপমণ্ডূকতায়, তা আরেকদিনের তর্ক। শুধু এইটুকু জানি, পাশাপাশি থেকে এইরকম ‘একা’ থাকার হৃদয়হীন উদাহরণ মানবসমাজের ইতিহাসে সম্ভবতঃ বিরল, অশ্রুতপূর্ব কিনা তা নৃতত্ত্ববিদরা বলতে পারবেন।
‘দুরাশা’র শুরু তাই কোলরিজের ‘দ্য রাইম অভ এনশান্ট ম্যারিনার’-এর মতন, দার্জিলিং-এর কুয়াশাঢাকা পাহাড়ের প্রায় অসম্ভব পটভূমিতে আচমকা এক নব্যবঙ্গীয়-ভদ্রলোক এক ক্রন্দনরত সন্ন্যাসিনীকে দেখতে পান এবং কথা শুরু করেন — ‘যা হতে পারে’ তা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভূসমতলের অত ওপরে নিশ্চয়ই কোনো বাধা নেই। কুয়াশায় দশদিক অবলুপ্ত হয়ে গেছে এমন কালে গল্পের শুরু — যেন গল্পটিকে একটি শূন্যস্থানে দোলকঘড়ির দোলকের মতো নিরালম্বভাবে দুলিয়ে রাখবার জন্যেই — এমন গল্প যার ঐতিহাসিক পটভূমি থাকা সত্ত্বেও আদতে স্থান নাই — কাল নাই — সময় নাই — বিধিবিধান নাই, আশ্চর্য বিদ্রোহী — সার্বভৌম মানবহৃদয়ের মতো তা মানচিত্রহীন। কুজ্ঝটিকার-কাল অবসান হবার সাথে সাথে সে গল্প শেষ হয়, যেন সূর্যালোকে তার মায়া ব্যাধিগ্রস্ত হতে পারে এই শঙ্কায়। যেন শুধু হৃদয় খুঁড়ে বের করে আনবার জন্যে — সংসারের চক্ষুলজ্জার আড়াল হিসেবে ঐটুকু কুয়াশার ধূমল ঘোমটা জরুরি ছিল।
সন্ন্যাসিনী কথা বলতে শুরু করলে আমরা জানতে পারি — তিনি বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর কন্যা। তাঁর গল্পের শুরু সিপাহী বিপ্লবের সময়, এনফিল্ড রাইফেলের ১৮৫৩ এর মডেলের টোটা দাঁতে কাটা নিয়ে ভারতবর্ষ তখন তোলপাড়। এ সেই ভারতবর্ষ, যার বন্দী পুরুরাজ বুক চিতিয়ে দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারকে বলেছিলেন — রাজার কাছে রাজার মতন ব্যবহার আশা করেন তিনি, অথচ পরে এই পুরুরাজই আলেকজান্ডারকে অন্য রাজ্যের রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা দিয়েছিলেন। এ সেই ভারতবর্ষ যেখানে নবাবরা গরু-ছাগলকে মহার্ঘ্য জাফরান মেশা জাবনা খাওয়াচ্ছেন যাতে কাবাবের মাংসের ভাঁজে ভাঁজে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মশলার সুঘ্রাণ পাওয়া যায়, (শরীর আইঢাই করলে খাচ্ছেন সোফিয়ানি, মন ভাল করতে বিরিয়ানি) আর সেই মেধযজ্ঞে ব্যস্ত নবাবের নাকের ডগা দিয়ে ইংরেজ বেনিয়ারা তাঁদের ‘বাবুল’ দখল করে নিয়েছে — দিল্লীশ্বর বাহাদুর শাহ জাফরের ছেলে-নাতিদের হত্যা করেছে — ‘বাবুল মোরা নৈহার টুট হি যায়’ নাকিকান্না ছাড়া নবাবরা কিছু করতে পারেননি। এহেন ভারতবর্ষে যে নবাব গোলাম কাদের খাঁ ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বেন না এবং উপর্যুপরি তাঁদেরকে গোপনে নিজকেল্লার বিদ্রোহসংবাদ দিয়ে আসবেন — তাতে আশ্চর্য কী!
নবাব গোলাম কাদের খাঁয়ের ফৌজের অধিনায়ক ছিলেন এক পরম ব্রাহ্মণ, তাঁর নাম কেশরলাল। যমুনার জলে সূর্যতর্পণ করতেন, শ্বেত সোপান বেয়ে ভৈরোঁ ভজন গেয়ে ফিরতেন — তাঁর সেই তপস্যার আঁচ লেগেছিল নবাব গোলাম কাদের খাঁয়ের তামসিক অন্তঃপুরে। নবাবপুত্রীর সহজাত পূজার পিপাসা, ভক্তির তৃষ্ণা, পবিত্র কিছুর আকাঙ্ক্ষা সকলের অন্তরালে এই কেশরলালকে ঘিরে আকারলাভ করছিল। এই ভক্তির পিপাসা রবীন্দ্রনাথে নতুন নয়, ‘দৃষ্টিদান’-এর কুমু, ‘ঘরে-বাইরে’র বিমলা, ‘ঘাটের কথা’র কুসুম কিংবা ‘বোষ্টমী’র আনন্দী এরা সকলেই সেই প্রেমসায়রপিয়াসী। ‘মুসলমানীর গল্প’তে কমলা যেমন অতি সহজে বলে “আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভগবানই আমার ধর্ম। যে ধর্ম আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আস্তাকুঁড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি তো দেবতার প্রসন্নতা কোনোদিন দেখতে পেলুম না”, অনেকটা সেই রকম — নবাবপুত্রী তাঁর হিন্দু বাঁদীর কাছে রামায়ণ-মহাভারতের কথা শোনেন, কবে কোনকালে তাঁর বংশের রক্তে এক ব্রাহ্মণকন্যার রক্ত এসে মিশেছিল, সেই শোনিতধার তাঁকে উষ্ণ করে তোলে। তাঁর চারপাশে হিন্দু অনুষঙ্গ এসে ভিড় করে, “মূর্তিপ্রতিমূর্তি, শঙ্খঘণ্টাধ্বনি, স্বর্ণচূড়াখচিত দেবালয়, ধূপধুনার ধুম, অগুরুচন্দনমিশ্রিত পুষ্পরাশির সুগন্ধ, যোগীসন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতা, ব্রাহ্মণের অমানুষিক মাহাত্ম্য, মানুষ-ছদ্মবেশধারী দেবতাদের বিচিত্র লীলা” — নবাবপুত্রীর শূন্য হৃদয়ক্ষেত্রে নানান বায়ূবাহিত বীজ উপ্ত হয়, অর্থাৎ আবারও সেই অপ্রাকৃত মায়ালোকের সূচনা হয়। অন্তঃপুরের অনন্ত আড়ালে বিপ্র একরকম দেবরূপ লাভ করেন, নানা উপচারে তাঁর নিঃশব্দ পূজা চলতে থাকে। কিন্তু বাইরে তার কোনো আভাস মেলে না, ধর্মান্তর সেখানে বিপুল বাধা। এমনকী পূজা নেবার বেলায়ও। নবাবপুত্রীর ক্ষুব্ধপরাণ যতদূর চায়, ততদূর তিনি ভালবাসেন শুধু।
বিদ্রোহকালে নবাবপুত্রী তাঁর সব গহনা পুঁটুলি বেঁধে কেশরলালের সেনাবাহিনীতে দান করেন। বিদ্রোহসংবাদ পেয়ে গোরা ফৌজ আচম্বিতে কেল্লা আক্রমণ করে, কেশরলাল অন্যায় সমরে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধের ডামাডোলে নবাবপুত্রী ছদ্মবেশে কেল্লা থেকে বের হয়ে পড়েন। যে যমুনার জলে বিপ্রশ্রেষ্ঠের সূর্যপ্রণাম দেখে তাঁর বালিকাহৃদয় উন্মথিত হতো, সে যমুনার জল রক্তসমাচ্ছন্ন। যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কেশরলাল এবং তাঁর খাসভৃত্য দেওকীনন্দনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন।
পূজনীয়ের সাথে প্রণতের সে এক অভিনব সাক্ষাৎ, মৃত কেশরলালের পা মুছিয়ে দেন আকুলকেশে, পদচুম্বন করেন তিনি। এমনসময় কেশরলাল নড়ে ওঠেন এবং জল চান, নবাবপুত্রীর দিগভুল হয়ে যায়, কেশরলালকে যমুনার জল দেন তিনি, আহতস্থান মুছে দেন। সম্বিত ফিরে পাবার পরে এবং পরিচয়লাভ করবার পরে কেশরলাল যবনীর (এবং বিশ্বাসঘাতক যবনকন্যার) হাতের জল খেয়ে তাঁর ধর্মনাশ হয়েছে এই জ্ঞানে নবাবপুত্রীকে ভয়ানক এক চড় মারেন।
এইখানে শ্রোতা ভদ্রলোকটির দিকে ফিরি, নবাবপুত্রীকে যখন কেশরলাল দুঃসহ চপেটাঘাত করছেন, তখন তিনি থাকতে না পেরে বলে বসেন — “জানোয়ার”। নবাবপুত্রী জিজ্ঞেস করেন — জানোয়ার কি মৃত্যুযাতনার কালে পানি অস্বীকার করে? অপ্রতিভ শ্রোতা ভুলস্বীকার করবার মতো করে বলে — “তা বটে। সে দেবতা, নবাবপুত্রী তাও অগ্রাহ্য করেন, বলেন — দেবতা কি ভক্তের একাগ্রচিত্তের দান অস্বীকার করেন? দেবতা এবং জানোয়ারের অমীমাংসিত তর্কের ভিতর দিয়ে গল্প এগিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ ছোট্ট করে কেবল জানিয়ে রাখতে চান এই হঠকারিতা কেবল মানুষের দ্বারা সম্ভব, মনুষ্যেতর বা মনুষ্যোর্ধ্ব কিছুর দ্বারা নয়। ভক্তিভারাতুরের তর্পণে দেবতাও এমন উদাসীন বা নিষ্ঠুর হতে পারেন না যতটা মানুষ।
বাইরের পৃথিবীর সেই প্রথম সম্ভাষণ অন্তঃপুরচারিণী সেই ষোড়শী পূজারিণীর পৃথিবীকে কেমন টলিয়ে দিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তা জানিয়েছেন একটিমাত্র ব্যথিত প্রণামের পরে। প্রণম্য তো শ্রদ্ধার দান অগ্রাহ্য করে কালো যমুনার ঝিকিঝিকি জলে নৌকা ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে, এদিকে — “নৌকা দেখিতে দেখিতে মধ্যস্রোতে গিয়া ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া গেল — আমার ইচ্ছা হইতে লাগিল, সমস্ত হৃদয়ভার, সমস্ত যৌবনভার, সমস্ত অনাদৃত ভক্তিভার লইয়া সেই অদৃশ্য নৌকার অভিমুখে জোড়কর করিয়া সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই চন্দ্রালোকপুলকিত নিস্তরঙ্গ যমুনার মধ্যে অকাল-বৃন্তচ্যুত পুষ্পমঞ্জরীর ন্যায় এই ব্যর্থ জীবন বিসর্জন করি ।
কিন্তু পারিলাম না। আকাশের চন্দ্র, যমুনাপারের ঘনকৃষ্ণ বনরেখা, কালিন্দীর নিবিড় নীল নিষ্কম্প জলরাশি, দূরে আম্রবনের ঊর্ধ্বে আমাদের জ্যোৎস্নাচিক্কণ কেল্লার চূড়াগ্রভাগ, সকলেই নিঃশব্দগম্ভীর ঐকতানে মৃত্যুর গান গাহিল; সেই নিশীথে গ্রহচন্দ্রতারাখচিত নিস্তব্ধ তিন ভুবন আমাকে একবাক্যে মরিতে কহিল। কেবল বীচিভঙ্গবিহীন প্রশান্ত যমুনাবক্ষোবাহিত একখানি অদৃশ্য জীর্ণ নৌকা সেই জ্যোৎস্না রজনীর সৌম্যসুন্দর শান্তশীতল অনন্ত ভুবনমোহন মৃত্যুর প্রসারিত আলিঙ্গনপাশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাকে জীবনের পথে টানিয়া লইয়া চলিল।”
দশদিক একবাক্যে মরতে বলবার পরেও ভালোবাসা এবং তার বিভ্রম অপার প্রসন্নতা জাগিয়ে রাখে, রবীন্দ্রনাথের নারীরা ‘সুদূরের পিয়াসী’, জহরব্রত তাঁদের জন্য নয়, তাঁদের ব্রত জীবতকালের। যেজন্যে আমরা দেখি, নবাবপুত্রী ভেবে নেন — ব্রাহ্মণ হীনের সেবা নেন না, ধনীর দান নেন না, যুবতীর যৌবন — রমণীর প্রেম গ্রহণ করেন না, তিনি স্বতন্ত্র-একাকী-নির্লিপ্ত এবং সুদূর। তিনি সঙ্গীহীন, সেবকহীন, আত্মনিমগ্ন আর সম্পূর্ণ। (প্রেমাকুল মন প্রেমজর শরীরে কত বিভ্রমকেই না আরোপ করে!) সেই অবিভাজ্য-মৌলিক সত্তার কাছে আত্মসমর্পণের অধিকারও নবাবপুত্রীর নাই। এবং স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো সেরাতে যমুনার পাড় ধরে চলতে থাকেন।
ব্রাহ্মণত্ব লাভ করবার অসম্ভব তৃষ্ণা তাঁকে হাউইয়ের মতো উড়িয়ে বেড়ায়, পুড়িয়ে বেড়ায়, অবশেষে সেদিনের সকালে তিনি মৃত ধুমকেতুর মতন আবিষ্কার করেন এতকালের সূর্যপ্রদক্ষিণশেষে তাঁর সম্বল ছাই আর পাথর। যা এতকাল জ্বালিয়ে বেড়িয়েছেন — প্রেমের যজ্ঞে যা দুঃসহ দহনে ঊর্ধ্বশিখা হয়ে জ্বলছিল — তা একদা ঈশ্বরের পরম আদরে তাঁর হাতে সম্প্রদান করা বস্তু, জীবন যার নাম, যা একবারই হাতে নেবার জন্যে মেলে। এতক্ষণ গল্প শুনতে থাকা নিউ বেঙ্গল এই হেঁয়ালির অর্থ ধরতে পারে না।
নবাবপুত্রী তখন তাঁকে বলেন — আজ সকালে বহুকাল (আটতিরিশ বছর) অন্বেষণের পরে তিনি কেশরলালের খোঁজ পেয়েছেন। দেখেছেন কেশরলাল নেপালের ভুটিয়াপল্লীতে ম্লেচ্ছ ভুটিয়া স্ত্রী আর নাতিনাতকুড়সহ উঠানে বসে ভুট্টা থেকে দানা সংগ্রহ করছেন।
যে দীপাবলি প্রাণের ভিতর এতকাল জ্বলছিল, তা এক ফুৎকারে নিভে গেলে পর মানুষের যে হাহাকার — তা শুনতে পাই — সন্ন্যাসিনীর গলায়, “হায় ব্রাহ্মণ, তুমি তো তোমার এক অভ্যাসের পরিবর্তে আর-এক অভ্যাস লাভ করিয়াছ, আমি আমার এক যৌবন এক জীবনের পরিবর্তে আর-এক জীবন যৌবন কোথায় ফিরিয়া পাইব।”
কিশোরহৃদয়ের ভক্তি-যৌবনের পূজা দিয়ে তিলে তিলে গড়া যে ধর্ম, যাকে অনাদি-অনন্ত ভেবে নবাবপুত্রী অকূল সাগর পাড়ি দিয়ে ফিরছিলেন, এক আঘাতে যেন তিনি বুঝতে পারেন — তা অভ্যাস এবং সংস্কারের সমন্বয়মাত্র, তা কালের দাবীতে বিচলিত হয়, মোচিত হয়, তা কালের যাত্রায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বীরের বীরগাথা নয়, বিপ্লবীর আত্মত্যাগ নয়, কেবল কালো যমুনার জলে ভাসানো কবেকার কালো-নৌকাকে লক্ষ্য করে তাঁর এতকালের যাত্রা, তা কবে দিক হারিয়েছে লেপচাদের ম্লেচ্ছ দেশে। এই হাহাকার যেন সেই অপ্রাকৃত মায়ালোক থেকে ঝুপ করে পড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ। যার পরে সন্ন্যাসিনী ‘সেলাম বাবুজি/বাবুসাহেব’ ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না। শেষ অভিবাদনটি মুসলিম, যেন নিঃশব্দে এতকালের অতি আদরের ব্রাহ্মণ্যকে পরিত্যাগ করে যাওয়া।
এইখানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ম্প্রকাশ, যিনি সকল ধর্মের আগে (কিংবা অনুষ্ঠানের আগে) মানবধর্মের পূজারী, জীবন বারেবারে যাঁর আসল দেবতা। জীবনের দাবী যে সর্বোচ্চ, জীবন যে অফেরতযোগ্য — তা বড় তিক্ত মূল্যে একটি জীবন জানতে পায়। নিতান্ত মানুষকে দেবতার মতো মহিমাময় করে একান্ত পুতুলখেলায় যা শুরু হয়েছিল, যার মূল্য চুকাতে ফুল ফোটাবার শস্য ধরাবার তাবত কাল চন্দ্রাহতের মতন তপস্বিনী পার হয়ে গেছেন, তা একরকম প্রাকৃতিক মৃত্যুর সামনাসামনি হয়। নবাবপুত্রীর এতদিনের কেশরলালের জন্যে বোনা রাজপোশাক, আসল কেশরলালের গায়ে ঢলঢল করতে থাকে, বিপ্রজীবনের সকল ত্যাগ-তপস্যার মায়া-চুমকি সেখান থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে, যেন তাঁকে লজ্জা দিতেই (এইরকম লজ্জা আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘বিচারক’ গল্পের হেমশশীকেও পেতে দেখি “দেবপ্রতিমা যখন তাহার সমস্ত মাটি এবং খড় এবং রাংতার গহনা লইয়া তাহার পার্শ্বে আসিয়া সংলগ্ন হইল, তখন সে লজ্জায় ধিক্ কারে মাটিতে মিশিয়া গেল।”); যা আচারবিচারের সমষ্টিমাত্র, যার সাথে হৃদয়ের সরল আবেদনের যোগ নাই, যা ভক্তি-ভালবাসা-স্নেহ-প্রীতি-সম্প্রীতির সহজ মূল্যায়ন করতে অক্ষম, যা যুক্তিবিহীন অলঙ্কারে মানসদৃষ্টিকে ঢেকে দেয় এবং তাকে কাছের মানুষকেও দেখতে দেয় না — যা মানুষকে আদতে মুক্তি দেয়না — তা যে এমনি করেই ঝরে পড়তে বাধ্য, কালের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতে বাধ্য।
মনে হয়, যে রবীন্দ্রনাথ এমন করে তাঁর দুর্ভাগা দেশের শ্রেয়কে অনায়াসে চিনবার ক্ষমতাহীনতাকে জেনেছেন (নিজে যে কারণে শেষবয়েসের আঁকা ছবির পাঁজা নিয়ে গেছেন পশ্চিমে, বলেছেন তাঁর ছবি দেখবার জন্যে ভারতবর্ষ এখনো প্রস্তুত নয়। কিংবা নোবেল প্রাইজ পাবার পরে তাঁকে নিয়ে গোটা দেশের মাতাল হবার সময় তিনি যেমন করে নিজেকে সংযমে বেঁধেছিলেন এই জেনে যে পশ্চিম-আপতিত রশ্মির ছটায় তাঁর আপনার দেশ তাঁকে নতুন করে দেখছে), যেমন করে মহাপুরুষের জ্ঞানচক্ষু দিয়ে দেখেছেন শ্রদ্ধার গন্ধমাদনের আড়ালে অতল হৃদয়হীনতা এবং মননশীলতার অভাবকে — মানবিকতার অভাবকে ভক্তির ভানে ঢাকবার সম্পূরক প্রচেষ্টা (স্মরণ করে দেখুন মৃত রবীন্দ্রনাথের শবযাত্রার কালে কলকাতার ভক্তরা তাঁর চুলদাড়ি ছিঁড়ে নিচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এই জন্যেই কি মরতে চেয়েছিলেন বোলপুরে?) সেই রবীন্দ্রনাথ যেন এই গল্পে উঁকি দিয়ে গেছেন।
অগাস্ট, ২০১০
লেইটন পার্করোড, লন্ডন
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ২৫ জুলাই ২০১১ (৪:২৬ অপরাহ্ণ)
অনন্যসাধারণ দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ বটে। শুধু অভিমানী নারীর একটি চরম রূপ বাদ পড়েছে। গল্পের নাম ‘শাস্তি’। শেষ সংলাপটা ভাবুন। অভিমানাক্ত হৃদয়ে বলে ওঠে ছিদামের তরুণী মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত স্ত্রী যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় স্বামীর সাথে সে সাক্ষাতে আগ্রহী কি না! মাত্র তিন অক্ষরের শব্দটিতে ঝলসে ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান।
আপনি আরও লিখুন হাত খুলে। অমর্যাদা করবেন না এমন শিল্পমানসের।
মাসুদ করিম - ২৫ জুলাই ২০১১ (৭:০৬ অপরাহ্ণ)
মন্তব্য নয়, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন করতে চাই সাগুফতা শারমীন তানিয়াকে, কথাকারের স্মৃতিই কি পৃথিবীর সবচেয়ে টনটনে স্মৃতি?
সাগুফতা শারমীন তানিয়া - ২৭ জুলাই ২০১১ (১১:০৬ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ ব্লাডি সিভিলিয়ান, সত্যি ছিদাম রুইয়ের স্ত্রী চন্দরাকে ভোলা যায় না, বিশেষতঃ স্বামীর স্ত্রী মরিলে স্ত্রী পাইব এই যুক্তির পর তার হতবিহ্বলদশা এবং ডেস্টিনির কাছে নির্বিকার সমর্পণ।
মাসুদভাই,
আপনার প্রশ্নের উত্তর জানি না, তবে সবচেয়ে টনটনে স্মৃতি বোধ করি পাঠকের, আজো ‘অগ্রদানি’র পেটুকলোকটার জন্যে নইলে এমন করে মন মুচড়ে ওঠে কি করে। পাঠকের স্মৃতিই সবচেয়ে সার্বিক, স্বয়ম্ভূ, সবচেয়ে নিবিড়।