আমার পড়াশোনা আইন বিষয়ে। ‘ক্রসফায়ারের’ সাথে আমার পরিচয় বেশ কয়েক বছর আগে, সেই ২০০৭ সালে, যখন আমি ছাত্র অবস্থায় ‘অধিকার’ নামক একটি মানবাধিকার সংগঠনে কাজ শুরু করি। আমি সেখানে মূলত ডকুমেন্টেশানের কাজ করতাম। প্রধানত র‌্যাব কর্তৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ক্রসফায়ারের ঘটনার উপর তৈরি করা অধিকারের প্রতিবেদন আমি বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতাম। বলতে গেলে অনুবাদ করার সুবাদেই আমার টানা বেশ কয়েক বছর অগণিত ক্রসফায়ারের বিষদ বর্ণনা পড়ার সুযোগ হয়। প্রায় সব ঘটনাতেই র‌্যাব -এর পক্ষ থেকে বলা হত যে একটি সোর্স-এর মাধ্যমে তারা ঘটনাস্থলে হাজির হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত একটি সন্ত্রাসী/ডাকাতের দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণের ফলে র‌্যাব সদস্যরা আত্মরক্ষার স্বার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গুলি বিনিময়কালে একজন মারা যান (যিনি ক্রসফায়ারের শিকার) এবং সন্ত্রাসী/ডাকাত দলের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। গুলিবিদ্ধ সন্ত্রাসী/ডাকাতের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া যায় একটি রিভল্ভার এবং কয়েক রাউন্ড গুলি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন র‌্যাবের গুলি কখনো ক্রসফায়ার ভিক্টিমের ‘পায়ে’ লাগে না কেন? কেন তাদের গুলি সবসময়েই ‘বুক’ বা তার কাছাকাছি স্থানে আঘাত হানে? সেই প্রশ্ন সবারই। এমনসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই পরবর্তী বছরগুলোতে আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর জন্য কিছু কাজ করতে গিয়ে। আমার মনে আছে হেনরিক আলফ্র্যামের সাথে ঢাকা এবং গাজিপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোর কথা। আমরা ক্রসফায়ার ভিক্টিমদের কথা শুনতাম। হয়তোবা একজন হতভাগা মা আমাদের জানাতেন কিভাবে তার সন্তানকে র‌্যাব তাদের বাসা বা বাসার সামনের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায়। কিভাবে জীবিত অবস্থায় সেই সন্তানকে আর খুঁজে পাওয়া হয়ে ওঠে না। আমার আজও মনে পরে কিভাবে ক্রসফায়ার ভিক্টিমদের পরিবারের সদস্য আমাকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট প্রকাশিত কবে হবে? তাদের বুকে তখন অনেক আশা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মত বিদেশী মানবাধিকার সংগঠন তাদের না বলা কথা তুলে ধরবে আর সেই সুবাদে বিচারের পথ প্রশস্ত হবে, এই ছিল তাদের চাওয়া। দুবছরের মধ্যে দুটি পৃথক (২০০৯ ও ২০১১ সালে) রিপোর্ট প্রকাশিত হয় । শুরুর দিকে মনে অনেক আশা ছিল – মহাজোট সরকার ক্রসফায়ারকে শক্ত হাতে দমন করবে যেমন তারা আশ্বাস দিয়েছিল ক্ষমতায় আসার আগে। আশ্বাস আশ্বাসই থেকে যায়। ‘জিরো টলারেন্স’ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। ভিক্টিম পরিবাবারের ফোন এলে আমার বলার কিছু থাকে না। ধীরে ধীরে ফোন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। দেশবাসী দেখতে শুরু করে আরেক নতুন নাটক – ‘গুম’ বা ‘এনফর্সড ডিসাপিয়ারেন্স’ অর্থাৎ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কাউকে গায়েব করে ফেলা।

বেশ কিছু বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটতে থাকলেও কিছুদিন আগে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলে ‘গুম’ আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বিএনপি তার নেতাকে ফিরে পাওয়ার দাবীতে টানা হরতাল ডেকে বসে। হরতালের সময় দুজন শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় ফেইসবুকে একজন ক্ষুব্ধ বন্ধু লিখেন – একজন নামকরা ক্যাডার-মাস্তান ইলিয়াসের নিখোঁজ হওয়ার প্রতিবাদে যদি এদেশে দুদিন হরতাল হয়, তাহলে নষ্ট রাজনীতির বলি দুজন ভাল মানুষ খুন হওয়ার প্রতিবাদে কতদিন হরতাল হওয়া উচিৎ? শত অনুরোধ উপেক্ষা করে বিএনপি ঠিকই এইচএসসি পরীক্ষার মাঝে দ্বিতীয় দফার মত হরতাল ডেকেছে। তার সাথে এও জানিয়েছে যে এপ্রিল ৩০, ২০১২ মধ্যে ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে না দিলে তারা আরো কঠিন আন্দোলনে নামবে। এতগুলো হরতাল ডাকার পর আন্দোলন আর কিভাবে ‘কঠিন’ হবে, তা আমরা কেউই খুব একটা বুঝে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার – বিএনপি দেখাতে চায় যে মহাজোট সরকারের আমলে রাষ্ট্র একটি ‘তরল’ অবস্থার মধ্যে ধাবিত হচ্ছে – যেখানে আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী আইনের উর্ধে থেকে একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে। বিএনপি’র এমন প্রচেষ্টা অবশ্য ধোপে টেকে না। র‌্যাবের সৃষ্টিকারী বিএনপিই এবং বিএনপি আমলেও অসংখ্য ক্রসফায়ার ঘটেছে, মানুষ হয়েছে ‘গুম’। আগামীতে ক্ষমতায় ফিরে বিএনপি’র মধ্যে অলৌকিক পরিবর্তন না আসলে তারা ক্রসফায়ার-গুমের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থাই নেবে না। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস-যোগ্যতা-ইচ্ছা কোনটিই বিএনপি’র আছে বলে আমার মনে হয় না। তারপরেও র‌্যাবের মত রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক ক্রসফায়ার-গুম বন্ধ কেন জরুরী এবং বন্ধের জন্য কী কী করণীয় তা এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। তার সাথে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে আমার রাজনৈতিক ভাবনাও লেখাতে তুলে ধরব।

ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা দুটি প্রেক্ষিত থেকে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেউ কেউ আমার সাথে একমত নাও হতে পারেন তবে আমি মনে করি দুটি প্রেক্ষিতকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ‘ক্রসফায়ার-গুম’কে মোকাবেলা করা উচিৎ। প্রথম প্রেক্ষিতের কথায় আসি। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তাহল কেন সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা। ক্রসফায়ার-গুমকে আমরা কেন বিরোধিতা করি? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি তথাকথিত খারাপ মানুষদের মেরে বা গুম করে ফেলে তাতে ক্ষতি কি? এতে কি অপরাধের হার কমে আসবে না? সহজ ভাষায় এর উত্তর হচ্ছে না। রাষ্ট্র কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা-গুম করার মানেই হচ্ছে যে রাষ্ট্র তার বিচার বিভাগকে অগ্রাহ্য করে নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে যে রাষ্ট্র যদি নিজ হাতেই আইন তুলে নেয়, তাহলে ‘রাষ্ট্রের’ সাথে ‘সাধারণ অপরাধী’র আর কোন তফাৎ থাকে না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনকে তোয়াক্কা না করার এই প্রবণতা যত বাড়বে, সময়ের সাথে সাথে সাধারণ মানুষও একদিন টের পেয়ে যাবেন যে অপরাধের হার কমছে না বরং বাড়ছে – ক্রসফায়ার অথবা গুম কাজে লাগছে না। এতে সাধারণ মানুষেরও বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা কমে যেতে থাকবে। অপরাধের শিকার হলে এক পর্যায়ে আমার আপনার মত মানুষরাও একদিন নিজ হাতে আইন তুলে নিব, হয়তোবা কোন তুচ্ছ কারনে। এমন নমুনা কিন্তু আমরা চোখের সামনে প্রায়ই দেখতে পাই যখন একজন ছিনতাইকারীকে আমরা গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলি। এই সবই আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর অনাস্থার অশুভ লক্ষণ। আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই যদি বিচারকের ভূমিকা অবলম্বন করেন তাহলে বিচার বিভাগের আর প্রয়োজনীয়তা কোথায়? আমরা তো তাহলে সেই রাজা-বাদশাদের যুগেই ফেরত যেতে পারি যখন অপরাধীকে ধরার লোক এবং শাস্তি দেয়ার লোক ছিলেন এক ও অভিন্ন? কী প্রয়োজন ছিল তাহলে এত কষ্ট করে বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করার? ক্রসফায়ার-গুম যে আমাদের ‘শিক্ষানবিস’ গণতন্ত্রের ভীতকেই নড়বরে করে দিচ্ছে, এই উপলব্ধি আজ আমাদের বড়ই প্রয়োজন। বহু বছর গবেষণা করেই কিন্তু পৃথিবীর ক্রিমিনলজিস্টরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। ভয় হয় যখন ভাবি ১০-১৫ বছর পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য প্রায় দুই যুগেরও বেশী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হবেন ক্রসফায়ার-গুম করার ক্ষেত্রে। আমার শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক যথার্থই বলেছেন: ১০ বছর ধরে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া একজন র‌্যাব-পুলিশ সদস্যকে নিয়ন্ত্রন করার কোন উপায়ই থাকবে না। ইতিমধ্যেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। স্যার আরো বলেছেন, আজকের যারা সংসদ সদস্য তাদের অন্তত এটি ভাবা উচিৎ যে তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হলে তারাও কিন্তু ইলিয়াস আলীর মত হয়ে যাবেন ‘সাবেক সংসদ সদস্য’। তখন হঠাৎ একদিন ‘গুম’ হয়ে যাওয়া কি অবিশ্বাস্য শোনাবে?

এবার আসি দ্বিতীয় প্রেক্ষিতে, যেই প্রেক্ষিতটি ‘রাজনৈতিক’ও বটে। ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার পর মোটামুটি সব রাজনৈতিক দলই কমবেশি কথা বলেছে। স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশী বলেছে বিএনপি, তারপর আওয়ামী লীগ। দুই দলই একে অপরকে দোষারোপ করেছে। এই সব কিছুর মধ্যে আমার কাছে অবশ্য অদ্ভুত ঠেকেছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির ভূমিকা। তারা এই বিষয়ে বলতে গেলে নিশ্চুপ ভূমিকাই পালন করছে। একটা বিষয় নিয়ে আমি প্রায়ই চিন্তিত হই।

বাংলাদেশে চলছে বহু প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধের বিচার। সেই সূত্রেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির প্রধান নেতারা আজ জেলখানায়। অনেকে হয়ত কল্পনাও করতে পারেননি গোলাম আজমকে একদিন জেলে আটক করা হবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে। এটি ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য একটি সুন্দর স্বপ্নের মত যা আজ বাস্তবে রূপ ধারণ করেছে বহু মানুষের ত্যাগ ও সাধনার ফলে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে – আগামী দুবছরে আসলেই যদি আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি কি একটি শেষ মরণকামড় দেবে না? কিছুদিন আগে আমাদের সেনাবাহিনীতে কিছু উগ্র-ডানপন্থী সদস্য দ্বারা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা কি এই সবেরই কিছু আগাম লক্ষণ? কে না জানে যে রাষ্ট্রের ভেতরেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি লুকিয়ে আছে এবং তারা যেকোনো মূল্যে, এমনকি দরকার হলে, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বন্ধ করে দেবে? ইলিয়াস আলীর মত বিএনপি’র নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে যদি কোন রাষ্ট্রীয় সংস্থায় লুকিয়ে থাকা কিছু লোক ‘গুম’ করেই ফেলেন, ক্রসফায়ার-গুমে ইতিমধ্যেই নিমজ্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি একটি ‘তরল’ অবস্থার দিকেই যাবে না? বলার অপেক্ষা রাখে যে এমন ‘তরল’ অবস্থার সুবিধা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিই নিবে।

এই দুটি প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখেই বর্তমান সরকারের উচিৎ ক্রসফায়ার-গুম বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমার মতে প্রথমেই হাত দেয়া প্রয়োজন আমাদের আইনে, যেসব আইন মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘ইনডেমনিটি’ বা ‘দায়মুক্তি’ প্রদান করে। যেমনঃ

• আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৪৬ এ সেই অংশটুকু বাদ দেয়া যেতে পারে যেখানে সংসদকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা সম্পর্কিত কোন কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে ‘ইনডেমনিটি’ দেয়ার।
• আমাদের ‘Criminal Procedure Code’-এ ১৩২, ১৯৭ এর মত ধারা সংশোধন করা, যেগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রক্ষা করে।
• র‌্যাবের মূল ভিত্তি Armed Police Battalions Ordinance, 1979 এবং এই আইনের ২০০৯ সালের সংশোধনীতে পরিবর্তন আনা। আরো সচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে এই আইনের অধীনে গঠিত স্পেশাল র‌্যাব ট্রাইব্যুনাল বাতিল করা।
• ‘Preventive detention’কে অনুমোদন করে এমন আইনকে বাতিল করা।
• Army Act, Air Force Act, Navy Ordinance, Armed Forces Battalion Ordinance এবং এ ধরণের অন্যান্য আইন সংশোধন করা যাতে সশস্র বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সকল অভিযোগ যাতে বেসামরিক কোর্টে বিচারাধীন হয়।
• আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সেনা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করার চর্চা থেকে বের হয়ে আসা।
• মানবাধিকার কমিশনের আইনকে আরো শক্তিশালী করা।

উপরে উল্লেখিত প্রস্তাবনাগুলো যে শুধুমাত্র একটি ‘রাজনৈতিক’ সরকারই করতে পারে তা যে কেউই বুঝবে। তাই শেষমেশ ক্রসফায়ার-গুম বন্ধের সিদ্ধান্ত আসলে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তির বিধান বাতিল করে দিলেই ক্রসফায়ার-গুমের জন্য তারা বিচার ব্যবস্থার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তখন দ্রুতই এইসব বিচার-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি – মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির কোন অসাংবিধানিক ইচ্ছার আস্ফালনও অনেকাংশে কমে আসবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮শে এপ্রিলের নাগরিক সংবর্ধনায় খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করলেন সবাইকে নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষ হতে বেশ রাতই হয়ে গিয়েছিল। আমি বিটিভি-তে তাঁকে দেখছিলাম এবং মনে মনে বলছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহস এখনও অটুট আছে। যিনি আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন, হরতালের আগের রাতের ঐ সংবর্ধনায় নাগরিকদের মাঝখানে তাঁর সবল উপস্থিতি একজন সাহসী নারীর কথা মনে করিয়ে দেয় যিনি নির্ভয়ে কঠিন সংকট মোকাবেলা করে চলেছেন। আমি আশা করবো প্রধানমন্ত্রী আবারো সামনের রাজনৈতিক প্রতিকূলতাকে সরাসরি মোকাবেলা করেই ছাড়বেন, যেমনটি তিনি করেছিলেন সেনা-চালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কথা শুধু একটাই, এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আপনাকে আটকে ধরা সিভিল ও মিলিটারি বুরোক্রেসির বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সাধারণ জনগণকে আবারো আপনার চারপাশে রাখতে হবে, যারা আপনাকে ভোট দিয়েছিল ২০০৮ সালে। তা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ অবশ্যই নিমজ্জিত হবে একটি ‘তরল’ অবস্থায়, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ঠিক আগে-পরে, যেই অবস্থার ফায়দা লুটতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ১৯৭৫ সালেও দ্বিধাবোধ করেনি, সামনেও করবে না।

তথ্যসূত্র: পড়ুন ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘Ignoring Executions and Torture- Impunity for Bangladesh’s Security Forces’ এবং ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘Crossfire’ Last accessed on April 30, 2012.
পড়ুন ‘Army foils coup plot against Hasina’ Last accessed on April 30, 2012.

এম সানজীব হোসেন

১৯৮৫ সালের ১ এপ্রিল জাপানের কিয়োটো শহরে জন্মগ্রহণ করি। বর্তমানে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের সাহায্যে যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ক্রিমিনলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ে এমএসসি সম্পন্ন করেছি। কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটরের রিসার্চার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) ও একাত্তর বাংলাদেশ-এর সদস্য এবং কর্নেল তাহের সংসদ-এর গবেষণা সম্পাদক।

৩ comments

  1. মাসুদ করিম - ৩ মে ২০১২ (২:১৪ পূর্বাহ্ণ)

    এটা হয়তো তেমনি এক গোলকধাঁধাঁ যেখানে ঢোকা যায় কিন্তু বের হওয়া যায় না। একথা ভেবেই আমি আরো আক্রান্ত, আমি জানি না, র‌্যাব বা পুলিশ বা আর্মি বা বিজিবি বা সরকার বা রাষ্ট্র কেউই এই ‘NO EXIT’এর জগত থেকে বের হতে পারবে কি না।

  2. রাকিন - ৩ মে ২০১২ (১:৩৫ অপরাহ্ণ)

    আমার মনে হয় একে বন্ধ করা সম্ভব না , আমাদের প্রতিষেধক আছে কিন্তু প্রতিকারের ইচ্ছা নেই।

  3. মোহাম্মদ মুনিম - ২৩ মে ২০১২ (৫:৪১ অপরাহ্ণ)

    কিছুদিন আগে ফাতেমা ভুট্টোর বইয়ে পড়েছিলাম পাকিস্তানের করাচী শহরে বেনজির ভুট্টোর সরকার পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনীকে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে indemnity দিয়েছিল। এর ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০০০ মানুষ প্রাণ হারায় এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ‘দেশের মধ্য আরেকটি দেশ’ হয়ে উঠে। ভারতের মুম্বাইয়ের পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও ৯০ এর দশকে নিজেরা মিলেই death squad গঠন করেন এবং প্রায় চারশো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে হত্যা করেন। এই সবকটি হত্যাকাণ্ডকেই encounter নামে আখ্যা দেওয়া হয় এবং মুম্বাইয়ের death squad এর পুলিশ কর্মকর্তারা এক ধরনের মিডিয়া তারকায় পরিণত হন। বাংলাদেশের র‍্যাবও সম্ভবত ভারত পাকিস্তানের পুলিশের আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল।
    বিএনপি সরকার র‍্যাব গঠন করেছিলেন শুধুমাত্র political point-scoring এর জন্য, আওয়ামী লীগ সরকারও সেই কারণেই র‍্যাব টিকিয়ে রেখেছে। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে আজ ‘দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোবাইল সুমন’ কাল ‘কুখ্যাত চাঁদাবাজ গালকাটা রিমন’ ক্রসফায়ারে নিহত এই জাতীয় খবর মধ্যবিত্তদের এক ধরনের নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। কিন্তু দুদিনের মধ্যেই আরেকজন ‘মোবাইল সুমনের’ জায়গা নিয়ে নেয়। ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে লক্ষ লক্ষ স্বল্পশিক্ষিত তরুণ আছে, এদের দেশে চাকরি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, মালয়শিয়া যাওয়ার টাকা নেই, ব্যবসা করার মূলধন নেই। চাঁদাবাজ বা ছিনতাইকারী হয়ে যাওয়াই এসব তরুণের স্বাভাবিক পরিণতি। র‍্যাব-পূর্ব বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় শহরে চাঁদাবাজেরা নিজেদের মাঝে এলাকা ভাগ করে স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করে বেশ গুছিয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আদালত থেকে সহজেই জামিন নিয়ে আবার নিজেদের কাজে ফিরে আসতো। এলাকার দখল নিয়ে এই চাঁদাবাজদের নিজেদের মাঝে অন্তঃকলহ হতো এবং সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে খারাবিও হতো। এই নিজেদের মাঝে কলহ করে মারা যাওয়াটা professional hazard হিসাবে চাঁদাবাজেরা মেনেই নিয়েছিল। র‍্যাবের এই ক্রসফায়ারও অপরাধীদের কাছে আরেকটি professional hazard ছাড়া আর কিছুই নয়। পৃথিবীর কোথাও পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীকে এভাবে অবাধে মানুষ মারার লাইসেন্স দিয়ে অপরাধ নির্মূল করা যায়নি (অন্তত আমার জানা নেই)।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.