২০১১ সালের ২২শে মার্চ এমন একটি দিন যেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিজের গায়ে লেপটে থাকা বহু বছরের পুরনো একটি কালো দাগ মুছে ফেলে। শেক্সপিয়ার হয়তো এমন ব্যাপারগুলোকেই ‘আইরনি’ বলতেন। আর এভাবেই শেষ হল আমাদের আইনি লড়াই। এখন তবে শুরু হোক রাজনৈতিক লড়াই। দেখা হবে হয়তো পত্রিকার কলামে বা কোন ব্লগের রাজনৈতিক আলোচনায় অথবা কোন মিছিলে বা হাজারো মানুষের জনসভায়।[...]

আমি তখন অনেক ছোট। সম্ভবত ক্লাস ওয়ান বা টু তে পড়ি। আমি তখন আমার বাবা মা’র সাথে থাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবা সেই সময় বন্যা সহনশীল ধান নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একদিন একটি দাওয়াত থেকে বের হতে হতে দাওয়াতে উপস্থিত একজন ভারতীয় ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তুমি তোমার তাহের চাচার কথা জানো? জানো তিনি কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন?’ আমার বয়শ তখন পাঁচ কি ছয় বছর। তাহের চাচার কথা বাসায় শুনেছিলাম। কিন্তু ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে যা জানতে পেরেছি তা তো তখন জানার প্রশ্নই আসে না।

আমি তাকে হা-না কিছুই বলতে পারিনি। তবে মূলত সেই দিন থেকেই কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম) এর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। আমি আমার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তাহের নিয়ে শত ধরনের প্রশ্ন করতে থাকি। আমার মনে আছে বাবাকে করা অনেক প্রশ্নই ছিল বেশ অদ্ভুত ধরনের। বিদেশী স্কুলে তখন আমি ‘রেড ইন্ডিয়ান’দের গল্প নতুন নতুন শিখছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, তোমরা কি মুক্তিযুদ্ধের সময় তীর ধনুক ব্যবহার করতে?’ আরও কত কি জিজ্ঞেস করতাম। মনে পড়ে আরেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমরা কি যুদ্ধের সময় স্পীড-বোট ব্যবহার করতে?’। চলতে থাকে আমার এবং আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধ ও একই সাথে তাহের কে চেনার গল্প।

১৯৭১ সালের ১৪ই নভেম্বরে পাকিস্তানিদের শেলের আঘাতে পা হারানোর কিছুক্ষণ পরেই যখন আমার বাবা তাহেরের মুখে ফ্লাস্কে রাখা চা ঢেলে দিতে যাচ্ছিলেন, তাহের তখন কাপটি নিজ হাতে তুলে নেন এবং বাবাকে বলেন, ‘আমার হাত তো ঠিক আছে’। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন গল্প শুনলে যে কারোরই আগ্রহ প্রবলভাবে বাড়ারই কথা। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। ঠিক এভাবেই একদিন আমি জানতে পারি ১৯৭৬ সালে কিভাবে নির্দোষ কর্নেল তাহের কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। একজন ‘অপূর্ব’ মানুষকে নিজ চোখে দেখার সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হই এবং ’৭৬ পরবর্তী বাংলাদেশ বঞ্চিত হয় একজন প্রতিভাবান দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদ থেকে।

১৯৯৪ সালে আমরা বাংলাদেশ এ ফিরে আসি। আমার মনে আছে প্রতি বছর ২১শে জুলাই ও ৭ই নভেম্বর আমরা পুরো তাহের পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র অডিটোরিয়ামে যেতাম কর্নেল তাহের সংসদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করার জন্য। প্রায় প্রতি বছর এই দুটি দিনে আমি তাহেরের উপর আমার বাবা, প্রয়াত মেঝ চাঁচা আবু ইউসুফ খান (বীর বিক্রম) সহ বিভিন্ন মানুষের লেখা পত্রিকায় পড়তাম। আর সেই সুযোগে আমার জানা হয়ে যেত মুক্তিযুদ্ধে তাহেরের অবিস্মরণীয় অবদান, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক এবং সাধারণ সেনা অফিসার থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অর্থনীতির উপর বোঝা নয় এমন এক সেনাবাহিনী বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে তাহেরের বীরোচিত ফাঁসীর কথা। ফাঁসীর ঠিক আগ মুহূর্তে কেউই যখন তা কার্যকর করতে এগিয়ে আসছিল না, তাহের বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের এই সাহসটুকুও নেই?’। আমার পড়া হয়ে যায় মেজর আনোয়ার হোসেনের লেখা ‘হেল কমান্ডো’। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিজাত প্যারা-কমান্ডো গ্রুপ ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এস.এস. জি.)’ এর সিনিয়র অফিসার তাহের নতুন আগত মেজর আনোয়ারকে বলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কথা। তাহের এই কথাটি উচ্চারণ করেছিলেন সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় যখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরাও স্বাধীনতার কথা মুখে আনতেন না। আমি যখন আরেকটু বড় হই তখন নতুন করে লরেন্স লিফশুলজ ‘বাংলাদেশঃ দি আনফিনিশড রেভোলিউশান’ বইটি পড়ি। এই বইটির কপি বাংলাদেশে খুবই অল্প সংখ্যক লোকের কাছেই ছিল। তাহেরের কথা যাতে বাংলাদেশের মানুষ না জানতে পারে সেই লক্ষে জেনারেল জিয়া বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। লিফশুলজের বইয়ে তাহেরের ঐতিহাসিক জবানবন্দী আমি একদিন পড়ে ফেলি। আমি জানতে পারি পরবর্তীতে এই এস.এস.জি.’ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেফতার করে। তাহের তখন সেই সুদূর পাকিস্তানে কোয়েটার স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্সের প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলেন। পরে বাবার কাছে শুনেছি তার কিছুদিন আগেই এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে তাহের তার কলার চেপে ধরে হত্যা করার হুমকি দেন এবং বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন। তাই তাহেরের উপর তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের চরম নজরদারি নেমে আসে। তাহেরের জবানবন্দী থেকেই আমি পরিষ্কার ধারণা পাই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কি চোখে দেখত। সেখান থেকেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তাহের বলেন, ‘আমার এখনও মনে পড়ে পাকিস্তানিরা আমাদের কি পরিমাণ ঘৃণা করতো। তাদের অবজ্ঞা ও উপহাস ছিল অসহ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হতো বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকের জাতি। তাদের জন্ম হয়েছে গোলামী করার জন্য। বাঙালিদের পাক্কা মুসলমান ও দেশপ্রেমিক বানানো পাকিস্তানিদের পবিত্র দায়িত্ব’।

আমার মনে আছে, প্রতি বছর ২১শে জুলাই তাহের হত্যার বিচার চেয়ে হাইকোর্টের সামনে আমরা হাতে হাত ধরে দাঁড়াতাম মানববন্ধনে। সেখানে উপস্থিত মিডিয়া কর্মীরা সবসময় আমার ছোট বোন দামিনী, বিনীতা ও দীপান্বিতার প্ল্যাকার্ড হাতে ছবি পত্রিকায় ছাপাত, এই আশায় যে ছোট শিশুর আকুতিতে যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বোধোদয় হয় যে ১৯৭৬ সালের এই দিনে তাহেরের প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছিল। আমরা যখন ফজলুল হক হলের টিচার্স কোয়ার্টারে থাকি, জাসদ-ছাত্রলীগ এর মিছিল প্রায়ই আমাদের বাসার সামনে দিয়েই যেত। তাদের প্রধান দুটি স্লোগান ছিল, ‘ছিয়াত্তরের ক্ষুদিরাম তাহের তোমায় লাল সালাম’, ও ‘যে তাহের জনতার সে তাহের মরে নাই’। ফজলুল হক হলের ছোট ছোট চুপচাপ ওলিগলি দিয়ে বয়ে যাওয়া মিছিল আমাকে দারুনভাবে নাড়া দিত। বেশ মজাও লাগত যখন ছাত্ররা আমাদের বাসার ঠিক সামনে আসতেই স্লোগানের তীব্রতা বাড়িয়ে দিত। তাহেরের ভাই যে এই কোয়ার্টারে থাকেন এটি তাদের অজানা ছিল না। ঠিক যেন তারা আমাদের জানান দিচ্ছিল, ‘তাহেরের অনুসারীরা এখনো মরে যাইনি, তাহের হত্যার বিচার একদিন হবেই, তাহেরের স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবেই’। আমার নিজেকে তখন শক্তিশালী মনে হতো, মনের ভেতর সঞ্চারিত হতো তখন অনেক সাহস। নিজেকে বলতাম সত্যের জয়কে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। জিয়া যে তাহের কে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিলেন সেই সত্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে একদিন প্রকাশিত হবেই। পরবর্তীতে তাহেরের জবানবন্দী আমি অসংখ্যবার পড়েছি। জবানবন্দী প্রদানের শেষ প্রান্তে এসে তাহের বলেন, ‘আমি একজন অনুগত নাগরিক নই বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একজন মানুষ যে তার রক্ত ঝরিয়েছে, নিজের দেহের একটা অঙ্গ পর্যন্ত হারিয়েছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তার কাছ থেকে আর কি আনুগত্য তোমরা চাও? আর কোনভাবে এদেশের প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করবো? আমাদের সীমান্তকে মুক্ত রাখতে, সশস্ত্র বাহিনীর স্থান আর জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখবার ইচ্ছায় ঐতিহাসিক সিপাহি অভ্যুত্থান পরিচালনা করতে যে পঙ্গু লোকটি নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছিল তার কাছ থেকে আর কি বিশেষ আনুগত্য তোমাদের পাওনা?’। এই কথাগুলো পড়লে প্রতিবারই আমার চোখে পানি চলে আসতো।

শুধুমাত্র তাহের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে নয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও আমি অনুভব করতে থাকি তাহের হত্যার বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা। আমার মাথায় বুদ্ধি আসে যে নিজে আইন পড়ে তাহের হত্যার বিচার করবো। একদিন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর শিক্ষক এবং পরবর্তীতে ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ উপন্যাসটির লেখক ড. শাহাদুজ্জামান। বাসায় তাহের চাচার ছেলে মিশুও উপস্থিত ছিল। আমার ’ল পড়বার ইচ্ছার কথা শুনে তারা আমাকে ড.শাহদীন মালিকের কথা বলেন। সেভাবেই আমি এবং আমার বাবা ২০০৫ সালের একটি দিনে উপস্থিত হই ড.শাহদীন মালিকের সেগুনবাগিচার চেম্বারে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে বাবা ড.মালিককে সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের কিছু লফটি আইডিয়ালস আছে। ও ’ল পড়তে চায় ওর চাচার হত্যার বিচার করার জন্য’। শুধুমাত্র শাহদীন স্যারের কারনেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ’ল তে আমি ভর্তি হই। ’ল স্কুলে স্যার আমাদের প্রথম প্রবন্ধের বিষয় দিয়েছিলেন, ‘ওয়েয়ার আই ওয়ান্ট টু বি ইন দি নেক্সট ফিফটিন ইয়ারস’। সেখানেও আমি উল্লেখ করি তাহের হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় আমার অবদান রাখার ইচ্ছার কথা। বেশ কিছু বই পড়ে আমি তাহেরের পক্ষে আইনি যুক্তিও সেই প্রবন্ধে উপস্থাপন করি। প্রবন্ধে শাহদীন স্যার আমাকে ‘এ’ গ্রেড দিয়েছিলেন। এতে আমার অনুপ্রেরণা আর বহুগুণ বেড়ে যায়। আজকে যখন ২০০৫ সালের ঐসব দিনের কথা মনে করি আমার মনে একফোঁটাও দ্বিধা হয় না এই ভেবে যে কেন সরাসরি ব্র্যাকে এসেছিলাম ’ল পড়তে। ব্র্যাকে না এলে শাহদীন স্যার সহ আর বহু গুণীজন ও বন্ধুর সংস্পর্শে আমার আসা হতো না। হয়তো ২০১০ সালে এসে স্যারের সাথে ’৭৬ সালে তাহেরের বিচার প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করা রিট লেখার সুবর্ণ সুযোগও পেতাম না।

’ল পড়াকালীন সময়েই আমি ‘অধিকার’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এ কাজ করার সুযোগ পাই। সেখানে কাজ করতে গিয়েই আমার সামনে উন্মোচিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক অতি ভয়ানক রূপ। প্রধানত র‍্যাবের মাধ্যমে রাষ্ট্র কি করে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছিল, তা এই দুটি সংস্থায় কাজ করার সময় আমার জানা হয়ে যায়। ক্রসফায়ারের একেকটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট পড়ে আমার শুধু একটি কথাই মনে হতো। তাহেরও তো এমনই বিচারবহির্ভূত ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তাঁকে হয়ত গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি, তবে যেই বিচার ১৯৭৬ সালে করা হয়েছিল তা কি প্রকৃত বিচার ছিল? মোটেই তা ছিল না। ১৯৭৬ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল এর প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণভাবে সাজানো একটি নাটক, যাকে আমরা বলি বিচারের নামে প্রহসন।

২০১০ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের অন্যতম কালো আইন বলে পরিচিত পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে। তখন অনেকটা হঠাৎ করেই আমাদের সামনে হাই কোর্টের দুয়ার খুলে যায় তাহের হত্যার বিচার চাওয়ার জন্য। গত ৩৪ বছর ধরে এই পঞ্চম সংশোধনীই ছিল আমাদের আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বাঁধা। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে অবগত নন যে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত তখনকার মার্শাল ’ল অথরিটি দ্বারা জারিকৃত সকল ফরমান, আদেশ, নির্দেশ, বিধি ইত্যাদিকে বৈধতা প্রদান করেন। একই সাথে সেই সংশোধনীতে এও বলা হয় যে কোন কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল বা অথরিটির কাছে ওগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এখানে উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরকে বিচার করার জন্য ১৯৭৬ সালের ১৪ই জুন একটি মার্শাল ’ল রেগুলেশান, যার নাম ছিল মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬, জারি করা হয়। এই রেগুলেশানটির মাধ্যমেই সেই কুখ্যাত স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় যেটি তাহেরকে ১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই ফাঁসীর রায় দেয়। ফলে গত ৩৪ বছর ধরে তাহেরের পরিবার এবং অনুসারীগণ পঞ্চম সংশোধনীর কারনে মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬’র এবং সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। তাই গত বছর পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়ে গেলে আমাদের বহু বছরের প্রতীক্ষার সমাপ্তি ঘটে। প্রথমেই এগিয়ে আসেন আমার বাবা। মহামান্য হাই কোর্টের কাছে কর্নেল তাহেরের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট পিটিশান পেশ করার ভাবনা তিনি আমার সাথে আলোচনা করেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম যে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণের উপযুক্ত সময় এখনি। ঠিক সেই ২০০৫ সালের মত আবারো আমি এবং বাবা রওনা দিলাম শাহদীন স্যারের চেম্বারে। এবার তাঁর কাছে তুলে ধরলাম আমাদের এই চিন্তার কথাটি। ঠিক হল রিট পিটিশানে বাদী আমার বাবা, তাহের চাচার স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং আমার প্রয়াত মেঝো চাচার স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ। বাবা শাহদীন স্যারকে বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ার অনুরোধ করলে স্যারও সানন্দে রাজি হয়ে যান। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে মামলার জন্য যাবতীয় আইনি গবেষণার কাজের বেলায় আমি স্যারকে সাহায্য করব। সেদিন আমরা খুবি স্ট্র্যাটেজিক একটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। ঠিক হয় যে মামলায় আমরা কোন প্রকার রাজনৈতিক তথ্য উপস্থাপন করব না। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার পেছনে একটি বিশ্বাস আমাদের মনের মধ্যে কাজ করছিলো। বিশ্বাসটি ছিল এই যে আদালত হচ্ছে আইনি বিরোধ নিষ্পত্তির জায়গা। এটি রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির জায়গা নয়। রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান হওয়া উচিত রাজনৈতিক যুক্তিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে যা প্রতিদিনই ঘটছে পত্রিকার কলামে, রাস্তার মিছিলে বা জনসভায়। কোর্টের কাছে আমরা তাহেরের রাজনীতি ও তা নিয়ে দৈনন্দিন বিতর্কের অবসান চাচ্ছিলাম না, বরং আমরা চাচ্ছিলাম তার বিচারের বৈধতা নিয়ে বিতর্কের অবসান।

বলতে গেলে তখন থেকেই শুরু হয় স্যারের সাথে আমার রিট পিটিশান তৈরির দিন রাত প্রচেষ্টা। স্যারের সাথে এই রিট পিটিশান লেখার সুবাদে দুই মাস আমি তাঁর একদম কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ পাই। প্রায় প্রতিদিন গবেষণা শেষে স্যার আমাকে বসতে দিতেন তাঁর ঐতিহাসিক রিভলভিং চেয়ারে। আমাদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত নতুন নতুন তথ্য স্যার ডিক্টেশান আকারে বলে যেতেন এবং আমি তাঁর রিভলভিং চেয়ারে বসে কম্পিউটারে তা টাইপ করতাম। এ ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি! তবে আমার এই অনুভূতি খুব অল্পসংখ্যক মানুষের সাথে শেয়ার করেতে পেরেছিলাম কারন রিটের প্রস্তুতির কথা আমরা কাউকেই জানাইনি। এমনকি আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরাও এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ইচ্ছা করেই আমরা জানাইনি। আমাদের কোন ধারনা ছিলোনা এই রিট পিটিশান দায়ের করলে কি হবে বা কত দিন পর আমরা রায় পাব। তাই ৩৪ বছর ধরে অপেক্ষা করা একটি পরিবারের মনে আমরা এমন কোন আশা জাগাতে চাচ্ছিলাম না যেই গল্পের শেষ আমাদের সেই মুহূর্তে অজানা ছিল। গোপনীয়তা রক্ষার আরেকটি বড় কারন ছিল যে এই মামলার প্রস্তুতির সম্পর্কে স্বাধীনতাবিরোধী যেকোনো পক্ষ আগাম আভাস পেলে আমাদের প্রচেষ্টা ভেস্তে যাওয়ার একটি সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

বাকি ইতিহাসটা তো মোটামুটি আপনাদের জানাই আছে। গত বছর আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে আমরা মহামান্য বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চে আমাদের দুই মাসের চেষ্টার ফল, সেই রিট পিটিশানটি দায়ের করি। সেদিনই রুল ইস্যু হয় এই মর্মে যে কেন মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ ও একই সাথে সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরের বিচারকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না। এটি ছিল আমাদের জন্য একটি বিরাট সাফল্য কারন আদৌ রুল ইস্যু হবে কিনা তা নিয়েই আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। আমাদের শুধুমাত্র একটিই ভয় ছিল যে না জানি কখন কথা থেকে কোন হস্তক্ষেপ এসে পরে। রুল ইস্যু হওয়ার পর স্যার আমাকে মজা করে বলেন, ‘সানজীব, আপনি যেই কারনে ’ল পড়তে এসেছিলেন তা তো আজকে মোটামুটি সার্থক হয়ে গেল। আপনি বরং তাহলে এখন অন্য কোন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন’। এখানে বলে রাখা দরকার শাহদীন স্যার তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন। এরপর চলতে থাকে আমাদের মামলার শুনানি। গত মার্চ মাসের ২২ তারিখে তাহের পরিবার এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সকল মানুষ তাদের বহুল প্রতীক্ষিত রায় পান। মহামান্য বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী কর্নেল তাহেরের বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন যে ১৯৭৬ সালের স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল বা বিশেষ সামরিক আদালতের বিচার ছিল লোক দেখানো প্রহসন এবং কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় একটি পরিকল্পিত হত্যা। রায়ে এও বলা হয় যে কর্নেল তাহেরের হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।

কেন তাহেরের বিচারটি অবৈধ ঘোষণা করা হল? এটিকে বিচারের নামে প্রহসন আখ্যায়িত করা হল কেন? কি ছিল আইনি যুক্তিগুলো? সেগুলোই এখন সহজ ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করব।

১) প্রথমেই বলি তাহেরের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার এফআইআর নং ৮ এ কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১এ’র অধীনে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়, যার মানে এই দাড়ায় যে রাষ্ট্রপক্ষের চেষ্টা ছিল প্রমাণ করা যে তাহের তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্রচেষ্টার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। দণ্ডবিধির ১২১এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যে এর সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড নয়। অনেকেই বলেন যে যেহেতু তাহের সেনা কর্মকর্তা তাঁকে আর্মি এ্যাক্ট ১৯৫২’র অধীনে বিচার করে ফাঁসিও দেয়া যেত। এই ধারনাটি সম্পূর্ণভাবে ভুল। কর্নেল তাহের ১৯৭২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক ঐতিহাসিক পদত্যাগপত্র পেশ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহন করেন। ফলে তাহেরের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালে আর্মি এ্যাক্ট ১৯৫২ অথবা অন্য কোন সেনা আইনের অধীনে বিচার করা সম্ভব ছিল না কারন তার প্রায় ৪ বছর আগেই তাহের সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিলেন। সেনা আইন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারনে তাহেরের মামলায় প্রযোজ্য ছিল না। তাহেরকে বিচার করার জন্য গঠিত স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনালের দুইজন সদস্য ছিলেন সিভিলিয়ান ম্যাজিস্ট্রেট। তারা সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন না এবং তাই তাদের পক্ষে কোন সেনা ‘প্রসিডিং’ এ অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা ছিল না। ফলে যারা ভেবেছিলেন যে তাহেরের মামলা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৫ দ্বারা প্রটেক্টেড এবং এটি একটি ‘মিলিটারি প্রসিডিং’ তারা ভুল ভেবেছিলেন। আজকে যারা তাহেরের বিরুদ্ধে সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগ আনেন তারা ভুলে যান যে সেনা অফিসার হত্যার অভিযোগ সেই ১৯৭৬ সালেও তাহেরের বিরুদ্ধে আনা হয়নি। অথচ তখনকার সরকার ছিল অনেক বেশি আগ্রাসী ও হিংস্র। যত রকমের অভিযোগ আনা সম্ভব তাই তাহেরের বিরুদ্ধে দাড় করানোর চেষ্টা নেয়া হয়েছিল। ফলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ও তার পরে যেই অল্পসংখ্যক সেনা অফিসার মারা গিয়েছিলেন তাদের কাউকেই যে তাহেরের নির্দেশে হত্যা করা হয়নি, এটা তখনকার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা খুব ভালো করেই জানতেন। তাহের তার অনুগত সিপাহিদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যে কাউকে হত্যা করা যাবে না। সিপাহিরা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। এমনকি খালেদ মোশাররফ কেও কিন্তু তাহেরের সিপাহিরা হত্যা করেনি। খালেদ, হুদা এবং হায়দার কে হত্যা করে তাদেরই মত সেনা অফিসার যারা তাহেরের অধিনে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরপরই সেই সব অফিসার খালেদের লাশ জিয়াউর রহমানের কাছে নিয়ে আসেন, তাহেরের কাছে নয়। এই বিষয়ে প্রয়াত কর্নেল হামিদ তার বই ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ তে বর্ণনা দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১এ’ই ছিল তাহেরের বিরুদ্ধে আনিত একমাত্র অভিযোগ।

২) মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ নানা কারনেই অসাংবিধানিক ও অবৈধ। প্রথমত আমরা যদি আমাদের সংবিধানের দিকে তাকাই তাহলেই দেখতে পাই যে সেখানে কোন ধরনের মার্শাল ’ল রেগুলেশান জারি করার বিধান নেই। ফলে সহজ ভাষায় বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের সংবিধানের অধীনে কোন প্রকার মার্শাল ’ল রেগুলেশান জারি করা যায় না। তাই ১৯৭৬ সালে জারি করা মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ ছিল সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবহির্ভূত এবং অবৈধ এবং সেই রেগুলেশানের অধীনে তাহেরকে বিচার করার জন্য গঠিত স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনালও ছিল সংবিধানবহির্ভূত এবং অবৈধ কারন এমন কোন ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা আমাদের সংবিধানে নেই।

৩) ১ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখিত এফআইআরের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে জুন মাসের ১৪ তারিখে অসাংবিধানিকভাবে জারি হয় মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ যার ৩(১) ধারার উপর নির্ভর করে একটি অবৈধ স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কর্নেল তাহেরের মামলাটি ছিল ১৯৭৬ সালের স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল কেস নং ১। বলে রাখা প্রয়োজন এই মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনালকে বিশেষ কিছু ক্ষমতা প্রদান করে। সেগুলো ছিলঃ
– ধারা ৩(৪)’র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে তার গঠিত হওয়ার আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়।
– ধারা ৩(৪)(ক)’র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে দণ্ডবিধির চ্যাপ্টার ৬ ও ৭ এর অধীনে সকল অপরাধ বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়।
– ধারা ৪(২)’র অধীনে ট্রাইব্যুনালকে ‘ইন ক্যামেরা’ অর্থাৎ গোপনে বসার ক্ষমতা দেয়। ঢাকা সেনট্রাল জেলের ভেতরে একটি ‘ইন ক্যামেরা’ গোপন বিচার পরিচালনা করা (যেমনটি তাহেরের বেলায় হয়েছিল) পুরোপুরিভাবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩)’র সাথে সাংঘর্ষিক।
– ধারা ৪(৮) এ বলা হয় যে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের কোন সুযোগ থাকবে না। এই ধারাটি সুস্পষ্টভাবে তাহেরকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আপীল করতে বাঁধা দেয় যা আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা সকলেই জানি যেকোনো সভ্য দেশে রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের বিধান থাকে। আমাদের দেশেও সকল অভিযুক্ত ব্যক্তি আপীলের সুযোগ পান, যেটি তাহের পাননি।
– ধারা ৪(১০)’র অধীনে বলা হয় যে মামলায় অংশগ্রহণকারী যেকোনো ব্যক্তিকে মামলার বিষয়বস্তুর ব্যাপারে একটি ‘ওথ অফ সিক্রেসি’ অর্থাৎ ‘গোপনীয়তা রক্ষার শপথ’ নিতে হবে। কেউ এই শপথ ভঙ্গ করলে তাঁকে শাস্তিস্বরূপ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড প্রদানের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেয়া হয়। এমন বিধান দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে তাহের এমন কি বলেছিলেন বা ঐ মামলায় এমন কি ঘটেছিল যে মামলার সাথে জড়িত সকলকে গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নিতে হয়েছিল? তাহেরের জবানবন্দীতে একটু চোখ বুলালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। তাহের বলেন, ‘… আমি ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করেছিলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়ার. অ্যাডমিরাল এম.এইচ. খান, এয়ার ভাইস. মার্শাল এম. জি. তাওয়াব, জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী ও বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করার জন্য। তারা যদি এখানে আসতেন, ট্রাইব্যুনালের যদি ক্ষমতা থাকতো এখানে আনার তাহলে আমি নিশ্চিন্ত যে তারা এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে’। সত্যিকার অর্থেই ট্রাইব্যুনাল তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। জিয়া থেকে শুরু করে সায়েম পর্যন্ত কেউই ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে তাহেরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহস পাননি।

এইসব বিধান দেখে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় যে, সেই সময়কার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাহেরের বিরুদ্ধে মামলাটির ব্যাপারে দেশবাসীকে কিছু না জানিয়ে, গোপনে, আপীলের কোন সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে সমাপ্ত করার ব্যবস্থা মার্শাল ’ল রেগুলেশান নং ১৬ জারি করার মাধ্যমে পাকাপোক্ত করেছিলেন। লিফশুলজের বই তে পড়েছি কিভাবে ইত্তেফাকের সম্পাদককে সেনা কর্তৃপক্ষ ডেকে হুমকি দিয়েছিল যখন তাহেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার খবরটি তার পত্রিকায় ছোট্ট করে ছাপানো হয়েছিল। স্বামীর ফাঁসি ঠেকাতে আমার চাচী লুৎফা তাহের যখন সরকারের প্রতি ‘স্টে অফ একজিকিউশান’ এর আবেদন জানান, অত্যন্ত অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে মাত্র দুইদিনের মাথায় আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। রায় ঘোষণার ৭২ ঘন্টার মাথায় অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা ছিল সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

৪) আগেই বলেছি দণ্ডবিধির ১২১এ ধারার অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তাই কার্যত ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই তাহেরকে এমন একটি আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল যেখানে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়াটাই অসম্ভব ছিল। কোন আইনের তোয়াক্কা না করে ১২১এ’র অধীনে ফাঁসি দেয়া ছিল আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(১) এর জঘন্য লঙ্ঘন।

১৯৭৬ সালের ১৭ই জুলাই যখন তাহেরের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়, সবচেয়ে অবাক হন রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি এ.টি.এম আফজাল (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি)। তার মতে এমন শাস্তি দেয়া ছিল অসম্ভব। মামলার রায়ের ব্যাপারে যখন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের মন্তব্য চাওয়া হয়, তিনি কোন প্রকার মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের কোন স্বাভাবিক মানুষ এই মামলার রায় মেনে নেয়নি। এই মামলায় বহু দুঃখজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে আরেকটি ছিল যে স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার (পরবর্তীতে তাহের হত্যার পেছনে অবদান রাখার জন্য জিয়াউর রহমান তাকে ব্রিগেডিয়ার পদে পদন্নোতি দেন) যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছিলেন।

আশা করি কিছুটা হলেও কর্নেল (অব) আবু তাহের (বীর উত্তম) এর বিচার প্রক্রিয়ার চরম আইনি অসঙ্গতিগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি এবং মহামান্য হাইকোর্ট কেন সেই বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করলো তা বোঝাতে পেরেছি। ১৯৭৬ সালের ঘটনাবলির দিকে ফিরে তাকালে আমার মনে হয় কিরকম অন্ধকারে ঢাকা ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ পার হয়েছে। তাহেরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন। এর পর তো ঘটে গেছে আর জিয়া কর্তৃক শত শত সিপাহি হত্যা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। আমাদের লেখা রিট পিটিশানটিতে যদিও কোন রাজনৈতিক আলোচনা ছিল না ২০১১ সালের ২২ শে মার্চের ঐতিহাসিক রায়ের মধ্যেই কিন্তু লুকায়িত আছে রাজনৈতিক তত্ত্বের দিক থেকে একটি দারুন তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। সেটি বলেই আজকে লেখাটি শেষ করি। তাহের ছিলেন একজন ‘বিপ্লবী’। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি বিপ্লবী রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ অবশ্য এখনো সেই শোষণহীন বিপ্লবী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু অবিপ্লবী হয়েও আমাদের অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম অবিপ্লবী স্তম্ভ ‘হাইকোর্ট’ ৩৪ বছর পরে হলেও একজন খাটি বিপ্লবীর প্রতি করা চরম অবিচারের কথা স্বীকার করেছে। এখানেই প্রকাশ পায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ‘মহানুভবতা’। যেই দেশ এমন মহানুভবতা দেখাতে কার্পণ্য করে না, সেই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? আজ হোক কাল হোক তাহেরের চেতনার বাস্তবায়ন বাংলার বুকে হবেই। যেই দেশের জন্য তাহের নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে নেমেছিলেন সেই দেশ এতদিন তাহেরকে বলে এসেছিলো বেইমান। এমন একটি ব্যাপার কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। তাই এই রায়ের মধ্য দিয়ে আমরা তাহেরের পরিবার অবশ্যই এক ধরণের শান্তনা খুঁজে পেয়েছি, যদিও আমাদের মনে এবং হৃদয়ে তাহের চিরকালই একজন বীর ছিলেন। আমার মতে এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাহেরের পরিবার যত না পেল, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কথাটি অদ্ভুত শোনালেও ২০১১ সালের ২২শে মার্চ এমন একটি দিন যেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার চরম মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের গায়ে লেপটে থাকা বহু বছরের পুরনো একটি কালো দাগ মুছে ফেলে। শেক্সপিয়ার হয়তো এমন ব্যাপারগুলোকেই ‘আইরনি’ বলতেন। আর এভাবেই শেষ হল আমাদের আইনি লড়াই। এখন তবে শুরু হোক রাজনৈতিক লড়াই। দেখা হবে হয়তো পত্রিকার কলামে বা কোন ব্লগের রাজনৈতিক আলোচনায় অথবা কোন মিছিলে বা হাজারো মানুষের জনসভায়।

এম সানজীব হোসেন

১৯৮৫ সালের ১ এপ্রিল জাপানের কিয়োটো শহরে জন্মগ্রহণ করি। বর্তমানে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের সাহায্যে যুক্তরাজ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ক্রিমিনলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ে এমএসসি সম্পন্ন করেছি। কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটরের রিসার্চার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) ও একাত্তর বাংলাদেশ-এর সদস্য এবং কর্নেল তাহের সংসদ-এর গবেষণা সম্পাদক।

২১ comments

  1. এহসানুল কবির - ২৫ এপ্রিল ২০১১ (২:২৬ পূর্বাহ্ণ)

    লেখাটা একবারমাত্র পড়লাম; আরও অনেকবার পড়তে হবে, নানা কারণে, নানা প্রসঙ্গে। “আমার মাথায় বুদ্ধি আসে যে নিজে আইন পড়ে তাহের হত্যার বিচার করবো” এই কথাটা যখন পড়ছিলাম, তখন ভাবছিলাম শিশুকালে বাবার কাছে “আচ্ছা, তোমরা কি মুক্তিযুদ্ধের সময় তীর ধনুক ব্যবহার করতে?”-ধরনের প্রশ্ন করা ছেলেটাতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বয়সে পৌঁছেও খুব একটা বড় হয় নি! কিন্তু কয়েক অনুচ্ছেদ এগোতেই মারাত্মক সেই ভুলটা ভাঙলো। শেষ পর্যন্ত দেখলাম সে বিদ্যা-বুদ্ধি-চেতনায়-মননে এত বড় হয়েছে যে, শুধু তাহের হত্যার বিচার পেয়েই সে তার লড়াইয়ের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে বলে ধরে নেয় নি; বরং জাতীয় বীর তাহেরের রাজনৈতিক আদর্শের অনুসরণে এদেশটাকে একটা শোষণহীন বিপ্লবী রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রামে অংশ নেওয়াটাকে সে তার পরবর্তী কর্তব্য বলে ঠিক করেছে।

    সানজীব, আপনাকে লাল সালাম, কমরেড!

    “দেখা হবে হয়তো পত্রিকার কলামে বা কোন ব্লগের রাজনৈতিক আলোচনায় অথবা কোন মিছিলে বা হাজারো মানুষের জনসভায়।”

    • এম সানজীব হোসেন - ২৫ এপ্রিল ২০১১ (১০:৪১ অপরাহ্ণ)

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. রায়হান রশিদ - ২৫ এপ্রিল ২০১১ (৫:৪৫ অপরাহ্ণ)

    হাইকোর্টের এই রায় এবং এর আইনগত দিক নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন আলোচনায় অনেক বিভ্রান্তি চোখে পড়েছে। এই লেখাটার দরকার ছিল। ধন্যবাদ সানজীব।

    • এম সানজীব হোসেন - ২৫ এপ্রিল ২০১১ (১০:৪৯ অপরাহ্ণ)

      আপনাকেও ধন্যবাদ রায়হান ভাই। রায় এর কপি হাতে এলে সেটাকেও পর্যালোচনা করা যাবে। আপাতত (গভীরভাবে চিন্তা না করে) আমার মনে হচ্ছে এই রায়টিকে ‘ক্রসফায়ার’ ঠেকানোর ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। দেখা যাক।

      • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৯ এপ্রিল ২০১১ (১২:৫৫ অপরাহ্ণ)

        এর মাধ্যমে কী করে ক্রসফায়ার ঠেকানো যাবে তা বিস্তৃতভাবে জানালে ভালো হতো। তাহের কি ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন? রায়ের কোনো জায়গায় কি ক্রসফায়ারকে যুক্ত করা হয়েছে? আর রায় দিয়ে কি আন্দোলন-সংগ্রাম হয়? বুর্জোয়া সংগঠনের প্রধানতম কাজই হচ্ছে, আইন-আদালত দিয়ে মানুষের জাগরণকে থামিয়ে রাখা।

  3. নীড় সন্ধানী - ২৫ এপ্রিল ২০১১ (১১:২৪ অপরাহ্ণ)

    তাহের সম্পর্কে হেল কমান্ডো বইটাতে কিছু চমকপ্রদ তথ্য ছিল যা অন্য কোথাও পাইনি। তাহেরের রাজনৈতিক দর্শন বা প্রক্রিয়ার সাথে অনেকের দ্বিমত থাকলেও, তাঁর সাথে প্রতারণা করেই যে জিয়া তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার এই লেখাটি তাহেরকে এবং তার প্রহসনমূলক বিচারের অন্যায্যতাকে বোঝার ক্ষেত্রে দারুণ সাহায্য করেছে।

  4. ফিরোজ আহমেদ - ২৭ এপ্রিল ২০১১ (৭:০৯ অপরাহ্ণ)

    লেখাটা তাহের-হত্যার আইনী দিক নিয়ে অনেকগুলো বিভ্রান্তির অবসান ঘটাবে।

    তারও চেয়ে বড় বিষয়, তাহেরের ওপর যে সেনাকর্তা-হত্যার দায়ভার চাপানো হয়, সেটারো নিরসণ ঘটাবে।

    কিন্তু আশ্চর্য হলাম, বিচার-পূর্ববর্তী সময়ে তাহেরের জীবন ও কর্ম আলোচনা করতে গিয়ে তাহের কিভাবে সেনাবাহিনী থেকে বাতিল মালে পরিনত হলেন, কি করে তার মত দেশপ্রেমিক মহান ব্যক্তিত্বরা দৃশ্যপটের পাশে স্থান পেলেন, আর গোটা দেশটাই লুটেরাদের হাতে চলে গেল, আরো বহু কিছুর সাথে সেই প্রসঙ্গটা আসল না। না, আশ্চর্য হবার হয়তো কিছু নাই, পুরো বিষয়টা তাহেরের আদর্শ বাস্তবায়ন করার বদলে যদি কেবল তাহের-হত্যার বিচারে কেবল পর্যবসিত হয়, তবে তো তা কেবল প্রতিশোধস্পৃহা। তাতে রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ অনেক বেশি প্রাধান্য পাবে, আদর্শ সঙ্গতকারণেই গৌণ হয়ে যাবে।

    মুজিবর রহমানের নিন্দা করায় তাহেরের আরেক পাকিস্তানী কর্মকর্তাকে হত্যা করার হুমকি প্রদানটা সম্ভবত অতিরঞ্জন, এটা কি সম্ভব সামরিক বাহিনীতে? কোর্টমার্শাল হয়ে যাবার কথা। মেজর মঞ্জুর সাহেবের অসাধারণ বইটাতে মনে পড়ে না এমন কোন বর্ণনা আছে। তবে তার সাহস আর স্পর্ধা আর স্বপ্নের যে বর্ণনা হেলকমান্ডেতে আছে, তা থেকে জাতির নায়ককে চিনে নিতে কষ্ট হয় না।

    জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকেষ করেছিলেন, তার হিসাব নিকেষ নিতেই হবে। কিন্তু হাজার হাজার বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ৭৫ সালের আগেই খুন হওয়া, গৌণ হওয়া, প্রান্তিক হওয়ার হিসাব-নিকাশ তাহেরকে জাসদে উদ্ধুদ্ধ করেছিল, জাসদ, তাহের পরিবারের কেউ কেউ, আর আরও অনেকেই সেই কথাগুলোকে আড়াল করার প্রাণপণে যে চেষ্টা করে আসছেন, সেটাও তাহেরের স্মৃতির জন্য কম লজ্জাজনক না।

    হাবীব ভাইকে ধন্যবাদ, লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার করার জন্য। অনেক ভাল একটা লেখা। লেখককেও ধন্যবাদ, আইনগত অনেকগুলো দিক পরিস্কার করার জন্য।

    • মাসুদ করিম - ২৮ এপ্রিল ২০১১ (৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ)

      পুরো বিষয়টা তাহেরের আদর্শ বাস্তবায়ন করার বদলে যদি কেবল তাহের-হত্যার বিচারে কেবল পর্যবসিত হয়, তবে তো তা কেবল প্রতিশোধস্পৃহা। তাতে রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ অনেক বেশি প্রাধান্য পাবে, আদর্শ সঙ্গতকারণেই গৌণ হয়ে যাবে।

      হত্যার বিচার প্রতিশোধস্পৃহা?

      • ফিরোজ আহমেদ - ২৮ এপ্রিল ২০১১ (১২:৪৩ অপরাহ্ণ)

        দেখা যাচ্ছে মাসুদ সাহেব ভালভাবে আমার কথাটাকে মালুম করেন নাই, তাই ‘হত্যার বিচার প্রতিশোধস্পৃহা’এই সারসংক্ষেপ করেছেন,এবং মাসুদ সাহেবের বিষয়ে পূর্বধারণা যা আছে, তাতে এটা অস্বাভাবিক ঠেকেনি। ধরে নিচ্ছি যে কোন বিবেচক পাঠক আমার বক্তব্যটুকু একবার পাঠেই আমার কথার সারবস্তুটুকু বুঝে নিতে পারবেন, তারপরো প্রশ্নটা যখন উঠলই, একটু ব্যাখ্যা করে রাখা নিরাপদ।

        যে কোন হত্যার বিচারেই প্রতিশোধস্পৃহা আছে। আইনীবিচার হল আইনসঙ্গত প্রতিশোধগ্রহণ। ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ তাই বেআইনীও বটে।

        কিন্তু তাহের হত্যা তো কোন বাজারি আট-দশটা খুন না। টাকাপয়সা, সম্পত্তির দ্বন্দ্বে তিনি হত হন নাই। একটা আদর্শের প্রতি ভীত হয়ে শত্রুরা তাকে হত্যা করেছে। সেই আদর্শটা কি?

        বর্তমান নিবন্ধটির লেখক, জানা গেল তিনি কর্নেল তাহেরের ভ্রাতুষ্পুত্র, তাহেরের একাত্তর ও একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ের ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রভূত আলোচনা করলেও ৭২-৭৫ সময়টুকু বাদ দিয়েছেন। যে তাহেরকে আমরা চিনি, যিনি ৭১ এর বহু আগে মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, তার সেনাবাহিনী হতে অপসারণ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবেশ, বিদ্রোহে নেতৃত্বদান এই প্রসঙ্গগুলোকে কেন লেখক আলোচনায় আনেননি, আমার প্রশ্ন ছিল সেটুকুই। আর আমি নিজের কাছে গ্রহণযোগ্য উত্তরটাও বলে রেখেছি, তাহের অনুসারী বলে পরিচিত বড় অংশটাই আজকে আসলে তাহেরের আদর্শ-বিচ্ছিন্ন একটা বীরপুজারী অংশ। ফলে তাহেরের জীবনের এই অস্বস্তিকর অংশটাকে ঢেকে রাখাটা, সচেতন বা অচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। এবং সেই বিচারে তাহের হত্যাকাণ্ডের আইনসঙ্গত প্রতিশোধ গ্রহণ করা হলেও তাহেরের যে আদর্শ, সেটাকে চাপা দেয়া হয় এই অনুল্লেখে।

        ক্ষতি নাই, মুজিব, জিয়া, তাহের বা যে কোন হত্যাকাণ্ডের আইনী-বিচার সম্পন্ন করা হলে। খুনী নিজে যেহেতু শাস্তি ডেকে আনে,তাই সকল খুনেরই বিচার অত্যাবশ্যক। কিন্তু তাহেরের জন্য লজ্জার, যদি তাহেরের জীবন কর্ম নিয়া কোন আলোচনায় তার জীবনের গূরুত্বপূর্ণতম একটা অধ্যায় অন্ধকারে ঢাকা হয়। আর কিছুই বলতে চাওয়া হয় নাই, জনাব মাসুদ করিম।

        • মাসুদ করিম - ২৮ এপ্রিল ২০১১ (১:৩১ অপরাহ্ণ)

          না, আপনার বক্তব্য বুঝতে পেরেছি। শুধু ‘প্রতিশোধস্পৃহা’ নিয়ে আপত্তি ছিল তাই শুধু সেটাকেই হাইলাইট করেছি।

          • ফিরোজ আহমেদ - ২৮ এপ্রিল ২০১১ (১:৪২ অপরাহ্ণ)

            প্রতিশোধস্পৃহা নিয়া আপত্তির কারণ দেখি না। প্রতিশোধস্পৃহাকে একতরফা খারাপ অর্থেও দেখার কিছু নাই।

            একটা আইনী সমাজে প্রতিশোধ নেয় রাষ্ট্র, তাই যে কোন অপরাধবিষয়ক মামলায় রাষ্ট্র থাকে বাদী। এইখানে প্রতিশোধটাকে রাষ্ট্র আইনসঙ্গত করে শুধু।

            আইন কার্যকর না থাকলে প্রতিশোধটা নেয় ব্যক্তি, তার আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন। প্রতিশোধস্পৃহার মাঝে ইনহেরেন্ট খারাপ কিছু নাই।

            কে কার কোন বিষয়ে প্রতিশোধ নিতে চায়, ব্যক্তি বড়জোর তার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে।

            আমি খালি বলতে চাইছি যে তাহের হ্যত্যার প্রতিশোধে বিষয়টারে রিডিউস করা হলে আদর্শটা চাপা পড়ে যায়। এই লেখাটাতে তাই করা হয়েছে। প্রতিশোধ তো চাই-ই বটে, কিন্তু সেইটা খণ্ডাংশ মোটে। বর্তমান লেখাটাতে সেই আদর্শটারই অনুপস্থিতি দেখা গেছে। সেই কারণেই ৭২-৭৫ এর ইতিহাস চাপা পড়ে গেল।

  5. কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ২৯ এপ্রিল ২০১১ (১০:২৩ পূর্বাহ্ণ)

    কথাটি অদ্ভুত শোনালেও ২০১১ সালের ২২শে মার্চ এমন একটি দিন যেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার চরম মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের গায়ে লেপটে থাকা বহু বছরের পুরনো একটি কালো দাগ মুছে ফেলে। শেক্সপিয়ার হয়তো এমন ব্যাপারগুলোকেই ‘আইরনি’ বলতেন। আর এভাবেই শেষ হল আমাদের আইনি লড়াই। এখন তবে শুরু হোক রাজনৈতিক লড়াই। দেখা হবে হয়তো পত্রিকার কলামে বা কোন ব্লগের রাজনৈতিক আলোচনায় অথবা কোন মিছিলে বা হাজারো মানুষের জনসভায়।

    এভাবেই এম সানজিদ হোসেন তার লেখাটি শেষ করলেন। প্রথমত লেখককে ধন্যবাদ জানাই তাহেরের বর্তমান বিচার-কার্যক্রমের একটা বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য। এটি শুধু তার পারিবারিক দিক থেকেই একটা বড়ো কাজ নয়, যারা তাহেরকে ভালোবাসেন তাদের দিক থেকেও দরকারি কাজ।

    আমার কথা হচ্ছে, এখানে যে পারিবারিক ইমোশন প্রকাশ পেয়েছে তা হতেই পারে, তাকে আমি অদরকারি কাজ হিসাবে দেখছি না। কিন্তু এ লেখার ভিতর দিয়ে তাহরেকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের নিরাকার চেতনার অনুসারী বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করছি।

    একটা বিষয় আমার প্রায়ই মনে হয় তাহেরকে যদি সিরাজ শিকদারের মতোই মরতে হতো তাহলে তার ভাগ্যে তার বিচার চাওয়ার লোকজন একেবারে বিপরীত মেরুর হয়ে যেত। অর্থাৎ তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা তার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইত। যেমন, এখন কোনো একজন বাঙালি জাতীয়তাবাদেই পাওয়া যাবে না যিনি সিরাজ শিকদারের রহস্যময় মৃত্যুর বিচার চাইছেন। এমনকি এই লেখকও তা চাইবেন বলে মনে হয় না।

    আমার কথা হচ্ছে, এমন একটা সরকারি সিদ্ধান্ত তাহেরের ফলোয়ারদের জন্যও দরকারি। আমি ব্যক্তিগতভাবে একে সাধুবাদ জানাই। তবে কথা হচ্ছে, ইমোশন নিয়েও বাণিজ্য হয়, সংসদে, ক্ষমতায়, রসনায় যাওয়ার পথ খোঁজা হয়। তাহেরের মৃত্যুর এই রায় নিয়েও যেন তাই হতে যাচ্ছে! আমার কথা হচ্ছে, একজন প্রগতিশীল চিন্তক, এক্টিভিস্ট সারাজীবনই বুজোর্য়া রাষ্টের বা ফ্যাসিবাদী চেতনার আসামী হয়ে থাকে। এটাই স্বাভাবিক। আমরা যখন আশির দশকে শ্লোগান দিতাম — ‘কর্নেল তাহের শিখিয়েছে লড়াই করে বাঁচতে হবে/ ৭৬-এর ক্ষুদিরাম, কর্নেল তাহের লাল সালাম’, তখন তার কার্যক্রমকে সফল করার জন্যই তা করতাম। বা, এখনও দূর থেকে করছি।

    আমি এখনও তাহেরের শুদ্ধতম রক্তে নিজেকে বিশুদ্ধ করি। তাঁকে আমার প্রেরণা মনে করি। তাকে ভালোবেসেই বিপ্লবের কাছে দীক্ষা নিতে চাই। কাজেই আমার কথা হচ্ছে, তাহের সরকারি খাতায় একজন শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী, এটা তেমন কোনো বিষয়ই নয়। তাহের বিপ্লবী, ফ্যাসিবাদের ত্রাস — সেটাই আসল কথা। শুধু একটা বদনাম থেকে তাকে রক্ষা করার আহ্লাদে মাতলে তাকে খাটোই করা হয়।

  6. এম সানজীব হোসেন - ২ জুন ২০১১ (১১:০৬ পূর্বাহ্ণ)

    ফিরোজ আহমেদ, আপনাকে ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। কিছু বিষয় পরিষ্কার করে করা দরকার।
    ১) আপনি বলেছেন, ‘না, আশ্চর্য হবার হয়তো কিছু নাই, পুরো বিষয়টা তাহেরের আদর্শ বাস্তবায়ন করার বদলে যদি কেবল তাহের-হত্যার বিচারে কেবল পর্যবসিত হয়, তবে তো তা কেবল প্রতিশোধস্পৃহা। তাতে রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ অনেক বেশি প্রাধান্য পাবে, আদর্শ সঙ্গতকারণেই গৌণ হয়ে যাবে।’ এই মামলার প্রক্রিয়ায় আমাদের (তাহেরের পরিবার) কোন প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করেনি। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন, তাহের এর রাজনৈতিক আদর্শের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন এবং তাই করা হচ্ছে। আমার মতে এই মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর মানুষ ধীরে ধীরে আর আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
    প্রতিটি লেখার একটি অবজেক্টিভ থাকে। আমার লেখার অবজেক্টিভ ছিল তাহেরের মামলার আইনি দিকগুলো এবং ছোটবেলা থেকে তাহেরকে আমি কিভাবে দেখেছি, তা তুলে ধরা। তাহেরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কম প্রাধান্য দেয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন আমি উল্লেখ করেছি, ‘প্রায় প্রতি বছর এই দুটি দিনে আমি তাহেরের উপর আমার বাবা, প্রয়াত মেঝ চাঁচা আবু ইউসুফ খান (বীর বিক্রম) সহ বিভিন্ন মানুষের লেখা পত্রিকায় পড়তাম। আর সেই সুযোগে আমার জানা হয়ে যেত মুক্তিযুদ্ধে তাহেরের অবিস্মরণীয় অবদান, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর মৌলিক এবং সাধারণ সেনা অফিসার থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীনতা পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অর্থনীতির উপর বোঝা নয় এমন এক সেনাবাহিনী বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখে তাহেরের বীরোচিত ফাঁসীর কথা।’ কর্নেল তাহেরের পরিবারের পক্ষ থেকে বহু বহু লেখা এইসব বিষয়ে ইতিমধ্যেই লেখা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আর গভীর আলোচনার ইচ্ছা আমার আছে।
    ২) আপনি বলেছেন, ‘‘মুজিবর রহমানের নিন্দা করায় তাহেরের আরেক পাকিস্তানী কর্মকর্তাকে হত্যা করার হুমকি প্রদানটা সম্ভবত অতিরঞ্জন, এটা কি সম্ভব সামরিক বাহিনীতে? কোর্টমার্শাল হয়ে যাবার কথা। মেজর মঞ্জুর সাহেবের অসাধারণ বইটাতে মনে পড়ে না এমন কোন বর্ণনা আছে।’’ আসলে অতিরঞ্জিত ঘটনা বলে আমার কোন লাভ নেই, এবং ঘটনাটি মোটেও তা নয়। এটি ঘটে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে আগে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। এর পরপরই তাহেরকে শাস্তিস্বরূপ তাঁর ইউনিট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তাঁর উপর কড়া নজরদারি আরোপের কথা আগেই বলেছি। শেষ পর্যন্ত তাহের রেহাই পান এসএসজি’র ইন্সট্রাক্টার জেনারেল মোস্তাফার ইন্টারভেনশানে, যিনি তাহেরকে একজন মেধাবী অফিসার হিসেবে পছন্দ করতেন। এর পরের ইতিহাসটি আমাদের সবারই মোটামুটিভাবে জানা যেখানে তাহের সেই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। আরেকটা ছোট তথ্যগত ভুল আছে আপনার মন্তব্যে। মেজর মঞ্জুর কোন অসাধারণ বই লেখেননি। আপনি বোধহয় মেজর আনোয়ার হোসেনের বইটির কথা বলছিলেন। সেই বইতে এই ঘটনার উল্লেখ নেই বলেই যে এটি বাস্তবে ঘটেনি এটা ভাবা বোকামি হবে।
    ৩) আপনি বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকেষ করেছিলেন, তার হিসাব নিকেষ নিতেই হবে। কিন্তু হাজার হাজার বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ৭৫ সালের আগেই খুন হওয়া, গৌণ হওয়া, প্রান্তিক হওয়ার হিসাব-নিকাশ তাহেরকে জাসদে উদ্ধুদ্ধ করেছিল, জাসদ, তাহের পরিবারের কেউ কেউ, আর আরও অনেকেই সেই কথাগুলোকে আড়াল করার প্রাণপণে যে চেষ্টা করে আসছেন, সেটাও তাহেরের স্মৃতির জন্য কম লজ্জাজনক না।’ অভিযোগটি বেশ হাস্যকর। তাহের পরিবারে অনেকেই বহু বছর ধরে (যেমন প্রয়াত আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রম, আমার বাবা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন) ক্রমাগত তাহেরের রাজনীতি (যেটি অবশ্যই ১৯৭২-১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়) তাহের বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। এই নির্মাণ ব্লগেই আনোয়ার হোসেনের ‘তাহেরের স্বপ্ন’ লেখাটি আপলোড করা আছে। ১৯৭২-১৯৭৫ আওয়ামী লীগ আমলের সমালোচনা করা এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে কোন কার্যকর বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করাকে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে যে শেষ হিসাবে জামাতেরই লাভ হবে, তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন।

  7. এম সানজীব হোসেন - ২ জুন ২০১১ (১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ)

    কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, আপনাকে ধন্যবাদ।
    ১) আপনি লিখেছেন, ‘কিন্তু এ লেখার ভিতর দিয়ে তাহরেকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের নিরাকার চেতনার অনুসারী বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করছি।’ আপনার এই উপলব্ধি ঠিক নয়। তাহের যে সোশিয়ালিস্ট/কমিউনিস্ট ছিলেন তা আমি জানি। তবে একই সাথে তাহের ন্যাশনালিস্ট ছিলেন বটে। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে রুপান্তরের জন্য তাহেরের কর্মকাণ্ড দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এমনকি আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের পরে তাহেরের বিভিন্ন লেখা পরি (যখন তাহের বাংলাদেশকে একটি সোশিয়ালিস্ট রাষ্ট্রে রুপান্তর করার চেষ্টায় নিয়োজিত), যেমন ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে’ অথবা ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’, সেখানে স্পষ্টত বোঝা যায় যে তাহের শুধু ‘ন্যাশনালিস্ট’ বা শুধু ‘সোশিয়ালিস্ট/কমিউনিস্ট’ ছিলেন না, বরং এই দুটি ধারার একটি সংমিশ্রণ ছিলেন।
    ২) আপনি লিখেছেন, ‘আমি এখনও তাহেরের শুদ্ধতম রক্তে নিজেকে বিশুদ্ধ করি। তাঁকে আমার প্রেরণা মনে করি। তাকে ভালোবেসেই বিপ্লবের কাছে দীক্ষা নিতে চাই। কাজেই আমার কথা হচ্ছে, তাহের সরকারি খাতায় একজন শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী, এটা তেমন কোনো বিষয়ই নয়। তাহের বিপ্লবী, ফ্যাসিবাদের ত্রাস — সেটাই আসল কথা। শুধু একটা বদনাম থেকে তাকে রক্ষা করার আহ্লাদে মাতলে তাকে খাটোই করা হয়।’ তাহেরকে কোন বদনাম থেকে রক্ষা করার আহ্লাদে আমরা হাই কোর্টে রিট দায়ের করিনি। সরকারি খাতায় তাহের শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কার জন্য? উত্তরটি এখানে খুব সহজ। তাহের শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী, সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বোঝা খুব প্রয়োজন, তাহেরের পরিবারের জন্য নয়। তাই আমি আমার লেখায় লিখেছিলাম, ‘আমার মতে এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাহেরের পরিবার যত না পেল, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্র।’ প্রশ্ন করতে পারেন যে একটি অবিপ্লবী রাষ্ট্রকে তার ভুল শুধরে দিয়ে কি লাভ? দুটি লাভের কথা আপাতত মাথায় আসছে। ১) বাংলাদেশ রাষ্ট্র অবিপ্লবী হলেও আমি তাকে ভালবাসি; ২) আমি চাই বাংলাদেশ একদিন একটি বিপ্লবী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বিপ্লবী প্রচেষ্টা সফল হবে তখনই যখন তা রাষ্ট্রের ‘ভেতর’ (ভেতরের শুভ শক্তি) এবং ‘বাইরের’(বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি) একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা হবে। ঠিক সেই প্রয়োজনীয়তার কারনেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তার নিজের ভুলগুলো শুধরে নেয়া জরুরি।

    • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৭ জুন ২০১১ (১০:১০ অপরাহ্ণ)

      সরকারি খাতায় তাহের শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
      রাষ্ট্রের ভুল শুদ্ধকরণ কথাটি একেবারেই আপেক্ষিক একটা বিষয়_ যে কোনো ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা তাহেরকে হাজার বার রাষ্ট্রদ্রোহী বলুক, তা-ই বলবে, তাতে তাহেরের বা সাচ্চাবিপ্লবীর কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আপনি বা আপনারা যেভাবে রায় নিয়ে একতরফা উৎফুল্ল হচ্ছেন, তাতে পারিবারিক শাস্তি বা রাজনৈতিক কৌশলই প্রকাশ পাবে_ তাহেরের বিপ্লবী সত্তার তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ আমারা এটা ভুলতে চাই না যে, তাহের কাদের কাদের বিরুদ্ধে ফাইট করেছিলেন। আপনারা পারিবারিকভাবে হয়ত এখন ভুলে-থাকার আরামে আছেন। কিন্তু তাহের এখন আর শুধু আপনাদের নন; তিনি বিপ্লবের প্রতীক। কাজেই রাষ্ট্রীয় ভাবে তাকে শুদ্ধকরণপ্রক্রিয়ার সাথে একমত হওয়া যায় না।
      সবদিকে খেয়াল করে দেখুন আমরা কেমন আছি। তাহের এ সময়ে কী করতেন!

      • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৭ জুন ২০১১ (১০:১৫ অপরাহ্ণ)

        ‘সরকারি খাতায় তাহের শুদ্ধ লোক নাকি দেশদ্রোহী সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
        আমার রিপ্লাইয়ের এ বাক্যটি এম সানজীব হোসেন থেকে উদ্ধৃতি হিসাবে দেয়া হয়েছিল।

      • এম সানজীব হোসেন - ১৪ জুন ২০১১ (৫:২৭ পূর্বাহ্ণ)

        কথা হচ্ছিল রাষ্ট্রের ভুল শুদ্ধকরণ নিয়ে। আপনি যদি বিতর্কের মূল বিষয়ে আলোচনা করতে না পারেন সেটা আপনার সমস্যা। এবং সেই ক্ষেত্রে আপনার সাথে তর্ক করার কোন যৌক্তিক কারণ দেখি না। সবার মতই, আমারও সময়ের মূল্য আছে।

        বার বার আপনি একই ভুল করছেন। রাষ্ট্র তাহেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করে তা হয়ত তাহেরের বিপ্লবী আত্মার কিছুই আসবে যাবে না। কিন্তু মামলাটি আমরা তাহেরের আত্মার শান্তি বা সন্তুষ্টির জন্য করিনি। আমরা মামলা করেছি যাতে বর্তমান রাষ্ট্র ১৯৭৬ সালে একটি চরম ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সহজ কথা। আমরা এটিকে একটি প্রয়োজনীয় কাজ বলে মনে করেছি।

        বাংলার ব্লগস্ফিয়ারে আপনি একজন ‘সাচ্চা বিপ্লবী’।

        বিপ্লবের ঝাণ্ডা উড়াতে থাকুন। ভালো থাকুন।

        • কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৪ জুন ২০১১ (১০:১২ অপরাহ্ণ)

          বিপ্লবের ঝাণ্ডা কোনো সুবিধাজীবীর পারমিশন নিয়ে উড়াতে হবে না। আশা করি আপনিও কাউকে আজেবাজে উপদেশ দিতে আসবেন না।

  8. এম সানজীব হোসেন - ১৪ জুন ২০১১ (৭:১৩ পূর্বাহ্ণ)

    ‘Left-Wing Communism: An Infantile Disorder’ লেখাটি লেনিন ১৯২০ সালে লিখেছিলেন। ঐ সময়কার ‘জার্মান লেফট’ এর থিওরেটিকাল পসিশানকে (যা ছিল ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সাথে আপোষহীন অবস্থান) সমালোচনা করতে গিয়ে লেনিন এই লেখায় পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন কেন অবিপ্লবী রাষ্ট্রেকে সাথে নিয়ে কাজ করাও গুরুত্বপূর্ণ। এই লিঙ্কে লেখাটি পড়া যাবে।

    এই লেখাটি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর সহ সকলকে পড়তে অনুরোধ করছি। ধন্যবাদ।

  9. ফিরোজ আহমেদ - ১৫ জুন ২০১১ (৮:২৩ অপরাহ্ণ)

    গ্রন্থকারের নামের সংশোধনীর জন্য অনেক ধন্যবাদ। বাকি বিষয় নিয়া অল্পস্বল্প কিছু বলি।

    অভিযোগটি বেশ হাস্যকর। তাহের পরিবারে অনেকেই বহু বছর ধরে (যেমন প্রয়াত আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রম, আমার বাবা অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন) ক্রমাগত তাহেরের রাজনীতি (যেটি অবশ্যই ১৯৭২-১৯৭৫ সালের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়) তাহের বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। এই নির্মাণ ব্লগেই আনোয়ার হোসেনের ‘তাহেরের স্বপ্ন’ লেখাটি আপলোড করা আছে। ১৯৭২-১৯৭৫ আওয়ামী লীগ আমলের সমালোচনা করা এবং বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে কোন কার্যকর বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করাকে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে যে শেষ হিসাবে জামাতেরই লাভ হবে, তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন।

    তাহেরের রাজনীতি কেবল ৭২-৭৫ এর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায়! একের পর এক গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়া, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনি করার জন্য মরিয়া কিংবা আরও বহু ভাবে দেশের অথর্নীতি-রাজনীতি ভারত-মার্কিনের হাতে তুলে দেয়া বর্তমানের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায় না? ধন্যি তাহের-পরিবার!

    বর্তমান সময়ে “বাংলাদেশে কোন কার্যকর বিপ্লবী শক্তির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করাকে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে।” কথাটাও তাহেরের রাজনৈতিক স্পিরিটের বিরোধী জ্ঞান করি। কোন সত্যিকারের বিপ্লবী দল না থাকলে কর্তব্য সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা করা, লুন্ঠকের দলের লেজুড়বৃত্তি করা না। এবং বামপন্থীরা সেটা করতে ব্যর্থ হলেই জামায়াতে ইসলামী লাভবান হবে, বাম রাজনীতি আর আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে লীগের লুণ্ঠন বামদের ঘাড়ে আসবে।

    আর তৃতীয়ত,লেনিনের গ্রন্থখানা আপনাকে পড়ে দেখবার অনুরোধ করি। বইটি হঠকারিতা বিষয়ে রচিত, আপনার বিবেচনায় বিপ্লবী বাম দলের অনুপস্থিতিতে তা গড়ে তোলার চেষ্টা হঠকারী হিসেবে বিবেচিত হলে আমার বলার কিছু নাই। আপনি বরং লেনিনের আরেকটা গূরুত্বপূর্ণ বই ঘেটে দেখতে পারেন, দি স্টেট অ্যান্ড রেভুলিশন, বইটাতে রাষ্ট্র, শ্রেণী ইত্যাদি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাগুলি কি, রাষ্ট্রের কাছ থেকে কি চাওয়া যায়, কি যায় না, সেটা বিবৃত আছে।

    আর শেষত, আমি আসলেই খুব বেশি কিছু আশা করি নাই। আমি জানতে চেয়েছিলাম তাহেরের পরিবার তাহেরের রাজনীতি কতটুকু ধারণ করে, তা জানা। আপনার অবস্থান আপনার স্টেটমেন্টে পরিস্কার। এই সততার জন্য ধন্যবাদ।

    কিন্তু তাহেরের রাজীনীতির সবচে বড় শক্তি এই যে, সেটা পরিবারের পেটেন্ট করা না, যে কেউ তার স্পিরিটের উত্তরাধিকারী হতে পারে। আপনার তাহের আপনার থাকুক, আমার তাহেরের আবেদন আরেকটু বেশি।

  10. এম সানজীব হোসেন - ১৭ জুন ২০১১ (৩:৩৭ পূর্বাহ্ণ)

    @ ফিরোজ আহমেদ, আপনার কথা দিয়েই শুরু করি। আপনি বলেছেন, ‘আপনার অবস্থান আপনার স্টেটমেন্টে পরিস্কার।’ আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকুই বা জানেন? এত দ্রুত যেকোনো কঙ্কলুশান এ না পৌঁছালেই বোধহয় ভাল হয়।
    আপনি বলেছেন, ‘কিন্তু তাহেরের রাজীনীতির সবচে বড় শক্তি এই যে, সেটা পরিবারের পেটেন্ট করা না, যে কেউ তার স্পিরিটের উত্তরাধিকারী হতে পারে।’ আপনার সাথে আমি একমত। এবং আমাদের পরিবারের কেউ তা পেটেন্ট করেও নাই, করবেও না। অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য দয়া করে কম করুন।
    আপনি বলেছেন, ‘একের পর এক গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়া, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনি করার জন্য মরিয়া কিংবা আরও বহু ভাবে দেশের অথর্নীতি-রাজনীতি ভারত-মার্কিনের হাতে তুলে দেয়া বর্তমানের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায় না? ধন্যি তাহের-পরিবার!’ বর্তমানে আওয়ামী লীগ কে পেছন থেকে সমর্থন দেয়া মানে এই নয় যে আমরা তাদের সকল সিদ্ধান্ত বা পলিসি সমর্থন করি। আপনি যতগুলো ইসু’র কথা বললেন, তার সবগুলো ব্যাপারেই আমরা সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না।
    আপনি বলেছেন, ‘…আপনার বিবেচনায় বিপ্লবী বাম দলের অনুপস্থিতিতে তা গড়ে তোলার চেষ্টা হঠকারী হিসেবে বিবেচিত হলে আমার বলার কিছু নাই।’ আমি তো কোথাও বলিনি বিপ্লবী দলের অনুপস্থিতিতে তা গড়ে তোলার চেষ্টা হঠকারীতা হবে। কোথায় পেলেন এই ‘বিবেচনা’? অবশ্যই নিবেদিত বিপ্লবী শক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন, এবং তা এখনি। তবে তাহেরের পরিবারের সদস্যদেরকেই তা আবারো করে দেখাতে হবে বা সেই প্রচেষ্টার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকতে হবে, তা আমি মনে করি না। এতটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে যায় এমন যেকোনো বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে তাহেরের পরিবার সমর্থন করবে, যেমন আগেও করে এসেছে।
    আপনি বলেছেন, ‘কোন সত্যিকারের বিপ্লবী দল না থাকলে কর্তব্য সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা করা, লুন্ঠকের দলের লেজুড়বৃত্তি করা না।’ Imperialism এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ভুলে গেলে চলবে না যে তার মাঝখানে আরো দরকারি যুদ্ধ আছে, যেগুলো মোকাবেলা না করলে imperialism কেও পরাস্ত করা শেষমেশ হবে না। এই দরকারি যুদ্ধগুলোর মধ্যে পড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সামরিক শাসন ঠেকানো ইত্যাদি। এইসব যুদ্ধে আওয়ামী লীগ কে সমর্থন করাকে যদি আপনি ‘লেজুড়বৃত্তি’ বলতে চান বলতে পারেন। তবে তাতে আপনার বালখিল্যতাই বেশী প্রকাশ পাবে। ধন্যবাদ আপনাকে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.