ছবির এই লোকটার চেহারা দেখে রাখুন। কথাগুলোও খুব মন দিয়ে লক্ষ করুন। এর নাম মুকেশ। চিনছেন না? তাহলে আসুন চিনিয়ে দিচ্ছি। দিল্লীর সে মেয়েটার কথা মনে আছে? ২৩ বছরের জ্যোতি? হ্যাঁ, সেই জ্যোতি যাকে দিল্লীর বাসে এক রাতে এই মুকেশসহ আরও পাঁচ জন ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। হত্যাকারীরা সবাই ধরা পড়েছিল। আপনি হয়তো ভাবছেন এর পর মুকেশরা নিশ্চয়ই তাদের কৃৎকর্মের বিভৎসতা বুঝতে পেরে অনুশোচনায় কাতর। আপনার ধারণা ভুল।
মুকেশদের কখনো অনুশোচনা হয় না। যে কারণে এখনও মুকেশরা দম্ভ ভরে বলতে পারে – “ধর্ষক পুরুষের চেয়েও ধর্ষিতা নারীটির দায় বেশী,… কারণ তার পোশাক-আশাক ঠিক ছিল না,… কারণ সে রাত বিরেতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল,… তার উচিতই হয়নি প্রতিরোধের চেষ্টা করা” ইত্যাদি।
[লিন্ক ১; লিংক ২].
যদি ভাবেন এই চিন্তাপদ্ধতি শুধু মুকেশ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের, তাহলে বিরাট ভুল করবেন আপনি। চার পাশের যে নিপাট মডারেট ভদ্রলোকদের দেখছেন, তাদেরও বেশীরভাগ আসলে ওভাবেই চিন্তা করে। তফাত একটাই – মুকেশরা কর্মে বীর, এরা ফ্যান্টাসীতে। আর এদের মধ্যেও যারা একটু হাবা ধরণের, তারা ফ্যান্টাসীর কথাটা ভুস করে জনসমক্ষে বলে বসে। আর যাদের মাথায় ঘিলু একটু বেশী তারা এক ধরণের দার্শনিকতার ছাঁচে আড়ে আড়ে তাদের এপলজিস্ট যুক্তিগুলো তুলে ধরে (যেমন: ‘ক নিন্দনীয় কিন্তু/তবে খ এরও উচিত হয়নি …’)।
একে বলে – ভিকটিমের উপর দোষ চাপিয়ে অপরাধীর পক্ষে কার্যত সাফাই গাওয়া, অপরাধী আর তার ভিকটিমকে একই পাল্লায় মাপা। যাতে করে একসময় এ দু’য়ের মধ্যে আর কোন পার্থক্য খুঁজে না পাওয়া যায়। তাতে বিচারের দাবীটি হাল্কা হয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও পোক্ত হয়।
এদিকে এক সপ্তাহও পার হয়নি অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন। জীবনে তিনি কোনদিন কারও পাকা ধানে মই দিয়েছেন এমন শুনিনি। শুধু প্রান্তিক বিভিন্ন বিষয়ে নিজের উপলদ্ধিগুলো তুলে ধরতেন। সে সব নিয়ে লিখবার জন্যই প্রাণ দিতে হল তাকে। ইতোমধ্যেই বুদ্ধিমানগণ ঠিক উপরের ঐ মুকেশ আর তার বুদ্ধিমান এপলজিস্টদের মতো করেই ঘ্যানঘ্যানে তানে সুর ধরেছে – ‘অভিজিৎ এর মৃত্যু অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়, কিন্তু/তবে এটাও বুঝতে হবে ও ছিল নাস্তিক, ওর লেখা ধার্মিক এর দিলে বেজায় চোট দিতো রোজ’। আর ঘ্যানঘ্যানে এই তান প্রতিবারই শেষ হয় সাধারণত এই জাতীয় বাক্য দিয়ে – ‘বাকস্বাধীনতারও তো সীমা/দায়িত্ব বলে একটা ইয়ে আছে, আছে কিনা বলেন?’!
আর এভাবেই এমনকি অভিজিৎদের হত্যাকারীদের পক্ষেও ন্যারেটিভ তৈরীর চেষ্টা চলে। অভিজিৎদের মরতে হবে, মরতে হয়। কারণ অভিজিৎরা এমনকি নিঃশ্বাস নিলেও আজকাল কিভাবে যেন বিশ্বাসীদের আরাম চটে যেতে থাকে। তাই বুদ্ধিমান বিশ্বাসীরা এভাবে মুকেশদের চিন্তার ফর্মুলা ধারণ করে খেলিয়ে খেলিয়ে গোল গোল বাক্যে দায়মুক্তির নতুন ব্যাকরণ লিখতে থাকে। তাদের অমানবিক দুর্বোধ্য এ ব্যাকরণের মূল উপপাদ্য হল – কেবল অভিজিৎই অভিজিৎ এর মৃত্যুর জন্য দায়ী, আর কেউ না!
চারপাশের ছোটবড় আততায়ী পরিবেষ্টিত এই সময়ে আমরা সবাই বেশ ভাল আছি। যেভাবে সম্প্রতি চলে যাওয়া আরেক বন্ধু লিখেছিল – কি বিচিত্র সুন্দর এই জীবন!
রায়হান রশিদ
জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৪ comments
Shagufta Sharmeen Tania - ৪ মার্চ ২০১৫ (১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
রায়হানভাই, এই লেখায় মুকেশদের উকিলের জবানিও উল্লেখ করুন, একটি ধর্ষকের পক্ষের উকিলও যে আদালতে এবং আদালতের বাইরে নারীর বিষয়ে এমন কথা বলতে পারে, তাতে শিউরে উঠতে হয়।
আমি জানি না, মুকেশের এই উক্তি বাইরের লোকের কাছে পৌঁছবার মানে কি, কারণ এই উদ্ধত নোংরা মানসিকতার আরো আরো প্রকাশ এবং প্রচারে লাভ কার?
অভিজিত রায়কে মারবার পর থেকে যাঁরা তাঁর লেখা কোনোদিন পড়েননি বা পড়বেন না, তাঁদের মুখেও একই লব্জ শুনছি যে, উনি ধর্ম এবং রাসুলের অবমাননা করেছিলেন। আসলেই কি অবমাননা করেছিলেন,কারো অবমাননা কি এতই সোজা কিংবা অবমাননার শাস্তি কি মৃত্যুদন্ড… এইসব প্রশ্নে কেউ আসছেন না। প্রয়োজনই নেই!
রায়হান রশিদ - ১৭ মার্চ ২০১৫ (৮:২২ পূর্বাহ্ণ)
কোন বৈজ্ঞানিক স্যাম্পলিং নিশ্চয়ই না, কিন্তু মুকেশ এর উকিল বা পঞ্চায়েত এর যে নেতাদের উদ্ধৃতিগুলো দেখেছি, তাতে এই দৃষ্টিভঙ্গি সংখ্যাগুরুর হলেও কিন্তু অবাক হবো না।
মুকেশের উকিলের কথা উল্লেখ করায় আরেকটা মজার বিষয় মনে পড়লো। ক’দিন আগে ‘বিজ্ঞানমনষ্কতা’ নিয়ে কি এক মন্তব্য করেছিলাম ফেসবুকে, সেটা পড়ে আমার ধার্মিক কিছু বিজ্ঞানী বন্ধু খুবই খেপে গেল। অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলবো না। পরদিনই বন্ধুটি আমাকে অবাক করে দিয়ে জোরেশোরে ফেসবুকে India’s Daughter এর প্রচারণা শুরু করলো। একটু পর স্পষ্ট হল এই হঠাত-উদ্যম এর রহস্য, যখন লক্ষ্য করলাম বন্ধুটি আসলে বিশেষভাবে মুকেশের “উকিল” এর মন্তব্যের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, আর বোঝাতে চাইছে ওকালতির লাইনের লোকগুলো আসলে যে কতো গোলমেলে! বিষয়টা এরকম – তুই বিজ্ঞানীদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিস, এবার আমি উকিলদের দেখে নেব!
কারও লেখা অবমাননাকর ছিল কি না সে বিষয়ে আমাদের মূল্যায়নে আসলে কিছু যায় আসে না। যে আহত হওয়ার সে যে কিসে আহত হবে আর কিসে হবে না, তা বোঝা কঠিন। হিচেন্স এজন্যই অবমাননার মানদন্ড নির্ধারণকারীদের ব্যাপারে গোড়াতেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। আসল কথা হল – অভিজিৎ রায়রা নিশ্বাস নেবেন, ভাববেন, লিখবেন – সেটাই অবমাননাকর অনেকের জন্য।
মাসুদ করিম - ৩০ মার্চ ২০১৫ (২:০০ অপরাহ্ণ)
তেজগাঁওয়েব্লগারওয়াশিকুরবাবু(https://t.co/BY4GngL2QT)-কেকুপিয়েহত্যাhttp://t.co/5ZT3p6P8As #Bangladesh pic.twitter.com/Am1WbwZvEf
— ICSF (@icsforum) March 30, 2015
Pingback: চার পাশের আততায়ীরা! » বাংলাদেশী শীর্ষ কমিউনিটি নিউজ পোর্টাল