ছবি-বিতর্ক: প্রথম আলোর সাফাই বিবৃতির জবাবে

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো 'কোন কোন মহল'কে একটা উচিত জবাব দেয়া হয়েছে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। সেখানে দাবী করা হয়েছে প্রথম আলো জীবনেও কখনো ছবিতে ফটোশপ করে না। তাদের দাবী: 'খবরের জন্য তোলা আমাদের প্রকাশিত আলোকচিত্রে কোন কিছু সংযোজন বা বর্জন করা (পড়ুন: ফটোশপ) প্রথমআলোর সাংবাদিকতা সংক্রান্ত নীতিমালা সমর্থন করে না'। ভাল। তাহলে এটা কি? [...]

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো ‘কোন কোন মহল’কে একটা উচিত জবাব দেয়া হয়েছে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে [লিংক]। সেখানে দাবী করা হয়েছে প্রথম আলো জীবনেও কখনো ছবিতে ফটোশপ করে না। তাদের দাবী: ‘খবরের জন্য তোলা আমাদের প্রকাশিত আলোকচিত্রে কোন কিছু সংযোজন বা বর্জন করা (পড়ুন: ফটোশপ) প্রথমআলোর সাংবাদিকতা সংক্রান্ত নীতিমালা সমর্থন করে না’। ভাল। তাহলে এটা কি? দেখুন কিভাবে নায়িকা বিদিয়া বালানের ছবি ফটোশপ করে আরেকটু ‘পর্দানশিন’ বানানো হয়েছে! [লিংক]

প্রথম আলোর এই সাফাই সঙ্গীতে যেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল — তারা তাদের বক্তব্য সীমিত রেখেছে ভোটার সারির ছবিতে হিন্দু মহিলাদের ছবিগুলো ফটোশপ করা হয়েছে কি হয়নি তার মধ্যেই। ফটোশপ হয়েছে কি হয়নি সেটা বিশেষজ্ঞ টেকিরা দেখবেন, বুঝবেন, সেটা আমার অন্তত মাথাব্যাথা না। মূল অভিযোগ তো সেটা ছিল না। মূল অভিযোগ ছিল — এ ধরণের ছবি (যদি তা ফটোশপ ছাড়াও হয়ে থাকে ধরে নিই) দিয়ে এক ধরণের সাম্প্রদায়িক উস্কানি প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। দুঃখজনক হল — সে বিষয়ে বিজ্ঞ প্রথমআলোর গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা এখনো পাইনি।

দেখলাম তাদের এক প্রতিনিধি যুক্তি দেখিয়েছেন: ‘ঢাকার সুদূর লালবাগের ছবি ছাপিয়ে কি অভয়নগরে দাঙ্গা ঘটানো সম্ভব’! কি হাস্যকর যুক্তি! ফেসবুকে ছবি দিয়ে রামুতে দাঙ্গা হয়নি? রামু কি ফেসবুকে? ড্যানিশ কার্টুন নিয়ে বাংলাদেশে মোল্লারা লাফায়নি? আমাদের বাংলাদেশের মোল্লারা কি ড্যানিশ? সুদূর ভারতের বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে মন্দির ভাঙ্গা হয়নি? কোন্ সে জাদুবল যা সে সব প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে ভৌগলিকত্বকেও হার মানালো! এই সামান্য বিষয়টা যারা বোঝে না বা বুঝেও না বোঝার ভাণ করছে এখন তাদের হাতে আজকে আমাদের মিডিয়া জিম্মি — বিষয়টা আসলেই আশংকাজনক।

বিষয়টা আসলে খুবই সহজ। এখানে না বোঝার কি আছে, তাই তো বুঝতে পারছি না। বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর ছবি ছাপিয়ে এক ধরণের গোষ্ঠীগত প্রোফাইলিং এর কাজটুকু করে দেয়ার অর্থ আক্রমণকারীদেরই সহায়তা করা, চূড়ান্ত ফলাফলে যা আক্রমণ বা বিদ্বেষকেই আরও ত্বরাণ্বিত করে, এমনকি কিছুটা হলেও। উদাহরণ: লনড্নের দাঙ্গার (যেখানে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সবাই ভূমিকা রেখেছিল) কাভারেজে এখন যদি শুধুমাত্র কিছু কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের ছবি পত্রিকায় ছাপানো হয় তাহলে সেটা কেমন হবে? কিংবা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স (যা সকল শ্রেনী, বর্ণ, ধর্মের সমাজেই একটি সমস্যা) এর কোন সাধারণ রিপোর্টের সাথে যদি হিজাব পরিহিতা কোন মুসলিম নারীর ছবি জুড়ে দেয়া হয় — তাহলে সেটা কি নির্দেশ করবে? এজাতীয় রিপোর্ট পাঠকের পারসেপশনে কি প্রতিক্রিয়া বা অনুসিদ্ধান্ত তৈরী করে?

দেখলাম প্রথম আলোর আরেক বুদ্ধিমান প্রতিনিধি সাফাই যুক্তি সাজিয়েছেন। তিনি বলছেন — মিডিয়ার দিকে মনযোগ সরিয়ে দিয়ে নাকি সমালোচকরা মূলত সরকারকে দায়মুক্তি দিতে এবং সরকারের পিঠ বাঁচাতে বদ্ধপরিকর; এবং সে লক্ষেই নাকি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে নেমেছে প্রথমআলোর বিরুদ্ধে এই সমালোচনাকারীরা। রিয়েলি? এতো ভেবে এই বের করলো প্রথমআলোর বুদ্ধিমান সম্পাদনা টিম! হতাশাব্যঞ্জক। প্রথমত: পুরো মিডিয়ার সাথে প্রথমআলোর এখন নিজেকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ফেলার চেষ্টাটা লক্ষণীয়। একচেটিয়াভাবে পুরো মিডিয়ার ওপর কখনোই কোন দোষ চাপানো হয়নি, আলোচনা হচ্ছে মিডিয়ার একটি বিশেষ অংশের উস্কানী প্রদানে ভূমিকার ব্যপারে। দ্বিতীয়ত: জ্বি না স্যার, প্রথমআলোর ভূমিকার সমালোচনাকারীরা সবাই সরকারের অন্ধ সমর্থক না, সবাই সরকারকে ছেড়েও কথা বলছেন না। অন্যান্য দাবীগুলোতেও একবার সময় হলে চোখ বুলিয়ে নেবেন। [যেমন: এখানে]। তবে সমালোচনা শুরু হওয়া মাত্রই প্রথমআলোর নিজেকে সরকারের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে ফেলার, এবং বাকিদের আওয়ামী-ট্যাগিং করার এই চেষ্টাটুকু লক্ষনীয়!!

মজার ব্যাপার হল — প্রথমআলোর বুদ্ধিমান প্রতিনিধির একই ধারার যুক্তির লাইনেই তো এও বলার সুযোগ থাকে: “সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাটা প্রথম আলোর মতো পত্রিকাগুলো আসলে উস্কেছেই যেন সেটাকে উপজীব্য করে নির্বাচন পরবর্তী সরকারকে আরেকটু বিপাকে ফেলা যায় নানান ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে! যাতে তারা বলতে/লিখতে পারে — ‘দেকলে, আগেই বলেছিলুম কিন্তু’!” (এখানে নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রথমআলো-সুশীলদের অবস্থান দ্র্ষ্টব্য)। এভাবেও কিন্তু সমালোচকরা দেখতে পারতেন, দেখানোর দেদার সুযোগ তো ছিলোই! কিন্তু এভাবে কেউ অপযুক্তি করছেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তদন্তে আরও স্পষ্ট হচ্ছে বিষয়গুলো – যে কারণে তদন্ত দাবী করা হয়েছে।

প্রথম আলোর আরেক প্রতিনিধি সবচেয়ে অদ্ভুত যুক্তিটি দেখিয়েছেন, অনেকটা এই লাইনে — ‘হিন্দুরা বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই মিডিয়াতে ছবির মাধ্যমে তারা নাকি উঠে আসতেই পারেন। আর এভাবে তাদের মিডিয়ার উপস্থাপন থেকে বাদ দিতে থাকলে, তারা নাকি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাবে।’ এই যুক্তির অংশ হিসেবে এই প্রতিনিধি দিব্যি দোষারোপ করছেন আজকের সমালোচকদের। তার দাবী – ‘এই সমালোচকরা নাকি হিন্দুদের বাংলাদেশ থেকে অদৃশ্য করে দেয়ারই পক্ষে, তাই নির্বাচনে হিন্দু নারীদের ছবির বিরোধীতা করছে’! আপাতভাবে উক্ত প্রতিনিধির এই কথাগুলো অনেকের কাছে খুব যৌক্তিকই মনে হতে পারে, যদি না আরেকটু তলিয়ে দেখা হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে হিন্দুদের উপস্থিতি তিনি তুলে ধরতে চান মিডিয়ায় — খুবই ভাল কথা। কিন্তু সেটা নির্বাচনের মতো একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল (এবং অত্যন্ত বিপদজনক) একটা বিষয় দিয়েই তুলে ধরতে হবে কেন? তাও আবার যেখানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অতীতে যেখানে হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহিংসতার নজির রয়েছে? পাঠককে মনে করিয়ে দিই এই প্রথমআলোই ২০০১ সালে হিন্দুদের ওপর সহিংসতার খবরগুলো কোন এক বিশেষ নীতির বিবেচনায় চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হিন্দুদের অস্তিত্বই যখন বিপন্ন তখনও তাদের মনে হয়নি প্রতিনিধিত্বমূলক এই ‘তুলে ধরার’ কথা! পাঠককে অনুরোধ করবো প্রথমআলোর গত এক বছরের প্রতিটি সংখ্যার একটা দ্রুত খতিয়ান নিতে, এবং দেখতে সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে হিন্দুদের উপস্থিতি কতটা প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে তারা তুলে এনেছে আসলে! আমার ধারণা সেখানেও খুব আগ্রহোদ্দীপক কিছু পাওয়া যেতে পারে। আর পত্রিকায় ছবি ছাপলেই সত্যি সত্যি অদৃশ্য হতে থাকা হিন্দুদের অদৃশ্যতা ঠেকানো যাবে বুঝি? গত চার দশকে দেশ ত্যাগ করা, দ্রুত অদৃশ্যমান হিন্দুদের পরিসংখ্যানগুলো পড়ে দেখুন। এই সচেতনতা দিয়েও তাহলে বাংলাদেশে প্রথম সারীর একটা পত্রিকা চালানো সম্ভব!

সাংবাদিকতা মানে spin না, আশা করি প্রথমআলোর এই প্রতিনিধিরা spin doctor-এর ভূমিকা ছেড়ে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় আরও মনোযোগী হবেন।

ধন্যবাদ।

[আগে যা ঘটেছে: এখানে দেখুন]

রায়হান রশিদ

জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম, নটিংহ্যাম, এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমান আবাস যুক্তরাজ্য। ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা প্রদান, এবং ১৯৭১ এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের দাবীতে সক্রিয় নেটওয়ার্ক 'ইনটারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম' (ICSF) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.