[অণুব্লগ]
যারা মনে করবেন রাজাকার ত্রিদিব রায়ের লাশ সমাহিত করার ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই সুযোগে পাহাড়ী-আদিবাসীদের ওপর ঢালাওভাবে এক হাত নেবেন, সুযোগ বুঝে তাদের অধিকারকে খাটো করার চেষ্টা করবেন – তারা এই পোস্ট থেকে দূরে থাকুন। আবার যারা মনে করেন রাজা ত্রিদিব রায়ের ইস্যুকে উপলক্ষ্য করে এই সুযোগে ১৯৭১ এর চিহ্নিত এক অপরাধীর কৃতকর্মকে ‘আদিবাসী অধিকার’ ইত্যাদি ইস্যুর সাথে মিলিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ নেবেন, এবং পক্ষান্তরে এই অপরাধীর কৃতকর্মকে জায়েজ করিয়ে নেবেন, তারাও দূরে থাকুন। এখানে কথা হচ্ছে একজন চিহ্নিত অপরাধীকে নিয়ে। অপরাধীর কোনো জাত নেই, বর্ণ নেই, সম্প্রদায় নেই। তার শেষ ঠিকানা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়। ১৯৭১ এর সকল অপরাধীর বিচারের দাবীতে আমরা সোচ্চার, ঠিক যেভাবে সবসময় সোচ্চার ছিলাম এবং আছি সকল পাহাড়ী এবং আদিবাসীদের অধিকার এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের ইস্যুতে। পাশে আছি, পাশে থাকবো, কিন্তু ১৯৭১ এর চিহ্নিত অপরাধীর ইস্যুতে কোনো আপস নেই, তা সে যে ধর্মের, বর্ণের, সম্প্রদায়েরই হোক না কেন।
————————–
লেখক কুলদা রায় লিখেছেন ‘রাজা ত্রিদিব আর রাজাকার ত্রিদিব : ত্রিবিধ কথা‘ শিরোনামে। সেখানে তিনি চাকমা রাজার মৃতদেহ বাংলাদেেশ সমাহিত করার পক্ষে যে যুক্তিগুলো তুলে ধরলেন, সবিনয়ে সেখানকার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ, এ জাতীয় যুক্তি বিভ্রান্তিজনক।
#১: লেখক প্রশ্ন করেছেন – ‘ত্রিদিব রায়ের বিরুদ্ধে কি এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র কোনো যুদ্ধাপরাধের মামলা করেছে?’ এর পর লেখক নিজেই উত্তর দিচ্ছেন – ‘করেনি’। এটুকু লিখেই তিনি প্রসঙ্গটি ছেড়ে দিয়েছেন। (অন্তর্নিহিত সাব-টেক্সট: সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন – ত্রিদিবকে অপরাধী বলা ঠিক হচ্ছে না!)
— লেখকের এই প্রশ্নের এবং তার নিজেরই দেয়া উত্তরের শাণে নজুল বোঝা কঠিন। বুদ্ধিজীবি হত্যাকারী চৌধুরী মুঈনউদ্দিন, আশরাফুজ্জামানদের বিরুদ্ধেও এর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। সুতরাং, প্রশ্নটা কি এভাবে আদৌ উত্থাপন করা যায়, নাকি উত্থাপন করাটা সঙ্গত? তাহলে কি তাদের নিরপরাধ ধরে নিয়ে আমাদের সবার এতদিন মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা উচিত ছিল? আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না দায়ের হওয়ার মতো এমন সংকীর্ণ যুক্তিই মুঈনুদ্দিন-আশরাফুজ্জামানদের দেশী-বিদেশী বন্ধুরা ফলাও করে তুলে ধরতেন এতদিন, আমাদের সেটাও দেখা আছে। এখন আমার প্রশ্ন হল – রাষ্্্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের অনুপস্থিতিতে ‘৯০ এর দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং অন্যরা তাহলে কোন্ মুখে গোলাম আযমদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন? তাহলে ৪১ বছর বাংলাদেশের সবার কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা উচিত ছিল – যেহেতু তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে (ICT-তে) তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা ওঠেনি কিংবা অভিযোগ দায়ের হয়নি? উল্লেখ্য, রাজাকার ত্রিদিব রায়ের নাম কিন্তু ১৯৭২ সালেই দালাল হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে আদালতে হাজির হওয়ার সমন জারী করা হয়েছিল দালাল আইনের আওতাতেই। সে তালিকায় তার নাম ছিল ৮ নম্বরে যে একই তালিকায় গোলাম আযমের নাম ছিল ১১ নম্বরে।
#২: লেখক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন – রাজাকার ত্রিদিব রায়ের মরদেহ ফিরলেই নাকি “মরণোত্তরকালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগটি” তৈরী হবে।
— আশাবাদে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনো কোনো আশাবাদ ভিত্তিহীন তো বটেই, এমনকি বিভ্রান্তিকরও। যুদ্ধাপরাধের মরণোত্তর বিচারের মতো এমন উদ্ভট বিধান আমােদর আইনে আছে বুঝি? কোনো আইনেই কি আছে? তাহলে বিশ্ববাসী হিটলারের মতো অপরাধীর বিচার করা বাদ দিল কি বুঝে? লেখক এই “মরণোত্তর যুদ্ধাপরাধের বিচার তত্ত্ব” কোথায় পেলেন, এবং কিভাবে তা আমাদের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাতেও সম্ভব তা আরেকটু বিস্তারিত জানিয়ে গেলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হয়। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে এমনভাবেও “মরণোত্তর বিচার” (!) করা যায়, তাহলে আমার প্রশ্ন থাকবে – বিচারটা যেহেতু ICT-তেই হতে হবে, সেহেতু লাশ পাকিস্তানে রেখেই সেই জাতীয় বিচার করতে কি কোনো বাধা আছে? নাকি এখানে কোনোভাবে রাজাকার রাজার কফিন ICT’র এজলাসের সামনে টেনে-হেঁচড়ে এনে বিচার করবার স্বপ্ন দেখছেন লেখক? কিংবা বিকল্প হিসেবে রাঙামাটিতেই রাজার (সম্ভাব্য) সমাধির সামনে আমাদের ICT’র বিচারকদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে বিশেষ এজলাস বসানোর কল্পনা করা হচ্ছে?!!
#৩: তিনি দাবী করেছেন, “ব্যক্তি মানুষ” হিসেবে ত্রিদিব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, রাজা হিসেবে নাকি করেননি।
— সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করছি। কোন রাম-শ্যাম-যদু-মধুর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যোগাযোগ করে সাহায্য এবং আনুগত্য চায়নি। চেয়েছে “রাজা” ত্রিদিব রায়ের কাছে, তার অবস্থানের কারণেই। সুতরাং, ত্রিদিব রায়ের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতা কোনো ব্যক্তি মানুষ হিসেবে নয়। এভাবে তার পর্যায়ের একজন অপরাধীর ক্ষেত্রে “ব্যক্তি” এবং “প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকে” পৃথক করবার চেষ্টাটা কতটা সঙ্গত? ত্রিদিব রায়ের উর্ধ্বতন অবস্থানই তাকে প্রাসঙ্গিক করেছিল পাকিস্তানীদের কাছে। সেই উর্ধ্বতন অবস্থানের জোরেই সেদিন তিনি তরুন চাকমা সমাজকে EPCAF এর মতো একটি অপরাধী মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দানে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন! তার উর্ধ্বতন অবন্থানের কারণেই তার বিরুদ্ধে এমন সব আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ আমাদের বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনের আওতাতেই আনার সুযোগ ছিল, যে সব অপরাধের অভিযোগ গোলাম আযম এবং নিজামীদের বিরুদ্ধেও বর্তমানে আনা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে আইসিএসএফ এর ই-লাইব্রেরীতে আপলোডকৃত ফর্মাল চার্জগুলো পড়ে নেয়া যেতে পারে। যেটা স্পষ্ট হতে হবে তা হল – রাজা/ব্যক্তি ত্রিদিব এবং রাজাকার ত্রিদিব একই ব্যক্তি, এবং তাদেরকে পৃথক করা যায় না। রাজাকার ত্রিদিব রাজাকারী করার সুযোগ এবং ক্ষমতাই পেয়েছিলেন রাজা ত্রিদিব হওয়ার সুবাদে!
কেমন রাজা ছিলেন ত্রিদিব রাজাকার?
অনেকে য়ুক্তি দেখানোর চেষ্টা করছেন যে – রাজাকার ত্রিদিবের রাজাকারির পেছনে নাকি তার সম্প্রদায়ের মঙ্গলই মূল বিবেচ্য হিসেবে কাজ করেছে। এবার এক নজরে দেখা যাক, এই ব্যক্তি ত্রিদিব বা রাজা ত্রিদিব তার জনগণের জন্য আসলে কি করেছেন বা করেননি –
(ক) ১৯৭১-এ বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ (পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসিদের সিংহভাগও এতে অন্তর্ভুক্ত) যখন দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আগ্রাসী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে – তখন তিনি নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করেছেন, রাজা হিসেবে নিজের অবস্থানকে অপব্যবহার করে। বাংলাদেশের আপামর মানুষের সাথে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা উদ্বুদ্ধ বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি তার জনগণকেও টেনে আনার চেষ্টা করেছেন, তার প্রতি তার জনগণের আস্থা, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার অবস্থানকে ব্যবহার করেই। যে নেতা বা যে প্রধান নিজের অনুসারীদের এভাবে বিপথগামী করে সে কোন্ ধরনের নেতা?
(খ) যদি ধরেও নিই যে তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়েও অখন্ড পাকিস্তান তার জনগণের জন্য ‘বেশী উপকারী’, তাহলে প্রশ্ন করবো ঠিক কি বিবেচনার ভিত্তিতে তিনি সেই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন? অখন্ড পাকিস্তান কি কোনো বিচারে ‘কম সামরিকায়িত’, ‘অধিক সেকুলার’, কিংবা ‘অধিক গণতান্ত্রিক’ ছিল ১৯৭১ এর সেই পটভূমিতে? এই পাকিস্তান আমলেই কি কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হয়নি, তার পূর্বপুরুষের রাজপ্রাসাদসহ পার্বত্য অঞ্চলের সিংহভাগ আবাদী জমি লেকের নিচে ডুবিয়ে দিয়ে? হাজার হাজার চাকমা পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করে? সবচেয়ে বড় কথা হল – যে পাকিস্তানের সৃষ্টিই হল ধর্মের ভিত্তিতে, সেই পাকিস্তানে চাকমাদের অবস্থান কোথায়? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন – অখন্ড পাকিস্তানের আরেক সক্রিয় সমর্থক জামায়াতে ইসলামীর সাথে তিনি সেদিন ঠিক কি আদর্শিক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন? যে জামায়াতে ইসলামীর মজ্জাগত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ প্রতিটি সাধারণ পাহাড়ী প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছে? এটা সত্য কথা যে গত চার দশকে জিয়া-এরশাদ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেেশর প্রতিটি সরকারের পার্বত্য ইস্যুতে নীতিগুলো ছিল আদিবাসীদের অধিকার এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের বিরোধী, কিন্তু সেটা এক দিনে হয়নি। ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশ যে এমন হবে তা ১৯৭১ সালেই ত্রিদিব রায় কোন্ “ক্রিস্টাল বল” ব্যবহার করে আগেভাগেই বুঝে গিয়েছিলেন? যদি বুঝে গিয়েই থাকেন, তাহলে তো বলতে হয় তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান একজন রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন। আর সেটাই যদি ধরে নিই, তাহলে তো একথাও বলা যায় যে গত চার দশকে তার জনগণ যখন বিভিন্ন সরকারের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল তখন তাদের দরকার ছিল এমনই একজন “প্রজ্ঞাবান” নেতার (রাজার)। কিন্তু সেই দুঃসময়ে তিনি নিজের জনগণকে ফেলে রেখে কোথায় ছিলেন? বাস্তবতা হল – তখন তিনি আশে পাশে ছিলেন না, কারণ, তখন তিনি ভীন দেশী সরকারের কাছ থেকে নিজের একসময়কার দাসানুগ আনুগত্যের প্রতিদানের হিসাব বুঝে নিতেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন! সে এক মোহময় জীবন, কঠিন তার হাতছানি!
(গ) পাকিস্তানীরা পরাজিত হয়ে গেছে, দেশ ততদিনে স্বাধীনও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বীকৃতিকে নস্যাত করার মিশন নিয়ে ত্রিদিব রায় গিয়েছিলেন তার চাকমা জনগণের কোন্ উপকার সাধন করতে? পাকিস্তান রাষ্ট্রের জামাই আদর হালাল করার জন্য সেটুকু কি সেদিন না করলেই চলতো না?
(ঘ) ত্রিদিব রায় যখন এই সব কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন (এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরও), তখন কি তিনি একবারও ভেবেছিলেন যে তার কর্মকান্ডগুলোকেই একদিন সাম্প্রদায়িক অগণতান্ত্রিক শক্তিরা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করবে তারই জনগণের ন্যায্য দাবীগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অজুহাত হিসেবে? তিনি কি তার সম্প্রদায়ের (পড়ুন: প্রজাদের) কথা একবারও ভেবেছিলেন? দেশের বাইরে থেকেও ত্রিদিব রায় সক্ষম হয়েছিলেন নিজ সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। আজও কোনো সংকট হলেই, সমতল-পাহাড়ী বিতর্ক শুরু হলেই একরকম অবধারিতভাবেই এক পক্ষ তুলে ধরে ১৯৭১ এ ত্রিদিব রায়ের ভূমিকা, আর তার জবাবদিহি করতে হয় পাহাড়ীদের অধিকারের/দাবীর পক্ষের সকল একটিভিস্টকে। ত্রিদিব রায় আদিবাসীদের অধিকার, কিংবা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের এজেন্ডার কি উপকার করেছেন তার জীবদ্দশায়, একে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়া?
(ঙ) গত ৪১ বছর তার সম্প্রদায়ের জনগণ যখন কখনো রাষ্ট্রযন্ত্র, কখনো সামরিক ছাউনি, কখনো সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে একের পর এক নিপীড়ন সহ্য করে গেছে – তখন রাজা ত্রিদিব রায় কোথায় ছিলেন? একটা বিবৃতি দিয়েও কি তিনি কখনও পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন? (আমার জানা নেই, কারও জানা থাকলে দয়া করে রেফারেন্স দিয়ে যাবেন)। নিজের আজীবন মন্ত্রীত্বের মসনদ, অনুগত দালালকে দেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্মানের মোহ কি তার কাছে তার জনগণের চেয়েও বেশী দামী ছিল?
১৯৭১ এ ত্রিদিব রায়ের অপরাধগুলোকে জায়েজ করার অপচেষ্টা
অনেককেই দেখছি আবার এটাও ধোয়া তোলার চেষ্টা করছেন এই বলে যে – ত্রিদিব রায় শুধু অখন্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন, তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি! তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি – তিনি এর বাইরেও অপরাধ করেছেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে। এটা ঠিক যে অখন্ড পাকিস্তান চাওয়ায় কোনো আইন ভঙ্গ হয় না, কারণ কারও রাজনৈতিক অবস্থান থাকতেই পারে, সেটা অপরাধ না বরং রাজনৈতিক অবস্থান লালন করা মানুষের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সেটা আর নির্দোষ থাকে না, যখন সেই রাজনৈতিক অবস্থান আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখে, অপরাধীকে মদদ জোগায়, অপরাধ পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখে, অপরাধকে আরও সংঘবদ্ধ এবং ত্বরাণ্বিত করে। ত্রিদিব রায় এর প্রতিটিই করেছেন। ত্রিদিব রায়ের ক্ষেত্রে অপরাধ হল নিজের ‘উর্ধ্বতন অবস্থান’ (Superior Status) কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানী অপরাধীদের সাথে কোলাবোরেশন বা সহায়তা দান (abetment), EPCAF এর মতো অপরাধী সংগঠন/মিলিশিয়াতে (criminal enterprise) যোগদানে উৎসাহ দান বা অন্যান্যভাবে নিজের প্রভাব খাটিয়ে রিক্রুটমেন্টে সহায়তা করা, লজিসটিক্স সরবরাহ করা, উস্কানী প্রদান (incitement) বা উস্কানীদাতাদের সহায়তা প্রদান। আর সব বাদ দিলেও অন্তত একজন বীরশ্রেষ্ঠ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে ত্রিদিবের সহায়ক ভূমিকা তো ছিলোই, যা অন্যান্যদের লেখাতেও উঠে এসেছে (দেখুন)। নিজের ‘উর্ধ্বতন অবস্থান’ অপব্যবহার করা আরেক অপরাধী গোলাম আযমের অপরাধগুলোও ছকে ছক মিলিয়ে ত্রিদিব রায়ের অপরাধগুলোর সাথে মিলে যায়, কেবল অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রটুকু সেখানে আলাদা। ত্রিদিব রায়কে যদি নির্দোষ বলতে হয় তাহলে গোলাম আযম এবং নিজামীকেও নির্দোষ বলতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইন ১৯৭৩ পড়ে দেখার আহ্বান রইলে সবার প্রতি, সেখানেই অপরাধের তালিকা এবং এর সংঘটনের শর্তাবলী ও দায়বদ্ধতার বিধান সংক্রান্ত উত্তরগুলো পাওয়া যাবে। তিনি অভিযুক্ত হওয়ার মত কোন আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছেন কি করেননি তা আইনেই বলা আছে। আর তার কৃতকর্ম ‘যুদ্ধাপরাধ’, নাকি ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’, নাকি ‘জেনোসাইড’ নাকি ‘আন্তর্জাতিক আইনভুক্ত অন্য কোন অপরাধ’ এগুলোর ঠিক কোনটির আওতায় পড়বে, সেটাও নির্ভর করবে তদন্ত এবং চার্জের ওপর। দুঃখজনক হল সে সুযোগ আর হলো না, কিন্তু তাতেও কোনো কিছু পরিবর্তন হয় না; হিটলারকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কাঠগড়ায় তোলা হয়নি কখনো, কিন্তু সেটা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেনি, ত্রিদিব রায়কেও করবে না। আজকে গোলাম আযমের যদি বিচার নাও হোতো, তারপরও বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১-এ গোলামের অপরাধী ভূমিকা অনুধাবনে কোনো ভুল করতো না।
ধন্যবাদ।
——————–
প্রাসঙ্গিক পাঠ:
১। অমি রহমান পিয়াল, ‘রাজা(কার) ত্রিদিব রায় : এ লাশ সইবে না বাংলার মাটি‘
২। ফজলুল বারী, ‘রাজাকার পাকিস্তানি কুলাঙ্গার ত্রিদিব রায়ের ডাম্পিং প্লেস আমার বাংলাদেশ না‘
৩। প্রীতম দাস, ‘এখন যৌবন যার . . . ‘
৪। নিঝুম মজুমদার, ‘প্রিয় স্বদেশ, কী করে বইবে তুমি ত্রিদিবের বোঝা?‘
৫। অমি রহমান পিয়াল, ‘প্রতিক্রিয়া নোট: রাজা ত্রিদিব ও রাজাকার ত্রিদিব : ত্রিবিধ কথা (কুলদা রায়)‘