কবি শামসুর রাহমানের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, নাম ‘সফেদ পাঞ্জাবী’। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর উপর লেখা কবিতাটি। কবিতাটিতে শামসুর রাহমান অবিসংবাদিত এই জননেতার মনুমেন্টাল চরিত্রটি তুলে ধরেছেন। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে একজন অসাম্প্রদায়িক মাওলানার মানবপ্রেমের গাথা কবি এখানে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। বাম চেতনার প্রতিভূ এই কমিউনিস্ট মাওলানা সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং এই আদর্শে লক্ষ কোটি বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।
তবে এ বছরের ৬ এপ্রিল ঢাকায় লক্ষাধিক সফেদ পাঞ্জাবিওয়ালার যে-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো, তা কবি শামসুর রাহমানের ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতার মূল সুরকে ছিন্নভিন্ন করে এবং ভাসানীর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করে যেন একটি সফেদ সন্ত্রাসের রুপ পরিগ্রহ করেছিল। সমস্ত বাংলাদেশ শুধু তাকিয়ে দেখলো আর ভাবলো, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো আমাদের চেনাজানা ভূবনের বাইরে থেকে পঙ্গপালের মতো একদল লোক আমাদেরকে তাদের রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে আবার তাদের ডেরায় ফিরে গেল। হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ছিল আয়োজক এই সফেদ সন্ত্রাসের। তারা ‘ইসলাম গেল’ ধুয়া তুলে মুক্তচিন্তার আদর্শে বিশ্বাসী ব্লগারদের ফাঁসি চাইলো, নারীদের অবরোধবাসিনী করা সহ নানা অবমাননাকর বক্তব্য দিলো এবং সেই সাথে একজন নারী সাংবাদিককে বেধড়ক পেটালো। নারীর বিরুদ্ধে তারা কত কী যে করতে পারে তার একটা নমুনা প্রদর্শন করে গেলো। আর সবশেষে জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করে গেলো — যা এই বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর ঘৃণিত বাসনার প্রতিফলন। এই ১৩ দফা দাবির মধ্য দিয়ে নারীদের অপমান করা হয়েছে, মুক্তচিন্তাকারী মানুষদের অপমান করা হয়েছে, শিল্পীদের অপমান করা হয়েছে, অন্যধর্মের সংস্কৃতিকে অপমান করা হয়েছে এবং সর্বো্পরি প্রকৃ্ত ইসলামের চেতনাকেও ধুলায় লুণ্ঠিত করা করেছে।
বাংলাদেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের এই মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনা বাস্তবায়নের নীল নকশার খসড়া। আমার জানামতে অনেক বিবেকবান মানুষই তাদের আস্ফালন আর টিভির পর্দায় দেখতে চায়নি, ঘৃণাভরে টিভির সুইচ অফ করে দিয়েছে। বিশেষ করে নারী সমাজ ফুঁসে উঠেছে তাদের এই সফেদ সন্ত্রাসে। তবে আশার কথা এই হুঙ্কারে কেউ গুটিয়ে যায়নি। বরং তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যেদিন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে হেফাজতের সন্ত্রাসীরা আক্রমণের পায়তারা করছিলো সেদিন আমি দেখেছি মধ্যবয়সী নারীদেরকেও লাঠি হাতে তুলে নিতে। নারীরা সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং রুখে দাঁড়ায়, যে-কারণে মৌলবাদী হেফাজতিদের প্রধান টার্গেট নারী সমাজ।
হেফাজতিদের ১৩ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্ত ভাস্কর্য অপসারণ করতে হবে। এই দাবির সাথে আমরা যোগসুত্র খুঁজে পাই তালেবানদের ঐতিহ্যবাহী বামিয়ান বৌদ্ধ মূর্তির ভাঙার ঘটনার, এবং তারা যে প্রকারান্তরে এ-দেশে একটি তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা-ই এ দাবি প্রমাণ করে। উগ্র ইসলামপন্থীদের সাথে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে বঙ্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন তলোয়ারের জোরে এবং বিভ্ন্নি হিন্দু ও বৌদ্ধ কেন্দ্র ধ্বংস করেছিলেন। এমনকী বিহারের বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যলয়ও ধ্বংস করেছিলেন তিনি। বখতিয়ার ছিলেন ভিনদেশী, কিন্তু হেফাজতিরা তো এই দেশী। তবে কি তাদের মধ্যে ভিনদেশী তু্র্কি, আফগান, পাকিস্তানি প্রেতাত্মা ভর করেছে? আসলে হেফাজতিদের ভয় হাজার বছরের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিকে; কারণ এই সংস্কৃতি উগ্র ইসলামকে সমর্থন করে না, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সমন্বয়ধর্মী সুফিবাদকেই বুকে লালন করে।
মুঘলরা এ-দেশের শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তাদের রোল মডেল ছিল পারস্যের সংস্কৃতি। তারা পারস্যদেশ থেকে ওস্তাদ মনসুর, রিজাই আব্বাসির মতো শিল্পীদের এই দেশে আমন্ত্রণ করে এনেছিলো এবং শক্তিশালী মুঘল মিনিয়েচারের ধারা এই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো। পাশাপাশি সুফিরাও এদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে, তবে তাঁরা ছিলেন অহিংস, শান্তিপ্রিয়। তাঁরা ধর্মীয় উগ্রতাকে প্রশমিত করে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। এবং হাজার বছর ধরে বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে।
তাহলে হেফাজতের সমস্যা কোথায়? ওদের সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটছে, এবং ধীরে ধীরে ধর্মান্ধতার কবর রচিত হচ্ছে। আর ধর্মান্ধতাই হচ্ছে হেফাজতিদের ব্যবসার প্রধান পুঁজি। তাই তথাকথিত ১৩ দফার মধ্য দিয়ে সমস্ত জাতির সাথে দ্বৈরথে লিপ্ত হয়ে তাদের বাঁচার এই শেষ মরিয়া চেষ্টা। তবে এই ১৩ দফা প্রচারের মধ্য দিয়ে মৌলবাদী হেফাজতিরা নিজেরাই তাদের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলো।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
অদিতি কবির - ১৪ জুন ২০১৩ (৮:২১ পূর্বাহ্ণ)
সরকার যেভাবে এইসব তথাকথিত ইসলামের ধ্বজাধারীদের মদত দিচ্ছে তাতে আমি আর কোন আশা দেখি না।