এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, পহেলা বৈশাখ আজ আমাদের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির জীবনে এমন এক উৎসব যাতে কোনো ধর্মীয় প্রভাব নেই, একেবারে নিরেট খাঁটি সেকুলার উৎসব। এবং বাঙালি জাতিসত্তার একেবারে অন্তঃমূল থেকে উৎসারিত একটি প্রাণের উৎসব। বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান, এই দিনেই যেন সবাই একযোগে গেয়ে ওঠে, আমরা সবাই বাঙালি। এবং বাঙালি জাতির উপর যখন কোনো আঘাত আসে তখন এই পহেলা বৈশাখই আমাদের প্রেরণা যোগায় সেই অপশক্তিকে প্রতিহত করার জন্য। পৃথিবীর সমস্ত বাংলাভাষীদের কাছে এই উৎসব এখন একটি প্রাণের উৎসব। চীনাদের বসন্ত উৎসব তথা চীনা নববর্ষ যেমন চীনা জাতির সমস্ত মানুষকে একই আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়, তেমনি ইরানিদের নওরোজে একইভাবে সমস্ত দেশে উৎসবের ফল্গুধারা বয়ে চলে। আবার বিভিন্ন জাতির নববর্ষ উদ্যাপনের মধ্যে নানা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন চীনারা নববর্ষে ড্রাগন-নৃত্য সহযোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে এবং পটকা ও বাজি পোড়ায়; এক্ষেত্রে তাদের ধারণা পটকার আওয়াজে অশুভ শক্তি দূরীভূত হবে। আরেকটি বিষয় খূব গুরুত্বপূ্র্ণ, তা হচ্ছে আমাদের চৈত্র সংক্রান্তির মেলা কিংবা বৈশাখী মেলার আদলে চীনেও টেম্পল ফেয়ার বা মন্দির-মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে-শহরেও চৈত্র সংক্রান্তির যে-মেলা অনুষ্ঠিত হতো কিংবা এখনও হয়ে থাকে তাও মন্দির প্রাঙ্গণে বা বিভিন্ন কালীবাড়িতে হয়ে থাকে। যদিও আমাদের অনেক মেলা হারিয়ে গিয়েছে তবে বর্তমানে তার আবার একটি পুনর্জাগরণ ঘটেছে। জাতীয়ভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সাংগঠনিক উদ্যোগে নানা জায়গায় বৈশাখী মেলা আয়োজিত হচ্ছে। চীনের মতো বাংলাদেশেও নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন আছে এবং ঐতিহাসিকভাবেই তা ছিল; তবে নানান ঘাত-প্রতিঘাতে এবং বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাতের কারণে আমাদের অনেক আচার অনুষ্ঠানই হারিয়ে যেতে বসেছিল। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে দেশব্যাপী চারুশিল্পীদের উদ্যোগে নতুন করে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় এবং তারপর থেকেই সারা দেশ জুড়ে আবার তা রেওয়াজে পরিণত হয়।
আমাদের বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্যে মিশে আসে এই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। তবে এই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে অনেক ছন্দপতন ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাববার আঘাত হেনেছে বাঙালি সংস্কৃতির উপর এবং পৃথিবীর বুক থেকে ধর্মের নামে বাঙালি সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তবে বাঙালি জাতি সবসময় তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পরাজয় ঘটে। বাঙালি জাতি স্বাধীন জাতি হিসাবে পৃ্থিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়ায় এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার এক ব্যাপক বাতাবরণ তৈরি হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে আবার ধর্মান্ধ গোষ্ঠী মাথা চাড়া ওঠে এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সাথে মিলে বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দীর্ঘদিন তারা দেশ শাসন করে এবং বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধে নানা প্রচারে মেতে ওঠে।
নব্বই দশকের শুরুতে ১৪০০ সাল উপলক্ষে বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ ব্যাপকভাবে উদ্যাপিত হয়। যদিও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ছায়ানটের উদ্যোগে প্রতিবছর রমনার বটমূলে বর্ষবরণের সাঙ্গীতিক আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তবুও ১৪০০ সালের নানামুখী আয়োজনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখের আয়োজনটি যেন আরো জমজমাট হয়ে উঠলো। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চারুকলার উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৈশাখ উদ্যাপনের আবেদন যেন বহুলাংশে বৃ্দ্ধি পেল। এবং এর পর থেকে প্রতি বছর এই আয়োজনটি সংগঠিত হয়ে আসছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে যেন আমাদের হাজার বছরের লোক-ঐতিহ্য নতুন করে জেগে উঠলো। শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ হিসাবে উঠে এলো লোকশিল্পের নানা মাধ্যম। কখনো-বা ময়মনসিংহের টেপা পুতুল, কখনো গ্রামীণ নকশি পাখা, কখনো-বা বহুবর্ণিল লক্ষ্মীর সরা, আবার মেলার ঘোড়া, লোকজ হাতি কিংবা বাঘ। আর নানা নকশার বিস্তর মুখোশ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের আগে মাসাধিক কাল সময় নিয়ে চারুশিক্ষার্থীরা রাতদিন পরিশ্রম করে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি এইসব মডেল বানাতে বাশের চটা, চট, কাগজ এবং রঙ ব্যবহার করা হয়। বৈশাখের প্রভাতে ঢাকের আওয়াজের সাথে সাথে শুরু হয় শোভাযাত্রা, ধীরে ধীরে তৈরি হয় বিশাল জনস্রোত, কেউ কেউ ঢাকের তালে তালে নৃ্ত্যের বোল তোলে। সবার হাতে হাতে শোভাযাত্রার উপকরণ – কারো হাতে মুখোশ, কারো হাতে মাঙ্গলিক পাখি। মিছিল এগিয়ে যায়, সবার চোখে মুখে প্রত্যয়, বাঙালি সংস্কৃতিকে রক্ষার। জনস্রোতের মাঝ থেকে উঠে আসে বিশালাকৃ্তির পৌ্রাণিক হাতি অথবা হাজার বছরের লোকজ ঘোড়া কিংবা কোনো শুভসূচক প্রাণীর অবয়ব যা অশুভকে বিনাশ করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু একটি শোভাযাত্রাই নয়, বরং এটি এখন জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নতুন নতুন ভাবনা বা থিম যুক্ত হয় এই শোভাযাত্রায়। আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসাবে এই শোভাযাত্রা একটি জাতীয় কার্নিভালে রূপান্তরিত হয়েছে। পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে রমনার বটমূলে চলতে থাকে ছায়ানটের উদ্যোগে নতুন বছরকে আবাহনের সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও পঞ্চকবির গানে মুখরিত হয়ে ওঠে এই প্রাঙ্গণ; আর এদিকে চারুকলায় চলতে থাকে দৃশ্যশিল্পের এক অনবদ্য প্রদর্শনী। এ-কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, বৈশাখের প্রথম প্রহরে দারুণ শিল্পময় হয়ে ওঠে রমনা ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এবং তা একান্তই বাঙালির শিল্প।
নব্বই দশকের বৈশাখী মহাজাগরণের চেতনা সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আজকে দেশের জেলা উপজেলা, থানা মহল্লা গ্রাম গ্রামান্তরে সর্বত্র ব্যাপকভাবে বৈশাখ উদ্যাপিত হয়। বাঙালির চেতনার গভীর থেকে উৎসারিত এই বৈশাখ উদ্যাপন মানে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার চর্চা। এই বৈশাখ উদ্যাপন মানে বাঙালি সাংস্কৃতির চর্চা। এই বৈশাখ উদ্যাপন মানে স্বাধীন বাঙালির সত্তার উন্মেষ। এই বৈশাখ উদ্যাপন মানে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রত্যয়। টিএসসি থেকে চারুকলা, চারুকলা থাকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে রমনার বটমূল – এ যেন বাংলার বৈশাখতীর্থে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার নরনারী বাঙালি সাজে উৎসবে যোগ দিয়েছে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। বৈশাখের প্রথম সকালটি যেন লক্ষ-কোটি বাঙালির ঐক্যের প্রতীক হয়ে জ্বলে ওঠে।
শুধু একদিনের বাঙালি নয় বরং বৈশাখী মহা জাগরণের মধ্য দিয়ে কি শিল্পে কি সাহিত্যে কি সঙ্গী্তে কি জীবনযাপনে বাঙালি জাতি এখন অনেক বেশি শেকড়-অন্বেষী।
