একজন ফকির হায়দার বাবা এবং কিছু প্রশ্নরেখা…

সম্ভবত বছর দুয়েক আগের ঘটনা। মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে বেরিয়ে রিকশায় মিরপুর ১-এর দিকে যাচ্ছি। হযরত শাহ আলী মাজারের কাছাকাছি আসতেই রিকশার গতি মন্থর হলো। [...]


সম্ভবত বছর দুয়েক আগের ঘটনা। মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে বেরিয়ে রিকশায় মিরপুর ১-এর দিকে যাচ্ছি। হযরত শাহ আলী মাজারের কাছাকাছি আসতেই রিকশার গতি মন্থর হলো। সামনে মোটামুটি হৃষ্টপুষ্ট একটা মৌন মিছিলের মতো। ধীর গতিতে, সম্ভবত মাজারের দিকেই যাচ্ছে। কোনো অকেশন-টকেশন আছে কিনা জানি না। পাশ কেটে ওভারটেক করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সবার হাতেই কোনো না কোনো খাবারের পোটলা বা ভাণ্ড। ফল-পসারি পানির বোতলও আছে অনেকের হাতে। মিছিলের অগ্রভাগে বেশ ময়লা-অপরিষ্কার জীর্ণ-শীর্ণ আলখাল্লা পরিহিত একজন বেটেখাটো শ্মশ্রু-গুম্ফধারী দরবেশ টাইপের বৃদ্ধলোক আপন মনে দুলে দুলে হাঁটছেন মাথাটাকে সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে। সামনের দিকে দু-একজনকে আবার অনেকটা শৃঙ্খলারক্ষার ভঙ্গিতে তৎপর দেখা গেলো। উনি কে? জিজ্ঞেস করতেই রিকশাচালক বললো, ‘হায়দার বাবা, বড় কামেল ফকির!’

এসব ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে যথেষ্ট ঘাটতি থাকলেও মানব-মনস্তত্ত্বে কৌতূহলের কোনো কমতি নেই। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে আকস্মিক ও নতুন হলেও এলাকাবাসীর কাছে খুবই সাধারণ একটা বিষয় বলেই মনে হলো। ছবি নেয়া হলো না বলে আফসোস হলো। যাক, এদিনের মতো কৌতূহলটা ঝুলে রইলো।

বছর খানেক পরে একদিন। মোবাইল ক্যামে সংরক্ষিত তারিখে ১৭-০৬-২০০৯। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। অফিস-ফেরতা মানুষের ভিড়ে আশপাশ সরব। মিরপুর পোস্টাফিসটার সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে হঠাৎ মিছিলটা নজরে এলো। ফকির হায়দার বাবা! দুই-মেগাপিক্সেলটা যে আসলেই রাতকানা, টের পেলাম ছবিটা কম্প্যুটারে আপলোড করেই (শীর্ষ ছবি) — কিছু ভৌতিক ছায়ার মতো মনে হচ্ছে মানুষগুলোকে।

এরপর আরেকটা বছর প্রায় ঘুরে এলো। ২৫ মার্চ ২০১০ বিষ্যুদবার। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। মিরপুর পোস্টাফিসেরই ফাঁকা চত্বরটাতে অনেক মানুষের জটলা দেখে কৌতূহল হলো। বিশ্রামরত ছোটখাটো একটা কাফেলা যেনো। কৌতূহলী মানুষের ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। আপাতদৃষ্টিতে খুব নোংরা মলিন পোশাকে উস্কুখুস্কু দাঁড়ি-গোঁফধারী ছোটখাটো আকৃতির বৃদ্ধ লোকটি কাত হয়ে মাটিতে শুয়ে আছেন দেয়াল ঘেঁষে। শরীরের উন্মুক্ত অংশে হাতে পায়ে সাফ না করা বহুদিনের ময়লার পুরু স্তর কালো হয়ে বসে আছে তা স্বাভাবিক চোখেই ধরা পড়ে। আর বেশ কিছুসংখ্যক নারী-পুরুষ হরেক রকম খাবারের রসদ নিয়ে তাঁকে ঘিরে আছে। চৈতের দাবদাহে কেউ কেউ হাতপাখায় বাতাস করছে তাঁকে। চিনতে কষ্ট হলো না — ফকির হায়দার বাবা। আশে পাশে আরো কিছু নারী-পুরুষের জটলা। বোঝা গেলো, এরা সবাই বাবার ভক্ত-আশেকান।

দুপুরেও দৃশ্যের কোনো হেরফের ঘটলো না। একইরকমভাবে ফকির বাবা শুয়ে আছেন, আর ভক্তরা তাঁকে বেষ্টন করে আছে। এবার আর আগ্রহ দমিত রাখতে পারলাম না। সুস্থ হোক বা অসুস্থ হোক বা অন্য কিছুই হোক, জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে বিশ্লিষ্ট একজন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি না হয় অজ্ঞাত কোনো কারণে একটা বোহেমিয়ান জীবনের অভ্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ভক্ত নামের এই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষগুলো কিসের টানে কিসের আশায় তাঁর পিছে পিছে এমন অনির্দিষ্ট সময় ধরে অনিশ্চিত গন্তব্যে ঘুরছে? কোথাও কোনো সমস্যা না হলে কেন এই মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবনস্রোত ছেড়ে এসে আরেকজন ছন্নছাড়া মানুষের পিছু পিছু এভাবে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াবে? এটা কি কোনো নেশা? কোনো মাদকতা? না কি অজ্ঞাত কোনো সমস্যা থেকে মুক্ত হবার অসহায় ভরসা? এই ধৈর্য্যরে রহস্য কোথায়? কৌতূহল নিবৃত্ত করতে দেখতে-শুনতে শিক্ষিত গোছের কয়েকজন ভক্তের পাশে আমিও বসে গেলাম। মৃদু আলাপচারিতা থেকে যতটুকু জানা যায়।


যার সাথে আলাপ করছিলাম, তিনি মিরপুরের একজন ব্যবসায়ী। বিষ্যুদবার মার্কেট বন্ধ থাকে বলে মনের টানে ফকির বাবার কাফেলায় এসে যোগ দিয়েছেন। সারাদিন বাবার পিছে পিছে কাটাবেন। দিন শেষে ফিরে যাবেন নিজের ঠিকানায়। পরদিন থেকে যথারীতি তাঁর নিজস্ব জীবন, ব্যবসায়।

ফকির বাবা সম্পর্কে তথ্য জানাতে গিয়ে তাঁকে বেশ সতর্ক ও অতিশ্রদ্ধাশীল মনে হলো। কী জানি প্রদত্ত তথ্যে কোনো ভুল হয়ে যায়, তাই বারেবারে নিজের অজ্ঞতা ও আশঙ্কা প্রকাশ করতে ভুল করলেন না। জানা গেলো, ফকির বাবাজির নাম হচ্ছে হযরত জুলফিকার আলী হায়দার। ভক্ত-আশেকানরা তাঁকে বাবা বলে ডাকে। পাকিস্তান আমলে নাকি বেশ বড়সড় পদে চাকরি করতেন। সবসময় নীরব থাকতে অভ্যস্ত তাঁকে খুব একটা কথা বলতে দেখা না গেলেও উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষিত বাবাজি নাকি কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী। এককালে সংসারও করেছিলেন, পুত্র-পরিজনও রয়েছে তাঁর। তবু কী জন্য হঠাৎ করে ঘরবিবাগী হয়ে গেলেন তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। কিন্তু সহজে এর সদুত্তর পাওয়ার আপাতত কোনো কায়দা নেই। কোনো নির্দিষ্ট অবস্থানে বেশিক্ষণ ঠাঁই না গাড়া এই ফকির বাবাজির আধ্যাত্মিক পর্যায়ে যে অতি উচ্চ মাপের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এ ব্যাপারে তাঁর ভক্তরা একেবারে নিঃসন্দেহ, তা তাদের ভাবাবেগপূর্ণ কথাবার্তা থেকেই টের পাওয়া যায়। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা খানকা রয়েছে তাঁর। কোনো আশেক-ভক্তের দেয়া বিশাল বাড়িটিতে তিনি কত সময় অবস্থান করেন সেটা বিবেচ্য না হলেও ওখানে নাকি সারাক্ষণই ভক্তদের আনাগোনা রয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে অবস্থাসম্পন্ন ভক্তদের পাঠানো খাবার-দাবারের আয়োজনও রয়েছে প্রচুর মাত্রায় বলে শোনা যায়। এছাড়া নূরজাহান রোডে এবং আরো কোথায় কোথায় যেন তাঁর আখড়া রয়েছে ভক্তদের দান করা বাড়িতে।

এতকিছুর পরও ফকির বাবাজির ঠিকানা মূলত রাস্তাই। লক্ষ্যহীন ছুটে চলায় বিরাম নেই। পেছনে পেছনে ভক্ত-আশেকানদের কাফেলা। কিন্তু কাউকে কিছু বলেনও না। হাতে তাদের বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য। কোথাও গিয়ে হয়তো বাবাজি বসে পড়লেন। সাথে সাথে সবাই। চলার পথে এই কাফেলায় কেউ কেউ এসে যোগ দেয়, কেউ হয়তো চলেও যায়। কিন্তু কোথাও বাবাজিকে একাকী দেখা যায় না। আলাপের প্রেক্ষিতে জানা গেলো, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে বাবার কাফেলায় আসে। পিছু পিছু হাঁটতে থাকে অনিশ্চিত। এটা নাকি বাবার অনুকম্পা পাওয়ার একমাত্র উপায়। হয়তো কাউকে ইঙ্গিতে চলে যাবার ইশারা করলেন, ধরে নেয়া হয় তার মানত পূর্ণ হয়েছে। বিশাল এক তৃপ্তি নিয়ে ফিরে যায় সে। বুঝি সব মুশকিল আহসান হতে চললো এবার। এরপর আবারো হয়তো আসে তারা, সেটা একান্তই মনের টানে। একধরনের আধ্যাত্মিক তৃপ্তিবোধ থেকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেউ বাবাকে স্পর্শ করতে পারে না, কাউকে স্পর্শ করতে দেন না তিনি। দুনিয়াটা আসলেই বড় বিচিত্র। তার চেয়েও বিচিত্র বুঝি দুনিয়ার মানুষগুলাই!

হঠাৎ বাবাজি নড়েচড়ে উঠলেন। ঘুম ভেঙে গেছে হয়তো। একটু পরই তিনি উঠে বসলেন, দেয়ালে হেলান দিয়ে কুঁজো হয়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কলার কাঁদিটার দিকে হাত বাড়ালেন। একটা কলা তাঁর হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো। নিজ হাতেই ছিলে নিলেন তিনি। অতঃপর বাকি কলাগুলো ভক্তদের হাতে হাতে ভাগবাটোয়ারা হতে লাগলো। সাথে অন্যান্য খাবার-দাবারও। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, বাবাজির কি কখনো অসুখ-বিসুখ হয় না…?’ প্রশ্ন শেষ করা হয়নি, তার আগেই পাশের নেতা গোছের ভক্ত ভদ্রলোক বেশ উষ্মার সাথে কাউন্টার দিলেন, ‘আপনি এরকম আপত্তিকর প্রশ্ন করছেন কেন?’ আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তিনি বলেই চলছেন, ‘আপনার এতো আগ্রহ থাকলে আপনি কিছুদিন আসতে থাকেন, তখন একটু একটু করে বুঝতে পারবেন!’ বুঝলাম, আপাতত আর কিছু জানার সুযোগ এ মুহূর্তে নেই।

একটু দূরেই আরেকটা জটলার মধ্যে একজন পরিচিতা চাকুরে ভদ্রমহিলাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। কথার শুরুতেই বুঝলাম একেবারে অন্ধভক্ত তিনি। তাঁর বাসাও নাকি বাবাজির খানকা শরীফের কাছেই। চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো তিনি ভাবের ঘরে অবস্থান করছেন। বাবাজি সম্পর্কে আগ্রহের কথা জানাতেই অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বললেন যে তাঁর কাছে একটা ম্যাগাজিন আছে যেখানে হায়দার বাবা সম্পর্কে অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ওটা পড়লেই তাঁর সম্পর্কে অ-নে-ক কিছু জানা যাবে। ম্যাগাজিনটির নাম বলতে না পারলেও ওটা তিনি আমাকে ধার দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন। অতঃপর বাবাজি তাঁর কাফেলা নিয়ে রয়ে গেলেন, আমি আমার কাজে চলে গেলাম। পরে জানলাম যে সন্ধ্যার আগে আগে বাবাজি এখান থেকে ঊঠে গেছেন। কাফেলাও তাঁর পেছনে গেছে।

নির্দিষ্ট দিনে ভদ্রমহিলার অফিসে গেলাম ম্যাগাজিনটির জন্য। কথা অনুযায়ী তিনি আনেননি ওটা। যাক, অন্যদিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরে এলাম। কথাপ্রসঙ্গে একজন সহব্লগার অনুরোধ করেছিলেন হায়দার বাবাজিকে নিয়ে একটা ছবিপোস্ট দেয়ার জন্য। সাথে আমার কৌতূহল ছিলো কিছু প্রশ্ন খোঁজা। দ্বিতীয় দিন ম্যাগাজিনটির খোঁজে ভদ্রমহিলার ওখানে গিয়ে ভিন্ন পরিস্থিতি। তিনি আমাকে দেখেই বলে ওঠলেন, ‘দেখেন, ম্যাগাজিনটা আপনাকে দিতে হলে তাদের অনুমতি লাগবে।’
‘কাদের অনুমতি!’ আমি রীতিমতো বিস্মিত।
তিনি এর কোনো সুস্পষ্ট জবাবে না গিয়ে আমতা-আমতা করে তাঁর অপারগতা প্রকাশ করলেন। আমি আর খোঁচাখুঁচি করলাম না। কারণ আমার কিছু উত্তর পেতে দুয়ে দুয়ে চার হিসাব মেলার জন্য সম্ভবত এটাই স্বাভাবিক ছিলো। ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। বুঝে গেলাম, ডালমে কুছ কালা হ্যয় !


বাঙালির চিরায়ত লোকমানসে সহজিয়া ভাবের প্রভাব সেই আদিকাল থেকেই যথেষ্ট প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সাথে মানু্ষের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কায়িত শাসন-অনুশাসনের বিপরীতে আউল-বাউল-ফকির-দরবেশ জাতীয় সহজিয়াপন্থী মতবাদীদের মধ্যে আশেক-মাশুক সম্পর্কের এক অদ্ভুত রহস্যময় বৈচিত্র্যের কারণেই বাঙালির আগ্রহ সবসময়েই এদিকেই বেশি দেখা গেছে। হয়তো এটাই বাঙালির প্রাণের ধারা। সংস্কৃতির গভীরেই এই ধারা প্রোথিত হয়ে আছে। বাঙালির নাড়িতে এই সহজিয়া সুরই চিরকাল টঙ্কার তোলে এসেছে, এখনো তোলে। এছাড়া আমাদের পিছিয়ে পড়া সমাজটাতে আদিম টোটেম-বিশ্বাসগুলোও বাঙালির ভাবজগতে সমভাবে বহমান বলে রহস্যময়তার সাথে অলৌকিকতাকে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা বাঙালি বৈশিষ্ট্যে খুবই ক্রিয়াশীল এখনো। ফলে পীর মুর্শিদ দয়াল ফকির গুরু আউল বাউল সাঁই-বন্দনা বাঙালির আধ্যাত্মিক তৃপ্তির সবচাইতে বড় অনুষঙ্গ আজো। আর তাই প্রচলিত ধর্মীয় অনুশাসনের সমান্তরালে পরস্পরবিরোধী হয়েও এই ধারাটি বাঙালি জীবনধারার সাথে মিশে গেছে ওতপ্রোতভাবে। কোথাও কোনো ছন্নছাড়া গোছের কিছু বা কাউকে দেখলে, যদি সেখানে কোন রহস্যের উপাদান উপস্থিত থাকে, তাহলে এতে কল্পনা মিশিয়ে অলৌকিকতা আবিষ্কার করে ফেলার সৃজনশীলতায় এ জাতির কখনোই ঘটতি পড়েনি। এর পর যা হবার তা-ই হয়। অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত বঞ্চিত পীড়িত মানুষের ঢল নামতে থাকে সেই গড়ে তোলা ফকির-দরবেশের কাছে, কিংবা আখড়ায় বা দরবারে। স্বাভাবিকভাবে যে সমস্যার সমাধান করায়ত্ত করা সম্ভব নয় বলে মনে হয়, তা সমাধানের ভার যে এসব তথাকথিত অলৌকিক মাধ্যমগুলোতে সমর্পণ করে ভারমুক্ত হবার অসহায় সান্ত্বনা খোঁজা মাত্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবেই এই বাঙাল-ভূখণ্ড জুড়ে যত্রতত্র অগণিতহারে গজিয়ে উঠেছে কতো মাজার খানকা পীর দয়াল গুরুর আখড়া এবং আগামীতেও হয়তো আরো গজাতে থাকবে।

এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অন্তত দু’ধরনের লোকের আনাগোনা বেড়ে যায়। সহজ সরল ভীরু অসহায় মানুষগুলোর কথা আর না বললাম। এরা আসে একটা অবলম্বনের খোঁজে। সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে সরল বিশ্বাসে ভক্তিভরে ফকিরবাবাদের কাছে আসে নিজেদের মানত পুরা করতে। আর এদের এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এখানে সমাবেশ ঘটে সেইসব চতুর সুবিধাবাদী প্রতারক শ্রেণীর মানুষের, যাদের লক্ষ্য একটাই, যেভাবে যার কাছ থেকে যা পারে হাতিয়ে নেয়া। নগদ বাণিজ্যের এই প্রবণতাই মূলত এসব মাজার ব্যবসার একমাত্র প্রতিপাদ্য। তিলকে তাল বানিয়ে স্রেফ একজন বিকারগ্রস্ত অসুস্থ মানুষকেও সাক্ষাৎ কামেল পীর দরবেশ বানিয়ে ফেলায় সিদ্ধহস্ত ফেরেববাজ এরা। কখনো কখনো নিজেরাই ভণ্ডপীর সাজার উদাহরণও এদেশে কম নেই। একান্ত করিৎকর্মা সাগরেদ ভক্ত সেজে এরা শুধু যে বর্তমান ব্যবসার ক্ষেত্রটাকে সাবলীল করে তোলে তা-ই নয়, আগামীর অতিসম্ভাবনাময় একটা দুর্দান্ত ব্যবসার ক্ষেত্রও পাকাপোক্ত করে ফেলে। জীবিত ফকির বাবাকে একটা বাড়ি দান করে ফেলার উৎকৃষ্ট মাজেজা হয়তো এটাই যে, মৃত্যুপরবর্তী স্বর্ণডিম্ব প্রসবকারী একটা মাজার প্রতিষ্ঠার আগাম বীজ রোপণ করে নেয়া। কেননা শেষপর্যন্ত এসবের দেখভালের দায়িত্ব তো এই একনিষ্ঠ ভক্তদেরকেই নিতে হবে! এরা জানে, আমাদের দেশে সবচাইতে প্রতিশ্রুতিশীল ও অতিসম্ভাবনাময় ব্যবসা পণ্যটি হলো পীর ফকির সাধু দরবেশ ইত্যাদি। আর অতিমুনাফাকারী ব্যবসাক্ষেত্রটির নাম আশ্রম বা মাজার। তাকে যতই বিজ্ঞাপিত করা যাবে, ব্যবসায় শনৈ শনৈ উন্নতি অবশ্যম্ভাবী, একে ঠেকায় কে!

দেখতে একান্তই সাদাসিধে ভবঘুরে ফকির হায়দার বাবাকে নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে এ কথাগুলো বলা না হলেও তাঁর মৃত্যুপরবর্তী আখড়াটা যে অতিজৌলুসময় অসম্ভব ফলবান একটা মাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না, তা কে বলবে! বরং সে সম্ভাবনাই তীব্রভাবে লক্ষ করা যায়। এতে কারো সন্দেহ থাকলেও থাকতে পারে। তা নিশ্চিত হতে হয়তো সে সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে। কেননা সময় অনেক কিছুরই যথাযথ উত্তর সাজিয়ে রাখে আগামীর জন্যে।

সাবস্ক্রাইব করুন
অবগত করুন
guest

8 মন্তব্যসমূহ
সবচেয়ে পুরোনো
সাম্প্রতিকতম সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
8
0
আপনার ভাবনাগুলোও শেয়ার করুনx
  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.