প্রবাসের শব্দচিত্র দিয়েই শুরু হলো আমার লেখা। ওয়াশিংটন ডিসিতে এখন বসন্ত আসছে। ধীরে ধীরে শীতের চাদর সরে বসন্তের উষ্ণতায় সবুজ হয়ে উঠছে চারপাশ। মার্চের ২৮ তারিখে এখানে শুরু হয়েছে বসন্ত উৎসব। এখানে রমনার বটমূল না থাকলেও জেফারসন মেমোরিয়ালের ঠিক সামনে টাইডাল বেসিনের পাশে মঞ্চে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী চেরী ফুল উৎসব। গান আর নৃত্য দিয়ে মাতিয়ে রাখবে। জাপানীরা ১৯১২ সালে তিন হাজার চেরী ফুলের চারা দিয়েছিল, তা আরও বিস্তৃত হয়ে চারদিকে শুভ্র ফুলের বাহারি শোভা এক সপ্তাহের জন্য ছড়িয়ে দেয়। দর্শনার্থীদের ভীঁড়ে ডিসি হয়ে উঠে জনাকীর্ণ। প্রতি বছরের মতো উৎসব আনন্দে বরণ করা হয় বসন্তকে।
এসব প্রাণবন্ত ছবি আর সচল চিত্র আমাদের চিত্তকে উৎফুল্ল করলেও তার অন্তরালে থাকা চিত্রটা অনেকটা অদৃশ্যই থেকে যায়। এখানে অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো গুটিয়ে ফেলছে তাদের কার্যক্রম। বাড়ছে বেকারত্ব। আজকের সারাদিনের শিরোনাম ছিল: গাড়ী প্রস্তুতকারী কোম্পানী জিএম হয়তো মন্দার ঠেলায় এবার দেউলিয়া ঘোষণা করতে যাচ্ছে। ব্যবসার অবস্থা খারাপ। অবস্থা এতোটাই খারাপ যে, কোন রেসকিউ প্ল্যানই কোন কাজ করছে না। এর মধ্যে সেদিন রেডিওতে একটা খবর শুনে বেশ মজাই পেলাম। ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের এক মশলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এই দু:সময়ে বেশ ভালই মুনাফা করেছে। তাদের বিক্রি বেড়েছে প্রায় শতকরা ১২ ভাগ। হঠাৎ করে আমেরিকানরা অর্থ সাশ্রয়ের জন্য রেস্টুরেন্টে না খেয়ে বাড়ীতে খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বেড়েছে মশলার চাহিদা ও বিক্রয়।
এর মাঝে সরকার স্টিমিউল্যাস প্যাকেজ দিয়েছে। তাতে অর্থনীতি উদ্দীপ্ত হবে কি না জানি না। তবে এখানে অফিসগুলোতে পাক্ষিক বেতনে গড়পড়তা বিশ ত্রিশ ডলার সবাই বেশী পাওয়া শুরু করেছেন। এখানে বেতনের সাথে সাথে আয়কর কেটে রাখা হয়। ফেডারেল সরকার গত দু’সপ্তাহ থেকে আয়করের হার কমিয়ে দেওয়াতে অনেকের বেতন সামান্য পরিমাণ বেড়েছে। জর্জ বুশ ক্ষমতায় থাকা সময় এই একই প্যাকেজের টাকা নগদ এককালীন চেকে দিয়ে দিয়েছিল। ওবামা সরকার তার চেয়ে এক কাঠি সরেস। তারা পুরো টাকা একটি চেকে না দিয়ে তা বেতনের সাথে যোগ করেছে একটু একটু করে। অর্থনৈতিক মন্দার এই মন্দ সময় কখন কাটবে তা কেউ জানে না। সবাই আশা করছে, অবস্থার পরিবর্তন আগামী বছর থেকে শুরু হবে। আর না হলে, ততোদিনে এই মন্দার মাঝে বসবাস করতে লোকজন অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাতে ভোগান্তি এতোটা দু:সহ মনে হবে না। দরিদ্রদের মাঝে দারিদ্রের তীব্রতার অনুভূতি হয়তো একসময় ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু বিত্তবানদের কাছে দারিদ্রের কষাঘাত অসহ্য ও তীব্র মনে হতে থাকে অনভিজ্ঞতার কারণে।
দারিদ্র ও বিত্তের আপেক্ষিক অনুভূতির অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি তার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ বেশ চমকপ্রদ। অনেকদিন আগে এক আমেরিকান অধ্যাপক বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন। টাকা পয়সার কথা আসতেই আমেরিকান প্রফেসর বললেন, “যা সামান্য বেতন পাই, তাতে আর বছর বছর গাড়ীর মডেল চেঞ্জ করা হয়ে উঠে না”। এই কথা শুনে বাংলাদেশী অধ্যাপক বেশ কঠিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আরে বাদ দাও তোমার গাড়ী? যা বেতন পাই তাতে নতুন স্যুট কেনা আর হয় না। ঐ এক প্রস্থ প্রাচীন স্যুট দিয়েই চলতে হচ্ছে”। দারিদ্র আপেক্ষিক। পশ্চিমকে ঈর্ষণীয় প্রাচূর্যের স্থান মনে হলেও দারিদ্রের অনুভূতি কিন্তু অভিন্ন। ভবঘুরে আর ভাসমান মানুষদের এক বাটি স্যুপের জন্য কোন চার্চের বাইরে লাইন করে দাঁড়াতে অনেকদিন দেখেছি। সেই লাইন এখন আরও দীর্ঘ হয়েছে। এক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “ইংল্যান্ডে দরিদ্র হওয়া অপরাধ”। আর এই অপরাধের দায়ভার, ভোগান্তি ও গ্লানি সবসময় দরিদ্রদেরকেই বহন করতে হয়। তা ঢাকার বস্তি হোক আর ডিসি’র গৃহহারাদের জন্য শেল্টার হোম হোক, দারিদ্রের চিত্র আর চরিত্র বড্ডো অভিন্ন। ক্ষুধা, দারিদ্র ও বঞ্চণার কোন রাজনৈতিক সীমান্ত নেই!