ব-দ্বীপের রাজধানী তিলোত্তমা ঢাকার বুকের ওপর তিলের মতো এই যে স্থানটুকু – এই ভূঁইখানি শহরের ওয়ার্মহোলগুলোর একটি। এটি আক্রান্ত অসুখী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ডাকবাকসো। দুই ভুবনের মেলবন্ধন ঘটাবার দীগন্ত, কিম্বা মহাকালের এ ভাঁজে টুপ করে ঢুকে পড়ে জীবন অন্য টাইমলাইনে চলে যায়। রাজনীতির ভডেভিল ট্রুপগুলোর পান্ডুলিপিবিহীন নাট্য সংলাপ ও রাজপথের স্ট্রিপটিজ এবং ইসলামিক দলের শিল্পবুদ্ধির পরিচয় অঙ্কিত দেয়ালসজ্জা পেরিয়ে এখানে সতেরই অক্টোবর কিছু মানুষ মাতা প্রকৃতির কাছে তাদের কন্যা মতিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
বাংলার এ দুহিতাটি বড়ো প্রজ্জ্বলন্ত ছিল! বহু আগে, সে হবে বোধহয় ১৯৬৪ সাল – যখন মেয়েরা তেল চুপচুপ চুল বেঁধে পেতলের কাজললতায় প্রদীপের শিখা থেকে গড়া কাজল চোখে লেপ্টে কণে দেখায় আগত সম্ভাব্য পাত্রপক্ষের সামনে হাঁটু-কম্পিত চরণে ভীরু নতমুখে হেঁটে, বসে বিয়ের ভাইবা দিতো; দুরু দুরু বক্ষে বোনদের সাথে এজমালি কক্ষের কোণটিতে বসে অপেক্ষা করতো “আলহামদুলিল্লাহ”, ঘরভরা হাসি, কিম্বা মায়ের মৃদু কান্না শোনার, সেই কালে- একুশ কি বাইশ বছুরে মতিয়া কিনা তরুণ বজলুর রহমানকে বলেছিলেন, “চলো বিয়ে করে ফেলি।” যেই কথা সেই কাজ।
ষোল তারিখ থেকেই তার সহোদর দৌড়োচ্ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির মহামহা কর্তাদের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে বোনের জন্য কিনতে – শহীদ বুদ্ধিজীবি গোরস্থানের এক টুকরো মাটি। শহীদদের পাশে নয় তো আর কোথায় মুক্তিযোদ্ধা মতিয়া চৌধুরীর শেষ শয়ান হতে পারে? মাটি কেনারই অনুমতি দেয় কে আজ?
তার জন্য আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রাইফেল গর্জে ওঠে নি, হাঁকে নি জলপাই সৈনিকেরা বুটে বুট ঠুকে খটাখট্ স্যালুট। মাথা আমাদের তার কাছে নতই হয়ে রইল, এই ভেবে যে, বাংলার স্বাধীন পলিমাটিটুকুর উত্তরাধিকারী আমাদের রেখে গেলেন মতিয়াদের মতো স্বদেশ মুক্তির ব্রতে প্রাণ বাজি ধরে লড়ে যাওয়া একগুঁয়ে বহু যোদ্ধা। কিন্তু আমাদেরই সন্তানেরা তাদের বিভৎস অসম্মান দিয়ে আঘাত করলো। বহু বছর আগে যার হাত ধরেছিলেন, সেই সঙ্গীর দুধসাদা অস্থি নুহের মহামৎস্যের মতো তাকে নিজ বক্ষে আহ্বান করলে দুধেল জ্যোৎস্নার চাদরে মুখ ঢেকে দর্শনের আলোর বাইরের কোনও ঘেরাটোপে ঢুকে পড়লেন মতিয়া চৌধুরী।
তিনি অন্তর্হিত হতেই যেন চাদ্দিক ঘিরে শ্লথপায়ে মুড়ে এলো সুদীর্ঘ রাজনৈতিক উপন্যাসের প্রচ্ছদ, ঘিরে ধরলো তার জীবনের কাব্যিক আখ্যান। দীর্ঘদিনের দলীয় সঙ্গী ও অনুসারীদের চারপাশে ঘনঘোর হয়ে উঠলো মীথিকাল অতীতে ঘটে যাওয়া কোনও দুঃসময়ের চেহারা ধরে বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তব, কবরখানার দোর গোড়ায় ১৯৮৪, জর্জ অরওয়েলের বিগ্র ব্রাদারের প্রহরীরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে।
সব শেষ হলে ওরা ফিরে আসতে আসতে একটু বুঝি দাঁড়ালো, কেউ কেউ ফিরেও তাকালো কালচে সবুজ হয়ে আসা গোরের পর গোরের দিকে। টের পাওয়া যাচ্ছিল ধীরে বইছে ইতিহাস ভারাক্রান্ত হাওয়া। এখনও এই বুদ্ধিজীবি গোরস্থানেমাটির পাটে পাটে কতো কাহিনী স্তরে স্তরে অতীতের গোপন হিস্যার মতো ফিসফিসায় । গাছের পত্র-পল্লবের মৃদু ঢেউয়ের মধ্যে কাল প্রবাহের নীরব ঘড়ি চলতে থাকে। জীবন্ত মানুষদের ফিরতে হয়। খোকা ফিরলো কিনা জিজ্ঞেস করে লোকে। খুকী ফিরলো কিনা ক’জনই বা তা নিয়ে বেকায়দা কিসিমের কাঁদে, এক জননী ছাড়া?
চকমকে খবরের কাগজের সম্পাদক এরপর মতিয়াকে নিয়ে আর ফ্রন্ট পেজ খবর করে না। তারা তিরিশোত্তর পাকিস্তানের বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনের আদলে কিম্বা তার চেয়ে তীব্র কোন মুসলমানী সাহিত্য ও খবরের ধারা আবিষ্কারে কম্পিউটারে মাথা কুটছে। এডিটরিয়ালে ইসলামী রাজনীতির নেতাদের খবর টেবিলে টেবিলে। সেখানে প্রধান পরামর্শককে কি তুর্কীচালে না মালয়েশিয়ান চালে অভিবাদন জানাবেন, তার বয়ান আসছে দূরালাপনীতে মাইক্রো-ক্রেডিট ভবন থেকে। মডরেট আওয়ামী লীগের আমলে এ সম্পাদকগণ যথেচ্ছা উদারবাদ ও বিচিত্র্যবাদীতার চর্চায় লীগ কতোটুকু পিছিয়ে আছেন তা নিয়ে খেটে জেরবার হতেন। দু’য়েকটি কাগজ মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে না লিখে পারলো না বলে মৃদু রিস্ক নিয়ে ফেললো।
সতেরই অক্টোবর দু’ হাজার চব্বিশ সাল। জুলাইতে বাংলাদেশে যে আগুন জ্বলে উঠেছে তা আর মতিয়াকে ছোঁয় না। তার অনুসারীদের জন্য ব্যাপারটা উল্টো। তাদের জন্য এখন ফেরারী বর্তমান, ভবিষ্যত ক্রুশবিদ্ধ। বাংলার জনগণ যে কমন আছে যদি প্রশ্ন করেন, বলতে হবে তারা তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেই একাত্তর থেকে। এখনও একই শত্রুর আগুনে পোড়া ঘর-বাড়ি, মসজিদ ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেসের মধ্য দিয়ে হাঁটছে ঊনিশশো একাত্তরে যেমন হাঁটতো। কিন্তু একাত্তরের যোদ্ধাদের সংগঠিত করতো যে তিনি নেই।
এই আগুনঝরা কালে বাংলার ইটকাঠ পাথরের নগরের মদ্যিখানে – আজটেক রমণী চিহুয়াতেতোর যুদ্ধের মাঠে গর্ভস্থ সন্তান হারিয়ে ফেলার পরাজয়ে প্রাণত্যাগের মতো – মতিয়া চৌধুরী স্বদেশে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ে পিছু হটতে বাধ্য হওয়া যোদ্ধাদের স্যালুটের মাঝে চলে গিয়ে আচমকা আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আয়নার সামনে। আমরা কে? আমরা কি ছিলাম? কেন আমরা যা হতে চেয়েছি তা না হয়ে, হলাম এই রক্ত-স্নাত পিচ্ছিল মাটির বুকে আজন্ম ফেরার?
আজটেক জনপদের বিশ্বাস ছিলো, নিহত কি মৃত যোদ্ধাদের আত্মা আকাশের পৃথক পৃথক অঞ্চলে যাত্রা করে। একদল পূর্ব দিক হতে প্রতিদিন সূর্যকে উদিত করে আমাদের কাছে পাঠান। মতিয়া কি তাদের সাথে পূবে না পশ্চিমে যাবেন? হয়তো আমাদের চিহুয়াতেতেদের সাথে মতিয়ার রুহুও পূবে সূর্য হাতে উদিত হবেন, এবং পশ্চিম সায়রে আগুনের গোলকটিকে ধীরে নামিয়ে দেবেন। চন্দ্রোদিত করে দগ্ধ বাংলাদেশের হৃদয়কে তার দুধেল ছায়া শান্ত ও স্থিত হবার সুযোগ করে দেবেন! তিনি তো জানেন, কোনও না কোনও আলো না হলে তার স্বদেশের কিষাণেরা কিভাবে ফসল ফলাবে? যে ফসল নিয়ে তিনি উদয়াস্ত সওদা করেছেন, বাংলার ফসলের গোলাগুলো ভরে তুলেছেন যেন একটিও শিশু ক্ষুধাকাতর না থাকে।
২.
১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরের নাজিরপুরের বলেশ্বর ও কালীগঙ্গার তীরে ধরণীতে বেরিয়ে শীতল ছোঁয়ায় কেঁদে উঠেছিল যে মেয়েশিশুটি তার আখ্যান তার আকরের চেয়ে বৃহৎ হয়ে উঠেছিল। দিকচক্রবাল ঘুরে দেশের মানুষের রাজনৈতিক কিষাণী হয়ে ওঠায় তার যাত্রাপথটি দীপ্যমান আলোর পরিসর সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং আমাদের চোখে মতিয়া হয়ে উঠেছিলেন এক কূর্ম মাতা, যিনি পিঠে কোটি মানুষকে খাওয়ানোর দায়ভার নিয়ে বাংলার সংখ্যাতীত জননীর মতো সংসারের মহাস্রোতকে নোঙ্গরে বেঁধে রেখেছেন। এই দায় থেকে “ছুটি” মেলে নি তার – যতদিন মানুষ আছে ততদিনই যে তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তির দায়।
পঞ্চাশের দশকের যে পাকিস্তানে তার জন্ম, সে এক সুতীব্র মুসলমানিত্বের ও স্বরাজের পুুরুষতান্ত্রিক আবহ। তার মাঝে নবীন রাজ্যলাভে মদমত্ত মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর দাম্ভিক আস্ফালন। জিন্নাহর অনুসারী আশরাফ মুসলমানদের জাগরণের মধ্যবিত্তের চৌকি পাহারা দেয়া পুলিশের কন্যার কণ্ঠ আধা গ্রাম আধা শহরতলীর আতরাফদের নিবিড় নৈঃশব্দ্যে কেমন অবাক করে দিলো মানুষকে। মতিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে তারা চমকে উঠলেন। ও মেয়ের কণ্ঠ যে তাদেরই কণ্ঠস্বর হয়ে বেজে উঠেছিলো।
ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে তখন বাংলা। তার বুকে জন্মানোর দায়ভার তার। পঞ্চাশ দশকে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার সাথে মিশেছে ষাটের দশকের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন-কালের আচ্ছন্নতা। নিজ শৈশব ও তারুণ্যকে তিনি নিয়োগ করলেন জনগণের রাজনীতিতে। চাক্ষুষ দেখা অবিচার, অন্যায়, বাংলার গণমানুষের জীবনে ঘটে চলা বর্তমানের বিভীষিকা পেরিয়ে ভিন্ন এক ভবিষ্যতের সম্ভাবনার অঙ্কুর ক্রমেই জনমানসে বিকশিত হচ্ছিল। এই ভূ-রাজনীতির পট-পরিক্রমার সাথে বিকাশ হলো মতিয়ার।
সামাজিক প্রথা, সুবিধা কিম্বা অজ্ঞতার নীরবতা, এমন কি নিপীড়নের মাঝেও এক অনমনীয় চেতনায় মাথা উন্নত রেখেই এগিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষমতার শীর্ষমণ্ডলীর একাংশ হওয়ার আগে বাঙলা পায় তার আদি নারী কণ্ঠ-পুরুষতান্ত্রিক এক দলীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে, যে চ্যালেঞ্জরূপে হাজির হয়। তার ইচ্ছাশক্তির অবিচলতা বিস্ময়কর এবং বাধা ভাঙার ক্ষমতা পুরুষতন্ত্রের ভীত কাঁপিয়ে দেবার মতো। ফলে পুরুষতন্ত্র তার নাম দিলো “লৌহমানবী”! কেমন দিলাম, হে হে ১ভাবখানা এমন। বাংলার নারী হয় পলিমাটির ঢেলার মতো নরোম, কোমল। এ নারী লোহা দিয়ে তৈরী!
সেই জগদ্দল সমাজের ভার নিয়েই নির্ভার মতিয়া ১৯৪২ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী কয়েক দশক ধরে জনগণের অধিকার রক্ষায় তার সংগ্রামের পথ ধরে, গণমানুষের মনে শক্তি ও আশার প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন। তার উপস্থিতি মানেই মানুষের মন নির্ভার, নিঃসন্দেহ। তিনি যা বলবেন, তাই করবেন- এ বড়ো আস্থার যায়গা। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মতিয়া জাতীয় চেতনার মুক্তির রক্ষক হিসেবে গণহৃদয়েই স্থান করে নিলেছিলেন।
৩.
যে ধূলোমাটির মধ্যে তার অন্তিম শয়ান হলো, রাজনীতির শীর্ষপীঠে থাকার কালেও সে মাটি থেকে কদাচিৎ তাকে দূরবর্তী দেখা গেছে। রাজনীতির বাইরেও ছড়িয়ে জড়িয়ে ছিলেন এমন এক স্বদেশের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যা আশ্চর্য স্বপ্নময়। যা এই মহাস্বপ্ন ছড়াতে শুরু করেছিল যে, সৈয়দ-চৌধুরী, খান-তহশীলদার, রহিম-করিম, আছিয়া বেওয়া কি পায়রা বানুদের সবারই শ্রেণী, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে খানিকটা মর্যাদার, খানিকটা মূল্যের জীবন পাওয়ার হক আছে বৈ কি।
মতিয়া নজর দিলেন বিশেষতঃ কৃষি সংস্কার, শ্রমিক অধিকার এবং গ্রামোন্নয়নের দিকে। গ্রামবাংলায় শেকড় থাকায়, শ্রমিক – কিষাণ, যারা বাঙলার পিতাদের জেব, মাতার আঁচলের খুচরো পয়সা, থালার ভাত-মাছ যোগানেওয়ালা, তাদের সংগ্রামের অংশ হয়ে উঠলেন তিনি। আওয়ামী লীগ তো তার কাজের ফসল তোলার কালের সঙ্গী। তাকে দলে নিয়ে আওয়ামী লীগ এই একটি যুক্তিসঙ্গত কাজ করেছে যে, মাটির মানুষদের ঘামে-শ্রমে মেশা কালতিক্রমী যৌথ লড়াইয়ে মতিয়ার অভিজ্ঞতাকে ভূমি বণ্টনে সমতা, ন্যায্য মজুরি এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা সংষ্কারে কাজে লাগাবার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তা সহজ কাজ ছিল না। এমন বিপুল দরকারী ও প্রায় অসম্ভব সংস্কারের কাজে, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা হওয়ার পরও, রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থার জরদগব সিস্টেমের সাথে মতিয়াকে নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে।
তিনি কৃষি মন্ত্রী হওয়ার পর লোকে বলে উঠেছিলো, “যাক, দেশের মানুষ খেয়ে আছে, নাকি না খেয়ে আছে এই মানুষটা অন্ততঃ দেখবেন।” কাড়াকাড়ি খাওয়া খাওয়ির দুর্বৃত্তপণা, ও জলপাই বাহিনীর শাসনের দুটি দশক পেরিয়ে জনতার আশায় বসতি ছিল সেই সব নেতাদের ঘিরে, যারা স্বদেশপ্রেমী। তারা ভাবতেন এরা হবেন তাদের উজ্জ্বল উদ্ধার। মতিয়া চৌধুরী এই জনতাকে নিরাশ করেন নি। কৃষি উন্নয়নে মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ যে ”ভাতে-মাছে বাঙ্গালী”কে উত্তরোত্তর তিনবেলা পেট পুরে খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পেরেছিল গত কয়েক দশক – গ্রামবাংলার কিষাণের জীবনমান যে আগের মতো নয়, তার পেছনে রয়েছে তার গৃহীত একাধিক উন্নয়ন উদ্যোগ। সেসবের মধ্যে টেকসই কৃষি চর্চা এবং কৃষি সম্প্রসারণের প্রসার বাস্তবে ফলদায়ী হয়ে ওঠে। গ্রামীণ কিষাণীর খাবার বন্টনের মতোই তিনি রাষ্ট্রের সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের লড়াই জারী রেখেছিলে নানাভাবে, যার ফল আজ বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও উৎপাদনশীলতায় স্পষ্ট দেখা যায়।
৪. রাজনৈতিক অঙ্গনে মতিয়া চৌধুরী সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে এই যে লড়াইটি করেছেন, তা কয়জন উপলব্ধি করে? সবাই তার ইডেন কলেজে অধ্যয়ন কালেই ছাত্র রাজনীতির কথা বলে। তার বাম রাজনীতির ইতিহাসের অর্থ না বুঝেই বলে। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে রোকেয়া হলের ভিপি হওয়া, ১৯৬৪ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক, তারপর ১৯৬৫ তে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রতিটি ক্ষেত্র তাকে সফল নেত্রীরূপে গড়ে তুলেছিলো।
ছাত্র ইউনিয়নে একটি গ্রুপের নামই হয়ে যায়‘মতিয়া গ্রুপ’। সভাপতি হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তার অগ্নিঝরা ভাষণের পর নামের সাথে জুড়ে যায় ”অগ্নিকন্যা” উপাধি। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপে যোগ দেয়ার পরপরই তাকে কার্যকরী কমিটিতে দেকা যায়। ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে তার কাজ ছিল বহুবিধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য সংগঠিত করা, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ, পাশাপাশি কখনও প্রচারণা, কখনও তদবির, কখনও আহতদের শুশ্রুষায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলার রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্নিঝরা কালের সহযোদ্ধাদের পাশেই তাকে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে।
কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তে যোগ দেন মতিয়া ১৯৭৩ সালে। যুদ্ধের আগে আগে সিপিবির তখন ব্যাপক সঙ্কট। লীগের নেতৃত্বাধীনে তাদেরই পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারের দমন নিপীড়নে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাল কাটছে। লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে মতিয়া চৌধুরী যে সম্মেলনে সিপিবির কেন্দ্রীয় সদস্য হন, সে সম্মেলনসহ ইউনিয়ন ও সিপিবির সব কাউন্সিলে প্রধান অতিথি থাকতেন বঙ্গবন্ধু। তথাপি মতিয়ার নামে গুজব ছড়ানো হলো যে তিনি একবার বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে নিন্দাসূচক কথা বলেছেন। কবে, কোথায় এবং কেন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিলেন এর সদুত্তর কেউ দিতে পারেনা। তার স্বামী বজলুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলত্যাগের হিড়িকের কালে মতিয়া চৌধুরী দলে যোগদান করেন। কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি তাকে ছাড়ে নি।
উপমহাদেশের রাজনীতির টেরোডাকটাইল দন্ত যাকে চুম্বেছে তার জীবনে স্বস্তি থাকার কথা নয়। দুই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনকালে মতিয়া বারংবার গ্রেপ্তার হন। পনের বার জেলে গেছেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ দুই বছর জেলেই ছিলেন।
তিনবারের মন্ত্রী শেরপুর ২ আসন থেকে পাঁচদফায় নির্বাচিত সাংসদডিনি পরে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছিলেন। ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ উপনেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
প্রলয়ের ভেতর দিয়ে জনতার হাত ধরে যে লড়াকুর অভিযাত্রা, ঠাট-বাটে তার কি কাজ? তার ঠাট ভিন্ন। তিনি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েও নকলা ও নালিতাবাড়িতে দরিদ্রদের কম্বল বিতরণ করতে মুড়ির টিন জাতীয় লোকাল বাসে চড়ে গ্রামে চলে যাবেন। সেখানে বসে নতুন কোনও জনগল্প থেকে তাদের ভাগ্য বদলের উদ্দীপক খুঁজবেন। তার নেতৃত্ব যে মুখের কথা নয়, বরং কঠিন, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি সদা তৈরী।
স্পষ্টভাষী মতিয়াকে তাই সংসদে খুঁজলে চলে না। তাকে খুঁজতে হয় সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমিক অধিকার এবং ভূমি সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন কিভাবে জাতীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছিলো, সে উত্তরের অন্বেষায়। তাকে পেতে হবে গণমানুষের চিরচেনা আখ্যানগুলোতে।
৫.
বাংলার বিরলপ্রজ নারীদের একজন মতিয়া চৌধুরী। তার জীবন ও কর্ম – একজন নারীর পক্ষে ক্ষমতা ও শাসনের ক্ষেত্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারে কতোখানি সক্ষম হওয়া সম্ভব সে আশ্চর্য ঘটনার – শক্তিশালী উদাহরণ। কিন্তু তাকে কোনো পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যায় না। তারপরও পরবর্তী প্রজন্মের নারী নেত্রীদের গুরুর অবয়ব ভাবলে মতিয়াকে স্মরণ হবে। তিনি তাদের নির্ভয়ে নিজ নিজ স্বপ্ন অনুসরণে এবং সততা ও সহানুভূতির সঙ্গে দেশসেবায় উৎসাহিত করেছিলেন। নারী কেবল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুষঙ্গ নয়। নারীর ক্ষমতায়নের কথা নিয়ে দুনিয়া যখন এক আধটু ভাবছে, তখন বাংলাদেশে তিনি সেই ক্ষমতার সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করেছেন। তার প্রভাব কেবল নীতি এবং শাসন ব্যবস্থায় নয়। তিনি প্রমাণ করেছিলেন দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে নারীর কণ্ঠ এবং নেতৃত্ব অপরিহার্য। বাংলাদেশের নারীদের জন্য তিনি নিজের ভূমিকাকে উত্তরাধিকার রূপে রেখে গেলেন।
যার কর্মজীবন কয়েক দশকজুড়ে বিস্তৃত, তার প্রভাব কি মৃত্যুতে ম্লান হতে পারে? তার কাজ কথা কয় বাংলাদেশের প্রান্তে, প্রতিধ্বনিত হয় প্রজন্মান্তরে। রাজনীতিকের নৈতিক মানদন্ডের নাম মতিয়া। দেশকে সেই মূল্যবোধের কথা তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দেন, যার উপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত এবং যার প্রতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচক জনগণ উভয়েরই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা অত্যাবশ্যক। তার কাজের সার-সংক্ষেপ করা কঠিন। লড়াইয়ের নীতিতে, জনউন্নয়নে এবং অনুপ্রাণিত প্রজন্মে তার কাজ অব্যাহত।
মতিয়া চৌধুরীর জীবন একটি শক্তিশালী আদর্শের। সাহস কতোখানি রূপান্তরের ক্ষমতা রাখে তার সাক্ষ্য তিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আদর্শের ঝলক মতিয়া — যে আদর্শে এমন একটি জাতির দৃষ্টিভঙ্গি বিম্বিত – স্বাধীনতাযার নিছক স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ নয়। যার অগ্রগতি বস্তু উন্নয়নে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে ন্যায়বিচার একটি অধিকার, বিশেষ সুবিধামাত্র নয়।এই স্বপ্নের উত্তরাধিকার দেশের মর্মমূলে খোদাই করে মতিয়া স্মরণ করিয়ে দেন, একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একজন ব্যক্তির সাহস পুরো জাতিতে প্রাণসঞ্চার করতে সক্ষম।
৬.
বাংলাদেশের সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস গ্রন্থের পাতা খুলুন, দেখুন। খুব কম মানুষই পাবেন যাদের জীবনের কৃত্য এতটা স্থায়ীভাবে প্রোজ্জ্বল, কিন্তু এতটা অবমূল্যায়িত ও অজ্ঞাত। এই বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রা প্রজাতান্ত্রিক দেশের গণের জীবনে স্বস্তি আনার প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ়ভাবে নোঙ্গর বাঁধা ছিল। মতিয়া নাম, দেশের মুক্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামের গণসঙ্গীত। দৃঢ়ভাবে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের ঘোরের সাথে যে নাম একাকার। স্বদেশের প্রায় সুদীর্ঘ এক শতাব্দীর জাতীয় ও আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তরাধিকার ছিল । সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য এ অঞ্চলের গণমানুষের লড়াইয়ের, তাদের সম্মিলিত পদক্ষেপের, এগিয়ে যাবার ও উত্থিত হবার প্রতিজ্ঞার মতোই মতিয়া এক অটল উৎসর্গ।
এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার সরব ভূমিকা ও সৎ নীতির জন্য নমস্য মতিয়া যদিও বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে শায়িত; যদিও ঢাকার ক্ষণস্থায়ী ভোরের জেগে ওঠার শব্দে, কিম্বা সন্ধ্যার নিঃশ্বাসে প্রাচীন বৃক্ষদের মাটির গভীরে শিকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের অংশীদার তার দেহ – সময়ের ঝড়-ঝাপটায় অটুট সেই সব বৃক্ষ ব-দ্বীপের মানুষদের চোখে মতিয়া হয়ে উঠার সম্ভাবনা কম নয়।
পল্বল ভূমি বাংলার বৃক্ষ—যারা স্থিতিশীলতার স্তম্ভ, অক্লান্ত ছায়াদানকারী তাদের মতোই বাংলার অযুত শাণিতচেতনার সন্তানদের দলে যোগ দিলেন মতিয়া। মতিয়াকে এখনো প্রত্যক্ষ করা যাবে বাংলার রাজপথে। এখনো শোষকের, সন্ত্রাসীর মনে হবে পৃথিবীর একটুকরো চিরন্তনতা বাংলার অনমনীয় পাহাড়রূপে খাড়া। এখনো তিনি মাতৃতান্ত্রিক আদি সমাজের প্রেরণার প্রতীক, যার হাত শ্রমের রেখায় খচিত – যিনি শুধু নিজেই নন, বরং আশেপাশের সবাইকে সাথে নিয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। জ্বলে উঠবেন নাই বা কেন?
মতিয়া চৌধুরীকে স্মরণ মানে এক অপরাজেয় শক্তির সংজ্ঞাকে স্মরণ-যা দূরদর্শি ও অনন্য সাহসিকতায় স্বাধীনতার নিরন্তর সংগ্রামে চূড়ান্ত মূল্য দিয়ে গেছেন। তার বিশ্রামের আয়োজনে যে বৃক্ষ গুল্মলতা ছায়া রচে মাটি জুড়ে মৃদু নৃত্যে, আমরা তাদের পাতাগুলির মর্মরিত প্রার্থনার ধ্বনি শুনি। হাওয়া চলনে টের পাই, মৃত আত্মাদের জন্যে এবং ফেরারী মতিয়ার ফেরারী অনুসারীদের সম্মানে, প্রকৃতি নিজেই শোকগ্রস্ত আজ। পল্বল ভূমি বাংলা, ইটকাঠের এই শহরে শান্তি প্রদান করো -যেখানে জীবন এখন ঘৃণার কদর্য প্ররোচনায় দুর্বহ। যেখানে দুরুদুরু বক্ষে সংলাপে হতাশা অব্দি প্রতিফলনের সুযোগ নেই আজ কারু।
বাংলা এক তীর্থস্থান। তার প্রতি ইঞ্চি মাটি ইতিহাসকে স্পর্শ করে থাকে।এক সাহসী জনজাতির দুহিতা মতিয়া। সে বহুবর্ণিল জনজাতি যেন তাদের জাতীয় দুঃখের ওজন অনুভব করে এবং যারা আত্মত্যাগ করেছিল বলেই তারা আজ স্বাধীন, তাদের জন্য গর্ব অনুভব করে শক্তি পায়।
মতিয়া চৌধুরীর আখ্যানের পথে হাঁটতে হাঁটতে আপনি অনুভব করবেন বাংলার উত্থানের গল্পগুলির শেকড় মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। সবই প্রতিরোধ ও স্থিতিস্থাপকতার আখ্যান। তার সবই গণমানুষের মনের কথা – যা নীরব ছিল, অথচ ক্রমেই তার মৃত্যুতে আরও সোচ্চার হয়ে উঠছে। কবর একটি অনুস্মারক মাত্র। দেশব্রতীর জীবন এক অলঙ্ঘনীয় ব্রত, নীরবতার মধ্যেও, পতিতদের আত্মাকে অনুপ্রেরণা দেয়ার শক্তি রয়েছে যার। বাংলার এমন সন্তানের জীবনের স্মৃতি দিয়ে ভবিষ্যত রক্ষার দায় জীবিতদেরই। ব্যক্তির চলে যাওয়া তাই কেবল হারানোর নয়, বরং অপহৃত আশা ফেরাবার লক্ষ্যে জেগে ওঠার। যেন বুদ্ধি, সাহসিকতা ও মাতৃভূমির প্রতি অবিরাম ভালবাসার স্মৃতি ও বর্তমান উদ্যোগ যূথবদ্ধ হয়, ঐক্য জনমনে স্থায়ী হয় এবং দেশকে এমন এক অভয়ারণ্য রূপে গড়া যায়, যেখানে গণমানুষের পরম লালিত স্বপ্ন, স্বাধীনতা-চেতনার আগুনে-পরশমণি সুরক্ষিত রাখা যায়। অগ্নিকন্যার আগুণের পরশমণি আমাদের ছুঁয়ে থাকুক।

সাংবাদিক, সেকুলার যুক্তিবাদী লেখক, মানবাধিকার এ্যাক্টিভিস্ট। চরমপন্থী ইসলমিক মৌলবাদী দল ও জিহাদী জঙ্গীরা লাগাতার জবাই, ধর্ষন, ও বিচারে ফাঁসীর হুমকী দিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে দেশহীন মানুষ। বর্তমানে ইউরোপ ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লিখে থাকেন। তার লেখার কেন্দ্রে রয়েছে নর্ডিক দেশগুলো এবং দক্ষিণ এশীয় জাতিরাষ্ট্রসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রশ্নগুলো। বিদ্যালয় জীবন থেকে সৃষ্টিশীল লেখালেখিতে নিয়োজিত। গ্রন্থ সংখ্যা: বারো (সাহিত্য), পাঁচ ( সাহিত্য ও উন্নয়ন গবেষণা বিষয়ে)