সেদিন সিরিঞ্জ সিরিঞ্জ রক্ত ঢেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের দেয়ালগুলো রাঙিয়ে দিয়েছিলো সাধারন শিক্ষার্থীরা। বেতন ফি বৃদ্ধির যে অযৌক্তিক ও অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো চবি প্রশাসন, তার বিপক্ষে দাড়ানোই ছিলো তাদের অপরাধ। সেই অপরাধের কারনে চবি উপাচার্য অনুগত মিডিয়া মারফত তাদেরকে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জাতীয় বমিজাগানো বিশেষনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু যখন মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত শহর টানা ছয় ঘন্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকে, সড়ক চলাচল বন্ধ করে দেয় লড়াকু শিক্ষার্থীরা কিন্তু একটি গাছের পাতাও ছেড়ার ঘটনা ঘটে না বা টানা তিন চার দিন ক্যাম্পাসের এখানে সেখানে চিৎকার করে, রোদে পুড়ে, গলা ফাটিয়ে সহজ গণতান্ত্রিক পথে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে প্রশাসনের; তখন চবি উপাচার্যের সমস্ত অভিযোগ-ই সম্ভবত বৈধতা হারিয়ে ফেলে। পরের দিন প্রশাসন প্রশাসনিক ভবনের দেয়াগুলোতে চুন মাখিয়ে দেয়। রক্তের রঙ আর ন্যায্য দাবির আকুতি ঢেকে যায় প্রশাসনের চুন মাখানো মুখে।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড হয়ে উঠবে, জ্ঞান আর তরুণ সম্ভাবনাকে উসকে দেবে, এটা খুব-ই কাম্য। কিন্তু অদ্ভূত উটের পিঠে চড়ে বসা এ দেশে এগুলো কেবলই পুস্তকই বুলি। বরং এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চিত্র খুবই চমকপ্রদ ! মহান বিশেষণ পিঠে করে গজিয়ে ওঠা তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এখন ক্যাডার আর ছাগল উৎপাদনের কেন্দ্র। সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের ছুড়িকা আর পেশী প্রদর্শনের চমৎকার উদ্যান। এই ছিলো এই পর্যন্ত বাস্তবতা। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি প্রশাসনের অমানবিক নির্যাতন আর ক্যাডারবাজি, লাঠি দিয়ে শিক্ষার্থী শায়েস্তা করার পদ্ধতি, ছাত্রীদের উপর হামলে পড়ার দৃশ্য বাস্তবতা, ওড়না ধরে টান মারা অথবা পুলিশি লাঠি দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য দাখিলের যে কায়দা তাতে সম্ভবত প্রশাসনকেও তার ক্যাডারবাজির জন্য একটা উপযুক্ত বিশেষনে বিশেষিত করা দরকার।
আমার ক্যাম্পাসে যখন পুলিশ লাঠি উচিয়ে ঘুরে বেড়ায় আমাকে পেটাবে বলে, যখন আমার ক্যাম্পাসে আমার সহপাঠীনির উপর পুরুষ পুলিশের লাঠি আর লোলুপতা কালো দাগ হয়ে লেপটে থাকে পত্রিকার পাতায়, যখন আমার-ই বিপক্ষে প্রশাসন পুলিশ লেলিয়ে দেয়, নির্লজ্জের মতো গণগ্রেফতার করা হয়, বাছ-বিচার ছাড়া যাকে পাওয়া যায়, তাকে ধরে গাড়িতে তোলা হয় প্রশাসনের নিদের্শে আর যাচাই বাচাই-এর নামে রাতভর অমানবিক নির্যাতন করা হয় পুলিশ লাইনে নিয়ে গিয়ে, তখন কোথায় থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্ট থেকে জন্ম হওয়া মধুর বুলিসমূহের ! আমাদের অভিভাবক মাননীয় উপাচার্য যখন পুলিশ দিয়ে আমাদের পেটানোর বন্দোবস্ত করেন, আমাদের ঘাড়ে মামলা ঝুলিয়ে দেন, উচ্ছৃঙ্খল বলে বিশেষায়িত করেন, তখন ক্যাম্পাসে লাঠি হাতে হামলে পড়া সব পুলিশের মুখে মাননীয় উপাচার্যের মুখ ভেসে ওঠে ! আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে পুলিশের গাড়িতে তুলতে থাকা পুলিশটির অবয়বে আমাদের মাননীয় অভিবাবক একাকার হয়ে যান। লাঠি হাতে পুলিশ আর আমাদের অভিভাবক মাননীয় উপাচার্যের পার্থক্য ঠাওর করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে সাধারন শিক্ষার্থীদের জন্য ।
সেদিন শত শত টিয়ার গ্যাস আর রাবার বুলেটের তুমুল আক্রমনে হতবাক হয়ে পড়েছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস। ছাত্রীহলে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে আর ছাত্রীদের উপর লাঠিসোটা হাতে হামলে পড়ে প্রশাসনের তাবেদার পুলিশ কি চেষ্টা করেছিলো ! তোমরা বেতন বৃদ্ধির জন্য প্রতিবাদ করবে কেন ? বেতন বৃদ্ধি করা তোমার মহান প্রশাসনের নৈতিক অধিকার ! চাইলে পড়বে, না চাইলে পড়বে না। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু যায় আসে না! যখন দেশের সমস্তটায় শিক্ষা আর অধিকার না থেকে পন্য হয়ে উঠছে, তখন তুমি কেন কম বেতনে পড়তে চাও ! তোমার বাবা চাষা, দিনমজুর, তুমি টাকা না থাকার জন্যে বিকেল বেলা নাস্তা না করে একসাথে সাতটা বাজতে না বাজতে ডাইনিং-এ দৌড় দেও কিনা সেটা দেখবার দায়িত্ব তো প্রশাসনের নয় ! আমরা আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় চালাবো, উপাচার্য আর উপ-উপাচার্যের নাস্তা বিল ৫ লক্ষ টাকা করবো, লক্ষ লক্ষ টাকা মোবাইল বিল দেবো, কিন্তু তাতে তোমাদের কি , হে শুদ্র শিক্ষার্থী বৃন্দ ! হ্যা, যদি প্রশাসন এমনটা বলতো , তাতে হয়তো শিক্ষার্থীরা দমে যেতো । স্মারক লিপি দেয়া, রোদে দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভিসি মহোদয় বরাবর আবেদন নিবেদন জানিয়ে যাওয়াটা তাদের কাছে অযৌক্তিক ঠেকতো । তারা আন্দোলন আর দাবি না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে খুব নিরবে একে একে ঝড়ে পড়তো ! রিক্সাঅলা’র দেয়া ভ্যাটের টাকা দিয়ে রাষ্ট্র আর তার কলকব্জারা আয়েস করে চলবে, মোজ-মাস্তি করবে, এই দৃশ্য যখন এদেশে খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে, তখন আমরা কেন আর আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে বাড়তি দাবি করবো !
গণ গ্রেফতারের পর অনেক শিক্ষার্থীকে পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। ইচ্ছে মতো পুলিশি খায়েস চালানো হয় তাদের উপর দিয়ে। দিনের বেলা পুলিশি রাবার বুলেট রক্তাক্ত হয় বিভিন্ন শিক্ষার্থীর শরীর। শহীদ মিনার চত্বরে ছাত্রীদের উপর পুলিশের বর্বর লাঠিপেটা আর শীøলতাহানির চেষ্টা মানুষ হিসেবে, স্বাধীন মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখা সাধারন শিক্ষাথী হিসেবে নিজেদের কাছে নিজেদের খুব ছোট করে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় তার কথা মতো চলতে নারাজ সাধারন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে। কতো কতো মামলা ! কতো কতো রকমারি সে সব জিনিস ! কিন্তু আমি একজন সাধারন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার সহপাঠিনীর সম্ভ্রমহানি আর আমার বন্ধুর শরীর থেকে ঝড়ে পড়া রক্তের হিস্যা চাই। সম্ভ্রমহানির বিচার চাই !
কিন্তু আমি জানি, আমার বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়া অদ্ভূত এই দেশের কোথাও নাই! নাই !!!
নাসিমূল আহসান
আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। আমি নতজানু হবার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। আমি পিঠে কুঁজের বদলে বুকে ছুড়িকাকে সাদরে গ্রহন করেছিলাম। আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম। আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস। কিন্তু...আমার চারপাশ জুড়ে দেয়াল, অজস্র থাবা। আমি অন্ধকার ছাড়াতে ছাড়াতে জোছনা খুঁজতে খুঁজতে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যাই।.... তারপর পথে নেমে মানুষের মুখ খুঁজতে থাকি। মুখের ভাঁজ গুলোতে প্রতিরোধের , লড়াইয়ের চিহ্নগুলা মুখস্থ করে করে আত্মহননের রাস্তায় নামি...
You must be logged in to post a comment.