আমাদের সময় প্রবাহিত হয় উলটা ধারায়, যেখানে অস্বাভাবিককে স্বাভাবিকে পরিণত করতেই যেন সকল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। RAB-এর কার্যক্রম থেকে এটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, RAB কর্তৃক সংঘটিত সমস্ত হত্যাকাণ্ড নির্বাহী আদেশেই সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে । সেক্ষেত্রে এই আদেশের দায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাঁধেই বর্তায়, যদি তিনি প্রকৃত দায়ীদের চিহ্নিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন।
উন্মুক্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য বিচারিক পদ্ধতিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার । একটি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই পদ্ধতি ব্যাহত হলে বিচার কার্যক্রম তার গ্রহণযোগ্যতা হারায় । এ কারণেই আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার্থে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ও সর্বতোস্বীকৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বগুলোর অন্যতম । এই লক্ষ্যে বেশ কিছু বিধান বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রেও সন্নিবেশিত হয়েছে, যা প্রধানতঃ বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সমূহের মাধ্যমে বিধৃত ।
বিশেষতঃ বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের নিম্নোক্ত ধারা সমূহ :
৩১। আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে-কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
৩৩। (১) গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না। […]
৩৫। (১) অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।
(৩) ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।
(৪) কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
(৫) কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। […]
শাসনতন্ত্রে যা-ই থাক, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মানুষের বিভিন্ন মৌলিক মানবাধিকার সমুহ অবহেলিত ও লঙ্ঘিত হয় । আর সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞ ।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাত দিয়ে, সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ২০০৪ সালে গঠন করা হয় Rapid Action Battalion বা RAB, এই বাহিনী গঠন করা হয়েছে প্রধানত প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন শাখার সদস্যদের নিয়ে। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সমুহ এবং সাধারণ বিচার পদ্ধতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যগণ স্বভাবতই কিছুটা কম পরিচিত ; পরিচয়ের এই স্বল্পতা বা সে-সম্পর্কে জেনেও তার প্রতি সচেতন অবহেলা RAB-এর কার্যক্রমকে প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ।
RAB এর হাতে এমন বিশদ ক্ষমতা যে, তারা চাইলে যে-কোনো সময় যে-কোনো ব্যাক্তিকে আটক করতে পারে । এ ক্ষমতাবলে তারা প্রচুর নিরীহ এবং সন্দেহভাজনকে ব্যাক্তিকে আটকও করেছে । সাধারণ আইন হচ্ছে, কাউকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে হয় মুক্তি দিতে হবে অথবা আদালতের সন্মুখে হাজির করতে হবে ।
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র, ধারা ৩৩-(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না। […]।
কিন্তু, RAB কর্তৃক আটককৃত সকলকে সাধারণ আইন এবং আদালতের হাতে অর্পণ করা হয় না । অনেককে আটকের পর অমানুষিক নির্যাতন ও অনেক সন্দেহভাজন এবং নিরপরাধকে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের নামে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে । এঁদের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ ছাত্র সুমন, সংখালঘু সম্প্রদায় নেতা চলেশ রিচিল, সন্দেহভাজন অপরাধী পিচ্চি হান্নান থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দলের রাজনৈতিক নেতা মোফাখখার আহমেদ ও ড. টুটুল । একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী RAB এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ব্যাক্তিকে হত্যা করেছে এবং এ সংখ্যাটি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে ।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই RAB-এর পক্ষ থেকে যে-সমস্ত আষাঢ়ে গল্প প্রচার করা হয় তা থেকে এটা বুঝে নিতে কারোই অসুবিধা হয় না যে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই সংগঠিত হচ্ছে পরিকল্পিত ভাবে । কেউ কেউ বলে থাকেন যে, ক্রসফায়ারের শিকার বেশির ভাগই হছে কুখ্যাত সন্ত্রাসী কিংবা খুনী । সেক্ষেত্রে লক্ষ করার বিষয়, এটা কিন্তু বলা হছে না যে তারা সকলেই সন্ত্রাসী বা খুনী । তার মানে এই দাঁড়ায় যে, ক্রসফায়ারের শিকারদের মধ্যে অনেক নিরপরাধও রয়েছেন । আবার তর্কের খাতিরে যদি এটাও মেনে নেয়া যায় যে, এঁরা সকলেই ছিলেন জঘন্যতম সন্ত্রাসী, খুনী ইত্যাদি (সম্ভাবনার দিক থেকে যেটা প্রায় অসম্ভব), তাহলেও বলতে হয, রাষ্ট্রে আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে দোষীদের অপরাধের মাত্রা বিচার করে শাস্তির বিধান দেয়া আর প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে সে বিধান কার্যকর করা । কিন্তু কোনো ধরনের বিচার প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে, RAB কর্তৃক সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডগুলো তাই অবশ্যই আইন বহির্ভূত (extra judicial) । এছাড়াও এগুলো কি রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যাও (custodial killing) নয়? যে-কোনো হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিচারের সম্মুখীন করে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যাবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব । আর কোনো হত্যাকাণ্ডে যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে, সে দায়িত্ব বেড়ে যায় বহু গুণ । এ দায়িত্ব পালনের কোনো লক্ষণ কি বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি? উপরন্তু, RAB-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত RAB সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের দিয়েই করানো হচ্ছে; তাতে ফল যা হবার তা-ই হছে । এটা সকলেরই জানা যে কাক কখনো কাকের মাংশ ভক্ষণ করে না ।
একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকারের এই চরম ও বর্বরতম লংঘনের দায় কি সরকার বা রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারবে? সে-চেষ্টাও মোটেই কাঙ্ক্ষিত কিংবা গ্রহণযোগ্য কোনোটাই হবে না, বরং এ-দায় স্খলনের পথে একটি পদক্ষেপ হতে পারে এ পর্যন্ত সংগঠিত সমস্ত হত্যাকাণ্ডের জুডিশিয়াল তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যাক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো । পাশাপাশি RAB কর্তৃক আটককৃত সমস্ত অভিযুক্তকে সাধারণ আইনানুযায়ী বিচারের সম্মুখীন ও তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি । সাধারণ আইনের আওতায় বিচারের কার্যকরিতা সম্পর্কে কেউ হয়তো সন্দেহ পোষণ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে বলতেই হয়, যদি শায়খ আব্দুর রহমান আর বাংলা ভাইয়ের মতো অপরাধীদের সাধারন আইনে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি বিধান সম্ভব হয়, তা হলে আর সমস্ত অপরাধীর ক্ষেত্রেও তা সম্ভব এবং সেটাই হবে স্বাভাবিক ।