অনেক দিন ধরে বেশ কিছু মানুষ এই আশঙ্কাটার কথা লিখে আসছিলাম। পক্ষান্তরে এই আশঙ্কাটাকে কেউ কেউ আশীর্বাদ ভেবে বিস্তর লেখা লেখিও করেছেন। কথা হচ্ছে হাইব্রীড ধান নিয়ে। বাংলাদেশে যখন থেকে এই হাইব্রীড বীজের আগমন ঘটেছে, তখন থেকেই কেউ কেউ এই বীজের ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষকের কি কি ক্ষতি করতে পারে তা উল্লেখ করে সরকারকে, দেশবাসীকে সাবধান করতে চেয়েছেন। এই বিষয়ের ওপর যখনই কোন তথ্যমূলক লেখা ছাপা হয়েছে, সাথে সাথে হাইব্রীড বীজের কর্ণধাররা তাদের নিযুক্ত লেখকদের দিয়ে কাউন্টার বক্তব্য সম্বলিত লেখা প্রচার করেছে। প্রায় প্রতিটি সংবাদ পত্রেই এই ঘটনাটা ঘটেছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এত লেখা-লেখির পরও সরকার এই বিষয়টাকে বিন্দু পরিমানে আমলে আনেননি। কার্যত একে কিছু বামপন্থী লেখকের ‘আজাইরা প্যাচাল’ ভেবে বসেছেন, এবং অন্যান্য অনেক কিছুর মত এই বিষয়টাও হিমঘরে ঠাঁই পেয়েছে।
ফরহাদ মজহার কে অনেকেই পছন্দ করেন না। আবার অনেকেই পছন্দ করেন। তিনি তার ‘নয়া কৃষি আন্দোলনের’ অভিজ্ঞতা বা নিজস্ব গবেষণা থেকে এই হাইব্রীড বীজ কি ভাবে বাংলার কৃষদের সর্বনাশ করছে, এবং ভবিষ্যতেও করবে,তা নিয়ে অনেক লেখা-লেখি করেছেন। এই নিবন্ধকারও বহুবার এই সর্বনাশা বীজ নিয়ে লিখেছে। আমাদের ভবিতব্য হচ্ছে,আমরা খাল শুধু জলের জন্য কাটি না। খালে কুমির আনারও ব্যবস্থা করি। এমনিতে কুমির না এলে আদর করে ডেকে আনি। ফরহাদ মজহার কে দেখতে পারা না-পারা নিয়ে যদি তার গুরুত্বপূর্ণ মত যা দেশের কৃষকের অস্তিত্বের সাথে জড়িত, তাও আমরা অচ্ছ্যুৎ করে রাখি তাহলে আমাদের বুদ্ধি-বিবেকগুলোও যে বিভিন্ন ইজম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বেনিয়া তোশামুদকারী হয়ে গেছে এতে আর এখন কোন সন্দেহ নাই।
আমরা বহুবার বলে এসেছি, হাইব্রীড হচ্ছে বন্ধ্যাবীজ। এর কোন ‘সন্তান’ উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। বাংলার আবহমান কৃষক তার প্রচলিত বীজধান থেকেই বীজ তৈরি করে। আগামী চাষের সময় তাকে দোকানে দোকানে,দুয়ারে দুয়ারে বীজের জন্য ধর্ণা ধরতে হয় না। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলের কৃষক চাষবাস করে আসছে। এখন খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক বিঘা জমিতে আগের তুলনায় দ্বিগুণ ফসল ফলাতে হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই কৃষক যে বেশি ফসল ফলাচ্ছে তাতে তার লাভ কি হচ্ছে? সে যদি নিজের ঘরের বীজ দিয়ে এক বিঘায় ১৬ থেকে ১৮ মণ ধান ফলায় তার যা বাজার মূল্য,তার চেয়ে কি সে মূল্য পায়, যদি সে হাইব্রীড বীজ ব্যবহার করে ? মোটেই না,কারণ তাকে ওই হাইব্রীড বীজ যে দামে কিনতে হয় তার সাথে বীজ কেনার খরচ, সেচ, কীটনাশক, বালাইনাশক, প্ল্যান্ট গ্রোথ রেগুলেটর, প্ল্যান্ট গ্রোথ কন্ট্রোলার ইত্যাদি কিনে মোট যে পরিমান টাকা খরচ করতে হয় সেটা করার পর কৃষকের হাতে যে কয় টাকা থাকে, ঠিক সেই পরিমান টাকাই তার হাতে থাকত যদি সে প্রচলিত বীজ ব্যবহার করত। ফলাফল যদি সমান সমানই হয় তাহলে কৃষক কেন হাইব্রীড ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে? কে তাকে বাধ্য করাচ্ছে? আমরা জানি সংশ্লিষ্ট কৃষি দপ্তর বা কৃষি উন্নয়ন পরিষদ বা কৃষি সংক্রান্ত আমলারা এবং সরকার তাদের হাইব্রীড ব্যবহারে বাধ্য করাচ্ছে।
হাইব্রীড বীজের আড়ৎদার হচ্ছে বেনিয়া বহুজাতিক কোম্পানী। এদের সাথে অসম ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীতায় টিকে আছে কিছু দেশী কোম্পানীও। কর্পোরেট পুঁজির বেনিয়া বহুজাতিক কোম্পানী গুলো কোটি কোটি টাকা এই সেক্টরে ইনভেস্ট করে রেখেছে। তার সাথে প্রতিযোগীতায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না দেশী কোম্পানী গুলো। যখন এরা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে না, তখন এদের টিকে থাকার জন্য এক মাত্র উপায় মনে হয়েছে ভেজাল। অর্থাৎ নিম্নমানের বীজ বিক্রি করা। ভাল বীজের দামে নিম্নমানের বীজের লাভ বহুগুণ। বাঙালিরা আগে ‘মুনাফাখোর’ বলে মেড়োদের (মাড়োয়ারি) তিরষ্কার করত। এখন নিজেরা অনৈতিক মুনাফা,চুরি-চামারি,জোচ্চুরি,ধাপ্পাবাজীতে মেড়ো তো কোন ছার বিশ্বকেই হটিয়ে দিয়েছে।আর এটা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। নকল ওষুধ,নকল কীটনাশক, নকল গুড়োদুধ, নকল ভোজ্যতেল, নকল কী না? সারা দেশটা যেন নকলের ওপর ভাসছে! সকাল থেকে রাত অব্দি মানুষ ভেজাল আর নকল ব্যবহার করে করে যাপিত জীবনের অর্ধেকটাই শেষ করে ফেলছে! শুধু আমাদের কৃষকের ওপর, সাধারণ মানুষের ওপর যে অত্যাচার নিপীড়ন,জেল-জুলুম,হত্যা-নির্যাতন গুলো যে যে জিনিষপত্তর দিয়ে করা হয় সেগুলো সবই খাঁটি! ওখানে কোন ভেজাল নেই!
যে হাইব্রীড নিয়ে আমাদের আশঙ্কা,সেই হাইব্রীড দিন কে দিন তার ব্যবহার বাড়িয়েই চলেছে।গত বছর যেখানে ৯লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রীড চাষ করা হয়েছিল, এবার সেখানে ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে হাই ব্রীড চাষের আওতায় আনার ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে।অর্থাৎ গত বারের তুলনায় পাঁচগুণ! কিন্তু সেই পাঁচগুণ হাই ব্রীড ব্যবহারের ফলাফল কী হয়েছে ? কৃষকের হাহাকার আর বুক চাপড়ানো! গত ২৫ অক্টোবর ভোরের কাগজে নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করে চাষীর কি তি হয়েছে সেই সংবাদ দিয়ে একটি লিডনিউজ হয়েছে
‘নিম্নমানের হাইব্রীড ধানবীজ ব্যবহারে হাজার হাজার প্রান্তিক চাষি ক্ষতিগ্রস্থ’ এই শিরোনামে।
“ বিদেশ থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানির ব্যাপারে সরকারের প্রয়োজনীয় মনিটরিং ব্যবস্থা ও কার্যকর নীতিমালা না থাকায় দেশের কৃষকরা বিপাকে পড়ছেন। নিম্নমানের বীজ ব্যবহার করায় প্রতি বছরই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তারা। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী প্রতি বছরই নিম্নমানের বীজ আমদানি করায় সেই বীজ খোলাবাজার থেকে কিনে হাজার হাজার প্রান্তিক কৃষক প্রতারিত হচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। উলেখ্য, এ বছর হাইব্রিড ধানের বীজ কিনতে কৃষকের ব্যয় হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। প্রতি হেক্টর জমিতে ১৫ কেজি হিসেবে মোট বীজের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৫ হাজার টন। বর্তমানে প্রতি কেজির মূল্য ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা হিসেবে খরচ হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
গত মৌসুমে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড বীজের ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৯ হাজার টন। ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি হিসেবে সেই বীজ কিনতে কৃষকের প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এ বছর ৪০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ জাতের ১১ হাজার ২৬৫ টন হাইব্রিড বীজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রিম সিড ৩ হাজার টন, ব্র্যাক ২০০ টন, আফতাব এগ্রিকালচার ৯৫০ টন, এসিআই ২ হাজার ২০০ টন, মলিকা ১ হাজার ৮০০ টন, সিনজেন্টা ৪৫০ টন, ন্যাশনাল সিডস ২০০ টন এবং লালতী ১৫০ টন বীজ আমদানির অনুমতি পেয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানেরই মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। দেশীয় এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকার ৬০ জাতের বীজ উৎপাদনের অনুমোদন দিলেও কেবলমাত্র দুটি জাতের বীজই ধান উৎপাদনে সম। সরকারের সংশিষ্ট সংস্থার প্রয়োজনীয় মনিটরিঙের অভাবে আমদানিকারকরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন না বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিদেশ থেকে নিম্নমানের বীজ আমদানি করছেন।
এদিকে গত অর্থবছর থেকে স্থানীয় বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসিআই ভারত থেকে ‘অলোক’ নামে নিম্নমানের একটি উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ আমদানি করতে শুরু করেছে। দেশের প্রান্তিক চাষীরা এই জাতের ধান চাষ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন(ভোরের কাগজ,২৫,অক্টোবর,২০০৮)”
ক্ষতি তো কেবল শুরু হয়েছে। এর পর হতেই থাকবে। একটা সময় এমন আসবে যখন প্রান্তিক কৃষক চাষ করার জন্য তার নিজের ঘরে এক ছটাক বীজও খুঁজে পাবে না। তাকে সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে দেশী মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট বেনিয়াদের উপর। তাকে ওই বীজ কিনতে গেলে গাদা গাদা কাগজপত্তর আর বান্ডিল বান্ডিল টাকা নিয়ে ওই বেনিয়াদের দপ্তরে দপ্তরে ধর্ণা দিতে হবে। অনেক কসরৎ করে তাকে নিজে বাঁচার জন্য এবং শহুরে সায়েবদের বাঁচানোর জন্য অধিক ফসল ফলাতে হবে।নিম্নমানের বীজের জন্য তার ফসল মার গেলে সে না খেয়ে থাকবে, আর সায়েবরা, বাবুরা আমদানি করা চালে চাহিদা মেটাবেন।বন্ধ্যাবীজের সয়লাব ঘটিয়ে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থা কর্পোরেট ধান্ধাবাজরা নিয়ন্ত্রণে নেবে এটা অনেক আগে থেকেই তাদের মাষ্টার প্ল্যান। সেই প্ল্যান তারা সরকারের সহায়তায় নিরাপদ আর নিখুঁত ভাবেই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এখনো আমাদের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কৃষকরা বুঝতে পারছে না,তাদের কোন রাহুর নাগপাশে বেঁধে ফেলা হচ্ছে।এখনো আমাদের ‘কৃষকদরদি’ কৃষিবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না তারা সচেতন ভাবে কিসের ওকালতি করে যাচ্ছেন,কার সেবা করে যাচ্ছেন! সোনার ডিম পাড়া হাঁসের সেই গল্পটা সম্ভব সবাই ভুলে গেছেন।একের পর এক ডিম আদায় করে যেমন শেষে হাঁসটাই মারা গেছিল,ঠিক তেমনি ভাবে বেশি,আরো বেশি ধান আদায় করে আমাদের উর্বর জমিগুলোর সকল দেবার ক্ষমতা লুটে নেওয়া হচ্ছে।আমাদের এই জমিগুলো আর খুব বেশি দিন বোধহয় সোনার ডিম দিতে পারবে না।
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ……
