বার্লিন সীমান্তঘেঁসা স্কাসিন শহরটা পোল্যান্ডের একেবারে পশ্চিমে। সেই শহর থেকে আরো পশ্চিমে ছোট্ট একটা উপশহর। হিটলারের নাজি বাহিনী তখন পোল্যান্ডের পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। স্টালিনের রেডগার্ড তখনো স্টালিনগ্রাদ ছেড়ে পশ্চিমে আসেনি। হিটলারের বাহিনী দোর্দন্ড প্রতাপে ইউক্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময়টাতে পোল্যান্ডের ওই ছোট ছোট শহর আর গ্রামগুলোয় খন্ড খন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সাধারণ নাগরিকেরা। সেই রকমই এক প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিল রুশভ আর নিকভ। আপন দুই ভাই। সৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া কিছু পিস্তল, গ্রেনেড আর গোটা দুই কারবাইন দিয়েই তাদের ক্ষুদে বাহিনী সজ্জিত হয়েছিল।
হিটলার বাহিনীর কনভয়ের উপর অতর্কীতে আক্রমন করা, দলছুট জার্মান সৈন্যদের গোপনে হামলা করা,সরাইখানায় কিংবা হোটেল-রেস্তোরায় ঝড়ের বেগে ঢুকে গ্রেনেড মেরে পালিয়ে যাওয়া…এরকমই ছিল তাদের গেরিলা যুদ্ধ।ওদের দলের যোদ্ধাদের প্রায় সকলেরই বয়স কুড়ির নীচে। মোট সদস্য সংখ্যা কত সেটাও প্রতিদিনকার গণনায় ঠিক থাকত না।কেউ মারা গেলে বাড়িতেও জানানো হত না। নিজেরাই লাশ কবর দিয়ে দিত। যদিও অধিকাংশ সময় সাথীদের লাশ পেত না ওরা।
শীতের শুরুতে রুশভ ঠিক করল,এবার বড় ধরণের অপারেশন করতে হবে, কেননা বেশ কয়েকটা গেরিলা অপারেশন করে ওদের সাহস এবং মনোবল বেড়ে গেছিল। রুশভ চিন্তাভাবনা করে নিত্যনতুন কৌশল বের করত, তারপর টিম মিটিং করে অপারেশনে নেমে পড়ত। এবারকার মিটিংয়ে কেউ কেউ অবশ্য বলেছিল-স্কাসিনের জার্মান গ্যারিসনে ঠিক এই মুহূর্তে হামলা করা ঠিক হবে না। কিন্তু রুশভ অনড়। শেষমেশ হামলার দিনক্ষণ ঠিক হল।
নির্দিষ্ট দিনে গোটা দলটা দুইভাগ করে শুরু হলো অপারেশন ডে-ব্রেক। গ্যারিসনের ছয়-সাতশ’ গজ দূরে একটা পরিত্যাক্ত বাঙ্কারে আশ্রয় নিল রুশভ আর নিকভের টিম। উল্টো দিকের রাস্তার ঢালে অপেক্ষায় থাকল আর একটা টিম।প্ল্যান ছিল ওই বাঙ্কার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে একেবারে গ্যারিসনের নিচে চলে যেতে হবে। তারপর গ্যারিসনের আর্মার ঘরটার নিচে দুটো মাইন রেখে আসতে হবে। মাইনের ব্যবহার জানত না ওরা, শুধু শুনেছিল-মাইন থেকে দুটো তার বের করে এনে ব্যাটারি দিয়ে ফাটাতে হয়। সারা রাত মাটি খুঁড়ে একটু একটু করে এগোয়,আর দিন হলে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে নেয়। অন্য টিমও সারা রাত পাহারা দেয়,আর দিন হওয়ার আগেই পালিয়ে যায়।
আর মাত্র একদিন খুঁড়লেই আর্মারের নাগাল পাবে! যত সময় যাচ্ছে তত ওদের আতংক আর উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। যেদিন প্রায় কাজটা শেষ হতে চলেছে, সেদিনই দুজন জার্মান সৈন্য বাঙ্কারের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় মাটি খোঁড়ার শব্দ পেল।পাথরে লেগেছিল গাইতি,তাতেই শব্দ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাজোয়া যান সহ সৈন্যদের গোটা ট্রুপ ঘিরে ফেলল ওদের। বাঙ্কারের মুখে দাঁড়িয়ে টানা মেশিনগানের গুলি।প্রথম চোটেই পাঁচ-ছ’জনের মুত্যু হলো।বাকিরা প্রাণ বাঁচাতে হাত তুলে বেরিয়ে এলো। সৈন্যরা ওদের নিয়ে চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ ওদের একজনের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল…..রুশভ ! সৈন্যরা একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করে তিন জন কে নিচে পাঠাতেই কারবাইনের ম্যাগজিন খালি করে ফেলল রুশভ।মৃত্যু হলো তিন জার্মানের। নিকভ চিৎকার করে বলল..আমাদের কাছে মাইন আছে, কাছে আসলেই ফাটিয়ে দেব…..
ধরা পড়া ছেলেগুলোকে সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে খুব ফরমাল কায়দায় গুলি করা হলো।কয়েক জন কে রেখে গাড়ি ফিরে গেল গ্যারিসনে। লাশগুলো পড়ে থাকল বাঁকাচোরা ভঙ্গিতে। কমান্ডিং অফিসার অনেক ভেবে চিন্তে কৌশল ঠিক করল। বাঙ্কারের ভিতর গ্রেনেড ছোঁড়া যাবে না। তাতে বিস্ফোরণে আর্মারেও বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। তাই ঠিক করা হলো বাঙ্কারে পানি ঢালা হবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পানির গাড়ি এনে পানি ঢালা শুরু হলো।বাঙ্কারের শেষ মাথায় দুই ভাই। পানি বাড়ছে…..পা-হাঁটু-কোমর-বুক—-পানি বাড়ছে—-গলা অব্দি উঠে এলো পানি। রুশভ-নিকভ একে অপরের দিকে নিঃস্পলক তাকিয়ে আছে।চোখে সামান্যতম ভয় বা আতংক নেই! কারবাইনের গুলি শেষ! সম্বল শুধু দুটো পিস্তল আর মাইনটা। পানি যখন মুখ স্পর্শ করল, রুশভ শান্ত গলায় বলল-‘নিকভ তুই আমায় গুলি কর!’ নিকভ পাথরের মত নিশ্চুপ! চিৎকার, ধমক দিয়েও নিকভকে রাজি করানো গেল না। অবশেষে রুশভ ভাইকে আলিঙ্গন করে নিজের পিস্তল তার কপালে ঠেকাল ! বলল, এবার তোরটা আমার মাথায় ঠেকা,—সময় নেই—ধরা দেব না কিছুতেই…পানিতে খাবি খেয়ে মরার চেয়ে এই-ই ভাল না ভাই ? এবার শান্ত ছেলের মত নিকভ তার পিস্তলটাও রুশভের কপালে ঠেকাল—-পানি বেড়ে চিবুক ছুঁলো—-তারপর ঠোঁট—নাক স্পর্শ করার সাথে সাথে দুটো পিস্তল থেকে এক সাথে দুটো গুলি বেরিয়ে গেল………..
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ……
