পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ নিতান্তই গুরুত্বহীন একটি দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, আগুন পুড়ে বা পানিতে ডুবে প্রচুর সংখ্যক মানুষ মারা না গেলে বাংলাদেশ সাধারণত পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। তবে বিশ্বের বৃহত্তম সংবাদ মাধ্যম বিবিসি (BBC) এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, বাংলাদেশে বিবিসির স্থায়ী প্রতিনিধি আছে, বাংলা ভাষাতে বিবিসি রেডিও এবং বিবিসি ওয়েবসাইট আছে। গত কয়েক দশক ধরেই বিবিসি বাংলাদেশের বিভিন্ন খবর গুরুত্বের সাথে প্রচার করে আসছে। কিন্তু কোন এক কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুটি, যা গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম প্রধান ইস্যু, তা বিবিসিতে তেমন কোন গুরুত্বই পাচ্ছে না। আমি কাজের ফাঁকে প্রতিদিনই বিবিসির ইংরেজী ওয়েবসাইটে একবার হলেও যাই, তবে সেটা প্রধানত বিদেশের খবর জানার জন্য (দেশের খবর তো বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র থেকেই জানা যায়)। তাই এই ব্যাপারটা সেভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু গতকাল (২৭ জুলাই, ২০১০) যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল শুরুর খবর বিবিসিতে না দেখে বেশ অবাক লেগেছিল। গতকাল বিবিসিতে বাংলাদেশ বিষয়ে দুটো পোস্ট ছিল। প্রথমটি গার্মেন্টস কর্মীদের ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর খবর, দ্বিতীয়টি ডঃ ইউনুসের মার্কিন টিভি সিরিজ ‘সিম্পসন’ এ কন্ঠ দেওয়ার একটা নিতান্তই গুরুত্বহীন খবর। এমনকি বিবিসি বাংলা ওয়েবসাইট, যেটি মূলতঃ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও মুল পাতাতে যুদ্ধাপরাধী বিচার বিষয়ে কোন পোস্ট নেই। বিডিআর সৈনিকদের বিচার, গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন বাড়ানো নিয়ে পোস্ট আছে। এছাড়াও আয়ুব বাচ্চু এবং হাবিব ওয়াহিদের রেডিও ইন্টারভিউর লিঙ্ক আছে। বাংলাদেশের আখ চাষীদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মত রিপোর্টের লিঙ্কও আছে।
বিবিসির ইংরেজী ওয়েবপেজের আর্কাইভে সার্চ দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে অসংখ্য পোস্ট পাওয়া যায়, বিডিআর বিদ্রোহ, শৈতপ্রবাহে মানুষের কষ্ট, ঢাকার যানজট, ফেসবুক বন্ধ করা, ডিজ়িটাল বাংলাদেশ সবই আছে। বাংলাদেশের চলতি ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে খুব দ্রুত জানতে চাইলে বিবিসির ওয়েবসাইটে সার্চ দিলেই জানতে পারা সম্ভব। স্বভাবতই বাংলা পড়তে পারেন না এমন কেউ বাংলাদেশের চলতি ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর পক্ষে বিবিসির ওয়েবসাইটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক (বিবিসির ইংরেজী ওয়েবসাইট বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলোর একটি)। কিন্তু এই সমৃদ্ধ ওয়েবসাইটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সরাসরি একটা মোটে পোস্ট পাওয়া গেল (ট্রাইবুন্যাল শুরুর খবর, যে খবর ২৬ জুলাই প্রকাশিত হয়ে অতিদ্রুত আর্কাইভে চলে গেছে)। এছাড়া মওদুদীর বই নিষিদ্ধ করা বিষয়ক সংবাদে এই বিচার বিষয়ে কিছু আলোচনা আছে। বাংলা ওয়েবপেজের আর্কাইভে সার্চ দিয়ে এই বিষয়ে চার পাঁচটা পোস্টের বেশী কিছু পাওয়া গেল না। অথচ এই সময়কালে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে হাজার হাজার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে (WCSF এর Media Archive এ হাজার তিনেক আইটেম আছে)। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিবিসির প্রতিনিধিরা নিশ্চয় সমস্ত খবরই বিবিসির লন্ডন অফিসে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু লন্ডনে বিবিসির সম্পাদকেরা এইসব রিপোর্ট ওয়েবপেজে ছাপাচ্ছেন না।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী যারা আছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশকে বিবিসির মাধ্যমেই জানেন। তাঁদের কাছে বাংলাদেশের যানজট, নির্মাণ শিল্পে অনিয়ম, ফেসবুক বন্ধ হওয়া এবং খুলে যাওয়া, সব খবরই যাচ্ছে, যাচ্ছে না কেবল স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে জাতিকে দায়মুক্ত করার এই অসাধারণ কর্মকান্ডের খবর।
একটি বিদেশী সংবাদ মাধ্যম কি ছাপাবে না ছাপাবে, সেটা নিয়ে আমাদের দাবী করার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে গত দেড় বছর ধরে সর্বাধিক আলোচিত এই বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনে বিবিসির এই অনীহা কেন? তারা সুদানের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধাপরাধের ওয়ারেন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর খবর দিচ্ছে, কম্বোডিয়া আর বসনিয়াতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের খবর ফলাও করে প্রচার করছে, সেই একই সম্পাদকীয় নীতির আওতায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার খবর আটকে যাচ্ছে কেন? একি নিছক সম্পাদকীয় নীতি, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে? সাম্প্রতিক কালে চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রভাবশালী ব্রিটিশ লর্ড এরিক এভবারি যেভাবে জামাতকে রক্ষা করতে উঠে পড়ে লেগেছেন, তাতে সন্দেহ হয়, বিবিসির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ক ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়ার পেছনে এরকম প্রভাবশালী কারো হাত আছে কিনা?
মোহাম্মদ মুনিম
পেশায় প্রকৌশলী, মাঝে মাঝে নির্মাণ ব্লগে বা ফেসবুকে লেখার অভ্যাস আছে, কেউ পড়েটড়ে না, তারপরও লিখতে ভাল লাগে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৩ comments
মাসুদ করিম - ২৯ জুলাই ২০১০ (১:২৪ পূর্বাহ্ণ)
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম মুখপত্র দৈনিক ‘গণশক্তি’তে এবিষয়ে কোনো খবর আজো দেখিনি, অবশ্য ত্রিপুরার সিপিএম মুখপত্র দৈনিক ‘দেশের কথা’য় দেখেছি ২৭ তারিখেই। যে ‘দি হিন্দু’ বাংলাদেশের খবরের ভাল সূত্র, আশ্চর্যের বিষয় সেপত্রিকায় আজ পর্যন্ত ট্রাইবুনাল শুরুর কোনো খবর নেই — যদিও হারুন হাবীব ওই পত্রিকায় গতকাল ভারতের সাথে হওয়া বিদ্যুৎ চুক্তির খবর পাঠিয়েছেন। এবিষয়ে কোনো খবর নেই ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'(যেখানে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে কম্বোডিয়ান কমরেড ডুকের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধে শাস্তি পাওয়ার খবর), ‘টাইমস অফ ইান্ডয়া’য়। অবশ্য এখবর ছেপেছে ‘দি পাইওনিয়র‘,’নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস‘ ও ‘দি স্ট্যাটসম্যান‘। আর ভারতের সংবাদ সংস্থা ‘পিটিআই’ ও ‘আইএএনএস’ যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এখবর পরিবেশন করেছে। সব মিলে যে ‘কাভারেজ’ লক্ষ্য করেছি, তাতে মোটেই খুশি হইনি। বিশেষ করে হারুন হাবীবের একটা লেখা ‘দি হিন্দু’তে এবং আতাউর রহমানের একটা লেখা ‘ গণশক্তি’তে আমি খুবই আশা করেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে ‘আজকাল’ও খুঁজে দেখলাম, সেপত্রিকায়ও এই বিষয়ে কোনো খবর নেই। ‘আনন্দবাজার’-এ এখবর আছে কিনা ওয়েবসাইটের গন্ডগোলের জন্য আমি খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু একই গ্রুপের ইংরেজি পত্রিকা ‘টেলিগ্রাফ’-এ কোনো খবর নেই। এমন কি নেপালের ‘দি হিমালয়ইয়ান টাইমস’ ও ‘কান্তিপুর’-এ ও এসংক্রান্ত কোনো খবর গত দুদিনে আমার চোখে পড়েনি। পাকিস্তানের ডন, ডেইলি টাইমস ও দি নিউজের মতো প্রধান পত্রিকার কেউই এখবর ছাপেনি।
অবিশ্রুত - ২৯ জুলাই ২০১০ (৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ)
সত্য হলো এই যে, বিবিসি বাংলা বিভাগ এখন তথাকথিত নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে- যে নিরপেক্ষতা খুঁড়লে একটি ভয়ানক রাজনৈতিক চরিত্রই বেরিয়ে আসবে।
অনেকেরই মনে আছে, তারেক রহমান বিবিসির বাংলা বিভাগের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, এ ঘটনার সঙ্গে (বোমা হামলার সঙ্গে) আল-কায়েদা জড়িত থাকতে পারে।
আমরা পৃথিবীর হাজার হাজার বাঙালি এই সাক্ষাৎকার শুনেছি। কিন্তু পরের দিনই এক প্রযোজককে বিবিসিতে বলতে শুনলাম তারেক রহমান তার বক্তব্য সঠিকভাবে প্রচার করা হয়নি বলে প্রতিবাদ করেছেন। বিবিসির পক্ষ থেকে তারেকের এ বক্তব্যের ব্যাপারে কোনও বক্তব্য বা অবস্থানই নেয়া হলো না। অথচ সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রচার করলেই শোনা যেত, তারেক রহমান কী বলেছিলেন। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বিবিসি বাংলা বিভাগে পরে সাক্ষাৎকারটি পুনঃপ্রচারের জন্যে অনুরোধ করেছিলেন- কিন্তু প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষাৎকার পুনঃপ্রচারের রেওয়াজ বিবিসিতে থাকলেও এ ক্ষেত্রে সে রেওয়াজ অনুসরণ করা হয়নি।
শুনেছি, তারেক রহমানের ওই বক্তব্য ধামাচাপা দেয়ার জন্যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং বিবিসির বাংলা বিভাগের সাংবাদিকরাও সানন্দে সেই চাপ সহ্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে আশার কথা, বাংলাদেশের অনেকেই বিবিসির সংবাদ রেকর্ড করে রাখেন, কোনও কোনও সংবাদপত্র অফিসেও রাখা হয়। যাদের কাছে এ ধরণের রেকর্ড আছে, তাদের একটু তারেকের ওই সাক্ষাৎকারটি এবং তার প্রতিবাদটির বয়ান ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়ে রাখছি।
এ হেন বিবিসি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টি প্রচারণায় নিয়ে আসবে, এরকম আশা করাই বাতুলতা।
kamruzzaman Jahangir - ২৯ জুলাই ২০১০ (১১:৪৮ অপরাহ্ণ)
বিবিসি যে নিরপেক্ষতার ভাণ ধরে থাকে, বিশেষ উদ্দেশ্যেই এর সংবাদ প্রচার চালু রাখে, নতুন করে তা সরেজমিনে প্রমাণের দরকারই বা কী!