এতো ভোরে এতো আলোর ঝলকানি আর এতো গুলির শব্দ আমি কোনোদিন শুনিনি। তখন স্কুলে পড়তাম, সার্কিট হাউজের খুব কাছে থাকতাম, তারপর আমরা শুনলাম ক্যু-এর কথা, জিয়াকে মেরে ফেলার কথা। কলেজ জীবন পুরোটা আড্ডা দিয়েছি জামাল খান এলাকায়, একটি বিশেষ বাড়িকে দুয়েকজন বিশেষ বন্ধু বলত খুনির বাড়ি, হ্যাঁ, জিয়াউর রহমানের খুনির বাড়ি। কিন্তু সে খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরে, কারণ তাকেও খুন করে ফেলা হয়েছে সেসাথে মঞ্জু ও আরো অনেক সেনা কর্মকর্তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু জিয়া হত্যার সাথে জড়িত সবাইকেই কি হত্যা করা সম্ভব হয়েছে? সব প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সহযোগী ও সব পর্যবেক্ষকরা নিহত হয়েছেন? মুজিব হত্যার সাথে আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক যেভাবে জড়িত বিএনপির জিয়া হত্যার সাথে জড়িত তেমন কেউ কি নেই? কেন খালেদা কোনোদিন এ হত্যার বিচার চান না? আমরা কি তার দিকে হাত তোলার মতো টানটান উত্তেজনার প্লট সাজাব? না কি সেদিন সকালে অনেকে যেমন বলছিল, বদরুদ্দোজা পালিয়ে গেছে সার্কিট হাউজের খিড়কি দিয়ে—মীরজাফর!মীরজাফর!! আমার মনে হয় আমাদের দেশের আর্মিরা আর্মি দ্বারা নিহত হতে ভালবাসেন, এবং খালেদা জিয়া ব্যাপারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চান না, কারণ তিনি কোনো আর্মির মনে দুঃখ দিতে চান না, যদিও বিএনপির কে কে জিয়া হত্যার সাথে জড়িত তিনি জানেন, জানেন এরশাদের কী ভূমিকা, মুখ তিনি খুলছেন না, কারণ তিনি আর্মিদের ব্যাপারে স্পর্শকাতর, এবং তিনি এও জানেন জিয়া হত্যার বিচার চাওয়ার সাথে সাথে সেনাবাহিনীতে জিয়ার কার্যকলাপের পেন্ডোরার বাক্স খুলে যাবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বপ্রকার অমঙ্গলচর্চার খবর বের হবে জনসমক্ষে, জিয়ার খালকাটা হাতে রক্তের নদীর উৎস দেখা যাবে। এবার যখন তিনি বন্দী ছিলেন, তখন মাঝে মাঝে তার মনে হয়েছিল সবার মুখোশ খুলে দেবেন, কিন্তু একটি মুখের সব বিভৎসতা বেরিয়ে যাবে বলে, সারাজীবনের মতো সাবধানতা অবলম্বন করেছেন, বিবাহিত স্ত্রীর মনের কথা অনেক সীমাবদ্ধ, বিখ্যাত লোকের বিধবার আবার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, কিন্তু তাকে করতে হয় অনেক হিসাব, কী চেপে গেলে লাভ বা কী প্রকাশ করলে লাভ, একটা মৃত জীবনের সব সম্ভাবনা যখন তার হাতে, তখন এতো সুযোগ শুধু স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতা করে তিনি কেন হারাবেন? কিন্তু আমরা তো চাইতে পারি তার বিচার, আমরা যারা জানি, এক জিয়া হত্যার বিচারের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তার প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার ভেতর ফিরিয়ে আনা যাবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই ঔদ্ধত্য বিডিআর-এ চাকুরী করব কিন্তু বিডিআর-এর পোষাক পরব না, বিডিআর-কে ঠিক করতে হলে রক্তের দাগ(সেনাবাহিনীতে কোনো রক্তের দাগ নেই, এক অফিসার আরেক অফিসারকে খুন করা, এক অফিসারের আরেক অফিসারের সাথে বন্ধুত্বের মতোই, সমানে সমান, কিন্তু বিডিআর আর্মি মারবে, এতো একেবারে আর্দালির অফিসার হত্যা করা, এতো আর্দালি অফিসারের বন্ধুত্বের মতোই অসম্ভব) মুছতে হলে বিডিআর-এর নাম পরিবর্তন করতে হবে, এই সবকিছুকে মোকাবেলার একটাই উপায় : জিয়া হত্যার বিচার এখনই চাই।

মাসুদ করিম

লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।

১২ comments

  1. মাহতাব - ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (১১:৫২ অপরাহ্ণ)

    তারেক জিয়া যদি এরশাদের কাছে যায় তাহলে জিয়া হত্যার বিচার কোনদিন বিএনপি র পক্ষে চাওয়া বা করা সম্ভব নয়।

  2. নাবালক - ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৪:২৪ অপরাহ্ণ)

    এটা আবার কোন জিয়া?
    বিএনপি-কে কোনো দিন তো দেখিনি জিয়া হত্যার বিচার চাই বলে স্লোগান দিতে??

  3. মাসুদ করিম - ২০ ডিসেম্বর ২০১১ (১০:০৩ পূর্বাহ্ণ)

    ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ খালেদা জিয়া বিএনপি আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, জিয়াকে কারা হত্যা করেছে তা তিনি জানেন – এরপরই বললেন, একদিন তা বের হয়ে আসবে – তার মানে? তার অবস্থান, ও তার নাম বলব না? – বিচার এতদিনে কেন করা হয়নি সেপ্রসঙ্গে বললেন, বিএনপি উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই কোনো প্রতিহিংসা চায়নি। হত্যার বিচার চাওয়া প্রতিহিংসা! সাবাশ খালেদা, তোমাকেই খুঁজছে সব হত্যাকারী – তারা তোমাকে মাথায় করে রেখেছে, তারা তোমাকে মাথায় করে রাখবে।

    • মাসুদ করিম - ৫ মে ২০১৪ (১১:৩১ পূর্বাহ্ণ)

      যাক, গতকাল শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য জনসভায় খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের হত্যাকারীর নাম মুখে নিলেন। কিন্তু এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা এখন হবে না, মামলা বিচার যা হবার খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতায় এলে হবে। কই মাছের প্রাণ, তুমি বেঁচে থাক।

      Khaleda accuses Ershad of killing Zia, Manzur

      HM Ershad is the man behind the murder of Ziaur Rahman and Maj Gen Muhammad Abul Manzur, said BNP Chairperson Khaleda Zia. She made the allegation while speaking at a ‘mass hunger strike’ held at the National Press Club on Sunday to protest against the recent spike of abductions and killings. She criticised the ruling Awami League for keeping ‘close ties’ with the Jatiya Party chief. “You are living with killers, you (Sheikh Hasina) have made him your (special) envoy,” she said. Ziaur Rahman was killed during a failed coup at Chittagong Cantonment in 1981. Maj Gen Manzur was blamed for his assassination, according to a news agency.

      • মাসুদ করিম - ৭ মে ২০১৪ (৯:০৪ পূর্বাহ্ণ)

        এবার খালেদাকে খুনি বললেন এরশাদ।

        Ershad calls Khaleda a killer

        Terming delirium BNP chairperson’s remark that he is the killer of her husband and General Manzur, Jatiya Party Chairman HM Ershad Tuesday said Khaleda Zia herself is a killer.

        “It’s Khaleda who is a killer, not me… she have killed many people at different parts of the country. Khaleda Zia should be tried,” he said.

        Ershad, also a special envoy to Prime Minister Sheikh Hasina, came up with the counter-attack on Khaleda while addressing a views-exchange meeting with his party leaders and activists at the district circuit house.

        Earlier on Sunday, Khaleda said Ershad is the killer of Abul Mazur and Ziaur Rahman and he should be tried.

        Addressing her party’s mass-hugger strike programme on the Jatiya Press Club premises, she also asked the government why the judgement of Ershad in Mazur murder case has been deferred.

        Reacting to Khaleda’s remarks, Ershad said, “I got stunned hearing her speech. BNP was in power for several terms while Khaleda Zia was the Prime Minister. But she had not raised any question about it then. I condemn her speech.”

        The former military dictator went on saying: “Khaleda sees dark around as she has no political future. So she is raving and saying everything as per her whim.”

        The Jatiya Party chairman also said BNP has no capacity to overthrow the government by waging a movement. “BNP is neither in Jatiya Sangsad nor in movement. In fact, the party has no power to topple the government by waging movement.”

        Comparing his party with BNP, Ershad claimed that Jatiya Party is in a better position in the present context.

        Voicing deep concern over the country’s sliding law and order, the former president said people are now not safe as the incidents of killing, abduction and forced disappearance marked a sharp rise.

        “People are passing their days in panic. They can’t even sleep in peace. Forced disappearance, killing and abduction are undermining the good activities of the government. The government should uphold its image by improving the country’s law and order situation,” he added.

  4. মাসুদ করিম - ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ (৯:১৫ অপরাহ্ণ)

  5. মাসুদ করিম - ২৬ এপ্রিল ২০১৪ (৩:০৩ অপরাহ্ণ)

    শুনলাম বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিঞা জনসমক্ষে বলেছেন, এরশাদ জিয়া হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত, তাহলে দেরি কেন? জিয়া পরিবারকে বলে আজই কেসটা কেন ঠুঁকে দেয়া হচ্ছে না?

  6. মাসুদ করিম - ১২ মে ২০১৪ (৭:০৮ অপরাহ্ণ)

  7. মাসুদ করিম - ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪ (৯:৩৫ অপরাহ্ণ)

    জিয়া হত্যার বিচার চান এরশাদও

    সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন সাবেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ, যিনি নিজেই ওই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক বলে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে।

    রোববার রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ বলেন, “খালেদা জিয়া আমাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। আমি বলতে চাই, আপনারা তিন বার ক্ষমতায় ছিলেন। কেন বিচার করেন নি?”
    “বিচার একবার শুরু হয়েছিলো। শেষ হয় নি কেন? প্রয়োজনে আবার বিচার শুরু করুন। আমরাও জিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”

    বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ১ মে এক সমাবেশে বলেন, ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যা করেছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান এরশাদ।

    ওই সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, “এরশাদ মেজর মঞ্জুর ও জিয়াউর রহমানের খুনি।”

    এরপর ১০ মে জাতীয় পার্টির অঙ্গ সংগঠন জাতীয় যুব সংহতির এক সমাবেশে এরশাদ বলেন, “আমি জানি, দেশবাসী জানে জিয়ার খুনি কে?

    “ওইদিন জিয়ার পাশের কক্ষে কে ছিলেন? তার সঙ্গে খালেদা জিয়া ২০ বছর রাজনীতি করেছেন কিন্তু বিচার করেন নি।”

    ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। হত্যার দিন জিয়ার পাশের কক্ষেই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরীও ছিলেন। ওই অভ্যুত্থানে জড়িত অভিযোগে আটক মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে এর পরপরই হত্যা করা হয়।

    ওই সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা এরশাদ পরে সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। অন্যদিকে জিয়ার মৃত্যুর পর রাজনীতিতে এসে বিএনপির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা।

    এরশাদের বক্তব্যের একদিন পর ১১ মে সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমানে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রতিবাদ করে এক বিবৃতি দেন, যাতে তিনি এরশাদকে ‘সহজাত মিথ্যাবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি।

    অবশ্য বদরুদ্দোজার বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায় ১২ মে এরশাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি আমার বক্তব্যে কারো নাম উল্লেখ করিনি। তিনি কেন এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নিলেন, তা আমার বোধগম্য নয়।”

    সাধারণ আদালতে জিয়া হত্যার বিচার না হলেও মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচার শেষ পর্যায়ে এসেছে। এরশাদকে আসামি করে দায়ের করা এই মামলায় রায়ের দিন ঠিক হওয়ার পর এখন পুনরায় অধিকতর তদন্ত চলছে।

    আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপিবিহীন দশম সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি সরকারেও যোগ দিয়েছে। এরশাদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

  8. মাসুদ করিম - ৩১ মে ২০১৬ (৮:০০ পূর্বাহ্ণ)

    সেনা-অভ্যুত্থান, জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড ও বিভিন্ন প্রশ্ন

    উনিশশ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নানা সময় বিভিন্নভাবে সেনা-অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ সেই সময়ে ঘটে চলেছিল নিয়মিতভাবেই। বলা যায়, এমন পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সামরিক বাহিনীর একদল অফিসারের হামলায় নিহত হন দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। ছয় বছর আগে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সামরিক বাহিনীতে আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই তিনি দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। এর পরের বছরগুলিতে তাঁকে উৎখাতের জন্য বিভিন্ন সময় সামরিক বাহিনীতে চেষ্টা করা হলেও তাঁর অনুগত সেনা অফিসার এবং সদস্যরা সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাগুলি দমন করেন।

    কিন্তু ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমান নিহত হন সেনা অফিসারদের হামলাতেই। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তখন যে সেনা অফিসাররা ছিলেন তাদের অনেকেই জিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও ঘটে যায় এই হত্যাকাণ্ড। প্রশ্ন ওঠে, অনুগত অফিসাররাই কি জিয়াকে হত্যা করেছিলেন? নাকি তাঁর অনুরাগী অফিসারদের ব্যবহার করে অন্য কোনো গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থের জন্য হত্যা করেছিল তাঁকে?

    এই হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের প্রভাবশালী অফিসাররা কয়েকদিন চট্টগ্রামে কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখলেও ঢাকা সেনা সদর এবং দেশের অন্যান্য সেনানিবাস তাদের সঙ্গে নেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যেতেই তাদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি বা ডিভিশনাল কমান্ডার জেনারেল আবুল মঞ্জুর তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও দ্রুতই ধরা পড়ে যান এবং তাঁকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরিয়ে এনেই হত্যা করা হয়। বলা হয়, উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যরা তাঁকে হত্যা করেছে।

    জেনারেল মঞ্জুরকে বিচারের সম্মুখীন না করে এভাবে হত্যা করা অনেক প্রশ্ন আর সন্দেহের জন্ম দেয় স্বাভাবিকভাবেই। জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় যে সেনা অফিসারদের তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম কারাগারে গোপনে এবং খুব তাড়াহুড়ো করে বিচারের পর ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়, অনেককে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত করা হয় আরও বেশ কিছু অফিসারকে।

    দেখা যায়, এই অফিসারদের বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে দুর্ভোগের শিকার হন মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই। এই দিকটিও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় জিয়া এবং মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। তারপরও বিভিন্ন তথ্য এখনও অজানা।

    মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া বা থেকে যাওয়া বাঙালি সেনা সদস্যদের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করা হলে মুক্তিযোদ্ধা আর পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকরাী সেনা অফিসারদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয় যার কারণে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা চাকুরিতে পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যান।

    পাকিস্তান-প্রত্যাগতরা এ ব্যাপারে অসন্তষ্ট ছিলেন। তবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদসমূহে সত্তরের দশকে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই। ফলে পাকিস্তান-প্রত্যাগতরা ক্ষুব্ধ থাকলেও এই সময়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে জড়াননি।

    অন্যদিকে, ১৯৭৫ সাল থেকে সেনাবাহিনীতে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানসমূহে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিলেন। যেমন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেনাবাহিনীর কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।

    এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অফিসার মেজর ফারুকের কথায় জানা যায়, সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার কথা তিনি সে বছর মার্চ মাসেই সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া তখন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

    বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত অফিসারদের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে অবস্থান নিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে সেনা ও বিমানবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। তারা তখন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে বন্দিও করেন। কিন্তু সে সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার জিয়ার পক্ষেই ছিলেন এবং তারা খালেদ-শাফায়াতকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেননি।

    মাত্র পাঁচ দিন পরই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন গোপন সেনা সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলের বিরুদ্ধে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয়। এরপরই হত্যা করা হয় মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার এই তিনজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে।

    কর্নেল তাহের আর জেনারেল জিয়ার সম্পর্ক ভালো থাকলেও ১৯৭৫এর নভেম্বরে জিয়া মুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন দাবি পূরণ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। দ্রুতই এরপর গ্রেফতার করা হয় কর্নেল তাহেরকে। একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে কারা-অভ্যন্তরে গোপন বিচারের পর ১৯৭৬ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

    এই সামরিক ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে যিনি ছিলেন একজন অ-মুক্তিযোদ্ধা। জানা যায়, ১৯৭১ সালে ইউসুফ হায়দার বাঙালি হয়েও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে লড়াই করেছিলেন (কবির, পৃষ্ঠা ৩০ ও ৬২) আর ইউসুফ হায়দার চেয়ারম্যান হিসেবে যে ট্রায়াল পরিচালনা করেন সেখানে অভিযুক্ত ছিলেন কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, মেজর জিয়াউদ্দিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধারা।

    মুক্তিযুদ্ধের পর আবু তাহেরের মতো আবুল মঞ্জুরের সঙ্গেও জিয়ার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জিয়ার আস্থাভাজন মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ সিজিএসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই পদে আগে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।

    লক্ষণীয় যে, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মঞ্জুর আর তাহের পাকিস্তান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। দুজনকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় দুটি সেক্টরের কমান্ডার করা হয়। তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া এবং খালেদ-শাফায়াতের অনুগত অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত করা হলেও মঞ্জুর এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা জিয়ার অনুগত হিসেবেই সেনাবাহিনীতে থেকে যান।

    তার মানে দেখা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা ঐক্যবদ্ধ থাকার পরিবর্তে আলাদা আলাদা শিবিরে বিভক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন।

    সত্তরের দশকের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অফিসাররা একাধিকবার জিয়াকে উৎখাতের চেষ্টা করেন। ১৯৮০ সালে দুই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল দিদারুল আলম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুন্নবী খানের মাধ্যমেও এই অফিসাররা জিয়ার বিরুদ্ধে সেনা-অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। নুরুন্নবী খান মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সের একটি বাহিনীতে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন। জিয়ার বিরুদ্ধে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানসমূহের কোনোটাই অবশ্য সফল হয়নি।

    রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জেনারেল জিয়া মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিজের রাজনৈতিক দলে স্থান দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়া ডানপন্থী রাজনীতিবিদ শাহ্ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।

    জিয়ার এই পদক্ষেপ তাঁর অনুগত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, জিয়া নিহত হওয়ার দু মাস আগেই ঢাকা সেনানিবাসে এক অনুষ্ঠানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা শাহ্ আজিজুর রহমানের মতো স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিকে কী করে প্রধানমন্ত্রী করা হয় সে ব্যাপারে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াকে (মল্লিক, পৃষ্ঠা ৮)। অ-মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল এরশাদকেও সেনাপ্রধান করা হয়েছিল।

    এর আগেই ১৯৭৭ সালে ঢাকা সেনানিবাসে বিমানবাহিনীর সৈনিকদের একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দুই জ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা অফিসার আবুল মঞ্জুর আর মীর শওকত আলীকে যথাক্রমে চট্টগ্রাম আর যশোর সেনানিবাসের জিওসি করে ঢাকা থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা সেনাসদরের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে তখন চলে আসেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসাররা।

    মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে আবুল মঞ্জুর যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। দেখা যায় সেই সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে যে, মঞ্জুরের চারপাশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে জড়ো করা কি মঞ্জুরের আগ্রহে নাকি অন্য কারও পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছিল? চট্টগ্রামে কোনো সেনাবিদ্রোহ ঘটলে একসঙ্গে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে দায়ী করা যাবে এই কারণেই কি কোনো গোষ্ঠী সচেতনভাবে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের চট্টগ্রামে নিযুক্ত করছিল?

    সেনাবাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় গিয়েও ক্রমশ সেনাবাহিনী থেকে দূরে সরে দলীয় রাজনীতির দিকে জিয়ার ঝুঁকে পড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিপ্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধান সৃষ্টির ব্যাপারে মঞ্জুরের আগ্রহ নিয়ে জিয়ার সঙ্গে মতবিরোধ এবং কিছু সামরিক অফিসার ও বিএনপির বিভিন্ন নেতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রভৃতি কারণে মঞ্জুর জিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলে জানা যায় (আলি, পৃষ্ঠা ১৫৪-৫৫)।

    সেনাপ্রধান এরশাদের সঙ্গেও মঞ্জুরের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই অবস্থায় এরশাদের ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার আর মঞ্জুরের অনুগত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে একটি বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছিল তা ধারণা করা যায়।

    ওদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হিসেবে একদিকে যেমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের কাছে প্রিয় ছিলেন, তেমনি তিনি পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসারদেরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। জিয়ার বিভিন্ন পদক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা পছন্দ করেননি, তাঁরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসাররা সংখ্যায় বেশি হয়েও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারছিলেন না।

    এমন জটিল এক পরিস্থিতিতেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সফরের সময় শেষ রাতে এক সামরিক হামলায় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে মঞ্জুরের অধীনস্থ সেনা অফিসাররা এই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাই হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল মঞ্জুরকেই এই পরিস্থিতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

    ৩০ মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ওপর আক্রমণ চালানো হবে তা কি জেনারেল মঞ্জুর জানতেন? সেই সময় চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, যেদিন রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম পৌঁছান তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য জেনারেল মঞ্জুর বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন না। মঞ্জুর কেন আসেননি সে ব্যাপারে জিয়া চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অন্য একজন উর্দ্ধতন সেনা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেসও করেন (এই প্রসঙ্গে আবার অন্য বর্ণনায় জানা যায়, রাষ্ট্রপতি জিয়াই নাকি জেনারেল মঞ্জুর যেন বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে না আসেন সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন)।

    সার্কিট হাউসে হামলায় জিয়া নিহত হওয়ার পর সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুর সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, সেই বৈঠকে জিয়াউর রহমানের সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বর্ণনা করে মঞ্জুর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এই অবস্থায় দেশপ্রেমিক শক্তির মাধ্যমে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এই বিপ্লবের অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে কি না বা কারা তাঁকে হত্যা করেছে সে ব্যাপারে কিন্তু মঞ্জুর আলোকপাত করেননি। তিনি কেবল জানান যে, একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়েছে, কিন্তু তিনি একবারও বলেননি কে এই পরিষদের প্রধান এবং পরিষদের সদস্য কারা। মঞ্জুর জানান যে, তিনি বিপ্লবী পরিষদের মুখপাত্র।

    পরের দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকেও মঞ্জুর একই কথা বলেন। তাঁর এমন বক্তব্য অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে, কীভাবে বিপ্লবী পরিষদ তাদের কাজ পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে কোনো ধারণা তিনি দিতে পারেননি। কখনও তাঁর কোনো উত্তর নিজের বক্তৃতার সঙ্গেই সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে (চৌধুরী, পৃষ্ঠা ১৬, ৬০, ৬৮)।

    যথেষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে জিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলে এবং মঞ্জুর আগে থেকেই তা ভালোভাবে জানলে পরবর্তীতে তাঁর কথাবার্তায় এমন অস্পষ্টতা আর সঙ্গতিহীনতা আসত কি? এমন একটি ধারণা করা যায় যে, মঞ্জুরের অধীনস্থ অফিসাররা জিয়াকে হত্যা করার পর মঞ্জুরকে বাধ্য হয়েই অফিসারদের পক্ষ অবলম্বন করতে হয়েছিল।

    সার্কিট হাউসে হামলার ব্যাপারে মঞ্জুর আগে জানতেন না এ ব্যাপারে একটি ধারণা পাওয়া যায় মেজর রেজাউল করিমের বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে। জিয়া হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর, ৩০ মে সকালে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে মেজর রেজাউল করিমের যখন প্রথম দেখা হয় তখন মঞ্জুর রেজাকে প্রশ্ন করেন সার্কিট হাউসে গিয়ে রেজা কী কী দেখেছেন তা নিয়ে। মেজর রেজা জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের মৃতদেহের কথা জিওসিকে জানালে মঞ্জুর দুবার বলেন, “ওহ্, হোয়াট দে হ্যাভ ডান! হোয়াট দে হ্যাভ ডান!”

    এরপর মঞ্জুর নিজের অধীনস্থ কিছু অফিসার সম্পর্কে রেজাকে বলেন, ‘‘ওদের তো মাথা গরম, তোমার মাথা ঠান্ডা আছে, তাই এখন থেকে তুমি আমার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।’’

    বোঝা যায়, মঞ্জুর তাঁর সেনানিবাসের সেই সব অফিসার যারা সার্কিট হাউসে হামলায় অংশ নিয়েছিল তাদের উত্তেজিত অবস্থা নির্দেশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, সার্কিট হাউসে হামলায় অংশ নেওয়া অফিসারদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পর্যন্ত বিভিন্ন পদের অফিসাররা ছিলেন। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। আর সে কারণে তাঁরা জেনারেল মঞ্জুরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

    কিছুদিন আগেই ঘটে গিয়েছিল আরেকটি ঘটনা। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কমান্ডারের পদ থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে বদলি করা হয় ঢাকায় ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট হিসেবে। এর অর্থ, জেনারেল মঞ্জুর পদাতিক ডিভিশনের সক্রিয় কমান্ডে আর থাকবেন না। উপরন্তু, স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট হিসেবে তাঁকে সিজিএসের নির্দেশ মানতে হবে যে, সিজিএস পদে মঞ্জুর কয়েক বছর আগে নিজেই ছিলেন। ফলে বদলির এই আদেশ মঞ্জুরসহ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাঁর অনুরক্ত অফিসাররা মেনে নিতে পারেননি। রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতি তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

    ৩০ মে ভোর রাতে সার্কিট হাউসে হামলার পরিকল্পনা করায় এবং হত্যাকাণ্ড ঘটার পর সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন দুজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার: চট্টগ্রাম ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার্সের সিনিয়র স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবুর রহমান। মেহবুব ছিলেন জেনারেল মঞ্জুরের আপন ভাগ্নে।

    সার্কিট হাউসে হামলায় কেবল অফিসাররাই অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন অফিসারের বর্ণনায় জানা যায় যে, তাদের বলা হয়েছিল প্রেসিডেন্টকে সার্কিট হাউস থেকে তুলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে নিয়ে আসা হবে, বিভিন্ন দাবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, জিয়ার নিরাপত্তায় নিয়োজিত অফিসার ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে হামলাকারীদের গোলাগুলি শুরু হওয়ার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া তাঁর কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে এক ঝাঁক গুলি করে জিয়াকে হত্যা করেন।

    (উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই মতিউর রহমান সেনাবাহিনীর আরও দুই অফিসার ডালিম আর নূরের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ডালিম ও নূর জড়িত ছিলেন সক্রিয়ভাবে)।

    যে প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, কার নির্দেশে মতিউর রহমান সেদিন জিয়াকে গুলি করেছিলেন? এর উত্তর কখনও জানা যায়নি। কারণ চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সেনা কর্মকর্তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে জেনারেল মঞ্জুর এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অফিসার সেনানিবাস ত্যাগ করে পালানোর চেষ্টা করেন। পলায়নের সময় একটি স্থানে সরকারের অনুগত একদল সৈনিকের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। সে সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবুর রহমান নিহত হন।

    মেজর রেজাউল করিমের বক্তব্য থেকে একটি তথ্য জানা যায়; তা হল, মতিউর রহমান জিয়া হত্যাকাণ্ডের অল্প কদিন আগে ঢাকায় আর্মি হেড কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন। সেখানে সেনাপ্রধান এরশাদসহ অনেকের সঙ্গেই নাকি তিনি কথা বলেছিলেন (কবির, পৃষ্ঠা ১৮৭)। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান তখন কী আলোচনা করেছিলেন তা জানা যায়নি। অথচ তিনিই পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানকে গুলি করে হত্যা করেন।

    জেনারেল মঞ্জুর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে পুলিশের হেফাজতে থেকেই বিচারের সম্মুখীন হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে একটি সেনাদল গিয়ে পুলিশি হেফাজত থেকে মঞ্জুরকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনেহিঁচড়ে সেনানিবাসে নিয়ে আসে এবং দ্রুত তাঁঁকে হত্যা করা হয়।

    মঞ্জুরকে একদল উত্তেজিত সেনাসদস্য হত্যা করেছে এ কথা বলা হলেও দেখা যায়, মঞ্জুরের মাথায় পিস্তল দিয়ে মাত্র একটি গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিক কাউকে হত্যা করলে মৃত ব্যক্তির শরীরে একাধিক আঘাত থাকার কথা। কিন্তু মঞ্জুরের শরীরে তা ছিল না।

    জানা যায়, মঞ্জুর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এই তথ্য জানার পর তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দিন সেনাপ্রধান এরশাদকে বলেছিলেন মঞ্জুরকে কোনোভাবেই হত্যা না করতে। মঞ্জুরের হত্যার পর এরশাদ সদরুদ্দিনকে জানান, একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্য মঞ্জুরকে হত্যা করেছে। সদরুদ্দিন তখন ক্ষুব্ধকন্ঠে এরশাদকে বলেছিলেন, “এই গল্প অন্য কাউকে বলুন। অ্যাট লিস্ট ডোন্ট আস্ক মি টু বিলিভ ইট।”

    এর কদিন পরই মুক্তিযোদ্ধা অফিসার সদরুদ্দিনকে বিমান বাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় (ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪)।

    প্রশ্ন ওঠে, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে জেনারেল মঞ্জুরকে বিচারের সম্মুখীন না করে কেন তাঁকে দ্রুত হত্যা করা হল? দুই লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও মেহবুবুর রহমানকেই-বা হত্যা করা হয়েছিল কেন? মঞ্জুর-মতিউর-মেহবুব বেঁচে থাকলে জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে কারা কারা যুক্ত ছিলেন সে তথ্য প্রকাশিত হয়ে যেত বলেই কি দ্রুত এই তিনজনকে হত্যা করা হয়?

    সেনাবাহিনীতে মেধাবী এবং বুদ্ধিমান অফিসার হিসেবে মঞ্জুরের সুনাম ছিল। দশ বছর আগেই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতেও তিনি পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। পুরো সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া কেবল চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কিছু অফিসারের মাধ্যমে বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা গ্রহণ যে সম্ভব নয় এ কথা নিশ্চয়ই মঞ্জুরের মতো একজন অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সেনা কর্মকর্তার অনুধাবন করার ক্ষমতা ছিল।

    মঞ্জুর যদি জিয়াকে জোরপূর্বক বন্দি বা হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে থাকেন সে ক্ষেত্রে এটাই ভাবা স্বাভাবিক যে, মঞ্জুরকে অন্য অনেক ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু জিয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর দ্রুত মঞ্জুরসহ চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যাকাণ্ডে যুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। মঞ্জুরকে বিচারের মুখোমুখি করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়নি যা সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাছাড়া কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরই গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম কারাগারের একটি অংশে আদালত বানিয়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে সামরিক বিচারের সম্মুখীন করা হয়।

    সেই কোর্ট মার্শালে এই অভিযুক্ত অফিসারদের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অফিসার ছিলেন তৎকালীন কর্নেল মোহাম্মদ আইনউদ্দিন। তিনি পরবর্তীতে কোর্ট মার্শালের ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর এবং এই কোর্ট মার্শালে দশ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া মেজর রেজাউল করিমের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ব্রিগেডিয়ার মোহসীন, কর্নেল নওয়াজেশ, কর্নেল মাহফুজ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেলাওয়ার, মেজর রওশন ইয়াজদানী, মেজর মুজিব প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হেভি টর্চার করে তাদের থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়।

    অত্যাচারের ফলে ব্রিগেডিয়ার মহসীনের পুরো পিঠে অক্ষত জায়গা ছিল না, কর্নেল মাহফুজের হাতের সবগুলো নখ সুঁই ফুটিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এভাবে টর্চার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার বিধান মিলিটারি বা সিভিল কোনো আইনেই নেই।

    লক্ষণীয় যে, কোর্ট মার্শালে অভিযুক্ত ছিলেন কেবল মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই। সে সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে চার জন ব্রিগেড কমান্ডারের তিনজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা– ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্ণেল নওয়াজেশ ও কর্নেল রশিদ। এই তিনজনকেই কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসি দেওয়া হয়। অপর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার লতিফ ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। তাকে কোর্ট মার্শালে অভিযুক্তই করা হয়নি।

    আরেক পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের তৎকালীন কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু তাকেও বিচারের আওতায় আনা হয়নি। আইনউদ্দিন আরও জানিয়েছেন, ব্রিগেডিয়ার মহসীন, কর্নেল নওয়াজেশ, কর্নেল রশিদ, কর্নেল মাহফুজ, মেজর মোমিনুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অফিসার যে সেনা-বিদ্রোহে জড়িত ছিলেন সে অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। তারপরও তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় (মাণিক, পৃষ্ঠা ২৯-৬০)।

    এই কোর্ট মার্শালের জন্য যে সামরিক কোর্ট গঠন করা হয় তার সাত সদস্যের মধ্যে ছয় জনই ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত। জানা যায়, এই কোর্টের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল আবদুর রহমান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা-বিদ্বেষী এবং তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গালাগালি করতেন (মাণিক, পৃষ্ঠা ৫৯)। কোর্টের সাত সদস্যের মধ্যে একজনও যদি অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরুদ্ধে থাকতেন তাহলে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া যেত না। কিন্তু কোর্টের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সদস্য কর্নেল মতিউর রহমানও এতোজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিরুদ্ধে বলেননি।

    এ প্রসঙ্গে আইনউদ্দিন লিখেছেন, “তিনি (মতিউর রহমান) যদি বলতেন, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, আমি ফাঁসি দিতে রাজি নই, তাহলে কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত না। কিন্তু তারা (কর্তৃপক্ষ) মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর থেকে এমন একজনকে বেছে নিয়েছিল যার কাছ থেকে তাদের মনমতো ব্যবহার পাবে।” (মাণিক, পৃষ্ঠা ৪৯)।

    এই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের টর্চার করায় নেতৃত্ব দিয়েছিল আরেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল আশরাফ। যিনি জেনারেল এরশাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং পরবর্তীতে এরশাদের শাসনামলে এনএসআইএর ডিজি হন।

    আইনউদ্দিনের মতে, চট্টগ্রাম কারাগারে এই গোপন সেনা-বিচার ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনের একটি ধাপ। বিচারটি খুব অন্যায্য ছিল বলে তিনি মনে করেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতাশালী, তার নির্দেশেই হয় এই কোর্ট মার্শাল। এই কোর্ট মার্শালে যে অনিয়মসমূহ চোখে পড়েছে তার দায়দায়িত্ব জেনারেল এরশাদ এড়াতে পারবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে বলে আইনউদ্দিন মনে করেন (মাণিক, পৃষ্ঠা ৪০, ৫০, ৫২)।

    পুলিশের হেফাজত থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনী তাদের জিম্মায় নিয়ে আসার পর যখন মঞ্জুরকে হত্যা করা হল, সেটিতে জড়িতদের শনাক্ত করে অবশ্যই বিচার করা দরকার ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। বিচারের পর সেনাবাহিনী থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকেও বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। জিয়া ও মঞ্জুর নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধারাই দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিলেন। সে সময়ের ঘটনাসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে যে প্রশ্নসমূহ উঠে আসে তা নিয়ে তদন্তের উদ্যোগও নেই। কিন্তু সেই ঘটনাসমূহ ভুলে যাওয়া বা ঢেকে রাখার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সত্য অনুসন্ধান সব সময় প্রয়োজন, দেরিতে হলেও।

    সহায়ক গ্রন্থসমূহ:

    ১. S. Mahmud Ali, “Understanding Bangladesh” (New York: Columbia University Press, 2010)

    ২. Ziauddin M. Choudhury, “Assassination of Ziaur Rahman and the Aftermath” (Dhaka: The University Press Limited, 2009)

    ৩. জুলফিকার আলি মাণিক, “জিয়া হত্যাকাণ্ড: নীল নকশার বিচার”

    (ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৬)

    ৪. ত্রিশোনকু মল্লিক, “চট্টগ্রাম সেনাবিদ্রোহ”

    (ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ, ২০১৫)

    ৫. আনোয়ার কবির, “সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা: ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১” প্রামাণ্য চিত্রের গ্রন্থরূপ

    (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৪)

    ৬. এ. এস. এম সামছুল আরেফিন, “জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড এবং তারপর”

    (ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউস, ১৯৯৮)

    ৭. মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি, “একাশির রক্তাক্ত অধ্যায়”

    (ঢাকা: আফসার ব্রাদার্স, ২০০২)।

  9. মাসুদ করিম - ২ অক্টোবর ২০২১ (৪:১১ পূর্বাহ্ণ)

    বিদ্রোহ দমনের নামে স্বজন হত্যায় জিয়ার বিচার দাবি
    https://samakal.com/todays-print-edition/tp-last-page/article/2110123482/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%B9-%E0%A6%A6%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BF

    বিদ্রোহ দমনের নামে মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও বিমানবাহিনীর শত শত সদস্যকে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনায় তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বিচার চেয়েছেন তাদের স্বজনরা। ওই সময়ে ঘটনার শিকার পরিবারের সদস্যরা গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে মানববন্ধন থেকে এ দাবি তোলেন।

    ভুক্তভোগী সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অস্থায়ী বেদি বানিয়ে সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। পাশাপাশি প্রহসনের ওই বিচারে জড়িতদের প্রতি ধিক্কারও জানান তারা।

    স্বজনরা বলছেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ১৪শ জনকে ফাঁসি এবং ফায়ারিং স্কোয়াডের নামে হত্যা করে লাশ গুম করেছিলেন। এক দিনের সামরিক আদালতে বিচারের নামে সেই রাতেই ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর ও বগুড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি সম্পন্ন করা হয়। রাতের আঁধারে কারফিউর মধ্যে কোনো ধরনের ধর্মীয় সৎকার ছাড়াই লাশগুলো আজিমপুর কবরস্থান এবং কুমিল্লার টিক্কারচর কবরস্থানে মাটিচাপার ব্যবস্থা করেন জিয়া। মূলত নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য জিয়ার নির্দেশে তখন বেছে বেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়। একই সময়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা সদস্য ও কর্মকর্তাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং চাকরিচ্যুতও করা হয়।

    গতকালের কর্মসূচিতে ফাঁসির শিকার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও ওই সময়ে সামরিক আদালতে কথিত বিচারে কারাদণ্ড পাওয়া ও চাকরিচ্যুত হওয়া অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তারা ‘১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর খুনি জিয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর যেসব সদস্যকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়েছে তাদের আংশিক তালিকা’ শিরোনামে একটি ব্যানারও টানান।

    ওই সময় ফাঁসির নামে হত্যার শিকার হন বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান মিঞা। তার ছেলে কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন জানান, তারা তৎকালীন কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে ফুল দিয়ে ওই সময়ের শহীদদের স্মরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি না পেয়ে ফটকের সামনে অস্থায়ী বেদি বানিয়ে তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন।

    তিনি বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেওয়ার আগে আত্মপক্ষ সমর্থন বা আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরিবারগুলোকেও কিছু জানানো হয়নি তখন। আমরা জানি না আমাদের বাবার কবর কোথায়। তাই হতভাগ্য সন্তানেরা-স্বজনেরা ৪৪ বছর পর একত্র হয়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষগুলোকে নির্দোষ হিসেবে দায়মুক্তি দেওয়ারও দাবি জানান তারা। এসব দাবিতে আজ শনিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন তারা।

  10. Pingback: রাজনৈতিক বিরতি | প্রাত্যহিক পাঠ

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.