অমর্ত্য সেন ভারতীয়দের ইংরেজ উত্তরাধিকারের ভালোদিক নিয়ে একটি বই লিখেছেন The Argumentative Indian। পরে বইটির বাংলা অনুবাদ বেরিয়েছে ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ এবং বাংলা অনুবাদটি তিনি অনুমোদন করেছেন। ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ দুটোর একটাও আমি পড়িনি। এ উপমহাদেশের অন্যদের কথা জানি না, তবে আমাদের দেশের মানুষের যে তর্কে মতি আছে তা জানি; এবং একে ঠিক ‘তর্কপ্রিয়’ও বলব না, তারচেয়ে ‘তর্কগ্রস্ত’ বলার দিকেই আমার পক্ষপাত থাকবে। (Argumentative: A person who is argumentative likes arguing or often starts arguing. Argument: A conversation or discussion in which two or more people disagree , often angrily.) অভিধানে উল্লেখিত উপরের অর্থেই আমাদের দেশের মানুষ Argumentative, এবং অভিধান বর্ণিত অর্থেই তারা Argument করে থাকেন। কিন্তু আমরা Argumentative-এর পাশাপাশি Vindictive (Vindictive: trying to harm or upset somebody or showing that you want to, because you think that they have harmed you.)-ও, জানি না প্রতিশোধপরায়ণতা আমাদের মধ্যে উপনিবেশবাহিত, না কি আদি-অকৃত্রিম মন্ত্রেই আমরা প্রতিশোধপরায়ণতায় দীক্ষিত।
এই কথাগুলো সব বললাম বাংলার নেতা ও ত্রাতা শেখ মুজিবের প্রতি আমাদের সাধারণ মনোভাবের দৈন্যতা ও তাকে হেয় করবার তৎপরতার দিকে লক্ষ্য রেখেই। আমাদের সাধারণ মনোভাব তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন ঠিক কিন্তু তিনি সারাক্ষণ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত ভুল করেছেন, এবং সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন ‘বাকশাল’ গঠন করে তাই তার ওপর ১৫ আগস্ট হামলা চালানো হয় এবং তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ছিনিয়ে আনা হয়।
১৫ আগস্ট ২০০৯-এর সমকালে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলাম কালের আয়নায় পনেরো আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি যদি সংঘটিত না হতো পড়ার পর আমি এখানে কলামটি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে দিলাম এই জন্য যে আমরা তাকে ও তার প্রবর্তিত বাকশালকে প্রতিনিয়ত হেয় করেছি এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছি, আমাদের ভাবনায় এই বেদনাবোধ যেন জাগ্রত হয় এবং আমরা যেন তাকে ও তার কাজকে গণ্ডিবদ্ধভাবে না দেখি, তার উচ্চতায় আমাদের জাতিসত্তার প্রবলতম সংগ্রামী মানুষটিকে যেন আর অশ্রদ্ধা না করি।
পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি যদি না ঘটত এবং বঙ্গবন্ধু তার বাকশাল শাসনব্যবস্থা চালু করতে পারতেন তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা আজ কী দাঁড়াত সে সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে সুষ্ঠু চিন্তাভাবনার দরকারআছে।…ব্রিটিশ আমলের আমলাতন্ত্রের হাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বন্দি ছিল। নির্বাচিত জেলা গভর্নর প্রথা সেই বন্দি অবস্থা থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করত। এজন্যই এই গণতন্ত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল শোষিতের গণতন্ত্র।
শেখ মুজিবের বাকশাল ব্যবস্থায় নির্বাচিত জেলা গভর্নরদের অধীনে আমলাতন্ত্রকে ন্যস্ত করা হয়েছিল। ফলে দেশের সিভিল ব্যুরোক্রেসি ভয়ানকভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের বহু যুগের আধিপত্য ধ্বংস হতে বসেছে জেনে বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্রান্তে শামিল হয়।
আইনজীবীদের মধ্যে ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট, মোক্তার এই তিন শ্রেণী বিভক্তি লোপ করে সবাইকে অ্যাডভোকেট শ্রেণীভুক্ত করা হয়। তাতে ব্যারিস্টার ও অ্যাডভোকেট শ্রেণী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আমার মনে আছে, তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মির্জা গোলাম হাফিজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আইনের পেশাই ছেড়ে দেব। শেখ মুজিব কি চান মোক্তার –মুহুরিদের পঙক্তিতে আমাদের নিয়ে বসাতে?’ আমার জানামতে, মেখ মুজিব তা চাননি। তিনি অ্যাডভোকেটদের মোক্তার পর্যায়ে নামাতে চাননি, চেয়েছিলেন মোক্তারদের জন্য ট্রেনিংয়ের শর্ট কোর্স প্রবর্তন করে অ্যাডভোকেট পর্যায়ে উন্নীত করতে।
আমার মনে আছে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে এক ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার আইনটি যখন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য তার কাছে আসে, তখন আওয়ামী লীগেরই দু’জন মন্ত্রী তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তিনি যেন এই আইনে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর কয়েকদিন বিলম্বিত করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তারা অনেক জমির মালিক এবং আইনটি পাস হওয়ার আগে এ জমির মালিকানা পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে হস্তান্তর করে বেনামে তার মালিকানা অক্ষুন্ন রাখতে চান।
বাকশাল পদ্ধতিতে সমাজের মাথাওয়ালাদের সুযোগ ও স্বাধীনতা প্রয়োজনে খর্ব করে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে সুদূর অতীত থেকে অনুপস্থিত গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারগুলো এই প্রথমবারের মতো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে বাকশালের বিরুদ্ধে যে বিরাট চিৎকার শুরু হয়েছিল, তা সমাজের উপরতলার শিক্ষিত ও সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলোর চিৎকার। তৃণমূলের জনগোষ্ঠীর চিৎকার ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে ছুটে গেছেন। চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শত্রুতা করা সত্ত্বেও বেইজিংয়ের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শেখ মুজিবের টি-ডিপ্লোমেসি নামে খ্যাত মৈত্রীর হাত বাড়ানোর নীতি অধিকাংশ আরব দেশকে এই বলে আশ্বস্থ করেছিল যে, তিনি সংগ্রামী আরব স্বার্থের বন্ধু। পাকিস্তানের ভুট্টোকেও তিনি বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছিলেন শুধু এই দেশটির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তখনকার দিল্লি-মস্কো জোটের সমর্থন ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মার্কিন নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের আরও বৈরিতা সৃষ্টির মতো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ভারতের ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে তিনি যে মৈত্রী গড়ে তুলেছিলেন তা ছিল কিংবদন্তির মৈত্রীতুল্য। একটি বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশীর দ্বারা তিন দিক থেকে পরিবেষ্টিত থাকা অবস্থায় কীভাবে একটি ছোট দেশ তার আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বড় দেশটির সঙ্গে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু কি ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখেছিলেন? এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় যাওয়ার এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ব্রিটেনের লর্ডসভার মানবতাবাদী সদস্য প্রয়াত লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব তার দেশকে একবার নয়, দু’বার স্বাধীন করেছেন। একবার পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আরেকবার ভারতীয় সৈন্যদের দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাস না যেতেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে। শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরতে না পারলে ভারতের সৈন্য বাংলাদেশ থেকে দ্রুত প্রত্যাহার হতো না।’
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকায় পানি ভাগ নিয়ে বিবাদের মীমাংসা করতে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফকে সালিশ ও সাহায্যদাতা হতে হয়েছে, সেখানে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সমস্যায় মুজিব সরকার দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই ৪০ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারতের এক সাংবাদিক দিল্লির এক ইংরেজি দৈনিকে কিছুকাল আগে লিখেছেন, শেখ মুজিব আজ বেঁচে থাকলে এবং তার নীতি দ্বারা বাংলাদেশ চালিত হলে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ-ভারতের মৈত্রী আজ বিশ্বে এক উদাহরণ সৃষ্টি করত এবং দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা, সীমান্ত-সংঘর্ষ দূর অতীতের দুঃস্বপ্নে পরিণত হতো।
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১৭ comments
রায়হান রশিদ - ১৬ আগস্ট ২০০৯ (১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
ধন্যবাদ মাসুদ ভাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালের কতখানি পক্ষ নেয়া সম্ভব, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। বহু দলীয় গণতন্ত্র যাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র তিনি কিভাবে বাকশালের মত একটি চিন্তা আদৌ মনে স্থান দিলেন, সেটা আমার বোধগম্য না। শহীদ তাজউদ্দিনের একটি মন্তব্যই কেবল মনে পড়ছে: “এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রক্তপাতহীনভাবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার সব পথ বন্ধ করলেন”। থাক সে সব কথা। বাকশাল ব্যবস্থা নিয়ে তেমন জানা নেই; সুতরাং বাকীরা সে বিষয়ে আলোকপাত করলে ভাল হয়। আমি শুধু কয়েকটি সাধারণ প্রচারণার দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে একটা কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয় এবং আমরা বেশীর ভাগ মানুষই কিঞ্চিত বুঝে আর বাকীটা না বুঝে তাতে সায় দিই:
বঙ্গবন্ধুর কিছু ভয়ংকর ভুল তো ছিলই, আর সে রকম ভুল একটাও করেননি এমন নেতা কিন্তু গোটা পৃথিবীতে খুঁজেও একজন পাওয়া যায় কিনা বলা কঠিন। কিন্তু আমরা জনগণ যে ভুলটা করে এসেছি সবসময় তা হল, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বিচারে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটির তখনকার আর্থ সামাজিক বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটগুলো ঠিকভাবে আমলে আনতে পারিনি; স্বাধীন এই রাষ্ট্রটির স্বীকৃতি পর্যন্ত যখন ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল একাধিক পরাশক্তি রাষ্ট্র। আর কিছু ভুল তো বহুগুণে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে সবসময়। এতো বার সেগুলো বাজিয়ে শোনানো হয়েছে আমাদেরকে যে আজকে আমরা বেশীর ভাগ মানুষই কিন্তু বিনা প্রশ্নে সে সব একরকম সত্য বলেই ধরে নিই। তিন দশকের রাষ্ট্রীয় প্রপাগ্যান্ডা যন্ত্রের ভূমিকাকে তাই খাটো করে দেখি কিভাবে। যেমন ধরা যাক, সংস্কৃতি-কর্মী মাত্রই জানেন, পঁচাত্তর থেকে নব্বই, একটা দীর্ঘ সময় এমনকি কিছু কিছু কবিতা পর্যন্ত (যেমন: নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’) মঞ্চে আবৃত্তি করা যেতো না। প্রতিটি অনুষ্ঠানের আগে ‘কর্তৃপক্ষের’ নির্দেশে নিয়ম করে স্ক্রিপ্ট পরীক্ষা করা হোতো, পাছে যদি কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে ফেলে! কিন্তু তারপরও জানি, আমার পরিচিত বহু মানুষই এ কাজ করেছে – মঞ্চে উঠে স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে সেই সব ‘নিষিদ্ধ’ কবিতার লাইনগুলোই উচ্চারণ করতেন তাঁরা। কিন্তু এই ছিল প্রচার যন্ত্রের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের চিত্র!
এক ধরণের অপ-প্রচারণা চালু রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্টেটসম্যানশিপ নিয়েও। সরাসরি কাজ করার সুবাদে এমন অন্তত দুটো সেক্টরের কথা জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, যার ফলে কিছু বিষয় নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার একটি হল জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ সেক্টর, আরেকটি হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আইনগত-প্রতিষ্ঠানগত অবকাঠামো নির্মাণ সেক্টর। এই দুটো সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি ‘বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত’ এই সব প্রচারণার পুরোটা কিন্তু সত্য নয়; অন্তত যতটা সরলভাবে উপস্থাপন করা হয় ততটা তো নয়ই!
সরাসরি বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে এই দুটো সেক্টরে যাঁরা কাজ করেছেন ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত, তাঁদের মধ্যে ছিলেন হার্ভার্ড-কেমব্রীজ-অক্সফোর্ড-এলএসই থেকে পাশ করা সেরা বিশেষজ্ঞদের টীম। এমন বেশ কিছু ঘটনা জানি, যখন এই বিশেষজ্ঞদের টীম স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ধার করে অনেক গবেষণা করে কোনো একটা মহা-পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছেন, আর বঙ্গবন্ধু সেটা একবার শুনেই সে সবের ভেতরের মূল সমস্যাগুলো এবং বিপদগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁদেরকে। সেই ধরিয়ে দেয়ার ফলে পরিবর্তিত যে নীতিমালা সেগুলোই কিন্তু পরবর্তীতে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেই সব বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত আছেন, তেমনই দু’একজনের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। একজনের মন্তব্য উদ্ধৃত করছি:
“… দেশের … প্রস্তাবটা পেয়ে আমাদের টীমের সবাই উত্তেজিত; কল্পনার বাইরে ভাল একটা প্রস্তাব; এক টাকাও খরচ হবে না দেশের অথচ … পুরো কাজটা ওরা করে দেবে নিজেদের খরচে; মুজিব ভাইয়ের কাছে দুঘন্টা ধরে আমরা প্রেজেন্টেশন দিলাম; শুনে উনি একটাই প্রশ্ন করলেন, ’তোদের মধ্যে কেউ আমাকে বল, বিনা পয়সায় ওরা কেন এত বড় খরচের একটা কাজ করে দিতে চাইবে, ওরা আসলে কি চায়?’ আমাদের মধ্যে কেউই মুজিব ভাইয়ের সেই প্রশ্নের এবং পরবর্তী নীতিমালা সংক্রান্ত টেকনিক্যাল প্রশ্নগুলোর সদুত্তর দিতে পারিনি। এর পর তিনি পাল্টা কিছু নীতিগত কৌশল বাতলে দেন জটিল সেই নেগোশিয়শনের জন্য, যেগুলো পরবর্তীতে সঠিক এবং ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়েছিল।”
এই ঘটনাটা উল্লেখ করছি এ কারণে যে, জনগণের মধ্য থেকে রাজনীতির প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নেতাদের এমন অনেক কিছু মাঠ থেকেই শেখা হয়ে যায় যা পৃথিবীর সেরা ইন্সটিটিউশনগুলোও কাউকে ধরে বেঁধে শেখাতে পারে না। আর এই প্রক্রিয়ার সেরা ফলাফল ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে, সে তো আমরা সবাই মানি। তাই যদি না হোতো, তাহলে বিভিন্ন সময়ে পিএইচডি-ধারী উপদেষ্টারা শাসন করতে গিয়ে এত এত লেজে গোবরে অবস্থা তৈরী করতো না, যেটা আমরা গত দুই বছরেই বহুবার ঘটতে দেখেছি।
সবশেষে শুধু এ-ই বলবো – মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন, এবং একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা – একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপগুলো মেনে নিতে পারিনি। তবে এখানে আমার মনে একটা খটকাও রয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা আওয়ামী রাজনীতির বৃহৎ ছাতার সুযোগ নিয়ে কে কোন্ সমীকরণকে মূখ্য করে তুলতে পেরেছিল নিজেদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে, সেটাও মনে হয় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এই গোষ্ঠিটি কিন্তু যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকেও কম সমস্যায় ফেলেনি। এদের সম্ভবত সবচেয়ে বড় সাফল্য মুজিব-তাজউদ্দিনকে আলাদা করতে পারা। স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, এবং সুবিধাবাদীরা সঠিক মন্ত্রণাদাতাদের অনেককেই বঙ্গবন্ধুর নিকট বলয় থেকে দুরে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল; আর বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণ পড়ে জানা যায়, এঁদের প্রত্যেককেই বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে গিয়েছিলেন আবারও ফিরিয়ে আনতে, সফল হননি (দ্রষ্টব্য: নুরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, কামাল হোসেন)। তাই, এই সব বিষয় আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনাগত ব্যার্থতা কখনই মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কিংবা নোংরা ভিলেজ পলিটিক্স, উদার কিংবা বড় মনের কোন মানুষের পক্ষেই যে সবের সাথে সমানে সমান তাল মিলিয়ে চলা মনে হয় না সম্ভব। বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনরাও পারেননি। হাজার হলেও শেষ বিচারে তাঁরা তো মানুষই ছিলেন, অতিমানব তো আর না। এই পরিপ্রেক্ষিতগুলোর বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন জরুরী, এই জাতির সঠিক ইতিহাসের স্বার্থেই।
বিনয়ভূষণ ধর - ১৭ আগস্ট ২০০৯ (১২:২৮ অপরাহ্ণ)
১৫ই আগস্ট ২০০৯-এর দৈনিক “যায় যায় দিন” পত্রিকায় প্রকাশিত ডা: এস এ মালেকের কলাম “কেন বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন?” এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা হলো……
মোহাম্মদ মুনিম - ১৭ আগস্ট ২০০৯ (১১:৪৯ অপরাহ্ণ)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এ কি হয়েছে এবং কি হতে পারতো এই নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার পরবর্তী ৩৫ বছরের রাজনীতি নিয়ে এর কিয়দংশ আলোচনাও হয়নি। বঙ্গবন্ধু কিভাবে দেশ চালিয়েছেন, তা নিয়ে দেশের একটি বিরাট অংশের অসন্তোষ ছিল। তাদের অসন্তোষটাই বিএনপির রাজনীতির মুল অস্ত্র। সেই অস্ত্রটি সময়ের সাথে সাথে ভোঁতা হয়ে গেছে। ভোটাররা এবার আওয়ামী লিগে ভোট দিয়েছেন ২০০১-২০০৬ সালের বিএনপির বিকট দুর্নীতির জবাব দিতে গিয়ে। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের রাজনীতি এখন academic debate এর বিষয়, বাকশাল এর রাজনীতির তাত্বিক বিশ্লেষন আজকের বাংলাদেশে খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না।
বঙ্গবন্ধু কলকারখানা জাতীয়করন করে সর্বনাশ করেছিলেন, এমন একটা কথা এখনও শোনা যায়। কলকারখানাগুলোর মালিক ছিল পাকিস্তানিরা, তারা চলে যাবার পর সেগুলো জাতীয়করন না করে আর কি করা যেতো? যুদ্ধাপরাধীদের (যাদের নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই) সাধারন ক্ষমার ব্যাপারটিও যুক্তিযুক্তই মনে হয়। গাফফার চৌধুরীর লেখাটা পরে মনে হচ্ছে বাকশালের মধ্যে কিছু ultra romantic concept ছিলো, যেটি মধ্যবিত্ত এবং উঠতি ধনিক শ্রেনীকে খেপিয়ে দিয়েছিল। এদের খেপালে যে চলে না, সেটি সম্ভবত বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেননি।
রায়হান রশিদ - ১৮ আগস্ট ২০০৯ (১:১১ পূর্বাহ্ণ)
@ মোহাম্মদ মুনিম # ৩
‘৭২-‘৭৫ এর সময়টার ইতিহাসে বেশ কিছু বিষয়েরই তাৎপর্য এখনকার প্রেক্ষাপটে অনেকটাই একাডেমিক, এ বিষয়ে আপনার সাথে দ্বিমত নেই। তবে আপনি নিশ্চয়ই একমত হবেন যে সে সময়কার বাকশাল-ইস্যুর সাথে আরও দশটা বিষয়কে জড়িয়ে অনেক ধরণের অপ-প্রচার আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো চালু রয়েছে। এখনকার রাজনীতিতে সে সবের গুরুত্ব কিন্তু খুব কম না, আমরা চাই বা না চাই। এই অপ-প্রচারগুলোর লক্ষ্য – প্রথমত: নিজেদের অপকর্মগুলোকে জায়েজ করার চেষ্টা করা, দ্বিতীয়ত: মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বিতর্কের ঘোলা জল তৈরী করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। দুটোরই বিধ্বংসী ক্ষমতা খাটো করে দেখার উপায় নেই মনে হয়। যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি সম্ভবত তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এই ধোঁয়াটে অধ্যায়ের পাতায়। সাধারণ ক্ষমার বিষয়টিকে ভুলভাবে উপস্থাপন, যুদ্ধকালীন সময়ে প্রগতিশীল অনেক সংগ্রামী মানুষের ভূমিকাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা – ইত্যাদি কিছু বিষয়ে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন নতুন করে আরেক দফা অপ-প্রচারের ঝড় উঠেছে। আগামী দিনগুলোতে আরও কত ধরণের মিথ্যাই যে ছড়িয়ে দেয়া হবে সেটা ভাবতেও আশংকা হয়। কারণ সে সবের উদ্দেশ্য হবে জাতিকে (মূলতঃ তরুণ প্রজন্মকে) নতুন করে বিভাজিত এবং বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা। তাই মনে হয় বর্তমানের ঘটানাগুলোর পাশাপাশি ইতিহাসের সঠিক পাঠও তথ্য প্রমাণসহ নতুন করে ঝালিয়ে নেয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছে।
আপনি লিখেছেন: “যুদ্ধাপরাধীদের (যাদের নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই) সাধারন ক্ষমার ব্যাপারটিও যুক্তিযুক্তই মনে হয়।” এই বিষয়টিই প্রয়োজনের তাগিদে, অনেকটা রেকর্ডের খাতিরেই এখানে স্পষ্টভাবে আরেকটু বিস্তারিত তথ্যসহ লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এতে আশা করছি, যাদের মনে এ বিষয়ে এখনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে তারা তা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সহায়তা পাবেন।
ক.
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দালাল আইন করে ট্রাইবুনালের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারকার্য শুরু হয়। প্রাথমিক অবস্থায় অভিযুক্ত ছিল ৩৬ হাজারেরও বেশী লোক। এদের বেশীর ভাগের বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিলো না; আর বেশীর ভাগেরই অপরাধের মাত্রা তেমন গুরুতর ছিলো না। এ কারণে মূল অপরাধীদের পেছনে যেন মনোনিবেশ করা যায় সে জন্য ১৯৭২ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই ক্ষমা শুধু তাদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল যারা হত্যা ধর্ষণ অগ্নি-সংযোগ বা এ জাতীয় গুরুতর অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও প্রায় ১১ হাজার ভয়ংকর অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং বিচার কার্য বহাল ছিল। সেই বিচারে চিকন আলী নামের এক কুখ্যাত রাজাকারের বিরুদ্ধে ফাঁসীর আদেশও হয়েছিল।
খ.
বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন মূল যুদ্ধাপরাধীদের “সাধারণ ক্ষমা” তো করেইনি, বরং, আরও ভালোভাবে যাতে তাদের বিচার করা যায় সে জন্য International Crimes (Tribunals) Act প্রণয়ন করে ১৯৭৩ সালে। এই আইনটি প্রণয়নের সময় দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সহায়তাও নেয়া হয়েছিল যাদের মধ্যে নুরেমবার্গ-টোকিও ট্রায়ালের বিশেষজ্ঞদেরও কয়েকজন ছিলেন। সম্প্রতি এই আইনটিই সংশোধন করা হয়েছে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে যাতে এর আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুষ্ঠভাবে করা যায়। অসংশোধিত মূল আইন পাওয়া যাবে এই লিন্কে।
গ.
এর পর যা হয়েছে তা এক কলন্কের ইতিহাস। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সে বছরই ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন এবং এর আওতায় চলমান সমস্ত বিচারকার্যকে বাতিল করা হয়। বিচারকার্য বাতিল করে সকল ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধীকে চূড়ান্তভাবে ক্ষমা প্রদানের এই কুকর্মটি করেছিলেন বিচারপতি আবু সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান। দালাল আইন (এবং এতদসংক্রান্ত সকল বিচারকার্য) বাতিলকারী অধ্যাদেশটি এই লিন্কে পাওয়া যাবে। আইনটি প্রণয়নের তারিখের দিকে সবার মনযোগ আকর্ষণ করবো।
ঘ.
সবার সুবিধার্থে সাধারণ ক্ষমার মূল সার্কুলারটির পুরোটা উদ্ধৃত করছি এখানে। মন দিয়ে এর দুই নম্বর অনুচ্ছেদটি পড়ার অনুরোধ করবো (খুঁজে পাবার সুবিধার্থে অংশটা ইটালিক করে দেয়া হল)।
অরণি সেমন্তি - ৬ জানুয়ারি ২০১১ (১০:২৮ পূর্বাহ্ণ)
অনেকেই তো বলে থাকেন বঙ্গবন্দ্ধু ক্ষমতা নিেজর কাছে রাখার জন্য বাকশাল করেছেন। কিন্তু নির্বাচন তো হতই। এখানে এ বিষয়টি কেন আাসছে?
মাসুদ করিম - ২৯ জুন ২০১৩ (১০:৫২ পূর্বাহ্ণ)
বাকশাল কি? : https://www.facebook.com/RussellRahmanHW/posts/10152338402239057
মাসুদ করিম - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩ (১:৫২ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৭ মার্চ ২০১৫ (১০:৫০ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ (৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ (১২:২১ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ (১০:০৫ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ১৭ আগস্ট ২০১৯ (৫:০৫ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ২১ আগস্ট ২০১৯ (২:৪০ অপরাহ্ণ)
মাসুদ করিম - ১৩ জানুয়ারি ২০২২ (৬:০০ অপরাহ্ণ)
বঙ্গবন্ধু, বাকশাল এবং প্রসঙ্গ সিপিবি
https://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/68420
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র এবং সমতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে তার কারাগারে। নিজের পরিবার, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কথা না ভেবে, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে তিনি ভেবেছেন দেশের সব মানুষের কথা, তাদের অধিকারের কথা, সুখ ও নিরাপদ জীবনের কথা। সেজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, হয়েছেন জাতির পিতা। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিন বছর যেতে না যেতেই তিনি কেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ থেকে একদলীয় শাসনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, সেটা কি শুধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, নাকি এর পেছনে আরও কোনো ‘রাজনীতি’ ছিল? বাকশাল কি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল, নাকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্থায়ী পদক্ষেপ ছিল? এসব প্রশ্নের আসল উত্তর জানা সম্ভব হবে না কোনোদিন। কারণ এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের কোনো বয়ান নেই।
তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যে এক দল গঠন করলেন তা নিয়ে নানা বিভ্রান্ত্রিকর প্রচারণা আছে। তার একটি হলো কমিউনিস্ট পার্টির প্ররোচনায় তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন। আসলে কি তাই? বঙ্গবন্ধু তো কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি অনেকের কথা শুনতেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। বাকশাল করার সিদ্ধান্ত তিনি নিজের বুঝ-বিবেচনা থেকেই নিয়েছিলেন, সেটা হওয়াই স্বাভাবিক।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বছর দুয়েক আগে বলেছিলেন, “১৯৭৫ সালে সিপিবি ‘একদলীয় ব্যবস্থা’ তথা ‘বাকশাল’ গঠন না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি পার্টির পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এমতাবস্থায়, ‘বাকশাল’ গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে পার্টিকে প্রকাশ্যে ‘বিলুপ্তির’ ঘোষণা দিতে হলেও আসলে পার্টি বিলুপ্ত করা হয়নি। খুবই গোপনে, অনেকটা সংকুচিত আকারে, পার্টির অস্তিত্ব ও তার কাঠামো বহাল এবং সক্রিয় রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সে কথা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি অনেক পার্টি সদস্যকেও সে বিষয়টি অবগত করে ওঠা সম্ভব হয়নি। গোপনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধীরে-ধীরে পার্টি কাঠামো সম্প্রসারিত করা হচ্ছিল। এরকম একটা ‘হার্ড কোর’ আগাগোড়া গোপনে সংগঠিত ছিল বলেই ১৫ আগস্টের পর সব পার্টি সদস্যদেরকে তাই দ্রুত পার্টি কাঠামোতে সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।”
আমার জানা মতে, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভুল তথ্য দেননি। তবে এতদিন পরে এসে এ সত্য প্রকাশ কেন জরুরী মনে হয়েছে কমরেড সেলিমের, প্রশ্ন সেটাই। বাকশাল সম্পর্কে আমাদের দেশে অনেকের মধ্যেই বিরূপ ধারণা আছে। সেটা ‘ক্যাশ’ করার জন্যই কি এই সত্য প্রকাশ? কিন্তু এই বক্তব্য প্রচারের পর রাজনীতি সচেতন অনেকের প্রতিক্রয়া দেখে বোঝা গিয়েছিল, কমরেড সেলিম সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে ভুল বার্তা দিয়েছেন মানুষের কাছে। এটাও সিপিবি রাজনীতির এক ট্রাজেডি যে, দলটি যা বলতে চায়, মানুষ সেটা না বুঝে বোঝে উল্টোটা।
বাকশাল প্রশ্নে সিপিবির ভেতর এবং বাইরের অবস্থান সবার জানার কথা নয়। সিপিবি বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল না করার পরামর্শ দিলে তা দিয়েছিল গোপনে, আর বাকশালের পক্ষে অবস্থান ছিল প্রকাশ্য। এমনকি তখনও এমন প্রচার ছিল যে, সিপিবির পরামর্শেই বঙ্গবন্ধু একদলীয় ব্যবস্থায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তখন এই প্রচারণার বিরোধিতা সিপিবি করেনি বরং এক ধরনের অহংকার তাদের ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও তাদের ‘পরামর্শ’ শুনে ‘সিদ্ধান্ত’ নেন।
এ ব্যাপারে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বছর দেড়েক পর একটি ঘরোয়া বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে বলেছিলেন, সিপিবি-এর পরামর্শ শুনে বাকশাল করেই বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হলো।
মোহাম্মদ ফরহাদ জবাবে বলেছিলেন, এমন কথা দয়া করে বলবেন না। কারণ তাতে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়। এতে মানুষের মনে হতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু নিজের বুদ্ধিতে নয়, অন্যের বুদ্ধিতে চলতেন।
সাজেদা চৌধুরী আর কিছু না বলে চুপ করেছিলেন।
এটা ঠিক যে, বাকশাল গঠনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, আবার একটি গোপন কাঠামোও রাখা হয়েছিল। দেশে দেশে অবস্থা বিবেচনায় এটা কমিউনিস্ট পার্টির একটি কৌশল। গোপন এবং প্রকাশ্য– দুই ধরায় কাজে তারা অভ্যস্ত। আবার এই কৌশলের কথা পার্টির সবাই জানেন না, জানেন নীতিনির্ধারক কয়েকজন। কমিউনিস্টরা অন্য দলে ঢুকেও কাজ করে, পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে না থাকলে। সময়মতো আবার আত্মপ্রকাশের সুযোগ হাতে রাখে। বাকশালের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সমাজতন্ত্রের পথে যেতে চেয়েছিল সিপিবি। সিপিবির ত্যাগ-দেশপ্রেম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সংশয় ছিল না। কিন্তু তাদের জটিল তত্ত্ব ও প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে প্রশ্ন ছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও তার সরাসরি উল্লেখ আছে। সিপিবির কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন করা কঠিন হতো– মনে করতেন বঙ্গবন্ধু। সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দলিল রচনা করেছিল যে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হইবে’। ওই দলিল ছাপাখানায় থাকতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কাজেই সিপিবির দলিলে কি লিপিবদ্ধ আছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে বাস্তবে কি ঘটেছে সেটাই দেখা উচিত। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের সময় দলের নাম লিখত ‘পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির নাম এমন রাখা নিয়েও কম বিভ্রান্তি (হাসাহাসি) হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশে সিপিবি বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি ‘ঐক্য ও সংগ্রামের’ নীতি গ্রহণ করেছিল। ভালো কাজে সমর্থন, খারাপ কাজের বিরোধিতা। কিন্তু মানুষের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে ঐক্যটাই, সংগ্রামটা সেভাবে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মানুষ সমর্থনটাই দেখেছে, বিরোধিতা চোখে পড়েনি। তাই সংগ্রামের জায়গাটি দ্রুত দখল করে নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ– বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া একদল বিভ্রান্ত মানুষ। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে উগ্র সরকারবিরোধী রাজনীতির নামে ক্রমশ গভীর খাদের কিনারে নিয়ে যেতে বড় ভূমিকা পালন করেছে জাসদের হঠকারী রাজনীতি।
সিপিবি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘সৎ ও দক্ষ’ সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। তবে সেই সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি কোথায় পাওয়া যাবে তার কোনো নির্দেশনা তাদের ছিল না। আবার বঙ্গবন্ধুও আওয়ামী লীগের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নেতাকর্মীদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারেননি। কারণ, তিনি মনে করতেন, বিপদের সময় ওই নেতাকর্মীরাই তার সঙ্গে ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে কিন্তু তিনি শক্তিশালী হবেন না।
একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে বাকশাল ছিল আওয়ামী লীগেরই সম্প্রসারিত রূপ। অথচ বাকশাল নিয়ে সিপিবির উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি সিপিবির প্রধান নীতিনির্ধারণী নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে অনেক তথ্য জানি, যা থেকে আমার ধারণা হয়েছিলো, সিপিবির নির্ভরতা ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর, তার দল আওয়ামী লীগের ওপর নয়।
বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে, বাকশাল টিকে গেলে সিপিবি নিঃসন্দেহে ‘ক্রেডিট’ দাবি করত, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় তাতে সিপিবি কিছুটা দিশেহারা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কারণ এমন ঘটনা প্রত্যাশিত ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাকশাল ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ায় সিপিবি গা থেকে বাকশালের গন্ধ মুছতে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কিছু ‘উল্টাপাল্টা’ কাজ করে বসে। তারা জিয়াউর রহমানকে ‘সীমিত অর্থে জাতীয়তাবাদী’ তকমা দিয়ে তার ‘খালকাটা’ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। জিয়া সিপিবির বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ভুল করেননি। নেতাদের গ্রেপ্তার করে পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিলেন মিলিটারি শাসক জিয়া। পার্টির সভাপতি, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ এবং সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মোহাম্মদ ফরহাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। জিয়ার মৃত্যুর পর সে মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল।
সিপিবি একসময় আওয়ামী লীগের ‘বি-টিম’ বলে পরিচিতি পেয়েছিল। তারপরও তখন দলটির স্ফীতি ও বিস্তার ঘটছিল। তারপর মোহাম্মদ ফরহাদের অকাল মৃত্যু, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ইত্যাদি ঘটনা সিপিবির জন্য কঠিন এক দুঃসময় নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে সিপিবি ভেঙে যায়। সিপিবি ছেড়ে কেউ কেউ আওয়ামী লীগ, গণফোরাম এমনকি বিএনপিতে যোগদান করেন। সিপিবি নামে যারা থাকেন তারাও পার্টির রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের পরিবর্তন আনেন। এখন সিপিবি স্বাধীন অবস্থানের নামে আওয়ামী লীগ থেকে দূরত্ব রেখে চলছে। আর আমাদের দেশের রাজনীতির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো আওয়ামী লীগ থেকে দূরে মানে প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছে। সিপিবি এখন সে জায়াগায় আছে বলেই কমরেড সেলিম আকস্মিকভাবে ‘বাকশাল’ বিতর্ক সামনে এনে সুফল পেতে চেয়েছিলেন বলে কারো কারো মনে হয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো অনেকেই সিপিবিকে ভুল বুঝেছে। সিপিবির নেতারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আপদ ও বিপদ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু মুসিবত হলো মানুষ সিপিবিকে তাদের আস্থায় নিচ্ছে না।
সমাজতন্ত্র বা বাম ধারার রাজনীতির পালে হাওয়া লাগার বাস্তবতা বাংলাদেশে আর কখনো আসবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করতেও এখন অনেকে ভরসা পান না। তাই সিপিবির লাল ঝাণ্ডা আকাশে উড্ডীন হবে, মানুষ দলে দলে সিপিবির পক্ষে মিছিলে সামিল হবে সেটা এখন অনেকটাই কষ্টকল্পনা। তাহলে বৈষম্যমুক্ত সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই কি আর অগ্রসর হবে না? এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর দেওয়ার যোগ্য নেতৃত্ব কি সামনে দেখা যাচ্ছে?
মাসুদ করিম - ১৮ জানুয়ারি ২০২২ (১:৪৫ অপরাহ্ণ)
‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ বদলে ‘বাকশাল দিবস’ পালন করবে বিএনপি
https://bangla.bdnews24.com/politics/article2002031.bdnews
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবসের’ পরিবর্তে এখন থেকে ‘বাকশাল দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, “গতকাল স্থায়ী কমিটির সভায় আগামী ২৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকল মহানগর ও জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সূবর্ণ ফসল গণতন্ত্রকে জবাই করে একদলীয় স্বৈরশাসন জারির দিনটিকে ‘বাকশাল দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
“মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটি (বিএনপি) ওইদিন সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত দল-মত নির্বিশেষে গণতন্ত্রমনা বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।”
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব দল নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেন।
সরকারি চাকুরে ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অপরাপর সব দল ও সংগঠনকে বাকশালে যোগ দিয়ে অপশক্তির মোকাবেলা এবং দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা বাকশালের বিধিবিধানে বলা হয়।
তবে ওই বছরের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বাকশালের বিলোপ ঘটে।
২৫ জানুয়ারির ওই দিনটিকে এতোদিন বিএনপি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছিল।
সোমবার রাতে ভার্চুয়ালি যুক্ত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়।
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
মাসুদ করিম - ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (৮:১৪ পূর্বাহ্ণ)
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
https://samakal.com/kaler-kheya/article/220295492/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE
এ রকমই ছিল বাকশাল গড়ার পটভূমি। এমনটাই আমি ভাবতে চাই। বাকশালের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর মধ্যে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই প্রতিশ্রুতির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর যেটা ধূসরতম দিক সেটাও ৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের অব্যাহত নিষ্ঠুরতার প্রেক্ষিতে আজ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে মনে হয়। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এমন কিছু প্রগতিশীল সংস্কার এটি আনতে চেয়েছিল, যা পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক যে কোনো যুগের অবাধ বাজার অর্থনীতির অন্ধ অনুসরণের মানদণ্ডে আজ নিছক ঘোষণা হিসেবেও বিস্ময়কর ঠেকে বৈকি। বাহাত্তরের সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাকশালের কর্মসূচি শুধু ধারণই করেনি, একে বাস্তবায়ন করার কনক্রিট প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সামনে সত্যি বলতে গেলে আর কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পন্থা খোলাও ছিল না সেদিন। কী করতে পারতেন তিনি সেদিন? সিপিবি-ন্যাপের বক্তব্য ছিল দেশ বাঁচানোর জন্য একটি ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ গঠন, যেখানে এ দলগুলো আরও বেশি ‘স্বতন্ত্র’ সত্তায় বিচরণ করতে পারবে। মুজিব যে কোনো কারণেই হোক সেই পথে এগোতে চাননি। তিনি একটি নতুন দল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে কথিত জাতীয় ফ্রন্টের সবাই থাকবে। বিষয়টি সেদিক থেকে দেখলে একান্তভাবেই ‘ফর্মের’ বিষয়। দেশের স্বার্থে নিজেকে বা তার হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে ভাঙচুর করে নতুন ‘ফর্মের’ সন্ধান করতে হয়েছিল তাকে। এ নিয়ে তার বেদনাবোধের পরিচয় পাই ২৫ জানুয়ারির (১৯৭৫) ভাষণের একাধিক মুহূর্তে। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বাকশালের সম্ভাব্য ভূমিকা একটি কেবল আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। এক গুচ্ছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদাহরণ :
১. নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন সম্পর্কে বললেন :’সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পিকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করছে, এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে।’
২. বিরাজমান রাজনৈতিক অরাজকতা নিয়ে মন্তব্য করলেন :’বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আজ যাকে arrest
করব, বলবে যে, আমি অমুক পার্টির লোক। একে arrest করব, অমুক পার্টির লোক। ওকে arrest
করব, অমুক পার্টির লোক।’
৩. দেশে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে উল্লেখ করে মুজিব বলেন, ‘বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, … এই সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে Constituent Assemblyর যারা সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেও কয়েক জনকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি, আমরা যা কোনোদিন দেশে শুনি নাই, ঈদের নামাজের জামাতে, এই সংসদের একজন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাদের হত্যা করা হয়েছে? হত্যা করা হয়েছে তাদের, যারা স্বাধীনতার মুক্তিযোদ্ধা।’
৪. পাক-মার্কিন নীতির অনুসারী দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং পাক-চীন নীতির অনুসারী উগ্র বামপন্থি শক্তির দিকে (এর মধ্যে জাসদকেও আগ বাড়িয়ে রাখতে হবে) ইঙ্গিত করে মুজিব বলেন, ‘কোন রাজনৈতিক দল, যাদেরকে আমরা অধিকার দিয়েছিলাম, একটা কোনোদিন condemn তারা করেছে এদের বিরুদ্ধে? না, তারা condemn করেনি। তারা মুখে বলেছে- অধিকার চাই। তারা মিটিং করেছে, সভা করেছে। পার্টি করতে তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী করেছে তারা? আমরা বলেছি, যা আমাদের সংবিধানে আছে যে, ভোটের মাধ্যমে তোমরা সরকারের পরিবর্তন করতে পার। সে ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে। বাই-ইলেকশনসমূহ আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি, জনগণ তাদের ভোট না দিলে আমরা কী করব? তখন তারা বলেছে, এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। মুখে তারা বলেছে- আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি। তারা অস্ত্র জোগাড় করেছে, সেই অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছে।…আর, তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ঘরে ঢুকে শৃগাল-কুকুরের মতো মানুষকে হত্যা করেছে।’
৫. বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন :’বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা hot bed of international clique হয়েছে। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেওয়া হয়, এখানে তারা বিদেশিদের দালাল হয়।’
৬. এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক দুর্গতি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন বঙ্গবন্ধু :’আজ সত্যি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। কারণ, আমরা কী নিয়ে শুরু করেছিলাম?…আমাদের food কিনতে হয়। আমাদের food deficit কত? আমাদের এখন নানা রকম কাজ। মানুষ দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মারা যায়। আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তার পরে বাংলাদেশে হলো draught। তারপর হলো সারা দুনিয়াজুড়ে inflation।…শুধু আমরা না, সমস্ত দুনিয়ায় যারা অনুন্নত দেশ, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আসল ভয়াবহ বন্যা। এত বড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা, সন্দেহ। না ছিল খাবার। ৫৭০০ লঙ্গরখানা করা হলো এবং relief operation চালানো হলো।…বাঁচাতে পারলাম না সকলকে।…এখনও মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই।’
৭. এই দুঃখী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য সাময়িককালের জন্য হলেও কিছু নতুন পরিবর্তন আনতে হয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় :’আমি একদিন তো বলেছি এই হাউসে, স্পিকার সাহেব, যে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই। যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা বিদেশিদের পয়সা ভোট কেনার জন্য দেয়, তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের, এবং সেজন্য আজকে আমাদের শাসনের পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
৮. এটা কোনো একনায়কের কথা নয়; দেশবাসীর কাছে আবেদন করছেন তিনি। ব্যাখ্যা করছেন কেন নিজের বিরুদ্ধে তাকে যেতে হচ্ছে :’আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব। আজ আপনারা constitution সংশোধন করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন, আমার দুই-তৃতীয়াংশ majority দরকার। তা আমার আছে। মাত্র ৭ জন ছাড়া সমস্ত সদস্যই আমার। তবু আপনারা amendment করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সিটে আমি আর বসব না- এটা কম দুঃখ না আমার। আপনাদের সঙ্গে এই হাউসের মধ্যে থাকব না- এটা কম দুঃখ নয় আমার।’
৯. এর পরে এলো ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর প্রসঙ্গ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘প্রথম বিপ্লব’:’তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ, একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ দেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই, This is our Second Revolution। এই Revolution আমাদের এই Revolution হবে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এর অর্থ :অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’
১০. সবশেষে সবাইকে আহ্বান জানালেন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে :’আমি এই হাউস থেকে, জনাব স্পিকার, আপনার মাধ্যমে দেশবাসীকে, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, যারা দেশকে ভালোবাসেন, চারটি principleকে ভালোবাসেন- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা; এই চারটিকে, তারা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি, যারা এই মতে বিশ্বাস করেন।…দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’
যদি তার এই ডাক শুনে কেউ না-ও আসে, তাহলে একলাই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে এবং স্রোতের বিপরীতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এ জন্যই অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সামনে গুনগুন করে গাইছিলেন এই ভাষণের দুই সপ্তাহ আগে- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে….’। ৬-দফার সময়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র চলাকালীন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পর্বে, ৭ মার্চের ঘোষণায়, ২৫ মার্চের কালরাতে রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন পর্বে আলটিমেটলি এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একাই নিতে হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন সে সময়ে। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ছিল কেবল তার একার। ১৯৬৪ সালের পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমের পর থেকেই এটা দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আর কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না।
আগেই বলেছি, বাকশাল বাস্তবায়ন করার সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। কিন্তু অভিপ্রায়টি স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন। বাকশালের গঠনতন্ত্রের প্রথম ধারাতেই বলা হয়েছিল সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষার কথা। বাহাত্তরের সংবিধানের চেয়েও আরও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে মানবাধিকার, স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত, সুষম বণ্টনের ‘সাম্যভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল সেখানে। এর সাম্প্রতিক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ৭ জুন, ১৯৭৫ (শনিবার) বাংলাদেশ গেজেটের সংখ্যায় বিধৃত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের ‘লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’:
‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত একক জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, নর-নারী ও ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং মানব-সত্তার মর্যাদা ও মূল্যের স্বীকৃতি, মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ সৃস্টি, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন, কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণ অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও সুষম সাম্যভিত্তিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি-ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ও ক্রমিক যান্ত্রিকীকরণ এবং সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন, কৃষি ও শিল্পের প্রসার এবং উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান, মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও অধিকতর কর্মসংস্থান, বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ গণমুখী সার্বজনীন সুলভ গঠনাত্মক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন, অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-স্বাস্থ্য রক্ষাসহ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যাবলির সুসমাধান, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, বিচার-ব্যবস্থার কালোপযোগী জনকল্যাণকর পরিবর্তন সাধন এবং গণজীবনের সর্বস্তর হইতে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করা- এ সকল নীতিসমূহ ও উদ্দেশ্যাবলী সমগ্র জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত উদ্যম সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় বাস্তবে রূপায়িত করিতে…সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিবে।’
মিথ্যে ইউটোপিয়ার কথা দেশবাসীকে সেদিন শোনাচ্ছিলেন না বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজের একান্ত বিশ্বাসের কথাই বলছিলেন। আবারও বলছি, এটি কোনো তৃতীয় বিশ্বের একনায়কের কথা নয়। বরং সমাজ বদলের লড়াইয়ে যার সামনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন একজন ডেসপারেট মানুষের উপলব্ধি ছিল কথাগুলো :
‘আজকে আমাদের কথা কী? আমাদের শোষণহীন সামাজ গড়তে হবে। এটায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আজকে থেকে নয়, আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে, স্পিকার সাহেব। আপনি জানেন, এই দল এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারও কাছে কোনোদিন আপস করে নাই, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, কালোবাজারি, নতুন পয়সাওয়ালা এদের কাছে আমার আত্মবিক্রয় করতে হবে? এদের অধিকারের নামে এদেরকে আমরা ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দিতে পারি না। কক্ষণও না। কোনো দেশ কোনো যুগে তা দেয় নাই, দিতে পারে না।’
বাকশাল এই একক জাতীয় রাজনৈতিক দল বা মঞ্চ কি পারত তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে? আয়েন্দে কি সফল হতে পারতেন? অ-ধনবাদী বিকাশের পথে চলতে আগ্রহী এমন অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এ প্রশ্ন আজ তোলা যায়। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাকশাল তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হতো। উদেশ্য পূরণ হলে আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পরিচিত ছকে ফিরে যেতেন তিনি। সামগ্রিক বিষয়গত ও বিষয়ীগত ফ্যাক্টর বিচার করেই এ রকম বলা যায়।
প্রথমত, যে সময়ে বাকশালের গঠনতন্ত্র প্রণীত হয় (অর্থাৎ জুন, ১৯৭৫) সে সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শুভ পরিবর্তনের চিহ্ন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩/৭৪ সালের ওপেক দেশভুক্ত জোটের সিদ্ধান্ত ও তার প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি-তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ম্ফীতি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমশ কমে আসতে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। বিদেশ থেকে খাদ্যশস্যের আমদানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে থাকে। খাদ্যশস্যের দাম কমে আসতে থাকে এবং এর জোগানও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ ও ৭৪ পরপর দু’বছরের বিধ্বংসী বন্যা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ পার হয়ে দেশে প্রথমবারের মতো স্বাভাবিক ফলনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রযুক্তি, বিশেষত শুকনো মৌসুমের বোরো ধানের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী সাফল্য আসে আরেকটু পরে। উফশী ধানের অধিকাংশ জাতই উদ্ভাবিত হয় ১৯৭৫ সালের পরে। যেমন, বি.আর-১ (চান্দিনা) বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালে; বি.আর-২ (মালা) ১৯৭১ সালে; বি.আর-৩ (বিপ্লব) বেরোয় ১৯৭৩ সালে; বি.আর-৪ (ব্রিশাইল) বের হয় ১৯৭৫ সালে; বি.আর-৭ (ব্রি-বালাম) ১৯৭৭ সালে; বি.আর-৮ (আশা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-৯ (সুফলা) ১৯৭৮ সালে; বি.আর-১০ (প্রগতি) ও বি.আর-১১ (মুক্তা) ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উফশী ধানের প্রযুক্তিতে নতুন নতুন জাত সংযোজিত হতে থাকে, যার সূচনা কেবল বঙ্গবন্ধু দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা চলে, দু-তিন বছরের মধ্যেই দেশের খাদ্য-পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চলে আসত অবজেকটিভ নিয়মেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুফল দুঃখী মানুষের মধ্যে নিজের হাতে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। এদেশের কৃষি গবেষণার ভিত্তি গড়ে ওঠা অবধি শুধু দেখে যেতে পেরেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, শুধু অর্থনৈতিক (বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটজনিত মূল্যস্ম্ফীতি বা দেশের ভেতরে কৃষিপ্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রসার) দিক নয়, সাংগঠনিক দিক থেকেও বাকশাল দু-তিন বছরের মধ্যে একটি সক্ষমতর রাজনৈতিক মঞ্চে রূপান্তরিত হতে পারত। আমার আশাবাদের কারণ, সে সময়ে বাকশালের ভেতরে সিপিবি-ন্যাপ এ দুই প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন থেকে এক ঝাঁক সাংগঠনিক প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে আগ্রহী হয়ে এই সমাবেশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। এবং এ রকম আরও ঘটুক, তার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ১৯৭৩ সালের দিকে গড়ে ওঠা স্বল্পস্থ্থায়ী আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবির ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর মূল ব্যক্তিত্বরা বাকশালের এক মঞ্চে আবার একত্র হয়েছিলেন দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরের বৃহত্তর রাজনৈতিক তাগিদে। যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দলীয় পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়ে এক মঞ্চে জড়ো হতে চাননি ঠিক (এ প্রসঙ্গে অচিরেই আসছি), কিন্তু এই একত্র-সমাবেশের সাংগঠনিক ফলাফল হতে পারত অভূতপূর্ব। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্রগুলো বাকশালে ধারণ করা হয়েছিল। বাকশালের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ‘পরিচালনা কমিটি’ তথা নেতৃত্বে বামপন্থিদের লক্ষণীয় উপস্থিতি ছিল। কৃষক সংগঠন পরিচালনার জন্য ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মণি সিংহ, পীর হাবিবুর রহমান, জীতেন ঘোষ, বজলুর রহমান প্রমুখ। শ্রমিক সংগঠন পরিচালনার জন্য ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান, আবদুস সালাম খান প্রমুখ। মহিলা সংগঠনের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মালেকা বেগম, আয়শা খানম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ। যুব সংগঠনের ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান প্রমুখ। ছাত্র সংগঠনের ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিন, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, পীর হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ। মনে রাখতে হবে, শুধু দু’জনের অন্তর্ভুক্তি (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা) ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ‘ক্রিয়াশীল গণপরিষদ’কে মাতিয়ে রেখেছিল। বলা বাহুল্য, এতজন প্রতিভাবান বামপন্ িবুদ্ধিদীপ্ত সাংগঠনিক প্রতিভা বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা অঙ্গ সংগঠন পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত হলে সংগঠনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে (ও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে) একটি শুভ ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা অবাস্তব ছিল না। অধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রসর হওয়া এমন অনেক দেশেই এ রকম এক দল বা এক মঞ্চ গড়ার উদাহরণ ইতোপূর্বে (ও পরে) দেখা গেছে। অর্থাৎ সাংগঠনিক দিক থেকে নিতান্ত ‘হিউম্যান রিসোর্স’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাকশালের সাংগঠনিক রূপরেখা ও কর্মপদ্ধতি কালক্রমে যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারত।
তৃতীয়ত, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও সংগঠন-প্রক্রিয়া বাকশালের গণভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করতে পারত। মহকুমা প্রশাসনকে জেলা প্রশাসনে রূপান্তর করে জেলা পর্যায়ে ক্ষমতা-কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছিল প্রথমবারের মতো। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীভবন ঘটার বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীভবনের প্রশ্নর আলোচিত হচ্ছিল। শুধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীভবন নয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে ‘বহুমুখী সমবায়’ গড়ে তোলার জন্য। এর বস্তুগত ভিত্তি ছিল গোটা গ্রামের ‘সোশ্যাল মোবিলাইজেশন’। এর মধ্য দিয়ে গ্রাম পর্যায়ে সমতামুখী সমাজের আদর্শ ও সংগঠন সম্প্রসারিত হওয়ার রাজনৈতিক সম্ভাবনাও খুলে যায়।
চতুর্থত, ভাবাদর্শগত লড়াইয়ের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল বাকশাল কাঠামোয়। এর গঠনতন্ত্রের ৮ম ধারায় ২য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, দলের সদস্য ‘নিজের রাজনৈতিক এবং সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতার মান উন্নয়নে সদা সচেষ্ট থাকিবেন, দলের প্রচারিত পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য পাঠ করিবেন এবং প্রচার করিবেন।’ সেখানেও ‘গঠনমূলক আলোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে কার্য পরিচালনা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধন’ করার কথাও বলা হয়েছিল। এসব বাক্যে বামপন্থি ভাষাভঙ্গির প্রভাব আঁচ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাস্তবিকই নতুন দল গড়ে নতুন ‘সমাজতান্ত্রিক ক্যাডার’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে কথা তিনি ‘৭২ সাল থেকেই অনেক বার বলে এসেছেন। সমাজতান্ত্রিক মন-মানসিকতা ছাড়া সমাজতন্ত্র গড়ে তোলা যায় না- এ উপলব্ধি তার বহুবার হয়ে থাকবে।
পঞ্চমত, বাকশাল কর্মসূচি সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি ছিলেন মুজিব নিজেই। তিনি একাই ছিলেন এ কর্মসূচির রক্ষাকবচ। এটি বাস্তবায়নে তার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতিও ছিল না। পরিস্থিতি তার বিরুদ্ধাচরণ করলেও তিনি প্রতিকূলতার সামনে নুয়ে পড়ার মানুষ নন। তদুপরি অনেক নেতার মধ্যেই যা দেখা যায়নি অতীতে, তার ছিল প্রচণ্ড কাণ্ডজ্ঞান। এ কথা বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেছেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল, সুবিবেচনাবোধ তার ও তার অগ্রজ প্রজন্মের ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের মধ্যে টানটান ছিল। অনেক বামপন্থি নেতার তুলনায় এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে ছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে প্রধান সমালোচনা হচ্ছে ‘একক জাতীয় দল’ গড়া নিয়ে। কিন্তু কার্যত এটি ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে উপদল বা গ্রুপ গড়ার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না থাকলেও এর উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু হিসাবের মধ্যে রেখেছিলেন। হায়দার আকবর খান রনো-রাশেদ খান মেনন এদেরকে দলে আকৃষ্ট করার জন্য বলেওছিলেন সেই সম্ভাবনার কথা- সে কথা কিছু আগে আমি উল্লেখ করেছি (বলশেভিক পার্টিতেও এমন আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল)। এত তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যায় বামপন্থি ন্যাপ-সিপিবির তরুণ নেতৃত্বকে বাকশালের অঙ্গ সংগঠনে সম্পৃক্ত করলে সেসব প্রতিষ্ঠান আর আগের গতানুগতিক ধারায় চলতে পারবে না- এটিও তিনি হিসাবে নিয়েছিলেন। সাংগঠনিক, আদর্শিক ও মানসিকভাবে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি এ দুই ধারার একত্র-সমাবেশের মধ্য দিয়ে কালক্রমে একটি নতুন ‘রাজনৈতিক সংস্কৃৃতি’র বিকাশ ঘটবে দলের ভেতরেই- এটা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত ছিল না। এর মধ্য দিয়ে তার নিজেরও সত্তার প্রগতিশীল রূপান্তর ঘটতে পারত; যেমনটা ঘটেছে কিউবার কাস্ত্রো বা যুগোশ্নাভিয়ার টিটোর বেলায়। আমার কল্পনায় এ রকম সম্ভাবনা অপার্থিব বলে মনে হয় না।
আগেই বলেছি, বাকশালের গঠনতন্ত্র ও সংগঠন সম্পর্কিত উপরোক্ত বিবরণীটি নিয়ে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ জুন। এর প্রায় আড়াই মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ বাকশাল গঠনের একান্ত প্রাথমিক ও অস্ম্ফুট পর্যায়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অস্ম্ফুট বলছি এ কারণে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাকশালের কোনো causal link নেই। যে জিনিস বাস্তবায়নই হয়নি, সে সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল না করলেও তাকে হত্যা করা হতো। হত্যা করার জন্য সুযোগ খুঁজছিল তার হত্যাকারীরা বহুদিন থেকে। এখন যে প্রায়ই বলতে শুনি, সেনাবাহিনীর ‘কিছু বিপথগামী সদস্য’ ঘটনাটি ঘটিয়েছে- সেটি নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা। হত্যাকারীরা বিপথগামীপাড়ার মস্তান নয় যে হুট করে এমন কাণ্ড ঘটাবে। এর পেছনে ছিল দক্ষিণপন্থি দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থান-পরিকল্পনা। এই শক্তির অবয়ব জানা বা অন্তত অনুমান করা কঠিন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান যারা ঘটিয়েছে, যাদের সমর্থনে বা প্রত্যক্ষ মদদে ঘটিয়েছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ বাহানায়; বাংলাদেশেও তারা সেভাবে ঘটিয়েছে। শুধু আমরা হত্যাকাণ্ডের নিষ্ঠুরতায় অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি।
পূর্বাপর বঙ্গবন্ধুর শত্রুর অভাব ছিল না। এই শত্রুদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাকশাল কর্মসূচির আগে ও পরে এরা দেশের ভেতরে-বাইরে সক্রিয় ছিল। নূহের নৌকার মতো সবাইকে ক্ষমাশীল উদারতায় জলে-ডোবা থেকে নৌকায় ওঠানোর উদারতা দেখালেও তার শত্রুদের চরিত্র-বদল হয়নি। বরং কালক্রমে তারা আরও জোটবদ্ধ হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এক জায়গায় তারা ছিল একমত- যে করেই হোক শেখ মুজিবকে উৎখাত করতে হবে। এ জন্য মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার, গুজব ছড়ানো, সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন থেকে শুরু করে রাতের অন্ধকারে রাজনীতিকদের খুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ কাউন্টার-রিভলিউশনের কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা থেকে শত্রুরা বিরত থাকেনি। অথচ এত ঝুঁকির কথা জেনেও বঙ্গবন্ধু নিজের সিকিউরিটি বিষয়ে ছিলেন একান্তভাবেই উদাসীন। মানুষ যে জন্তু হতে পারে- সেটা তিনি জানতেন। তাই বলে তার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ অস্ত্র উঁচিয়ে ধরতে পারে- এটি তার রাজনৈতিক কল্পনার বাইরে ছিল। যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃৃতির মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন; জেল-জুলুম অতীতে সয়েছেন; জেল থেকে বেরিয়েও এসেছেন; সে রকম মানস-আবহাওয়ায় ১৫ আগস্ট কল্পনাতীত ছিল।
মাসুদ করিম - ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (৮:১৭ পূর্বাহ্ণ)
বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: বাহাত্তরের সংবিধান ও সমতামুখী সমাজের আকাঙ্ক্ষা
https://samakal.com/kaler-kheya/article/220296380/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE
স্বাধীনতার পরে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্যজোটের দরকার ছিল দেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন। প্রথমে ত্রিদলীয় আওয়ামী লীগ-ন্যাপ-সিপিবি ঐক্যজোট ও পরে বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তার স্বীকৃতি মেলে। অ-ধনবাদী বিকাশের পথে অগ্রণী এমন অনেক দেশেই এটি দেখা গেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তি একত্র হয়েছে। যুগোস্লাভিয়ায় এটা ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্নভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের নানা পর্যায়ে এ ধরনের ঐক্যজোট হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ নানা ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় এবং এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐক্যের নানা অভিব্যক্তি দেশে দেশে দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির ঐক্য-বিরোধের ‘ডায়ালেকটিক’ অবশ্য একটি পৃথক আলোচনার বিষয়বস্তু, যা এই লেখার পরিধির বাইরে। এখানে শুধু এটাই যোগ করার যে এ দেশেও একপর্যায়ে এরকম ‘ঐক্যজোট’ বাড়ার প্রয়োজনীয়তা ঐতিহাসিকভাবেই দেখা দিয়েছিল (যার সমসাময়িক তাৎপর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়)। তবে ঐক্যজোটে যোগ দেওয়া মানে নিজস্ব রাজনৈতিক সত্তার বিলোপ নয়। বাকশালের মতো ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও অন্যান্য দলের নিজস্ব ‘রাজনৈতিক সত্তা’ বিলোপ হয়ে যায় না। ন্যাপ-সিপিবির নির্দেশে যারা সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সবাই নিজ নিজ পার্টির নির্দেশেই সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। সবাই যে সাগ্রহে যুক্ত ছিলেন এমনও নয়-কিন্তু কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে সেদিন তাদের তা করতে হয়েছিল। আবার, কেউ কেউ বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি বলে আহতও বোধ করেছিলেন। এ বিষয়ে সিপিবির নীতি ছিল পরিস্কার। দলটি ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে সমন্বয় করার লেনিনীয় নীতিতে পূর্বাপর অটুট ছিল। বাকশাল গঠন করার পরপরই ‘গোপন ও প্রকাশ্য কাজের সমন্বয়’ এ বিষয়টি চিঠির আকারে তৎকালীন সিপিবির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়:
‘যারা প্রকাশ্যে কাজ করেন একটা কথা খেয়াল রাখা দরকার যে একমাত্র নিজেদের বিশ্বাসভাজন লোক ছাড়া তারা কারও নিকট পার্টিগত পরিচিতি প্রকাশ করিবেন না। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকেই কোন না কোন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত থাকিতে হয়। একমাত্র নিজেদের ইউনিটের সভ্য ছাড়া ও ঊধর্ক্ষতন কমিটির নির্দিষ্ট লোক ছাড়া এর অস্তিত্ব আর কারও নিকট প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। এতে বিপদের আশংকা বাড়ে। ইউনিটের সভা গোপনেই করিতে হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নেওয়া সত্ত্বেও বাইরে কাজ করার সময় তা আলাদাভাবে কার্যকরী করাই যুক্তিসঙ্গত। তা না হলে ইউনিটের অস্তিত্ব ও সভ্যদের পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ অবস্থায় ইউনিট সভ্যদেরকে একে অন্যের সংগে পরিচয় আছে তাও অস্বীকার করতে হয়। পার্টির গোপন ও প্রকাশ্য কাজগুলি নিয়মমাফিক সুষ্ঠুভাবে চললে এবং তার ভিতরে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন ঠিকমত হলে পার্টির অগ্রগতি ঠিকমত চলা সম্ভব হয়।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির পরে কোনো একসময়ে সিপিবির উপরোক্ত চিঠিটি প্রমাণ করে বাকশালের ‘একক জাতীয় দলে’ যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলীয় রাজনৈতিক সত্তা ‘বিলোপ’ করেনি। নতুন পরিস্থিতিতে তারা শুধু তাদের কাজের ধারা বদলেছিল ‘প্রকাশ্য’ ও ‘অপ্রকাশ্য’ কাজের মধ্যে নতুন ধারায় সমন্বয় সাধন করে। এ কথা সম্ভবত ন্যাপের সম্পর্কেও খাটে।
নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখা সম্পর্কে সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও বাকশালের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চরিত্র শনাক্ত করতে সিপিবি সেদিন ভুল করেনি- এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে বাকশাল সম্পর্কে পার্টির ইতিবাচক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে- সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে-সিপিবির হাতেলেখা একটি সার্কুলারে অভ্যুত্থান-উত্তর দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর শাসনকাল নিয়ে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য রাখা হয়। এর থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সিপিবির পূর্বাপর সমর্থনের দার্শনিক-রাজনৈতিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেশে তখন ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিপদসংকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সিপিবি তখন আন্ডাগ্রাউন্ডে। সে-রকম পরিস্থিতিতে বাকশালকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি নিচে তুলে ধরা হলো:
‘৭ই নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মূলগতভাবে এই সরকার দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল।
১. এই সরকার দেশে পূর্ণভাবে সামরিক শাসন এবং সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখিয়াছে।
২. এই সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রগতিশীল নীতিসমূহকে বাতিল করিয়া দেশে পুঁজিবাদ নীতি অনুসরণ করিয়া সাম্রাজ্যবাদী খপ্পরে পড়িতেছে। দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থি প্রভৃতিরা এই সরকারের সমর্থক। এরা প্রগতিশীলদের নির্মূল করিয়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুসরণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদী চীন এই সরকারের দৃঢ় সমর্থক। ভারত বিরোধিতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইহাদের মূল আওয়াজ। সাম্রাজ্যবাদ নহে, ভারতই ইহাদের মূল শত্রু।
৩. জাসদের সরকার বিরোধিতাসহ দেশে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করিতেছে। জাসদ ও চার নীতি পরিবর্তনকারী উগ্র দক্ষিণপন্থিদের চাপ বিদ্যমান। সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা রহিয়াছে।
৪. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়া যে সাম্রাজ্যবাদী মাওবাদী চক্রান্ত শুরু হইয়াছে তাহাকে পরাস্ত করিয়া বঙ্গবন্ধুর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির অনুসারী একটি দেশপ্রেমিক সরকার কায়েম করা আমাদের লক্ষ্য।
৫. বঙ্গবন্ধুর নীতির অনুসারী একটি দুর্নীতিমুক্ত, সৎ ও দক্ষ দেশপ্রেমিক সরকার কায়েমের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া ‘দক্ষিণ প্রতিক্রিয়া ও উগ্র বামকে জনগণের মধ্যে হইতে বিচ্ছিন্ন করা’ এই আওয়াজের ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শিবিরের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইতে।
৬. বঙ্গবন্ধুর আমলে জনগণের মধ্যে নানারূপ বিভ্রান্তি বিরাজ করিতেছিল। একদলীয় শাসন যে উন্নত ধরনের গণতন্ত্র ইহা জনসাধারণ বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি জনগণকে হতাশ করিয়া তুলিয়াছিল। দেশের ব্যাপক অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়বাদী চেতনা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন কূটকৌশল সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশবাসী ভারতের সাহায্য নিয়াছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদের চক্রান্ত প্রতিরোধে যে ভারত ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মৈত্রীর ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে তারা তাহারা বুঝিয়া উঠে নাই। গণচেতনার এই দুর্বলতার সুযোগ সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণ করে।
৭. একমাত্র মুজিববাদী নয়। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলকেই ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।
৮. দেশপ্রেমিক শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্বন্ধে মোটামুটি সমঝোতা থাকিলেও কৌশল ও পদ্ধতির প্রশ্নে মতানৈক্য আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়িয়া তুলিতে না পারিলে শত্রুরা লাভবান হইবে।
৯. ইদানীংকার ঘটনাবলী প্রমাণ করিয়াছে যে (৭ নভেম্বরের পরে) সরকার নিরপেক্ষতার যে নীতি ঘোষণা করিয়াছে ইহা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাহারা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকতাবাদী, সাম্রাজ্যবাদঘেঁষা, মাওবাদ ও পাকিস্তানপন্থি শক্তিদের বিনা বাধায় কাজ করিতে দিতেছে, আর বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তিকে দমন করিতেছে।
১০. সরকার জাতীয়করণ নীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করিয়া ব্যক্তিগত পুঁজিকে অবাধভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ করিয়া দিতেছে। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির উপরে পুরাপুরি নির্ভর করিবার পথ গ্রহণ করিয়াছে।
১১. রাজনৈতিকভাবে ভারত ও সোভিয়েতবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন, সাম্প্রদায়িক নীতির অনুকরণ, সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির নজীরবিহীন প্রসার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে ভাবিত করিয়া তুলিতেছে।’
ওপরের দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে সিপিবি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিল। বাকশাল-ব্যবস্থাকে এমনকি ‘উন্নত ধরনের গণতন্ত্র’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। বাস্তবিকই ১৯৭৫ সালে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থি শক্তির এক এলায়েন্স গঠিত হয়েছিল, যা স্বাভাবিক নিয়মে অগ্রসর হলে দেশের প্রগতিশীল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারত।
বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিষ্ঠুর মৃত্যু সমাজের জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। সমাজ-মনোবিদ আশিস নন্দী যাকে বলেছিলেন ‘ব্রুটালাইজেশন অব সোসাইটি’ সেটি ভিন্নতর মাত্রা পায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে।
‘শাকের আহমেদ’ এই ছদ্মনামে সিপিবির একজন নেতা ‘মহান একুশের আবেদন ও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ’ প্রবন্ধে ৭৫-পরবর্তী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে যা লিখেছিলেন তাতে করে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে তীব্র আকারে আক্রমণ করা হয়েছিল। সেখানে লেখক তার প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে:
আজ একদল বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নিয়ে বিদ্রূপ করছেন, যেন দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ জন শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী প্রমুখ মেহনতি মানুষ আর জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৫ জন শোষক ও নির্যাতকদের স্বার্থ এক ও অভিন্ন যেন এই দুই অংশের মানুষের একই রকম অধিকারই হলো প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কথা কে না বোঝেন যে শোষক আর শোষিত, নির্যাতনকারী আর নির্যাতিত যদি সমান অধিকার ভোগ করে তা হলে দেশ হতে কোনদিনও শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। শোষক ও নিপীড়কদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ করা, শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প গ্রহণ করা। গণতন্ত্রকে হত্যা করা তো নয়ই, বরং তাই হলো প্রকৃত গণতন্ত্র, ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠার পথ।
রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম থেকে আরম্ভ করে আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকরা প্রায় প্রতি দিনই ‘আইনের শাসন’ ‘ন্যায়ের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রব সেরনিয়াবাতের দুবছরের নাতিকে বা বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করল কিংবা ঢাকা জেলের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দী দশায় দেশের চারজন বিশিষ্ট নেতাকে যারা নৃশংসভাবে হত্যা করল সেই নরপশুদের কী করা হচ্ছে? তারা শুধু বহাল তবিয়তেই নেই, তাদের নিরাপত্তা ও বিলাস-ব্যসনের জন্য এই সরকার পাহারাদার এবং খোরপোষেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীরা এই সম্পর্কে কোন প্রতিবাদ বা দাবী উত্থাপন করা তো দূরের কথা, তারা এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চুপও নন, বরং তারা নানাভাবে সরকারের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনই করছেন। নিজের অরক্ষিত বাসগৃহে ডাকাতের মত ঢুকে সরল বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, শেখ মুজিবের সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধূদের হত্যা, শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যা, রব সেরনিয়াবাতের বাড়ীর অতিথি ও চাকরদের হত্যা, জেলে আবদ্ধ তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখকে হত্যা-এই সকল জঘন্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডকে এরা সমর্থন করেন এবং এতে আনন্দ উল্লাসও প্রকাশ করেন।’