ইএমএস-এর কথা আমি প্রথম শুনি তার মৃত্যুর এক বছর পর বোম্বেতে আমার কেরালার বন্ধু সুনীল শ্রীধর-এর কাছে। কিন্তু ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের লেখা আমি প্রথম পড়তে শুরু করি ২০০৬ সালে। ২০০৭-এ এসে “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস” পড়া শেষ হয়। এই একটি বই পড়েই ইএমএস আমার কাছে অসাধারণ এক ইতিহাসবিদ, এক তুলনাহীন রাজনৈতিক লেখকের মর্যাদায় ভাস্বর হয়ে গেলেন। এখন আমার হাতে আছে ইএমএস-এর আত্মজীবনী “ভারতের এক কমিউনিস্টের স্মৃতিমন্থন”, যা পড়তে শুরু করেছি মাত্র এখনো শেষ করতে পারিনি।
ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের জীবনপঞ্জি (সূত্র : গণশক্তি)
• ১৯০৯-এ জন্ম। ১৯২৫ সালে স্কুল ভর্তি হন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই “বেশ উজ্জ্বল ছাত্র” বলে পরিগণিত হন। প্রকৃতপক্ষে তালুকের সদর শহরের জেরা বোর্ডের স্কুলে যে তিন বছর তিনি লেখাপড়া করলেন তাতে জাতপাতের অন্য আর সব বাধা ডিঙ্গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সহযোগিতার সমাজ গড়ার তাঁর হাতেখড়ি হয়। যুবক বয়সে জাত বিভাজনের বিরুদ্ধে সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় হন।
• ১৯২৯ সালে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, এরপর ত্রিচূড়ে কলেজে পড়াশুনা শুরু করেন। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হবার আগে প্রায় প্রতিদিন তাঁর সন্ধেবেলা কেটেছে বিক্ষোভ আন্দোলনে ( ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীর ফাঁসির প্রতিবাদেই ওই বিক্ষোভ আন্দোলন)। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরীক্ষায় তিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করেন।
• ১৯৩১ সালে কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে যান। তখন থেকে কংগ্রেসের আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কেরালার কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টির তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩২ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন করার জন্য জেলে যান।
• ১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টির প্রথম প্রাথমিক পরামর্শ সভায় এবং ওই বছরেই অক্টোবরে বোম্বাই-এ প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। ওই সম্মেলনেই সর্বভারতীয় স্তরে যুগ্ম সম্পাদক হন এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় পর্যন্ত ওই পদে কাজ করেন। কেরালা প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এই সময়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার সময়েই কমরেড ইএমএস মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিত হন।
• ১৯৩৬ সালে কেরালায় যে পাঁচজন মিলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রুপ গড়ে তোলেন কমরেড ইএমএস ছিলেন তাঁদেরই একজন। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ-বিরোধী দুই সংগ্রামের স্রোতধারার মিলনের প্রতিনিধি ছিলেন ইএমএস। কেরালার শক্তিশালী কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ভিত্তি ছিল এই মিলন।
১৯৩৬ সালেই তিনি সিপিআই-এর সদস্য হন।
• ১৯৩৭ সালে কৃষ্ণ পিল্লাই প্রমুখ কেরালা কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টির লোকদের নিয়ে সিপিআই এবং প্রথম কেরালা ইউনিট গড়েন।
• ১৯৩৯ সালে কমরেড ইএমএস প্রথম মাদ্রাজ প্রাদেশিক বিধানসভায় নির্বাচিত হন। কিন্তু বেশিদিন বিধায়ক থাকতে পারেননি।
• ১৯৩৯-৪২ এবং ১৯৪৮-৫০-এর গুরুত্বপূর্ণ পর্বে পার্টি গঠনের জন্য তিনি আত্মগোপন করেন। কমরেড ইএমএস কমিউনিস্ট পার্টিকে তাঁর পারিবারিক ভূ-সম্পত্তি টাকাপয়সা দিয়ে দেন।
• ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে A Short History Of The Peasant Movement In Kerala প্রকাশ করেন্। এটাই তাঁর লেখা ইংরেজিতে প্রথম বই।
• ১৯৫০ সালে তিনি সিপিআই-এর পলিটব্যুরো সদস্য হন। পরে পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন।
• ১৯৫৭ সালে কেরালা রাজ্য গঠনের পর প্রথম নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি গরিষ্ঠতা পায়। ভারতে প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট পার্টির সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন কমরেড ইএমএস। এই মন্ত্রীসভা ভূমিসংস্কার ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন পথের দিশা দেখানো পদক্ষেপ নেয়।
• ১৯৫৯ সালে অগণতান্ত্রিকভাবে এই মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
• ১৯৬২ সালে তিনি অবিভক্ত সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক হন।
• ১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম) প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে পলিটব্যুরো সদস্য নির্বাচিত হন।
• ১৯৬৭ সালে কমরেড ইএমএস আবার কেরালার যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৬৯ পর্যন্ত এই মন্ত্রীসভা চলে।
• ১৯৭৭ সালে তিনি সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের পার্টির চর্তুদশ কংগ্রেস পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। স্বাস্থ্যের কারণে তারপর তিনি এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।
• ১৯ মার্চ ১৯৯৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
ইএমএস নাম্বুদিরিপাদকে নিয়ে কিছু লিন্ক:
১.জন্মশতবর্ষে কমরেড ইএমএস : প্রকাশ কারাত
গণশক্তি, ৩১ জুলাই ২০০৯।
২. ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ : উইকিপিডিয়া।
৩. Memories Of The Radical: Venu Menon
Outlook India, 30 March 1998.
৪. Jyoti Basu On Birth Centenary Of Comrade EMS namboodiripad.
৫. The Opposition and the Left : EMS Namboodiripad
Frontline, 9-22 August 1997.
৬. Farewell To EMS: R. Krishnakumar.
Frontline, 4-17 April 1998
৭. Editorial, Frontline, 4-17 April 1998
৮. An Icon For Millions: Harkishan Singh Surajeet
৯. Marxism In Theory And Practice: Prakash Karat
Frontline, 4-17 April 1998
১০. A Global Vision: Prabhat Patnaik
Frontline, 4-17 April 1998
১১. A Great Life: R. Krishnakumar
Frontline, 4-17 April 1998
১২. EMS Our Columnist
Frontline, 4-17 April 1998
১৩. Father, friend, philosopher and guide…
Frontline, 4-17 April 1998
১৪. EMS And Kerala: V.K. Ramachandran
Frontline, 4-17 April 1998
১৫. EMS As A Historian: K.N Panikkar
Frontline, 4-17 April 1998
১৬. The Tireless Writer: Sukumar Azhicode
Frontline, 4-17 April 1998
১৭. Picture Feature
Frontline, 4-17 April 1998
১৮. Centre, states and river waters: EMS Namboodiripad
Frontline, 4-17 April 1998
১৯. frontline readers letters
মাসুদ করিম
লেখক। যদিও তার মৃত্যু হয়েছে। পাঠক। যেহেতু সে পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে। সমালোচক। কারণ জীবন ধারন তাই করে তোলে আমাদের। আমার টুইট অনুসরণ করুন, আমার টুইট আমাকে বুঝতে অবদান রাখে। নিচের আইকনগুলো দিতে পারে আমার সাথে যোগাযোগের, আমাকে পাঠের ও আমাকে অনুসরণের একগুচ্ছ মাধ্যম।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
রায়হান রশিদ - ১ আগস্ট ২০০৯ (১০:০২ অপরাহ্ণ)
অনেক ধন্যবাদ এই লিন্কবহুল পোস্টটির জন্য। লিন্কে দেয়া লেখাগুলো এক এক করে পড়ছি। ইএমএস এর আত্মজীবনীটি কেমন লাগলো শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।
মাসুদ করিম - ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯ (৮:৪১ অপরাহ্ণ)
গতকাল রাতে আত্মজীবনীটি পড়া শেষ হল। “ভারতের এক কমিউনিস্টের স্মৃতিমন্থন”–২২০ পৃষ্ঠার বইটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমার মনে হয়েছে, বইয়ের যেসব স্থানে সিপিআই ভেঙ্গে সিপিআই(এম) গড়ার কথা বলা হয়েছে। বইটির আজকের দিনের প্রাসঙ্গিকতা, এবং ভারতের বাইরের পাঠকের প্রাসঙ্গিকতাও ঠিক এখানে। সিপিআই(এম) তার লক্ষ্যপূরণ কতটুকু করতে পেরেছে বা ভবিষ্যতে কতটুকু কী করতে পারবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার অবকাশ এটা নয়। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত সংশোধনবাদ বা চীনা সংকীর্ণতাবাদ থেকে বেরিয়ে একটি কমিউনিস্ট দল সৃষ্টি ও তার পথচলা সম্ভব করেছিল সিপিআই(এম)। এবং এই প্রচেস্টাই আজো ভারতীয় প্রেক্ষাপটে দলটিকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে, দলটি ভারতীয় কমিউনিজমের একটি সংস্করণ ভারতীয় জনগণের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে বলেই আজো হাজার সমস্যার মধ্যেও ভারতে বামপন্থার উল্লেখজনক অবস্থান এখনো দেখা যায়। আর ঠিক এখানেই ইএমএস-এর অবদান, তিনিই ছিলেন এই দলের প্রধানতম তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নেতা। রামচন্দ্র গুহ যথার্থই লিখেছেন, Totalitarian thinker and practising democrat, subservient Stalinist and proudly Indian: this was the tragedy as well as the achievement of E.M.S. Namboodiripad. জাতিসত্ত্বা ও তত্ত্বের প্রায়োগিক কৌশল কমিউনিস্টদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই দুটি বিষয়ের উপাদানগত রসায়ন বুঝতে হলে ইএমএস-এর আত্মজীবনীপাঠ আমাদের কর্তব্য।
মাসুদ করিম - ২ জুলাই ২০১৫ (১০:৫৯ পূর্বাহ্ণ)
হয়ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙত না
Pingback: মাসুদ করিম | বইপ্রস্থ | মুক্তাঙ্গন
মাসুদ করিম - ২৭ জুলাই ২০১০ (৪:৫৬ অপরাহ্ণ)
নেহেরুর ‘ইএমএস’ সংকট নিয়ে লিখেছেন ইন্দার মালহোত্রা। বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
Pingback: পাকিস্তানের আগের বাংলাদেশ, সংগ্রাম ইতিহাসের নয়, অধিকার পারিবারিক নয় | প্রাত্যহিক পাঠ