আমাদের মুক্তিযু্দ্ধের মাত্র তিন বছর চার মাস পূর্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে পিপিপি অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টির। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবশ্যই আলোচনার দাবিদার এক প্রতিষ্ঠান। অথচ এটি খুবই বিস্ময়ের বিষয় যে তা নিয়ে আমরা তেমন আলোচনাই করি না। শুধুমাত্র ভুট্টোর নামটি প্রসঙ্গক্রমে মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয়। এর আলোচনা করা দরকার দুটি কারণে- ১. মুক্তিযুদ্ধে এর সার্বিক কাজের ধরন নির্ণয় ২. পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতিতে এর ঈর্ষণীয় উত্থান!
আমরা এত জানিই যে পিপিপির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন সামরিক শাসক আইউব খান সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তিনি ওই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সেই লোক একসময় আইউবের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন। তার প্রাথমিক কারণ হিসাবে ৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধে আইউবের টোটাল কার্যক্রমকে পাকিস্তানের পক্ষে অপমানজনক বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি এবং একপর্যায়ে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি লাহোরে ৩০ নভেম্বর-পহেলা ডিসেম্বর/১৯৬৭-এ এক সম্মেলনের মাধ্যমে পিপিপি গঠন করেন এবং তিনিই নির্বাচিত হন এর চেয়ারম্যান। এখানে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি আইউব খানের সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। অনেকটা মুজাফফরপন্থি ন্যাপের মতোই ধর্ম-সামাজিক কর্ম-সর্বকল্যাণমুখর গণতন্ত্র-অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরেন। তিনি বারবার মিলিটারি-জমিদার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের এই দুই জান্তব সত্যের (মিলিটারিজম-ফিউডালিজম) বিরুদ্ধে তাঁর সংগঠনকে দাঁড় করান। কৃষক-শ্রমিক-মজদুর-ছাত্রদের ভিতর এক অদ্ভুত জাগরণ তৈরি হয়। ৭০-এর নির্বাচনে তার শ্লোগান ছিল রোটি-কাপড়া-মাখান(অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান)। এর জন্য নির্বাচনী মেনিফেস্টো তৈরি করে বিপুল জনজাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হয় তার দল। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই জরুরি যে, তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক মুরুব্বির পরিবর্তন করেন। আইউবের মুরুব্বি ছিল চিন-আমেরিকা। জনশ্রুতি আছে যে, রাজনীতির একপর্যায়ে মৌলানা ভাসানী এমন আস্থা রাখতেন যে, আইউবের থ্রুতে চিনের মাধ্যমে এই দেশে সমাজতন্ত্রের কাজ অনেকদূর এগোনো সম্ভব! যাই হোক, পিপিপি চিনের দিক থেকে মুখ-বুক সবই ফিরিয়ে নেন। তিনি মুরুব্বি হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকেই যথার্থ মনে করতে থাকেন। যাই হোক, ৭০-এর নির্বাচনে সিন্ধু আর পাঞ্জাবে খুবই ভালো ফলাফল করে এ দল। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৪ আসনের ভিতর ৮৭ আসন পায় তারা। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ পায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু ভুট্টোর খায়েশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। ক্ষমতার কলনাঠি নাড়লেও ভুট্টো খুব একটা সামনে আসেন না। ইয়াহিয়াকেই ক্ষমতা না ছাড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পিপিপি সর্বদাই সিভিল ওয়ার বলে থাকে এবং ভারতকেই দেশভাগের জন্য দায়ী করে। এখানে আরও একটি বিষয় স্মরণ করতে হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পিপিপির খানিক মাখামাখির দরুনই সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযু্দ্ধের প্রথম দিকের ছয়-সাত মাস আমাদের লড়াই-সংগ্রামের পক্ষে সরাসরি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
যাই হোক, আমাদের মুক্তিযু্দ্ধ শেষ হলেও পাকিস্তানকে রক্ষার খায়েশ ভুট্টোর যায় না। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারিতে দেশে ফেরার প্রাক্কালে শেখ মুজিবকে বার-বার তিনি অনুরোধ করেন, যাতে পাকিস্তানের মিনিমাম একাত্মতা বজায় রাখা হয়। কিন্তু তা কী আর হয়! এরপরের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সরাসরি ক্ষমতাগ্রহণ করে সামরিক শাসক এহিয়া খানকে জেলে ঢুকান তিনি। জেলখানাতেই তার মৃত্যু হয়। যাই হোক, আমাদের মুক্তিযু্দ্ধে পিপিপির ভূমিকা নিয়ে আরও গবেষণার দাবি রাখে বলে আমার বিশ্বাস।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
কথাসাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত। পেশায় চিকিৎসক। মানুষকে পাঠ করতে পছন্দ করি। আমি মানুষ এবং মানব-সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গে লিপ্ত থাকার বাসনা রাখি।
আমিও এখানে আপনার ধারনার সাথে একমত পোষণ করছি…
জাহাঙ্গীর ভাই!!! আপনার প্রতি শুভেচ্ছা রইল…
আপনার মতামতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এই পোস্ট করেইছি, যারা অনেক খোঁজখবর রাখেন, ইন্টারনেট বা সংবাদের ব্যাপারে সিরিয়াস যারা যাতে এ বিষয়টাতে নতুন করে আলো ফেলেন, দেখেন। আমার মনে হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন। তবে এও বলতে হয়, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। যারফলে যারাই আমাকে বা অন্যকে অত্র বিষয়ে আরো আলোকিত করবেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যায় কেবল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আর সামরিক বাহিনীই ছিল না, এই গণহত্যার পেছনে রাজনৈতিক পরিকল্পনাও যে ছিল পিপিপির ভূমিকা বিশদভাবে আলোচিত হলে তা বিস্তৃতভাবে উঠে আসতে পারে। ইতিহাস পর্যালোচনায় ব্যক্তিকে মুখ্য করে এগিয়ে যাওয়ার যে ভুল প্রবণতা আমাদের আক্রান্ত করে রেখেছে, সেটির কারণেই আমরা কেবল ভুট্টোকে বা ইয়াহিয়াকে ভিলেন বানিয়ে মনের ঝাল মেটানোর চেষ্টা করি। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা অবশ্যই থাকে, এই নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লবের পূর্বে বেশ আলোচনাও হয়েছে মনে পড়ছে, কিন্তু ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটিকে বাদ দিয়ে আলোচনার ঝুকিঁ হলো এই, তাতে ঘটনাপ্রবাহের সংঘবদ্ধতা ও গতিপ্রবণতা চাপা পড়ে যায়। ধন্যবাদ, বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার জন্যে। উৎসাহীরা… বাকিটুকু পড়ুন »
এতথ্যের সত্যতা কতটুকু? শুধুই পিপিপি-সংস্রব, আর কিছু নয়? আসলেই কি কোন পক্ষে ছিল না তারা? আর, পরে যে সরাসরি পক্ষ নেয় রাশিয়া, এতে পিপিপি কি বাধা দেয় নি? কতটুকু?
চমৎকার লেখার জন্য কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে ধন্যবাদ।
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর এই যে, পিপিপি, কংগ্রেস বা আওয়ামী লীগ-বিএনপি — কেউই পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেনি।
সাতের দশকের পর দুর্নীতিসহ বিবিধ গুরুতর অপরাধের দায় এড়ালেও এই একটি কারণে এ সব দল যখন জনগণের নামে, গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায় বসে বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে, তখন তাদের ভন্ডামীর নান্দনিক মুখশের আড়ালে কুৎসিত মুখগুলোই উন্মোচিত হয়ে পড়ে। কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে আবার তারাই!
স্কুলে আমার দুই ক্লাস উপরে পড়তেন ভুট্টো ভাই – সুরুজ আলী ভুট্টো। সন্দেহ কী, এই নাম যিনি রেখেছিলেন তিনি জুলফিকার আলি ভুট্টোর ভক্ত ছিলেন। কিন্তু কখন রাখা হয়েছিল এই নাম – সুরুজ আলী ভুট্টো? স্বাধীন বাংলাদেশে, যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভুট্টো? না কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে? না কি সত্তরের নির্বাচনের পরে? অনেককাল হলো ভুট্টো ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, থাকলে এক্ষুনি ফোন করে জেনে নিতে পারতাম তাঁর (সত্যিকার) জন্মতারিখ। আবছা মনে পড়ছে একটা ফাঁসির দড়ির ছবির কথাও, ছাপা হয়েছিল সম্ভবত কোনো একটা সাপ্তাহিকের প্রচ্ছদে। তখনো ভুট্টো ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি; আমি তখন পড়ি অন্য স্কুলে, অন্য জেলায়। সেই প্রথম… বাকিটুকু পড়ুন »
৪.১ নম্বর মন্তব্যে পোস্টলেখক ‘আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের সাথে পিপিপির সম্পর্ক-পরিবর্তনের-ধারা খেয়াল’ করা বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। কোন্ লেখা/বই/ওয়েবসাইট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেতে পারি, কেউ জানালে বাধিত হব। রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ। আসলে আমি ইতোপূর্বে বলেওছিলাম, রাজনীনিতর অত খুঁটিনাটি বিষয় আমার পক্ষে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ আমার ঠিক পছন্দের বিষয় নয়। তবু সুমনের উপরোক্ত কথার ফলেই ইতিহাস থেকে হয়ত খানিক অপরিপক্ব কথকতা তুলে ধরছি। মুশকিল হল, আমরা নানামুখী পন্থা আর ইজম কর্তৃক এত বেশি নিয়ন্ত্রিত যে রাষ্ট্রের অতি নিত্য-নৈমিত্তিক আচরণও নিজেদের কমনসেন্স দিয়ে বুঝতে চাই না। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অপরাপর দেশের কুটনৈতিক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, এখন আন্তর্জাতিক… বাকিটুকু পড়ুন »
বর্তমান পাকিস্তানের নিজেদের রাজনীতিই এতো বিভ্রান্ত আর ছল কপটে ভরা, ওদের কাছে থেকে সত্য উদঘাটন এর আশা দূরাশা মাত্র। তবে এই বিষয়টা সামনে আসা উচিত। আমাদের জানা দরকার এই নৃশংসতার পিছনে আসলে কারা ছিলেন, কি উদ্দেশ্যে?
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লেখাটির জন্যে।
একদম শেষ থেকে শুরু করি। এরপরের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সরাসরি ক্ষমতাগ্রহণ করে সামরিক শাসক এহিয়া খানকে জেলে ঢুকান তিনি। জেলখানাতেই তার মৃত্যু হয়। ইয়াহিয়াকে কখনওই জেলের ভাত খেতে হয়নি। প্রথম দিকে তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয় বন্নির এক ফরেস্ট বাংলোয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর রওয়ালপিন্ডীর ৬১ নং হার্লে স্ট্রিটে নিজের বাড়িতেই গৃহবন্দী হয়ে থাকেন একসময়কার প্রবল ক্ষমতাধর এই প্রেসিডেন্ট। সেখানেই এক স্ট্রোকের পর পক্ষাঘাতগ্রস্থ অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। মূল পোস্টের ব্যাপারে এটুকুই শুধু বলবো, ভুট্টো কিংবা পিপিপি মোটেও রুশপন্থী রাজনৈতিক দল ছিলো না, তারা ছিলো পুরোপুরিই চীনঘেষা। একাত্তরে চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক আতাতটা রাশিয়াকে কাবুর করার জন্য… বাকিটুকু পড়ুন »
আশা করবো, ইতিহাস-সংক্রান্ত লেখালেখিগুলো আরও তথ্যভিত্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠ হবে। নিজস্ব ধ্যানধারণা দিয়ে ব্লগ লেখা হয় বটে, তবে এধরনের লেখায় সেসব না থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি।
পাকিস্তানের সেই ২২ পরিবারের কথা আমরা শুনেছি, পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতিবিদ লাল খান বলছেন, ভুট্টো ওই ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। ১৯৭৯ সালে এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখের মধ্যে রাতের কোনো এক সময়ে রাওয়ালপিন্ডি জেলে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের নির্দেশে ভুট্টোকে হত্যা করা হয়, এই হত্যার পেছনেও সিআইএ-র হাত আছে বলছেন লাল খান। সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদে দীর্ণ হয়েছিলেন ভুট্টো, এক কথাও বলছেন লেখক। As Bhutto tried to compromise, reaction upped its attacks on the PPP government. The capitalists stoked inflation and the PPP government was soon engulfed in a crisis. In 1977 the right wing started a movement covertly supported by… বাকিটুকু পড়ুন »