আমাদের মুক্তিযু্দ্ধের মাত্র তিন বছর চার মাস পূর্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে পিপিপি অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টির। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অবশ্যই আলোচনার দাবিদার এক প্রতিষ্ঠান। অথচ এটি খুবই বিস্ময়ের বিষয় যে তা নিয়ে আমরা তেমন আলোচনাই করি না। শুধুমাত্র ভুট্টোর নামটি প্রসঙ্গক্রমে মাঝে মাঝে উচ্চারিত হয়। এর আলোচনা করা দরকার দুটি কারণে- ১. মুক্তিযুদ্ধে এর সার্বিক কাজের ধরন নির্ণয় ২. পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতিতে এর ঈর্ষণীয় উত্থান!
আমরা এত জানিই যে পিপিপির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন সামরিক শাসক আইউব খান সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং তিনি ওই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সেই লোক একসময় আইউবের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন। তার প্রাথমিক কারণ হিসাবে ৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধে আইউবের টোটাল কার্যক্রমকে পাকিস্তানের পক্ষে অপমানজনক বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি এবং একপর্যায়ে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি লাহোরে ৩০ নভেম্বর-পহেলা ডিসেম্বর/১৯৬৭-এ এক সম্মেলনের মাধ্যমে পিপিপি গঠন করেন এবং তিনিই নির্বাচিত হন এর চেয়ারম্যান। এখানে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি আইউব খানের সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। অনেকটা মুজাফফরপন্থি ন্যাপের মতোই ধর্ম-সামাজিক কর্ম-সর্বকল্যাণমুখর গণতন্ত্র-অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্রের পতাকাকে উর্দ্ধে তুলে ধরেন। তিনি বারবার মিলিটারি-জমিদার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানের এই দুই জান্তব সত্যের (মিলিটারিজম-ফিউডালিজম) বিরুদ্ধে তাঁর সংগঠনকে দাঁড় করান। কৃষক-শ্রমিক-মজদুর-ছাত্রদের ভিতর এক অদ্ভুত জাগরণ তৈরি হয়। ৭০-এর নির্বাচনে তার শ্লোগান ছিল রোটি-কাপড়া-মাখান(অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান)। এর জন্য নির্বাচনী মেনিফেস্টো তৈরি করে বিপুল জনজাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হয় তার দল। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই জরুরি যে, তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক মুরুব্বির পরিবর্তন করেন। আইউবের মুরুব্বি ছিল চিন-আমেরিকা। জনশ্রুতি আছে যে, রাজনীতির একপর্যায়ে মৌলানা ভাসানী এমন আস্থা রাখতেন যে, আইউবের থ্রুতে চিনের মাধ্যমে এই দেশে সমাজতন্ত্রের কাজ অনেকদূর এগোনো সম্ভব! যাই হোক, পিপিপি চিনের দিক থেকে মুখ-বুক সবই ফিরিয়ে নেন। তিনি মুরুব্বি হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকেই যথার্থ মনে করতে থাকেন। যাই হোক, ৭০-এর নির্বাচনে সিন্ধু আর পাঞ্জাবে খুবই ভালো ফলাফল করে এ দল। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৪ আসনের ভিতর ৮৭ আসন পায় তারা। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ পায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু ভুট্টোর খায়েশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। ক্ষমতার কলনাঠি নাড়লেও ভুট্টো খুব একটা সামনে আসেন না। ইয়াহিয়াকেই ক্ষমতা না ছাড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পিপিপি সর্বদাই সিভিল ওয়ার বলে থাকে এবং ভারতকেই দেশভাগের জন্য দায়ী করে। এখানে আরও একটি বিষয় স্মরণ করতে হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পিপিপির খানিক মাখামাখির দরুনই সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযু্দ্ধের প্রথম দিকের ছয়-সাত মাস আমাদের লড়াই-সংগ্রামের পক্ষে সরাসরি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
যাই হোক, আমাদের মুক্তিযু্দ্ধ শেষ হলেও পাকিস্তানকে রক্ষার খায়েশ ভুট্টোর যায় না। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারিতে দেশে ফেরার প্রাক্কালে শেখ মুজিবকে বার-বার তিনি অনুরোধ করেন, যাতে পাকিস্তানের মিনিমাম একাত্মতা বজায় রাখা হয়। কিন্তু তা কী আর হয়! এরপরের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সরাসরি ক্ষমতাগ্রহণ করে সামরিক শাসক এহিয়া খানকে জেলে ঢুকান তিনি। জেলখানাতেই তার মৃত্যু হয়। যাই হোক, আমাদের মুক্তিযু্দ্ধে পিপিপির ভূমিকা নিয়ে আরও গবেষণার দাবি রাখে বলে আমার বিশ্বাস।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
কথাসাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত। পেশায় চিকিৎসক। মানুষকে পাঠ করতে পছন্দ করি। আমি মানুষ এবং মানব-সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গে লিপ্ত থাকার বাসনা রাখি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
২৭ comments
বিনয়ভূষণ ধর - ১৩ জানুয়ারি ২০১০ (৩:০৬ অপরাহ্ণ)
আমিও এখানে আপনার ধারনার সাথে একমত পোষণ করছি…
জাহাঙ্গীর ভাই!!! আপনার প্রতি শুভেচ্ছা রইল…
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ১৩ জানুয়ারি ২০১০ (৩:১৮ অপরাহ্ণ)
আপনার মতামতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এই পোস্ট করেইছি, যারা অনেক খোঁজখবর রাখেন, ইন্টারনেট বা সংবাদের ব্যাপারে সিরিয়াস যারা যাতে এ বিষয়টাতে নতুন করে আলো ফেলেন, দেখেন। আমার মনে হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন। তবে এও বলতে হয়, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। যারফলে যারাই আমাকে বা অন্যকে অত্র বিষয়ে আরো আলোকিত করবেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
ইমতিয়ার - ১৩ জানুয়ারি ২০১০ (৭:১৭ অপরাহ্ণ)
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যায় কেবল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আর সামরিক বাহিনীই ছিল না, এই গণহত্যার পেছনে রাজনৈতিক পরিকল্পনাও যে ছিল পিপিপির ভূমিকা বিশদভাবে আলোচিত হলে তা বিস্তৃতভাবে উঠে আসতে পারে। ইতিহাস পর্যালোচনায় ব্যক্তিকে মুখ্য করে এগিয়ে যাওয়ার যে ভুল প্রবণতা আমাদের আক্রান্ত করে রেখেছে, সেটির কারণেই আমরা কেবল ভুট্টোকে বা ইয়াহিয়াকে ভিলেন বানিয়ে মনের ঝাল মেটানোর চেষ্টা করি। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা অবশ্যই থাকে, এই নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লবের পূর্বে বেশ আলোচনাও হয়েছে মনে পড়ছে, কিন্তু ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলটিকে বাদ দিয়ে আলোচনার ঝুকিঁ হলো এই, তাতে ঘটনাপ্রবাহের সংঘবদ্ধতা ও গতিপ্রবণতা চাপা পড়ে যায়। ধন্যবাদ, বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার জন্যে। উৎসাহীরা নিশ্চয়ই ইতিহাস খুঁড়ে পিপিপির অনুদ্ঘাটিত ভূমিকা তুলে আনবেন।
পিপিপি-র একটি ওয়েবসাইট আছে, সেটি দেখলে টের পাওয়া যাবে, ইতিহাসকে লুকিয়ে রাখতে তারা বেশ পারদর্শী।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ১৩ জানুয়ারি ২০১০ (৯:৪১ অপরাহ্ণ)
ধন্যবাদ ইমতিয়ার শামীম।
আপনার এই উপলব্ধি খুবই যথার্থ। আসলে আমাদের প্রয়োজন ছিল ৭১-এর পরও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বেগবান রাখা। এতে আমাদের ব্যর্থতা আছে। তা না হলে এই নাটের গুরু দেশ-স্বাধীনের বছর তিনেকের ভিতর কী করে মেহমান হয়ে বাংলাদেশে আসে?
পিপিপি-এর যে লিংকটা আপনি দিলেন, ওইটা আসলে পিপিপি’র দলীয় এক প্রচারণা, যারফলে ওইখানে প্রকৃত সত্য পাওয়া মুশকিল।
তবে পিপিপি’র রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পজেটিভ দিকটা ওদের দেশেই পড়েছিল। ওরা প্রথম পাকিস্তানকে ভাববাদ থেকে সরিয়ে কিছুটা হলেও বস্তুগত চৈতন্যের দিকে টানতে পেরেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ওদের মোহগ্রস্ত দৃষ্টিকে পুবের দিকে আনতে পেরেছিল এই পিপিপি।
বেনজিরের দল তো এখন জারদারির মতো প্লেবয় কাম মিস্টার ১০%-এর হাতে পড়ে পচা-দূগর্ন্ধে চারপাশ একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে।
bloodycivillian - ১৪ জানুয়ারি ২০১০ (৪:৫২ অপরাহ্ণ)
এতথ্যের সত্যতা কতটুকু? শুধুই পিপিপি-সংস্রব, আর কিছু নয়? আসলেই কি কোন পক্ষে ছিল না তারা? আর, পরে যে সরাসরি পক্ষ নেয় রাশিয়া, এতে পিপিপি কি বাধা দেয় নি? কতটুকু?
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ১৪ জানুয়ারি ২০১০ (১১:২৩ অপরাহ্ণ)
সোভিয়েত ইউনিয়ন কখন থেকে আমাদের মুক্তিযু্দ্ধে সরাসরি পজেটিভ ভূমিকা রাখতে শুরু করে তা তো ইতিহাসের অংশ। মুক্তিযুদ্ধ চলার একপর্যায়ে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হতে থাকে, আমেরিকার সাথে চীনও পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষে কাজ শুরু করে। আসলে ওইসময় বাংলাদেশের মানুষের লড়াই-সংগ্রামই ছিল স্বাধীনতাযু্দ্ধের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। ভারতের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা আমাদের মুক্তিযু্দ্ধে মহতী ভূমিকা রাখে; যা আমাদের সংগ্রামের সার্বিক অবস্থানকে আলাদা এক মাত্রায় উন্নীত করতেও সক্ষম হয়। এই জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম, মস্কোপন্থি রাজনৈতিক দলসমূহের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে রাজনৈতিক মেরুকরণ সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অবস্থান স্পষ্ট করতে থাকে।
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুই শক্তির আলাদা অবস্থানের কথা ভুলে থাকলে সবকিছু পরিস্কার হবে না। ওইসময় রাজনৈতিক পরাশক্তির অবস্থান এখনকার একরৈখিক ছিল না। আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের সাথে পিপিপির সম্পর্ক-পরিবর্তনের-ধারা খেয়াল করলে সবই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
এই ব্যাপারে ভিন্নমত থাকলে ব্লাডিসিভিলিয়ানকে অনুরোধ করব তথ্য সহযোগে তা জানানোর জন্য।
বিপ্লব রহমান - ১৫ জানুয়ারি ২০১০ (৮:১৭ অপরাহ্ণ)
চমৎকার লেখার জন্য কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে ধন্যবাদ।
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর এই যে, পিপিপি, কংগ্রেস বা আওয়ামী লীগ-বিএনপি — কেউই পরিবারতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেনি।
সাতের দশকের পর দুর্নীতিসহ বিবিধ গুরুতর অপরাধের দায় এড়ালেও এই একটি কারণে এ সব দল যখন জনগণের নামে, গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতায় বসে বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করে, তখন তাদের ভন্ডামীর নান্দনিক মুখশের আড়ালে কুৎসিত মুখগুলোই উন্মোচিত হয়ে পড়ে। কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে আবার তারাই!
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ১৫ জানুয়ারি ২০১০ (১০:০৫ অপরাহ্ণ)
বিপ্লব রহমান, আপনাকে ধন্যবাদ।
আসলে একসময় আমি বিশ্বাস করতাম, সাধারণ জনগণ কখনও ভুল করে না, আমরাই, মানে মধ্যবিত্তরাই, এদের গাইড করতে পারছি না।! আর এখন মনে হয়, আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের সাধরণ জনগণ একই সাথে সার্বভৌম আর হতচকিত-বিহ্বল অবস্থাকে লালন করে। ধর্মের আবেগ আর সামন্ত-অবশেষের ছোঁয়ার বাইরে এরা এখনও যেতে পারছে না। যারফলে এদের ভিতর এত হতচকিত, দলবদলের অপরিপক্ব লম্ফঝম্ফ দেখা যায়!!!
রেজাউল করিম সুমন - ২১ জানুয়ারি ২০১০ (৮:৩৯ অপরাহ্ণ)
স্কুলে আমার দুই ক্লাস উপরে পড়তেন ভুট্টো ভাই – সুরুজ আলী ভুট্টো। সন্দেহ কী, এই নাম যিনি রেখেছিলেন তিনি জুলফিকার আলি ভুট্টোর ভক্ত ছিলেন। কিন্তু কখন রাখা হয়েছিল এই নাম – সুরুজ আলী ভুট্টো? স্বাধীন বাংলাদেশে, যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভুট্টো? না কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে? না কি সত্তরের নির্বাচনের পরে? অনেককাল হলো ভুট্টো ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই, থাকলে এক্ষুনি ফোন করে জেনে নিতে পারতাম তাঁর (সত্যিকার) জন্মতারিখ।
আবছা মনে পড়ছে একটা ফাঁসির দড়ির ছবির কথাও, ছাপা হয়েছিল সম্ভবত কোনো একটা সাপ্তাহিকের প্রচ্ছদে। তখনো ভুট্টো ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি; আমি তখন পড়ি অন্য স্কুলে, অন্য জেলায়। সেই প্রথম জেনেছিলাম জুলফিকার আলি ভুট্টোর কথা – যাঁর মৃত্যু হয়েছে তারও বছর দুয়েক আগে, আমার শৈশবে।
২
If I am Assassinated বইটা পড়ার ব্যাপারে কখনোই আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু ভুট্টোর অন্য একটা বই পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে আগ্রহভরেই কিনেছিলাম, পড়েওছিলাম – The Great Tragedy (দ্বিতীয় মুদ্রণ)। বেরিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই, মাসখানেকের মধ্যে ছাপা হয়েছিল দ্বিতীয়বার। যতদূর মনে পড়ে, বইটিতে পাকিস্তান ‘ভাঙা’র দায়ে শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করেছিলেন ভুট্টো, কোনো ‘ঘোষক’-এর নামগন্ধও কোথাও ছিল না; অবশ্য ছিল কয়েকটা আজগুবি তথ্যও। বইটি প্রকাশ করেছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি। সম্প্রতি জেনেছি, যুদ্ধের পরে কোনো এক সময়ে এই বইয়ের বাংলা অনুবাদও হয়েছিল।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ‘পিপিপি বিষয়ে কিছু কথাবার্তা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখার সূত্রেই খানিকটা প্রসঙ্গবহির্ভূতভাবেই চলে এল উপরের কথাগুলো।
৩
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভূমিকা নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা হতে পারে বই-কী (মূল লেখায় এক্ষেত্রে ‘দাবিদার’ শব্দটাকে খুব সুপ্রযুক্ত বলা যায় না হয়তো)। হওয়া দরকারও। এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে ধন্যবাদ জানাই।
এক জায়গায় তিনি লিখেছেন,
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধে আইয়ুবের ‘টোটাল কার্যক্রম’ নিয়ে নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে আইয়ুবের শান্তি চুক্তি (সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে সম্পাদিত) নিয়ে ভুট্টো প্রশ্ন তুলেছিলেন; যার পরিণামে ভুট্টো-আইয়ুবের সম্পর্কের অবনতি হয় এবং শেষমেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ থেকে ভুট্টো সরে দাঁড়ান।
আরেক জায়গায় পোস্টলেখক লিখেছেন,
অনলাইনে প্রাপ্তব্য তথ্যে (উইকিপিডিয়া-র ভুক্তি দ্রষ্টব্য) অবশ্য দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেও –
৪
৪.১ নম্বর মন্তব্যে পোস্টলেখক ‘আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের সাথে পিপিপির সম্পর্ক-পরিবর্তনের-ধারা খেয়াল’ করা বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। কোন্ লেখা/বই/ওয়েবসাইট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেতে পারি, কেউ জানালে বাধিত হব।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ২২ জানুয়ারি ২০১০ (১২:১০ পূর্বাহ্ণ)
রেজাউল করিম সুমনকে ধন্যবাদ। আসলে আমি ইতোপূর্বে বলেওছিলাম, রাজনীনিতর অত খুঁটিনাটি বিষয় আমার পক্ষে জ্ঞাত হওয়া সম্ভব নয়। কারণ রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ আমার ঠিক পছন্দের বিষয় নয়। তবু সুমনের উপরোক্ত কথার ফলেই ইতিহাস থেকে হয়ত খানিক অপরিপক্ব কথকতা তুলে ধরছি।
মুশকিল হল, আমরা নানামুখী পন্থা আর ইজম কর্তৃক এত বেশি নিয়ন্ত্রিত যে রাষ্ট্রের অতি নিত্য-নৈমিত্তিক আচরণও নিজেদের কমনসেন্স দিয়ে বুঝতে চাই না। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অপরাপর দেশের কুটনৈতিক বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয়, এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে প্রায় একরৈখিক অবস্থা, তা ৭১-এ চালু থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা আমি সন্দিহান। এদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি, ইন্ডিয়ান সোলজারদের সক্রিয় অংশগ্রহণেই মাত্র ১১ দিনে স্বাধীনতার একেবারে দোরগোড়ায় পৌছেঁ যায় বাংলাদেশ।
এবার আমি ইতিহাস থেকে কিছু কথাবার্তা বলি, ২৫শে মার্চের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের খবরটি তখনকার সোভিয়েট ইউনিয়নের পত্রিকায় ছাপতেই এক সপ্তাহ লেগে যায়। অথচ ২৫শে মার্চের হত্যাকাণ্ডের খবর দুই-একদিনের ভিতরই ইন্ডিয়া, বৃটেন, আমেরিকার নানান কাগজে তা একেবারে সরবতাসহ প্রচার পায়। ইন্ডিয়ার লোকসভা/বিধানসভায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। কলকাতায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। আমাদের সরকার গঠনের খবরটি ১ মে’র পূর্বে রাশিয়ার কাগজে ছাপেইনি। এটা ঠিক, সোভিয়েত সরকারের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি আর প্রধানমন্ত্রী আলেক্স কসিগিন এপ্রিলের প্রথম দিক থেকেই এই দেশের অভ্যন্তরিণ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এবং এহিয়াকে তা বন্ধ করতে চিঠিও লেখেন।
মূলত ৯ অগাস্ট ভারত-সোভিয়েট ইউনিয়ন পারস্পরিক শান্তিচুক্তির পর একটা আশার আলো আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নেয় যখন ইন্দিরা গান্ধী ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে তিনদিনের জন্য রাশিয়ায় অবস্থা করে রাশিয়ার সাথে একটা যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেন, যাতে বাংলাদেশের এই সঙ্কটের একটা রাজনৈতিক সমাধানের কথা প্রকাশ করা হয়েছিল। এই প্রথম রাশিয়ান সরকার বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানান। এটা তো ইতিহাস। আর চিন মুক্তিযু্দ্ধের শুরুতেই ইন্ডিয়ার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামেরও বিরোধিতা করা শুরু করে। আসলে রাষ্ট্র মানেই নিজস্ব ভূখণ্ডের স্বার্থে জড়িয়ে থাকা নিজেদের সুবিধা আদায়ের এক সংস্থা। পৃথিবীর সমস্ত দেশই তা করে যাচ্ছে। কাজেই অমুক দেশের সবই ভালো, তমুক দেশের কিছুই সঠিক বলা যাবে না, তা করতে গেলে প্রকৃত ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়।
অমি রহমান পিয়াল - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ)
ধরে নিচ্ছি এটা লেখকের আন্তরিক স্বীকারোক্তি, সুবাদেই গোটা বক্তব্য যা আসলে হাইপোথেটিকাল রূপ নিয়েছে তার জন্য তাকে দোষারোপ করা যায় না। উচিতও হবে না। এক ব্লগে আমাকে প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন করে এই পোস্টের লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছিলেন একজন। তখন কিছু মন্তব্য উহ্য রেখে পোস্ট প্রসঙ্গেই যা বলার বলে গেছি। এবং বেশ কয়েকবার পড়ার পর বিস্ময়ভরেই মনে হলো একদম কোনো বিশ্বাসযোগ্য উপাত্ত ছাড়াই কিভাবে লেখক এই রকম একটা শিরোনামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে জুড়ে দেওয়ার রাস্তায় হাটলেন!
ভুট্টো প্রসঙ্গে যে কথা না বললেই নয়, তাহলো তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং সুযোগ সন্ধানী এক লোক। আইউবের প্রডিজি ছিলেন তিনি, অর্থাৎ আইউবের আবিস্কার। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব নিয়ে সে আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন। ভারত-চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বেশ কটি সফল চুক্তির রূপকার ভুট্টো। আবার যে তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে তার পদত্যাগ এটাও তারই নকশা করা। কিন্তু বিষয়টা গোটা পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দেওয়ায় ভুট্টো সুর পাল্টে ফেলেন। তার ধূর্ত মাথায় এটা চলে আসে এবার আইউবের পতন হলো বলে। হলোও তাই, আর ভুট্টো সময়টায় দেশজুড়ে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে জেল খেটে নিজের একটা দেশপ্রেমিক ভাবমূর্তি তৈরি করলেন। পিপিপির জন্মও তখনই। তবে এটাকে লেখক যেভাবে আর্মি আর ফিউডালিজমের বিপরীতে ভুট্টোর প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠা বলে রূপ দিতে চেয়েছেন, তা একদমই সত্যি নয়। কারন ভুট্টো নিজেই ছিলেন এই সামন্তবাদের প্রতিনিধি। আত্মীয়তাসূত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক জেনারেলও তার ঘনিষ্ঠ।
‘৭০এর নির্বাচনে ভুট্টো মোহাজির এবং চমকপ্রদ ঠেকলেও আহমদিয়াদের ভোট পান বেশী। ইয়াহিয়া চাইছিলেন আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের সমান্তরালে তাকে তুলে আনতে। কিন্তু ভুট্টো যে শেষ মুহূর্তে পাশার দান পাল্টে দিতে পারেন সেটা আইউবকে দেখেও শেখেননি ইয়াহিয়া। পাকিস্তানের পরাজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখন জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে হাতের কাগজ ছিড়ে- আমি যুদ্ধে যাচ্ছি বলে নাটক দেখিয়ে ভুট্টো নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নেন। ফলে ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার পতনও যখন অবশ্যম্ভাবী তখনই এই কূটচালে নিজেকে বরং বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেন পাকিস্তানীদের কাছে। এই পর্যায়ে তার তুরূপের তাস হয়ে দাড়ায় ‘৭০ নির্বাচনের ফলাফল ও সংখ্যা গরিষ্ঠতা।
ভুট্টো ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দি করালেন, আবার টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীদের মতো খুনে জেনারেলদের পুরষ্কৃত করলেন। হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট যাতে না বেরোয় সে ব্যবস্থা করলেন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবকে দিয়ে ব্যবস্থা করলেন বাংলাদেশ যেনো স্বীকৃতি না পায়।
মোটকথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভুট্টো একাই ছিলেন খলনায়কের ভূমিকায়, ওয়ানম্যান শো দেখিয়ে গেছেন। তার পার্টির কোনো ভূমিকা আদতেই কোনো প্রভাব রাখেনি। তারা জামাতে ইসলামীর মতো রাজাকার আলবদর গঠন করেনি। দল বেধে এদেশে এসে বাঙালী হত্যায়ও যোগ দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর মালেকের যে সরকার গঠন করেছিলেন তাতেও তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিলো না। গোটা সময়টা তারা ইয়াহিয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে তাদের নেতা ভুট্টোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যা করছে ঠিকই করছে, পাকিস্তানের জনগন তাদের পাশে আছে- একাত্তরের যুদ্ধকালে এটাই ছিলো পিপিপি।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:০২ অপরাহ্ণ)
আপনার এমনসব মনোভাবের সাথে কখনও দ্বিমত করেছি কি? আমি শুধু একটা দলের হঠাৎ রাজনৈতিক উত্থানের কথাই বলেছি। এবং তারা যে নতুন ধরনের কর্মসূচি নিয়ে এসেছিল, তাই উল্লেখ করেছি। আমার মূল পোস্ট বা পরবর্তী কথকতায় এটাই জানতে চেয়েছি যে, এই দলটিই ৭১-এ আমাদের উপর নির্যাতনের মূল কারিগর, কিন্তু পিপিপি বা তাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয় না। সেই বিষয়টিকে হাইলাইট করাই যে আমার উদ্দেশ্য তা তো আমার লেখা পড়লেই বোঝা যাবে। মূল বিষয় বোধ হয়, সোভিয়েট ইউনিয়ন নিয়ে কথা বলাতেই আমি কারো কারো উস্মার কারণ হয়েছি মনে হয়! সোভিয়েত ইউনিয়ন যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করেছিল তা কি আমি অস্বীকার করেছি?
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রগতিশীল আদর্শ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল এবং আফগানিস্তানে তারা কী ধরনের অমানবিক আচরণ করেছিল তা কে না জানে। খালেদ হুসাইনের কাইট রানার-এ তা সবিস্তারে উল্লেখ আছে। কথা হচ্ছে, ইতিহাসকে ভাবাবেগ নিয়ে পাল্টানোর কিছু আছে কি? আমি আবারও বলছি, মুক্তিযু্দ্ধে পিপিপির ভূমিকা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।
অমি রহমান পিয়াল - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:৫৭ অপরাহ্ণ)
ভাই আপনি ভুল বুঝছেন আসলে। এখানে সোভিয়েত রাশিয়ার উল্লেখ ব্যাপার না। আপনি যে শিরোনামটা দিয়ে পোস্টটা লিখেছেন, সেটাই ব্যাপার। আর আমি যা লিখেছি, তার লাইন বাই লাইন আপনাকে রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ করে দেবো। রাগ করার এখানে কিছু নেই তো। আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বলেই আগ্রহ প্রকাশ করেছি, আপনার ভুলগুলো তুলে ধরেছি। আপনি যদি আমার কোনো তথ্য ভুল প্রমাণ করতে পারেন সানন্দে মেনে নেবো। গঠনমুলক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই তো সত্যি প্রতিষ্ঠা পায়। আবারও বলছি, ভুট্টো একাই মুক্তিযুদ্ধে খলনায়ক ছিলেন। পিপিপির তেমন কিছু করার ছিলো না, করেও নি ইয়াহিয়াকে ঠ্যাকা দেওয়া ছাড়া।
বিপ্লব রহমান - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:৫৬ অপরাহ্ণ)
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও লেখক অমি রহমান পিয়ালকে সবিশেষ ধন্যবাদ ভূট্টোর স্বরূপটিকে উন্মোচিত করার জন্য। তথ্য-উপাত্তসহ এই রাজনৈতিক বিশ্লেষনটুকু সত্যিই খুব দরকার ছিলো। অরপি’র মন্তব্যসহ এখন পুরো লেখাটিকে অনেক প্রাসঙ্গিক ও পূর্নাঙ্গ বলে মনে হচ্ছে।
তাকে বিনীত অনুরোধ, ভূট্টোর রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও বেনজির ভূট্টো সর্ম্পকিত একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা ‘মুক্তাঙ্গন’এ দেয়ার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর মাধ্যমে শুধু ‘মুক্তাঙ্গন’এর পাঠকরাই সমৃদ্ধ হবেন না, সমৃদ্ধ হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও।
অনেক ধন্যবাদ।
তানবীরা - ২২ জানুয়ারি ২০১০ (৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
বর্তমান পাকিস্তানের নিজেদের রাজনীতিই এতো বিভ্রান্ত আর ছল কপটে ভরা, ওদের কাছে থেকে সত্য উদঘাটন এর আশা দূরাশা মাত্র। তবে এই বিষয়টা সামনে আসা উচিত। আমাদের জানা দরকার এই নৃশংসতার পিছনে আসলে কারা ছিলেন, কি উদ্দেশ্যে?
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লেখাটির জন্যে।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ২২ জানুয়ারি ২০১০ (১:৩৪ অপরাহ্ণ)
আপনার সাথে আমিও একমত- আমাদের প্রকৃত ইতিহাস বের করার স্বার্থেই পিপিপি-এর রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতা জানা দরকার। আমরা আসলে অনেককিছুই জানিওনা। এই যেমন, আইউব খান, তখন তো অসুস্থ্যই ছিলেন। তবুও ভুট্টোর সাথে এত শত্রুতার পরও চিকিৎসার অজুহাতে গোপন-দুতিয়ালী সাপেক্ষে বৃটেন হয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক তথ্য-তালাশকারীগণ বলেন।
আর ইতিহাসের দুইটা জিনিস আমাদের মনে রাখা দরকার- ১. প্রচলিত ইতিহাস সর্বদাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের এক বিষয়। ইতিহাসে জনসংস্কৃতির বিষয় যেমন আমাদের মনে রাখতে হয়, তেমনি শাসককুলের কথা ভুলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ২. সরব ইতিহাসের চেয়ে নির্জন ইতিহাসের মূল্য আরও বেশি। কাজেই সব ইতিহাস গ্রন্থ, ওয়েবসাইটে খোঁজার প্রবণতা সঠিক নাও হতে পারে।
তানবীরাকে ধন্যবাদ।
তানবীরা - ২২ জানুয়ারি ২০১০ (৩:৪৭ অপরাহ্ণ)
আমি আপনার খোঁচাটুকু কিন্তু সত্যি সত্যি উপভোগ করেছি। কিন্তু আমরা বোধ হয় ওয়েব সাইট জেনারেশন হয়ে গেছি। ঃ)
তবে এটা নির্দ্বিধায় সত্যি বলে মনে নেয়া যায়, আসল ইতিহাস মানুষের চোখের আড়ালেই থাকে সাথে ইতিহাসের নায়ক আর নায়িকারাও।
অমি রহমান পিয়াল - ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১০:০৪ অপরাহ্ণ)
একদম শেষ থেকে শুরু করি।
ইয়াহিয়াকে কখনওই জেলের ভাত খেতে হয়নি। প্রথম দিকে তাকে নজরবন্দী করে রাখা হয় বন্নির এক ফরেস্ট বাংলোয়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর রওয়ালপিন্ডীর ৬১ নং হার্লে স্ট্রিটে নিজের বাড়িতেই গৃহবন্দী হয়ে থাকেন একসময়কার প্রবল ক্ষমতাধর এই প্রেসিডেন্ট। সেখানেই এক স্ট্রোকের পর পক্ষাঘাতগ্রস্থ অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
মূল পোস্টের ব্যাপারে এটুকুই শুধু বলবো, ভুট্টো কিংবা পিপিপি মোটেও রুশপন্থী রাজনৈতিক দল ছিলো না, তারা ছিলো পুরোপুরিই চীনঘেষা। একাত্তরে চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক আতাতটা রাশিয়াকে কাবুর করার জন্য জরুরী ছিলো নিক্সন প্রশাসনের। সেকারণে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো ছিলো তাদের পছন্দের ঘটক।
এসব ব্যাপারে কারো দলিলদস্তাবেজ সহ তর্ক করার ইচ্ছে থাকলে স্বাগতম। অন্যকাজে ব্যস্ততা থাকায় এই মুহূর্তেই পারছি না। তবে একটি ছোট যুক্তি দিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান থেকে যে প্রতিনিধি দলটি চীনের পূর্ন সমর্থন আদায়ের জন্য সেখানে গিয়েছিলো তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভুট্টো। আগস্টে ভারত-রাশিয়া মৈত্রি চুক্তি সাক্ষরের পর রাশিয়া পুরোপুরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে বসে যা জাতিসংঘে ডিসেম্বরের লড়াইয়ে কাজে আসে আমাদের। রাশিয়ার একের পর এক ভেটোতেই নিশ্চিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। ভুট্টোর রাশিয়ান কানেকশন ভালো থাকলে, ইয়াহিয়া তাকে মস্কো পাঠাতেন, পিকিং না।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
আমি যে রাজনৈতিক অবস্থার কথা বলেছি, তা আমাদের মুক্তিযু্দ্ধের প্রথম দিককার কথা। আর চিনের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল আইউব খানের, মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকার মাঝামাঝি সময় থেকে চিনের সাথে ভুট্টো্র রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এহিয়া খান যে জেলে ছিল, এমন একটা ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছিলাম। এহিয়ার জেলখানার বিষয়টা সেই স্মৃতি থেকেই বলা। পত্রিকা হয়ত নজরবন্দিকেই জেলখানা উল্লেখ করেছিল!
অমি রহমান পিয়াল - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:০৮ অপরাহ্ণ)
ভাই আপনার মেধা এবং প্রজ্ঞার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আপনি ঠিক বলেননি। এ বিষয়ে আপনার জানায় আসলেই যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। খুব জোর দিয়ে কথাটা বললাম এজন্য যে গত ১৫ বছর ধরে আমার পড়াশোনা, জানার আগ্রহ এসব নিয়েই, লেখালেখিও। আইউব চীনের সঙ্গে যে লবিং করেছিলেন তাতে মূল ভূমিকা ছিলো ভুট্টোর। একইভাবে ইয়াহিয়াও তাকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শীতলযুদ্ধের মহাদেশীয় সামরিকগুরুত্বে চীনের সঙ্গে মার্কিন আতাতের সিদ্ধান্তে এই যোগাযোগটা নিক্সন-কিসিঞ্জার ব্যবহার করেছিলেন। পাকিস্তানে সফরে এসে অসুস্থতার কথা বলে এক সামরিক বিমানে করে পিকিং গিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। আর ভুট্টোর রাজনৈতিক আঁতাতের নবায়নটা শুরু হয়েছিলো আরো আগে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় একটা বিমান হাইজ্যাক করে ধ্বংস করে কাশ্মিরী মুজাহিদরা, যার জন্য পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেছিলো ভারত। তখনও একটা যুদ্ধ লাগি লাগি করছিলো, আর তখন ইয়াহিয়া চীনকে পাশে পেয়েছেন ভুট্টোর দূতিয়ালীতে।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:৪৭ অপরাহ্ণ)
অত্র বিষয়ে আপনার কার্যক্রমের উপরও আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিশ্চয়ই আছে। তবে কথা হচ্ছে, আমিও একেবারে পড়াশুনা না-করে আন্দাজের উপর সব সাজিয়েছি তা কিন্তু নয়।
কথাক্রমে বলছি, চলমান ইতিহাসের বাইরেও রাষ্ট্রের নির্জন-ইতিহাস থাকে, কাণ্ডজ্ঞানের ধারাক্রম থাকে। তাও ইতিহাস নির্ধারণে কম মূল্যবান নয়। ৬০-৭০ দশকের পিপিপির সাংস্কৃতিক ইতিহাস খেয়াল করুন, তা কিন্তু চিনা রাজনীতির মাও ধারাকে বেগবান করার কাছাকাছিও নয়। চিনা-প্রশাসন বরং তখন ভারতের চারু মজুমদার আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হক-তোয়াহার রাজনৈতিক ধারাকেই সাপোর্ট দিয়ে গেছে। আমি আবারও পিপিপি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মস্কোপন্থি ন্যাপের রাজনৈতিক ইস্যুসমূহকেই স্মরণ করব। আপনার যেহেতু এই ব্যাপারে আগ্রহ আছে, তাহলে কাইন্ডলি এসব মিলিয়ে দেখুন।
আমি আমার কথকতার সপক্ষে আমার কর্তৃক প্রদানকৃত প্রত্যুত্তর নং ৭-এ এসব নির্দিষ্ট করে জানিয়েছি। এ বিষয়ে আমি তখন সাহায্য নিয়েছিলাম আবদুল হকের গবেষণালব্ধ গ্রন্থ চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ (১৯৫৩-‘৯৩)-এর। কাজেই এটা চিন্তা করা সঠিক হবে না যে, আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে কথাশিল্পের চর্চা করেছি!
তবে এও জানাতে হয়, আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল, তখনকার পিপিপি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা। পিপিপি আর ভুট্টো কোনো আলাদা সত্তা নয়। বরং বলা যায়, ভুট্টো যেভাবে পিপিপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল, তাতে দলটির ফিউডাল ক্যারেক্টারই স্পষ্ট করে। তার মানে এরা সামন্তবাদের বিপক্ষে কথা বললেও তাদের রাজনৈতিক চরিত্রেই তা ছিল!
অমি রহমান পিয়াল - ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ)
চারু মজুমদার! হক-তোয়াহা!! পিপিপি!!! না ভাই আগ্রহ পাচ্ছি না আর বিতর্কে, ভালো থাকবেন
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (২:৪৭ অপরাহ্ণ)
আশা করবো, ইতিহাস-সংক্রান্ত লেখালেখিগুলো আরও তথ্যভিত্তিক এবং বস্তুনিষ্ঠ হবে। নিজস্ব ধ্যানধারণা দিয়ে ব্লগ লেখা হয় বটে, তবে এধরনের লেখায় সেসব না থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে করি।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:৫৭ অপরাহ্ণ)
আপনার উপরোক্ত কথার জবাব হিসাবে আমার প্রত্যুত্তর ৭ ও ৯.১.১.১. পড়তে অনুরোধ করছি।
মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা মেলে ধরার কথিত ঐতিহাসিক-প্রবণতা এখনও হয়ত আমাদের কারও কারও মনোজগতে আছে!
ব্লাডি সিভিলিয়ান - ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১২:৫১ অপরাহ্ণ)
হা, হা, হা, ব্যাপক মজা পাইলাম!
মস্কোপন্থী নই, চিনপন্থী নই। ডান বা বামপন্থীও নই। কেবল সত্য ও তথ্যপন্থী। আপনার লেখায় এর ঘাটতি চোখে পড়ছে।
অমি রহমান পিয়াল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে-পরিমাণ লেখালেখি ব্লগে করেছেন এবং শিবির বা ছদ্মশিবিরিদের বিপক্ষে ব্লগে যে পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে তাদের নগ্নরূপ উন্মোচন করেছেন, তাতে এব্যাপারে তাঁর মতের প্রামাণিকতায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ করছি না। ইচ্ছে হলে সামহোয়্যারে তাঁর ব্লগে ঘুরে আসতে পারেন, যদিও তাঁর একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমার এবং অনেকেরই আপত্তি, এবং এটি এখানে মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়।
যাই হোক, শুভেচ্ছা রইলো এবং আশা, ভবিষ্যতে আরো তথ্যমূলক লেখা পাবো।
কামরুজ্জমান জাহাঙ্গীর - ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:০৩ অপরাহ্ণ)
আমি কিন্তু ভাই এই সহজ সত্যটি বলেওছি। কথাক্রমে বলছি, এ ব্যাপারে আমার ঘাটতি না-থাকলে আমি তা উল্লেখও করতাম না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মাসুদ করিম - ৩ এপ্রিল ২০১১ (২:৪২ অপরাহ্ণ)
পাকিস্তানের সেই ২২ পরিবারের কথা আমরা শুনেছি, পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতিবিদ লাল খান বলছেন, ভুট্টো ওই ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। ১৯৭৯ সালে এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখের মধ্যে রাতের কোনো এক সময়ে রাওয়ালপিন্ডি জেলে সামরিক শাসক জিয়াউল হকের নির্দেশে ভুট্টোকে হত্যা করা হয়, এই হত্যার পেছনেও সিআইএ-র হাত আছে বলছেন লাল খান। সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদে দীর্ণ হয়েছিলেন ভুট্টো, এক কথাও বলছেন লেখক।
ভুট্টো ও মুজিব দুই প্রান্তের দুই শক্তিশালী রাজনীতিবিদ কি এক ঢিলে দুই পাখির মতো মারা গিয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা এখন খুবই জরুরী।
বিস্তারিত পড়ুন : Bhutto: a legacy betrayed।