এনজিও যে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছায়ার মতো তাদের থাবা বিস্তার করছে তা বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি এনজিও-কার্যক্রমের দিকে নজর দিই তাহলে দেখব, স্বাধীনতার পর-পর মাত্র গুটিকয় এনজিও তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। আর এখন তো বাংলাদেশের প্রতি ধূলিকণায় তাদের রক্তাক্ত ছোঁয়া রেখে যাচ্ছে। রুরাল ইকোনোমির প্রায় সবটুকুই তারা তাদের করায়ত্ত করে ফেলছে।
তাদের কাজের বিস্তৃতির কিছু নমুনা দেয়া যাক। রেলের টেলিকম সিস্টেমের সাথে গ্রামীণ ফোনের সম্পর্ক বরাবরই বেশ নিবিড়। এখন এরা সুবর্ণ এক্সপ্রেসের একটা বগি সেলফোনের জন্য নানান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করছে। আরও এক মজাদার বিষয় কেউ কেউ লক্ষ্য করে থাকবেন : চট্টগ্রাম শহরের অলঙ্কার মোড়ে একটি পুলিশ বক্স। তা এমনই দৃষ্টিনান্দনিকতায় পরিপূর্ণ যে, মনে হবে বেহেশতের স্নিগ্ধস্রোত চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। যে-কোনো পুলিশ বক্সকে বরাবরই ষড়যন্ত্রমুখর, পলায়নপর, যন্ত্রণাময় এক জায়গা মনে হয়। কিন্তু এমন স্মার্ট আর রোমান্টিক পুলিশ বক্স এই দেশে কমই আছে। এটি নির্মিত হয়েছে সানমারের সৌজন্যে। এ-ধরনের বহু কাজ সরকার-নিয়ন্ত্রিত অঙ্গনে হরহামেশাই চোখে পড়ে।
সবচেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে, এই যে, এনজিও-গ্রাস শুরু হয়েছে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশ কি এতে রুদ্ধ হবে না?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
কথাসাহিত্য চর্চার সঙ্গে যুক্ত। পেশায় চিকিৎসক। মানুষকে পাঠ করতে পছন্দ করি। আমি মানুষ এবং মানব-সমাজের যাবতীয় অনুষঙ্গে লিপ্ত থাকার বাসনা রাখি।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১১ comments
ইমতিয়ার - ৬ নভেম্বর ২০০৯ (২:৩৭ পূর্বাহ্ণ)
সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? কিন্তু এনজিও-গুলি তাদের মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে অসুস্থ পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার যে কোরামিন-স্যালাইন প্রস্তুত করে চলেছে, তার জন্যে আমাদের অহরহ শুনতে হচ্ছে যে, এনজিওগুলি সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
আমার মনে হয়, সামাজিক উন্নয়নের যে-টুকু এনজিও করছে বলা হয় (যেমন, নারীর ক্ষমতায়ন), তা ‘চুঁইয়ে পড়া’ একটি প্রতিফল মাত্র। তাদের দরকার একটি ঋণগ্রস্থ জনগোষ্ঠী, যাদের কাছ থেকে তারা এক হাতে দেবেন, আরেক হাতে নেবে। লক্ষ্যদল হিসেবে তাই পুরুষ সঠিক নয়। কেননা, উন্মূল পুরুষ পালিয়ে যেতে পারে, ঋণগ্রস্ত হওয়ার পর এখানে ওখানে চলে যেতে পারে। নিরাপদ লক্ষ্য দল হলো নারী, তাদের ঘরেই পাওয়া যায়, সামাজিক দুর্নামের কারণেই তারা পালিয়ে বেড়াবে না ঋণগ্রস্ত হওয়ার পরে এবং তাকে ‘সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের’ স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা করা সহজ। এনজিও-গুলি নারীদের নিয়ে যা করেছে তা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই করেছে।
তবে গ্রামীণ ফোনকে কি আমরা এনজি-ওর পর্যায়ে ফেলব? না কি সরাসরি কর্পোরেট পুঁজির সংস্থা বলব?
ব্রাক এবং গ্রামীন ব্যাংক মিলে যা করছে তা অবশ্য কৃষিতে এই কর্পোরেট পুঁজি প্রতিষ্ঠার কাজ। বর্তমান সরকারের কৃষি পদক্ষেপগুলি সাময়িক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বটে; কিন্তু কতদিন পর্যন্ত এ প্রতিবন্ধকতা থাকবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। যেদিন থাকবে না, সেদিন রুরাল ইকনোমির পুরোটাই এনজিও ভাই-বেরাদরদের দখলে যাবে।
ধন্যবাদ জাহাঙ্গীর ভাই, এই নিয়ে কলম ধরায়।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৬ নভেম্বর ২০০৯ (৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ)
প্রিয় ইমতিয়ার শামীম,
আমার ভাববিগ্রহের প্রতি আপনার চমৎকার একাত্বতার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসা। গ্রামীণ ফোন কর্পোরেট পুঁজির অংশ_ তা ঠিক, আমি আসলে বিকৃত পুঁজির কাছে (এখানে উল্লেখ করতে হয়, আমার লেখায় উল্লেখিত পুলিশ বক্সটি নির্মাণ করেছে সানমার নামের সংস্থা) সরকারের নিরীহ-আত্মসমর্ণের বিষয়টিই আমি মুখ্য বিষয় করে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছি।
আপনার মৌলিক পোস্ট পাঠের অপেক্ষায় থাকলাম।
মুয়িন পার্ভেজ - ৬ নভেম্বর ২০০৯ (১১:১১ পূর্বাহ্ণ)
এই প্রথম ‘মুক্তাঙ্গন’-এ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের একটি লেখা পড়লাম। লেখাটি সংক্ষিপ্ত হলেও বিষয়টি বিতর্কবিস্তারী। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে এনজিও-কার্যক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু আলোচনা চোখে পড়েছে। ক্ষুদ্রঋণনির্ভর এনজিও-গুলোর ‘নিরাপদ লক্ষ্য দল হলো নারী’, ইমতিয়ার যেমন বলেছেন, ‘এনজিও-গুলি নারীদের নিয়ে যা করেছে তা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই করেছে’ — তাঁর এ-পর্যবেক্ষণ যথার্থ ব’লে মনে হয়। আবার যেসব এনজিও-র (যেমন ‘বিটা’) ইশতেহার হল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো, সেগুলোরও প্রধান লক্ষ্য ‘বঞ্চিত’ বা ‘নির্যাতিত’ নারীসমাজ। গ্রামাঞ্চলে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বোধহয় এখনও স্পর্শকাতর এক নাম, যার বিরুদ্ধে নব্বইয়ের দশকে মাওলানারা অনলবর্ষী স্লোগানও দিয়েছিলেন (চট্টগ্রামের এক গ্রামে, আমার দেখা)। কিন্তু মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গে (বগুড়া, জয়পুরহাট) কিছুদিন ঘুরে দেখেছি, ঘরে-ঘরে এনজিও-র সুবাতাস বয়ে চলেছে — ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ ছাড়াও বহু অখ্যাত-স্বল্পখ্যাত স্থানীয় এনজিও বা উত্তমর্ণ সংগঠন পরমানন্দে ঋণবিতরণ ক’রে যাচ্ছে সকাল-সন্ধ্যা। কাবুলিওয়ালা-বিবাদ অবশ্য আছে, গৃহিণীরা ‘নিরাপদ লক্ষ্য দল’ হলেও ঋণাক্রান্ত গৃহকর্তারই পলায়নসংবাদ শুনেছি সময়ে-অসময়ে। তবে ‘দৃষ্টিকোণ’-এর প্রশ্নটি আপাতত উহ্য রেখেও অত্রিশঙ্কু বিকল্প ব্যবস্থার কথা আমরা ভাবতে পারি; কিন্তু কী সেই অপূর্ব পন্থা, যা সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে দারিদ্র্যবিমোচনের মহান দায়িত্ব পালন করতে পারে?
২
অলঙ্কার মোড়ের ‘সানমার’-প্রযোজিত ‘রোমান্টিক পুলিশ বক্স’টির একটি ছবি কি তুলে দেওয়া যায় মূল লেখাটির সঙ্গে?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৬ নভেম্বর ২০০৯ (১:৫৩ অপরাহ্ণ)
মুয়িন পার্ভেজকে শুভেচ্ছা।
মুয়িনের কথামতে সানমার-এর সৌজন্যে নির্মিত পুলিশ বক্সটির ছবিটি দেয়ার খুব লোভ হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক সত্যি কি দারিদ্রকবিমোচনে (দুই-চার জন যে তাদের ব্যক্তিজীবেনের কথিত উন্নয়ন করছে না, তা কিন্তু আমি বলছি না।) দীর্ঘমেয়াদী কার্যকর ব্যবস্থা রাখতে পারছে? ক্ষুদ্রঋণের সুদের এমন ব্যাপক হার দাদন ব্যবসায়ীগণ ব্যতিত আর কে নেয়? তাদেরকে ঋণ নিতে গেলে জমি বন্ধক রাখতে হয় না, তা বোঝা গেল; কিন্তু যারা ঋণ নিচ্ছেন তারা দলগতভাবে নিজেদের বন্ধক দিচ্ছে না?
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিটা কিছু কাজ করছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমের ভিতর ভাসা ভাসা উপদেশ আর খরচের বিশালত্ব খেয়াল করলে বোঝা যায়, এনজিও’র বড়ো কাজ হচ্ছে খাজনার চেয়ে বাজনা-ই অধিক দেখানো। তাদের প্রকাশনা থেকে বের করা শৈল্পিক গুণে সমৃদ্ধ একটা গ্রন্থের প্রচ্ছদ করতে খরচ পরে হয়ত ১০/১২ হাজার টাকা! একটা প্রচ্ছদের টাকায় ৫/৬ ফর্মার একটা ছোটকাগজ বের করা যেতে পারে।
যাই হোক, এনজিও’র কার্যক্রমের যে সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে, যারা একসময় প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত রাখতে গৌরবে ফেটে পড়ত, তারাই এখন অদ্ভুত এক সাংস্কৃতিক চৈতন্য আর স্মর্টিলি পরজীবী প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে এরা যেভাবে রুরাল ইকোনোমি নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে এই লড়াকু মানুষজনকে আর কি বৃহত্তর আন্দোলনে পাওয়া যাবে। এভাবেই যারা ঋণ দিচ্ছে তারা তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারছে।
আমরা আমাদের সৃজনশীলতা, মুগ্ধতা, কান্না-হাসি এভাবেই পরধনের কাছে ক্রমশ বন্ধকি রেখে যাচ্ছি…
নুর নবী দুলাল - ৭ নভেম্বর ২০০৯ (২:৪১ অপরাহ্ণ)
জনাব কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর-এর লিখাটি সংক্ষিপ্ত হলেও, অর্থবহতা ব্যাপক। স্বাধীনতার পর দেশকে পূর্ণগঠনে বিদেশী সাহায্য এদেশের জন্য ছিল আবশ্যক। যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি ভঙ্গুর দেশকে সহযোগীতা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্হিবিশ্বের যে কয়টি দেশ/ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করেছিল, যুদ্ধপরবর্তীতে তারাই দেশ পূর্ণগঠনে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়। নিঃস্বার্থ সেই সহযোগীরা মনে করেছিল সরকারে একার পক্ষে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এদেশটি পূর্ণগঠন সম্ভব নয়। তাই, ঐ সব দাতাগোষ্ঠি দেশ পূর্ণগঠনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে স্বেচ্ছায় সেবা প্রদানে আগ্রহী এদেশের কিছু সহযোগীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে থেকে এনজিও বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্ম। যার শুরুটা ছিল অতি মহৎ। প্রচুর বৈদেশিক সাহায্যর হাতছানি আমাদের দেশের তথাকথিত সৃজনশীল ও বাম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, সাহায্যের টাকায় প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশি কিছু হাফ বুদ্ধিজীবি রাতারাতি গড়ে তোলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যার প্রচলিত নাম এনজিও। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা বিরোধিতা করেছিল, সেই আমেরিকা এনজিও নামের মহান সংগঠনগুলিকে সাহায্যের নামে পুজিঁবাদী ধ্যান-ধারনায় প্রশিক্ষিত করে তোলে। মহান সেবার ব্রত নিয়ে যে এনজিওগুলির জন্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে পূজিঁবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-ভাবনা। পূজিঁবাদী প্রভূরা লোভের বেড়াজালে ফেলে অনায়াসে আমাদের এনজিও নামধারী সংগঠনগুলোকে দিয়ে তাদেঁর হীন স্বার্থ চরিতার্থতায় নগ্ন এক খেলায় মেতে উঠে। আর ঐ খেলার একটি ইভেন্ট হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ। এখন আমরা এনজিও মানে বুঝি ক্ষুদ্রঋণ বা সোজা বাংলায় বলা যায় সুদি বাণিজ্য। আর এই সুদি বাণিজ্য সাম্রাজ্যবাদীদের আকাঙ্খা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারায়, চিরদিন অবহেলিত গরীব মেধাবী এই বাঙ্গালী পেল শান্তিতে নোবেল। মহাজনী প্রথাকে নতুন মোড়কে এই সমাজে টিকিয়ে রাখার এই এক মহা পুরষ্কার। কিন্তু এখনও কিছু কিছু এনজিও আছে, যারা সত্যিকার অর্থে এদেশের দরিদ্র, অবহেলিত জনগোষ্ঠির পাশে নীরবে কাজ করছে। যারা সত্যিকার অর্থে সুদি বানিজ্যের সাথে জড়িত নয়। কর্পোরেট ভাবে ঐ সকল এনজিও হয়ত তেমন পরিচিত নয়, যারা স্থানীয়ভাবে কিছু অবহেলিত জনগোষ্ঠির জন্য নিভৃতে কাজ করছে। তাদের জন্য রইলো শুভ কামনা…………
রায়হান রশিদ - ৭ নভেম্বর ২০০৯ (৯:৩২ অপরাহ্ণ)
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ভাইকে ধন্যবাদ পোস্টটির জন্য। বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে আপনার সংক্ষিপ্ত আলোচনায়। আপনি লিখেছেন:
কথাটা মনে হয় সত্যি। অন্তত ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে কথাটা তো সত্যিই, যদিও হাতে কোন তথ্য উপাত্ত নেই (কারও কাছে থেকে থাকলে অন্তত রেকর্ডভুক্ত করে রাখার খাতিরে হলেও এখানে উল্লেখ করুন প্লিজ)। কিন্তু এতে কি আসলেই অবাক হওয়ার মতো কিছু আছে? অর্থনৈতিক নিরাপত্তার যে আচ্ছাদন রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে সরবরাহ করার কথা, সেটা যখন ভেঙ্গে পড়ে (আসলে কখনোই ছিলো না সেটা তেমনভাবে), বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তো সে স্থান পূরণ করবেই। তা সে মুনাফার জন্যই হোক আর যে উদ্দেশ্যেই হোক।
আর “এনজিও” বা “বেসরকারী প্রতিষ্ঠান” অভিধাটি সবসময়ই একটু গোলমেলে মনে হয়েছে। কারণ, অনেক বিস্তৃত হতে পারে এর অর্থ। সেখানে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের নিয়ে গঠিত এমন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে যারা সদুদ্দেশ্যেই মাঠে নামেন, ‘কিছু একটা’ করার আকাঙ্খা থেকে। আবার এমন প্রতিষ্ঠানও থাকতে পারে যাদের কাজ হল “poverty porn” দেখিয়ে বিশ্ববিবেককে সুড়সুড়ি দিয়ে পকেট-সাফাই করা, আর মাঝখান থেকে নিজেদের মুনাফাটাও যথাসময়ে হাতিয়ে নেয়া। এমন কয়েকজনকে চিনি যারা লাভজনকভাবে ব্যবসা বা বিনিয়োগ করার অনেকগুলো বিকল্প-ক্ষেত্রের মধ্যে ‘এনজিও করা’-কেও আমলে এনেছেন, সেটাকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করেই। প্রায় বছর দশেক আগে সুপ্রীমকোর্টে দেশের সেরা আইনজীবিরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিলেন এই প্রশ্নে – ‘ব্র্যাক’ এর কি আসলে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত নাকি বেসরকারী ব্যাংক হিসেবে? বলাই বাহুল্য, দু’টোর ক্ষেত্রে কর প্রদান নিয়মে পার্থক্য রয়েছে, সে কারণেই এমন হন্তদন্ত হয়ে আইনী লড়াই। বিষয়টা ছিল ‘টাকা-আনা-পাই’ এর।
সংজ্ঞাগত দিক থেকেও ‘এনজিও’ অভিধাটিতে কিছু সমস্যা আছে মনে হয়। স্রেফ বেসরকারী বা ব্যক্তি উদ্যোগ কিংবা সরকার বহির্ভূত সব উদ্যোগকেই কে আমরা এনজিও বলবো? নাকি যে সব সংগঠন সরকারের ‘এনজিও পরিদফতরে’ নিবন্ধিত, শুধু সেগুলোকেই এনজিও বলবো? সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশীদারিত্বে যে সব প্রতিষ্ঠান তাকে আমরা কি বলবো? (সেগুলোকে কি সে বিচারে “বেসরকারী প্রতিষ্ঠান” বলা যায়?) আবার ধরা যাক অর্থায়নের বিষয়টি। এনজিও’র সাথে আমরা সাধারণত বিদেশী অনুদানের বিষয়টিকেও দেখে থাকি। বড়ো এনজিও-গুলোর বেশীর ভাগই বিদেশী অনুদানে চালায় তাদের প্রকল্পগুলো। কিছু কিছু আবার নিজেদের খরচ নিজেরাই উপার্জন করে। আবার কিছু কিছু রয়েছে যেগুলো দেশীয় দাতাদের আর্থিক সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আবার সেক্টর থেকে সেক্টরে এনজিও-তে রয়েছে পার্থক্য। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কাজ করা এনজিও যেমন আছে, তেমনি আছে আইনী সহায়তা প্রদানকারী এনজিও, তেমন আছে ‘পরিবেশ ইস্যু’ নিয়ে কাজ করা এনজিও, নির্যাতিত নিপীড়িত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা এনজিও, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন তৈরী করা এনজিও (এ নিয়ে মনজুরাউলের পোস্টেও কিছু আলোচনা হয়েছে), পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করা এনজিও, ইসলামী মাদ্রাসা বা জঙ্গী ছাউনী করা এনজিও (দ্রষ্টব্য: ফয়সাল মোস্তফা এবং গ্রীন ক্রিসেন্ট) ইত্যাদি। সুতরাং, এনজিও নিয়ে ক্যানভাসের পুরোটাই কেমন যেন চিত্র-বিচিত্র মোজাইকে ভরা। তাই পুরো সেক্টরটি সম্বন্ধে ঢালাও মন্তব্য করার মনে হয় না কোন সুযোগ আছে; তাতে মূল বক্তব্য (এমনকি সত্য হলেও) হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে (নিতান্তই ব্যক্তিগত মত)। জানা নেই বাংলাদেশে এ মুহুর্তে ঠিক কতগুলো এনজিও রয়েছে। অনেক বছর (প্রায় ১৩) আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটা রিপোর্টে দেখেছিলাম – সংখ্যাটা লক্ষাধিক। এখন না জানি কতো? আর ঠিক কোন্ সেক্টরে কাজ করছে কতগুলো এনজিও? এই বিষয়ে সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো হাতে পাওয়া গেলে ভাল হতো।
এই বিষয়ে তথ্যগুলো আমাদের নখদর্পনে থাকা দরকার আরেকটি কারণে। সেটি হল – চূড়ান্ত বিচারে জনগণের ভাল মন্দের দায়িত্ব সরকারের, অথচ সেটাই ধীরে ধীরে বেসরকারী হাতে/খাতে চলে যাচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে পুরো দেশ আর জনজীবন হয়ে পড়ছে ‘বেসরকারী’ (privatised)। এটাই যেন এখন ‘নতুন এক ধর্ম’! মুক্তবাজারের নামে এই সব অরাজনৈতিক, বিরাজনীতিকৃত মডেলগুলোর পক্ষে কথা বলার মতো মানুষও এখন খুব কম নেই; যাদের মধ্যে বহু হেভিওয়েট চিন্তাবিদও আছেন যারা তথ্য উপাত্ত ছাড়া কথা বলেন না। এ কারণেই উপরি উপরি আলোচনার চেয়েও এখন দরকার তথ্য উপাত্ত হাতে নিয়ে ধরে ধরে আলোচনা-বিশ্লেষণ; তাতে ফললাভের সম্ভাবনা বেশী। কারণ, সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করেই না সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ! সেখানে একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি ঘটার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
‘গ্রামীণ ফোন’-কে কি এনজিও বলা যায়?
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৮ নভেম্বর ২০০৯ (৭:০৫ পূর্বাহ্ণ)
রায়হান রশীদের তথ্যপূর্ণ লেখার জন্য ধন্যবাদ।
সাধারণ হিসাব থেকেই এটা বলা যায়, যাহা জিও নয় তাহাই এনজিও। আমি যেটুকু জানি, গ্রামীণ ফোন দেশি অর্থে যতটুকু চলে, বিদেশি অর্থ তারচেয়ে বেশি নিচ্ছে।
তাঁর লেখায় এনজিও সম্পর্কে অনেক তথ্যই কিন্তু উঠে এসেছে। তবে আমার মতামত প্রকাশের ভিতর এনজিও বিষয়ে কথকতা থাকলেও এর প্রবণতা কিন্তু এনজিও বা নানান সংস্থার সাথে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্তটাই বড়ো করে দেখাতে চেয়েছি।
কথা হচ্ছে, সরকার হচ্ছে সরকার- এ তো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা অসহায় কোনো ব্যক্তি নয়। এ হচ্ছে একটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বকারী সংস্থা, মানবিক গণতন্ত্রের পথকে সুগম করা যেমন এর কাজ, তেমনি রাষ্ট্রের সার্বিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখাও এর কাজ।
এখন ধরা যাক, কথিত পুলিশ বক্সে বা তাদের অন্য কোথাও তারা রিপোর্ট পেল যে, তাদের জন্য প্রযোজিত (শব্দটি এক্ষেত্রে মুয়িন পার্ভেজ থেকে ধার করা) সানমার তো আসলে চোর-ছ্যাচরে ঠাসা বা সেখানে তো পুকুরচুরি হচ্ছে, তখন জনাব পুলিশ সেখানে কী করবেন? এটা একটা নৈতিকতার সাধারণ হিসাব থেকেই বলা হলো; রাষ্ট্রপক্ষের দর্শনগত জায়গাটিও কিন্তু এক্ষেত্রে নানান ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
মোহাম্মদ মুনিম - ৮ নভেম্বর ২০০৯ (১০:৩২ অপরাহ্ণ)
বেশ কয়েকবছর আগে একটি ভারতীয় হাসির ছবিতে একটি দৃশ্য মনে পড়ে গেল। দৃশ্যটি হচ্ছে বহুল আলোচিত এক মামলায় আসামির ফাঁসীর হুকুম হয়েছে, যেহেতু মামলাটি বহুল আলোচিত, তাই ফাঁসীর ব্যাপারটি সমস্ত টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে এবং অনুষ্ঠানসত্ব মোটা অর্থে বিক্রি হয়েছে। অনুষ্ঠানের স্পনসরদের শর্ত হচ্ছে আসামি ফাঁসীর মঞ্চে যে পোশাকে ঊঠবেন তাতে তাদের লোগো থাকতে হবে। ফাঁসীর আসামি সেই শর্ত অনুযায়ী অসংখ্য কর্পোরেট লোগোতে সাজানো পোশাক পরে মঞ্চে উঠলেন। সেখানেই শেষ নয়, ফাঁসিতে ঝোলার আগে তাঁকে বিভিন্ন কর্পোরেট স্লোগানও দিতে হলো। যেহেতু হাসির ছবি, ফাঁসীর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি, তবে কর্পোরেট স্পনসরশীপের ব্যাপারটি যে কতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যেতে পারে, সেটা বেশ ভালোভাবেই দেখানো হয়েছে।
কর্পোরেট পয়সাতে পুলিশবক্স কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। পুলিশবক্সে কর্পোরেট লোগো থাকলে ভবিষ্যতে পুলিশের অস্ত্রেও কর্পোরেট লোগো থাকবে, এমনকি সানমারের সৌজন্যে ক্রসফায়ারও হয়ে যেতে পারে।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ৯ নভেম্বর ২০০৯ (৬:২৭ পূর্বাহ্ণ)
মোহাম্মদ মুনিম, ম্যানি ম্যানি থ্যাংক্স- আপনার যথার্থ আর কার্যকর মন্তব্য সত্যিই ভালো লাগল।
নুর নবী দুলাল - ১০ নভেম্বর ২০০৯ (৩:২২ পূর্বাহ্ণ)
জাহাঙ্গীর আমার মন্তব্যের কোন প্রতি উত্তর পেলাম না।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর - ১৩ নভেম্বর ২০০৯ (১১:৪৭ অপরাহ্ণ)
আপনার লেখাটির কেন উত্তর দিইনি? প্রথম কথা হচ্ছে, আপনার লেখাটি আমি ভিন্নভাবে উপভোগ করেছি, তা হচ্ছে, আপনি অতি মানবিক আর সরলভাবে এনজিও’র কার্যক্রমকে দেখেছেন। আমি বাস্তবতাকে অত সরলভাবে দেখতে পারি না। কিন্তু আপনার চমৎকার ঔদার্য আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, যার ফলে উত্তর দেয়া হয়নি। আরেকটা ক্ষীণ কারণ হচ্ছে, আমার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কটি সমকালেই চ্যাঞ্জ করতে বাধ্য হয়েছি।
স্বাধীনতার পরই হোক আর আজ-কালই হোক, এদের মূল কাজ হচ্ছে শোষণের চাকাকে লাগাতার সচল রাখা। আর এনজিওতে অনেক বাম-প্রগতিশীল ছেলে-মেয়েই কাজ করে। এতে এনজিও’রও সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে মেধাবাণিজ্য আর এই ধরনের ছেলে বা মেয়েদের একধরনের স্বভাবজাত সততাও তাদের কাজে লাগে।
কিছুকিছু এনজিও কৌশলগত কারণে ভালোত্বের ভাব নেয়, এতে এনজিও’র মৌলিক কর্মপদ্ধতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।