জোসে ফার্নান্দেজকে আমাদের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়-সংক্রান্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি তিনি। গত মে মাসের শেষদিকে বাংলাদেশ সফর করতে এসে এই ফার্নান্দেজ আমাদের জানিয়েছিলেন, দু দেশের মানে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। তবে তার ওই কথা বোধহয় অনেকের মনে তত দাগ কাটেনি। কেননা প্রায় একই সময় বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শেরম্যান -সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিলেন।
রাজনীতিবিষয়ক আর বাণিজ্যবিষয়ক দু জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রায় একই সময়ের সফরের মাত্র দু পক্ষের মাথায় গত ১৭ জুন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে টিকফার খসড়া চুক্তি অনুমোদন মিললেও এ দেশের গার্মেন্টস শিল্প জিএসপি সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, ফার্নান্দেজ শুধু ইঙ্গিত নয়, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করে গিয়েছেন। এখন কেঁদেকেট সাতকুল ভাসালেও বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় সেই ভাগ্যরেখা থেকে বেরিয়ে আসা। এক অর্থে,গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গত এক দশকের হিসেবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা তো আছেই-পাশাপাশি রয়েছে গত দু বছরেই এ বাণিজ্য ১১ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার রেকর্ড। এরকম প্রেক্ষাপট থাকার পরও ফার্নান্দেজ গত ২৬ মে ঢাকা চেম্বার আয়োজিত বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত ফোরামের বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক অধিবেশনের বক্তব্যে সম্পর্কজনিত জটিলতার কথা তুলেছিলেন। একই অধিবেশনে ঢাকা চেম্বারের পরিচালক মহিউদ্দিন মোনেম বলেছিলেন, ‘টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করা হলেই জিএসপি সুবিধা থাকবে-এরকম হলে চলবে না।’ নিশ্চয়ই মহিউদ্দিন মোনেমের বক্তব্যটি কথার কথা ছিল না। অনেকে মনে করেন, টিকফার সঙ্গে জিএসপি ইস্যুর কোনও সম্পর্ক নেই, ঠিক তেমনি সম্পর্ক নেই জিএসপির স্থগিতাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটন টাইমসে খালেদা জিয়ার অভিমত-নিবন্ধ লেখার। জিএসপি ইস্যুটি নিতান্তই শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং সে নিরিখেই গত সপ্তাহে বাংলাদেশে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বিষয়টি এরকম সহজ, সরল হলে ভালোই হতো। ‘বিশ্বে থাক সহজ সুখে, সরল আনন্দে’ রবীন্দ্রনাথ আমাদের এরকম পরামর্শই দিয়ে গেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’র মতোই সহজে কি সহজ থাকা সম্ভব? সহজে কি সব কিছু সহজ ভাবা সম্ভব?
আপাতদৃষ্টিতে এরকমই মনে হবে, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সামনে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যানের বিবৃতিতেও বলা হচ্ছে, তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং রানা প্লাজা ধ্বসে ১২শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য অত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারা বরং তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের মতো যে কোনো পরিস্থিতি অবশ্যই এড়াতে হবে, কেননা তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরণের বিরূপ প্রভাব পড়বে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরণের একটি সঙ্কট থেকে রক্ষা পেল, কেননা বাংলাদেশের উৎপাদিত মোট পোশাকের ৬০ শতাংশ, যার বাজার মূল্য ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি, প্রতি বছর কিনে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করেছে আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তা স্থগিত করেনি-এই বিপরীতমুখী অবস্থান কি কেবলই অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিবেচনা? কোনও রাজনৈতিক বিবেচনা কি কাজ করেনি এর পেছনে? জিএসপির স্থগিতাদেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সংসদের বাইরেও যে-আলোচনা হচ্ছে- কি প্রধানমন্ত্রী, কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীও যে আলোচনার অংশগ্রহণকারী- তার একটি রাজনৈতিক সংস্করণ আমাদের সামনে বেশ স্পষ্ট। এর সঙ্গে যদি আমরা যুক্ত করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নীতিও এক ধরণের রাজনীতির ফল, তা হলে এ সত্যও মানতে হয় যে, জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক বার্তাই দিচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ কোনও আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হয়নি, কেবল বলা হয়েছে, কারখানার কর্মপরিবেশকে উন্নত করতে হবে। ড্যান মজিনা এরকম স্বান্ত্বনাও দিয়েছেন যে, তারা এ সুবিধা বাতিল করেননি, স্থগিত করেছেন মাত্র। এই স্থগিতাদেশ যাতে উঠে যায় এবং আর কখনও এ ধরণের ঘটনা না ঘটে সে ধরণের পদক্ষেপ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও তাদের কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য শোনানো হয়নি, বরং গত ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের নিয়মিত বৈঠকে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে সংশোধিত শ্রম আইন-২০১৩ যাচাইবাছাইয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, কারখানার কর্মপরিবেশকে উন্নত করার প্রসঙ্গকে সরকার ও কারখানা মালিকরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন? বলতে কি পারি, এ নিয়ে দৃশ্যের অন্তরালে অদৃশ্য যে-রাজনীতি চলছে, তা থেকে আমরা দ্রুতই মুক্ত হবো? এরকম কোনও সম্ভাবনার চেয়ে বরং মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেশ কিছুদিন জিএসপি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে, এমনকি রাজনীতির মেরুকরণও ঘটবে। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের এক পর্যায়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যেকার বিতর্ক, তার আগেপরের বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতা সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের।
এটি খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়-২০১২ সালের প্রথমদিকে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা হয়েছিল। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যারা সামরিকতন্ত্র ও সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন, অন্তত তাদের কাছে ঘটনাটি ছিল নিঃসন্দেহে স্পর্শকাতর। একজন সামরিকজান্তার নেতৃত্বে বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হলেও দলটি পরবর্তী সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করায় বিএনপির কাছেও বিষয়টি স্পর্শকাতর হতে পারত। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান করার এ ব্যর্থ অপচেষ্টার এক বছর পার হতে না হতেই চলতি বছরের ২৪ মার্চ বগুড়ার এক জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশে কোনও বিশৃঙ্ক্ষলা হলে সেনাবাহিনী বসে থাকবে না। তারা সময়মতো কাজ করবে।’ অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই তার এ বক্তব্যকে দেখেছেন উস্কানি হিসেবে। তারও আগে ৩০ জানুয়ারিতে ওয়াশিংটনের একটি সংবাদপত্র ওয়াশিংটন টাইমসে খালেদা জিয়ার নামে এক অভিমত-নিবন্ধ ছাপা হয়। এতে লেখা হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ‘রক্ষার’ জন্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘হস্তক্ষেপ’ প্রত্যাশা করছেন। লেখা হলো, ‘শ্রমিক ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের পক্ষে যারা কথা বলেন,তাদের ওপর দমন-পীড়ন হওয়ায় জিএসপি সুবিধা বাতিলের হুমকি শেখ হাসিনা সরকারকে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।’ এ নিবন্ধ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তখন ওই নিবন্ধের সাফাই গেয়েছিলেন। বলেছিলেন, খালেদা জিয়া নিবন্ধে সঠিক তথ্য তুলে ধরেছেন বলেই আওয়ামী লীগ এতো সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে!
এখন অবশ্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ওই বক্তব্য অস্বীকার করছেন। আর শুধু মওদুদ আহমদ কেন, খালেদা জিয়াও অস্বীকার করছেন, জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে বলছেন, ‘কেউ কেউ বলে আমার নামে একটি লেখা বিদেশি পত্রিকায় প্রচারিত হয়েছে। আমি এমন কোনো লেখা পাঠাইনি।’ অথচ ওয়াশিংটন টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক ডেভিড এস জ্যাকসন জোর দিয়েই বলছেন, লেখাটি খালেদা জিয়াই লিখেছেন। লেখাটি তাদের দিয়েছেন মার্ক পার্সির মাধ্যমে এবং লেখা প্রকাশের আগে-পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে ওয়াশিংটন টাইমস। আর এই মার্ক পার্সি হলেন লন্ডনভিত্তিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বিটিপির অন্যতম অংশীদার। কানাডার বাংলা ভাষাভিত্তিক ওয়েবসাইট নতুন দেশ আবার এ-ও জানাচ্ছে, এ প্রতিষ্ঠানটির ক্লায়েন্টদের মধ্যে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রয়েছেন! যাই হোক, বিএনপির সব নেতাই এখন খালেদা জিয়ার স্বরে কথা বলছেন। সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের তারাই কাজী। তারাই বলেছেন, প্রয়োজনে খালেদা জিয়া এরকম নিবন্ধ ভবিষ্যতেও লিখবেন। আবার তারাই এখন বলছেন, খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। খালেদা জিয়া এবং তার পারিষদবর্গ হয়তো ভুলে গেছেন, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার সময় কী কথা বলেন, কী প্রতিজ্ঞা করেন। বলা চলে, প্রায় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস বাংলাদেশ ওই নিবন্ধটি নিয়ে উত্তপ্ত ছিল, তখন খালেদা জিয়ার কাছ থেকে আমরা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক কোনও কথা শুনিনি। বরং তার দলের উল্লেখযোগ্য নেতারা নিবন্ধটির পক্ষে কথা বলেছেন, যুক্তি দিয়ে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলছেন, ওই লেখা তার নয়! বলা হচ্ছে, বিএনপি জিএসপি সুবিধা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দেবে। আমরা কি ধরে নেব, যুক্তরাষ্ট্র সেই চিঠি পেয়ে জিএসপির ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেবে? নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমই’র সহ-সভাপতি মোঃ হাতেম বলেছেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকেন্দ্রিক কিছু এজেন্ডা রয়েছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্য থেকেই এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের ওপর চাপ দেয়া হচ্ছে। আরেকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। তা হলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে, টিকফার মতো ‘বাণিজ্যিক চুক্তির’ চেয়েও গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসের নেতৃত্ব এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুর মতো রাজনৈতিক ইস্যুগুলিই এ ক্ষেত্রে অনেক বড় হয়ে উঠেছিল?
এর আগে টিকফা নিয়ে কথাবার্তা চলার সময় ২০১২ সালে সেসময়ের পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসকে আমরা সাংবাদিকদের সামনে বলতে শুনেছি, ‘আপনি কাগজ নিয়ে এসে বললেন, আলোচনার সময় নেই। এটাতেই সই করতে হবে। এটা তো হতে পারে না।…টিকফা না হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না।’ তার এ কথা থেকেই অনুমান করা যায়, টিকফা নিয়ে বাংলাদেশ আসলে কতটা চাপের মধ্যে ছিল-এবং এখনও আছে। টিকফার যে-খসড়া চুক্তি বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যে সেটুকুতেই সন্তুষ্ট নয় তার আভাসও দিচ্ছে জিএসপি স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত।
চোখে পড়ার মতো ব্যাপার, এ সিদ্ধান্তের আগেপরে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিরোধী দলগুলির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ড. ইউনূস। ২৭ জুন বিএনপির খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদক পাওয়ায় তাকে দলের পক্ষ থেকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে ইউনূসের সঙ্গে সংহতিও প্রকাশ করেছেন। এর পরদিন ২৮ জুন বিশ্ব সামাজিক বাণিজ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস জানান, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের সব পদক্ষেপ বাতিলসহ গ্রামীণ ব্যাংককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবে।’ এরপর গত ১ জুলাই ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমেদ, লিবারেল ডেমোক্রাটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। এসব ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ ছিল একটাই, ‘গ্রামীণ ব্যাংককে ধ্বংসের পায়তারা প্রতিহত করা’। এসব তৎপরতার পাশাপাশি লক্ষ্যণীয় জিএসপি’র স্থগিতাদেশ প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের ভাষ্য। এ অবস্থার জন্যে তিনি কার্যত সরকারকেই দায়ী করেছেন এবং এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই সুবিধা পুনর্বহালের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই। কেননা, তিনি সরকারের কেউ নন! এর অর্থ পরিষ্কার,- যেখানে এ দেশের কলামিস্টরা তাদের কলামে, সাধারণ মানুষজন চিঠিপত্র কলামে চিঠি লিখে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়, সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি অথবা অনুরোধ জানায়, নিজের অভিমত ও অবস্থান জানায়, সেখানে এ দেশের নোবেলবিজয়ী, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদক পাওয়া মানুষটি জিএসপি পুনর্বহালের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ বা একটি বিবৃতি দিতেও প্রস্তুত নন। দুর্মুখেরা এ-ও বলতে পারেন, তিনি আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করতে বিব্রতবোধ করছেন!
যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশ প্রশ্নে যে অবস্থান নিয়েছে, তা কার্যত বাণিজ্য রাজনীতি এবং আমরা কতটুকু ছাড় দিচ্ছি কিংবা দিচ্ছি না, তার ওপর ওই রাজনীতি নির্ভর করে না। আমাদের মুখচেনা কলামিস্টরা ওবামা প্রশাসনের এই অবস্থান দেখে হায় হায় করতে পারেন, সরকারের চৈতন্যোদয়ের প্রত্যাশা করতে পারেন; কিন্তু গার্মেন্টসের কর্মপরিবেশ উন্নত করেও রাজনীতির ওই ছোবল থেকে আমরা বাঁচতে পারব না। তার মানে এই নয় যে, আমরা কর্মপরিবেশকে, গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের অধিকারহীন অবস্থানকে উপেক্ষা করছি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য রাজনীতিকেই বড় করে দেখছি। কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করা এবং শ্রম আইনের ক্ষেত্রে সংশোধন করা আমাদের জন্যে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গত মনে হচ্ছে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের একটি নিবন্ধের কথা- যেখানে তিনি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মানবিক জীবন ও উন্নত কর্মপরিবেশ দিতে ড. ইউনূসের একটি নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাসক্তভাবে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিদেশমুখিনতা ও ইউটোপিয় দিকগুলি তুলে ধরা হয়েছিল বলেই হয়তো ড. ইউনূস আর আলোচনাটি এগিয়ে নেননি; জিএসপি পুনর্বহালের ক্ষেত্রে যেমন তার ভূমিকা রাখার কোনও সুযোগ নেই, আলোচনাটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি উপসংহারে পৌঁছানোরও কোনও সুযোগ হয়তো তার ছিল না। যে-কথাটি বলা প্রয়োজন, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরে এবং সে অনুযায়ী বিকল্প অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়েই কেবল বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব, এর ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক বিপর্যয় থেকে নিজেকে রক্ষা করা-নতি স্বীকার করে নয়। টিকফার খসড়া চুক্তির অনুমোদন তো এক ধরণের নতি স্বীকারই করা-কিন্তু তারপরও কি আওয়ামী লীগ সরকার পেরেছে জিএসপি স্থগিতাদেশের বিপর্যয় থেকে গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষা করতে?
আপনারে এই জানা আমার ফুরাবে না…