সেনাবাহিনী বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা নিতে পারে- গত ২১ ডিসেম্বর এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ফরেন পলিসির অনলাইন সংস্করণে, জোসেফ অলচিনের ‘দ্য মিডলাইফ ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। অথচ ২০১২ সালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাই হলো, একটি সামরিক ক্যু-এর অপচেষ্টাকে নসাৎ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। ভবিষ্যতে সত্যিই কি এমন কিছু ঘটবে? বাংলাদেশের রাজনীতিকে যেসব ঘটনা, সংশয় ও গুঞ্জন অস্বচ্ছ করে রেখেছে, রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারে রেখেছে, সেসবের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন এই গুঞ্জনভিত্তিক প্রতিবেদন। আর সে প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছে ফরেন পলিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ দ্বি-মাসিক পত্রিকার ওয়েবসাইটে। এ রকম একটি নয়, অসংখ্য গুঞ্জন ও অপপ্রচার অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট করে রেখেছে আমাদের রাজনীতিকে। দিন আনি দিন খাই মানুষদের কাছে এখন তাই একটি বড় প্রশ্ন, আমাদের এ রাজনীতির গন্তব্য কোথায়? রাজনীতি নিঃসন্দেহে গতিশীল ও প্রবহমান, কিন্তু তার তো একটি গতিমুখ থাকে, লক্ষ্য থাকে। কিন্তু তেমন কিছু কি আছে চলমান রাজনীতির?
অনেক উত্তর দেয়া যাবে এই প্রশ্নের, কিন্তু পরক্ষণেই আমরা দেখতে পাব, সেসব উত্তরও প্রশ্ন হয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। এই রাজনীতি কি চায় আমাদের গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে? তা হলে সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হলেও এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কেন নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে জাতীয় সংসদকে? এই রাজনীতি কি চায় আমাদের জীবনযাপনের নিরাপত্তাব্যূহ তৈরি করতে? তা হলে কেন বিশ্বজিতের মতো জীবন ঝরে যায় রাজপথে? এই রাজনীতি কি চায় আমাদের ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা দিতে? সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠবে, আমাদের রাষ্ট্র কি আদৌ বোঝে ব্যক্তির স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা? আর আমরাইবা কতটুকু প্রস্তুত রয়েছি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ব্যক্তির ও বাকস্বাধীনতার অনুশীলন করতে? এই রাজনীতি কি চায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে? তা হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কেন এত সমালোচনা, কেনইবা এত ষড়যন্ত্র? এই রাজনীতি কি চায় সবার অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে? তা হলে কেন তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে, কর্মসূচিতে কোনো প্রতিফলন নেই সেসবের? প্রধান রাজনৈতিক কোনো দল একটি হরতালও কি করেছে খাদ্য সঙ্কট কিংবা দ্রব্যমূল্যের ক্রমবৃদ্ধি নিয়ে?
এ রকম অনেক প্রশ্নই আমরা করতে পারি। আর সেসবের উত্তরের জের ধরে আমাদের মনে দেখা দেয় আরো অজস্র প্রশ্ন। যদিও এক অর্থে বলতে গেলে, এসব প্রশ্ন এবং উত্তরও হয়তো অর্থহীন; কেননা যেসব রাজনৈতিক দল আমাদের জনগণের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছেন, রাজনীতিকে অস্বচ্ছ করে তুলেছেন, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের দিক থেকে কোনো অস্পষ্টতা নেই এক পক্ষ চাইছে রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে, আরেক পক্ষ চাইছে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য সরকারি দল বিচার বিভাগীয় রায়েরও দলীয়করণ ঘটিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। যেমন, বিচার বিভাগের রায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিপক্ষে গেলেও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ ব্যবস্থার উপযোগিতাকে বিবেচনায় এনে আরো দুটি টার্মের নির্বাচন এই সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে কেবল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বই বাড়েনি, ভুল বোঝাবুঝিই বাড়েনি, জনমানসের অনুভূতিও আঘাত পেয়েছে, জনগণ যে এ ধরনের সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুত নয়, সরকার তা এখনো অনুমান করতে পারছে না। সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে অব্যাহত রাখত, একদিকে জাতীয় সংসদকে কার্যকর রাখত, অন্যদিকে ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার পরিধি সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে সংসদ বহির্ভূত ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের ও শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, নারী সংগঠনসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনগুলোর মতপ্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্র তৈরি করে দিত, তা হলে জনগণের পক্ষ থেকেই রাজনৈতিক অবিশ্বাসের বহির্প্রকাশক এ ব্যবস্থাটি তুলে নেয়ার দাবি উঠে আসত। কিন্তু সরকারি দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তড়িঘড়ি করে একটি সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থাটির বিলোপ ঘটিয়েছে। অথচ বহাল রেখেছে এমন সব ব্যবস্থার, যা সংবিধান থেকে তুলে দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও সেই দাবির পক্ষে রয়েছে। এমন একটি দাবি হলো, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম আইন তুলে দেয়ার দাবি। সর্বোচ্চ আদালতের রায় খণ্ডিতভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের এই প্রবণতা সরকারকে গভীরতর রাজনৈতিক সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার রাজনৈতিক সহযোগী জামায়াত চাইছে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে। সাধারণভাবে এ চাওয়ায়ও কোনো দোষ নেই। কিন্তু মুশকিলটি হলো এখানেই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে তারা এমন কোনো কিছু কি করতে পারবে, যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায়, তারা আসলে জনগণের সঙ্গেই আছে? তারা কি পারবে বর্তমান সরকার শিক্ষানীতিতে যেসব সীমাবদ্ধতা রেখেছে, যেমন, প্রাথমিক পর্যায়েই একাধিক ধারার শিক্ষা, সেগুলোকে দূর করতে? পারবে কি মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে কিংবা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার ধারায় পরিবর্তন এনে চলতি সরকারের ব্যর্থতাকে ঢেকে দিতে? যে সরকারি নীতি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাকে উৎসাহিত করছে, সে রকম কৃষিবান্ধব নীতিগুলোকে তারা কি পারবে আরো জোরদার করে তুলতে? তারা কি পারবে যে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রতিবছর দেশে আসছে সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনমুখী ও কর্মসংস্থানমুখী ব্যয়খাতে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে? কিংবা পারবে কি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার শক্তিশালী উৎস গার্মেন্টস খাতকে শ্রমিকবান্ধব ও কর্মবান্ধব করে তুলতে? পারবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যাংক পরিচালনার পর্ষদ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সরিয়ে দিয়ে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনকল্যাণকামী মানুষগুলোকে ওইসব স্থানে অন্তর্ভুক্ত করতে? এ রকম অজস্র প্রশ্ন করা যায়, যেসবের উত্তর আমাদের কারোরই জানা নেই। তাদের এমন কোনো কর্মসূচি নেই, এমন কোনো অতীত নেই- যা থেকে আমরা তাদের সম্পর্কে সামান্যতম ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে পারি।
সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এই স্পষ্ট খেলাই জনগণের সামনে রাজনীতিকে অস্বচ্ছ করে তুলেছে- জোসেফ অলচিনদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল করার মতো রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করার পরিস্থিতি তৈরি করে দিচ্ছে। এবং আমাদের তাই চোখে পড়ছে না, কোনো ভালো খবর, বাংলাদেশের সুসংবাদগুলো। যেমন, গত ১৯ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক পত্রিকা গার্ডিয়ানের অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক ল্যারি এলিয়ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার। তিনি এ প্রতিবেদন লিখেছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সুপরিচিত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা প্রাইসওয়াটার হাউস কুপারসের (পিডব্লিউসি) একটি সমীক্ষার ভিত্তিতে। ওই সমীক্ষায় পৃথিবীর বিকাশমান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের এই ধারা যদি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে এবং সামষ্টিক অর্থনীতি ও মানবসম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিবর্তন করা যায় তা হলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব এমনকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতিকেও অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া। এ রকম আরো একটি সুসংবাদ আমাদের, যা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। চীন, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের পরেই অবস্থান আমাদের এই দেশের। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নগরায়ণের ফলে গত অর্ধশতাব্দীতে যে উন্নয়ন ঘটেছে, বাংলাদেশের স্থান সেগুলোর তালিকায় প্রথম দিকে। এসব প্রতিবেদনকে হাড়ে হাড়ে বিশ্বাস করতে হবে, আমরা সে রকম মনে করি না কিংবা এগুলো দেখে উচ্ছ্বসিত হতেও বলি না। তবে বোধকরি এটুকু বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনের রূপরেখা সুস্পষ্ট এবং আমাদের রাজনীতি স্বচ্ছ হলে, স্থিতিশীল হলে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুস্থির ও প্রাজ্ঞ হলে ওই অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া কোনো কঠিন ঘটনা নয়।
মুশকিল হলো, আমাদের রাজনীতি জনগণের কাছে কেবল অস্বচ্ছ ও অস্পষ্টই নয়, তারও বেশি কিছু। রাজনীতিবিরোধী শক্তি তো আছেই, রাজনৈতিক দলগুলোও রাজনীতিকে একদিকে ভীতিকর করে তুলেছেন, অন্যদিকে ভীতিকর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘আমি রাজনীতি করি না’ এ কথা বলার অর্থও এক ধরনের রাজনীতি করা এবং তা বলার মধ্য দিয়ে মূলত প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিকেই জিইয়ে রাখা হয়- কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এখন যে ধরনের খেলা খেলছে, তাতে প্রচলিত ব্যবস্থা জিইয়ে রাখার চেয়েও বড় ধরনের একটি সঙ্কট দেখা দিয়েছে- আর তা হলো, এমনকি প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমর্থক ব্যক্তিরাও এ রাজনীতিতে আর নিরাপদ বোধ করছেন না। তারাও শঙ্কিত, এ রাজনীতি তাদের কাছেও বিপজ্জনক খেলা, আগুন নিয়ে খেলা। এ রাজনীতি প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার সপক্ষে উচ্চকিত রাজনীতিকদেরও ভীত, সংশয়ী ও সন্দেহযুক্ত করে তুলেছে। সরকার যে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন না করার দিকে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে বিরোধী দল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার জন্য আন্দোলন করছে এই পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও বোধকরি রাজনীতিকদের ওই ভীতি, সংশয় আর সন্দেহেরই বহির্প্রকাশ।
এই পরিস্থিতি হয়তো জনগণের জন্য শাপে বর হয়ে উঠতে পারত, যদি এখানে যাকে বলা হয় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি, তেমন একটি কিছুর ক্রমবিকাশমানতা অব্যাহত থাকত। সরকার ও রাজনীতিবিজ্ঞান বলে, বুর্জোয়াদের এ ধরনের সঙ্কটকালীন অবস্থাই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও বিকাশের পথ তৈরি করে দেয়। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পথেও কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এখনো আমাদের চোখে পড়েনি। যারা জনগণকে এক সময় এ ধরনের বিকল্প শক্তির স্বপ্ন দেখাতেন, তাদের কাউকে কাউকে আজকাল আমরা মধ্যরাতের বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিভিন্ন টক শোতে দেখছি একেবারে বিপরীত মেরুর কথা বলতে — এরা এখন মনে করে জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক শক্তি, জামায়াত-শিবির কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হলে এরা ব্যথিত হন, যে ভাষায় তারা কথা বলেন তাতে জনগণের পদে পদে মনে হয়, জামায়াতে ইসলামীই বোধকরি পরস্পরবিরোধী সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি। তারাও যুদ্ধাপরাধীর বিচার চান, ‘তবে’ তারা মনে করেন এ বিচার ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের উদ্দেশ্যে’ করলে চলবে না- যার অর্থ হলো এই, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর খাতায় নাম লেখানো কোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা যাবে না, করলে তা ‘রাজনৈতিক দমননীতি’ হয়ে যাবে, ‘অস্বচ্ছ’ হয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ঈপ্সিত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে লাগসই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কার্যক্রম বেছে নিতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি রাজনৈতিক দল দলীয় প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করছে, রাষ্ট্র সম্পর্কে জনগণকে ভীত করে তুলছে এবং এভাবে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করছে; অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দলও অভিযোগমুক্ত নয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তারা জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করে রেখে রাজনৈতিক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, অযৌক্তিকভাবে রাজপথে আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ নিয়ম রক্ষার জন্য, নির্বাচন কমিশনের নিয়মরক্ষার জন্যে গত ২৯ ডিসেম্বর ঢিলেতালের একটি কাউন্সিল করেছে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অংশ হিসেবে যে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয় নি, এ কথা বলার জন্য কোনো তথ্যের বা তত্ত্বের দরকার নেই। এবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাই রয়েছেন — যদিও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তার অনেক আগেই উচিত ছিল দলীয় সাংগঠনিক পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। কিন্তু শেখ হাসিনা চার বছরেও সে রকম সিদ্ধান্তে যেতে পারেননি, এমনই তিনি কর্মীপ্রিয় নেতা। সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক দলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হওয়ার আগে বিভিন্ন জেলা ও থানা শাখার কাউন্সিল হওয়ার কথা- কিন্তু তেমন করতে গেলে বিভিন্ন স্থানের দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ হয়ে পড়বে, অতএব সে পথে আর পা বাড়ায়নি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। এমনকি কাউন্সিলে কোনও জেলা শাখাই সাংগঠনিক রিপোর্ট উপস্থাপন করতে পারে নি। হতাশ শেখ হাসিনা সাংগঠনিক রিপোর্ট চেয়ে কোনও প্রতিনিধিই তা জমা দিচ্ছে না দেখে, ‘আনেন নি? ঠিক আছে, একমাস পরে আমি একটা বর্ধিত সভা ডাকব, সেখানে জমা দিবেন’ বলে ক্ষান্তি দিয়েছেন। এই জোড়াতালির কাউন্সিল কি পারবে আওয়ামী লীগকে গতিশীল করে তুলতে? পারবে কি জনগণকে গণতন্ত্রের নির্দেশনা দিতে?
গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা জনগণের সামনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি সম্পর্কিত হতাশাকে আরও ঘনীভূত করেছে, তারা আসলে কী চায় সে সম্পর্কে প্রচুর অস্বচ্ছতা তৈরি করেছে। গত সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে মন্ত্রিসভার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছিল, মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন না হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম না কমলেও অন্তত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কিন্তু মানুষের সে প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। যেমন, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বরং জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, নতুন নতুন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, বিশেষ করে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর জনগণের প্রত্যাশার পূর্ণ মৃত্যু ঘটেছে। প্রবাদ আছে, ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা খ্যাদা’জনগণের অবস্থা এখন তাই, তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি চায় না, তারা চায় ছাত্রলীগের এ রকম দুর্বিনীত দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচতে যারা, যদিও বলা হচ্ছে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত, অথচ যাদের রক্ষা করার জন্য বিভ্রান্তিকর নানা কথা বলছেন বিভিন্ন মন্ত্রী। অনেকেই মনে করেছিলেন, সরকার হয়তো প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পকে বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবসম্মত পথে এগোবেন, ‘প্রয়োজনে নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে’ প্রধানমন্ত্রীর এ রকম বাগাড়ম্বরের পরও তাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতার পথ ধরে এগোতে দেখা গিয়েছিল সরকারকে। কিন্তু দুই আবুলকে ছাড় দেয়ার মধ্য দিয়ে পাশাপাশি প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু কীভাবে নির্মাণ করা হবে সে প্রসঙ্গে কোনো ভাষ্য না দিয়ে সরকার তার অবস্থানকে অস্বচ্ছ করে তুলেছে। সরকারি দল কি চায় অভিযুক্ত দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের রক্ষা করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে আরো খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে? দুর্নীতি উন্মোচনের নামে দুদককে সরকারের গায়ে লাগা দুর্গন্ধ দূর করার কাজে ব্যবহার করতে? হলমার্ক কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা হয়েছে এমন কয়েকজনকে যাদের রাজনৈতিক প্রোফাইল বেশ ভারী। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার তার রাজনীতি সম্পর্কে অস্বচ্ছতার সৃষ্টি করেছে জনমনে।
উল্টো দিকে, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির রাজনীতিতে দৃশ্যমান দ্বৈততা থেকেও ফুটে উঠেছে অস্বচ্ছতা। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এর মধ্যে ভারত সফর করেছেন, যে সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দেয়া কৌতূহল শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড এক কৌতুকে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা দেখছেন, খালেদা জিয়া ও বিএনপির পক্ষ থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য এমন সব প্রতিশ্রুতি ও আশাবাদের কথা জানিয়ে আসা হয়েছে, যা দলটির রাজনৈতিক আদর্শ ও ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আবার ভারত সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরে এসেই ১৮ দলীয় ঐক্যজোটের ব্যানারে বিএনপি এমন কিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করেছে, যা একদিকে ওই সফরকে তাৎপর্যহীন করে তুলেছে, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জাগ্রত দেশবাসীকে হতবাক ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদলীয় বিভিন্ন নেতা এমন সব কথা বলেছেন এবং সেসব কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও এমন কথা বলেছেন, যা কুবাণী চিরন্তনী অভিধানে ঠাঁই পাওয়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া ভারত গিয়েছিলেন ‘তেল মারতে’। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ কথার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, ‘প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জবাব দেয়া আমার মুখে শোভা পায় না। আমার বন্ধু সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী থাকলে ভালো জবাব দিতে পারতেন।’ আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যে কত রকম বিনোদন দিতে পারেন, এসব উক্তি তারই প্রমাণ। এই বিনোদন আরও চরমে উঠেছে এখন সর্পউপাখ্যানের বদৌলতে।
রাজনীতিকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তারা জাতীয় সংসদকে কার্যকর করে তুলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার কাজ ত্বরান্বিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানে যে ধরনের পরিবর্তন এনেছে, তা শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কাও তৈরি করেছে। কেননা, সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পরও চলতি সংসদ কার্যকর থাকবে। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র চর্চার কথা বললেও তা যে অস্বচ্ছ, এই বিধান তার একটি উদাহরণ। আরও একটি উদাহরণ হলো, নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীকে নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণার বিধান অনুমোদনের অপচেষ্টা। এমন নয়, জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা সুস্পষ্ট। বছরের পর বছর ধরে তারা সংসদ বর্জন করছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংসদ প্রতিনিধিরা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে দিল্লিতে পার্লামেন্টারি ডায়ালগে অংশ নিতে গিয়েছিলেন এ ধরনের সফর বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও সংসদ অধিবেশনকে তারা বর্জন করে আসছে। দিল্লিতে ওই সময় মওদুদ আহমদকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনার দলের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে, তাহলে সংসদে যাচ্ছেন না কেন? উত্তরে তিনি তখন জানিয়েছিলেন, সংসদে যাওয়ার বিষয়টি বিএনপি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। কিন্তু এখনও সেই সক্রিয়তার কোনো নমুনা আমরা দেখতে পাইনি। ওই সময় মওদুদ আহমদ এ কথাও বলেছিলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী জোট হলেও দল দুটির মধ্যে আদর্শগত কোনো ঐক্যই নেই। জামায়াত একা নির্বাচন করলে দু’তিনটির বেশি আসন পাবে না।’ কিন্তু এর কয়েকদিন পরই জামায়াতে ইসলামী আহূত যুদ্ধাপরাধী বিচারবিরোধী হরতালে নৈতিক সমর্থন দিয়ে বিএনপি প্রমাণ করে, দলটির সঙ্গে তাদের আদর্শগত ঐক্য কত গভীর! আবার এ কাজ করে বিএনপি এত সমালোচিত হয় যে, কয়েকদিন পর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা দেয়- বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে বিএনপি ওই অনুষ্ঠানে আর জামায়াতে ইসলামীকে আমন্ত্রণ জানায়নি। তবে ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে খালেদা জিয়া যখন বলেন, ‘মানচিত্র পাল্টে দেয়ার চক্রান্ত চলছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক থাকতে হবে’, কিংবা বলেন, ‘কারো আধিপত্য মানব না…দেশ রক্ষায় এবার আরেকটি সংগ্রাম করতে হবে’ তখন শ্রোতাদের বা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বুঝতে সমস্যা হয় না, নৈতিকভাবে অদৃশ্য জামায়াতে ইসলামী বিএনপির ওই সংবর্ধনামঞ্চেই অবস্থান করছে। একই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয়মঞ্চে বক্তব্য দিতে গিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল ভারত কোনোদিনও তাদের সমর্থন দেবে না। এটা শুধু আমার কথা নয়। এটা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, যা আমি আপনাদের জানিয়ে দিলাম।’ এভাবে খালেদা জিয়ার ভারত সফর যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সরকারি দল আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা ও অস্পষ্টতা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতার কারণে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর অবস্থা নব্বইয়ের আন্দোলনের পর থেকেই নাজুক। কিন্তু জনগণের নিত্যদিনের এবং রাজনীতির মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে এদের সাম্প্রতিক সাংগঠনিক কার্যক্রম রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে তাদের সাংগঠনিক শক্তির কারণে নয়, বরং তাদের উত্থাপিত দাবি দাওয়াগুলোতে মানুষ যেভাবে সাড়া দিয়েছে সেসবের নিরিখে। বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর আহূত হরতাল সফল হওয়ার বাস্তব কোনো কারণ নেই, তাদের সেই সাংগঠনিক ভিত্তিও নেই; কিন্তু তারপরও তাদের আহূত গত ১৮ ডিসেম্বরের হরতাল কেবল সফল হয়নি, বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। মধ্যরাতের বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ, যারা আবার এককালে বামদর্শনে আপ্লুত ছিলেন, কিন্তু এখন যারা জামায়াতে ইসলামীকেও গণতান্ত্রিক শক্তির মর্যাদা দিচ্ছেন, তারা ওইদিনই এ হরতালকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। তাদের সমালোচনার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো, বাম দল এ হরতালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সুনির্দিষ্টভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছে। বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর এই হরতালে সরকারেরও মৌন সমর্থন ছিল বলে তারা মনে করে। এসব বলার মধ্য দিয়ে তারা এ হরতালের স্পিরিটটিকে ভিন্নমুখী করতে চাইছেন, এ হরতালে যে গার্মেন্টস ও পরিবহন শ্রমিকদের একটি শক্তিশালী ভূমিকা ছিল, তারা যে আগাম সমর্থন দিয়ে এ হরতালকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে কিংবা এ হরতালে যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদেরও যে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল এবং তেল-গ্যাস ও খনিজ-প্রাকৃতিক সম্পদকে জাতীয় স্বার্থে ব্যবহারের দাবিতে আন্দোলনকারীদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, তা আড়াল করার অপচেষ্টাই করেছেন। এই হরতালকে কেবল সরকারের নিরিখ থেকেই নয়, জনগণের নিরিখ থেকেও দেখতে হবে- এই বিষয়টি তারা পাশ কাটিয়ে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে কার্যক্রম চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেও এই হরতাল গুরুত্বপূর্ণ- কেননা তা মার্কিন দূতাবাসকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, এ দেশের ব্যাপক জনগণ ধর্মীয় রাজনীতিকে গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কিন্তু মধ্যরাতের বুদ্ধিজীবীরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ অবস্থান নিয়ে, বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনীতিকেই অস্বচ্ছ করে তুলছেন। গত ৩০ ডিসেম্বর বামদের কর্মসূচিতে পুলিশের হামলা, নির্যাতন ও রাবার বুলেট নিক্ষেপের ঘটনার মধ্যে দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মধ্যরাতের বুদ্ধিজীবীদের বামরাজনীতিক ও সরকারের সমঝোতাসংক্রান্ত ধারণা কত বিভ্রান্তিকর।
রাজনীতি অস্বচ্ছ হয়ে পড়েছে, আর তার জন্য দায়ী আমাদের রাজনীতিকরাই, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই। এখন জনগণের সামনে তাদেরই তা স্বচ্ছ করতে হবে। আমাদের এই দেশটি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে সামরিক শাসনের দিকে এগিয়ে যাবে, যেমনটি বলা হয়েছে ফরেন পলিসির অনলাইনে জোসেফ অলচিনের নিবন্ধে? নাকি রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র-রাজনীতি ও আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে, জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে দেশটিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়েও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাবেন, যেমন আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রতিবেদনে? রাজনীতিকদেরই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- জনগণের সামনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। জনগণ চায় রাজনীতিতে স্বচ্ছতা দেখতে, কেননা রাজনৈতিক স্বচ্ছতাই পারে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
১ comment
মাসুদ করিম - ২ জানুয়ারি ২০১৩ (৬:৫২ অপরাহ্ণ)
আমার কাছে অবশ্য এই রাজনীতিকে অস্বচ্ছের চেয়ে অক্ষমতার মনে হয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো অক্ষম হয়ে পড়েছে। ছোট বড় সব দল এক ধরনের স্থবিরতায় ভুগছে। কোনো একটা পরিকল্পনা বা দাবিকে দলগুলো রাজনৈতিকভাবে উপস্থাপনের অনবরত ব্যর্থতায় বিরক্তি উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে আর কখনো কোনো রাজনৈতিক দল নিকট ভবিষ্যতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে মনে হয় না। অথচ, এরকম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়ার ‘অল আউট’ প্রচেষ্টায় এখনো ব্যর্থ। সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত উদাহরণ হতেই বরং আওয়ামী লীগের আগ্রহ বেশি।
অস্বচ্ছতা অবশ্য আমি দেখতে পাচ্ছি সেনাপ্রশাসনে। বাংলাদেশে এই বলয়টি সবসময়েই অস্বচ্ছ থাকে। কারণ এদের সম্বন্ধে কোনো কিছুই ঠিকঠাক জানা যায় না। আবার এরাই বাংলাদেশের অঘোষিত সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল। এদের দিকেই তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সংগঠন ‘সুশীল সমাজ’। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়ার জন্য সর্বস্ব নিয়ে নামার মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ এই বলয়ের দূর্গে সবচেয়ে বড় আঘাতটি হানতে পারত — যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়াটাই একমাত্র রক্ষাকবচ নয়, সেনাবাহিনী ও এর লেজুড় ‘সুশীল সমাজ’কে অরাজনৈতিক করতে আরো অনেক পদক্ষেপের দরকার কিন্তু সেটাই শুরু হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়ার মাধ্যমে।