সংক্ষেপে, ঘটনাগুলো এভাবে ঘটেছে। গত বছর ১৩ই মার্চ ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষে খুন হয় রাবি-শিবিরের জি-এস শরীফুজ্জামান নোমানী। তখন রাবি’র বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ও জামাত নেতা অধ্যাপক আবুল হাশেম কয়েকশ’ শিবির-সদস্যকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন ‘‘লাশের বদলে লাশ’’(‘‘অধ্যাপক’’ বটে!)। এরই জের ধরে ৮ই ফেব্রুয়ারী ২০১০-এ ভয়াবহ তাণ্ডবে শিবিরের দল খুন করেছে লীগকর্মী ফারুক হোসেনকে আর হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে আরো চারজনের। এবং এরই জের ধরে দেশজুড়ে শিবিরের মিছিল-মিটিং অফিস ও বাড়ীঘরের ওপরে সরকারের নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার অসংখ্য, আরো খুন, দেশে বয়ে যাচ্ছে সংঘাতের ঝড়। রাজশাহী-শিবিরের একাংশ ‘‘সেভ শিবির’’ নামে জামাতের আমীর নিজামীর কাছে দাবী করেছে, কেন্দ্রীয় নেতা প্রাক্তন মন্ত্রী মুজাহিদী ও রাবি’র প্রাক্তন শিবির সভাপতিত্রয় রফিকুল, বুলবুল ও রেজাউলই রাবি’র খুনের জন্য দায়ী। তারা সরকারের কাছেও দাবী করেছে সাধারণ শিবির-সদস্যদের ওপর অত্যাচার না করে ওই চারজনের মোবাইল জব্দ করে তদন্ত করতে।
আমরাও শিবির উচ্ছেদ চাই কিন্তু প্রতিপক্ষের সাময়িক পরাজয়ে উল্লাসের মতো কৈশোর-অ্যাডভেঞ্চারিজম্ এটা নয়, এটা হল একটা ধর্মভীরু জাতির ধীর ও বহুমাত্রিক ধর্মীয়-সামাজিক বিবর্তন। গ্রেপ্তারকৃত প্রায় সবাই ছাড়া পাবেই এবং শিগগীরই ছাড়া পাবে। এ সরকারও চিরদিন থাকবে না। তাহলে লাভ কি হল? এ সংঘর্ষের দুটো দিক খেয়াল করা দরকার। প্রথমতঃ, দেশে হরহামেশা খুন হয়, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের হাতেও হয়নি এমন নয় কিন্তু শিবিরের খুনের সাথে সেসবের আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। সন্ত্রাসী ছাত্রদল-ছাত্রলীগেরা মনে মনে ঠিকই জানে ওরা ক্রাইম করছে, পুলিশী বা আইনি শক্তিতে সেটা পরাস্ত করা সম্ভব। কিন্তু শিবিরের ড্রাইভিং ফোর্স হল ধর্মবিশ্বাস – ওদের উদ্দেশ্যসাধনের পথে যে কোনো বাধাকে যে কোনভাবে অপসারিত করা ওদের ইবাদত। তাই ওদের সন্ত্রাসকে ওরা ক্রাইম বলে মনেই করে না। এই ভয়ংকর মানসিকতাকে শুধুমাত্র দৈহিক শক্তিপ্রয়োগে উচ্ছেদ করা যায় না। দ্বিতিয়তঃ, যতদিন জামাত থাকবে ততদিন শিবির থাকবে এবং জামাত থাকবে ততদিন, যতদিন ইসলামের শান্িতময় ব্যাখ্যা দিয়ে মওদুদিবাদকে পরাজিত না যায়। জামাতের অপতত্ত্বের বিরুদ্ধে আইন ও পুলিশী শক্তিপ্রয়োগ দরকার হতে পারে কিন্তু তার আগে যদি ওদের অধর্মতত্ত্বকে পরাজিত না করা হয় তাহলে ওরা সাময়িক পরাজিত হলেও বারবার ফিরে আসবে।
শিবিরেরা বয়সে তরুণ। ওদের বিশ্বাস ওরা সেবা করছে ইসলামের, দেশ ও জাতির। কিন্তু ওরা জানেনা ওদের পথে চলে অন্যান্য জাতির কি সর্বনাশ হয়েছে। ওরা জানেনা জামাতি বইপত্রগুলো কোরাণ-রসুল-মানবতা-নারী ও ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে কি ভয়াবহ ঠকবাজীতে ভরা, জানেনা কিভাবে অতিত-বর্তমানের মৌদুদি গং কোরাণ-রসুলের অপব্যখ্যা করেছে, কিভাবে ইসলামের ওই বিকৃত ও বিক্রীত রূপ প্ল্যান করে ওদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দলিল-প্রমাণ দিয়ে এসব না জানানো পর্য্যন্ত নুতন নুতন শিবির হতেই থাকবে। ছাত্রলীগের সবাই যেমন ধোয়া তুলসিপাতা নয় তেমনি ওদেরও সবাই হিংস্র নয়, খুনী নয়। সাধারণভাবে ওদের সবাইকে হ্যানস্থা করলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী। শক্তির পেছনে দর্শন না থাকলে সেটা অপশক্তিতে পরিণত হয়। ওরা শিবির হয় কেন সেই ধর্মীয়-সামাজিক মেকানিজম উপেক্ষা করে কোনদিনই এগোন যাবে না।
আমার সঙ্গে থাকুন।
আমাকে সঙ্গে রাখুন।
১৩ ফেব্রুয়ারী ৪০ মুক্তিসন (২০১০)
হাসান মাহমুদ
শারিয়া আইন বিষয়ক তথ্যচিত্র, নাটক ও গ্রন্থের রচয়িতা। উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেস; রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, হল্যান্ড; সদস্য, আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশন; ক্যানাডা প্রতিনিধি, ফ্রি মুসলিম্স্ কোয়ালিশন; প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল’, মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস।
Have your say
You must be logged in to post a comment.
৬ comments
মুক্তাঙ্গন - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৩:১৩ পূর্বাহ্ণ)
সাম্প্রতিক বিচারে বহুল আলোচিত এবং জনগুরুত্বমূলক ইস্যুগুলোর একটি বিবেচনায় এই লেখাটি রিপোস্ট হওয়া সত্বেও প্রযোজ্য নীতির ব্যতিক্রমের আওতায় মুক্তাঙ্গনে পূনঃপ্রকাশ করা হল।
ধন্যবাদ।
শামীম আহমেদ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৭:২৭ অপরাহ্ণ)
আপনাদের নীতি বোঝা সত্যই দুস্কর।
মাসুদ করিম - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৪:১৩ পূর্বাহ্ণ)
আমি অনেক শিবির ক্যাডার ও কর্মীদের দেখেছি, মনে হয়নি ‘ওদের উদ্দেশ্যসাধনের পথে যে কোনো বাধাকে যে কোনভাবে অপসারিত করা ওদের ইবাদত’, ইবাদতের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। ছাত্রদল-ছাত্রলীগ যেজন্য ক্রাইম করে শিবির ঠিক একই কারণে ক্রাইম করে — ক্যাম্পাসে ক্ষমতা দখল ও আয়ত্ব ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে জঙ্গীদের যতটুকু সম্পর্ক আছে, শিবিরের জামাতের তাও নেই। শিবির-জামাত হল হৃদয়হীন মধ্যবিত্তদের দল, ইসলাম ওদের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
আজ পর্যন্ত কোনো শিবির কর্মী ক্যাডার দেখে আমার মনে হয়নি, ওরা অবুঝ তরুণ-তরুণী। যারা শিবির করে তারা সম্পূর্ণ সজ্ঞানে করে এবং সম্পূর্ণ সজ্ঞানে অন্যদের ওপর নির্যাতন করে। জামাত-শিবির শুধুমাত্র ক্ষমতা নিয়েই ভাবে। আর কোনো কিছু নিয়ে তাদের ভাবনা আছে এমন আমি কখনো দেখিনি।
এই রগকাটা -কিরিচ-চায়নিজ কুড়াল বাহিনী আর কিছুই নয়, এরা ইয়াজিদ, এদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো উচিত নয়।
যেখানে সরকারের খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে সাধারণ ছাত্ররা যেন পুলিশের খাঁচায় বন্দি ও অত্যাচারিত না হয়। জামাত-শিবির দলনে আমাদের কারো কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়।
রায়হান রশিদ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (৫:২৫ পূর্বাহ্ণ)
এক সহ-ব্লগারের কল্যাণে এই নতুন ব্লগ-সাইটটির খবর পেলাম, যেখানে ছাত্র শিবির এর কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। এখানে দেখুন। ব্লগ-সাইটটির ভূমিকায় লেখা রয়েছে:
হাসান মাহমুদ - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ)
মাসুদ করিম,
জামাত-শিবিরের প্রতি সহানুভুতির প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের কামড় খেতে হয় এটা ইতিহাসেরই শিক্ষা। মিসরে, আলজিরিয়ায়, টার্কি ইত্যাদি দেশেও সরকারী শক্তিপ্রয়োগে ওদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা হয়েছইল। ফলে কি হয়েছে? কোনই লাভ হয়নি – ভিন্ন নামে-রূপে আবার ফিরে এসেছে ওরা। কারণ কোরাণ-রসুল-মানবতার সাথে ওদের ধর্মবিশ্বাস কোথায় কোথায় কতটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে দলিলগুলো সম্পর্কে জাতিকে সচেতন করা হয়নি। যেসব দেশে তা হয়েছে সেখানে পুলিশী শক্তির দরকার হয়নি, জনগণই ওদের উচ্ছেদ করেছে যেমন তাতারস্থান ইত্যাদি। এই উদাহরণ থেকে কি আমরা কোনই শিক্ষা নেব না ?
আমাদের সমস্যাসংকুল ষড়যন্ত্রময় গরীব দেশ – কোন সরকারই বেশীদিন ক্ষমতায় থাকবে না। আবার ওরা ক্ষমতায় এলে যে হিংস্রতা করবে তা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সেজন্যই, ব্যাপারটা যখন শুরু হয়েছে তখন এখনই ওদের উচ্ছেদ করা গত যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী দরকার। অথচ সরকারের পদক্ষেপ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী – এ ব্যাপারে সরকারের দিকনির্দেশনা, চুড়ান্ত লক্ষ্য এবং সেখানে পৌঁছবার রোডম্যাপ নেই। ফলে আমাদের যতই ইচ্ছে হোক, যা-ই আমরা বলি না কেন শিবিরের ওপর কিছুদিন অত্যাচার হবে, এর বেশী কিছুই নয়।
মোহাম্মদ মুনিম - ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ (১১:১৮ অপরাহ্ণ)
মিশরে, আলজিরিয়াতে ইসলামী দলগুলোকে নিষিদ্ধ এবং নানাবিধ নির্যাতনের কারণে দলগুলো আন্ডারগ্রাঊন্ডে গিয়ে সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও জামাতকে নিষিদ্ধ করলে তারাও এ রাস্তা নিবে। যেহেতু তাদের ব্যাপক আর্থিক সামর্থ্য আছে, সন্ত্রাসবাদী (চাইনিজ কুড়ালের নয়, আত্বঘাতি বোমা জাতীয় সন্ত্রাস) দলে পরিণত হওয়া তাদের জন্য কঠিন কিছু হবে না।
তবে বাংলাদেশে এখন যে ধরপাকড় হচ্ছে, সেটা এমন কিছু extreme ব্যাপার নয়, বাংলাদেশের মুলধারার প্রতিটি দল এই জাতীয় ধরপাকড় খেয়ে অভ্যস্ত। দু তিনটা খুন হওয়ার পর এটুকু “fallout” যদি না হয়, তবে লোকে ভাববে সরকারী দল দুর্বল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় না এই ধরপাকড়কে মিশরের বা আলজিরিয়ার পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে ‘চিন্তিত’ হওয়া উচিত।